ভূপাল চক্রবর্তী

দুপুরের জন্য উঁচিয়ে থাকে বদ্যিনাথ। ভাতটুকু কোনোরকমে মুখে দিয়েই সোজা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। কখনও বিড়ি ধরিয়ে ফোঁক ফোঁক টানে, দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার খুঁচিয়ে বার করে খানিক চিবোয়, না পারলে দাঁতের ভেতর জিভ লাগিয়ে ছুঁচো ডাকার মতো শব্দ করে। একবার একবার গিয়ে বসে সামনের রকে। ভেতরটা ছটফটায়। মাঝেমধ্যে ঝুঁকে তাকায় সড়কের দিকে। সোজা গেছে রাস্তা। দূরে লোকজন দু-একটা দেখা গেলেই শরীর ঝাঁকিয়ে দু-হাতে পাছার ধুলো ঝেড়ে তড়াক করে টান হয়ে দাঁড়ায়। ঠাহর করে যদি দেখে, যাকে খুঁজছে সে নয়; তো আবার খানিক পায়চারি। এই করতে করতে একসময় দু-পা এগিয়ে নিজেই বিড়বিড় করে বলে, ওই, ওই আসছে শ্যামসুন্দর!

দূরে একটা ছোটোখাটো চেহারার মানুষ দেখা যায়। খাঁখাঁ দুপুরে শেষ ফাগুনের ভাপ ওঠা গরমে রাস্তায় তখন দুটি মাত্র মানুষ। শ্যামসুন্দর আর বদ্যিনাথ। 

দুটোর আশেপাশে দু-দশ মিনিটের আগে পরে এ-মুখো রাস্তায় দেখা দেয় শ্যামসুন্দর। নদীর ঘাট অবধি সোজা রাস্তা, ঘাটের ওপর রাস্তার বাঁ-দিকে লাইব্রেরি। বদ্যিনাথ মুখে কিছু বলে না, শ্যামসুন্দরকে দেখে তার অস্থিরতা বাড়ে। কান খাড়া করে, ঘাড় শক্ত করে ঋজু কায়দায় নেড়ি কুকুরের মতো সে টান হয়ে দাঁড়ায়। তাকে পাশ কাটিয়ে যায় কী করে শ্যামসুন্দর! সে কাছে আসতেই ল্যাজ নাড়তে নাড়তে কুঁই কুঁই শব্দ করে যেন এগিয়ে আসে। নিজের মধ্যেই কথার বুড়বুড়ি কাটতে কাটতে সে পিছু নেয় চেনা মানুষটার।

দুপুরের ভাপে সেদ্ধ হবার অবস্থা শ্যামসুন্দরের। মুখে দুটি ভাত গুঁজে এতটা পথ ছুটে আসতে তার শরীরে ধকল হয়। কথা কইতে মন চায় না। শীত চলেই গেল। নদীর এই ঘাট চত্বরের খোলা পরিবেশে ঘাপটি মেরে থাকা গরম হাওয়া হঠাৎ হঠাৎ বাড়তি তেজ নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছোটে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। এটাই পরে লু হবে। শ্যামসুন্দর ভেবে পায় না বদ্যিনাথের এত ফুর্তি আসে কোত্থেকে। পরনে একটা চেক লুঙ্গি, পাছার জায়গাটা চিট নোংরায় ধুসর। গায়ে এখনও শীতের মোটা ফুলহাতা জামা, কনুই-এর কাছে কালো চাবড়া ছাপ। মুখে দু-তিন দিনের না কামানো দাড়ি, মাথায় শনের মতো সাদা চুল। শ্যামসুন্দর একবার আড় চোখে দেখে নিয়ে নিজের মতো হাঁটা দেয়। কখন থেকে অপেক্ষা করে কে জানে! লাইব্রেরির তালাটা খুলতে যেটুকু সময় লাগে। গেট ফাঁক করতেই সুড়ুৎ করে গলে যায় নেড়ি কুকুরের মতো। ঢুকেই পশ্চিমের বারান্দায় জানলার নীচে পাতা বেঞ্চিতে সে-ই যে বসবে আর উঠবে না। উঠবে সে-ই সন্ধ্যের পর, জানালার ওপারে তখন ঘন অন্ধকার।  

কালকের প্রশ্নটা স্মরণে আছে শ্যামসুন্দর? কিছু একটা সুর বিড়োচ্ছিল গুনগুন করে, সেটা থামিয়ে বেঞ্চি থেকে যেন লাফ দিয়ে শ্যামসুন্দরের পথ আগলে দাঁড়িয়ে কথাটা কয় । শ্যামসুন্দর ঠান্ডা মাথার মানুষ। রুমালে ঘাম মুছতে মুছতে বলে, সে তুমি বলবে তবে! তোমার কোনো প্রশ্ন জমা রাখার হিম্মৎ আছে আমার? চলো ভেতরে ঠান্ডায় একটু বসো। তারপর কথা হবেখন। তার আগে গাছটা একবার ভালো করে দেখতে হয় যে বদ্যিদা। বদ্যিনাথ ঘাড় কাত করে শোনে এবং পরক্ষণেই আবার সুর বিড়োয়।

‘কালবোশেখের ঘূর্ণিঝড়ে/ হিজল বনে অন্ধকারে।’ 

গানটা শ্যামসুন্দরের শোনা। কথা বলে কম, চোখ বুজিয়ে গুনগুন করে এই কয়েকটা কলি সে কদিন ধরেই গায় আর জানালার বাইরে নদীর পাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। সে দিকে তাকালে শুধুই ঝোপঝাড়। মাঝখানে একটাই গাছ, একমাথা ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওইটেই হিজল গাছ।  বদ্যিনাথ তাকে আগের দিন প্রশ্ন করেছিল হিজল গাছে কবে ফল ধরে। শ্যামসুন্দর ঠিক তাক করতে পারে না বদ্যিনাথের ভাবগতিক। প্রতিদিন ভেতরে এসে দু-দন্ড চেয়ারে বসে একটু দম নিয়ে তারপর কাজে হাত দেয় শ্যামসুন্দর। একা হাতে তাকে এই লাইব্রেরির সব কাজ সামলাতে হয়। বদ্যিনাথ জুড়ে যাবার পর থেকে তার অসুবিধের চেয়ে সুবিধেই বেশি হয়েছে। হাতে এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া, মেম্বারদের বই দেওয়া নেওয়া করা। অবান্তর বকবক করে ঠিকই। তবে মানুষটা ভালো। শ্যামসুন্দর মাস গেলে ক’টা টাকাও দেয় হাতে।

বিশ্রামের কথা ভুলে আজ শ্যামসুন্দর বদ্যিনাথের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ বুজে সে নিমগ্ন হয়ে গান গাইছে। শ্যামসুন্দরের দৃষ্টি বাঁধা পড়েছে দূরের গাছে।

ওই যে দামড়া গাছটা জটিবুড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে-ওই হল হিজল। আমি যৌবন ফোটার আগে থেকে দেখছি আর তুমি এতকাল চাকরি করছ এখানে-তুমি দেখলে না! গান থামিয়ে বদ্যিনাথ বলে, শ্যামসুন্দরকে।  

দেখেছি বটে আগে, তবে তুমি বলার পর ভালো করে দেখছি। চশমা নাকের একটু ওপরে তুলে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে শ্যামসুন্দর। 

বদ্যিনাথ শ্যামসুন্দরকে বড় ভরসা করে। এই ক’দিনে সে-ই ভরসা আরও বেড়েছে। বয়স কম, কিন্তু বেড়ে জ্ঞান! লাইব্রেরির বড়কত্তা। বদ্যিনাথ মুখ্যুর ডিম। বইয়ের ধারেকাছে কোনোদিন গেল না। দু-পয়সা রোজগারের লোভে মিলে চাকরি করতে লেগেছিল লেখাপড়া শিকেয় তুলে। তবে হ্যাঁ,  বইপত্তর ঘাঁটা মানুষ হলে কী হয়, দেমাক নেই এতটুকু। বদ্যিনাথকে খুব সম্মান করে ছেলেটা। দাদা  বলে ডাকে। পাড়ায় তাকে কেউ পাত্তা দেয় না, এতটুকু সম্মান করে না। বলে, খোজা বদ্যি। একবার  ঝুটমুট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল। গঙ্গার ঘাটে মেয়েছেলেরা চান করতে লেগেছে। বদ্যিনাথ ঠায় বসেছিল হিজল গাছের দিকে তাকিয়ে। ব্যস্, পাড়ার মস্তান নাচু আচমকা পেছনে থেকে এসে লাথি কষিয়ে দিল, শালা এখানে ভদ্দরলোকের পাড়ায় রাসলীলা করতে লেগেছিস! চল্ ফোট এখান থেকে। ফের যদি দেখি তো শালা একদম খোজা করে ছেড়ে দেবো। বদ্যিনাথ মুখ বুজে উঠে এসেছিল ঘাট থেকে। সে-ই থেকে ওর নাম হয়ে গেল-খোজা বদ্যি। পাড়ায় সবাই জানে। এতকাল আসছে যাচ্ছে, শ্যামসুন্দর জানে না? সবই জানে। প্রকৃত ভদ্দরলোক সে। বদ্যিদা ছাড়া কথা নেই মুখে। কোনদিন অসম্মান করে না।   

তা কী জানলে বলো দেখি? বদ্যিনাথ হাসতে হাসতে তাকায়।    

শ্যামসুন্দর বলে, বোশেখ-জোষ্টি মাসে ফল হয়। বিষ ফল। খেলে ভেদবমি হয়ে মানুষ মরে। কিন্তু তোমার এত কিছু জেনে কী লাভ? 

শ্যামসুন্দরের মশকরা বৈদ্যনাথ বোঝে। সে শুধু খ্যা খ্যা করে হাসে। বিষ যে হবে সেটা আমি আন্দাজে টের পেয়েছি। ওই গাছ-ওই চরের যম। জানো শ্যামসুন্দর, এক্কেরে যম।

 যম? কীরকম শুনি। 

বুঝলে না? বদ্যিনাথ হাসে। ও তোমার বুঝে কাজ নেই। ঠিকই বলেছ, বোশেখ-জোষ্ঠি মাসে লম্বা লম্বা ছড়া নামে। তাতে গুটিগুটি সবুজ ফল ধরে। আবার সে-ই ফল পাকলে লাল হয়ে গাছ ভরে থাকে। তখন দেখেছ সে গাছকে? এবার চোখ রেখো, দেখবে, এক্কেরে যুবতী মেয়ের মতো; মাথায় লাল সবুজ ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা। গলায় পুঁতির মালা। আঃ, এবারে তোমায় দেখাব।  

শ্যামসুন্দর ভ্রূ কোঁচকায়, যুবতী? বুড়ি গাছ তো! বলো বুড়ি রাক্ষুসি!   

বদ্যিনাথ মুখে চুকচুক শব্দ করে, আহা, আমি বলছি আমার যৌবনের কথা। সে-ই ছবিটা চোখে লেগে আছে যে! লাল-সবুজ ফিতেয় বাঁধা চুল, গলায় লাল-সবুজ পুঁতির মালা, ছিপছিপে হিজল সুন্দরী!

বদ্যিনাথ নিজের কথার গভীরেই হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। শ্যামসুন্দর জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার মনে পড়ছে চর্যাপদের গুঞ্জফুলের মালা পড়া একটি মেয়ের ছবি। 

বদ্যিনাথকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নিঃশব্দে চেয়ারে গিয়ে বসে। যেতে যেতে শোনে, বদ্যিনাথ আপন-মনে বলছে; আমিই তো! আমিই দেখেছি। সেদিন কী প্রকাণ্ড ঝড়, কী বৃষ্টি! লোডশেডিং হল।   

শ্যমসুন্দরের মনে কেমন যেন একটা ঘোর লাগছে ইদানীং। বদ্যিনাথের আচরণ তাকেও যেন মোহিত করে রেখেছে। একটা বুনো গাছের জন্য এমন কৌতূহল তার কোনোদিন ছিল না। হিজল সুন্দরীর ধীরে ধীরে সেজে ওঠা দেখার জন্য সে-যেন বদ্যিনাথের মতোই অস্থির হয়ে উঠেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক একবার চোখ ঘুরিয়ে গাছটাকে দেখে শ্যামসুন্দর। চেয়ারে হেলান দিয়ে একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল সে, ফাগুন-চোত-বোশেখ। মাস তিনেকের মধ্যেই সেজে উঠবে গাছটা! 

২.

চোত-বোশেখের মাঝামঝি হবে বোধহয়। কিংবা বোশেখের শেষ। বদ্যিনাথ ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল।  উলুঝুলু। ছাউনির নীচে ভাপের অসহ্য গরম হাওয়া ঘুরছে। তখনই চোখ গেছিল গাছটার দিকে। ডুমো ডুমো ফলে গাছটা ভরে গিয়েছে। মাথা থেকে কোমড় অবধি বাহার। অবাক লাগে বদ্যিনাথের। রোদ যেন কাকে খাই কাকে খাই করছে। চারপাশের গাছপালার ঝোপ নেতিয়ে আছে তাপে। কেবল চিকন শোভা নিয়ে ঢঙি মেয়েছেলের মতো  দাঁড়িয়ে রঙ্গ করছে গাছটা! দুলে দুলে নাচছে। বদ্যিনাথের গোঁফের রেখা দেওয়া কাঁচা বয়স। গাছটাকে দেখে যেন আশ মেটে না তার। বড়ো তাপ  লাগে গরমে। সারাক্ষণ ঘাটে বসেই কেটে যায় সময়। কেউ তাকে ডাকেও না। আর ডাকার আছেটাই বা কে? টি এন পাল রোডে শুয়োরের খোঁয়াড়ের পাশে গুমটি। বাপের ছিল শুয়োরের ব্যবসা। মা কোনকালে টিবি রোগে ওপরে চলে গেছে। বাপটাও মা চলে যাবার পর ব্যবসায় ঢিলে দিলে। সে-ও বছর ঘুরতে না ঘুরতে সটকে গেল। এখন গুমটিঘরটা তার জন্য হাওদা হয়ে থাকে। বদ্যিনাথ মিলে কাজ করতে লেগেছিল। এ হেন চালচুলোর খবর রাখে কে। একবেলা আধবেলা যেমন-তেমন খেয়ে কাটিয়ে দেয়। রাত ভিন্ন ঘরে ফেরা নেই তার।

তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়ি ধরায় বদ্যিনাথ। খানিক ঝিমুনি আসে। ছাউনির চাতালে চিত হয়ে গড়ায়। হিজলের ডালপালায় ছিনাল পানা নাচ। তার ঘুম এল।  

মেঘের ডাকে ঘুম ভাঙে বদ্যিনাথের। কালো চাঁই বাঁধা মেঘ ভুষোকালির মতো লেপে রয়েছে আকাশে। তেমনি হাওয়া ছুটছে শনশন করে। ঠান্ডা হাওয়ায় ফুর্তি জাগে তার। শরীর জুড়িয়ে আসে। চোখ যায় হিজলের দিকে। ঝড়ের সাথে মাথা দুলিয়ে সে আহ্লাদে মেতেছে। রুদ্রাক্ষের মালার মতো ছড়ার ডুমো ফলের ঝালর দুলছে গলায়। বদ্যিনাথ ভাবে, শালার হিজল ভৈরবী হয়ে গেল নাকি! অবস্থা দেখে সে একাই হাসে। ছুটে যায় গাছটার কাছে। মানুষ চলা একটা পথ আছে। বর্ষাকালে পথ ঢেকে যায় বাদাবনে আবার গরমে ফুটে ওঠে। ইচ্ছে করে গাছটার তলায় বসতে। এলোপাতাড়ি ঝাপটা দিচ্ছে হাওয়া। বদ্যিনাথ বসতে গেলে গুঁড়িটা পিঠে হালকা ঠেলা দিচ্ছে। শরীর তাতে দুলে উঠছে। খেপি ভৈরবী বুঝি বদ্যিনাথের গায়ে ঢলে পড়তে চায়। মনে মনে হাসে সে, বেশ লাগছে দুলুনি; ঢলানি খেপি তাকে নিয়ে নাচছে। 

ওই এল বৃষ্টি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বদ্যিনাথ দেখে, বড়ো বড়ো দু-খানা ফোঁটা পড়ল! তারপর পাতায় ফরফর শব্দ তুলে হাপুস নেমে এল জল। শব্দটা অন্যরকম। তার গুমটিঘরের চালে চড়বড় করে ডাকে এই একই বৃষ্টি। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। নদীর শরীরটা ঝাপসা হয়ে গেল! হিজলকে সে বলে, নাচ, আরও নাচ মাগি। বদ্যিনাথেরও নাচতে মন চায়।  

পাড়ের মাঠ বরাবর ঝাপসা ঘোলা রং। আয় আয় বলে একা একাই গলা ছাড়ে বদ্যিনাথ,- তেপান্তরের মাঠের পরে দেখা হয়েছিল..গান থামায় বদ্যিনাথ। কে যেন এদিকে ছুটে আসছে! ঝাপসা রঙে ধোয়া ছবি স্পষ্ট বোঝা যায় না। বদ্যিনাথ ভালো করে তাকাবার জন্য ডান হাতটা কপালের ওপর ছাউনি করে। হ্যাঁ, ওই তো আসছে। এদিক পানে। বুকটা ধরাস করে ওঠে। মেয়েমানুষ তো! ঠিক বিশ্বাস যায় না বদ্যিনাথ। আর একটু স্পষ্ট হলে তার ভ্রম কাটে। এ তো সত্যিই মেয়েমানুষ! ভরদুপুরের আঁধারে শুনেছে সে, শ্যাওড়া গাছের পেত্নি নামে। এই ঝড় বাদলে কোথাও সে দাঁড়াবে নাকি তাকে দেখা দিয়েই ভুস করে মিলিয়ে যাবে। তার এই হিজল ছাড়া আর তো কাছেপিটে কোনো ছাউনি নেই! বদ্যিনাথের ভয় করে। যদি এখানেই আসে! যদি ঘাড় মটকায়! 

জলে ভিজলে মুত পায়। নাকি তার ভয়ে মুত পাচ্ছে। মেয়েমানুষটা এগিয়ে এসেছে। তাকে বোধহয় দেখেওছে। মুত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে সে জড়ভরতের মতো। মেয়েটি তারই দিকে এগিয়ে আসে। বদ্যিনাথ দেখে, গলায় লাল-সবুজ পুঁতির মালা, মাথায় লাল ফিতে। তফাত করতে পারে না সে। একবার হিজলের দিকে চায় একবার মেয়েমানুষের দিকে। বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হয়। মেয়েটা ঝোপঝাড়ের ভেতর বুনো শুয়োরের মতো একবার অদৃশ্য হয়ে ফের ভেসে উঠল একেবারে বদ্যিনাথের সুমুখে। হিজলের মতোই তার গা বেয়ে, এলোচুল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। গলায় ঝুলছে পুঁতির মালা। হুবহু হিজলের ফলের মতো। গাছে-মানুষে এত মিল হয় নাকি! এলোমেলো ভিজে  পোশাকে শরীর এগিয়ে এসেছে পোশাকের আগে। বদ্যিনাথ দেখে ঘনঘন শ্বাসে মালাটা উঁচু বুকের পাহাড়ে উঠছে নামছে। হিজল গাছই যেন তার সামনে কালভৈরবী সেজে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে প্রলয় লেগেছে। বদ্যিনাথের যেন ভর হয় আচমকা।

বড়ো সাধ হয়। মরণের সাধ। ভুতে পাওয়া বদ্যিনাথ মেয়েছেলের বুকের পাহাড় থেকে নামিয়ে আনতে চায় পুঁতির মালা! তাকে জাপটে ধরে তার বুকের মালায় হেঁচকা টান দিল সে। ছড়িয়ে গেল পুঁতির মালা। মাগো! বলে বদ্যিনাথের বাঁধন ছাড়িয়ে সে যত সরে যেতে চায় বদ্যিনাথের নাগপাশে সে তত আটকে পড়ে। 

এই প্রথম বদ্যিনাথ ছুঁয়ে দেখল মেয়েমানুষের শরীর। কাছে টেনে নিয়ে তাকে শুধিয়েছিল, তোর নাম কী হিজল? সে কোনো উত্তর দেয়নি। চারদিক কালো করে আবার নতুন করে বৃষ্টি নেমেছিল। সাপের মুখ ছিঁড়ে যাওয়া বৃষ্টি। 

৩.

গুমটিঘরে থাকে বদ্যিনাথ। শুয়োরের চিৎকার আর তীব্র কটু গন্ধের অভ্যস্ত জীবনে নিজেকেও মাঝে মাঝে শুয়োর বলেই মনে হয় তার। শুধু যখন মুখ আর পা বেঁধে শুয়োরগুলোকে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের আকাশ ফাটানো চিৎকার সহ্য করতে পারে না বদ্যিনাথ। চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দ করে। এই একইরকম শব্দ করেছিল সেদিন, বৃষ্টির দিনে হিজল। এ-সময়ে বদ্যিনাথ গুমটি ছেড়ে বেড়িয়ে পরে। দেখে, ছাড়া শুয়োরের দল চিৎকার শুনে দিশাহারা হয়ে দৌড়োচ্ছে। হিজলের জন্য তার মনে একটা কষ্ট জমা আছে। সেইটে যেন এলোমেলো ছুটে যাওয়া শুয়োরের মতো তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁকপাঁক করছে। দম আটকে আসে তার। রাক্ষুসি হিজলের দিকে তাকালে তার মাথায় খুন চাপে যেন। সে তাকে ছারখার করে দিলে!   

চোত-বোশেখের আর কত দেরি, এসেই গেল প্রায়, কী বলো শ্যামসুন্দর? জানলার থেকে মুখ ঘুরিয়ে বদ্যিনাথ তাকায় শ্যামসুন্দরের দিকে। 

শ্যামসুন্দর চোখ নাবিয়ে রেখেই বলে, কেন? চোত-বোশেখ এলে কী হবে?

বদ্যিনাথ যেন কানেই নেয় না তার কথা। সে অন্য কথা বলতে চায় শ্যামসুন্দরকে। বলে, আমায় তুমি বদ্যিদা ডাকো। কিন্তু একেনে আমার একখানা নাম আছে, জানো?

কই, না-তো! 

ঠিকই জানো তুমি। আমাকে নুকোচ্ছ। আমাকে সবাই বলে খোজা বদ্যি। 

চুপ করে থাকে শ্যামসুন্দর।

আমি কিন্তু খোজা নয়, জানো? ওই গাছটা জানে। 

শ্যামসুন্দর চুপ করে থাকে। প্রসঙ্গ পালটাবার অছিলা খোঁজে। বদ্যিনাথ খানিক চুপ থেকে আবার কথা পারে।

সেবার ঝড়জলের দুপুরে আমার বিকার হল। তখন কিছুই বুঝিনি। ওই রাক্ষুসি গাছটার মতোই একটা  মেয়েমানুষ। কিছুই বুঝতে পারিনি। বুঝলে শ্যামসুন্দর, কিচ্ছুটি না। বাবু কোয়ার্টারের তরু। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসে দাঁড়াল হিজল গাছের তলে, আমার পাশে। এক্কেরে হিজলের মতো পুঁতির মালা, মাথায় ফিতে। আমি বুঝতেই পারিনি। তারে আষ্টপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছি। বড়ো পাপ লেগেছে। সে-ই জল ঝড়ে ওই গাছটা আমায় জাদুটোনা করেছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তরু যে…।

বদ্যিনাথ হাঁপায়। যেন সে ঘোরের মধ্যে থেকে, বিকারের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এসেছে এইমাত্র! শ্যামসুন্দর তাকে আশ্বস্ত করে, বলে, এসব কথা এখন থাক। তোমার কোনো দোষ নেই। তাছাড়া সে তো অনেকদিনের কথা! আমায় বলেছ অনেকবার। 

বদ্যিনাথ থামে না। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, বোশেখ আসতে কত আর দেরি! এবারে আর ছাড়ান নেই রাক্ষুসির। বড়ো পাপ লেগেছে। আমি তরুরে চিনতে পারিনি। পুলিশ আমায় ধরেছিল। কিন্তু শাস্তি হলনা। আমায় ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, তুই তো খোজা বদ্যি। আর কে কে ছিল নাম বল। সত্যি কথাই বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমি আর হিজল ছিলাম, আর কেউ না। পুলিশ হিজলকে অনেক খুঁজল। তারপর ধামাচাপা পড়ে গেল। আমি কিন্তু ছাড়ব না, এই তোমায় বলে রাখলাম শ্যামসুন্দর।   

৪.

গুমটিঘরে খাটিয়ার নীচে তার বাপের সম্পত্তি একটি চপার। সেটাকে সে শান দেয় আর গুনগুন করে গায়, কালবোশেখের ঘূর্ণিঝড়ে / হিজল বনে অন্ধকারে…। মেঘ ভেঙে রোদ উঠলে চকচক করে শান দেওয়া ধারালো ফলা। ফলার কিনার বরাবর আঙুল ছুঁইয়ে বদ্যিনাথ হাসে।  

চৈত্রমাসের শেষদিক। দুপুরের আলো ম্লান করে দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস এল। বদ্যিনাথকে যেন ডাক দিয়ে গেল সেই বাতাস। মেঘের ঘন কালো মূর্তি দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল আর দেরি নেই। চপারটা নিয়ে হিজল গাছের তলায় গিয়ে বসেছিল শান্ত হয়ে। ঠান্ডা হাওয়া ছুটছে উদভ্রান্তের মতো।  বদ্যিনাথ লক্ষ করে হিজল গাছটা পাগলের মতো পুঁতির মালা দুলিয়ে নাচতে লেগেছে। সে-ই আদিম নাচ। সে-ই  আদিম ছিনালপানা নাচ। বদ্যিনাথ মনে মনে বিড়োয়, চপারটা গাছের দিকে তুলে বলে, এই দ্যাখ, আজ তোরও মুক্তি আমারও মুক্তি।  

খানিক বাদে বৃষ্টি নামে। এলোপাথাড়ি হাওয়া আর বৃষ্টির তোড়ে বদ্যিনাথের চোখের ওপর থেকে উধাও হয়ে যায় জগৎ-সংসার। তার মনে হয় যেন সে আর হিজল গাছটা ছাড়া দুনিয়ায় কেউ নেই আর। ঝুপ করে আলো চলে গেল!  

বদ্যিনাথের জ্ঞান নেই যেন। সে দিগ্‌ বিদিক শূন্য হয়ে চপারের ঘা দিচ্ছে হিজলের কোমড় লক্ষ্য করে। ঝড়ের দাপটে আর কোপের চোটে থরথর করে কেঁপে উঠছে হিজলের ভরন্ত শরীর। রুদ্রাক্ষের  মালার মতো ভৈরবীর গলায় দুলছে অলৌকিক মালা। রাগে ফুঁসছে যেন সে! এই বুঝি রাক্ষুসির মতো নেমে আসতে চায় বদ্যিনাথের বুকে।  

ক্লান্ত লাগে তার। কাছে দূরে ছড়িয়ে যাওয়া লাল ফল কুড়িয়ে নিয়ে মুখে দিয়ে চিবোতে থাকে সে। এবার তার ভেদবমি হবে। সব উগড়ে দেবে সে!

গাছটা মড়মড় করে ঝুঁকে গেল! বদ্যিনাথ বলল, আয় আয় হিজল, আমার বুকে আয়-সে-ই সেদিনের মতো। দ্যাখ, আমি খোজা নই রে হিজল, খোজা নই! গাছটা বদ্যিনাথের দিকে হেলে পড়তে পড়তে সে দেখতে পেল আবছা আলোয় দূরে একটা মেয়েমানুষ ছুটে আসছে। গলায় তার লাল-সবুজ পুঁতির মালা।    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *