সমীরণ সরকার

নদীয়া জেলায় কোন সুপ্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে পাল-সেন যুগের কিছু ভগ্ন অথবা অখন্ড প্রস্তর জল মূর্তি, কয়েকটি পুরাতন ধাতু মূর্তি এবং সেন যুগের তাম্র শাসন।

কৃষ্ণনগর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে বামুনপুকুর বাজার সংলগ্ন ‘বল্লাল ঢিপিতে’ ভারত সরকারের পোষকতায় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বক্ষণের পূর্বাঞ্চল চক্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গত ১৯৮১ সাল থেকে আধুনিক প্রত্ন বিজ্ঞানসম্মত উৎখননের কাজ চলছে। এর ফলে উদঘাটিত হয়েছে আমাদের ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য। প্রায় তের হাজার বর্গমিটার আয়তাকার এই ঢিপির উচ্চতা ছিল প্রায় নয় মিটার। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করার এখানে কোন অবকাশ নেই।

          নদীয়ায় পাল -সেন যুগে নির্মিত কোন মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে কী সেই সময়ে নদীয়া জেলায় কোন মন্দির তৈরি হয়নি? হয়তো হয়েছিল। কিন্তু বিধ্বংসী জলবায়ু প্লাবন নদীর অতি পরিবর্তন এবং মন্দির ধ্বংসকারী কিছু মানুষের ব্যাপক ধ্বংসলীলায় অথবা অন্যান্য কারণে ছোট অথবা মাঝারি মন্দিরগুলি র অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীমূলক গ্রন্থে অথবা অন্যান্য বৈষ্ণব গ্রন্থ গুলিতে নদীয়ার কোন মন্দিরের উল্লেখ না থাকায় অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন মন্দিরগুলি হয়তো তার আগেই বিনষ্ট হয়ে গেছিল।

        নদীয়ায় মুসলমান রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত কোন উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তির নিদর্শন দেখা যায় না। স্থানীয় ইতিহাসের সে ছিল এক অন্ধকারময় সময়। পঞ্চদশ শতকের শেষে নদীয়ায় শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬ – ১৫৩৩) আবির্ভাবের ফলে জাতির জীবনে নবজাগরণের বার্তা পৌঁছেছিল। শুধু ধর্ম নয়, সাহিত্য, সংস্কৃতি শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য–সর্বক্ষেত্রে উদিত হল বিকাশের সূর্য ‌। সে এক অভূতপূর্ব নবজাগরণ।

আর সেই নবোদিত সূর্যের কিরণ ছটায় আলোকিত হয়ে উঠলো সমাজ। সমৃদ্ধ হল ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি ,স্থাপত্য ,ভাস্কর্য ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্র। সমৃদ্ধ হয়ে উঠল মন্দির শিল্প এবং পোড়ামাটির ভাস্কর্য। নদীয়ার মন্দিরগুলি বাংলার নিজস্ব মন্দির স্থাপত্য শৈলীতে শ্রীচৈতন্য পরবর্তী কাল নির্মিত হলেও শুধুমাত্র দেবস্থান নয়,নদীয়ার সামাজিক সংস্কৃতি জন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ উপাদান।

            প্রত্নবিশেষজ্ঞরা বাংলার নিজস্ব মন্দির স্থাপত্য রীতিকে ‘বাংলারীতি’ নামে অভিহিত করেন, তাঁরা উত্তর ভারত বিশেষত উড়িষ্যা থেকে প্রাপ্ত, ‘নাগর’ শৈলীর বিবর্তিত রূপ অনুযায়ী ‘দেউল’ রীতি ছাড়াও বাংলার নিজস্ব রীতিকে ‘চালা’, ‘রত্ন’ ও ‘দালান’ নামে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন।

‘চালা মন্দির’ শ্রেণীতে ‘দোচালা’ বা ‘একবাংলা’, ‘জোড়বাংলা’, ‘চারচালা’, ‘আটচালা’ ,’বারোচালা’

——এই সমস্ত রীতি অন্তর্ভুক্ত। রত্ন মন্দির পর্যায়ের মন্দিরগুলিতে মন্দিরের মাথায় এক বা একাধিক চূড়া নির্মিত হয় এবং সেই অনুযায়ী মন্দিরের শ্রেণী বিভক্ত হয় ‘পঞ্চরত্ন’ ‘নবরত্ন’ ইত্যাদি শ্রেণীতে। ‘দালানমন্দির’ সমতল ছাদের মন্দির। এগুলির সামনের অংশে সাধারণত তিন বা ততোধিক খিলানযুক্ত প্রবেশপথ সহ অলিন্দ থাকে।

নদীয়ায় এই তিন শ্রেণীর মন্দির দেখা যায়। দেউল রীতির কোন মন্দির নদিয়ায় দেখা যায় না, আগে ছিল কিনা তাও জানার কোন উপায় নেই। নদীয়ায় চারচালা মন্দিরের সংখ্যাই বেশি।

নদিয়ায় পাথরের তৈরি মন্দির একটিও দেখা যায় না, সবই চুন–সুরকির মসলা দিয়ে তৈরি ইটের মন্দির।

বাংলার চিরন্তন বাসগৃহ কুঁড়েঘরের সহজ সরল রূপ দোচলার আদলেই বাংলার প্রথম পাকা মন্দির গুলি তৈরি হতে শুরু হয়েছিল। এই শৈলীর প্রধান লক্ষণ—-চালার বাঁকানো শীর্ষ ও কার্নিস, যা চালা শিল্পের স্থাপত্য ইমারতে লক্ষ্য করা যায়। জোড়বাংলা রীতি টি দোচালা বা এক বাংলা রীতির পরিবর্তিত বা উন্নততর রূপ। ইমারতের অধিকতর স্থায়িত্বের জন্য দুটি দোচালা কে পাশাপাশি একত্রিত করে তাদের শীর্ষে কখনো এক সংযোগকারী চূড়া নির্মাণ করা হতো, কখনো বা হতো না।

বর্তমানে নদিয়ায় দোচলা মন্দির একটিও নেই। তবে কালীগঞ্জ থানার ঘোড়াইক্ষেত্র ও করিমপুর থানার দোগাছি গ্রামে দোচালা মন্দির ছিল, এখনো ভিত্তিভূমি বর্তমান। দুটি মন্দিরই ১৮ শতকের প্রথমার্ধে নির্মিত এবং দুটিতেই পোড়ামাটির ভাস্কর্য ছিল। প্রথমটি শ্যামরায় কৃষ্ণ বিগ্রহের মন্দির ছিল, দ্বিতীয়টিতে ছিল দুর্গা ও বিষ্ণুর দুটি সেন যুগের প্রস্তর মূর্তি, এখন একটি পাশে দালান মন্দিরে আছে।

          ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার রাজবংশের তথা জমিদারির প্রতিষ্ঠা করেন ভবানন্দ মজুমদার। মূলত নদীয়া রাজেরা এবং অন্যান্য বিত্তশালী ব্যক্তিগণ নদীয়ার মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। নদীয়ার রাজাদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাঘব রায় (১৬১৮–১৬৬৯ খ্রিঃ) এবং নদীয়ার বর্তমান পোড়ামাটির ভাস্কর্য্য মন্ডিত মন্দির গুলির অধিকাংশই তাঁর সময় নির্মিত। রাঘব রায় প্রতিষ্ঠিত মন্দির গুলির আকার ,গঠন ও অলংকরণের ক্ষেত্রে অনেক সাদৃশ্য আছে।

নদীয়ায় আটচালা মন্দির অনেকগুলি। তার মধ্যে প্রাচীনতম হলো বাঘ আঁচড়ায় চাঁদ রায় প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির (১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)।

          নদীয়ায় এখন মাত্র দুটি জোড়বাংলা মন্দির আছে। বীরনগরে, ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে, রামেশ্বর মিত্র মুস্তৌফী বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকা বিগ্রহের জন্য একটি, ও তেহট্টে, ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে, জনৈক রামদেব ,কৃষ্ণ রায় নামের কৃষ্ণ বিগ্রহের জন্য অপরটি নির্মাণ করেন। দুটি মন্দিরই পোড়ামাটির অলংকরণ সমৃদ্ধ।

বীরনগর

      রানাঘাট থানার অন্তর্গত এবং শিয়ালদহ–লালগোলা রেলপথে বীরনগর একটি মাঝারি স্টেশন। বীরনগর একটি পৌর শহর ও।

এই বীর নগরের প্রাচীন নাম ছিল উলা। আগে উলা ছিল ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম। গঙ্গার প্রাচীন খাত এখনো দেখা যায় দূরে।

‘উলা’ নামকরণ সম্পর্কে অনেক রকম মত আছে। কেউ কেউ বলেন, আগে এখানে উলুবনের জঙ্গল ছিল, সেই জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন হয়েছিল বলে জায়গাটির নাম হয় ‘উলা’।

‘আইন -ই -আকবরী’ গ্রন্থে উলার নাম উল্লেখ আছে। সম্রাট আকবরের আমলে উলা ছিল সরকার সুলেইমানাবাদের ৩২ মহলের অন্যতম।

১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্য এবং লোকশ্রুতি থেকে জানা যায় যে,   শ্রীমন্ত সদাগর সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার সময় উলার পাশে গঙ্গার দহে ভীষন ঝড় ওঠে। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। শ্রীমন্ত সওদাগর তীরে নেমে বটবৃক্ষ মূলে শিলরূপিনী উলাইচণ্ডীর পূজা করলে ঝড় থেমে যায় এবং তার সপ্তডিঙা রক্ষা পায়। সেই থেকে প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমায় ওই স্থানে উলাইচণ্ডীর পূজা হয়ে আসছে। দেবী উলাইচন্ডীর নামেও গ্রামের নাম উলা হতে পারে।

এখানে একদা গ্রামবাসীদের চেষ্টায় এক দুর্ধর্ষ ডাকাত দল ধরা পড়লে ইংরেজ সরকার উলার নতুন নামকরণ করেন বীরনগর অর্থাৎ বীরেদের নগর। 

উলা বীরনগর গ্রাম সম্পর্কে ১৯৫১ সালে নদীয়া ডিস্ট্রিক্ট হ্যান্ডবুকে বিবরণ পাওয়া যায়:-

“The ancient name of this small town was Ula. It is in the Ranaghat subdivision about 5 miles from Ranaghat and 13 miles from Krishnanagar…………..

One of the earliest traditions connected with this town is that it was once visited by srimanta Saudagar, the mythical Hindu merchant Prince. At that time the Ganges flowed past the place, and as srimanta was sailing up to it, a terrible storm came on. In response to divine inspiration he called upon ulai Chandi, one of the wives of Shiva, the destroyer, to help him. She answered his prayer and protected his fleet; where upon he instituted a special worship of her in this place, which has been carried on to the present day. The ulai Chandi festival is celebrated here annually in the month of Baisakh, and is attended by many pilgrims, who, it is said, are housed and fed by the residents…………….”

            অতীত সমৃদ্ধির চিহ্নস্বরূপ এখানে, এই বীর নগরে বড় বড় বাড়ি, দিঘী, প্রাচীন গড়ের খাত , ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। পোড়ামাটির অলংকরণ যুক্ত বহু প্রাচীন মন্দির ও বিশাল বিশাল অট্টালিকা জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসস্তূপ দেখা যায়। এখানে  এক সময়ে সাতটি পৃথক ঠাকুর বাড়িতে ২১টি মন্দির ছিল, এখন সেগুলির অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

উলা সমাজের শীর্ষস্থানীয় মুস্তৌফী বংশের  প্রতিষ্ঠাতা রামেশ্বর মিত্র মুর্শিদকুলি খাঁয়ের শাসনকালে বাংলার নায়েব কানুনগো বা মুস্তৌফী পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাধা কৃষ্ণের একটি সুন্দর জোড়া দোচালা বা জোড় বাংলা মন্দির তিনি তৈরি করান। মন্দিরটির সামনের দেওয়ালে পোড়ামাটির জীর্ণ ফলকে উৎকীর্ণ

একটি লিপি আছে—–

        “অঙ্গৈককালেন্দুমিতে

          শকাব্দে ১৬১৬ কায়

        স্থ কায়স্থ হরেষধ

       র্ম্মাঃ।যো নির্ম্মমে শ্রী হ

      রি যুগ্ম ধাম

      রামেশ্বর মিত্র দাস ঃ।।”

অর্থাৎ 1616 শকাব্দে (১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে) কায়স্থ কুলোদ্ভব শ্রী রামেশ্বর মিত্র শ্রীহরির এই যুগ্ম গৃহ

নির্মাণ করলেন। মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের যুগ্ম বিগ্রহ

নিত্যসেবিত।

ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, পশ্চিমমুখী এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য ,প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ২২ ফুট ২২ ফুট ও প্রায় ২৫ ফুট। প্রতিটি দোচালার প্রস্থ

সাড়ে ১০ ফুট ও সংযোগকারী দেওয়ালের প্রস্থ এক ফুট। প্রথম দোচালাটি অলিন্দ এবং দ্বিতীয়টি গর্ভগৃহ।

টেরাকোটার অলংকরণ শুধু সামনের দেওয়ালে এবং গর্ভগৃহে প্রবেশদ্বারের তিনদিকে উৎকীর্ণ আছে। কারিগরি নৈপুণ্যে সেগুলি নদীয়ার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এর তুল্য হলেও সংস্কারের সময় সেগুলি যথাযথ সর্তকতার অভাবে সাদা বা গোলাপি কলিচুনে ঢাকা পড়ায় কিছুটা শ্রীহীন হয়ে গেছে।

বাইরের দেওয়াল, ভিত্তিবেদীর অনুভূমিক সারিতে যে সমস্ত মূর্তিগুলি দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকি বাহিত বাবু ও রক্ষকগণ, সৈনিক দল, নৌকা ভ্রমণ, বাণিজ্যতরী মৃগয়া প্রভৃতি সামাজিক দৃশ্য।

বাইরের প্রবেশদ্বারের তিন দিক ঘেরা কুলুঙ্গিতে নিবন্ধ এক সারি মূর্তি ভাস্কর্যের মধ্যে কৃষ্ণলীলা ও পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তি পরিলক্ষিত হয়। বাম দিকের পূর্ণ স্তম্ভের গায়ে কার্তিক গণেশ সমেত একটি অপূর্ব মহিষমর্দিনী মূর্তি আছে। দেওয়ালের বাকি অংশে সূক্ষ্ম ফুলকারি  নকশার প্রাধান্য দৃষ্ট হয়। গর্ভ গৃহে প্রবেশদ্বারের প্রান্তেও অনুরূপ ফুলকারি সজ্জা আছে। সেখানে খিলান শীর্ষের দুপাশে দুটি লম্ফমান

সিংহের মূর্তি শিল্পীর নৈপুণ্যের নিদর্শন। মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি নিত্য পূজিত হয়।

       শোনা যায় মুস্তৌফী বাড়ির সিংহদ্বারের কাছে একসময় কাঠের কারুকার্য শোভিত খড়ে ছাওয়া একটি দোচালা চন্ডীমন্ডপ ছিল। দক্ষিণমুখী এই মন্ডপের অন্য তিন দিকে, চাল অবধি উঁচু দেয়ালের ভেতরের সমতলে পঙ্খের দেবদেবী মূর্তি ও ফুলকারি নকশা এখনো দেখা যায়। কাঠের থাম ও কড়ি -বরগা গুলির গায়ে  ক্ষোদিত শিল্পগুলির তুলনা হুগলি জেলার আটপুরের ও শ্রীপুর বলাগড়ের অপেক্ষাকৃত অক্ষত  ও বিখ্যাত চন্ডীমন্ডপ দুটিতেও নেই। ১৬০৬ শকাব্দে (১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে) রামেশ্বর মিত্র মুস্তৌফী এই চন্ডী মন্ডপটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই সময় নাকি বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে এই চন্ডী মন্ডপ দেখার জন্য প্রচুর ভিড় হত। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও এইজন্যি মন্ডপের শোভা দর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়।

মুস্তৌফি বাড়ির সিংহদ্বারের সামনে ,পূব দিকে রামেশ্বর মিত্র মুস্তৌফী প্রতিষ্ঠিত ইটের প্রাচীন দোলমঞ্চ দেখা যায়।

বর্তমান মুস্তৌফি বাড়ির উত্তর পূর্ব দিকে একটি পূবমুখী ভগ্ন আটচালা মন্দির আছে। অন্যত্র রক্ষিত ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপির পাঠ এই রূপ:-

   “শুভমস্তু শকাব্দাঙ্কেভূমিবিন্দু মহীপতৌ।

   শ্রীকাশীশ্বর মিত্রেন বিষ্ণবেযৎ সমর্পিতম।।”

রামেশ্বর মিত্র মুস্তৌফীর খুল্লতাত কাশীশ্বর মিত্র

এই বিষ্ণু মন্দিরটি ১৬০১ শকে অর্থাৎ ১৬০০৯ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপদে সমর্পণ করেন।উলার প্রতিষ্ঠা ফলক যুক্ত মন্দিরের মধ্যে এটি সবচেয়ে প্রাচীন।

আগাছায় ঢাকা এই মন্দিরটির উপরের চালা ও সামনের অংশের উপরিভাগ বিধ্বস্ত।

দক্ষিণপাড়ায়, মিত্রমুস্তৌফী বাড়ির পুবে, একদা যে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরটি ছিল, তা এখন বিধ্বস্ত। তিন কক্ষ বিশিষ্ট দক্ষিণমুখী এই দালান মন্দিরে একদা সাড়ে চার ফুট উঁচু কষ্টিপাথরের এক সিদ্ধেশ্বর ী কালী প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এখন সে বিগ্রহ না থাকলেও ভাঙ্গা দেওয়ালে সামান্য পোড়ামাটির অলংকরণের কাজ আজও দেখা যায়। দক্ষিণপাড়ায় আরেকটি লুপ্ত শিব মন্দিরের ভিত্তি বেদীটুকু অবশিষ্ট আছে। নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বলে পরিচিত ‘বুড়ো শিব’আজও সেই ভগ্নবেদীর উপরে নিত্য পূজিত হচ্ছেন।

সমগ্র বীরনগর -উলা জুড়ে এমন অনেক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়, যা একদা এই এলাকার মন্দির শিল্পের গৌরব বহন করত, শত শত নর-নারীর দৃষ্টিকে মুগ্ধ করত মন্দিরের অলংকরণ ও তার গঠনশৈলী দিয়ে, তা আজকে শুধু ইতিহাস মাত্র।

তেহট্ট     

       নদীয়ার দ্বিতীয় বিখ্যাত জোড় বাংলা বা জোড়া দোচালা মন্দিরটি আছে তেহট্টে।

কৃষ্ণনগর থেকে বাসপথে তেহট্টের দূরত্ব প্রায় 44 কিলোমিটার। প্রাচীন নাম ত্রিহট্ট। একসময় এই অঞ্চলের তিনটি স্থানে সপ্তাহে দুদিন করে হাট বসত। পরে জলঙ্গী নদীর পূর্ব তীরে এক প্রশস্ত জায়গায় তিনটি হাট একত্রিত হয়ে বসতে শুরু করলে , জায়গাটির নাম হয় ত্রিহট্ট; অপভ্রংশে তেহট্ট।

তেহট্টের ঠাকুরপাড়ায় কৃষ্ণরায় বিগ্রহের জোড় বাংলা মন্দির টি নদীয়া জেলার জোড়বাংলা টেরাকোটা মন্দিরের অন্যতম। এই দেবালয়ের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে পোড়ামাটির হরফে উৎকীর্ণ প্রতিষ্ঠালিপির পাঠ নিম্নরূপ।

  “১৬০০ শাকে শূন্যনভঃষড়িন্দুগণিতে মেষগতে ভাস্করে

শ্রীগোবিন্দপদারবিন্দনিরতঃ শ্রীরামদেব মহান

লক্ষ্মী যস্য পদারবিন্দসেবনবিধৌ ব্যাপার সম্পাদিনী

তস্য শ্রীপুরুষোত্তমস্য চ গৃহং যত্নৈরকার্ষীত্ স্বয়ং।।”

অর্থাৎ ১৬০০ শকাব্দের(১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দের) বৈশাখ মাসে শ্রী গোবিন্দের পাদপদ্মসেবী মহান পুরুষ রামদেব, লক্ষ্মীদেবী যাঁর পদসেবা করেন,তাঁর উপাসনার জন্য, যত্নের সঙ্গে শ্রী পুরুষোত্তমের এ মন্দির নির্মাণ করেন।

নদীয়ারাজ রুদ্র রায়ের সময়ে দেবগৃহটি নির্মিত।

এখানকার কৃষ্ণ রায় বিগ্রহ বারোদোলের সময়

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর

ক্ষুদ্র মূর্তিটি কষ্টিপাথর নির্মিত। এই মন্দিরে রাধিকা নাই, কিছু শালগ্রাম শিলা আছে। রাধিকা বিহীন কৃষ্ণমূর্তি বীরভূম জেলার কোন কোন মন্দিরে দেখা গেলেও পশ্চিমবঙ্গে বিরল।

         ইটের তৈরি জোড়বাংলা মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। সামনের দেওয়ালে একদা পোড়ামাটির প্রচুর মূর্তি ও অসাধারণ অলংকরণ ছিল ‌ কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ সংস্কারের ফলে সেগুলি চুন বালির পলেস্তারায় ঢাকা পড়েছে। পিছনের দোচালায় গর্ভগৃহে যাওয়ার প্রবেশ পথের উপরে পোড়ামাটির সূক্ষ্ম কারুকার্য এখনো দেখা যায়।

তার মধ্যে উল্লেখ্য চারটি মূর্তির মধ্যে দুটি চতুর্ভুজ শ্রীকৃষ্ণ এবং অপর দুটি রাজমূর্তি। ফ্রিলনের প্রান্তে মোট 14 টি আটচালা প্রতীক শিবমন্দির। সেগুলিকে বেষ্টন করে বারটি বাতিদান ও মেঝের অনুভূমিক হংসপংক্তি দেখা যায়। এছাড়া ফুল লতাপাতার কিছু নকশি কাজ এখানে আছে। অনুমান করা যায়, এ জাতীয় পোড়ামাটির সজ্জা একদা সামনের দেওয়ালেও ছিল।

কৃষ্ণ রায় কে কেন্দ্র করে স্থানীয় অনেক লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। কৃষ্ণরায় জিউকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর পহেলা মাঘ “উত্তরায়ন মেলা”নামে একটি মেলা বসত।

 এখানকার চাতর পাড়া প্রাচীনত্বে খ্যাত। সেখানে এক বিস্তীর্ণ স্থানে হরিনাম সংকীর্তন পূজা যাগযজ্ঞ ও হোমাদি হত।

 স্থানীয় দোল মন্দিরটি বর্তমানে প্রায় নিশ্চিহ্ন। বৈষ্ণবদের এককালীন প্রখ্যাত আখড়া এবং সাধনপীঠ চাতর এখন অতীতের নীরব সাক্ষী মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *