রম্যরচনা

অধ্যায় : এক

হাচিয়া ফালের সবাই শত্রু। সে এমন এক জগতে বসবাস করে যেখানে কেউ তার মিত্র নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, জায়গাটা আবার পৃথিবী। ওইজন্যই যত বিপদ। যদি সে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে থাকত আর এমন শত্রুবেষ্টিত হত তো পৃথিবীতে এসে বেঁচে যেত। ঝামেলা হয়েছে পৃথিবীতে সে থাকছে বলেই। চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার উপায় নেই, যেহেতু ওই স্থানগুলো মানুষের বাসযোগ্য নয়। 

হাচিয়া ফাল, তার পিতা ভাগিয়া ছাল এবং মাতা নাচিয়া ঝাল। তারা সব ইয়া-সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। তাদের সবারই নামের শেষে ইয়া শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন, তার এক মাসির নাম কাঁদিয়া খাল ও মামার নাম হাঁটিয়া  হাল। আবার দুই কাকার নাম ফাটিয়া থাল ও বাঁচিয়া কাল এবং পিসির নাম ঢাকিয়া গাল। এইসব ইয়া-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকের চরিত্রে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্তমান। যেমন, তার কাকা বাঁচিয়া কালের স্বভাব সবার পিছনে লাগা, বাবা ভাগিয়া ছালের সর্বদাই পালাই-পালাই ভাব, মা নাচিয়া ঝালের বকাঝকা ও ঝগড়া করার ক্ষমতা দেখে মড়া মানুষও জ্যান্ত হয়ে নেচে ওঠে, আবার মামা হাঁটিয়া হাল কেবল সর্বক্ষণ হাঁটাহাঁটিতেই ব্যস্ত, মাসি কাঁদিয়া খাল কেবল কান্নাকাটি করতেই জানে, পিসি ঢাকিয়া গাল কী যেন কারণে বা ভয়ে সব ঢাকাঢুকি করে রাখে। অন্য কাকা ফাটিয়া থালের ফাটাফাটি কীর্তিকান্ড। হাচিয়া ফাল নিজে প্রবল সন্দেহপ্রবণ মানুষ। সে সবাইকে শত্রু বলে ভাবে এবং ওইটা ভাবলেই সে বাঁচতে পারে। 

এত এত শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে বসবাস করা যে কী দুষ্কর কাজ তা একমাত্র হাচিয়া ফালই জানে। তার কপালগুণে কিংবা দোষে যে তার সংস্পর্শে আসে সে-ই তার শত্রু বলে প্রতিপন্ন হয়। বন্ধু হিসেবে কাউকে পাওয়ার সে অনেক চেষ্টা করেছে। সবই নিষ্ফল হয়েছে, এমনই তার ভাগ্য মন্দ। সে শুনেছিল যে কুকুর সর্বদাই প্রভুভক্ত হয়। বন্ধু পাওয়ার ব্যাকুল আগ্রহে সে একবার একটি কুকুর পুষেছিল। সেই কুকুরও একদিন অকারণে বা অজানা কারণে তার শত্রু হয়ে গিয়ে তাকে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিয়েছিল। গাদা গাদা ও গোদা গোদা ইনজেকশন নিয়ে এবং চব্বিশঘন্টা না ঘুমিয়ে না খেয়ে না ঘুরে ঠায় ঘরে বসে বসে দিনরাত জলাতঙ্কের দুশ্চিন্তায় ভুগে ভুগে তার কুড়ি কিলো ওজন বেড়ে গিয়েছিল। তখন তার মনে হয়েছিল, পরিবেশ এবং পরিস্থিতিও তার শত্রু, নাহলে না খেয়ে না ঘুমিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে কার ওজন বেড়ে যায় ? নিজের পোষ্য কুকুর প্রভুকে কামড়ায়, একথাই বা কে কবে জন্মে শুনেছে? এই ঘটনা অথবা দুর্ঘটনার পর সে আর কাউকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা করেনি, জগতে কেউ তার বন্ধু হতে পারে বা হবে এমন সন্দেহও মনে ঠাঁই দেয়নি।

একদা সে তার শত্রুদের নামের একটি লিস্টি বানাতে শুরু করেছিল। একদিনেই সব নাম লিখে ফেলবে ভেবেছিল। একদিন কেন, এক সপ্তাহেও লিখে কুলিয়ে উঠতে পারল না। এক মাসেও সম্ভব হল না সব নাম লেখা। দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল, তবুও শত্রুদের নাম লেখা চলছে তো চলছেই। সেই লিস্টি লেখার কাজ তারপর সে আর থামাতে পারেনি। রোজই সে লিস্টিতে নাম লিখে যায়। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ভুলে গেলেও লিস্টিতে নিত্যনতুন শত্রুদের নাম নথিভুক্ত করার কাজ সে কোনদিনও বাদ দেয় না। অবসর সময়ে বা অসময়ে ওই লিস্টি লিখেই তার সময় কাটে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে লিস্টিতে রোজ নতুন শত্রুদের নাম না লিখলে তার বদহজম হয়ে যায়। ইদানিং আবার সে এক নয়া বিষয় আমদানি করেছে ওই লিস্টিতে। আগে কেবল নাম লিখেই সে ক্ষান্তি দিত, এখন নামের পাশাপাশি শত্রুদের কার্যকলাপ ও কেন তারা তার শত্রু সেসব বিবরণও সবিস্তারে লিখে রাখে। ব্যাপারটা তার এমনই নেশার কারণ হয়ে গেছে যে লিস্টি লেখার উদগ্র উত্তেজনা ও আগ্রহে তার ভোররাতেই তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে স্বপ্নে এমন সব শত্রুর হদিশ পায় যাদের সে বাস্তবে দেখেইনি কোনদিন। তাদের নাম এবং বিবরণও সে লিস্টিতে লেখে। ফলে তার লিস্টি এখন দ্বিধাবিভক্ত, একটি ভাগের নাম বাস্তব শত্রুসমূহ এবং অন্য ভাগের নাম স্বপ্নাদ্য শত্রুসমূহ। পরে ভেবেচিন্তে সে লিস্টিতে তৃতীয় একটি ভাগের সংযোজন করেছে কল্পিত শত্রুসমূহ বলে যেখানে থাকে এমন শত্রুদের নাম যাদের সে বাস্তবে বা স্বপ্নেও দেখেনা, কেবলই হতে পারে বলে কল্পনা করে। 

অর্থাৎ দাঁড়ালো এই যে শত্রু তালিকাভুক্তির কোন নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। অহরহ চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেসমস্ত ব্যক্তিবর্গ ও জীবকুল, অবস্থানরত রয়েছে যেসব বস্তুসমূহ তারা অনায়াসে হাচিয়া ফালের শত্রু হয়ে যেতে পারে। বিবেচনা করলে দেখা যায়, জগতে প্রতিটি বিষয়ের মধ্যেই শত্রু হওয়ার অনুকূল উপাদান বর্তমান এবং প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে শত্রু হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা। যে জল পান করা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য সেই জলই আবার লোককে ডুবিয়ে মারে। এভাবে প্রতিটি বস্তুই কোন না কোনভাবে শত্রুসুলভ আচরণ করে। ঘটনা হল এই যে আমরা সাধারণ মানুষ সেসব বিষয় দেখতে পাই না, দেখার সেই চোখ নেই আমাদের। সৌভাগ্যক্রমে, হাচিয়া ফালের রয়েছে সেই অন্তর্দৃষ্টি, তাই সে শত্রুদের নির্ভুলভাবে শনাক্ত করে মহাভারততুল্য শত্রুতালিকা নির্মাণ করতে পারছে। আশা করা যায়, কোন একদিন সে তার এই মহাকীর্তির কল্যাণে অমর হয়ে যাবে যদিও লোকেরা এখন তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। তাতে অবশ্য তার দুঃখ নেই, কারণ লোকে পড়ে তাকে বাহবা দেবে এই উদ্দেশ্যে সে শত্রুতালিকা নির্মাণের কাজে হাত দেয় নি, সে এই চিরস্মরণীয় কাজ করছে শত্রুদের এড়িয়ে নিজে বেঁচে থাকার জন্য।

হালে যেভাবেই হোক, হাচিয়া ফালের লিস্টির কিয়দংশ আমাদের হস্তগত হয়েছে। পাঠ করে মনে হয়েছে যে তা অতি প্রয়োজনীয় এক আকর্ষণীয় বিবরণী। জগতে এত প্রকারের শত্রু এত ভাবে হতে পারে তা ভাবা যায় না। সকলেরই সে বিষয়ে অবগত হওয়া উচিত। তাহলে সবাই সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সমস্ত শত্রু সম্পর্কে সাবধান থাকতে পারবে। শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তিদের বিষয়ে কেউই বিশেষ সচেতন নয়। সে কারণেই নানা জনের নানা বিপদ ঘটে থাকে। হাচিয়া ফালের বিবরণী পড়লে শত্রুদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে একটি আন্দাজ পাওয়া যাবে। সে কারণেই হাচিয়া ফালের শত্রুদের তালিকা ও কার্যকলাপের বিবরণী সবার জন্যই অতীব উপকারী। এই তালিকার বাস্তব কার্যকারিতা তাই উপেক্ষা করা যায় না। 

এই কারণবশতই প্রকাশিত হল এই কাহিনী, হাচিয়া ফালের শত্রুরা। আশা করা যায় যে কাহিনীটি আদ্যোপান্ত জেনে সকলেরই সবিশেষ উপকার হবে। মূল কাহিনীর ভূমিকা হিসেবে তাই এত কথা বলা, যা অপরিহার্য ছিল। আগামী পর্ব থেকে বিচিত্র চরিত্রের শত্রুবর্গের পরিচিতি একে একে প্রদান করা যাবে। তথ্যসূত্র অবশ্যই হাচিয়া ফালের তৈরি করা শত্রুতালিকা, এই কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে সবাইকে না জানিয়ে রাখা রীতিমত অপরাধ।

অধ্যায় : দুই

হাচিয়া ফাল একদিন রাস্তায় বেরিয়েছে। 

রাস্তায় সবাই যেতে পারে, কারো তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। হাচিয়া ফাল যদি রাস্তায় বার হয় কার কিছু কি যায়-আসে? রাস্তা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। যে কেউ সেখানে ইচ্ছে হলেই যেতে পারে। সবারই রাস্তায় যাওয়ার সমান অধিকার রয়েছে, যে সরকারকে ট্যাক্স দেয় সে যেমন যেতে পারে, যে ট্যাক্স দেয় না তারও রাস্তায় যাওয়া কেউ আটকাতে পারে না, স্বয়ং সরকার বা তার প্রশাসনও নয়। যদি সরকারকে ট্যাক্স না দিলে রাস্তায় যাওয়া নিষিদ্ধ হত তো পাগল বা কুকুরদের রাস্তায় দেখা যেত না। লক্ষণীয় যে, অধিকাংশ পাগল এবং কুকুররা সর্বক্ষণই রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় অথচ তারা কেউ সরকারকে ট্যাক্স দেয় না। সাদা কথা হল, সবাই রাস্তায় ইচ্ছে হলেই যেতে পারে, সরকারকে ট্যাক্স দিল কী না দিল সেটা কোন ব্যাপার নয়। স্বয়ং সরকার যদি কারো রাস্তায় যাওয়াতে বাধা না দেয় তো সাধারণ কোন লোক বাধা দেবে হতে পারে না। এসবই হল হাচিয়া ফালের ভাবনার একফালি দৃষ্টান্ত। সে কেমন ভাবে, কী ভাবে, কিভাবে ভাবে অতঃপর আশা করা যায় বারবার না বলে দিলেও নিজগুণে সবাই সেসব অনুমান করে নিতে সক্ষম হবে।

এসব যুক্তি-তর্ক ভেবে হোক বা না ভেবে, হাচিয়া ফাল একদিন রাস্তায় বার হয়েছিল। কী কারণে সেটা দেখার বিষয় নয়, কেউ কেবল কারণ থাকলেই রাস্তায় বার হবে এমন নিয়ম হলে জীবন চলে না। অকারণেও কেউ যেতে পারে রাস্তায়। কী কারণে বা এমনি এমনি সে রাস্তায় গিয়েছিল সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কী ঘটল সেটা হল দেখার বিষয়। 

অনেক লোকই ছিল রাস্তায়, যেমন থাকে। তাদের দিকে বিশেষ নজর না ফেলে এবং তাদের কথায় কর্ণপাত না করে সে হেঁটে যাচ্ছিল নিজের মত। হাঁটছিল সে আপনমনে, হঠাৎ তার দেখা কূটকচালি বাবুর সঙ্গে। লোকটা কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, তাকে দেখেই হৈ হৈ করে বলে উঠল,

‘আরে এই যে হাচিয়া ফাল। কী খবর ?’

লোকটাকে দেখেই সে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, কথা শুনে সেই শঙ্কা আরও বেড়ে গেল। খামোখা কেউ কারও খবর জানতে চাইবে কেন? উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় সাধু হতে পারে না। খবর জেনে তারপর পিছনে লাগার ধান্দা। হতেই পারে। কাউকে বিশ্বাস নেই। এইসব লোক, যারা রাস্তায় দেখা হলেই ডেকে খবরাখবর নিতে চায় তারা বিশেষ সুবিধের পাত্র হয় না, সে তা নিজের বিবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানে। বহুবার বহু লোকের সঙ্গে সরল বিশ্বাসে তাদের খেজুরে আলাপের সামিল হতে গিয়ে দেখেছে সে যতটা সরল লোকগুলি একেবারেই তেমন নয়, তারা তাকে এমনসব কথা শুনিয়ে দেয় যা কোন না কোনভাবে সেইসব ব্যক্তিদের আত্মপ্রচার অথবা তার জন্য অপপ্রচার, যা যেকোনভাবেই তার অশেষ মানসিক ক্লেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর কিছু না হোক, আজেবাজে কথা বা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তারা এমনই বাক্যজালে আবদ্ধ করে রাখবে যে সময় ও প্রয়োজনীয় কর্মসম্পাদনের বারোটা বেজে যায়। এভাবে এইসব উটকো লোকজন রাস্তাঘাটে সদাসর্বদা শত্রুতা করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। তাদের খপ্পর থেকে অতি সাবধানে নিজের গা বাঁচিয়ে চলতে না জানলে বিপদ অনিবার্য।

তবুও উত্তর কিছু একটা দিতেই হয় ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু কী উত্তর দেবে? ভাল বললে লোকটা তার খারাপ করার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে, আবার খারাপ বললেও বিপদ আছে। তার খবর খারাপ জানলে লোকটা তার ভাল করার চেষ্টা না করে উল্টে তাকে আরও বেকায়দায় ফেলার ফন্দি আঁটতে পারে। চট করে এতসব চিন্তাভাবনা মাথায় খেলিয়ে হাচিয়া ফাল ভাল-খারাপের মাঝামাঝি একটা উত্তর দিল বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে। সে বলল,

‘এই চলে যাচ্ছে।’

‘চলে যাচ্ছে কী হে? দেখে তো মনে হচ্ছে বহাল তবিয়তেই আছ, যদিও চেহারা একটু আমসিমার্কা লাগছে।’

লোকটা শোরগোল তুলে জানাল। শুনে তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। মতলবটা ভাল নয় অবশ্যই। সে বহাল তবিয়তে আছে কী নেই সেটা তার ব্যাপার। লোকটা কেন এমন মন্তব্য করবে? তাছাড়া তার চেহারা আমসিমার্কা বলায় সে আরও চটে গেল। আমসিমার্কা চেহারা নিশ্চয়ই ভাল বিষয় নয়। এসব বলে তার মন খারাপ করে দেওয়ার কোন চাল হতেই পারে। হাচিয়া ফাল লোকটার উদ্দেশ্য আন্দাজ করতে গিয়ে কোন উত্তর দিল না। কূটকচালি বাবু নিজেই আবার জিজ্ঞেস করল,

‘তা যাচ্ছ কোথায়? দেখাই তো পাওয়া যায় না তোমার আজকাল। ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে নাকি?’

লোকটার গায়ে-পড়া ভাব দেখে হাচিয়া ফাল বেশ বিরক্ত হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে লোকটার মনে কোন অভিসন্ধি রয়েছে। না হলে সে কোথায় যাচ্ছে তা জানার কেন এত কৌতুহল? তাকে হরদম দেখা পাওয়ার কেন এত বাসনা? সে ভিআইপি, না এমএলএ, না সেলিব্রিটি? কূটকচালি বাবুকে কেন সে নিত্য দেখা দিতে যাবে? কিসের দায় তার তাকে নিত্য দেখা দেওয়ার? এসব অভিযোগ করা তো শত্রুতার লক্ষণ। তাছাড়া তাকে অকারণে কেন ডুমুরের ফুল বলবে? ডুমুরের ফুল থাকুক আর না থাকুক সে আলাদা কথা, কিন্তু ফুল যেহেতু গাছে থাকে তাই তাকে ফুল বলা মানে সে গাছে ঝুলে থাকুক নিশ্চয়ই লোকটার তেমনি ইচ্ছে। হাচিয়া ফাল বুঝল যে লোকটার মতিগতি মোটেই সুবিধের নয়। বিপদের আশঙ্কায় সে লোকটাকে এড়াতে গিয়ে বলল,

‘আমার একটু তাড়া আছে। অন্যদিন কথা হবে। আজ আসি, কেমন ?’

কূটকচালি বাবু তাকে রেহাই দিতে চাইল না মোটেই। বলল,

‘কী এমন রাজকাজ তোমার যে এত তাড়া? দাঁড়াও, দুটো কথা বলি। এতদিন পর দেখা যখন।’

লোকটার কথা শুনে হাতিয়া ফাল থ’। তাকে কেমন আটকে রাখার মতলব। তার সঙ্গে লোকটার কথা বলার কী এমন গরজ? নিশ্চয়ই তাকে কথা বলে বলে ফাঁসাতে চায়। তারপর বলল কেমন দেখ, কী এমন রাজকাজ তার! তার মানে, তার কোন কাজ থাকতে পারে না, থাকলেও তার কোন মূল্য নেই। কোন সন্দেহ নেই লোকটা তার সঙ্গে শত্রুতা করার জন্যই এভাবে ভাব জমাতে এসেছে গায়ে পড়ে। এত আলাপ কেন? ঠিক করল সে, পালাতে হবে। লোকটা যখন শত্রুতা করতে এসেছে সহজে তাকে ছেড়ে দেবে না। অতএব জোর করে না পালিয়ে উপায় নেই। পালাবেই যখন ঠিক করল তো পালাবার আগে ভদ্রতাসূচক কিছু কথা বলার দরকার আছে কি? না, দরকার নেই। তবুও সে ভাবল, একটা কিছু বলে যাওয়া উচিত যাতে লোকটা তাকে হঠাৎ পালাতে দেখে পাগল না ভেবে বসে। তাই যদি ভাবে তো আবার অন্য বিপদ আছে। সেই কথাটা সে চারদিকে রটিয়ে বেড়াবে। যদি লোকটা সবাইকে বলে বেড়ায় যে হাচিয়া ফাল পাগল হয়ে গেছে তাহলে সবাই মিলে জোর করে ধরে তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিতে পারে। সে শুনেছে, একবার যাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সে পাগল না হলেও ওইখানে থাকলে সত্যিসত্যি পাগল হয়ে যায়। এই বিপদের কথা মাথায় রেখে সে তাই বলল,

‘আজ যাচ্ছি। সত্যিই খুব তাড়া রয়েছে। পরে একদিন আপনার সঙ্গে প্রচুর গল্প করব। অনেক কথা বলার আছে।’

কথাগুলি কোনক্রমে শেষ করে কূটকাচালি বাবুকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। লোকটা তাকে বাধা দেওয়ার বা আটকাবার সুযোগই পেল না। 

বাড়িতে ফিরে হাচিয়া ফাল তার তালিকাপঞ্জিতে কূটকচালি বাবুর নাম তার একজন শত্রু হিসেবে নথিভুক্ত করল। এই কাজটা সে রোজই করে, বাড়িতে থাকলেই করে, বারবার করে। এজন্য শত্রুদের নাম তালিকাপঞ্জিতে নথিভুক্ত করার কথা বারবার উল্লেখ না করাই ভাল, কারণ তা একই বিষয়ে চর্বিতচর্বন হয়ে যেতে থাকবে।

অধ্যায় : তিন

ঘরে বসে নিত্য থোড়-বরি-খাড়া খেয়ে খেয়ে তার অরুচি ধরে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরেই ভুগছিল অরুচিজনিত সমস্যায়। ওজনযন্ত্রে টানা ওজন নিয়ে গেল কয়েক দিন ধরে। দেখল রোজই ওজন কমে যাচ্ছে গড়ে অন্তত দু’ কিলো করে। হিসেব কষে আবিষ্কার করল, যদি এমন চলতে থাকে তো পরবর্তী কুড়িতম দিনে তার দৈহিক ওজন কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাবে, একুশতম দিনে মাইনাস দু’ কিলো। কোনো মানুষের ওজন যদি শূন্য কিলো হয় তো সে কেমন দেখতে হবে বুঝে উঠতে পারল না হাচিয়া ফাল। সে কি তুলো হয়ে উড়ে বেড়াবে নাকি ঘুড়ি হয়ে আকাশে ভাসবে? মেঘ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। হাওয়া হয়ে গেলেও দোষ দেওয়া যাবে না। আটকাবে কে? আর যদি দৈহিক ওজন মাইনাস কয়েক কিলো হয়ে যায় তার কী যে চেহারা হবে কল্পনাও করতে পারল না। সে কি আর তখন হাচিয়া ফাল থাকবে নাকি এক অদৃশ্য ব্ল্যাকহোল হয়ে সবাইকে গিলে গিলে খাবে? 

এসব দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে তার ওজন আরও দ্রুত হারে কমে যাচ্ছিল। এই বিপদ কাটাতে কিছু একটা এক্ষুনি করা খুব প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করল, তাকে যথেষ্ট পরিমাণে সুখাদ্য খেতে হবে। তার জন্য দরকার একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল-মন্দ খেয়ে আসা। 

অনেক ঝাড়াই-বাছাই করে একটা পছন্দসই কাফেতে গেল একদিন হাচিয়া ফাল। কাফেটার নাম মিস্টিরিয়াস ফিস্টি। বাইরেটা এমনভাবে সাজানো যে দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাফেটাকেই যদি খেয়ে ফেলে তো কাফের খাবারগুলি খাবে কিভাবে? এইসব ভেবে কাফে খাওয়ার লোভ আপাতত দমন করে ভিতরে গিয়ে বসল একটা টেবিল নিয়ে। ওয়েটার এসে তার সামনে প্লেট, টাওয়েল, কাটলারি, জলের গ্লাস ইত্যাদি রাখতে রাখতে মেনু তালিকা হিসেবে একটা বুকলেট ধরিয়ে দিয়ে খুশি খুশি মুখে জিজ্ঞেস করল,

‘কী খাবেন স্যার? এইটা আজকে আমাদের স্পেশাল ডিশ, এই ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার।’

হাচিয়া ফালের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তাকে এত খাতির করা কেন? আর সে কী খাবে, কী খাবে না সেটা ও বলে দেওয়ার কে? তার খাওয়ার ব্যাপারে লোকটার এত আগ্রহ কেন? এরকম গায়ে-পড়া লোকগুলোর মতলব মোটেই সুবিধের হয় না। তারপর তাকে বলছে ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার খেতে। কী সর্বনাশা কথা! জোম্বি কেউ খায়, তাও ফ্রোজেন জোম্বি? সে শুনেছে, জোম্বিরাই মানুষ ধরে খায়। মানুষরা জোম্বিকে ফ্রোজেন করে বার্গার বানিয়ে খাবে ব্যাপারটা তার মোটেই সুবিধের বলে মনে হল না। মানুষ জোম্বি খেয়ে হজম করতে পারবে? জোম্বি খেলে কিছু না কিছু অঘটন ঘটতে বাধ্য, কারণ একটা জোম্বি তার শরীরে ঢুকে যাবে। তাকে আর তখন ইহজন্মে শরীর থেকে বার করে তাড়াতে পারবে? ওয়েটারকে তার মোটেই সাধু লোক বলে মনে হল না যেহেতু তাকে প্রথমে দেখেই কুপরামর্শ দিতে লাগল। লোকটাকে বিশ্বাস করে সে মরে আর কি! হাচিয়া ফাল সন্দেহের চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তুমি আমাকে জোম্বি খাওয়াতে চাইছো? জোম্বি দেখে লোকে ভয়ে পালায়। জোম্বি কেউ খায়? তুমি তো লোকটা মোটেই ভালো নও।’

ওয়েটার কী বুঝল কে জানে, জিভ-টিভ কেটে বলল,

‘এ জোম্বি সে জোম্বি নয় স্যার। এ হল জোম্বিল্যান্ড থেকে আমদানি করা রিয়েল জোম্বি। খেলেই বুঝবেন, কী টেস্ট! বারবার খেতে চাইবেন।’

এ তো দেখছি আরও বিপদের কথা, ভাবল হাচিয়া ফাল। জোম্বিল্যান্ড তো ভয়ানক জায়গা, সেখান থেকে আসল জোম্বি ধরে এনে এরা লোককে খাওয়াচ্ছে? তার মনে হল, এক্ষুনি পুলিশ ডেকে সব জানানো উচিত। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে সে কুলিয়ে উঠতে পারল না, মানুষ মারলে জেল-ফাঁসি হয়, কিন্তু মানুষ যদি জোম্বি মারে তো তার কোন শাস্তি হয় কিনা। এমন আজব ঘটনা সে আগে আর শোনেনি। এই নিয়ে কোন মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে বলেও খবর পড়েনি কাগজে কখনও। 

ওয়েটার তাকে তখনও ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সে হাচিয়া ফালের অনিষ্ট করতে বদ্ধপরিকর। লোকটাকে সে চেনে না, জানে না, তার সঙ্গে কোনদিন স্কুলে পড়েনি, তাস-দাবাও খেলেনি, তবুও লোকটা তার পিছনে পড়ে আছে কেন? এ আবার কী ধরনের শত্রুতা? শত্রুর নানা প্রকারভেদ আছে, কিন্তু এ তো দেখা যাচ্ছে একেবারে অজানা চরিত্রের শত্রু। 

অতএব হাচিয়া ফালকে সতর্ক হতেই হল। সে একসময় খেঁকিয়ে উঠে ওয়েটারকে ভাগিয়ে দিল। লোকটা বিরস মুখে চলে যেতে হাজির অন্য একজন। তারও সেই একই আবদার, তাদের স্পেশাল ডিশ ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খেতে হবে। তাকেও বকেঝকে ভাগিয়ে দিতে হাজির অন্য আরেকজন, সেই একই দাবি নিয়ে এবং এইভাবে একের পর এক ওয়েটার এসে তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল যে তাদের ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়া কতটা উপদেয় ও উপকারী। ওয়েটার ভাগাতে ভাগাতে হাচিয়া ফাল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। খাবে আর কখন? 

সবশেষে এল স্বয়ং কাফের ম্যানেজার। সে নানা কায়দা ও কৌশল অবলম্বন করল হাচিয়া ফালকে ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াতে এবং এমনও লোভ দেখালো যে তাকে একটার সঙ্গে আরেকটা ফ্রি দেওয়া হবে। তাকে খাওয়াবেই তারা যেভাবেই হোক তাদের ওই স্পেশাল ডিশ ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার। ব্যাপার দেখে হাচিয়া ফালের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।

শেষপর্যন্ত ঘটনা এমন দাঁড়ালো যে বোঝাতে বোঝাতে ম্যানেজারও যখন ফেল মেরে গেল তখন গোটা কাফেতে খাচ্ছিল যত কাস্টমার তারাও এসে হাচিয়া ফালকে ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াবার জন্য সদলবলে বোঝাতে লাগল। তারা জানালো যে যদি সে খেতে রাজি হয় তো সবাই মিলে চাঁদা তুলে তাকে যত খুশি ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াবে।

কান্ড দেখে হাচিয়া ফাল বুঝল যে কাফের ওয়েটার, কুক, ম্যানেজার এমনকি, কাস্টমাররা সবাই তার নিখাদ শত্রু। তাকে খাওয়াবার অত কী গরজ সবার, তাও ওই সন্দেহজনক ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার? বিশ্বাস নেই, যা চরিত্র দেখা যাচ্ছে, এরা তাকে বিষ-ফিস মেশানো খাবার খাইয়ে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। সে যদি মরে যায় তারপর তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধী ধরা পড়লে তার তো কোন উপকার হবে না।

এসমস্ত নানাবিধ অকাট্য যুক্তি ও কারণে হাচিয়া ফাল স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হল এবং বুঝল যে গোটা কাফেটাই একটা শত্রুপুরী আর কাফেতে উপস্থিত সব্বাই তার শত্রু।

অধ্যায় : চার

এত এত শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে জীবনযাপন করা খুবই দুঃসহ কাজ বলে হাচিয়া ফাল একবার ঠিক করেছিল, সে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। তার এই সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাতে মোটেই কোন ধর্মকর্ম করার বাসনা ছিল না, কারণ তার বাবা ভাগিয়া ছাল তাকে বলে রেখেছিল,

‘দ্যাখ্ হাচিয়া, ধর্মকর্ম করা খুব জটিল কাজ। ওসব করলে লাইফ হেল হয়ে যাবে।’

বাবার সেই উপদেশটা মনে আছে তার। তাই সে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিল শত্রু দেখে দেখে সংসারের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিবাগী হওয়ার বাসনায়।

কিন্তু বললেই তো আর চট করে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না, তার জন্য কিছু জোগাড়-যন্তর দরকার। সন্ন্যাসী হতে চাইলে কী করা উচিত সে ধারণা ছিল না তার। সন্ন্যাসী হওয়ার সহজ উপায় বিষয়ক কোন বইটই আছে কিনা খোঁজাখুঁজি করে দেখল বিস্তর। পাওয়া গেল না।

দুর্ভাগ্যক্রমে, মনের ইচ্ছেটা সে ব্যক্ত করে ফেলেছিল কয়েকজনের কাছে। তারা সবাই তাকে বোঝাতে লাগল যে সন্ন্যাসী হওয়া অতীব শক্ত কাজ। এসব পোকা মাথায় না থাকলেই ভালো, লোকগুলিকে সে হিতাকাঙ্খী ভেবে ভুল করেছিল। দেখা গেল যে এরা সবাই তার শত্রু। নাহলে তারা তাকে সন্ন্যাসী না হওয়ার কুপরামর্শ দেবে কেন? 

অনেক ভাবনাচিন্তা করে সে বুঝতে পারল যে একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। তার কাছেই জানা যেতে পারে কিভাবে সন্ন্যাসী হওয়া যায়। এইসব ভাবনাচিন্তা তাকে একা একাই করতে হয়। কারো সঙ্গে পরামর্শ করার কোন উপায় নেই। যেহেতু সবাই তার শত্রু, তাই কেউ তাকে হিতকথা বলবে যাতে মঙ্গল হবে, এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার সে কস্মিনকালেও মনে ঠাঁই দেয় না।

যাই হোক, একটা সন্ন্যাসী খুঁজে তার সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্তটাই সে পাকাপোক্ত করল। আর যাই হোক, কোন সন্ন্যাসী অন্তত তার শত্রু হবে না এ বিশ্বাস তার ছিল। সন্ন্যাসীরা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে, লোকের অমঙ্গল চিন্তা করে না। তারা লোকের উপকারই করে থাকে বলে সে জানে। তাছাড়া সে তো আর লোকটার কাছে কোন উপকার চাইতে যাবে না, কেবল জানতে যাবে সন্ন্যাসী হওয়ার উপায়। সেটা না বলার কোন কারণ নেই, আর এই সামান্য ব্যাপারটা জানাবার জন্য সে নিশ্চয় তার কাছে কোন পারিশ্রমিক বা ফিজ দাবি করবে না। সেসব না হয় পরে দেখা যাবে। এখন প্রথম প্রশ্ন প্রথমে। সন্ন্যাসী কোথায় পাওয়া যায়? 

সন্ন্যাসী কোথায় থাকে? সে রাস্তাঘাটে ঘুরতে বেরিয়ে কোন সন্ন্যাসীকে দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। হরদম যে দেখেনা সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সন্ন্যাসীদের জন্য কোন বাজারও নির্দিষ্ট করা নেই যে সেখানে গেলে তাদের সে পেয়ে যাবে। আগেকার দিন হলেও কথা ছিল। তখন সে জানে সন্ন্যাসীরা বনে-জঙ্গলে থাকত, আশ্রম বানিয়ে ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করত। আজকাল জঙ্গলে গেলে সন্ন্যাসীদের দেখা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। জঙ্গল কেটে লোকেরা এমন সাফ করে দিচ্ছে যে পশুপাখিরও পাত্তা পাওয়া যায় না, এমনকি, জঙ্গলে আজকাল গাছপালাও নেই বললেই চলে। তাই জঙ্গলে গিয়ে সন্ন্যাসীর খোঁজ করাটা যে বেকার হবে সেটা বুঝতে জঙ্গল-বিশারদ হতে হবে না। সন্ন্যাসীরা আগে পাহাড়-পর্বতের গুহাতেও বসবাস করত। বর্তমানে আর তারা গুহাবাসী নয় এটা সে জানে, জানে না যেটা তা হল সন্ন্যাসীদের এখনকার জীবনযাপন এবং গতিবিধি। পাহাড়ে-পর্বতে গেলে হয়ত দু-পাঁচটা সন্ন্যাসী পেলেও পাওয়া যেতে পারে, তবে অতটা খোঁজাখুঁজি করার ইচ্ছে বা উদ্দম তার নেই। পৃথিবীর মানুষ যে হারে আধুনিক হয়ে উঠছে তাতে সন্ন্যাসীরাও নিশ্চয়ই সমান তালে পাল্লা দেবে। এইসব আধুনিক সন্ন্যাসীরা কেমন হবে সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। 

হাচিয়া ফাল এভাবে কিছুদিন সন্ন্যাসীদের নিয়ে পড়ে রইল, তাদের নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালাল ঘরে বসে ভেবে ভেবে। তারপর তার মাথায় এল, তীর্থক্ষেত্রে সন্ন্যাসীদের অবশ্যই দেখা পাওয়া যাবে। তাছাড়া তারা কোন এক ধর্মস্থানে থাকবেই। যেকোন একটা সন্ন্যাসী পাওয়া নিয়ে কথা, যেখানে খুশি থাকুক সে। যত সহজে তাকে পাওয়া যাবে ততই মঙ্গল।  

দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে একদিন উদ্যোগ করে হাচিয়া ফাল একটা ধর্মস্থানে গিয়ে হাজির হল। সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসী কয়েকজনকে পেয়েও গেল সে। এখন আবার নতুন সমস্যা। আগে একজনকেই পাচ্ছিল না আর এখন একাধিক। কাকে ছেড়ে কার কাছে যাবে? দেখে কি বোঝা যায় কে সঠিক হবে? খেয়ে তো দেখার উপায় নেই কে ভালো কে মন্দ! যা থাকে কপালে ভেবে সে একজনকে গিয়ে পাকড়াও করল। ওপর ওপর দেখে মনে হল লোকটা তেমন মন্দ নয়। রক্তবস্ত্র পরিহিত এবং মাথায় জটাজুট, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। এমন জবরজং পোশাক হলেও চেহারায় শান্তশিষ্ট এবং রোগাটে। রেগে গিয়ে তেড়ে মারতে এলেও অনায়াসে পালিয়ে বাঁচা যাবে।

সন্ন্যাসীর সামনে উপস্থিত হয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়েই হাচিয়া ফাল তার মতলব জানাল। লোকটা নিশ্চুপ থেকে আপাদমস্তক তাকে দেখে একটা হাহাকারমিশ্রিত হাসিতে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে জিজ্ঞেস করল, 

‘সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে? লেখাপড়া কদ্দুর?’ 

সন্ন্যাসী হতে গেলে লেখাপড়া করতে হবে জানা ছিল না হাচিয়া ফালের। সে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানাল,

‘তেমন বেশি নয়। বেশি করতাম, কিন্তু করতে পারলাম না শিক্ষকরা সব আমার শত্রু হয়ে গেল বলে। তারা কেবল আমাকে পরীক্ষাগুলোতে ফেল করিয়ে দিত।’ 

শুনে সন্ন্যাসী আবার হাহাকার করে হেসে উঠল। বলল,

‘উত্তম। আমিও লেখাপড়া করিনি। লেখাপড়া করলে সন্ন্যাসী হওয়ার ব্যাঘাত ঘটে।’

শুনে হাচিয়া ফাল খুশি হতে যাবে যখন সেই সন্ন্যাসী পিলে চমকানো গলায় ঘোষণা করল,

‘সন্ন্যাসী হতে গেলে তোকে ঘর-সংসার ছাড়তে হবে। পারবি?’

এইখানে তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হল। সে জানতে গেছে সন্ন্যাসী হওয়ার উপায়, ঘরবাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন ? লোকটার মতলবটা কী? মনে মনে এমন জিজ্ঞাসা রেখে সে সতর্ক হতে থাকলে সেই সন্ন্যাসী বিকট এক হুঙ্কার ছেড়ে বলল,

‘স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করতে হবে। পারবি?’

‘আমার সেসব নেই।’

অতি সাবধানে উত্তর দিল সে। সন্ন্যাসীর হুঙ্কার শোনা গেল আবার,

‘উত্তম। তুই তাহলে সন্ন্যাসী হওয়ার যাত্রায় এক পা এগিয়ে গেছিস। বাকি রইল আর একটা পা। সেটা তুলে নিতে পারলেই তোর মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তোর ঘরবাড়ি আছে ?’

ততক্ষণে হাচিয়া ফাল বুঝতে শুরু করেছে যে এই সন্ন্যাসীটাও তার শত্রু হতে চলেছে। না হলে অমন বীভৎস হাসি হাসবে কেন? সে সন্ন্যাসী হতে চায় এতে হাসির কী হল? তাছাড়া আগে বাড়িয়ে এতসব অবান্তর প্রসঙ্গের উত্থাপন কেন? অতএব এর কাছে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা এই সন্দেহটা বাস্তব হতে লাগল। তবুও সে সন্ন্যাসীর শেষ প্রশ্নের উত্তরে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল যে বাড়িঘর আছে তার। সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল সন্ন্যাসীর বাক্যবাণ,

‘থাকা মানেই পাপের সংস্পর্শে থাকা। সন্ন্যাসী হতে চাইলে তোকে এক্ষুনি এই পাপের বোঝা ঘাড় থেকে ফেলে দিতে হবে। তুই এক কাজ কর্, তোর বাড়িঘর যা আছে তা দানধ্যান করে দে। তাহলেই তুই বাকি পা-টা তুলে নিতে পারবি, মুক্তপুরুষ হয়ে যাবি। তোর সন্ন্যাসী হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। কাকে বাড়িঘর দান করবি? কোন চিন্তা নেই, আমি বলে দেব। তোর হয়ে সব পাপের বোঝা আমি আমার ঘাড়ে নিয়ে নেব। তুই দায়মুক্ত হয়ে যাবি, তোর সব দায় হবে আমার।’

এবার হাচিয়া ফাল সন্ন্যাসীর আসল ধান্দাটা বুঝতে পারল, লোকটা আগড়ম-বাগড়ম কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার বাড়িঘর হাতিয়ে নিতে চাইছে। না, আর কোন সন্দেহ নেই সন্ন্যাসীটা শত্রুই হয়ে গেল, ঘোরতর শত্রু।

হাচিয়া ফাল তখন পালাতে পারলে বাঁচে। হঠাৎই কোন ভূমিকা না করে সটান উঠে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসীর সামনে থেকে প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে গেল। সন্ন্যাসী কিছু বলার অবকাশই পেল না। এমন পালানোর কায়দা রয়েছে তার জিনের মধ্যে, যেটা সে জন্মসূত্রে পেয়েছে তার বাবা ভাগিয়া ছালের কাছে।

অধ্যায় : পাঁচ 

শত্রু হওয়ার কোন নিয়ম নেই। থাকলে ভাল হত। তাহলে বোঝা যেত কে কিভাবে শত্রু হতে পারে। তেমন নিয়ম জানা থাকলে যেকোন মূল্যে তাকে হাচিয়া ফাল মেনে চলত। অনিয়মে-কুনিয়মে যখন তখন সবাই শত্রু হয়ে চলেছে তো চলেছেই। নিয়ম-টিয়ামের কোন তোয়াক্কা না করেই। বিপদটা সেখানেই। এই যে সবাই শত্রু হয়ে চলেছে তার তো একটা নীতি থাকতে হবে? নিয়ম-নীতি মানবে না, কেবল শত্রু হয়ে যাবে এ আবার কী কথা? 

একসময় হাচিয়া ফাল ভেবেছিল, কোন জীবিত প্রাণীর সঙ্গে সে সম্পর্ক রাখবে না। কোন মৃত প্রাণী বা মানুষের সঙ্গেও নয়। জীবিত বা মৃত সমস্ত প্রাণী ও মানুষকেই সে এড়িয়ে চলবে। মৃত ব্যক্তি বা প্রাণীর কথা উঠল এই জন্য যে সে দেখেছে, জীবিতদের মত মৃত মানুষ বা প্রাণীও শত্রু হতে ওস্তাদ। শত্রু হতে মৃত জীবরা জীবিতদের তুলনায় এককাঠি সরেস। জীবিত যারা তাদের দেখা যায়, ধরাছোঁয়ার উপায় আছে। কিন্তু মৃতদের না যায় দেখা, না যায় শোনা, ধরাছোঁয়ার প্রশ্নই নেই। তারা তাকে ভূত হয়ে ভয় দেখিয়ে শত্রুতা করে।

কারোর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা সে ভেবেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অচল থাকতে পারল না। লোকরা গায়ে পড়ে এসে তার শত্রু হতে থাকে, সে যতই তাদের এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করুক না কেন। রাস্তাঘাটে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েও সে দেখেছে, লাভের লাভ হয় না কিছুই। লোকরা সেক্ষেত্রে তার বাড়ি বয়ে এসে শত্রু হতে থাকে। লোকের গায়ে পড়ে বাড়ি আসা সে কিভাবে আটকাবে? বাধা দিতে গেলে ঝগড়াঝাঁটি করতে হয়, তাতে শত্রুতা আরও বেড়ে যাবে। তাছাড়া সে নিজে ঝগড়াঝাঁটি করতে পারে না বিশেষ, সেটা করতে দক্ষতা আছে তার মা নাচিয়া ঝালের। এমনই কপাল যে তার মা নাচিয়া ঝালও তার শত্রু হয়ে বসে আছে। লোকের গায়ে পড়ে বাড়ি এসে শত্রু হওয়া আটকাতে সে একটা সিকিউরিটি গার্ড বা পাহারাদার রাখার কথা ভেবেছিল। রাখেনি এই কারণে যে সে জানত, সেই পাহারাদার ব্যাটাও তার শত্রু হয়ে যাবে নির্ঘাৎ। আর জীবিত লোকজনদের যদিওবা পাহারাদার দিয়ে সে আটকায় মৃত শত্রুদের আটকাবে কিভাবে? তারা আবার বাড়ির গেট বা দরজা-জানলা বন্ধ রাখলেও দিব্যি ঘরে ঢুকে যাওয়ার কায়দা জানে। তাদের আটকাতে তাহলে তাকে একটা ভূত পাহারাদার রাখতে হয়। সেই ভূত পাহারাদার সে পাবে কোথায়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মৃত পাহারাদার পেলেও সে তাকে কাজে বহাল করবে কি? সে শত্রু হয়ে যাবে না তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? 

শত্রুদের এড়িয়ে চলতে নানা রকম পন্থার কথা দিনরাত ভাবে হাচিয়া ফাল। কোনটাই কাজের হয় না সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়ার কথা ভেবেও নাকাল হতে হয়েছিল। আরও সব অভিনব উপায়ের কথা ভেবেই চলেছে সে যেভাবেই হোক শত্রুদের নজর এড়িয়ে থাকার জন্য। কোনমতেই সে চায়না কোন শত্রুর মুখোমুখি হতে। সেটা সম্ভব হয় না কারণ, শত্রু নয় এমন কাউকে সে দেখেনি আজ পর্যন্ত।

রাস্তায় বার হলে তো নয়ই, বাড়িতে থেকেও যখন শত্রুদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন সে একবার ভেবেছিল যে নিজের বাড়িতে একটা বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানিয়ে লুকিয়ে থাকলে মন্দ হত না। একটা গুপ্তকক্ষ বানিয়ে বসবাস করলে শত্রুরা তার পাত্তা পেতনা একেবারেই। ঝামেলাটা অবশ্য অন্য জায়গায়। বাঙ্কার হোক বা গুপ্তকক্ষ, সেটা বানাতে গেলে মিস্ত্রি-মজুর ধরে আনতে হবে। সে ব্যাটারাও তো তার শত্রু হয়ে যাবে। হতে বাধ্য। তার জ্বলন্ত উদাহরণও রয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে ঘরের দেয়ালে রং করার জন্য তাকে মিস্ত্রি-মজুর লাগাতে হয়েছিল। জন্মে চিন্তা না সে কাউকে। তাদের সঙ্গে বাড়িজমি, ধারদেনা বা বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধে নিয়ে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ থাকার কথা নয় এবং ছিলও না। তার বাড়িতে রং করার কাজে ডেকে সে বরং তাদের উপকারই করেছিল কাজ পাওয়ার সুযোগ পাইয়ে দিয়ে। তার জন্য তাদের চাহিদামত যথেষ্ট টাকা-পয়সাও দিয়েছিল, কার্পণ্য বা দরাদরি করেনি, অথচ তারা অকারণে তার শত্রু হয়ে গিয়েছিল। সেটা সে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল বাড়িতে রং করার কাজ শুরু হওয়ার পর। রোজ তারা তার সঙ্গে ডেকে ডেকে আলাপ করবে। কাজ করবি কর্ না বাবা, এত আড্ডা মারার শখ কেন তার সঙ্গে? সে কি তাদের ইয়ারদোস্ত নাকি ব্যবসার পার্টনার? ভাইবন্ধু, আত্মীয়ও নয়। তবুও তার সঙ্গে দেখা হলেই নানা প্রশ্ন। ‘বাবু, এত বড় বাড়িতে একা থাকেন?’ বা, ‘আপনি চাকরি করেন?’ বা, ‘আপনার আত্মীয়রা থাকে কোথায়? বিয়ে-শাদী করেননি কেন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরক্তি দেখিয়ে ধমক-ধামক মেরেও লাভ হয়নি। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল যে তার সব গোপনকথা জেনে নিয়ে ওদের মতলব ছিল পাকাপোক্ত শত্রু হয়ে যাওয়া। একেকবার ইচ্ছে হয়েছিল যে মাঝপথে কাজ বন্ধ করে ঘাড় ধরে সব কটাকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ঘরে রং করাটা আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে থাকবে বলে মুখ বুঝে ওদের শত্রুতা সহ্য করে গিয়েছিল। তারা যে শত্রু ছিল তার প্রমাণ পেয়েছিল তাদের কাজ করার সময় বাড়ি-ঘরদোর নোংরা করে যাওয়ার বহর দেখে। আর কাজ শেষ করার পর সে দেখল, যে যে দেয়ালে সে যেমন যেমন বলেছিল সব তেমন তেমনই করে গেছে লোকগুলো। একটু অন্যরকম কিছুই মাথা খাটিয়ে করে যায়নি যা সে নিজে ভাবতে পারেনি। ইচ্ছে করলেই আরও ভাল কিছু করতেই পারত যেহেতু তাদের অভিজ্ঞতা তার চেয়ে বেশি। করেনি। এ শত্রুতা ছাড়া আর কী হতে পারে?

তাই বাড়িতে আবার মিস্ত্রি-মজুর ডেকে এনে বাঙ্কার কিংবা গুপ্তকক্ষ বানাবার উপায় নেই। তাতে আবার একদল নতুন শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। তাছাড়া তারা শত্রুতা করে ব্যাপারটা সবাইকে বলে বেড়ালে তার বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানাবার মূল উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে। রংমিস্ত্রিরাও এমনটাই করেছিল। তার ঘর রং করার ব্যাপারটা শত্রুতা করে রটিয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। রাজ্যসুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছিল যে তার ঘরে রং করা হচ্ছে। আর এই নিয়ে লোকের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তার পাগল হওয়ার জোগাড়। আসলে সবাই তো তার শত্রু আর তাকে হিংসে করে। সে যে ঘরে নতুন রং লাগিয়ে আরামে থাকবে সেটা কি কারও সহ্য হয় প্রাণে? 

অতএব বাঙ্কার বা গুপ্তকক্ষ বানানো যাবেনা। তাহলে শত্রুদের হাত থেকে আত্মগোপন করে লুকিয়ে থাকার জন্য সে কি একটা গর্ত বানিয়ে নেবে নিজের হাতে? এটা বেশ পছন্দসই মনে হল। এ নিয়ে পরে নাহয় ভেবেচিন্তে দেখা যাবে কিভাবে একা একা গর্তটা কবে কোথায় খুঁড়বে সে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *