তপোপ্রিয়
গেল যে গেলই
কোন এক অতিকায় নির্জন নৈরাশ্যে আমি এক আশ্চর্য উপস্থিতি বিপর্যস্ত দাঁড়িয়েছিলাম।নিজেকে আমার মনে হতে থাকে শব্দহীন এক গাছ, একলা দাঁড়িয়ে, মেলে দিয়েছি অনেক শাখাপ্রশাখা নিজেরই অজান্তে। জানি এমনি করেই ডালপালারা জড়িয়ে রাখে, জড়িয়ে থাকে। এমনি করেই আমার ইচ্ছেগুলি কন্ঠ হারিয়ে ফেলে।
জীবন এখন এমনই এক মঞ্চ যেখানে বিসর্জনের বাজনা শুনি।চোখ বুঝলেই দেখতে পাই বিষাদ লেগে থাকা প্রতিমার মুখ। আমার অন্তরের সুগভীর প্রদেশে ঘনীভূত হয়ে জমা কান্নাগুলি মুক্তি পাওয়ার অসম্ভব আগ্রহে ছটফট করে।এত কান্না লুকিয়ে আছে দেখে আমি অবাক হই।প্রস্তরমূর্তির মতো হয়ে পড়ে থাকি পথের পাশে, আমারই সামনে দিয়ে জীবন প্রতিমাকে নিয়ে যায় বিসর্জনের জন্য।
তখন আমার মনে পড়ে মায়ের কথা। পৃথিবী পরিপূর্ণ শব্দে—- কোলাহলে, নাগরিক জীবনযাপনের গর্জন চলে আমার চারপাশে, অথচ নিজেকে বড় বেশি নিঃসঙ্গ মনে হয়। কেমন অথর্ব অস্তিত্বের মতো বাক্যহারা দাঁড়িয়ে থাকি আর দেখি মাকে নিস্তব্ধ রাতের নির্বাক রাস্তা ধরে কারা যেন নিয়ে চলে যাচ্ছে, কোন এক অজানা প্রদেশে। তারপর থেকেই মায়ের ঘর ফাঁকা, অথচ আমার এখনো বিশ্বাস হয় না মায়ের এই চলে যাওয়া। কেবলি কানে ধাঁধা লাগে, শুনি মা ডাকছে। ভাবি হয়তো রয়েছে ওদিকে ঠাকুরঘরে বা স্নান করছে বাথরুমে।
প্যাসেজে দাঁড়িয়ে খোলা জানলায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি নিশ্চল। শূন্য বিছানাটার দিকে তাকিয়ে আমার যে কী বিস্ময় হতে থাকে। মনে হয় ওই তো মা শুয়ে আছে। হাত-পা গুটিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে, একখণ্ড নিষ্প্রভ জীর্ণ-দির্ণ অস্তিত্ব।নিষ্কলক চোখে উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে আছে। কাছে গেলেই আঁকড়ে ধরবে হাড়সর্বস্ব দু’হাতে, নিঃশব্দ হাসিতে আকর্ণ প্রসারিত হয়ে যাবে ঠোঁট কিন্তু দাঁত দেখা যাবে না। আকাশে-বাতাসে সেই হাসি কী স্পষ্ট, অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না।
ধরে রাখা যাবে না কাউকে জানি, জানতাম মাকেও একদিন চলে যেতে হবে। আসলে বিস্ময় সেটা নয়। চলে কোথায় যাবে সেটাই বিস্ময়। এই এত জীবন্ত উপস্থিতি, অথচ যাবে যখন কোন অস্তিত্বকেই আর দেখতে পাবো না ভাবলেই বুক তোলপাড় করে উঠতো। চলে যাওয়ার দিন যে আসন্ন বুঝে প্রস্তুত হছিলাম। তবু মা চলে যাবে ভাবতে পারতাম না।
মৃত্যুকে মা খুবই অপছন্দ করতো। বেঁচে থাকার কী যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। যখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল তখনও দেখেছি প্রায়ই রাতে ঘুমের ঘোরে আর্তনাদ করে উঠতো ‘মরে গেলাম’, ‘মরে গেলাম’ বলে। অসুস্থ হওয়ার পর ওষুধ খেতে কখনো গাফিলতি করত না। সারাজীবন মাকে মৃত্যু নিদারুণ সব আঘাত দিয়ে গেছে। মৃত্যু মায়ের কাছে ছিল এক বিভীষিকা।
কখনো রাগারাগির সময় আমি এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাকে ভয় দেখিয়ে বলতাম, মরে গিয়ে শিক্ষা দেব। শুনে মা সত্যিই কাবু হয়ে যেত। আমাকে বোঝাতে গিয়ে বলতো, ‘আরে, মরতে তো সবাই পারে। এ আর কী বাহাদুরি? বেঁচে থাকাটাই তো আশ্চর্য।’
চলে তো যাবার কথা ছিল মায়ের কবেই। কতবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে দেখেছি। দশ-বারো বছর আগে সেরিব্রাল অ্যাটাক হলো যখন সেবারই সব শেষ ভেবেছিলাম। পিয়ারলেস হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছিল মাকে। প্রথম কয়েকদিন জীবনের কোন লক্ষণই ছিল না। সে’কটি দিনের কথা আজ বড় মনে পড়ে। আমি তখন অর্ধোন্মাদ। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, দিনরাত পড়ে থাকি হাসপাতালে। আর পারিপার্শ্বিক ভুলে আত্মগতভাবে কেবলই প্রার্থনা করি সেই সব দেবতাদের কাছে যাদের জাগ্রত বলে জানি, যেন মাকে আমি আবার ফিরে পাই। সে যে কেমন প্রার্থনা নিজে ভেবে নিজেই আজ অবাক হই। এমন জ্বলন্ত বিশ্বাস নিয়ে এভাবে অন্তর উজাড় করে কোন চাওয়া আর কখনো চাইতে পারিনি কোনদিন। মনে পড়ে, হাসপাতালের নিঃসঙ্গ চত্বরে রাতে পাগলের মত অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মাথার ওপর তারাভরা নিশ্চুপ আকাশ—- আমি কেবল হাঁটছি কেবল হাঁটছি আর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে মাকে ফিরে পাবার আকুল আবেদন জানাচ্ছি। হাসপাতালে পিছন দিকের রিসেপশনে একটা বড় হল ঘর, সেখানে রাতে বসে থাকার ব্যবস্থা।সংকটাপন্ন রোগীদের স্বজনরা সব বসে কাটাতো সেখানে, কখন কী খবর আসে তার জন্য। আমিও অনেকের ভিড়ে সেখানে বসে থাকতাম এক বুক আতঙ্ক নিয়ে আর আপন মনে চলতে প্রার্থনা। একটু পরপর ইন্টারকম বেজে উঠতো, নানান খবর আসতো। ওই শব্দ শুনলেই হাত-পা অসাড় হয়ে যেত, বুক ধ্বক করে উঠত। কেবল মনে হতো এই বুঝি মায়ের কোন খারাপ খবর এলো। সে যে কী হিমশীতল ভয়!
সিকিউরিটির কয়েকটি ছেলে আবার আমার ছাত্র। ওখানে গিয়েই ওদের দেখতে পাই। তারা আমাকে সঙ্গ দিত, সান্ত্বনা দিতো। নিজেদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে আমার সঙ্গে গল্প করে দুশ্চিন্তা ভুলিয়ে রাখতে চাইতো।
দিন পাঁচ-ছয় পর মায়ের দায়িত্বে থাকা নিউরোসার্জন আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনার মা আজকে অনেক ভাল ভাই।বিপদ কেটে গেছে।’ জীবনে সেই প্রথম ঈশ্বরকে অনুভব করেছিলাম। ডাক্তার আমার পিঠ চাপড়াচ্ছিলেন, আমি নির্বাক দাঁড়িয়েছিলাম। আনন্দে চোখে জল এসে গিয়েছিল।
তারপরও সন্দেহ ছিল, মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরবে কিনা। ডাক্তারেরা বলছিল, মায়ের বাঁ দিকটা পুরোপুরি অচল হয়ে যাবে। আমি কেবল প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছি। মাসখানেক পর মা যখন বাড়ি ফিরল কেবল বাঁ-পাটা একচুল বেঁকিয়ে হাঁটে, আর সব স্বাভাবিক। ঈশ্বর আছে কি নেই জানিনা, কিন্তু জীবনে আর কখনো কোন প্রার্থনা এত প্রত্যক্ষভাবে পূরণ হতে দেখিনি।
আসলে ওভাবে আর প্রার্থনা করতেও পারিনি কোনদিন। চেষ্টা করেছি কতবার। বুঝেছি, চেষ্টা করলেও হয় না। অন্য আরও কিছু ব্যাপার আছে। প্রার্থনা করলেই যদি হতো তো এবার কেন আর রাখতে পারলাম না মাকে? কেন মায়ের শেষ বয়সের এই কষ্ট, স্মৃতিভ্রংশ হয়ে পড়ার যন্ত্রণা দূর করতে পারিনি? প্রার্থনা কি কম করেছি?
কাঁচের গোল টেবিলের পাশে সোফাটা ফাঁকা। মাকে ওখানে বসিয়ে রাখতাম। কাঠি-কাঠি পায়ের ওপর পা আড়াআড়ি ভাবে তুলে মা বসে থাকতো, পিঠ আর মাথা সোফার গায়ে ঠেকিয়ে। মুখটা এদিক-ওদিক ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করত কে এলো আর কে গেল। দৃষ্টি সোজা ছিল না, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেত। প্রায় সময়ই বড় বিষণ্ণ বড় নিষ্প্রভ। কাছে বসলে মাথাটা আমার কাঁধে রাখত নিশ্চিত আশ্রয়ের প্রত্যাশায়। অবসন্ন চোখগুলিতে ফুটে উঠতো ভীরু ছায়া।
‘এত ভয় পাও কেন মা?’
আমি জিজ্ঞেস করতাম। ক্ষীণ গলায় দুর্বলভাবে মা জবাব দিত,
‘মরে যে যাব বাবা, তাই। কোথায় যে যাবো মরার পর?’
‘সবাই তো একদিন মরবে মা। মরার ভয় পেলে চলবে?’
‘তোমাদের ছেড়ে চলে যাব ভাবলে কষ্ট হয় বাবা। আর তোমাদের দেখতে পাবো না।’
এ বিরাট জগতে কত কী বিস্ময় জমে আছে। বলে সবাই, খুঁজলে নাকি সবই পাওয়া যায়। অথচ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কি আরেকবার পেতে পারি যে চলে গেল তাকে? বাকি জীবনে আর কি কখনো দেখতে পাবো মায়ের সেই নিঃশব্দ হাসি? আরেকবার কি শুনতে পাবো সেই করুণ কন্ঠের বিষণ্ণ সুর? যতই ইচ্ছে তোলপাড় করুক না কেন সোফাতে বা বিছানায় মায়ের সেই অসহায় উপস্থিতি আমি আর খুঁজে পাবো না।
এমনি করেই আমার ইচ্ছেগুলি চিরকাল কণ্ঠ হারিয়ে এসেছে। একটা বিরাট মহীরূহ হওয়ার স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে এনেছে ছোটবেলা থেকে, যার থাকবে আশ্চর্য ছায়া। আর সেই ছায়াতে মাকে রেখে তার সারা জীবনের শোক-তাপ মুছিয়ে দেব। এমনি আচ্ছন্ন ছিলাম ওই অসম্ভব স্বপ্নে যে সময়ের খেয়াল রাখতে পারিনি। আজ সময় হারিয়ে সেই খেয়াল জেগেছে। মহীরূহ হওয়ার ইচ্ছে আমার নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মহীরূহ হওয়ার ইচ্ছেটা নয়, উদ্দেশ্যটা আসল ছিল, বুঝতে পারিনি। যাকে কেন্দ্র করে মহীরুহ হতে চেয়েছিলাম সে-ই যদি না থাকলো তো কিসের আর মোহ?
তবুও দেখি নিজের অজ্ঞাতসারে কখন একটা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি! মহীরূহ হতে পারিনি তো কী, এই যে গাছ হয়েছি এই বা মন্দ কোথায়? মাকে হারিয়ে বুঝতে পারলাম, সবাই মহীরুহু হতে পারে না কিন্তু কোনো না কোনো গাছ হতে পারে সবাই। এই গাছের ছায়াও বড়ই মনোরম।আমি আমাকেই বুঝতে পারিনি, দেখতে পাইনি আমার গাছটাকে।এই গাছেরই যেটুকু ছায়া ছিল তাতেই যদি যত্ন করে রাখতে পারতাম মায়ের বোধহয় মহীরুহের ছায়াতেও তত শান্তি হতো না।
অন্তরের হতাশা আর আক্ষেপগুলি কাঁটা হয়ে ফুটে বেরতে থাকে। পাতা খসিয়ে কাঁটা ভরা সারা গা নিয়ে আমি তারপর আগাছা হয়ে যাই। বিষাক্ত ছায়া নিয়ে বোবা দাঁড়িয়ে থাকি যেখানে মানুষ-পাখি কেউ আর আসে না।
অপ্রতিভ কুয়াশায়
কেউ বুঝতে চায় না। এই শোকাতুর বিবশতা, আমার এমন অকূল শূন্যতা, অন্তঃস্থলের এই বোবা কান্না, ধিকি ধিকি তুষের আগুন।
চারপাশে অনুল্লেখ্য বলয়াকৃতি গণ্ডিতে আবদ্ধ যাদের উপস্থিতি তারা বর্তমানে এমনই সম্পৃক্ত যে অতীত আর ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তা ভুলে যেতে হয়। ছোট ছোট স্বার্থ আর আত্মপ্রচারের গন্ডিগুলি সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে উঠতে থাকে।
মাতৃবিয়োগের শোকাতুরতা প্রকাশ করতে গেলে তাদের চোখের ভঙ্গিমা আমাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। আমাকে ঘিরে রাখা জনসমাজকে দেখে তখন মনে হয় আমি নিতান্ত অসামাজিক। বাধ্য হয়ে আমাকে ক্রমশ অন্তর্লীন করে তোলা ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই।
অথচ আমার এই শোকাতুরতা আমার কাছে কী ভীষণ স্বাভাবিক! বলয়াকীর্ণ যে জগত আমাকে ঘিরে থাকে তার অস্তিত্ব কেমন মিথ্যে লাগে। তারা শোক-দুঃখ-বিষাদ ভুলে থাকতে উন্মুখ, ভুলিয়ে দিতে চায়। এক অতিরঞ্জিত বাস্তবতার কুহক জড়িয়ে থাকে জগতের আপাদমস্তকে। এই নিষ্ঠুরতার নিষ্পেষণে আমি আখ-মারাই হতে থাকি।
সপ্রতিভ জগতের কাছে যতই তুচ্ছ হোক না কেন, ভূমিকা কিছু না থাকলেও আমি কখনো ভুলতে পারি না আমার মায়ের করুণ দুটি চোখের প্রকাশ। কোন শিথিল দুপুরে জানলায় বসে আকাশে যখন দেখি নীলের গায়ে মেঘের বর্ণমালা অক্ষর বিন্যাসে ব্যস্ত আমার মনে হয় মা আর বসবে না এমন সময় কখনো পাশটিতে । পড়াশুনা বড় ভালবাসত মা। যেকোন মূল্যে আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে তৈরি ছিল। মায়ের যে খুব লেখাপড়া হয়েছিল এমন নয়। মাধ্যমিক পাশও করতে পারেনি। একদিন আমাকে কথায় কথায় বলেছিল, ‘খুব ইচ্ছে ছিল রে বাবা অন্তত ক্লাস নাইনটা পাশ করি। পড়াশোনা করার আর সুযোগই পেলাম না।’
তাই আমাদের পড়াশোনা শেখাতে মায়ের কী যে প্রতিজ্ঞা ছিল! বাবার অকালমৃত্যুর পর মা সর্বস্ব পণ করেছিল কেবল আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য। তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকি, আমার জন্মও হয়নি। দিদি যে মেয়েদের স্কুলে পড়ত সেখানে উর্দু শেখা বাধ্যতামূলক। দিদিকে পড়াবার জন্য মা নিজে উর্দু শিখে নিয়েছিল। পুজোতে আমি পুজোসংখ্যাগুলি কিনলে আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়ত মা। ভালোবাসতো এডভেঞ্চার আর গোয়েন্দা কাহিনীগুলি। বড়দের লেখা প্রিয় ছিলনা মায়ের। আমারও একই ধাত। আমি কিনতাম সব ছোটদের পুজো সংখ্যা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর কাহিনী খুবই পছন্দ করত। পড়ত আর আমাকে বলত, ‘কাকাবাবুর কি সাহস রে বাবা!’
আসলে প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মায়ের নিজের জীবনেও বাস্তব বলেই এই ভালোলাগা। আর ভালোবাসত মা শরৎচন্দ্রের লেখা। চরিত্রহীন উপন্যাসের কথা কতবারই বলেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রও পড়েছিল মা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মুগ্ধতা থাকলেও তাঁর রচনা বিশেষ প্রিয় ছিল না, কিছু কিছু কবিতা ছাড়া। শরৎচন্দ্র-প্রীতি মায়ের অসম্ভব, বলতে গেলে উচ্ছ্বাসে অধীর হয়ে যেত, ‘গ্রামের যা বর্ণনা দিয়েছেন না শরৎচন্দ্র ভাবা যায় না! গ্রামের লোকগুলিকে একেবারে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে বইয়ের পাতায়।’
আমার পঠনপাঠনের আগ্রহ জেগেছিল মায়ের কাছ থেকেই। ত্রিপুরায় থেকে চলছে তখন জীবনযুদ্ধ। বাবা মারা গেছে। সারাদিনের খাটনি ছেড়ে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মা বড় ঘরের পিছনের দরজার কাছে জলচৌকিতে রামায়ণ নিয়ে বসত। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আম-কাঁঠালের ডালপাতায় হাওয়া খেলা করছে মিহি গলায়। মায়ের সুর করে রামায়ণ পড়া কি যে কবিতা বুনত! বাঁশঝাড়ের মাথায় বসে ডাক ছেড়ে জটলা পাকাত সাদা বকেরা। কাছাকাছি জঙ্গল থেকে ভেসে আসত অবিশ্রাম ঝিঝিঁপোকার কান অসাড় করে দেওয়া সাড়া । অনেক দূরে অকারণে ক্লান্ত স্বর তুলত ঘুঘুপাখি। এসবকিছুর সঙ্গেই মিশে যেত মায়ের রামায়ণ পাঠ। শ্রোতা আমি আর দিদি। আমার তখনও অক্ষরজ্ঞান ছিল না। কিন্তু রামায়ণের রঙিন ছবিগুলি আমাকে নিশির ডাক দিত। মায়ের পড়া হয়ে গেলে আমি রামায়ণ ঘাটাঘাটি শুরু করতাম। মা আপত্তি জানাত, কিন্তু কেড়ে নিয়ে যেত না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম কিভাবে অক্ষর চিনে পড়া যায়। তারপর সত্যি সত্যি পড়তে শিখে গেলাম। আমার পড়াশুনার সূত্রপাত ঘটেছিল ওই রামায়ণ দিয়ে।
দিদি তখন বি.এ. পড়ছে, প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে। পড়তে শুরু করেছিল কলকাতায়, কিন্তু হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের কাছে চলে আসে। মা তবুও তাকে কলকাতা রেখেই পড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু দিদি রাজি হয়নি। ত্রিপুরার সেই অখ্যাত গ্রামের নাম কাকারাবন, সেখানে কোন ডিগ্রী কলেজ ছিল না। পড়তে হলে দিদিকে যেতে হতো রাজধানী আগরতলায়, আমাদের বাড়ি থেকে অন্তত সত্তর-আশি কিলোমিটার, থাকতে হতো হোস্টেলে। মা তাতেও রাজি ছিল, যতই কষ্ট হোক না কেন, কিন্তু দিদি মাকে আর আমাকে ফেলে দূরে যেতে চাইলো না। দিদি বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করত, তার পড়াশোনার সঙ্গী হতো মা। পড়াবার এমন অদ্ভুত পদ্ধতি ভাবলে আজও অবাক লাগে। দিদি পড়ছে, মা কোন কাজ নিয়ে পাশে বসে শুনছে একমনে। আবার একটু পর পর জিজ্ঞেস করছে, তারপর কী হলো। ইতিহাসের কোন একটা অধ্যায় দিদি হয়তো আজ পড়ে রাখল খানিকটা, কাল মা তাকে পরের অংশটা পড়ে শোনাবার জন্য তাড়া দিয়ে বসালো। মাকে শোনাতে গিয়ে দিদির পড়া হয়ে যেত। তখন আমি খুবই ছোট, তবুও স্পষ্ট মনে আছে দিদি সন্ধের পর হারিকেনের আলোয় বসে ইলতুৎমিসের রাজ্যশাসন পড়ছে আর মা প্রতিমুহূর্তে তার উৎসাহ প্রকাশ করছে নানারকম মন্তব্য দিয়ে। হাজার কাজের মধ্যেও মা অনবরত দিদির সঙ্গে থেকে তাকে দিয়ে পড়াশোনা করিয়ে নিত।
বিস্মৃতির অন্ধকূপ থেকে আমি বহু চেষ্টায় খুঁজে বার করি কোন টুকরো ছবি—- দেখি দিদি বসে বসে মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য পড়ছে। এক একটি স্তবক পড়ার পর পঠিতাংশ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তার চলছে আলোচনা, আবার কৃত্তিবাসের কাহিনীর সঙ্গে তার তুলনাও হচ্ছে। মাটির মেঝেতে পাতা বিছানায় আমি তখন শুয়ে আছি। বিদ্যুৎ আসেনি গ্রামে, লণ্ঠনের আলোয় বসে পড়ছে দিদি। মা পাশে বসে হয়তো কুটনো কুটছে, পরদিনের জন্য। বাইরে হঠাৎ ঝাঁক বেঁধে শেয়ালরা হুক্কা-হুয়া ডাক জুড়ে দিল। অনেক দূরে বড় রাস্তা ধরে হাটুরে লোকেরা হয়তো দল বেঁধে ঘরে ফিরছে, তাদের কারো গলায় গানের চিৎকার। আর টানা আর্তনাদ ঝিঁঝিঁ পোকার। দিদি মাকে পড়ে শোনাচ্ছে ইন্দ্রজিতের যজ্ঞাগারে লক্ষণের প্রবেশ। মায়ের মন্তব্য কানে ভাসছে আমার, ‘আসলে ইন্দ্রজিৎ খুব বীর ছিল। লক্ষণের একা তাকে মারা কিছুতেই সম্ভব হতো না।।’
অথচ মা আমার কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তেই অভ্যস্ত, মধুসূদনের কাব্যে মায়ের এই প্রীতি আজ আমাকে অবাক করে।
সপ্রতিভ জগতের রাজনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, বাণিজ্য, কেরিয়ার-ভাবনা, চলন-বলন আমার কাছে জোলো হয়ে যেতে থাকে। আলোকোজ্জ্বল শহরের আকাশে চোখ রেখেও দেখি সপ্তর্ষিমণ্ডল তবুও আপন গৌরবে নির্বিকার। জগতের সপ্রতিভ বড়াই তাকে অগ্রাহ্য করলেও মুছে দিতে অপারগ। তার উপস্থিতিতে আমি দেখি মিটিমিটি কৌতুক। মাকে এখন পেলে জানাতাম, আমাদের অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ নেই।
গান, চেনা গান
গান শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম ছোট্ট উমুমতুমুমকে। কত আর বয়স তার, তিন হবে বড়জোর। হারমোনিয়াম দেখে সে কী কান্না তার ! বড়ই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আর এখনও চার বছরেও দেখি হারমোনিয়াম সম্পর্কে তার একটা অদ্ভুত সংকোচ। তার প্রশিক্ষিকা তাকে ফিঙ্গারিং যখন শেখান দেখি সে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে থাকে। আর উনি যখন নিজের মতো বাজান সে তখন অবাক বিস্ময়ে পলকহীন চোখ ফেলে রাখে হারমোনিয়ামের ওপর।
আমি একটু দূর থেকে দেখি ছোট্ট উমুমতুমুমের চোখের বিস্ময়, আর হারিয়ে যেতে থাকি অনেক অনেক দূরে। দেখি ওরই মত এমনই আরেকজনের শৈশব, হারমোনিয়াম তারও কাছে বড়ই বিস্ময়ের। সেই ফেলে আসা অবাক চোখ দুটির দৃষ্টি আমাকে কেমন বিবর্ণ করে দেয়। নিজেকে বড় বেশি সম্পৃক্ত মনে হয়, কারণ সে আমার নিজেরই শৈশব।
ন’মাস-ছ’মাস পর পর মা ঘরের পুরনো জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে গেলে হারমোনিয়ামটা বেরত কোন এক কোণ থেকে। কোন সূত্রে ছিল সেটা আমাদের ঘরে। পুরোপুরি অক্ষত ছিল না। এখনো চোখে ভাসে মা যখন নামাতো গা থেকে তার কাঠের কাঠামো খুলে খুলে যেত আর ভিতরের গোপনীয়তা উন্মুক্ত হয়ে পড়ত। ওই ভিতরটাকে দেখার ছিল আমার প্রচন্ড শখ। বেঁকানো লোহার শিক দেখতাম পরপর সাজানো রয়েছে। ওই শিকগুলোর নামা-ওঠা যে অদ্ভুত আওয়াজ বার করত তার উৎস খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে পড়তাম। মা কিন্তু আমাকে নাড়াঘাটা করতে দিত না একদমই। হাত দিতে গেলে হাঁ-হাঁ করে উঠত। যতই পুরনো হোক কাঠামো মা অবহেলা করত না কিছুমাত্র। যত্ন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলে রেখে দিত। মায়ের আমার এই এক স্বভাব, কোনকিছুই ফেলে দিতে দেখিনি কোনদিন। একটুকরো সুতোও দেখতাম সযত্নে তুলে রাখত। আর প্রায়ই মা বলতো, ‘তৃণটিও লাগে কাজে রাখিলে যতনে।’
পরে মনে আছে সেই হারমোনিয়ামকে উপলক্ষ করেই মাকে কিছুদিন পরপর ঘর গুছোতে হত। সে ভারি মজার ব্যাপার। হারমোনিয়ামের মধ্যে থেকে শোনা যেত কিচ-কিচ আওয়াজ, সে হারমোনিয়ামের নিজস্ব আওয়াজ নয় মোটেই। আর ফেলে রাখলে হারমোনিয়াম এমনি এমনি বাজবেই বা কেন ? ওই কিচ-কিচ আওয়াজ শুনলেই মা ঘরের কোণ থেকে রাজ্যের জিনিস নামিয়ে ফেলত, টেনে বার করত হারমোনিয়ামটাকে।
আমার সেই দৃশ্যটা এখনও স্পষ্ট চোখে ভাসে। খুব সতর্ক ভঙ্গিতে মা দুহাতে হারমোনিয়াম বুকে আগলে চৌকি থেকে নেমে আসছে, হারমোনিয়ামের ভারে মা কুঁজো। ওই কুঁজো হয়েই দুর্-দার কয়েক পা এসে ঘরের মেঝের ঠিক মধ্যিখানে হারমোনিয়াম নামিয়ে রাখল। তারপর নারকোল কাঠির ঝাঁটা হাতে এসে হারমোনিয়ামের সামনে উবু হয়ে তার গায়ের আলগা কাঠের কাঠামো আচমকা টেনে খুলে ফেলল। অমনি ভিতর থেকে তিরিং-বিরিং লাফিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো দু’- তিনটে নেংটি ইঁদুর আর তারা যে যেদিকে পারে ছুট লাগাল। মা-ও ঝাঁটাপেটা করতে করতে ছুটছিল একবার এদিকে আবার ওদিকে, যেদিকের ইঁদুর নাগালে পায়। হয়তো একটা ইঁদুরও ঝাঁটার আওতায় এলো না, খাটের তলা বা অন্য কোথাও দুরন্ত বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল। মা তখন ইঁদুরগুলোর বাপান্ত করতে করতে ঝাঁটাটা ফেলে হারমোনিয়ামের পাশে এসে বসল। আমার ভারি উৎসাহ, জানতাম মা এবার পুরো হারমোনিয়ামটাকে খুলবে। ভিতরে কোথায় সুরের উৎস দেখার যে কী কৌতুহল আমার !একটা একটা করে কাঠের ঢাকনা খুলত মা আর আমি ক্রমশ ঘন হতাম আরো কাছে। মায়ের কিন্তু আমার আগ্রহের দিকে নজর নেই, তখনও ইঁদুর গুলোর চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে চলেছে হারমোনিয়াম খুলতে খুলতে। আমি খুব কাছে চলে আসায় হয়তো অসুবিধে হল, খানিকটা বিরক্তভাবে এক ফাঁকে বলল আমাকে, ‘দেখি, সর্’— পরক্ষণেই আবার মুষিকবংশ উদ্ধার !আমার উৎসাহ আর উত্তেজনা কিছুই চোখে পড়ছিল না তার। আমি নিজেও জানতাম না কেমন ছিল সেই আমার উৎসাহের রং। আজ সেই কৌতূহল উদ্ধার করলাম মেয়ের চোখে। এমনই নিষ্পলকে উমুমতুমুমের মত আমিও নিশ্চয় তাকিয়েছিলাম সেই সুদূর অতীতে।
হারমোনিয়াম বাজাতে দেখিনি মাকে কোনদিন। মা নিশ্চয়ই জানতই না বাজাতে। মায়ের সব গান ছিল খালি গলায়। মাকে আমি গান ছাড়া ভাবতে পারতাম না। যখন-তখন কারণে-অকারণে মাকে কেবল গান করতে শুনতাম। হাড়ভাঙ্গা খাটনি চলুক বা বিশ্রাম, মায়ের গলায় সবসময় থাকত গান। পরে বুঝেছি, গান আসলে ছিল মায়ের কাছে ছিল এক মন্ত্র যা সমস্ত হা-হুতাশ ভুলিয়ে দিতে পারত।
ত্রিপুরায় থাকার দিনগুলি আমার মনে পড়ে। তখন মা যতই শোকাচ্ছন্ন থাকুক শরীর পূর্ণ সক্ষম। কাজে মায়ের চিরকালই খুব উৎসাহ। দুপুরে ঘুমোনো দূরের কথা, শুয়ে বিশ্রাম নিতেও দেখিনি কোনদিন। সারাদিন একটানা কাজ চলত মায়ের, সেই ভোর পাঁচটা-ছটা থেকে, সন্ধেবেলাও কিছু না কিছু কাজ থেকেই যেত। একটু রাতের দিকে কাজ থামত মায়ের। খাওয়ার আগে শুয়ে এক-দেড় ঘন্টা বিশ্রাম। তখন শুয়ে শুয়ে শুরু হত গান গাওয়ার পর্ব।
সমস্বরে শেয়ালদা ডেকে সন্ধে নামাতো। রাত বাড়তো আর কিছুটা সময় পরপর শেয়ালগুলো হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠত পিলে চমকে দিয়ে। জোৎস্না রাতে অদূরে দেখতাম খোলা মাঠগুলিতে অলৌকিক রিমঝিম, গাছ-গাছালির গায়ে ঝুলে থাকত থোকা থোকা অন্ধকার। ওখানে আমি এখন বুঝি সব কিছুই ছিল নিখাদ। কৃষ্ণপক্ষের কালো রাতগুলিও ছিল সত্যিই কালো। এখানে দেখি অমাবস্যার অন্ধকারও কেমন শ্বেতিরোগীর মত। দেখে আমার জ্বর-জ্বর বোধ হয়, গা বমি বমি লাগে।
আমাদের পুরনো বাড়ির ঠিক পাশটিতে ছিল দু’-দু’টি বাঁশ ঝাড়, ব্যবধান খুব বেশি হলে ত্রিশ-চল্লিশ হাত। বাঁশ ঝাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছিল কুয়েতলার দিকে, ওখানে আবার পেয়ারা গাছের জঙ্গল। দু’টি বাঁশঝাড়ের চরিত্র আর চেহারা ছিল দু’রকম, যদিও বাঁশগুলি জাতে এক। খুব ভালো বেত তৈরি হত ওই বাঁশ দিয়ে, নামই ছিল বেতের বাঁশ, কথ্য ভাষায় বলত সবাই ‘বেতির বাঁশ। সরু-পাতলা লম্বা লম্বা বেত ছাড়িয়ে তা দিয়ে তৈরি হতো ঝুড়ি, ঝাঁকা, ধামা, কুলো। ঝাঁকা বা ধামা নামগুলি বলত না কেউ। কুলোকে বলতো সবাই কুলা। ঝুড়ি বলতে বুঝতাম বাঁশের তৈরি বড় গামলার মত এক পাত্রকে যার গায়ে বড় বড় ফোকর, গরুর ঘাস কেটে ভরে আনার জন্য ছিল তার ব্যবহার। আর ছিল ওড়া, তার গায়ে কোন ফোকর থাকত না, সারা গা গোবর দিয়ে লেপা। ওড়া হত পাঁচ সেরি, দশ সেরি—- নানা আকারের। ওড়ার চেয়ে ছোট আয়তনের হত সাজি, অনেকেই বলতো তাকে পুরা। ধান রাখার জন্য গোলাও তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। আরেকটি বাঁশের পাত্র ছিল ডোল, চেহারা অনেকটা কালির দোয়াতের মত। ডোল হত বড় বড় আয়তনের, দু’-পাঁচ মণ ধান ধরত অনায়াসেই। আবার ছোট আয়তনেরও হতো। ধান ছাড়াও তাতে মুড়ি বা খই থাকত। ডোলের গা-ও ছিল গোবর দিয়ে নিপুণভাবে লেপা।
সন্ধের পর রাত বাড়তে থাকলে শেয়ালগুলো ডাকতে ডাকতে ঘরের পাশে বাঁশঝাড়ে চলে আসত। ওই বাঁশঝাড়ের পাশেই কোন গাছে বসে ডাকত নানারকম পেঁচা। কোন কোন পেঁচার ডাকে বুকের মধ্যে অজানা আতঙ্ক গুড়গুড় করে উঠত, শরীর জুড়ে বেজে যেত অদ্ভুত শিহরণ। কোন পেঁচা ডেকে রাতটাকে করে তুলত ভাবগম্ভীর। আমার কানে বাজে অন্য একটা পাখির ডাক, কোনদিনই চিনতে পারিনি পাখিটাকে। সে রোজই সন্ধের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিয়ম করে ডেকে যেত একটানা। বিরামহীন সুরে ডাউক-ডাউক ডাউক-ডাউক। ধ্বনিচিত্র শুনে মা বলত ওটাকে ডাহুক পাখি, পরে আমার মনে হয়েছিল ওটা অন্য কিছু। অন্তত ডাহুক পাখি নয়। মা আবার বলত মজা করে, ওই পাখিটা আমার বাবা, মৃত্যুর পর আমাদের এসে পাহারা দিচ্ছে। মায়ের কথায়, ‘বলছে, তোমরা ভয় পেয়ো না গো। আমি আছি।’
এমনই নৈশ প্রেক্ষাপটে মায়ের কন্ঠে গান বাজতে থাকত, একের পর এক। কত যে বৈচিত্র্য সেসব গানের আজও অবাক হয়ে ভাবি। কোন্ ছোটবেলায় মা গানগুলি বেশিরভাগ শুনেছিল তার ঠাকুমার গলায়, সব মুখস্থ করে নিয়েছিল। ওইসব গানের অনেকগুলি রামপ্রসাদী আর ছিল এমন সব আশ্চর্য গান যা অন্য কোথাও শুনিনি কখনো।
‘যন্ত্র যদি পড়ে থাকে লক্ষ জনার মাঝে
যন্ত্রী না হলে যন্ত্র কেমন করে বাজে। ‘
অথবা,
‘ওগো রানী মন্দোদরি, তুমি মিছে আমায় মন্দ বলো
আমার অশোক বনে লক্ষ্মী আছেন দ্বারে বাধা আছেন হরি…..
যদি বলো সীতে এনেছি লঙ্কাতে
আমার রাক্ষস দুরাচার বংশ উদ্ধার করিতে…..
রামের সীতে রামকে ফিরিয়ে দিতে পারি
কিন্তু বিভীষণ অরি দিবে টিটকারি
আমার সহেনা সহেনা প্রাণে…..’
গানের ওপর মায়ের টান ছিল অন্তরের। গান শুনতে বড়ই ভালোবাসত মা। অনেক অনেক পরে নানা রকম অসুখে যখন বিধ্বস্ত ঘুম আসতো না মায়ের। ডাক্তার লিখত ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে। ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে মায়ের ছিল খুব আপত্তি। আমি টেপ রেকর্ডারে গান চালিয়ে দিতাম। ওটাই ওষুধের কাজ করত। গান শুনতে শুনতে মা ঘুমিয়ে যেত।
যত কাজেই ব্যস্ত থাকুক না কেন রেডিওতে যখনই কোন ভালো-লাগা গান হত হাতের কাজ ফেলে শুনত বসে মা। মায়ের চরম দুর্দশার দিনগুলিতে দেখতাম কিভাবে গানকে আশ্রয় করে মা সব দুঃখ ভুলে থাকত। গান শোনার কোন বেশি ব্যবস্থা ছিল না তখন, রেডিও কেনারও সঙ্গতি ছিল না, দুঃসহ সেই দিনগুলিতে মা নিজেই নিজেকে গান শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখত। শেয়াল, পেঁচা আর রাতচরা পাখিদের ডাকের সঙ্গে মিশে যেত হওয়ার শব্দ। পৃথিবীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঘন থেকে ঘনতর হতে থাকত। রাতকে মনে হত কোন্ মায়াপুরীর কুহকজাল। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা গাইত অবিস্মরণীয় সেই সব গান :
‘শুন ব্রজরাজ স্বপনেতে আজ
দেখা দিয়ে গোপাল কোথা লুকালো !’
কোনদিনও মাকে বেসুরো গাইতে শুনিনি, বড় নিখুঁত ছিল তালজ্ঞান। এত এত গান মা কোন প্রথাগত রেওয়াজ ছাড়াই দীর্ঘকাল মুখস্থ রেখেছিল।
শহরের রাতগুলিতে আমি আর সেইসব ফেলে আসা রাতকে খুঁজে পাই না। তবুও যতই বিবর্ণ হোক আকাশে তারার ভিড় ঠিকই বুঝতে পারি। ওখানে কোথায় আছে আমার মা প্রায়ই অন্ধবিশ্বাসে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালাই। নিজেকে বড় একা লাগে, বড় নিঃসঙ্গ। আপাদমস্তক এই শূন্যতা রাতের পর রাত আমাকে ঘিরে রাখে, ঘর অন্ধকার করে ঘুমোতে গেলেই গিলে খেতে আসে, রাতে ঘুমোবার কথা ভাবলে তাই আতঙ্কে কাঁপি। ঘুম আমারও হারিয়ে গেছে। ভাবি, মায়ের মত চেষ্টা করে দেখলে হয় গান শুনে ঘুমাতে পারি কিনা। ভাবিই কেবল, চেষ্টা করতে যাই না ভয়ে। আমি আর গান শুনতে পারি না। গান শুনতে গেলে বড় বেশি মনে পড়ে মায়ের কথা, বুকে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। যদি সেইসব গান আবার শুনতে পেতাম মায়ের গলায় যা শুনতাম ফেলে আসা দিনে তাহলেই বুঝি এই কষ্ট কিছুটা কমত। মাকে আবার ফিরে পাই না। ঘুম নেই চোখে।
স্মৃতির ভারে ক্রমশ অচল হয়ে যেতে থাকি। হারানো দিনগুলি কি পুনরুদ্ধার করা যায় ? পৃথিবী আমাকে আজীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে, কেবল এই একটি ব্যাপারে সবাই দেখি নির্বাক। রাত্রির সর্বগ্রাসি বিষণ্ণতা দিনেও আমাকে অথর্ব বানিয়ে রাখে। চলি-ফিরি, নিজের মধ্যে নিজে থাকি না।
তবুও জীবনকে অস্বীকার করা যায় না। এযে কী অমোঘ বাস্তবতা বুঝি যখন উমুমতুমুম কচি কচি হাতে স্টিলের আলমারি বাজিয়ে আধো আধো বুলিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গায় আপন মনে, ‘বাঁশের সাঁকোয় পা দিয়ে পেরিয়ে ছোট্ট নালাটা।’
কেন জানিনা মনে হয় বুঝি শুনছি সেই বিস্মৃত রাতে আবার মায়ের গলা ! আমি তাকিয়ে থাকি কিছুটা অচেনা চোখে। মনে হয় : এই মেয়েটিকে আমি কি চিনি ? কোথায় যেন দেখেছি, কোথায় যেন ? মুখটা বড়ই চেনা চেনা লাগে। আমার হারিয়ে যাওয়া বিগত দিনগুলিতে ছিল কি তার উপস্থিতি ? দু’হাতে আলমারিতে বাজনা বাজায় আর টলোমলো গলায় সুর তোলে,
‘বনের ফাঁকে ফাঁকে রবির কিরণ ডাকে
সোনালি স্বপন আঁকে
বনছায়ায় মিশিয়ে
আমি চলি সেখান দিয়ে দিয়ে।’
তখন নিশ্চিত লাগে, আমার শৈশব আবার ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে তার সব মাধুর্য নিয়ে। মাকে মনে হয় কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। যদি না হত তাহলে এত ছোট্ট মেয়েটি শিখলো কোথায় এমন জটিল সুর-তাল-মাত্রা ?
হারমোনিয়ামটা মা তারপর পুরোপুরি খুলে ফেলত। আমার সামনে তখন প্রচলিত জগতের বাইরে অন্য একটা জগতের রহস্য উন্মোচিত। ময়ূরপঙ্খী মেঘ নীল পাখনা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে হাতের কাছে। মহাসমুদ্রে দেখছি ছায়া ভাসিয়ে হতভম্ব শঙ্খচিলের সবুজ উল্লাস ! হারমোনিয়ামের একেবারে তলা থেকে মা একের পর এক লালচে চামড়া দিয়ে ঢাকা ইঁদুর ছানা বার করে রাখত মেঝের ওপর। চোখ ফোটেনি তখনও ওদের। মেঝের ওপর ছেড়ে দিলে তারা চি-চি আওয়াজ তুলে অন্ধের মত বুক ঘষটে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই দেখে মায়ের আবার মায়া হয়। আমি প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে ছানাগুলির আরও কাছাকাছি যেতে চাইলে মা আমাকে আটকায়, আগলে রাখে ছানাগুলিকে।
‘সর্, ওদের গায়ে পা লাগবে। অবোলা জীব !’
হারমোনিয়ামটা এভাবেই আমাদের জন্য একটা ইঁদুর-কল হয়ে গিয়েছিল।
চোখে ভাসে
কোন নিস্তব্ধ প্রদেশের স্বপ্ন দেখি। মাটির আনাচে-কানাচে ক্লান্ত আলোর অলস চলাচল। সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই নিস্পন্দ তাকিয়ে থাকা কোন পাথরের মূর্তি যেমন। বসে থাকি একেবারেই একা আর আমাকে ঘিরে ফেলে আসা দিনগুলি যাতায়াত করে। আমার কৈশোরের দিনগুলি, যারা অনাদরে হারিয়ে গেছে।
তখন বুঝিনি তারা আমার এত প্রিয়। আজ সেই প্রদেশ ফেলে আসার পর উপলব্ধি করতে পারছি আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাসবায়ু ছিল ওখানেই। আসলে এমনই হয়। নাগালে যে রয়েছে তার কথা তেমন ভেবে দেখি না, যা অধরা তাকে পেতে মাথা খুঁড়ে মরি। এই করে করে হাতের পাঁচ হারিয়ে গেলে তখন বুঝি কী তার গুরুত্ব আর হায়-হায় করি। সেই ছোটবেলা থেকে মাকে বলতে শুনতাম চালু একটা কথা। বলত মা যখন তখন নানা প্রসঙ্গে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বুঝলে হয় !’
জীবনে এসে যেখানে দাঁড়িয়েছি দাঁতগুলো কিছুই নেই। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ছিল সেগুলি যখন মর্ম বুঝতে পারিনি। আমার কেবলই চোখে ভাসছে সেই দিনটি যেদিন মাকে নিয়ে ত্রিপুরা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। গন্তব্য ছিল কলকাতা যার স্বপ্নে মশগুল ছিলাম এতদিন। জীবনের প্রথম অধ্যায় ত্রিপুরাতে থাকার মেয়াদ আমার শৈশব আর কৈশোর, সেখানেই ফেলে রেখে এসেছি তাদের। এমনই মাতাল ছিলাম ওই শখের নেশায় যে মনে হত পাহাড়-জঙ্গলের এই অখাদ্য দেশটা ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচি।
রওনা দিয়েছিলাম সকাল সকাল, সাতটা বা আটটা হবেই। কলকাতার প্লেনটা বোধহয় ছাড়ার কথা ছিল বেলা দু’টো বা তিনটে নাগাদ। বিমানবন্দর আগরতলা শহর, আমাদের বাড়ি থেকে যার দূরত্ব কম করেও সত্তর-আশি কিলোমিটার। এতদিনের বাসস্থান ছেড়ে যাচ্ছি বরাবরের মতো, উদ্বেগ আর উত্তেজনা চলছিল কদিন ধরে। বোধহয় তা বেড়ে চূড়ান্ত হয়েছিল আগের দিন। রাতে কি ঘুমোতে পেরেছিলাম? ভাবতে গিয়ে আজ দেখছি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। দেখাগুলি এতই অস্পষ্ট যে পড়তে পারছি না। তবুও আবছাভাবে দেখছি মায়ের চলাফেরা। মা চিরকালই শীর্ণকায়া, খুব একটা লম্বাও নয়। বছরের পর বছর খাটুনি আর খাটুনি মায়ের শরীর আরো ভেঙে দিয়েছে। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স তখন, তার ওপর শুরু হয়েছে অসুখ-বিসুখের আক্রমণ। তবুও মা কাজ করতে পারে একটানা। কাজ করতে করতে শরীরটা কুঁজো হয়ে যায়, কাজ থামেনা। চোখে ভাসে, গায়ে আটোআটো সাদা ব্লাউজ, সায়ার ওপর কালো পাড়ের সাদা কাপড়টা কয়েক পাকে জড়িয়ে কোমরে মোটা করে গোজা শেষপ্রান্ত কোনো রকমে বুকে জড়িয়ে পিঠ দিয়ে এনে আবার কোমরে গুজে রাখা। চুল কখনো খোলা থাকে না মায়ের। যদিও কম তবুও মাথার পিছনে সব সময় গুটুলি খোঁপা। গোছগাছ করছিল মা ক’দিন ধরেই। কত যে জিনিসপত্র ! গুছিয়ে মা কুলিয়ে উঠতে পারেনা। এটা গোছায় ওটা গোছায় আর অনর্গল কথা বলে,
‘রাজ্যের জিনিস রে বাবা। কত আর নেওয়া যায় ? বোঝাও তো কম নয়। সারা জীবন আমার গোছাতে গোছাতেই গেল। একবার এই দেশ ছেড়ে ওই দেশে যাও, আবার সেই দেশে। আর পারি না রে বাবা।’
বড়ই দুশ্চিন্তা আগের দিন। সঙ্গে আছে দুটো-তিনটে ব্যাগ আর ঝোলা, দুটো-তিনটে বড় ট্রাঙ্ক আর শতরঞ্চি দিয়ে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে যথাসম্ভব টাইপ করে বাঁধা লম্বা পেটমোটা একটা বেডিং। এত দূরের রাস্তা এত মালপত্র নিয়ে কিভাবে যে যাওয়া যাবে ? অন্তত তিনবার গাড়ি পাল্টাতে হবে। সম্ভব ? মায়ের রোগা-রোগা মুখটা দুশ্চিন্তায় আরও শুকনো হয়ে ওঠে।
‘প্লেনটা ধরতে পারবো তো রে বাবা ? যদি শেষে মিস করি ? তাহলে আর উপায় নেই।’
বারবার আমার কাছে এসে দুশ্চিন্তা জানায় মা। আমি উড়িয়ে দিই, একেবারেই পাত্তা দিই না এত দুর্ভাবনা। ভিতরে ভিতরে নিজেও কিছু উদ্বেগে ভুগি, মাকে বুঝতে দিই না। বুঝলে মা যে আরও কাতর হয়ে পড়বে।
সকালে উঠেই জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে আমি গাড়ি ঠিক করতে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ ভেবেচিন্তে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেললাম। চুক্তি হলো একেবারে এয়ারপোর্ট অব্দি পৌঁছে দেবে। ত্রিপুরার পাহাড়ি রাস্তায় ভাড়ার ট্যাক্সি চলে না। ট্যাক্সিরা সব শেয়ারে চলে, পেটে ন’-দশ জন যাত্রী বোঝাই করে। বড়ই দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম আমি ওভাবে ট্যাক্সি রিজার্ভ করে। ভাড়াটা হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি লেগেছিল। মা শুনে প্রথমটায় শিউরে উঠেছিল, পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিল যে একটু বেশি ভাড়া লাগলেও কাজটা আমি ঠিকই করেছিলাম।
হুবহু না হলেও যাত্রাপথটা আমার চোখে ভাসে। ট্যাক্সিচালক ছিল অল্পবয়সী একটা ছেলে। ছোটখাটো রোগা চেহারা, শান্ত স্বভাব। অতটা রাস্তা ধীরেসুস্থে চালিয়ে নিয়ে গেল সে। বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম বেলা বারোটার মধ্যেই। রিক্সার ঝাঁকুনি আর দীর্ঘ জার্নি মায়ের চিরকাল অপছন্দ। অথচ সেই ট্যাক্সিযাত্রায় মা ততটা কাবু হয়নি। সারা রাস্তা পিছনে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেছিল। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলছিল, আবার ট্যাক্সিচালক ছেলেটির সঙ্গেও কিছু কিছু কথা হচ্ছিল। আজ সে সবকিছুই আর মনে করতে পারছি না। কেবল দেখতে পাচ্ছি, বিছানা আর ট্রাঙ্কগুলি পিছনের ডালায় রাখার পর ঢাকনা পুরোপুরি বন্ধ হল না। রাস্তায় না আবার কিছু পড়ে যায় এই নিয়ে মায়ের খুব দুশ্চিন্তা। ট্যাক্সিচালক ছেলেটা অভয় দিল। মালপত্র সে একা হাতে গুছিয়ে রেখে দড়ি দিয়ে ডালার ঢাকনা ভালোমতো বেঁধে রাখল। দু’-একটা বোঁচকা মা কিছুতেই কাজ ছাড়া করবে না, নিজের কাছেই নিয়ে বসল। এই নিয়ে আমার সঙ্গে খানিকটা অশান্তি। বোঁচকাগুলি থাকায় বসতে একটু অসুবিধেই হচ্ছিল।
উদয়পুর থেকে গোমতী নদী পেরিয়ে আগরতলা যাওয়ার দীর্ঘ পথের মনোরম শোভা কী স্পষ্ট চোখে ভাসে ! কখনো পাহাড় কখনো জঙ্গল, কখনো দু’পাশে ঢেউখেলানো দিগন্তছোঁয়া প্রান্তর। পথ কোথাও সর্পিল কোথাও সমতল, কোথাও অগুনতি চড়াই-উৎরাই দিয়ে সাজানো। অসংখ্য সেতু, কাঠের বা কংক্রিটের। ওই রাস্তা ধরে যেতে যেতে কতবার আমি ভেবেছি সেগুলির মোট সংখ্যা গুনে রাখব। কিন্তু যাত্রা শুরুতে মনে থাকে নি কোনদিন। সংখ্যাটা আর গোনাও হয়ে ওঠেনি।
এত আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার আর মায়ের সময় কাটে না। আমি এদিক-সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখি। নিজেকে মনে হচ্ছিল বেশ সাবালক। মা জিনিসপত্র আগলে লাউঞ্জে বসে থাকে। একটু-আধটু ঘোরাঘুরির ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারেনা। আমি বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে থাকলে আবার দুশ্চিন্তায় ভোগে কোথায় গেলাম ভেবে। কাছে এলেই বলে,
‘বোসো বাবা। আর কোথাও যেওনা। আমার কাছে থাকো।’
নিজেই আবার বিরক্তি প্রকাশ করে একটু পর পর,
‘বাবারে বাবা, বসে থাকতে থাকতে পিত্তি মজে গেল।’
এয়ারপোর্ট-এর রেস্তোরাঁতে হয়তো মাকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। কী যে খেয়েছিলাম মনে নেই, তবে খাওয়াটা বিশেষ সুখের হয়নি। মা হয়তো খায়নি কিছুই। আশায় ছিলাম প্লেনে কিছু খাবার-দাবার দেবে নিশ্চয়ই।
সেই প্লেন এলো ঠিক সময়েই। শুরু হল বিমানবন্দরে কর্মব্যস্ততা, হৈ-চৈ। এতক্ষণ এলাকাটা ছিল শুনশান, পরিত্যক্ত অঞ্চলের মতো। মনে হচ্ছিল জন্মে কেউ আসে না এখানে। আর এখন চিত্র একেবারেই অন্যরকম। মাকে নিয়ে প্লেনে চড়ে বসলাম আমি। দু’জনের আসন, মাকে বসতে দিলাম জানালার পাশে। যদিও মা আগে অনেকবারই প্লেনে চেপেছে, তবুও আমি জানলাটা মাকে ছেড়ে না দিয়ে পারলাম না। মায়ের যে খুব প্রিয় ওই জায়গাটা।
তারপর একটা মিহি আওয়াজ শুনতে পেলাম, প্লেনের ইঞ্জিন চালু হল। প্রপেলার ঘুরতে লাগল, আওয়াজ বেড়ে গিয়ে কানে তালা ধরিয়ে দিল। প্লেনের সারা দেহে কম্পন। তারপর সেটা অলস গতিতে চলতে চলতে রান ওয়ের মুখে এসে দাঁড়ালো, শুরু হলো চূড়ান্ত দৌড়। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি ছাড়লো প্লেন।মা বিষণ্ণ সুরে আমাকে বলল,
‘বুকটা কেমন পাড় দিয়ে ওঠে, সব জন্মের মত ছেড়ে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের ওপরে ভাসছে তখন প্লেন। তলায় এক বিশাল ক্যানভাসে বাড়িঘর, গাছপালা, নদী-জলাভূমি আঁকা। মা জানলার কাছে মাথা ঠেকিয়ে দেখছে আবার একটু পরপর আমি দেখতে পাচ্ছি কিনা জানতে চাইছে। মুগ্ধ গলায় কখনো বা বলছে,
‘চমৎকার সিনারি। পুতুলের মত লাগছে সব।’
এখন আর কোন উদ্বেগ নেই, উত্তেজনাও নেই। এবার আমার মনে পড়ছিল কী ছেড়ে এলাম। কিজানি কেন বুকের কোন্ গভীর অতলে এই প্রথম ক্ষীণ একটা বিষণ্ণ সুর অনুভব করলাম। আর তখন মা জানলা থেকে মাথা তুলে নিস্প্রভ গলায় বলল,
‘মনটা বড় খারাপ লাগছে রে বাবা। টুসিটাকে ফেলে এলাম।’
টুসি আমার দিদির ডাকনাম। কাছাকাছি বাড়িতেই থাকত দিদি ও তার পরিবার, প্রায় একসঙ্গেই থাকা। সবসময় আমারও তখন মনে পড়ছিল দিদি আর তার ছেলে মেয়েগুলির কথা। চলে আসার সময় তাদের অশ্রুসজল মুখগুলি। বুকের তলায় কী যেন পাক দিয়ে উঠছিল। আর কি কোনদিন ওভাবে কাছাকাছি থাকতে পারব আবার ? আর চোখে তাকিয়ে দেখি, মায়েরও সমস্ত মুখ জুড়ে কান্নার রং। সেই বিষণ্ণ কাতর মুখের ছবি আমার কী যে স্পষ্ট চোখে ভাসে ! জানালায় চোখ পড়তে দেখি মেঘের সাম্রাজ্যে ভাসছে প্লেন। নিচের দৃশ্য সবই মেঘে ঢাকা।
জন্মান্তরের কবিতা
একটি মানুষ কিভাবে তৈরি হয় ? নিজেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করি। যেখানে আছি আমাকে দেখে আমারই কেমন ধাঁধা লাগে। এ কি সেই আমি যাকে খুঁজে পাই অন্য সব দিনগুলির মানচিত্রে ? আমাকে কখনো দেখি কোন এক আশ্চর্য পথে, সেই পথ নাগালে না থাকলেও জানি একদিন নিয়মিত হাঁটতাম ওখানে। আবার আমি আমাকে দেখি দাঁড়িয়ে আছি কোন একটি জলার ধারে, ডাকমা জলা, তার পুব আর উত্তর দিকটা ছবি—- জলা থেকে ঢালে উঠে যাওয়া উঁচু-নিচু জমির কাঁথায় ঝাঁকড়া-মাথা গাছগাছালি আর ধনুক-চালা কুঁড়েঘরের নকশা। অবাক লাগে আমি কখনো সেখানে ছিলাম যখন ভাবি। এই জীবনেই।
আজও আমি ওই পুকুর আর জলার ধারে গিয়ে দাঁড়াই, ভাবনায়, আর দাঁড়ালে দেখি আমার মাকে। মা আজ আমার কাছে স্মৃতি, আসবে এই দিনটা কোনদিন জানতাম। প্রস্তুত থাকলেও এখন যখন এলো কিছুতেই মানতে পারছি না। ধান বোনা আর ধান কাটার মরশুমগুলিতে মাকে দেখি হরদম ওই জলার ধারে, এছাড়াও সারাদিন যখন-তখন নানা কাজে যেত মা ওই পুকুরধারে, স্নান সারতে বা ঘাস তুলতে। মায়ের যে আমার কত কাজ ছিল সারাদিন জুড়ে, কাজ আর দুশ্চিন্তা। জমি-বাড়ি সবই এ দেশে এনে বাবা মারা গিয়েছিল, কার ভাগে কতটা কিছুই ঠিক নেই। যাদের সঙ্গী করে এনেছিল বাবা তারাই এখন সব ছিনিয়ে নিতে উদ্যত। তাদের সঙ্গে লড়াই মায়ের দিনরাত। তারা দলে ভারি, অনেক জনতার জোর তাদের, আশেপাশের লোকজনরাও সব ওদেরই পক্ষে। মায়ের আর কে আছে ? বড় মেয়েটির সতের-আঠেরো বছর, ষোল-সতেরোর বড় ছেলেটি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে, পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট ছেলেটি আবার শারীরিকভাবে দুর্বল। মায়ের একা লড়াই, সঙ্গী শ্রীগোবিন্দ।
জমিতে আমাদের ধান হয় বছরে বড়জোর চল্লিশ মণ। একফসলী জমি, কেবল বোরো ধানের চাষ। ওই ধানের জমি ডাকমা জলায়। জলাজমি ছাড়া আছে টিলার উঁচু জমি, অধিকাংশটা জুড়ে আম-কাঁঠাল আর আনারসের বাগান আর জঙ্গল। ওখানে ফাঁকা মাঠও আছে, তাতে নামমাত্র ফসল হয়, নামমাত্রই। জলাজমির তুলনায় টিলা জমির আয় দশ ভাগের এক ভাগও নয়। এমনকি আম-কাঁঠাল আর আনারসের বাগান থেকেও বছরে খুব কমই টাকা আসে।
আনারস আর কাঁঠাল বাগানটা বেশ বড়, এমাথা ওমাথা ঘুরে আসতে এক-দু’ ঘন্টা লেগে যায়। অবশ্য ঘুরে আসাটা মুখের কথা নয়, বুনো ঝোঁপ আর জংলা গাছের এমন জঙ্গল যে প্রায়ই চলা দায়। ওই জঙ্গলে ঝাঁক ঝাঁক শেয়ালের বসবাস, এখানে ওখানে তাদের অজস্র গর্ত। রাত্তিরে তারা প্রহরে প্রহরে সমস্বরে ডাকে, দিনেও নির্ভয়ে সারা জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। আর আছে বনবেড়াল, বাঘডাশ জাতীয় প্রাণী। সাপ রয়েছে প্রচুর, কিছু কিছু খুবই বিষাক্ত।
একবার এক কাণ্ড হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার দু’-এক বছর পরের ঘটনা হবে হয়তো, মায়ের তখনও মনের অবস্থা বড়ই বিষণ্ণ। কাজে-কর্মে মন বসাতে পারছে না, আবার না বসালেও নয় বুঝে অস্থির হয়ে থাকে। সে যে কী উভয়সংকট চলছিল মায়ের বোঝার কেউ ছিল না তখন। পরেও কি মা তার সেদিনের মর্মান্তিক মর্মবেদনার কথা বোঝাবার কোন উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েছিল কখনও ?/ আমাকে বললে আমি শুনতাম এই যা। কতটা মায়ের সঙ্গী হতে পারতাম ? সেই যে মা বলত,
‘কেঁদে কেঁদে একদিন শেষে দেখি কী, ও মা, আমি যে চোখে কিছুই দেখতে পাই না ! কানা-মানা হয়ে যাব নাকি শেষে ? তাহলে আমার তপুর কী হবে ? ওকে কে দেখবে ? সেদিন থেকে ভাবলাম, দূর্, যে গেছে সে তো গেছেই। বসে বসে ঘরের মধ্যে কাঁদলে তো আর তাকে ফেরত পাবনা ? বরং যারা বেঁচে আছে তাদেরও প্রাণ যাবে।’
মাটির জগতে মায়ের সেই ফিরে আসা কতটা কঠিন ছিল আমি আজ কিছুটা কি বুঝতে শিখেছি ? যখন মগ্ন হই কোনকাজে, অন্তঃস্থলের কোন তাগিদে, আর আনন্দ পাওয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়, হঠাৎই কোত্থেকে একটা পিন সূক্ষ্ম খোঁচা মেরে জানায় আমি কী হারিয়েছি। ব্যাপক শূন্যতা তখনই সর্বগ্রাসী হাঁ-মুখে গিলে নিতে থাকে আর আমি ক্রমশ অবশ-আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। থেমে যেতে থাকে আমার সমস্ত কাজের উন্মাদনা। কেবলই আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে বাজতে থাকে ‘মা নেই-মা নেই’ হা-হা রণন। অথচ আমাকে আনন্দে রাখার আয়োজনগুলিও তুলনায় কী প্রবল ! মায়ের সেই ফিরে আসার প্রক্রিয়াকে কোনভাবেই মেলাতে পারি না আমার সঙ্গে। আমি ফিরে আসতে পারছিনা এখনো অথচ মা ফিরে এসেছিল অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায়। মায়ের সেই ফিরে আসার দিনগুলিতে যতরকম ঘটনাবলী তার মধ্যে সেই কাণ্ড, আজও চোখে ভাসে।
হয়েছিল কী, একটা বাঘ এসে নাকি কোত্থেকে জুটেছিল আমাদের কাঁঠাল-আনারস বাগানে। সকালবেলাতেই লোকে-লোকারণ্য ওই জঙ্গলের লাগোয়া মাঠে। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে দা—- যে যা পারে নিয়ে হাজির। কাছেই আমাদের টিলার কাঁঠাল গাছ, চেহারাটা ছোটখাটো, কাঁঠাল ধরলে মাটিতে লেগে যায় আর শেয়ালগুলির পোয়াবারো। মায়ের খুব হা-হুতাশ গাছটার বোকামি দেখে। সত্যিই কী বোকা গাছ ! ফল ফলাবি তো ফলা একটু ওপরদিকে যাতে কেউ নাগাল না পায়।চেহারায় ছোট হলে কী হবে কাঁঠাল ফলত গাছটা বিপুল পরিমাণে। অবশ্য কোয়াগুলি সব শক্ত-শক্ত, চলতি ভাষায় বলত সবাই, চাউল্লা কাঁঠাল ।
ওই অঞ্চলে ভাষাটা আমাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ, ভাষার স্বকীয়তা বলতে কিছুই আর ছিল না। পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হয়ে যে লোকগুলি এসেছিল তাদের কেউ ঢাকার, কেউ চিটাগাং-এর, কেউ নোয়াখালির, কেউ কুমিল্লার। তারা ত্রিপুরায় এসে একপাত্রে ব্যঞ্জন, মিলেমিশে একাকার। ওই জঙ্গলে ছাওয়া পার্বত্য প্রদেশে এখন বেঁচে থাকার যুদ্ধটাই মুখ্য। কত যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের এভাবে অপমৃত্যু ঘটে গেল ! ভাষার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অহরহ লক্ষ করা যেত। মায়ের বাড়ি ছিল ঢাকায় আমরা কুমিল্লার। মা আর আমরা কাঁঠালকে কাঁঠাল বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। অধিকাংশ লোকরা বলত, কাডল আর নোয়াখালীর লোকরা কান্ডল ।
কে যে প্রথম আবিষ্কার করেছিল ছোট মাঠটার ধারের ওই জঙ্গলে বাঘ এসে আশ্রয় নিয়েছে কে জানে ! সন্ত্রস্ত জনতার কোলাহলে আমরা টের পেয়েছিলাম। বাঘটা নাকি রুগ্ন আর কিছুটা অশক্ত। সমবেত জনমণ্ডলীর মধ্যে অনেকেই মাতব্বর। তাদের কত কত উপদেশ আর বিধান। মা আমার ঘরে আমাদের কাছে বলেছিল,
‘বাঘ না কচু ! ওরা কেউ জন্মে বাঘ দেখেছে ? বাঘ চেনেই না।’
ছোট মাঠটার একদিকে টিলার সেই কাঁঠাল গাছ, তার লাগোয়া অন্যদিকে বাঘাশ্রিত ওই জঙ্গল। তার পাশ দিয়ে টানা রাস্তা চলে গেছে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত, রাস্তার ওধারে আবার টানা মাঠ। ওই ছোট মাঠের অন্য পাশটায় চওড়া আলের পর আরেক মাঠ, সেই মাঠের ওধারে একটা বিশাল লিচু গাছ আর রাস্তার সঙ্গে যেখানে মাঠটা মিশেছে সেখানে আমবাগানের সূচনা। ওই লিচুতলার মাঠে দুই মাঠের মধ্যবর্তী ঘাসে ছাওয়া চওড়া আলের ধারে বসে এক বিকেলে আমি অতি দীর্ঘ এক কবিতার শেষাংশ লিখেছিলাম। লিখতে লিখতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। কাছেই আবার রাস্তাটার ঠিক গা ঘেঁষে এক দীর্ঘদেহী কুলগাছ। সেই একনিষ্ঠ কিশোর কবিটিকে এখনও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। চোখ না বুজেও। তার চোখে তখন অজস্র স্বপ্ন। কত কিছু করে ফেলার প্রতিজ্ঞা বুকের খাঁচায়। তার দু’-দিন পরই ত্রিপুরা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার কথা আমাদের।
প্রায় ত্রিশ বছর আগে সেই সহজ কবিকে আমি ফেলে এসেছি তপস্যাস্নিগ্ধ এক ঘাসের মাঠে। তারপর ত্রিশ বছরের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় তাকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন তারা সবই আমার কাছে জন্মান্তরের ইতিহাস। আমার সেই শৈশবের বৃন্দাবনে এখনও ধবলী-শ্যামলীরা ঘুরে বেড়ায়। অথচ আমি জানি, তাদের আর ফিরে পাব না। পিছনে তাকালে কেবল কষ্ট বুকে ঘনীভূত হয়, নিশ্চল হয়ে আসে চেতনা। ওই মাঠের ধার ধরে আমি দেখি সন্ধে-লাগা লগ্নে মা আমার ধলী গাইটাকে রুগ্ন বাছুরসমেত ঘরের দিকে নিয়ে চলেছে। আমি তাকিয়ে থাকি তাকিয়ে থাকি, আচ্ছন্ন আর অবসন্ন চারদিক। নিরাকার, বোবা, বিবর্ণ।
নদীর নাম গোমতী
কেউ যে কত প্রিয় বোঝা যায় বিচ্ছেদ হলে। আমার জীবনে একটি নদী এসেছিল। শৈশব, বালকবেলা আর কৈশোর সেই নদীকে দেখে কেটেছিল। যখন ছিলাম কাছাকাছি, চলতে-ফিরতে দেখা হত তখন বুঝিনি তাকে দেখা কেমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাকে না দেখতে পেলে কষ্ট হবে কিনা। আজ সেই নদীর কাছ থেকে অনেক দূর সরে এসে আমার বসবাস। তাকে আর দেখার উপায় নেই। আমার কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে।
হয়তো সবারই জীবনে কোন না কোন প্রিয় নদী আছে। জীবনে আমিও অনেক নদী দেখেছি। কিন্তু একটি নদীই আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার নাম গোমতী। ত্রিপুরা রাজ্যে সে নদীর ঘরসংসার। আমার সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা হত যখন আমিও সেখানে ছিলাম। কত যে বিচিত্র পরিবেশে তার সঙ্গে দেখা হত ! কখনো বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সরষে খেত, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে গোমতী, একেবারেই নিরীহ মেজাজে। আবার সেই নদীতেই দেখতে পেতাম দু’পাশে খাড়াই পাহাড়ি ঢাল রেখে গভীর খাদ বানিয়ে দুর্বার ছন্দে এগিয়ে চলেছে। কখনোবা দীর্ঘদেহী শাল গাছের জঙ্গল কাটিয়ে যাওয়ার সময় দেখতাম নদীর বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিঃশব্দ ঝোপঝাড় বা হৃষ্টপুষ্ট কোন গাছ। পাড়াগাঁয়ের রান্নাঘর আর সবজি বাগানের পাশ দিয়েও তাকে বয়ে যেতে দেখেছি পাড়াবেড়ানো আইবুড়ো মেয়েদের মত। আবার সঘন আখখেতের পর রুক্ষ মেঠো জমি পেরিয়ে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলার ঢাল ধরে অনেকটা এগিয়ে কোনদিন খুঁজে পেয়েছি গোমতীকে, ওধারে উঁচু পারে বিক্ষিপ্ত ভাঙ্গনের চিহ্ন লাল মাটির দেয়ালে, যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে গাঙশালিকের হই-চই। তখন পৃথিবীর অবসন্ন বুকে দেখা দিয়েছে গোধূলি, নদীর কালো চঞ্চল জলে রক্তবর্ণের খাপছাড়া ঝিকিমিকি। তার পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম একা বা বন্ধুদের সঙ্গে অথচ বুঝতাম না সে আমার কত প্রিয় হয়ে গেছে। এখন জীবনের অন্য অর্ধ আমাকে নিয়ে এসেছে অন্য রাজ্যে। গোমতীকে ফেলে এসেছি অনেক দূরে। আর তার দেখা পাই না। কোন কোন দিন বাড়ির ছাদে নিস্তব্ধরাতে একা যদি ঘুরি, হয়তো আকাশে দেখা হয় ছায়াপথের সঙ্গে। তার আদল খানিকটা নদীর মতো। তখন আমার মনে পড়ে গোমতীর মুখ। আমার কেমন কান্না পেতে থাকে।
বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যেত সেই নদী। পিচের রাস্তা বাজারের বুক চিরে সোজা চলে গিয়েছিল নদী পর্যন্ত, হেঁটে অন্তত দশ-পনের মিনিট। বাজারের পর ওই রাস্তার বাঁ ধারে লোকজনের বাড়িঘর, ডান ধারে বিশাল চর আর তাতে সবজি খেত। নদী যেদিকে চলেছে তার উল্টোমুখী ওই চরের জমি বিস্তৃত হতে হতে চলে গেছে দূরের গ্রামে, চাঁদ সাক্ষী রেখে কত কত রাত সেইসব জমির আল ধরে চলে যেতাম কত গাঁয়ে। কুয়াশা গায়ে জড়িয়ে নিথর হয়ে থাকত সরষে খেত, লাল শাক ভিজে থাকত সদ্য শিশিরে। বাজার থেকে বেরিয়ে রাস্তা নদী পর্যন্ত যাওয়ার বাঁ হাতে লোকজনের বাড়িঘর। কিছুটা পার হওয়ার পর বাঁ দিক থেকেই অন্য একটি রাস্তা চলে গেছে মির্জা বলে এক জনপদের দিকে। আরেকটু এগিয়ে গেলে আবার আরেকটি রাস্তা ওই বাঁ ধার থেকেই বেরিয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়ে মিলেছে উপজাতি অধ্যুষিত তৈবান্দাল এলাকায়। তারপরে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে, ডানপাশে বেদিবাঁধানো এক বিশাল বটগাছকে রেখে। ওই বটগাছের তলায় চৈত্র সংক্রান্তিতে জাঁকজমক করে শিবের পুজো হত। মা ডালা সাজিয়ে যেত, আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে অন্তত দেড়-দু’ কিলোমিটার। আমিও যেতাম মায়ের সঙ্গে। সকালে উঠে স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে ডালা সাজাতে বসত মা। সেই আনন্দ আমার আজ হারিয়ে গেছে। জীবনে কত কী যে হারিয়ে যায়, ফিরে পাওয়ার উপায় থাকে না। কোন এক বন্যায় নদীর জলের ধাক্কা সেই বটগাছটাকেও বেবিসুদ্ধ উপড়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
এদিক থেকে রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছিল নদীর এধারে, ওধার থেকে আবার রাস্তার সূত্রপাত। আসলে রাস্তা একটাই, মাঝখানটা নদী কেটে দিয়েছিল। যাত্রীবাহী বাসগুলি নদীর এপারে যাত্রীদের নামিয়ে দিত, তারা সব নৌকো করে নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করত। বাসও পার হত নৌকায়। দু’টি বড় বড় নৌকো পাশাপাশি জুড়ে ওপরে কাঠের পাঠাতন বানানো হত। বাস রাস্তা থেকে উঠে যেত সেই কাঠের পাঠাতনে। ওপারে গিয়ে নৌকো ছেড়ে আবার রাস্তায় নামলে অপেক্ষমান যাত্রীরা সব হই হই করে উঠে বসত বাসে। একবার একটা বাস পাটাতনে উঠেই ভারসাম্য হারিয়ে সোজা গিয়ে পড়েছিল নদীর মধ্যে। সে এক হুলস্থুল কান্ড।
নদীর সেই খেয়াঘাটকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত গুদারাঘাট। তার মালিক ছিল চিন্তা সিং নামের একটা লোক। সেই চিন্তা সিং-এর দশাসই চেহারা, গাল বেয়ে নেমে এসেছে বিশাল গোঁফজোড়া। বটবেদির ঠিক ধার ঘেঁষে ছিল একটা বেড়ার ঘর। তার মধ্যে মাচার ওপর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ক্যাশ বাক্সকে তাকিয়া বানিয়ে বসে থাকতো চিন্তা সিং। পরনে তার ধুতি আর গেঞ্জি, বাড়ি তার বিহারে। যানবাহন আর লোকজন নদী পারাপারের সময় পয়সা দিয়ে যেত চিন্তা সিং-এর ক্যাশবাক্সে।
শুনতাম চিন্তা সিং-এর স্বভাব নাকি ভালো ছিল না। তার গুদারাঘাটের পাশেই আবার ছিল একটা দেশি মদের ঠেক, তারও মালিক চিন্তা সিং। সেই ছোট বয়সে আমার কোন ধারণাই ছিল না খেয়াঘাটের মালিকানা মানে কী। পরে বুঝেছিলাম, চিন্তা সিং সরকারের কাছ থেকে নদী পারাপারের ইজারা নিয়েছিল। এই ইজারা নেওয়ার ব্যাপারটা সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা ছিল না। ভাবতাম চিন্তা সিং বোধহয় এমনি এমনি লোকজন, গাড়িঘোড়াকে নদী পারাপার করে পয়সা তুলতে শুরু করেছে। হয়তো ব্যাপারটা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে গেছে। তার পিছনে যে কত কী আয়োজন থাকতে পারে সেসব আমার মাথাতে ছিল না।
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বড়দের জগতের অনেক সমীকরণের কোন মানে বুঝতাম না ছোটবেলায়। যেসব রাস্তা দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চলে ভাবতাম বুঝি সেসব এমনি এমনি তৈরি হয়ে যায়। কোনো গ্রামে কোন স্কুল হয়েছে, মনে হত তাও নিশ্চয় আপনা আপনি তৈরি হয়ে আছে। রাস্তার বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের লাইন সেসব সম্পর্কেও এমনই ধারণা ছিল। জানতাম অবশ্য সরকার এসব বানায়। ছোটবেলায় ভাবতাম সরকার এক সর্বশক্তিমান পদার্থ যাকে চোখে দেখা যায় না। যার ইচ্ছে হলে যে কোন জিনিস তৈরি হয়ে যেতে পারে।
তারপর একটু বড় হওয়ার পর ঠিকাদার বলে একদল লোকের কথা জানতে পেরেছিলাম যারা নানা রকম নির্মাণকর্মের সঙ্গে যুক্ত। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ইত্যাদি সব বানায় তারাই। এই রহস্য জানার পরও ধারণা ছিল বোধ হয় কন্ট্রাকটাররা কোন এক চালু নিয়মে নানা নির্মাণকর্মের সঙ্গে আপনা আপনি যুক্ত হয়ে যায়। চুক্তি, টেন্ডার, লাভক্ষতি ইত্যাদি কত যে এলাহি কান্ড এসব নির্মাণকর্মের পিছনে সে সবকিছু বুঝতাম না। এখন কেমন স্পষ্ট বুঝি, একটা রাস্তা তৈরি করে যে কন্ট্রাকটার সে আবেদন করে সরকারের টেন্ডার দেখে, কাজের বরাত পেয়ে এস্টিমেট বানায়। লোকজন, মালমশলা যোগাড় করে সরকারের কাছে কাজের হিসেব পাঠায়, ইত্যাদি কত কী। ছোটবেলায় ভাবতাম, বুঝি কোন এক অলিখিত নিয়মে কন্ট্রাক্টর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে গেল, যেন এটাই তার কাজ।কী স্বার্থ থাকতে পারে এমন কাজের পিছনে ভেবে দেখতাম না। আমার আরও মনে হত যে রাস্তা, বিদ্যুতের লাইন ইত্যাদি যা যা থাকার দরকার সেসব আপন নিয়মে নিজে থেকেই হাজির হয়ে যাচ্ছে।
এখন আমি অনেক বিষয় বুঝতে পারি যেসব ছোটবেলায় বুঝতাম না বা বোঝার কথা ভাবতাম না। তবুও আমার ভাবনা হয়, কখনো কখনো বড় উদাসীন হয়ে পড়ি যখন প্রশ্ন জাগে যে জগতের সব সমীকরণের মানে আমি বুঝতে পেরে গেছি কিনা। এই যে আমার মানুষ হওয়া পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট সময়ে, এই যে আমার উপস্থিতি, এই যে জীবনের পথ বেয়ে আমার এগিয়ে চলা, পৃথিবীতে এই যে প্রাণের স্পন্দন, বিশ্বজগতের এই যে অস্তিত্ব, আমি ভাবি এসবই বুঝি এমনি এমনি হয়ে যাচ্ছে কোন এক অলিখিত নিয়মে। কখনও ভেবে দেখি না, পিছনে কোন ঠিকাদার বা কোন সরকার আছে কিনা। নিজেকে আমার এখনো সময় সময় অবুঝ বালক বলে মনে হয়। ছোটবেলায় যেমন ভাবতাম রাস্তাটা আপনা আপনি হাজির হয়ে গেল, তেমনি এখনো ভাবি পৃথিবীটা অকারণে নিজে নিজেই হাজির হয়ে আছে। আমার এই অবোধ বালকত্ব কি একশ বছর পরমায়ুতেও কাটতে পারে ? অথবা হাজার বছরের পরমায়ু কি মানুষকে বোঝাতে পারে যে হাজার কোটি বছরের প্রবীণ বিশ্বজগতের নিয়ম-নীতির স্বরূপ ?
বাজারের পর গোমতীর ওপর ব্রিজ তৈরির কথা ভাসছিল লোকের মুখে মুখে। সেই ব্রিজ ঘিরে এলাকার লোকজন কত না স্বপ্ন আলোচনা করত শুনতাম। আমার মায়েরও বড় আশা ছিল ব্রিজ একদিন সত্যি তৈরি হবে। ত্রিপুরা ছেড়ে চলে এলাম তারপর। ব্রিজ আর তৈরি হয়নি। অনেক অনেক দিন পর কোন এক সূত্রে সেদিন খবর পেলাম, ব্রিজটা নাকি সত্যি তৈরি হয়েছে। শুনে আমি হঠাৎ কেমন মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। আজ ত্রিপুরা অনেক দূরে, গোমতী এখন পূর্বজন্মের স্মৃতি মত। তবুও মনে হল, বুঝি কোনো স্বজনের খবর পেলাম। আর আমার মনে পড়ল মায়ের মুখ। গোমতীতে ব্রিজ হবে এই আলোচনা করতে গিয়ে মায়ের মুখে যে উৎসাহের পুলক আর চোখে যে আনন্দ দেখতাম তা আবার আমার অন্তরে জ্বলজ্বল করে উঠল। আর আমি কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। আমার ইচ্ছে করল মাকে ডেকে শোনাই, জানো মা, গোমতীতে সত্যি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও মাকে খুঁজে পেলাম না যাতে আমি শোনাতে পারি এই আনন্দ সংবাদ।
আমার মায়েরও এমনই একটি প্রিয় নদী ছিল। মা গোমতীকে খুব একটা পছন্দ করত না। গোমতী ছিল মায়ের কাছে নিচু জাতের এক নদী। মায়ের কাছে শুনেছিলাম উচ্চবর্ণের গোমতীর বাস ভারতের অন্য কোন প্রদেশে যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রীরামচন্দ্রের নাম। মায়ের প্রিয় নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। সেই নদীর নিবাস ছিল ঢাকা জেলায়, মায়ের ছোট্টবেলার বাড়ির পাশে। বুড়িগঙ্গা মায়ের কাছে কুলীন নদী। তার কথা বলতে গিয়ে মা মুখে আনত মনোরম হাসি। সেই নদীর সঙ্গে খেলাধুলায় কেটেছিল মায়ের ছোটবেলা।
মাকেও দেখতাম বুড়িগঙ্গা নদীর জন্য দুঃখ করতে। মায়ের সঙ্গেও সেই নদীর বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল অনেকদিন। আমার তখন মজা লাগত মাকে দেখে। নদী কি মানুষ নাকি যে তার জন্য এমন হাহাকার, ভাবতাম মাকে দেখে। বুড়িগঙ্গা নদীর কথা বলতে গিয়ে মা তারপর শুরু করত তার বাবা-মায়ের কথা, ছোটবেলার সঙ্গীসাথি আর পুরনো বাসস্থানের কথা। আজ এতদিন পর বুঝতে পারছি, নদীর জন্য মায়ের অন্তরের সেই আকুল হুতাশ। নদী মানে কেবল নদী নয়, নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, বাড়িঘর, জীবন। গোমতীকে হারিয়ে আমিও এখন তেমনি কাতর মা যেমন কাতর ছিল বুড়িগঙ্গার জন্য।
নৌকো করে নদী পারাপার বড়ই অসুবিধের। ওপারে ছিল অনেক গ্রাম। সেসব গ্রামের লোকদের হরদম আসতে হত এপারে।এপারে স্কুলকলেজ, বাজারহাট, হাসপাতাল, দোকানপাট। বড় দরকার ছিল একটা ব্রিজের। অনেকদিন ধরেই নদীর ওপর ব্রিজ হওয়ার কথা হচ্ছিল। ওই কথাই সার। তখন সবাই মিলে বাজারের পর নদীর ওপর বাঁশের মাচা দিয়ে একটা সেতু বানাল। দুটি করে লম্বা বাঁশ ইংরেজি এক্স অক্ষরের মত বেঁধে নদীর তলায় পুঁতে দেওয়া হল প্রথমে। পাঁচ দশ ফিট পরপর এমনই এক একটি জোড়াবাঁশের এক্স দাঁড় করিয়ে দিল লোকরা সারা নদীর প্রস্থ বরাবর। সেই এক্সে-এর জোড়ের ওপর প্রায় ফুট তিনেক চওড়া বাঁশের মাচা একের পর এক চাপিয়ে তৈরি হল গোটা সেতু। লম্বায় সেতুটা খুব ছোট ছিল না, অন্তত পাঁচ-সাতশ ফিট তো হবেই। নদীর বুক থেকে সেতুর উচ্চতাও ছিল কয়েকশ ফিট। নিচে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে উঠত। আমি জীবনে দু’-চার বার ওই মাচান সেতু দিয়ে নদী পেরিয়ে ছিলাম ভয়ে ভয়ে। মা জানত না আমার এই দুঃসাহসের কথা, জানলে আতঙ্কে হয়তো হার্টফেলই করত। মায়ের বড়ই দুশ্চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে। অথচ ছেলে-বুড়ো সবাই দেখতাম দৌড়ে দৌড়ে অনায়াসে ওই সেতু পেরিয়ে যেত চোখ বুজে। তারা অবশ্য কেউই নদী পার হওয়ার সময় আমার মত উদ্ভট ভাবনা ভাবত না। সেতুর ওপর উঠলে আমার কেবল মনে হত, আচমকা যদি হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ি বা হঠাৎ যদি পকেট থেকে কলমটা পড়ে যায়।
গোমতী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এমনি করে মায়ের জীবন থেকেও হারিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গা। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে অনায়াসেই ত্রিপুরায় গিয়ে দেখে আসতে পারি গোমতীকে। দেখে আসতে পারি ঠিকই কিন্তু তবুও কি তাকে আর ফিরে পাবো ? যদি আবার গোমতীর ধারে গিয়ে বসতে পারতাম আর পাশে থাকত মা তাহলেই বুঝি ভুলতে পারতাম যন্ত্রণা। আসলে মাকেও তো আমি হারিয়ে ফেলেছি। গোমতীকে তাই আমি আর সত্যিই কোনদিন ফেরত পাব না।
আকাশ দরিয়ায়
আকাশে উঠলে অহংকার জাগে। নিচে পিছিয়ে থাকা জনপদ পুতুল-পুতুল, দেখে লাগে যেন খেলনা আমারই খেলাঘরের। মনে হয় নিজের মধ্যে জেগে উঠেছে বিপুল ক্ষমতা, নিজেকেই মাপতে পারি না।
কতকালের সাধ মানুষের আকাশ ধরার। ডানার স্বপ্ন, উচ্চতার মোহ। আরও ওপরে, আরও, আরও—- যত ওঠা যায় আরও ওঠার নেশা পাগল করে দেয়। আমি এমনই উঠব নিচে তাকালে কেবল দেখব সবাইকে আর সবকিছুকে, ওপরে তাকালে কিছুই নেই কেউ নেই।
আকাঙ্খা জমে জমে তারপর বিমান।
আকাশের সঙ্গে আলাপ করার প্রথম সুযোগ পেয়েছিলাম বিস্মৃতবেলায়। এতই ছোট ছিলাম, আলাপ করতে পারিনি। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে ত্রিপুরাতে এসেছিল আমাদের পরিবার অনেকদিন আগে। পাহাড়-জঙ্গলের দেশেই আমার শৈশব। পাহাড় মানে ছোট ছোট মাটির মাটির স্তূপ, মাটির রং লাল। মাটির স্তূপগুলোর নাম টিলা, স্থানীয় ভাষায় বলে মুড়া । এক টিলা থেকে অন্য টিলায় যেতে মাঝখানে খাদ, স্থানীয় নাম কুচি । টিলার মাথা আর ঢালে জঙ্গল, কেটে সাফ করে আর টিলার মাথা সমতল বানিয়ে বসতি বানাতে ব্যস্ত উদ্বাস্তু হয়ে আসা পূর্ববঙ্গীয়রা। জঙ্গল হয়তো হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দরজার পাশে। দিনের বেলাতেই নির্ভয়ে উঠোনে এসে বেরিয়ে যায় শেয়াল। রাতে বেড়ার দরজা গায়ের জোরে ফাঁক করে ঘরে ঢুকে হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে পালায় বনবিড়াল।
অনেক অসুবিধে। বলে শেষ করা যায় না। দুঃখের কাহিনী শোনাতে প্রত্যেকেরই অফুরন্ত উৎসাহ। বলতে গিয়ে কোথায় যে পৌঁছে যায় খেয়াল থাকে না। সবাই বলে, কী ওপাড়ে ফেলে এসে কী পেলাম। প্রত্যেকেরই ও-বঙ্গে ছিল পাঁচটা দিঘি, একশ নারকেল গাছ, দু’শ বিঘা জমি আর দশটা আটচালার ঘর। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। মা শেষে বলত,
‘থাক, আমাদের আর বলে লাভ নেই রে বাবা। আমরা কিছুই ফেলে আসিনি।’
ত্রিপুরাকে প্রায় চারদিকেই ঘিরে রেখেছে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান, যা এখন বাংলাদেশ। মাথার কাছে একচিলতে দড়ির মতো যোগসূত্র আসামের সঙ্গে, ওটাই ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একমাত্র স্থলপথ যোগাযোগ। ত্রিপুরায় থাকার এটাই বড় অসুবিধে, ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। যাতায়াত ব্যবস্থা বড়ই পিছিয়ে থাকা। পাহাড়গুলো মাটির স্তূপ হওয়াতেই ঝামেলা। বর্ষায় গলে গলে যায়। রাস্তাঘাট ঠিক থাকে না। ওই কারণেই রেল যোগাযোগ তৈরি করা যায়নি রাজ্যের অন্দরে।
এটাই আবার ত্রিপুরায় থাকার উপকারী দিক, যাতায়াত ব্যবস্থার এই অসুবিধে। ত্রিপুরার লোকেরা, বাধ্য হয়ে যদিও, যখন-তখন প্লেনে চাপে। কলকাতায় আসাটা প্রায়ই জরুরী হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তদের। প্রায় সবাই প্লেনেই চেপে বসে।
আমার আকাশযাত্রা সবই মায়ের সঙ্গে। ত্রিপুরা চিরদিনের মত ছেড়ে আসার আগেও দু’-তিনবার যেতে হয়েছিল কলকাতায়, পরেও আবার ত্রিপুরাতে যেতে হয়েছিল কয়েকবার। ত্রিপুরা থেকে চলে এসেছিলাম ঠিকই, জমিজমা সব পড়ে রয়েছিল। মায়ের খুব চিন্তা ছিল,
‘জমিগুলি আর বিক্রি করতে পারি না কি রে বাবা।’
ওই জমিজমা কত যত্নে গুছিয়েছে মা। বাবা লণ্ডভণ্ড ফেলে চোখ বুজেছিল। কেড়েকুড়ে নিতে যাচ্ছিল প্রতিবেশীরা। মায়ের সেই যুদ্ধ দেখেছি। হারিয়ে যাওয়া সম্পদ কিভাবে উদ্ধার করেছিল। বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টায়। তার ওপর আছে চাষবাস। সেই জমিজমা থেকেই বছরের খাওয়া-পড়া, দিদির বিয়ে, আমাদের পড়াশোনা। সবই একা হাতে গুছিয়েছিল মা তিল তিল করে।
‘সব কি শেষে অদানে-অব্রাহ্মণে যাবে ?’
বলত মা। বোধহয় আশঙ্কা বেড়ে যেত একবার পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসার সময় কুমিল্লা শহরের বাড়িটা ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছিল ভেবে। মাকে আর আমি দেখতে পাই না আজকাল, কোন্ রহস্যে হারিয়ে গেছে কেজানে ! কিন্তু মনে খোদাই করা দেখি সেই দুশ্চিন্তায় নিষ্প্রভু মুখখানা। আমার ইচ্ছে করে নিথর বসে থাকি কোন অসীম নৈঃশব্দে আর কেবলই ভাবি মায়ের মুখ। এত ভাবি এত ভাবি যে মনের পর্দায় অস্পষ্ট সেই মুখ যেন প্রাণ পেয়ে বাস্তব হয়ে ওঠে।
কখনো কখনো দিগন্ত কাঁপিয়ে গুরুগম্ভীর টানা আওয়াজ ভাসতে থাকে। পৃথিবীর অনেক শব্দই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সুপরিচিত। ওই আওয়াজ শুনে তাই অজান্তেই চোখ চলে যায় মাথার ওপর। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মন্থর মেজাজে এগিয়ে যেতে দেখি ধাতব বিমান। তার রুপোলি গায়ে রোদ লুটোপুটি খায়, মেঘশিশুরা বিলি কাটে। আমি দেখি আর নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি, আর হারিয়ে যাই, কেবলই হারিয়ে যাই। কোথায় কেজানে !
সেবার মাকে নিয়ে ফিরছিলাম কলকাতা থেকে। তখন কেবল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, ত্রিপুরার জন্য ভাড়া কিছুটা কম রাখে। প্লেনগুলো প্রায়ই তাই ঝড়তি-পড়তি হয়। আমরা যে প্লেনটায় উঠলাম সেটা বোধহয় সবচেয়ে লজঝড়ে। তার গায়ের ধাতব পাতগুলি দেখি এখানে-ওখানে বেঁকিয়ে আছে, জোড়গুলি থেকে অনেক স্ক্রু আর পেরেক খুলে খুলে পড়েছে। ভিতরের অবস্থাও শোচনীয়। আসনগুলি ছেঁড়া, স্পঞ্জ বেরিয়ে এসেছে। মেঝেতে পাতা কার্পেট রঙচটা, ছেঁড়াফাটা। মা প্লেনে বসে হাসতে হাসতে বলল,
‘কোত্থেকে জোগাড় করেছে রে ? কী ছিরি প্লেনটার !’
হয়তো সেটা বর্ষাকাল। আকাশ দমদমে গেলাম যখন থম মেরে ছিল। প্লেনটা তো ছাড়লো শেষপর্যন্ত। কিছু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করছিলাম। প্লেনগুলি থাকে যাত্রীঠাসা। অথচ সেই প্লেনটা প্রায় ফাঁকাই। দশ-কুড়িজন যাত্রী হবে কিনা সন্দেহ। আর একটা ব্যাপারও অদ্ভুত লাগছিল। সব যাত্রাতেই প্লেনে দেখেছি বিমান সেবিকারা থাকে। সেই প্লেনে ছিল না। মূল পাইলট ছাড়া আর বোধহয় তার দু’-একজন পুরুষ সহকারীকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তারাই যাত্রীদের খাবার-দাবার দিচ্ছিল। সত্যিই ব্যাপারটা অদ্ভুত।
প্লেন তো আকাশে উঠল। মেঘের আস্তরণ ভেদ করে ঢুকে গেল অনেক উঁচুতে অজানা প্রদেশে। তাকিয়ে দেখি, নিচে কেবল মেঘ আর মেঘ। তাদের গায়ে ঘন কালো রং। সেই ঘন কালো মেঘ ভেদ করে নিচের কোন দৃশ্যই দেখার উপায় ছিল না।
তারপর শুরু হল বৃষ্টি। সে যে কী দুরন্ত বৃষ্টি আঁচ পাচ্ছিলাম জানলার কাচে চোখ রেখে। প্লেনটাকে আগাপাশতলা ঘিরে ধরেছিল কালো কালো মেঘের জটলা। দুর্-দুর্ করে মেঘগুলি দেখছিলাম জানলার কাচে ঠোক্কর মারছিল। বাইরেটা একেবারেই অন্ধকার। কেবল বৃষ্টি নয়, বাইরে যে ঘোর দুর্যোগ চলছে বুঝতে পারা যাচ্ছিল প্লেনের আচরণে। ঘন ঘন এয়ার পকেটে পড়ছিল প্লেন। কখনো এদিকে কাৎ হচ্ছিল, কখনো ওদিকে। গোঁত্তা খাচ্ছিল ক্রমাগত সামনে আর পিছনে। প্রবল ঝাঁকুনি তুলে তুলে একবার নামছিল আর একবার উঠছিল। দুলছিল টালমাটাল। মনে হচ্ছিল ভয়ংকর ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে একটা গরুর গাড়ি চলছে।
মায়ের মুখটা দেখছিলাম ভয়ে শুকিয়ে আছে। এক চিলতে শুকনো হাসি মুখে টেনে মিনমিন করে বলল,
‘কী খারাপ ওয়েদার রে ! কী যেন আছে কপালে।’
আমারও গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। পাইলটের সহকারীদের দেখছিলাম থমথমে মুখে প্লেনের এদিক থেকে ওদিকে ব্যস্তভাবে যাতায়াত করছে। ভিতরে যে আমারও ভয় সেটা মাকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য বেশ বিজ্ঞের গলায় বলেছিলাম,
‘দূর্, এটাকে খারাপ ওয়েদার বলে নাকি। এ তো সাধারণ বৃষ্টি। ওয়েদার খারাপ হলে কি আর প্লেন ছাড়ত ?’
মা আমার কথা শুনে ভরসা পাওয়া উচিত কিনা বুঝতে পারল না হয়তো। মুখের দুশ্চিন্তা কাটল না । জানলার দিকে তাকিয়ে নিথর বসে দেখতে লাগল বাইরের তাণ্ডব।
প্রকৃতির এমন এক ভয়ংকর খেলায় মাকে সঙ্গী করে আমি ছিলাম। এখন বড় ইচ্ছে করছে যদি মায়ের কাছে বসে মায়ের সঙ্গে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার গল্প করতে পারতাম !