রম্যরচনা
অধ্যায় : তিন
ঘরে বসে নিত্য থোড়-বরি-খাড়া খেয়ে খেয়ে তার অরুচি ধরে গিয়েছিল। কয়েকদিন ধরেই ভুগছিল অরুচিজনিত সমস্যায়। ওজনযন্ত্রে টানা ওজন নিয়ে গেল কয়েক দিন ধরে। দেখল রোজই ওজন কমে যাচ্ছে গড়ে অন্তত দু’ কিলো করে। হিসেব কষে আবিষ্কার করল, যদি এমন চলতে থাকে তো পরবর্তী কুড়িতম দিনে তার দৈহিক ওজন কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাবে, একুশতম দিনে মাইনাস দু’ কিলো। কোনো মানুষের ওজন যদি শূন্য কিলো হয় তো সে কেমন দেখতে হবে বুঝে উঠতে পারল না হাচিয়া ফাল। সে কি তুলো হয়ে উড়ে বেড়াবে নাকি ঘুড়ি হয়ে আকাশে ভাসবে? মেঘ হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। হাওয়া হয়ে গেলেও দোষ দেওয়া যাবে না। আটকাবে কে? আর যদি দৈহিক ওজন মাইনাস কয়েক কিলো হয়ে যায় তার কী যে চেহারা হবে কল্পনাও করতে পারল না। সে কি আর তখন হাচিয়া ফাল থাকবে নাকি এক অদৃশ্য ব্ল্যাকহোল হয়ে সবাইকে গিলে গিলে খাবে?
এসব দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে তার ওজন আরও দ্রুত হারে কমে যাচ্ছিল। এই বিপদ কাটাতে কিছু একটা এক্ষুনি করা খুব প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতে সে ঠিক করল, তাকে যথেষ্ট পরিমাণে সুখাদ্য খেতে হবে। তার জন্য দরকার একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল-মন্দ খেয়ে আসা।
অনেক ঝাড়াই-বাছাই করে একটা পছন্দসই কাফেতে গেল একদিন হাচিয়া ফাল। কাফেটার নাম মিস্টিরিয়াস ফিস্টি। বাইরেটা এমনভাবে সাজানো যে দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাফেটাকেই যদি খেয়ে ফেলে তো কাফের খাবারগুলি খাবে কিভাবে? এইসব ভেবে কাফে খাওয়ার লোভ আপাতত দমন করে ভিতরে গিয়ে বসল একটা টেবিল নিয়ে। ওয়েটার এসে তার সামনে প্লেট, টাওয়েল, কাটলারি, জলের গ্লাস ইত্যাদি রাখতে রাখতে মেনু তালিকা হিসেবে একটা বুকলেট ধরিয়ে দিয়ে খুশি খুশি মুখে জিজ্ঞেস করল,
‘কী খাবেন স্যার? এইটা আজকে আমাদের স্পেশাল ডিশ, এই ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার।’
হাচিয়া ফালের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তাকে এত খাতির করা কেন? আর সে কী খাবে, কী খাবে না সেটা ও বলে দেওয়ার কে? তার খাওয়ার ব্যাপারে লোকটার এত আগ্রহ কেন? এরকম গায়ে-পড়া লোকগুলোর মতলব মোটেই সুবিধের হয় না। তারপর তাকে বলছে ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার খেতে। কী সর্বনাশা কথা! জোম্বি কেউ খায়, তাও ফ্রোজেন জোম্বি? সে শুনেছে, জোম্বিরাই মানুষ ধরে খায়। মানুষরা জোম্বিকে ফ্রোজেন করে বার্গার বানিয়ে খাবে ব্যাপারটা তার মোটেই সুবিধের বলে মনে হল না। মানুষ জোম্বি খেয়ে হজম করতে পারবে? জোম্বি খেলে কিছু না কিছু অঘটন ঘটতে বাধ্য, কারণ একটা জোম্বি তার শরীরে ঢুকে যাবে। তাকে আর তখন ইহজন্মে শরীর থেকে বার করে তাড়াতে পারবে? ওয়েটারকে তার মোটেই সাধু লোক বলে মনে হল না যেহেতু তাকে প্রথমে দেখেই কুপরামর্শ দিতে লাগল। লোকটাকে বিশ্বাস করে সে মরে আর কি! হাচিয়া ফাল সন্দেহের চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি আমাকে জোম্বি খাওয়াতে চাইছো? জোম্বি দেখে লোকে ভয়ে পালায়। জোম্বি কেউ খায়? তুমি তো লোকটা মোটেই ভালো নও।’
ওয়েটার কী বুঝল কে জানে, জিভ-টিভ কেটে বলল,
‘এ জোম্বি সে জোম্বি নয় স্যার। এ হল জোম্বিল্যান্ড থেকে আমদানি করা রিয়েল জোম্বি। খেলেই বুঝবেন, কী টেস্ট! বারবার খেতে চাইবেন।’
এ তো দেখছি আরও বিপদের কথা, ভাবল হাচিয়া ফাল। জোম্বিল্যান্ড তো ভয়ানক জায়গা, সেখান থেকে আসল জোম্বি ধরে এনে এরা লোককে খাওয়াচ্ছে? তার মনে হল, এক্ষুনি পুলিশ ডেকে সব জানানো উচিত। কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে সে কুলিয়ে উঠতে পারল না, মানুষ মারলে জেল-ফাঁসি হয়, কিন্তু মানুষ যদি জোম্বি মারে তো তার কোন শাস্তি হয় কিনা। এমন আজব ঘটনা সে আগে আর শোনেনি। এই নিয়ে কোন মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে বলেও খবর পড়েনি কাগজে কখনও।
ওয়েটার তাকে তখনও ফ্রোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করে যাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সে হাচিয়া ফালের অনিষ্ট করতে বদ্ধপরিকর। লোকটাকে সে চেনে না, জানে না, তার সঙ্গে কোনদিন স্কুলে পড়েনি, তাস-দাবাও খেলেনি, তবুও লোকটা তার পিছনে পড়ে আছে কেন? এ আবার কী ধরনের শত্রুতা? শত্রুর নানা প্রকারভেদ আছে, কিন্তু এ তো দেখা যাচ্ছে একেবারে অজানা চরিত্রের শত্রু।
অতএব হাচিয়া ফালকে সতর্ক হতেই হল। সে একসময় খেঁকিয়ে উঠে ওয়েটারকে ভাগিয়ে দিল। লোকটা বিরস মুখে চলে যেতে হাজির অন্য একজন। তারও সেই একই আবদার, তাদের স্পেশাল ডিশ ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খেতে হবে। তাকেও বকেঝকে ভাগিয়ে দিতে হাজির অন্য আরেকজন, সেই একই দাবি নিয়ে এবং এইভাবে একের পর এক ওয়েটার এসে তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল যে তাদের ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়া কতটা উপদেয় ও উপকারী। ওয়েটার ভাগাতে ভাগাতে হাচিয়া ফাল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। খাবে আর কখন?
সবশেষে এল স্বয়ং কাফের ম্যানেজার। সে নানা কায়দা ও কৌশল অবলম্বন করল হাচিয়া ফালকে ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াতে এবং এমনও লোভ দেখালো যে তাকে একটার সঙ্গে আরেকটা ফ্রি দেওয়া হবে। তাকে খাওয়াবেই তারা যেভাবেই হোক তাদের ওই স্পেশাল ডিশ ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার। ব্যাপার দেখে হাচিয়া ফালের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।
শেষপর্যন্ত ঘটনা এমন দাঁড়ালো যে বোঝাতে বোঝাতে ম্যানেজারও যখন ফেল মেরে গেল তখন গোটা কাফেতে খাচ্ছিল যত কাস্টমার তারাও এসে হাচিয়া ফালকে ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াবার জন্য সদলবলে বোঝাতে লাগল। তারা জানালো যে যদি সে খেতে রাজি হয় তো সবাই মিলে চাঁদা তুলে তাকে যত খুশি ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার খাওয়াবে।
কান্ড দেখে হাচিয়া ফাল বুঝল যে কাফের ওয়েটার, কুক, ম্যানেজার এমনকি, কাস্টমাররা সবাই তার নিখাদ শত্রু। তাকে খাওয়াবার অত কী গরজ সবার, তাও ওই সন্দেহজনক ফ্ৰোজেন জোম্বি বার্গার? বিশ্বাস নেই, যা চরিত্র দেখা যাচ্ছে, এরা তাকে বিষ-ফিস মেশানো খাবার খাইয়ে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। সে যদি মরে যায় তারপর তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধী ধরা পড়লে তার তো কোন উপকার হবে না।
এসমস্ত নানাবিধ অকাট্য যুক্তি ও কারণে হাচিয়া ফাল স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হল এবং বুঝল যে গোটা কাফেটাই একটা শত্রুপুরী আর কাফেতে উপস্থিত সব্বাই তার শত্রু। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)