তপোপ্রিয়
অলৌকিক হিসেব
কিছু হিসেব মেলাতে পারি না।
স্কুলে পড়ি তখন। বোধহয় অষ্টম শ্রেণী। এক নতুন স্যার এলেন বাংলার। বেঁটেখাটো, স্বাস্থ্য মোটেই ভালো না হলেও মাথাটা বেশ বড়। বাড়ি অনেকটা দূরে বলে আমাদের বারো-আনা গ্রাম অঞ্চলটাতে ভাড়া থাকতেন এক বাড়িতে একাই। অবিবাহিত। কিছুদিন পর বোঝা গেল স্বাভাবিক সংসারের নিয়ম-কানুন বহির্ভূত তাঁর জীবন। বেশ মদ খান আর এমন সব কথা বলেন যা আর কেউ বলত না। ভালো-মন্দ মিশিয়ে নানা রটনা তাঁর সম্পর্কে। তবুও আমি আর আমার কিছু সহপাঠী তাঁর অনুগামী হয়ে গেলাম। বেশ ভালো নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা ছিলেন, গানও জানেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর আব্বাসউদ্দিন। সে যুগে রেকর্ড প্লেয়ারই আভিজাত্যের প্রতীক। তাঁর কাছে ছিল একটা। গান শুনতে যেতাম প্রায়ই। তিনিই আমাকে জীবনানন্দ চিনিয়েছিলেন। কেন জানিনা, তাঁর বড় প্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। নাম সুশীল দে। প্রায়ই আসতেন আমাদের বাড়িতে।

আমার বাড়ির লোকরা তাঁকে পছন্দ করত না। ব্যতিক্রম মা। বাড়িতে এলে মায়ের সঙ্গে তাঁর বেশ কথাবার্তা হত। খুব উঁচু ধারণা না থাকলেও মা তাঁর নিন্দেটিন্দে করেনি কখনো আমার কাছে। কেবল অন্যদের চাপে পড়ে সময় সময় আমাকে বলত,
‘থাক বাবা, সুশীল স্যারের সঙ্গে বেশি মিশিস না। সবাই যখন বলে মদটদ খায়।’
বলত বটে, জোর করে বাধা দিত না কখনো। আমার ওপর মায়ের অন্যরকম একটা আস্থা ছিল। আমি কোন খারাপ কাজ করতে পারি না, এমনই ছিল বিশ্বাস।
নাইন-টাইনে যখন পড়ি সুশীল স্যার একেবারে ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছিলেন। আবার স্যারেরও ধারণা ছিল আমাদের নিয়ে তিনি একটা অন্যজগৎ গড়ে তুলবেন। প্রায়ই তিনি শোনাতেন ডিরোজিও আর ইয়ং বেঙ্গল-এর গল্প।
তারপর নানা কারণে আমি তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগলাম। আমার মেলামেশার জগতটা ছিল একটু অন্যরকম। সহপাঠীদের সঙ্গেই কেবল মিশতাম না, দু-তিন ক্লাস উঁচু ছেলেদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব ছিল। মা ব্যাপারটাকে বেশ পছন্দ করত। প্রায়ই কিছুটা গর্বের সঙ্গে মন্তব্য করত,
‘এটা ওর একটা ভালো ব্যাপার। বড় ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা।’
মা আমার কোন কাজেই বিশেষ বাধা দিত না। ত্রিপুরা আমার শৈশব ও কৈশোরের নন্দনপুরী। পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, খরস্রোতা নদী-নালা, আদিবাসী সব নিয়ে এক আকুল সৌন্দর্যের বাসভূমি। দলবল নিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তাম পাহাড়-জঙ্গলের পথে। দুপুরে হয়তো বেরিয়ে গেলাম, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত। এইসব অভিযানে গান হত, চলত অজস্র আলোচনা। প্রায়ই ফেরার পথে আমি ফেঁদে বসতাম দীর্ঘ গল্প, হয় রহস্য কাহিনী নয়তো সায়েন্স ফিকশন। বন্ধুরা সব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত গল্পগুলি। বানাতাম তখন-তখনই। আজ বুঝি, বড়ই নিম্নমানের গল্প সেসব। তবুও সবাই তন্ময় হয়ে যেত কেন ? আসলে পরিবেশ। চারপাশে পাহাড়, ঝোপে ছাওয়া অন্ধকার খাদ, আবার হয়তো শুরু হল শাল-গর্জনের দুর্ভেদ্য জঙ্গল, উঁচু-নিচু কাঁচা রাস্তা ধরে চলছি আমরা। ঘন ঘন শেয়ালরা ডেকে উঠছে, দূরে পাহাড়ের কোলে দেখা যাচ্ছে আদিবাসী বসতির টিমটিমে আলোর আভাস। এই অনবদ্য রহস্যময় পরিবেশই আমার গল্প জমিয়ে তুলত।
যোগেশ যখন হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে গেছে আমি তখন দশম শ্রেণীতে সদ্য উঠেছি। কেবল তাকে সঙ্গী করে একবার একটা অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
মহারাজ উদয়মাণিক্যের নামে উদয়পুর মহকুমা শহর, আমাদের বাড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। শহরকেন্দ্র থেকে আরও অন্তত পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরার বিখ্যাত কালীবাড়ির পিঠস্থান, ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির। একদিন দুপুরের পর যোগেশের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম সেখানে যাব বলে।
আমার এইসব অভিযানে যাওয়ার আগে কোথায় যাচ্ছি বলে যেতাম না মাকে। যাচ্ছি বেড়াতে কোথাও, ফিরতে একটু দেরি হবে। মা অবশ্য বুঝত দূরেই যাচ্ছি, তবে বাধা দিত না বিশেষ। কেবল পাংশু মুখে বলত,
‘সাবধানে থাকিস বাবা। বেশি দেরি করিস না।’
মাকে কথা দিয়ে গেলে কী হবে, দেরি হতই। রাতে ফিরে দেখতাম সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও আমার অপেক্ষায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে মা নিদ্রাহীন বসে। আমার অবিবেচক কাজে ক্ষোভ প্রকাশ করত। চলত একটু বকাবকিও,
‘তোর আক্কেলটা কী বল্ তো ? এত রাত করে এলে চিন্তা হয় কিনা বল্ ? আমি তো একটা মানুষ।’
চুপ করে শুনতাম মায়ের অনুযোগ। কখনো রেগেও যেতাম। অপরাধবোধও হত একটা ভিতরে। সেটা চাপা দিতে মেজাজ দেখাতাম। মা বলত,
‘থাক, কিছু বলব না। কিছু বললেই রেগে যাস। চিন্তা হলে বলাটাও অপরাধ ?’
আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে জিপ-ট্যাক্সি-অটো যেত উদয়পুর। যোগেশ আর আমি ঠিক করলাম, ওই রাস্তা ধরেই হেঁটে যাব প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা। আমরা যারা শহরে থাকি রাস্তা বলতে বুঝি সমতলে এগিয়ে যাওয়া, দুপাশে বাড়িঘর আর দোকানপাটের ঘ্যানঘ্যানানি। এসব রাস্তা দেখলে বোঝা যাবে না সেই দশ কিলোমিটার রাস্তা কেমন। প্রায় পুরোটা রাস্তা কেবলই চড়াই আর উতরাই। এই নেমে গেল অতলে তো পরক্ষণেই আবার উঠে এলো। কোথাওবা জঙ্গলে ছাওয়া খাদ পাশে রেখে ঘুরে গেছে পুরোপুরি। এই গোটা রাস্তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু চড়াই অংশটার নাম ছিল মোল্লাটিলা। ওপর থেকে দেখলে মনে হত রাস্তাটা বোধহয় নেমে গেছে পাতালে, আবার নিচে নেমেও রাস্তা কোথায় উঠে গেছে তার থই পাওয়া যেত না।
উচ্চমাধ্যমিক পড়ছি যখন রোজ দু’বেলা এই রাস্তা ধরে যাতায়াত ছিল আমার। রাস্তার প্রতিটি বাঁক, চড়াই-উতরাই প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারপর কত কত বছর কেটে গেছে। আজ ওই রাস্তার মুখ স্মৃতিতে বড়ই অস্পষ্ট। তবুও খানিকটা কল্পনা মিশিয়ে হলেও তাকে দেখতে পাই। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় কিলোমিটার খানেক গেলে হাসপাতাল ডাইনে রেখে একটা চড়াই উঠে গিয়েই বেশ কিছু দোকানপাট, নাম সেই জায়গাটার ধুচিখোলা। সেখান থেকেই প্রায় রাস্তা চলে গেছে দুপাশে ঘন জঙ্গল সাজিয়ে, বেশিরভাগই শাল গাছ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই-উতরাই সেই রাস্তা আমি দ্বিতীয়টি খুঁজে পাইনি আজ পর্যন্ত। জঙ্গল যেখানে খুব ঘন সেই জায়গাটার নাম পালাটানা। তার কয়েক কিলোমিটার পর জমজমাট এলাকা জামজুড়ি। একটু পর থেকেই রাস্তা সমতল। উদয়পুর পর্যন্ত দু’পাশে জঙ্গলের বদলে জলাভূমি আর ধানখেত।
উদয়পুরে ঢোকার খানিকটা আগে বোধহয় বাধাঘাট বলে একটা অঞ্চল থেকে ডানহাতে পাকা রাস্তা বেরিয়ে গিয়েছিল। ওই রাস্তা ধরে ত্রিপুরেশ্বরী বাড়ি হয়তো একটু কাছে ছিল। যোগেশ আর আমি বিকেল পর্যন্ত মন্দিরে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিলাম। তারপরই শুরু হল বিপদ। আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। একটানা বৃষ্টি অবশ্যই নয়। এই নামে এই থামে। যোগেশের সঙ্গে ছাতা ছিল, তবে বৃষ্টি জোর হলে ছাতাও মানছিল না। তখন কোন গাছের তলায় বা কোন বাড়ির পাশে দাঁড়াতে হচ্ছিল। গিয়েছিলাম অন্য রাস্তায়, ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির থেকে ফেরার পথে উদয়পুর শহরটা ধরে যাব বলে ঠিক করলাম। এই পথেই আবার সুশীল স্যারের বাড়ি। যোগেশকে বললাম যে স্যারের সঙ্গে দেখা করে যাব। নিশ্চয় খুব চমকে যাবেন।
স্যারকে বাড়িতেই পেয়ে গেলাম। অবাকও হলেন আমাদের দেখে। কিন্তু বেশ বিপদেও ফেলে দিলেন আমাদের। বললেন, থেকে যেতে হবে। অনেক করে বুঝিয়েও তাঁকে নিরস্ত করা গেল না। উপরন্তু যাতে না যেতে পারি সেজন্য যোগেশের ছাতাটা বাজেয়াপ্ত করে নিলেন। থাকলে হয়তো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু মাকে যে বলে আসিনি। মাকে ছেড়ে কোথাও কখনো থাকি না রাতে।
স্যারকে বুঝিয়ে লাভ হলো না। যোগেশও থাকতে রাজি নয়। তখন জোর করেই আমরা বেরিয়ে এলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। স্যার ছাতাটা দিলেন না। আকাশ তখনও বেশ কালো। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। পাহাড়-জঙ্গলের অতটা পথ ছাতা ছাড়া যাব কিভাবে বুঝতে পারছিলাম না। বেড়াতে যেতাম আমি সবসময় শূন্য পকেটে। যোগেশের কাছেও টাকাপয়সা ছিল না তেমন। গাড়ি যে ধরে নেব তারও উপায় ছিল না।
একটা বুদ্ধি এল মাথায়। আমাদের স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের স্যার বন্ধুগোপাল বাবুর কথা মনে পড়ল। জানতাম, তাঁর বাড়িও কাছাকাছি। জিজ্ঞেস করে করে বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল। স্যারকেও পেয়ে গেলাম বাড়িতে। বললাম বিপদের কথা। সুশীল স্যারের ওপর বেজায় রেখে গিয়েছিলাম। খুব বললাম তাঁর বিরুদ্ধে। বন্ধুগোপালবাবুও সুশীল স্যারকে পছন্দ করতেন না। তো আমাদের ওপর সদয় হয়ে উনি একটা ছাতা দিয়ে দিলেন। পরদিন স্কুলে ফেরত দিয়ে দেবো এমন কথার ভিত্তিতে।
বৃষ্টি তারপর উধাও হয়ে গেল। মেঘ পরিষ্কার হয়ে ঝকঝকে চাঁদ উঠল আকাশে। রাত তখন ন’টা হবে অন্তত, গাড়ি-ঘোড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। তো উদয়পুর শহর ছাড়িয়ে খানিকটা যাওয়ার পর একটা অটো পেয়ে গেলাম। চালক গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। কাছাকাছি খিলপাড়া অঞ্চলে তার বাড়ি। এই রাতে যতটা এগিয়ে যাওয়া যায়। দু’-তিন কিলোমিটার অবশ্যই যাওয়া গেল। দু’-তিন টাকা ছিল সম্বল। অটোওয়ালাকে তাই দেওয়া হল।
সেই চাঁদ ঝকমকে রাতে নিঝুম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পথ বেয়ে যাচ্ছিলাম আমরা কেবল দুটি প্রাণি। আরেকটি মানুষেরও দেখা পাইনি গোটা রাস্তায়। রাত যথেষ্ট হয়েছিল, ভয়ও পাচ্ছিলাম, ভালোও লাগছিল। অবিস্মরণীয় সেই রাত্রির অভিযান মনে পড়লে এখনো বিবশ হয়ে যাই। বাড়ি ফিরেছিলাম রাত প্রায় বারোটা নাগাদ। মা ভয়ানক চিন্তায় মুখ কালো করে জেগে বসে ছিল আমার জন্য।
মায়ের সেই অস্থির দুশ্চিন্তার ছবি অথবা চন্দ্রালোকিত পাহাড়-জঙ্গলের সেই অভিযান, সবই আমি এখন দেখছি অন্য কোন দর্পনে। তারা সবাই এখন আমার জগতের বাইরে হয়তো অন্য কোন জগতে চলে গেছে, কেউ আর আমার নাগালে নেই। এত বাস্তব সবকিছু, অথচ কেন নাগাল পাচ্ছিনা ভেবে আমি কেবল হতভম্ব হতে থাকি।
অনেক পথ পেরিয়ে এলাম তারপর। সময়ের পথ। কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কত পরিকল্পনা, জগতকে পাল্টে দেওয়ার নানান স্বপ্নে বিভোর থাকতে থাকতে বুঝিনি দিন কেটে যাচ্ছে। ঘোর কাটল যখন দেখি জীবনের কোন স্বপ্নই সফল করতে পারিনি। এক নির্জন বন্দরে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে সময়ের জাহাজ। তবুও আশা ছিল, কিছু অন্তত স্বপ্ন সফল হতে পারত যা সময় ছিল। সেই আশাও এখন মৃত। সময় তবু আছে কিন্তু যাকে নিয়ে স্বপ্নরচনা সেই তো নেই। মা চলে যাওয়ার পর বুঝলাম, মানুষই আসল। সময় থাকলেও হয় না, মানুষ থাকা চাই। মাও ঠিক তাই বলত, বুঝতাম না।
মাকে হারিয়ে আমি তখন প্রবল শোকগ্রস্ত। বছরখানেকও হয়নি। একদিন একটা অদ্ভুত ফোন এলো বাড়িতে। কলকাতাস্থিত গৌড়ীয় মঠ থেকে জনৈক সন্ন্যাসীর ফোন। নাম তাঁর ন্যাসি মহারাজ। ভাবলাম হয়তো ভুল হচ্ছে কোথাও। আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে সন্ন্যাসী শান্ত গলায় বললেন আমার নাম উচ্চারণ করে,
‘তোমার সন্ধান অনেক খুঁজে যোগাড় করেছি। চিনতে পারছো তো আমাকে ? ত্রিপুরার কথা মনে আছে ? আমি তোমাদের সুশীল স্যার।’
এতটা বিস্মিত হয়েছিলাম যে বলে বোঝানো দায়। অন্তত পঁচিশ বছর দেখা নেই সম্পর্ক নেই যাঁর সঙ্গে তাঁর হঠাৎ সন্ধান পেয়ে যত না তার অনেক বেশি কী চেহারায় দেখছি তাঁকে ভেবে। চিরকাল ধর্ম-সংস্কার ঘোরতর অপছন্দ ছিল তাঁর। সেই মানুষের এ কেমন আপাদমস্তক পরিবর্তন ?
সদ্য মাতৃহারা হয়েছি শুনে উনি খুব দুঃখিত হলেন। আর জানালেন যে আমার বাড়িতে আসতে চান। নাকি মায়ের আত্মার শান্তির জন্য কিছু কাজ করবেন। মনে মনে খুশি হলাম। দেবদ্বিজে মায়ের ছিল অগাধ ভক্তি। মা চলে যাওয়ার পর নামগান, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি কিছুই করিনি। বেঁচে থাকতে যখন কোন স্বপ্নই পূরণ করতে পারিনি মৃত্যুর পর অহেতুক সান্তনা পাওয়ার বেকার চেষ্টা কেন, এই ক্ষোভে। অথচ জানতাম, মায়ের জগতে এসব আচার-বিচারের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। সেখানে উপযাচক হয়ে কোন মঠের সন্ন্যাসী মহারাজ যখন আসতে চাইছেন মন্দ কী ?
সুশীল স্যার অর্থাৎ ন্যাসি মহারাজ এলেন তারপর এক সকালে। মায়ের ঘর মা চলে যাওয়ার পর এখন ঠাকুরঘর। মহারাজ সেই ঘরে ঢুকে আসন পেতে বসলেন। ঝোলা থেকে একের পর এক গ্রন্থ বার করে নিলেন। সঙ্গে আনা নারায়ণশিলা প্রতিষ্ঠা করলেন। ধুপ-দ্বীপ জ্বেলে বিশুদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণে পুজো-উপচার শেষ করে আদ্যন্ত গীতা পাঠ করে গেলেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সারাটা দিনই মায়ের ঘরে কাটালেন তিনি এমনই সব ধর্মাচরণ করে, এক বিন্দু জলও পান করলেন না আমাদের ঘরে।
তার গীতা পাঠ, ভাগবত পাঠ, পূজা পদ্ধতি দেখতে দেখতে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। এ সমস্তই ছিল আমার মায়ের পরমপ্রিয়। মা নিষ্ঠার সঙ্গে এসব আচার-বিচার মেনে চলত, গীতা পাঠ ছিল মায়ের নিত্যসঙ্গী। আজ কোন্ জাদুমন্ত্রে মায়ের সমস্ত প্রিয় বিষয়গুলি এসে উপস্থিত হল ? এলো আবার বিশুদ্ধ গৌড়ীয় মঠের সন্ন্যাসীর মাধ্যমে। মায়ের যে কী প্রিয় ছিল এই সান্নিধ্য! সবচেয়ে বড় কথা, যাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না এতকাল হঠাৎ কোন্ হিসেবে এই বেশে কেন বা কিভাবে তাঁর উদয় হল ঠিক এই সময় ?
মায়ের ঘরে বসে ন্যাসি মহারাজ গান করছিলেন,
‘জয় রূপ সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ,
শ্রীজীব গোপাল ভট্ট, দাস রঘুনাথ…..’
শুনছিলাম আর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমার। রোজ সন্ধেবেলা ঠাকুরের আসনে বসে মা গদগদ কন্ঠে এই স্তব গাইত। বড় প্রিয় ছিল মায়ের এই প্রার্থনাসংগীত। মায়ের সেই পরম প্রিয় স্তবই উচ্চারিত হচ্ছে মায়ের ঘরে মায়ের বিছানার পাশে গৌড়ীয় মঠের সন্ন্যাসীর কন্ঠে এ কি কোন অলৌকিক হিসেব ? প্রতিভাস ম্যাগাজিন