অনিল ঘোষ

গুণময় ফৌজদারের সন্ধান পাওয়া যে রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার, গাছপুরে না এলে বুঝতেই পারত না শৌভিক। সে ভাগ্য না মানলেও এ ব্যাপারে অস্বীকার করতে পারছে না। যে মানুষটার সন্ধানে প্রায় দু-বছর আদাজল খেয়ে লেগেছিল একটু দেখা ও কথা বলার জন্য, তাকে কিছুতেই ধরে-ছুঁয়ে পাচ্ছিল না। মানুষটা যেন হাউইয়ের এক নবতম সংস্করণ। এই শুনল ফৌজদার আছে বরুণহাটে, তড়িঘড়ি গিয়ে দেখল, নেই। শুনল, সে গেছে রামপুরে। সেখানে গিয়ে শুনল, ফৌজদার সকালেই চলে গেছে বেলেঘাটায়। প্রায় চরকির মতো ঘুরিয়েছে শৌভিককে। এক মুহূর্তের জন্যও তার দেখা পায়নি। সে শুনেছে, ফৌজদার বাসে-ট্রেনে চড়ে না, রিক্সা-সাইকেল ওঠে না। স্রেফ পায়ে হেঁটে এই মহকুমার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। এমন একটি চরিত্র সংবাদ মাধ্যমে যথেষ্ট মূল্যবান। মানুষটাকে ছাড়া যায় না কিছুতেই।

   ফৌজদারের সন্ধান দিয়েছিল আলমগীর। দু-বছর আগে যখন ইটভাটা নিয়ে স্টোরি লেখর কাজে এই আলমগীর খুব সাহায্য করেছিল। সে নিজে ভাটার লেবার সাপ্লায়ার। খোঁজখবর ভালোই রাখে। গত পরশু ফোনে বলেছিল, নিশ্চিন্তে চলে আসুন, দেখা করতে পারবেন।

   শৌভিকের বিশ্বাস হয়নি। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেছিল, দুর, গিয়ে শুনব পাখি হাওয়া। 

   আলমগীর হেসে বলেছিল, পাখি এবার খাঁচায় আটকা পড়েছে। 

   — মানে!

   — আসুন না, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।

   আলমগীরের কথায় ভরসা হয়নি। গ্রামাঞ্চলের লোকের সব ব্যাপারে একটু বাড়িয়ে বলা অভ্যেস। আঞ্চলিক সংবাদদাতা হিসেবে শৌভিকের এই অভিজ্ঞতা বহুদিনের। কিন্তু গতকাল নানা কাজের ফাঁকে আলমগীরের কথাগুলো বারবার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল মনের মধ্যে। দেখাই যাক না কী হয়। সকাল সকাল তাই  বেরিয়ে পড়েছিল শৌভিক।

   দু-বছর আগে ইটভাটা নিয়ে স্টোরি করার সময় গুণময় ফৌজদারের কথা জেনেছিল শৌভিক। দেখত, ইছামতী-বিদাধরী দুই নদীর পাড় জুড়ে ইটভাটাগুলোতে কংক্রিটের উঁচু উঁচু চিমনি থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। দৈত্যাকার চিমনিগুলো কারা তৈরি করছে, কীভাবে তৈরি হচ্ছে– এসব ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে আজমল খানের নাম জেনেছিল। সে একজন কনট্রাকটর। সে-ই এইসব অঞ্চলের ভাটাগুলোর চিমনি গড়ার কন্ট্রাক্ট নিয়েছে। তবে মূল কাজটা করছে গুণময় ফৌজদার। আজমল খানের কাছে শুনেছিল ফৌজদার লোকটা খুবই গুণী মানুষ। খুব দ্রুত কাজ করতে পারে। তাছাড়া চিমনির মাথা তৈরি করতে গেলে যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন। সেকাজে ফৌজদার অসাধারণ। তখন থেকেই ফৌজদারের খোঁজখবর নিচ্ছিল শৌভিক। তা ছাড়া ওই পায়ে হাঁটার ব্যাপারেও কৌতূহল জেগেছিল খুব। কিন্তু লোকটাকে পেলে তো! আলমগীর বলেছিল, ওই লোকটার পায়ের তলায় নির্ঘাত সর্ষে আছে। লোকটাকে কেউ কখনও এক জায়গায় দাঁড়াতে দেখেনি। সবসময় ছুটছে। জিজ্ঞেস করলে জবাব দিয়েছে, আমাদের দাঁড়াতে নেই। 

   সেই থেকে গুণময় নামের লোকটার পিছনে পড়ে রয়েছে শৌভিক। একটা ভালো স্টোরির গন্ধ পেয়েছে সে। আঞ্চলিক সংবাদদাতা হিসেবে এমন চমকপ্রদ খবর অনেক করেছে, তবে এই ফৌজদারের স্টোরি সব থেকে আলাদা হবে বলে ওর বিশ্বাস।

   গাছপুরের মোড়ে চায়ের দোকানে বসে ছিল আলমগীর। শৌভিকের জন্যই অপেক্ষা করছিল বোধহয়। সে বাস থেকে নামতেই বলল, চা-টা খেয়ে নেবেন নাকি দাদা?

   শৌভিক মাথা নাড়িয়ে বলল, আরে না-না, আগে চলুন।

   — ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আপনি যার সন্ধানে এসেছেন, তিনিই এখন আপনার সন্ধান করছেন। 

   — মানে!

   — নিজেই দেখবেন চলুন।

   — কতক্ষণ থাকবেন?

   — বোধহয় বাকি জীবন।

   — একটু ঝেড়ে কাশুন তো।

   — আরে দাদা, চিমনির মাথা থেকে পড়লে কি চলার ক্ষমতা থাকে! বলে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো বাইকে উঠে শৌভিককে ইশারা করল পিছনে বসতে। শৌভিক জিজ্ঞেস করল, কদ্দুর?

   আলমগীর বলল, বেশিদূর না। ওই যে গাঙপাড়ে নতুন ভাটা দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে। 

   শৌভিক দেখল, ইটফেলা রাস্তাটা নেমে গেছে ইছামতী নদীর দিকে। নদীর পাড়ে সদ্যগঠিত ভাটার প্রায়-সমাপ্ত চিমনি বাঁশের খাঁচা দিয়ে ঘেরা। বোঝা যায় ভাটা এখনও চালু হয়নি। ওটা হবে বর্ষার পর। এখন সবে আষাঢ়। 

   বাইক চালাতে চালাতে আলমগীর নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, ভাবুন একবার, ওই উঁচু থেকে পড়লে কেউ বাঁচে! আশ্চর্য জান লোকটার। দিব্যি বেঁচে আছে। এমনিতে নড়তে চড়তে পারছে না, তবু মুখে বলে যাচ্ছে, আমায় যেতে হবে। কোথায় যাবে! পা তো ভেঙে চৌচির। বলে নিজের রসিকতায় হাসল আলমগীর। 

   মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভাটার কুলিঘরের সামনে বাইক দাঁড় করাল আলমগীর। ইটের গাঁথনি করা ইংরেজি এল প্যার্টানের একচালা ধরনের অনেকগুলো ঘর পরপর দাঁড়িয়ে। ইটের দেওয়াল, মাথায় টিনের চাল। ঘরগুলো এখন ফাঁকা। ইটের মরশুম শুরু হলে এসব ঘর কুলি-কামিন-পাতাই-বেলদারদের কোলাহলে ভরে যাবে। 

   আলমগীর বাইক থেকে নেমে বলল, আসুন।

   শৌভিক আলমগীরের পিছু পিছু একটা ঘরে ঢুকল। নতুন তৈরি বলে ঘরটা ঝকঝক করছে। পুবের জানলা দিয়ে আলো আসছে। শৌভিক দেখল মেঝেতে পাতা বিছানায় শোওয়া একজন প্রৌঢ় লোক। ঊর্ধ্বাঙ্গ খালি। খুব রোগা। শরীরের হাড়গোড় স্পষ্ট। পরনে লুঙ্গি। কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ব্যান্ডেজ। বারবার চেষ্টা করছেন নড়ার, পারছেন না।

   আলমগীর শৌভিকের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আপনার ফৌজদার।

   শৌভিক বলল, এভাবে রেখেছেন কেন! এ তো হসপিটাল কেস।

   — আরে থাকলে তো! ব্যান্ডেজটা কোনও রকমে হয়েছে। এক্সরে করাতে পারিনি। ওনার ধারণা, কারা ওনাকে ধরিয়ে দেবে। হাসপাতালে কিছুতেই থাকলেন না। এমন ছেলেমানুষের মতো কান্নাকাটি জুড়লেন যে, বাধ্য হলাম নিয়ে আসতে। এখানেই ডাক্তার দেখছেন। বলে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু যা বলেছেন, ইন্টারনাল হেমারেজ। অবস্থা সুবিধের নয়, যে-কোনও দিন–।

   শৌভিক দেখল, ফৌজদার মানুষটা চিত হয়ে শুয়ে, হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করা। ঠোঁটজোড়া নড়েই যাচ্ছে অবিরাম। বিড়বিড় করে কী বলছেন, বোঝা যাচ্ছে না। 

   শৌভিক আলমগীরকে জিজ্ঞাসা করল, কী বলছেন উনি?

   আলমগীর হেসে বলল, ওই একটাই কথা, আমায় ছেড়ে দিন, আটকে রাখবেন না। ওরা ধরিয়ে দেবে।

   — ওরা কারা?

   — কি জানি! বলে ইশারায় আলমগীর নিজের মাথায় টোকা মেরে বলল, গেছে। অতবড়ো চোট, ঘিলু সব ঘেঁটে ঘ।

   শৌভিক আলমগীরের কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলল, উনি পারবেন কথা বলতে?

   — দেখুন চেষ্টা করে। গতকাল আপনার কথা শুনে বললেন এখনই ডাকুন–। বলে আলমগীর বিছানার কাছে উবু হয়ে বসে জোর গলায় বলল, ও ফৌজদারবাবু, শুনছেন?

   গুণময় ফৌজদারের চোখদুটো খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। প্রায় কান্নার সুরে বললেন, আমায় ধরে রেখেছেন কেন? ছেড়ে দিন। এভাবে আটকে থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। 

   শৌভিক আলমগীরের কাঁধ ছুঁয়ে জানাল, সে নিজে কথা বলতে চায়। আলমগীর ফৌজদারকে বলল, এই নিন আপনার সাংবাদিক, যার খোঁজ করছিলেন। আপনি এনাকে সব বলুন। 

   ফৌজদার মানুষটা শোওয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। ব্যথাটা বোধহয় চাগাড় দিয়ে উঠল। কালো মুখটা বিকৃত হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। আবার শুয়ে পড়লেন। মানে বাধ্য হলেন। বোঝা যাচ্ছে উনি অস্থির হয়ে পড়েছেন। শৌভিকের দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইছেন। শৌভিক মেঝেতে বসে পড়ে নিবৃত্ত করে ওনাকে। গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, আপনি এমন করছেন কেন? যাবেন তো বটেই। আপনাকে কেউ আটকে রাখেনি। সুস্থ হয়ে উঠুন। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব যেখানে যেতে চান। 

   ফৌজদার শোওয়া অবস্থায় শৌভিকের হাতদুটো সজোরে আঁকড়ে ধরলেন। শৌভিক টের পেল উনি কাঁপছেন ঠকঠক করে। সেই অবস্থায় বললেন, আপনি কে জানি না।

   শৌভিক ওনার হাতে চাপ দিয়ে বলল, আমায় আপনার বন্ধু ভাবতে পারেন। 

   — চারদিকে শত্রু, বন্ধু কোথায়!

   — আমি শত্রু নই। নিশ্চিন্ত থাকুন। 

   ফৌজদার খুব নিশ্চিন্ত হলেন বলে মনে হল না। শৌভিক বলল, আপনি বাড়িতে কোনও খবর দিতে চান, আমি দিচ্ছি। বলে সে পকেট থেকে মোবাইল বার করে বলল, নম্বর বলুন।

   ফৌজদার বলল, অচেনা নম্বর ধরবে না। 

   — আপনার মোবাইল দিন, আমি ধরিয়ে দিচ্ছি।

   পাশ থেকে আলমগীর বলল, আরে ওনার সেই মান্ধাতা আমলের টেপা মোবাইল। চিমনির মাথা থেকে পড়ার সময় ভেঙেচুরে ছত্রাখান হয়ে গেছে। সিমকার্ডটাও ধুলোবালির মধ্যে পাওয়া যায়নি। এদিকে উনি কিছুই বলছেন না। কী করি বলুন তো এই সাংঘাতিক ইনজিওরড লোক নিয়ে।

   শৌভিক বলল, আমি দেখছি। 

   — ঠিক আছে, আপনারা কথাবার্তা বলুন। আমি একটু ঘুরে আসি। কিছু দরকার লাগলে বাইরে রাজু নামে একটা ছেলে আছে, ডাকলেই পেয়ে যাবেন। 

   শৌভিক মাথা নাড়তেই আলমগীর বেরিয়ে গেল। একটু পরে ওর বাইকের আওয়াজ মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। তখনই শৌভিক শুনল, গেছে?

   স্পষ্ট আওয়াজ। কোনও জড়তা নেই। শৌভিক অবাক হয়ে দেখল, ফৌজদার মানুষটা ওর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে। চাপা গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিন। আপনাকে কিছু কথা বলার আছে।

   শৌভিক ওঁর কথামতো দরজা বন্ধ করে দিল, কিন্তু মনের মধ্যে ধন্ধ পাক দিয়ে উঠছে। এতক্ষণ ফৌজদার যা করছিলেন, সেটা তবে কী? অভিনয়, নাকি সত্যিই ওঁর মাথার কোনও সমস্যা হয়েছে? শৌভিক কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ওঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল। ফৌজদার ব্যথা-যন্ত্রণা-কাতরানির মধ্যেও হাসার চেষ্টা করলেন। তবে সেটা স্পষ্ট হল না। তবে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আপনি অবাক হচ্ছেন, না? কিন্তু কী করব, এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। 

   শৌভিক না বলে পারল না, কী ব্যাপার যদি একটু খুলে বলেন। 

   — নিশ্চয়ই বলব। বলতে হবেই। কারণ আমি জানি আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। ভিতরে রক্তক্ষরণ চলছে। আর হয়তো বেশিদিন নয়। 

   — এমনভাবে বলছেন কেন! চিকিৎসা করালে তো সেরে যেতে পারে। আপনি তো রাজি নন শুনেছি।

   — আমাদের এসব করতে নেই। 

   — কেন?

   ফৌজদার চুপ করে শৌভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। তারপর বলল, আমাকে একটু ধরে বসাতে পারেন। শুয়ে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

   শৌভিক কথামতো আস্তে আস্তে তোলার চেষ্টা করে ফৌজদারকে। কাজটা সহজ নয়। তবে আশ্চর্য সহ্যশক্তি মানুষটার। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করছেন ঠিকই, কিন্তু কোনও আওয়াজ নেই। কনুইয়ে ভর দিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসলেন। মুখে বললেন, আহ্, বাঁচালেন মশাই। শোওয়ার অভ্যেস একেবারেই নেই। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। 

   শৌভিক বলল, কী বলছিলেন যেন!

   ফৌজদার শৌভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেসে বললেন, আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি?

   শৌভিক ওঁর হাতে চাপ দিয়ে বলল, হান্ড্রেড পারসেন্ট। প্রথমেই আপনাকে সত্যি কথাটা বলে দিই। আপনি তো জেনেছেন আমি সাংবাদিক। আজ দু-বছর ধরে আপনার পিছনে লেগে আছি একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাইনি আপনার। এখন আপনি না চাইলে একটি কথাও লিখব না। কথা দিচ্ছি। 

   ফৌজদার বললেন, না-না, আমি চাই আপনি লিখুন। আমার লোকজনের কাছে বার্তা দেওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। 

   — খবর দিলে কেউ আসবে না?

   — না, তাদের হদিশই পাবে না কেউ। আমাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যাবে, কিন্তু দেখা যাবে না– আমরা এমনভাবেই থাকি। সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয় তো।

   — এমনভাবে বলছেন যেন আপনারা কোনও গোপন কাজের সঙ্গে যুক্ত। 

   ফৌজদার মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে কিনা একটা সিক্রেসি মেনটেন করতেই হয়।

   শৌভিক একটু অবাকই হল ফৌজদারের কথা শুনে। লোকটাকে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, খুব সাধারণ, লেখাপড়া তেমন নয়। কিন্তু যেভাবে কথা বলছেন তাতে অবাকই হতে হচ্ছে। শৌভিক সম্ভ্রমের সুরে বলল, কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি যথেষ্ট কোয়ালিফায়েড। নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন?

   — কারণ আছে। আমি বর্ধমান থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলাম। তারপর পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েও শেষ করতে পারিনি। পালাতে হয়েছিল। এই চিমনির কাজটা আমিই ধরেছিলাম। এর টেকনোলজির ব্যাপারটা আয়ত্ত করেছিলাম ভালোভাবে। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, বেশি এগোনোর উপায় ছিল না। প্রথমত টাকার অভাব, তারপর নিজে কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করতে গেলে হয়তো ধরা পড়ে যেতাম। তাই বাধ্য হয়ে নিজেকে লুকিয়েই এ কাজ করতে হয়েছে।

   — আপনি যা বলছেন, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

   ফৌজদার হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলেন। কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর জোরে জোরে বলতে লাগলেন, গঙ্গারাম-গঙ্গারাম–। 

   সহসা ফৌজদারের এই পরিবর্তনে শৌভিক খুব অবাক হয়ে গেল। বলল, গঙ্গারাম! কে গঙ্গারাম?

   তখনই দরজা খুলে একটি অল্পবয়সি ছেলে ঘরে ঢুকল। ওর হাতে দুটো চায়ের গ্লাস, সঙ্গে বিস্কুট। মুখে বলল, দাদা পাঠিয়ে দিলেন। 

   শৌভিক হাত বাড়িয়ে দুটো গ্লাস নিয়ে মেঝেতে রাখল। তারপর বিস্কুট হাতে নিয়ে বলল, তুমি রাজু?

   রাজু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। শৌভিক বলল, ঠিক আছে, এখন আর কিছু দরকার নেই। পরে ডাকব তোমায়। 

   রাজু মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ফৌজদার এতক্ষণ চোখ বুজিয়ে বসে ছিলেন। রাজু চলে যেতেই আবার চোখ খুললেন। বললেন, নজর রাখছে, বুঝলেন না!

   শৌভিক এতক্ষণে হেসে ফেলল, আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। এরা ভাটায় কাজ করে। কেনই বা নজর রাখতে যাবে! আপনি কি কোনও অন্যায় কাজ করেছেন? 

   ফৌজদার হেসে ফেললেন, আসলে কী জানেন, এরা যে নজর রাখছে, সেটা নিজেরাও জানে না। অভ্যেসের মধ্যে ঢুকে আছে তো। আর এটা চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। বলতে পারেন কয়েকশো বছরের ব্যাপার।

   শৌভিক কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিল। ফৌজদার হেসে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলেন, মনে হচ্ছে আপনি রেগে গেছেন।

   শৌভিক সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, না-না ছি-ছি, রাগ করব কেন! এটা আমার কৌতূহল। 

   — হ্যাঁ, কৌতূহল নিরসন করা আমার কাজ। 

   — আপনি গঙ্গারাম বলে কী বলছিলেন? কে গঙ্গারাম? 

   ফৌজদার মুচকি হেসে বললেন, এক কবি। তিনি আমাদের সম্পর্কে বড়ো উল্টোপাল্টা কথা লিখে গেছেন, আর তার ফল ভুগতে হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। একটা পরম্পরা ধরে চলেছে সেই অবিশ্বাসের বাতাবরণ। 

   শৌভিক বলল, গঙ্গারাম, মানে আপনি মহারাষ্ট্র পুরাণের কবি গঙ্গারাম দত্তের কথা বলছেন?

   ফৌজদার চোখ বুজিয়ে পাঁচালির সুরে বলতে লাগলেন– 

রঘুরাজা নিকটে আছিলা বসিআ।

কহিতে লাগিলা তিনি হাসিয়া হাসিয়া।।

আজ্ঞা কর বাঙ্গালা মুলুকে আমি জাই।

জবর করিয়া তথা আনিব চৌথাই।।

তবে তারে আজ্ঞা দিলেন রাজন।

তিনি পাঠাইলেন দেওয়ান ভাস্করণ।।

রঘু [রাজা] আজ্ঞা দিলা ভাস্করে।

তৎপর করিয়া চৌথাই আনি দিবা মোরে।।…

শেষদিকে ফৌজদারের গলার স্বর নেমে যাচ্ছিল। হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। শৌভিক ফৌজদারের হাত ধরে বললেন, আপনি জল খাবেন?

   ফৌজদার মাথা নেড়ে বললেন, না। বরং চা-টা খাই। বলে কাপ উঠিয়ে চুমুক দিলেন। তারপর খানিক সময় নিয়ে বললেন, যে কথা আপনাকে বলছি, সেসব চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। আমি শুনেছি আমার দাদা-পরদাদার মুখে, তাঁরা শুনেছেন তাঁদের দাদা-পরদাদার কাছে। কয়েক পুরুষ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি এসব। বলতে পারেন এক অভিশপ্ত জীবন নিয়ে ছুটে চলেছি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। কোথাও থিতু হতে পারলাম না। গঙ্গারাম দত্ত নামে ওই কবি সত্যিটা না জেনেই লিখে দিলেন, আমরা লুঠেরা, ধর্ষণকারী। লোকজন ধরে ধরে দাস বানিয়ে বিক্রি করে দিই। তাঁরই প্ররোচনায় বোধহয় বাংলার ঘরে ঘরে একটা ছড়াই চালু হয়ে গেল আমাদের নিয়ে–

খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল বর্গী এল দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে…

বলতে বলতে ফৌজদার সহসা উত্তেজিত হয়ে বললেন, মিথ্যে মিথ্যে। আমাদের নিয়ে আজগুবি সব কথা বানানো হয়েছে। কিন্তু এসব কথা বলব কাকে! কেউ তো শুনতেই চায়নি, উপরন্তু তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কোথাও থিতু হতে দেয়নি।

   শৌভিক বলল, আপনারা কি মারাঠি? মানে ওই যাদের বর্গী বলা হত!

   ফৌজদার মাথা নেড়ে বললেন, দেখুন, আমি বংশ পরম্পরায় যা শুনে এসেছি, সেটাই বলছি। আপনি কি জানেন বর্গী কথাটা কোথা থেকে এসেছে?

   শৌভিক মাথা নেড়ে চুপ করে রইল। ফৌজদার বললেন, ওটা এসেছে বাগী থেকে। বাগী মানে জানেন তো, বিদ্রোহী।

   শৌভিক বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু বর্গীরা তো বাংলায় অত্যাচার করেছিল, এ তো সত্যি। 

   — কোনও প্রমাণ আছে? একজন কবি বলে দিলেন, সেটাই বেদবাক্য হয়ে গেল! আপনাদের আর এক কবি ভারতচন্দ্র কিছুদিন তো ছিলেন ভাস্কররামের শিবিরে, ওড়িশায়। কই, তিনি তো কিছু লেখেননি। আসলে বাগী সত্তাকে খাটো করে দেখাবার জন্য ইচ্ছে করেই এসব রটানো হয়েছে। 

   — তাতে কী লাভ!

   — লাভ-লোকসানের হিসেব কে কষে মশাই! সেদিন যদি ওই বর্গীরা জিতে যেত, তবে তো ইতিহাসে অন্য কথা লেখা হত। আপনি কি মনে করেন নবাব বাহিনী ধোয়া তুলসীপাতা? তারা অত্যাচার করত না? আসলে বিজয়ীর ধর্মেই সবাই দীক্ষিত হয়, বিজিতকে কে আর পাত্তা দেয়!

   — তাহলে সত্যিটা আপনাদের বলা উচিত ছিল, বলেননি কেন? শৌভিক উষ্মা প্রকাশ করে ফেলল।

   ফৌজদার হাত তুলে শৌভিককে নিবৃত্ত করলেন, সত্যিটা বলার সুযোগ পেলে তো!

   — এখন তো বলতে পারেন।

   — কতজনকে বলেছি, কেউ পাত্তাই দেয়নি। এখন যেমন আপনার সঙ্গে বলছি, বিশ্বাস করছেন কিনা জানি না। 

   — মহারাষ্ট্রের কোথায় আপনাদের ঘরবাড়ি ছিল?

   ফৌজদার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। একটু সময় নিয়ে চোখ বুজিয়ে বললেন, সাতারা। সেখানে আদিলশাহি সুলতানেরা রাজত্ব করত। তারা বড়ো অত্যাচারী ছিল, আর তাদের অত্যাচারে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। বাগী হয়ে বন-জঙ্গল-বেহড়ে থাকত। এইভাবে থাকতে থাকতে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠল তারা। ১৬৭৩ সালে শিবাজি মহারাজ সাতারা এলেন ফাগোয়া পতাকা উড়িয়ে।  জিতে নিলেন বাগীদের দিল। তাদের নিয়েই আদিলশাহি সুলতানকে সাতারা ছাড়া করে দেন মহারাজ। সেই শুরু। শিবাজি মহারাজ ওই বাগীদের নিয়ে গড়ে তুললেন ওঁর বিখ্যাত বাহিনী। একের পর এক যুদ্ধ, মোগল বাহিনীকে রুখে দেওয়ার কাজ– সবই করতে হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাটা রয়েই গেছে। শিবাজি মহারাজের পর যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা বাগীদের দিয়ে শুধু যুদ্ধবিগ্রহের কাজটাই করিয়েছে, তাদের থিতু হতে দেয়নি। বাগীরা কি শুধু যুদ্ধ করেই যাবে, ঘর-সংসার করবে না? ক্ষেতি-জমিন করবে না? ফসল ফলাবে না? সেকথা কেউ ভাবল না। বাগী সর্দারেরা ভাবছিল, এভাবে চললে তো ওরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। এইরকম সময়ে একদিন নাগপুরের সর্দার রঘুজি ভোঁসলে বাগী সর্দারকে ডেকে বললেন, বাংলা মুলুকে চলে যাও ভাস্কররামের সঙ্গে। চৌথ আদায় করো। বাংলা মুলুক সোনার দেশ। লুট করো সব, তাহলে আর তোমাদের বাকি জীবন নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমরা নিজেদের মতো থাকতে পারবে।

   থামলেন ফৌজদার। চোখ বুজিয়ে রইলেন খানিক সময়। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, বাংলা মুলুক সম্পর্কে বাগী সর্দারদের কোনও ধারণা ছিল না। শুধু শুনেছিল সে দেশ সোনার দেশ। প্রচুর ধনসম্পদ সেখানে রক্ষিত আছে। দখল করতে পারলে ওদের আর পায় কে! 

   — আর এখানে এসেই শুরু করে দিলেন খুন-জখম-লুটপাট-ধর্ষণ! ফৌজদারকে বাধা দিয়ে শৌভিক বলল।

   ফৌজদার হাসলেন, ওটা প্রচার।

   — প্রচারের কারণ আছে নিশ্চয়ই। এই তো আপনি বললেন, আপনাদের সর্দারেরা এ দেশে লুটপাট করতে এসেছিল। 

   — হ্যাঁ, এটা সত্যি। কিন্তু বাংলা মুলুকে এসে ওদের ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। দেখল, এ দেশটা একেবারেই অন্যরকম। মারহাট্টার মতো রুখা-শুখা-পাথুরে জমিনের দেশ নয়। বাংলা মুলুক একেবারেই নরম মাটির দেশ, ফসলের দেশ। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এমনকি গাছের উপর দুটো নরম রুটি আর লোটাভর পানি ঝুলতে দেখা যায়। এখানকার মানুষগুলোও অদ্ভুত। সহজেই সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারে। বাংলা মুলুককে কেন সোনার দেশ বলে, এ কথার মর্ম উপলব্ধি করেছিল বাগী সর্দারেরা। তারা তো এমন দেশেরই সন্ধান করছিল, যেখানে ওরা বাগী হিসেবে চিহ্নিত হবে না। ক্ষেতি-বাড়ি, ঘর-সংসার করতে পারবে সবার সঙ্গে মিলেমিশে। অন্তত প্রমাণ করতে পারবে ওরা বহিরাগত হলেও এদেরই ভাই-বেরাদর হয়ে থাকতে চায়। সর্দারদের মনের বদল ঘটতে থাকে একটু একটু করে। বুঝতে পারছিল ভাস্কররামের সঙ্গে থাকলে ওদের কেউ বিশ্বাস করবে না। দেখুন ভাস্কররাম ছিলেন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত লোক। শুধু বলতেন লুট করো, আর সেই সম্পদ তিনি নিজের ভোগেই লাগাতেন। আমাদের সর্দারেরা সেটা চায়নি। আর চায়নি বলে ভাস্কররামকে সহজেই কাবু করতে পেরেছিল বাংলার নবাব। কিন্তু এ দেশের শাসকেরা বাগীদের সম্পর্কে ভুল কথা প্রচার করেছিল। বাগীকে বর্গী করে দেওয়া ছিল ওদের কৌশল। যাতে লোকজন ভুল বোঝে। 

   শৌভিক বলল, আপনারা তো পাল্টা প্রচার করতে পারতেন।

   ফৌজদার মাথা হেলিয়ে বললেন, কী করে করব! আমাদের থাকতে দিলে তো। মানকরে কী হয়েছিল মনে নেই?

   — কী হয়েছিল?

   — সন্ধির নাম করে ভাস্কররামকে ডেকে এনে নবাব আলিবর্দি কী করলেন জানেন তো! বলে নিজেই আবার পাঁচালির ঢঙে বলতে শুরু করলেন–

নবাব উঠিয়া গেল হইল অনেকক্ষণ।

ভাস্কর পণ্ডিত কিছু কহেন তখন।।

দুই ডণ্ড বিলম্ব হইল কহে মুস্তাফার ঠাঁই।

এখন তবে আমি সান পূজাএ জাই।।

মুস্তাফা খাঁ বোলে চলো সভাই মিলে জাই।

সেপহরিতে আসিব নবাবের ঠাঁই।।

জেই মাত্র ভাস্কর ঘোড়ায় চড়িতে।

তরোয়াল খুলিয়া তখন মারিলেক মাথে।।

সেইক্ষণে তবে ঘটাচটি হইল।

জত জনা য়াইসা ছিল সব জনা মইল।।

তারপরে নবাব সাহেব সমাচার সুনে।

সুনি আনন্দিত নবাব হইল সেইক্ষণে।।

সাদিয়ানা নহবত কত বাজিতে লাগিল।

ফকির ফুকুরাকে খএরাত দিল।।

মোনকরা মোকামে জদি ভাস্কর মইল।

মনসুদাবাদ উড়াইয়া কবি গঙ্গারাম কইল।।

বলতে বলতে ফৌজদারের কণ্ঠস্বর খাদে নেমে গেল। হাঁপাতে লাগলেন। শৌভিক তাড়াতাড়ি জলের বোতল ধরিয়ে দিল হাতে। ফৌজদার বোতলটা উপুড় করে প্রায় সবটা ঢেলে দিলেন গলায়। বললেন, বাগী সর্দারেরা যদি সক্রিয় থাকত তবে কি নবাব ভাস্কররামের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারতেন? আসলে ভাস্করের মৃত্যু ছিল বাংলার মানুষের জন্য বাগীদের তরফে উপহার।  

   — তারপর কী?

   — মহারাষ্ট্র পুরাণের প্রথম কাণ্ড এখানেই শেষ। পরের কোনও কাণ্ডের কথা কেউ কি জানে? কবি আদৌ লিখেছিলেন কিনা সেটাই জানা যায়নি।

   — হয়তো লিখেছিলেন।

   — হয়তো। দারুণ একটা শব্দ। এটা দিয়ে কী বোঝানো যাবে? তিনি লিখেছেন কিন্তু দেখা যায়নি।

   — এমন তো হতে পারে, আপনার কথা অনুযায়ী, হয়তো সেটা নষ্ট করা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

   ফৌজদার শব্দ করে হেসে উঠলেন, এতক্ষণে একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা বললেন। এবার আমি যদি পাল্টা প্রশ্ন করি কেন নষ্ট করা হল, কেন পুড়িয়ে দেওয়া হল?

   শৌভিক চুপ করে রইল। ফৌজদার বললেন, আসল সত্যিটা ওখানেই লুকিয়ে আছে। সেই ইতিহাস কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।

   — কী সেই ইতিহাস আমায় বলুন।

   — ভাস্কররাম তো খুন হলেন। তারপর বাংলা-বিহার-ওড়িশা জুড়ে শুরু হয়ে গেল আমাদের পলায়নপর্ব। কে যে কোথায় ছিটকে গেল, কেউ জানতেই পারল না। বাংলা-বিহার-ওড়িশা-অসমে ছড়িয়ে পড়ল যে যার মতো নাম-পদবি পালটে, আর নবাবের ঘোড়সওয়ার বাহিনী তাড়া করে চলল আমাদের পিছু পিছু, ধরতে পারলেই কচুকাটা। ওদিকে মারহাট্টায় ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। ভাস্কররামের মৃত্যুর জন্য ওরা বাগীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অতএব ছুটে বেড়ানোই আমাদের জীবনে সত্যি হয়ে উঠল, যা আজও চলছে।

   শৌভিক মাথা নাড়িয়ে বলল, এ আপনি কী বলছেন! এখন তো স্বাধীন দেশ। কে আপনাদের ধরবে, মারবে!

   ফৌজদার হাসলেন, ওই যে বর্গী নামটা। তখন নবাব বাহিনী তাড়া করে বেড়াত। তারপর যে যখন ক্ষমতার আসনে বসেছে, তারাই তাড়িয়েছে। আর না চাইলেও বাগী আমাদের হতেই হয়েছে। বলতে পারেন বাধ্য হয়েছি। বুঝেছি এটাই আমাদের জীবন। 

   — আপনারা বিদ্রোহ করলেন?

   — বাগীরা সরাসরি কোথাও বিদ্রোহ করেনি। কিন্তু প্রতিটি বিদ্রোহে বাগীদের অংশগ্রহণ ছিল।

   — কী রকম?

   — মেদিনীপুরের চোয়ার বিদ্রোহের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? চোয়ারদের মধ্যেই আমাদের দাদা-পরদাদারা ঢুকে গেল। শুধু ওখানে কেন, সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, সাঁওতাল-কোল বিদ্রোহ, তারপর সিপাহি বিদ্রোহ– কোথায় না ছিল না আমাদের ফৌজদারেরা! আর তাদের কচুকাটা করতে উঠেপড়ে লেগে আছে বাহিনী। লাঠি-গুলি-বন্দুক নিয়ে তাড়া করে চলেছে। সিপাহি বিদ্রোহে একটা হেস্তনেস্ত হতই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করতে নামল, তারাও তো কোনও-না-কোনও ভাবে শাসক। অত্যাচার তারাও কম করেনি। কিন্তু এতে বাগীদের দোষ কোথায়? অতএব আবার পলায়ন, আবার ছুটে চলা। ছুটতে ছুটতে বিদ্রোহ, কখনও মোলঙ্গীদের সঙ্গে, কখনও কৃষকদের সঙ্গে। যারাই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তাদের পাশে থেকেছে বাগীরা। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সময়, আপনাদের উল্লাসকর দত্ত নারায়ণগড়ে রেললাইনে মাইন পুঁতলেন বড়োলাটকে মারবেন বলে, তাঁকে সাহায্য করেছিল বাগীরা। তারপর আধিয়ার বিদ্রোহ, তেভাগা– কোথায় না ছিল তারা! লড়াই আমাদের জীবন। লড়াই করো আর পালাও। এটা চলছে, চলেই আসছে। আমাদের পিছনে যারা তাড়া করে চলেছে, তারা জানে আমরা থামলেই ওদের সর্বনাশ। গদি টলমল করে উঠবে। অতএব ওদের একটাই নীতি, আমাদের ছোটাও। পেছনে খ্যাপা কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার মতো ওরা সবসময় তেড়ে আসে। কখনও থিতু হতে দেয় না। 

   — এই স্বাধীন দেশেও!

   — হ্যাঁ, এই স্বাধীন দেশেও। আমাদের স্বাধীনতা কোথায়! যখনই ওরা বুঝতে পারে আমরা থিতু হচ্ছি, তখনই কোনও-না-কোনও বাহানায় আমাদের পিছনে লেগে যায়। এই তো, আসামে আমাদের কাগজ দেখাবার নাম করে ডিটেনশন  ক্যাম্পে ভর্তি করেছে। এবার এখানেও নজর দিয়েছে। লোভ দেখিয়ে, ভয়-হুমকি দিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তার উৎসগুলোই ধ্বংস করার তালে আছে। করোনা বিধি দেখিয়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ, লাইব্রেরি বন্ধ। মানুষ যাতে জানতে না পারে, ভাবতে না পারে, তাই নানা প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মানুষকে ভিখিরি বানাবার তাল করছে ওরা। বাগী হয়ে এটা মেনে নিই কী করে বলুন!

   — তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আবার লড়াই?

   ফৌজদার এবার গম্ভীর স্বরে বললেন, অবশ্যই। লড়াই ছাড়া বাগী জীবনের কোনও সার্থকতা নেই। আমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু বাগী কখনও থেমে থাকবে না। 

   শৌভিক চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, আপনারাই যে এসবে আছেন, বুঝছেন কী করে?

   — নাম-পদবি দেখে। আমাদের নামগুলো হয় যুদ্ধ-লড়াইয়ের অনুষঙ্গে। আর পদবি হবে র-কারান্ত। যেমন আমি ফৌজদার। এইটা লিখবেন না, বুঝতেই পারছেন।

   — যদি না লিখি!

   — তাতেও ক্ষতি নেই। ওরা নিজেদের মতো সময় নেবে, তারপর যা বোঝার বুঝে যাবে। লিখলে গালগল্প লিখবেন না আশা করি। আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। হয়তো কাল বা পরশু, হয়তো আরও দু-দিন পর। কিন্তু আমি জানি, সংকেত চলে যাবে। ঘণ্টা বাজছে শুনতে পাচ্ছি। ওরা প্রস্তুতি নেবে। বাগী জীবনে আবার পতাকা উড়বে। 

   শেষের দিকে কথাগুলো প্রায় মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করছিলেন ফৌজদার। চোখদুটো আধবোজা। বিড়বিড় করে বলেই চলেছেন। শৌভিক দু-বার ডাকল, ও ফৌজদারবাবু, শুনছেন?

   ফৌজদার শুনলেন বলে মনে হল না, উনি নিজের মনে বিড়বিড় করেই চলেছেন। শৌভিক দেখল আধো-অন্ধকার ঘরে বিদ্রোহের আগুন স্তিমিত হতে হতে দপ করে জ্বলে উঠল।

(ঋণ স্বীকার : যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী সম্পাদিত মহারাষ্ট্র পুরাণ )    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *