রাজীব তন্তুবায়

 সকাল থেকেই  মাইক বাজছে মনসা মেলায়। বিশাল সাইজের ডিজে মাইক। ধক্ ধক্ করে কাঁপছে সারা গ্রাম। খাঁদুলালের ছোট্ট চালাটাও কাঁপছে তাতে। ছাউনি থেকে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে গুঁড়ো খড়। নির্বিকার খাঁদুলাল। সে শুধু দড়ির খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ভিতরে। কোটরে ঢুকে যাওয়া ঘোলাটে চোখ দুটো স্থির হয়ে দেখছে, শেষ দুপুরের ঝকঝকে রোদ কীভাবে পচা খড়ের ফোঁকর দিয়ে নেমে আসছে মাথা শিতানে। যার থেকে কিছুটা আলো ছিটকে গিয়ে পড়েছে দেওয়ালে টাঙানো বাঁশের হুড়পির উপর। ছায়াময় কোনে চকচক করছে সাপ বিহীন হুড়পি দুটো। একসময় ওই হুড়পিগুলোতেই বড় বড় বিষধর সাপ এনে ধরে রাখতে খাঁদুলাল। বহুদিন একভাবে অকেজো হয়ে ঝুলে থাকার অভিমান যেন উপছে পড়ছে তাদের গা থেকে।

   হঠাৎ করে আলো কমে গেলে অবোধ শিশুর মতো চিৎকার করে উঠে খাঁদুলাল , “শ্যামা, অ্যা বাপ শ্যামা… কুথায় গেলি বাপ?” 

   বাবার কথায় কান করে না শ্যামাপদ। সে তখন বড় ঘরের বারান্দায় মাদুরের উপর বসে এক মনে মুখস্থ ‘সাকি’ আওড়ে চলছে বিড়বিড় করে। সামনেই কাঠের চৌকিতে রাখা আছে তেল চ্যাটচ্যাটে মলাটের ছোট্ট একটা খাতা। মাঝে মাঝে উল্টে নিয়ে একটু করে দেখে নিচ্ছে সেটা। যার ঈষৎ হলদে পাতায় কালি-কলমে লেখা রয়েছে ‘সাকি’ — মনসামঙ্গল ও পুরাণ মিশ্রিত শ্লোক, সঙ্গে কিছু মন্ত্র-গাথা। 

   হঠাৎ  করগেটের চালে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ফোঁটার পট্ পট্ শব্দ হতেই থমকে তাকায় শ্যামাপদ। দেখতে পায়, মন্ডলদের পাকা ছাদ পার হয়ে, বামুনদের সেগুন বাগানের উপর দিয়ে চাকভাঙা মৌমাছির মতো কালো মেঘটা ভিড় ভিড় করে এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকে। যেন এক্ষুনি হুল ফুটিয়ে জ্বলন ধরিয়ে ছাড়বে সবার।

    ডিজে মাইকটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন? তবে কি সত্যি সত্যি প্রচন্ড বৃষ্টি আসছে নাকি! বাড়তি উদ্বেগ নিয়ে কান খাঁড়া করে থাকে শ্যামাপদ।

  থাকবেই না বা কেন? গ্রামে এতো বড় পরব! ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজনের ভীড়। আর একটু পরেই মামনসার ‘ঘট’ বেরোবে মন্দির থেকে। শোভাযাত্রা সহকারে বড় পুকুর থেকে ‘বারি’ আনতে যাবে সবাই। এক সাথে বেজে উঠবে জোড়া জোড়া ঢাক,  কাঁসর, ঘন্টা, শাঁখ। পিছনে ডুগি, করতাল সহযোগে গান জুড়বে কীর্তনিয়ার দল। চলতে চলতে হঠাৎ করে একেকবার নির্দিষ্ট স্থানে থেমে যাবে সবাই। ঢাক তখন বন্ধ। সবাই নিশ্চুপ। সেখানেই ছড়ার মতো সুর করে গলা উঁচিয়ে ‘সাকি’ হাঁকবে শ্যামাপদ।  ছুঁড়ে দেবে পৌরাণিক প্রশ্ন। জবাব দেবে মনোহর গুনীন। তারপর মন্ত্রোচ্চারণ শেষে ঘট সুরক্ষিত ঘোষণা করলেই আবার বেজে উঠবে ঢাক গুড়গুড় করে। কিছুক্ষণ পরে মনোহর গুনীন আবার প্রশ্ন ছুড়ে দেবে ‘সাকি’র  সুরে। জবাব দেবে শ্যামাপদ। এইভাবে চলতে থাকবে বারি তোলার শোভাযাত্রা।

    এই প্রথম এতবড় গুরু দায়িত্ব পড়েছে শ্যামাপদর উপর। তা নিয়ে অবশ্য উত্তেজনা‌ও কম নেই তার। তাই তো সকাল থেকে উপোস করে ব্রতী হয়ে আছে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে কেমন সুর করে সাকি হাঁকত দাদু। তারপর বাবা। কিন্তু বুড়ো খাঁদুলাল বিছানা নিতেই বাধ্য হয়ে শ্যামাপদকে এগিয়ে আসতে হয়েছে এবার। তবে যেদিন প্রথম অসুস্থ খাঁদুলালকে দেখতে এসেছিল মনোহর গুনীন, সেদিন‌ই প্রথম ‘সাকি’ হাঁকার প্রস্তাবটা দিয়েছিল শ্যামাপদকে। শ্যামাপদ সেদিন প্রায় ‘না-ই’ বলে দিয়েছিল। মনোহর গুনীন অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলেছিল, “দ্যাখ বাপ, ইটা ত আর যা তা ব্যাপার লয়, মামনসার কাজ। সেই বহুদিন থাক্যে গাঁয়ে চলে আসছে। সেদিক দিয়ে ইটা ত একটা গ্রামের ঐতিহ্য‌ও বঠে। না করিস না বাপ।” কথাটা মন্দ বলেনি মনোহর গুনীন। ঐতিহ্য বা বটে। শোভাযাত্রায় লোকসমাগমের মাঝে “সাকি-মন্ত্র” পরবে অন্য মাত্রা আনে। তাহলেও মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতে ভাব কিন্তু ছিল‌ই। অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে যখন রাজী হল, তখন মনোহর গুনীন খুশি হয়ে বলেছিল, “চিন্তা কী ভাইপো, আমি ত আছি। চ ন সাহস করে, দু’জনে জমাই দিব আসরটাকে।” জমাতে পারবে কিনা জানেনা, তবে মনোহর গুনীনের কথায় মনে মনে কিছুটা হলেও সাহস পেয়েছে শ্যামাপদ। তাছাড়া এমনিতেই দাদু বাবার মুখে শুনে শুনে সব‌ই তো প্রায় ঠোঁটস্থ। সেদিক দিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তা নেই শ্যামাপদর।

     তবুও আজ বুকের ভিতরকার ধুকপুকানি ঢাকটা কেমন যেন ঢিপঢিপ করে বাজছে সকাল থেকে। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে এই যে এখন, দুপুর গড়াতে না গড়াতে শেষ-ভাদরের উড়ো মেঘ  তাদের করগেটের চালটা এমনি করে ফোঁটায় ফোঁটায় বাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তা যেন ঠিক মেনে নিতে পারছে না শ্যামাপদ। পরবটা কি তবে সত্যি সত্যি মাটি করে ছাড়বে নাকি এবছর? ভাবতে ভাবতে মাদুর ছেড়ে উঠোনে নেমে আসে।

  খাঁদুলাল তখন‌ও ডেকে চলেছে, “ক‌ইরে শ্যামা, কুথায় গেলি বাপ?”

  এই হয়েছে শ্যামাপদর আর এক জ্বালা। দিন দিন বাপটার অসুখটা যেন বেড়েই চলেছে। চোখের সামনে কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। তার জন্য তো কম দৌড়াদৌড়ি করেনি শ্যামাপদ! কত কত ডাক্তারের কত কত ওষুধ শেষ হয়ে গেল। তবুও আর কাজের কাজ হলো না কিছুই। 

   ইদানিং আবার ভুলভাল বকছে খাঁদুলাল। মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছে সব কিছু। আবার কখনও কখনও পুরানো দিনের কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠছে হাও হাও করে। গায়ের বল‌ও আর নেই তেমন। বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় না। নিজের চেষ্টায় কখনও সখন‌ও বড়জোর পিছন দিকের সরকারি ছাপ দেওয়া ছোট্ট ল্যাট্রিন পর্যন্ত হেঁটে যায়। তাও আবার একবার কি দু’বার। দুপুরে খাবার সময় একটু ধরে দিলে টলতে টলতে রান্না চালা অব্দি যাওয়ার চেষ্টা করে। বাকি সময় তো শুধু শুয়েই থাকে। ঘুমায়। জেগে থাকলে কত কী বকবক করে। আর যখন তখন হাঁক ছেড়ে শ্যামাপদকে ডাকতে থাকে। এই যেমন এখন ডাকছে একনাগাড়ে।

   “কী হল্য, অত গাঙাচ্ছ কেনে?” বিরক্ত ঝরে পড়ে শ্যামাপদর গলায়। 

  “হ্যাঁ বাপ, তোর মা কুথা গ্যাছে রে?”

  “মনসা মেলায় জাগর জ্বালাতে গ্যাছে। তুমাকে যে বলে গেল!”

   “অ…” বলে চুপ করে যায় খাঁদুলাল। শ্যামাপদ‌ও মায়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে। মা এলেই ধুতি পরে, গায়ে নতুন গামছা জড়িয়ে মন্দিরের দিকে রওনা দেবে। অসুস্থ বুড়ো বাপটাকে তো আর একা বাড়িতে রেখে বেরোনো যায় না।

   খাঁদুলাল বলে উঠে, “হ্যাঁ বাপ, ঝাপানের তোড়জোড় চলছে?”

   “ঝাপান?” একরাশ বিস্ময় নিয়ে শ্যামাপদ বলে, “এখন আর ঝাপান টাপান কিছু হয় নকি, যে তার তোড়জোড় চলবেক? উসব ত বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে! মনে নাই থানা-পুলিশের কথা?”

  হা হা করে হেসে উঠে খাঁদুলাল। হেসে হেসে বলে, “বন্ধ হবেক কেনে রে? আমি থাকতে উসব আরও বন্ধ হয়? এই মাত্র ভূপেন সাধু আমাকে ডাকতে আসেছিল।”

  চমকে উঠে শ্যামাপদ। ভূপেন সাধু তো আজ বহুদিন হলো গত হয়েছেন। তাহলে কি বাবা আবার ভুল বকতে শুরু করল? ভাবতে না ভাবতেই গায়ের লোমগুলো সব শিউরে উঠে শ্যামাপদর।

  খাঁদুলাল বলতে থাকে, “ক‌ইরে শ্যামা, যা তোর মাকে ডাক। আমার গেরুয়া রঙের ধুতিটা আর গেঞ্জিটা বার করে দিতে বল। আর তুই বাপ একটু সাপের হুড়পিগুলা বয়ে নিয়ে চল।” বলেই হঠাৎ করে হাততালি দিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠে, “বাজুক বিষম ঢাকি, চলুক ঝাপান…” 

    তালি দিতে দিতে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। টলতে টলতে চালা থেকে বেরিয়ে আসে বাইরে। বর্ষার জলে মাটি ধুয়ে যাওয়া উঠোনের এবড়ো খেবড়ো পাথরে হোঁচট খেয়ে এই পড়ে যায় যায়। তার আগেই ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে শ্যামাপদ। জোর গলায় বলে, “কুথা যাবে তুমি? পড়ে গেলে এখুনি কী হবেক? পরবের দিনে বিপদ বাড়াবে ন-কি ?”

  “কীসের বিপদ?” হ্যাঁচকা মতো হাতটা ঘুরিয়ে খাঁদুলাল বলে, “আমি না গেলে ঝাপান হবেক? সাপগুলাকে কি এমনি এমনি ধরে রাখেছি?”

   “কী সব উল্টাপাল্টা ব‌কছ! সাপ কুথায়? চল দেখি, খাটে শুবে চল।” ধমক দিয়ে উঠে শ্যামাপদ। কিছুটা থতমত খেয়ে  ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে খাঁদুলাল। ধরে থাকা অবস্থায় বাবার ভিতরের কাঁপুনিটা তখন টের পায় শ্যামাপদ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চালার ভিতর নিয়ে গিয়ে বিছানাতে বসায়। গ্লাসে জল নিয়ে মুখের সামনে বাড়িয়ে দেয়। ঢক ঢক করে গিলতে থাকে খাঁদুলাল। তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ে বিছানায়। পাশে একটা ছোট্ট টুল নিয়ে বসে বাবার মাথায় হাত বুলাতে থাকে শ্যামাপদ। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে  ঝুলন্ত হুড়পিগুলোতে দৃষ্টি আটকে যায়। 

   হঠাৎ মনসা মন্দিরে একসাথে গুড় গুড় শব্দে ঢাক বাজতে শুরু করে। তাতে যেন একটুখানি নড়ে উঠে হুড়পিগুলো। যেখানে থেকে বেরিয়ে আসে টুকরো টুকরো স্মৃতি। এক এক করে  মনে পড়ে যাচ্ছে সব। মনে পড়ছে কেমন করে লাল টুকটুকে সিঁদুর লেপে, পদ্ম ফুল আর অপরাজিতা ফুলের মালা জড়িয়ে সদ্যপূজিত মামনসার ঘটভাঁড় মাথায় নিয়ে তার মা এগিয়ে যেত ঝাপানের আসারে। ওই তো, আজ‌ও যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে শ্যামাপদ। দেখতে পাচ্ছে, কেমন করে হুড়পি থেকে সাপ নিয়ে ঝাপানের মাচায় উঠে পড়েছে খাঁদুলাল। পরনে গেরুয়া বসন, মাথায় লাল গামছার পাগড়ী, গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে ঘটভাঁড় থেকে নেওয়া লাল তিলক। কী ভীষণ রূপ তার, যেন এক অন্য মানুষ। গলায় জড়িয়ে রয়েছে কাল কেউটে। ফনা তুলে দুলছে একটু একটু করে। নরম রোদে হীরের মতো চকচক করছে সারা গা।  দু’হাতে দুটো জাত গোখরো। বাঁশের মাচার উপর নাচতে নাচতে সাপ খেলাচ্ছে খাঁদুলাল।  

    চারিদিকে গিজগিজ করছে লোকে। কী অদ্ভুত কৌতুহল তাদের চোখেমুখে। ‘জয় মা মনসা — জয় মা বিষহরী — জয় বাবা শিবশঙ্কর’ বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে সবাই। ভূপেন সাধু সুর করে ছড়া কাটছে। শেষে জোর গলায় বলছে,  “বাজুক বিষম ঢাকি, চলুক ঝাপান…”  স্পষ্ট যেন শুনতে পাচ্ছে শ্যামাপদ।

  ওই তো আর এক মাচায় সাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে জোড়দা গ্রামের মোহন গুনীন। সুর করে প্রশ্ন ছুড়ে দিল খাঁদুলালের দিকে। খাঁদুলাল‌ও হাসতে হাসতে জবাব দিল সুরে সুরে। ভুপেন সাধু খাঁদুলালের সাথে গলা মিলিয়ে যেই বলে উঠল আবার, “বাজুক বিষম ঢাকি, চলুক ঝাপান…”, অমনি ঢাকিরা সব গুড় গুড় করে ঢাক বাজতে শুরু করে দিল আবার। এই যেমন এখন  ঢাক বাজছে মনসা মেলায়। একটা ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে শ্যামাপদ। সেদিনের ঢাকের সাথে আজকের ঢাকের কোনো তফাৎ খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোথায় ঢাক বাজছে — ঝাপনের আসারে না মনসা মেলায়, বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। তার দু’চোখ জুড়ে তখন কিলবিল করছে সাপ। যে সব সাপ একসময় তাদের এই চালাঘরে এই হুড়পিগুলোর ভিতর থাকে থাকে সাজিয়ে রাখত বাবা।

   হ্যাঁ, সাপ ধরায় খাঁদুলাল ওস্তাদ ছিল বটে। মনসা পূজার ঠিক আগে আগেই ভূপেন সাধুকে সঙ্গে নিয়ে সাপের খোঁজে বেরিয়ে পড়ত এদিক সেদিক। বন-জঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে খুঁজে খুঁজে ধরে আনত বড় বড় বিষধর সাপ। খরিস, গোখরো কেউটে আরও কত কী! এলাকায় কারো বাড়িতে সাপ বেরিয়েছে তো অমনি ডাক পড়ত খাঁদুলালের। খাঁদুলালও ছুট্টে গিয়ে ধরে নিয়ে এসে হুড়পিতে বন্দি করে রাখত চালাঘরের কোনায়। 

     যত্ন আত্তিতে কমতি ছিল না তার।। ব্যাঙটা, মাছটা যখন যেটা পেত ধরে ধরে এনে খাওয়াত ওদের। শুধু তো ঝাপান নয়, সারা ভাদ্র আশ্বিন মাস জুড়ে প্রায় দিনই ভুপেন সাধুকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে, হাটে, মোড়ে সব জায়গায় খেলা দেখতে বেরিয়ে পড়ত খাঁদুলাল। তারপর যেই আশ্বিন মাসের ডাক সংক্রান্তি পেরিয়ে কার্ত্তিক মাস পড়ে যেত। হালকা শীত নেমে আসত হাওয়া বাতাসে। অমনি সব কটাকে ছেড়ে দিয়ে আসত বাহাবুড়ির জঙ্গলে। ছাড়া পেয়েই যে যেদিকে পারত কিলবিল করে ছুটত সব। কেউ যদি ফনা তুলে ঘুরেও দাঁড়াত একটু খানি, খাঁদুলাল তখন হাসি হাসি মুখ করে বলত, “যাও মা যাও, শীতঘুমে যাও। আসছে বছর ডাকলেই আসবে আবার, যাও।”

    বছর কয়েক আগে, মনসা পূজার  ঠিক আগের দিন। দুটো কালো গাড়িতে কর একদল লোক আর সঙ্গে গোটা কয়েক পুলিশ এসে হাজির হল তাদের বাড়িতে। খাঁদুলাল তখন দুপুরের খাওয়া সেরে উঠোনের খাটে বসে বিড়ি টানছে আয়েস করে। শ্যামাপদ এই ফিরেছে মাঠ থেকে। পুলিশ দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে নুকিয়ে দেয় কপাট কোনে।

  একজন অফিসার গোছের লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে বলেন, “এটা কী খাঁদুলাল গুনীনের বাড়ি?”

  খাঁদুলাল ধড়ফড় করে উঠে পর জোড় হাত করে বলে, “আজ্ঞে আমিই খাঁদুলাল। হঠাৎ আপনরা…” 

  অফিসার এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলেন, “কিছু মনে করবেন না, আমরা খবর পেয়েছি আপনার বাড়িতে অনেক সাপ ধরে রাখা আছে।”

   “হ, সে ত রাখা আছেই। ই আবার নতুন কথা কী?”

  অফিসার বলেন, “কিন্তু এবার থেকে তো আর বাড়িতে এইভাবে সাপ ধরে রাখতে পারবেন না। কোথায় রেখেছেন বলুন, আমরা ওগুলো নিয়ে যাবো।”

   “নিয়ে যাবেন মানে?” রুখে দাঁড়ায় খাঁদুলাল। “কাল বাদে পরশু ঝাপান, আর লিয়ে যাবেন বললেই হ‌ইল!”

  অফিসার বুঝিয়ে বললেন, ” দেখুন আমাদের কিছু করার নেই। উপর মহলের নির্দেশ। আপনি যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন, তাহলে কিন্তু আপনাকেও আমরা বাঁচাতে পারবো না। তাই ঠিকমতো বলুন, সাপগুলো রেখেছেন কোথায়?”

  হাতে পায়ে ধরে আটকানোর চেষ্টা করেছিল খাঁদুলাল। কিন্তু যখন আর কিছুতেই পেরে উঠল না তখন বাধ্য হয়েই মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা হাতে  আঙ্গুল বাড়িয়ে চালা ঘরটা দেখিয়ে দিয়েছিল। 

   অফিসারের নির্দেশ পেতেই জনা চারেক খাকি পোশাক পরা লোক ঢুকে পড়ল চালা ঘরে।  একে একে সব সাপ নিয়ে গিয়ে তুলল গাড়িতে। খাঁদুলালকেও তুলে নিয়ে গেল ওরা। হ‌ইচ‌ই পড়ে গেল সারা গ্রামে। ওরা যেতেই শ্যামাপদ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালে মন্ডল পাড়ার পার্টি অফিসের দিকে। কিছুক্ষণ পর খাঁদুলাল ফিরল ঠিকই। সাপগুলো আর ফিরলনা। 

   হঠাৎ  খক্ খক্ করে কেশে উঠে খাঁদুলাল। কিছুটা চমকে গিয়ে সম্বিত ফেরে শ্যামাপদর। হুড়পি থেকে চোখ সরিয়ে বাবার বুকে মাথায় ভালো করে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, “ঘুমাও, ঘুমাও…”

  একবার চোখ মেলে ছেলের দিকে তাকায় খাঁদুলাল। “অ—” বলে চোখ বুজে আবার।  শ্যামাপদর চোখদুটো ছলছল করে উঠে। মনে মনে ভাবে, কয়েক বছর আগে যে মানুষটা  এমনি দিনে সারা গায়ে সাপ জড়িয়ে মেতে উঠত “ঝাপান” খেলায়, সেই মানুষটাই আজ কেমন মন্ত্রপুত সাপের মতোই জড়ো হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। হায় রে সময়! কে তোর নাগাল পায়? — ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শ্যামাপদ।

   “ক‌ই রে খোকা, কুথা গেলি? যা ইবার বারি আনতে বেরুচ্ছে সব।” মায়ের গলা পেয়ে একটু নড়েচড়ে বসে শ্যামাপদ।  বাপ ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায় মা। তাড়াহুড়ো করে বলে, “কী হল, তোর বাপের আরও বাড়াবাড়ি কিছু…”

   “না, না, কী আর হবেক? এমনি।” মাকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে শ্যামাপদ বলে, “বারি বেরুচ্ছে?”

   “হ, এইবার বেরুচ্ছে, যা।”  

    টুল ছেড়ে উঠে চালা থেকে বেরিয়ে আসে শ্যামাপদ। বড় ঘরে ঢুকে নতুন ধুতি আর গায়ে নতুন গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। বারান্দায় মাদুর থেকে খাতাটা তুলে নেয় হাতে। সোজা তুলসী থানে গিয়ে পড়ে দেয় ষষ্টাঙ্গে। জোড় হাত করে প্রণাম করে একটু মাটি নিয়ে তিলক করার মতো টেনে নেয় কপালে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মা। উঠে পর তাকে প্রণাম করে আবার চলা ঘরে ঢুকে শ্যামাপদ। হাঁটু গেড়ে বসে শায়িত বাবার পা দুটো মাথায় ঠেকাতেই হু হু করে কেঁদে উঠে । পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে মা বলে, “যা বাপ, আর দেরি করিস না। মনোহর গুনীন তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

  চোখ মুছে উঠে পড়ে শ্যামাপদ। খাতাটা হাতে নিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে যায় মনসা মন্দিরের দিকে। বৃষ্টি থামলেও মেঘটা তখন ঘোর করে ঢেকে ফেলেছে উপরের আকাশটাকে।

                      (২)

 বারি আনতে বেরিয়ে পড়েছে সবাই । চারিদিকে ঠাসা ভিড়।  মন্দির চত্বর থেকে রাস্তা অব্দি যে দিকে তাকায় সেদিকেই লোক। ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় শ্যামাপদ। কীর্তনের দল ছোটো ঢাকি, করতাল সহযোগে সুর ধরেছে একসাথে: 

   “মাকে আনতে যাব গো, ক্ষীর নদীর কুল,

    হাতে দিব লাল জবা, চরণে দিব ফুল,

    ও—মাকে আনতে যাব গো.…”

 তাদেরকে ঠেলে আর একটু এগিয়ে যায় শ্যামাপদ। দু’জন ব্রতী মাথায় দুটি নতুন  পোড়ামাটির ঘটভাঁড় নিয়ে এগিয়ে চলছেন ধীর গতিতে। এই ঘটভাঁড়েই বড়পুকুরে মামনসার বারি উঠবে। এদের ঘিরে রেখেছে বাকী সমস্ত ব্রতী মানুষজন। প্রত্যেকেরই পরনে  সাদা ধুতি আর গায়ে জড়ানো নতুন গামছা।

     অন্য দু’জন ব্রতী মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাত পা মেলে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে চলেছে সমান তালে। ভরন এসেছে তাদের। ঢাকিরাও যেন তাদের তালে তাল দিয়ে ঢাক বাজিয়ে চলছে মহানন্দে। কাঁসর বাজছে, ঘন্টা বাজছে, শাঁখ বাজছে । থেকে থেকে উলুধ্বনি দিয়ে উঠছে মহিলার দল। কিছুটা আগে উঠতি ছেলেরা সব বাজি ফাটাচ্ছে। শব্দবাজি, আতসবাজি, বাদ নেই কিছু। সারাবছর ভিন রাজ্যে কাজ করে ওরা। পরবের এই দিনে নতুন উন্মাদনায় বাড়ি ফিরে ওরা। ফুর্তি তো করবেই। অন্য বছর শ্যামাপদও যোগ দিত তাদের দলে। কিন্তু এবছর সেসবের দিকে খেয়াল নেই তার। সে শুধু দু’হাত দিয়ে লোক সরিয়ে আর একটু এগিয়ে গিয়ে ব্রতীদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মনোহর গুনীন তাকে দেখতে পেয়ে অতি উৎসাহী হয়ে বলে, “অ্যা বাপ, আসেছু? তোকেই আমি খুঁজছিলাম কখন থাকে। লে খাঁদুদার মতো সুর করে জয় মা বলে সাকিটা শুরু কর দেখি একবার।” বলেই ঢাকিদের দিকে ধেয়ে যায় হাত তুলে। ঢাক বাজানো থেমে গেলে থেমে যায় সকলে। জোড় হাত করে দাঁড়িয়ে পড়ে যে যার মতো। শ্যামাপদ আলতো করে ঢোক গিলে জোর গলায় শুরু করে সাকি। 

   শ্যামাপদ থামলে আপন সুরে জবাব দেয় মনোহর গুনীন। আবারও ঢাক বেজে উঠে একসাথে। আবারও চিৎকার, কোলাহল, বাজি পটকার আওয়াজ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। আবারও চলতে শুরু করে শোভাযাত্রা।

   একটুখানি পিছিয়ে গিয়ে দম নেয় শ্যামাপদ। জোরে জোরে বুকটা উঠানামা করলেও গা-টা বড়ো ফুরফুরে লাগছে তার। 

  মনোহর গুনীন কাছে এসে পিঠ চাপড়ে বলে, “না বাপ, বংশের নাম ধরে রাখতে পারবি তুই। আমরাও নিশ্চিন্ত হ’লম। বড় ভালো লাগল রে।” 

   “সবই মামনসার কৃপা, আর তুমাদের আশীর্বাদ, খুড়া।” বলেই জোড় হাত করে মাথায় ঠেকায় শ্যামাপদ। মনে মনে বেশ গর্ব করতে ইচ্ছে হয় এখন। পাশাপাশি চেয়ে দেখে কেউ তাকে চেয়ে দেখছে কিনা। না, কেউ দেখছে না। সবাই নিজের নিজের মতো ফুর্তি করতে ব্যস্ত। বরং ভিড়ের মাঝে হঠাৎ তার মাকে এগিয়ে আসতে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে যায় সে।

   কাছাকাছি আসতেই মা বলে, “অ্যা খোকা, চ দেখবি তোর বাবা কেমন করছে দেখবি চ। আমি একা মিয়া মানুষ সামলাতে পারছি নাই।”

   শুনা মাত্রই মনোহর গুনীনকে বলে, “তুমি একটু ম্যানেজ কর খুড়া। আমি একটু আসছি…” বলতে না বলতে ভিড় ঠেলে ছুট্টে বেরিয়ে যায় শ্যামাপদ। পিছনে সাকি গান, ঐতিহ্য, উৎসব। সামনে বাবা। মাঝে দোটানায় শ্যামাপদ। হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে সে। যতই এগোচ্ছে, তত‌ই যেন পিছনের ঢাকের শব্দটা তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। তবুও ছুটছে সে। ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায় দুয়ারে। উঠোনের মাঝে দু’হাতে দুটো হুড়পি নিয়ে সাপ খেলানোর ঢঙে নাচ করছে খাঁদুলাল। বিস্ফারিত চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে তার। কে বলবে এই মানুষটাই রোগীর বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে মাস ছয়েক। হুঙ্কার করতে করতে একটাই কথা বলে চলেছে বারবার, “বাজুক বিষম ঢাকি, চলুক ঝাপান…!”

     থর থর করে কাঁপতে থাকে শ্যামাপদ। পা যেন এগোতে চায় না আর। কী করবে সে? চোখের সামনে বিষম নাচ নাচছে বাবা। নাচতে নাচতে  হঠাৎ ধপ করে মাটিতে পড়ে যায় খাঁদুলাল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে হুড়পিগুলো। চাকার মতো গড়াতে গড়াতে এগিয়ে আসে শ্যামাপদর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দেয় শ্যামাপদ। হুড়পি ডিঙিয়ে এগিয়ে যায় খাঁদুলালের দিকে। খাঁদুলাল তখন মু-জুবড়ি খেয়ে পড়ে আছে মাটিতে। শ্যামাপদ দু’হাত দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করে তাকে। কিছুতেই আর উঠাতে পারে না মাটি থেকে।

    মাও তখন ছুটে এসেছে পিছনে। দু’জন মিলে হাত লাগায়। ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যায় চালার ভিতর। চোখেমুখে জল দেয় শ্যামাপদ। মা তখন হাত পাখা নিয়ে বাতাস করতে থাকে জোরে জোরে। চোখ মেলে তাকায় খাঁদুলাল। মুখ হাঁ করে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে জড়ানো গলায় বলে, “ঝাপান হচ্ছে, খোকা, ঝাপান….”

   কথা বাড়ায় না শ্যামাপদ। মুখের সামনে গ্লাসটা তুলে ধরে বলে,”লাও জল খাও।”

   বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। এতক্ষণ যে মেঘটা গুম হয়ে ঢেকে রেখেছিল আকাশটাকে, সেই মেঘটাই যেন সুযোগ পেয়েছে ঝরে পড়ার — অপেক্ষার প্রহর শেষে উন্মাদনায় মেতে উঠার। ঝরছে মেঘটা। জল বাড়ছে উঠোনে। মাটিতে পড়ে থাকা হুড়পিগুলো ভেসে উঠছে জলে। জলের তোড়ে ঠেলা খেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে দুয়ারের দিকে, যে পথ দিয়ে বাড়ির সমস্ত বৃষ্টি ধোওয়া ঘোলা জল রাস্তায় গিয়ে মেশে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

                                —০—

2 thoughts on “ হুড়পি

  1. গল্পটি আমার খুব ভালো লাগে। আগে কোথাও প্রকাশিত হয়েছে। পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *