তপোপ্রিয়
রথের মেলা
নিজেকে দেখে আমার বিস্ময় জাগে। যা আমি হতে চাইনি তা হয়ে যাচ্ছি, যা করতে চাই না তা করে ফেলছি। আপাদমস্তক আমাকে আমার কাছেই অচেনা ঠেকে। ছোটবেলার কৌতূহলী চোখ দিয়ে যা দেখেছি একদিন আজ সেগুলি সবই আমার কাছে স্বপ্ন হয়ে আছে। এই মাঠঘাট-আকাশকে আমার এখন মনে হয় অন্যরকম, সবই অচেনা লাগে। নিজেকে আজীবন নির্বাসনে হারিয়েছি বলে আবিষ্কার করি।
একবার রথের মেলায় গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে। মেলাপ্রাঙ্গণের ভিড় চোখে লেগে আছে আমার। ভিড়ের মানুষজন যারা এখন মনে হয় বুঝি তারা কেউ এই পৃথিবীর ছিল না। সেই দোতলা সমান উঁচু রথটিকেও আমি পরে আর খুঁজে পাইনি কোনদিন। আমার আপাদমস্তক বিস্তৃত চোখের সামনে সেই রথের মেলা অন্য রকম মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছিল। খুবই ছোট ছিলাম আমি, মা আমাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ভিড় ঠেলে। নিজে জগন্নাথ দর্শন করবে আর আমাকেও দেখাবে। সমস্ত মেলাজুড়ে ভিড় যেমন থাকুক না কেন রথকে ঘিরে ভিড়ের ঘনত্ব ছিল অকল্পনীয়। কাছাকাছি হতে পারছিল না মা, অনেকটা দূর থেকেই হাত তুলে আমাকে দেখাবার চেষ্টা করছিল।

‘ওই দেখো বাবা জগন্নাথ, আর ওই সুভদ্রা বলরাম।’
আমি কিছুই দেখতে পাইনি, অত ভিড়ের মধ্য থেকে কিছু দেখাও সম্ভব ছিল না। সবাই জগন্নাথ দেখতে চায়। পরিবর্তে আমি দেখেছিলাম এক অদ্ভুত মূর্তি। বাড়িতে ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করলে মা জানিয়েছিল,
‘ও হল উদ্ধব। কৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে নিয়ে চলে গিয়েছিল।’
এই কথায় আমার ভিতর কেমন একটা বিষণ্ণতা ছায়া ফেলতে থাকে। কাউকে তার পরিচিত প্রদেশ থেকে নিয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক, এমনই ভাবতে শিখেছি আমি। মা তারপর আরও বলেছিল,
‘সেই যে কৃষ্ণ গেল দ্বারকায়, আর কোনদিন ফিরে এলো না বৃন্দাবনে।’
এই কথা জানাতে গিয়ে মায়ের গলাতেও দেখেছিলাম বিষাদ, আর আমার মধ্যে প্রাথমিক দুঃখটা আরও জমাট বাঁধছিল। আজ অনেকদিন পর সেই ফেলে আসা দুঃখকে আবার দেখতে পাচ্ছি। এবার তার উপস্থিতি আমারই প্রসঙ্গে। আমিও আমার কৈশোরের বিচরণভূমিতে বা বৃন্দাবনে আর কি ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবো কোনদিন ? যদিও বা সুযোগ পাই যেতে কি পারব ? এক বিষজর্জর যন্ত্রণা আমাকে অথর্ব করে দেবে যখনি আমি পা ফেলব সেই ফেলে আসা প্রদেশে, কারণ যদি সেখানে যাই মা আর আমার সঙ্গে থাকবে না।
আষাঢ় মাসে আকাশে ঘন মেঘের আনাগোনাতে এমনিই মনে বিষণ্ণ পরিবেশ ছায়া ফেলে, যখন সেখানে প্রসঙ্গ হয়ে আসে রথের মেলা আমি শোকচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মা আমার হারিয়ে গেছে, এই নির্মম বাস্তবকে রথের মেলা যন্ত্রণা করে তোলে। মনে পড়ে, এই মেলাকে ঘিরে মায়ের নানান পরিকল্পনা, মেলা থেকে দা-কাস্তে, হাতা-খুন্তি কিনে আনার অপেক্ষায় থাকতো মা। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও পরিকল্পনার ডানা ভাসাতাম। মেলাতে পাওয়া যেত মাটির তৈরি রংবেরঙের হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি কত কত খেলনা। ওইসব খেলনা নিজের করে পাওয়ার কী যে আকর্ষণ ছিল সে সময় বলে বোঝানো যাবেনা। আজ যে আমি বড় হয়েছি বুঝি এভাবেই যখন দেখি ওসব খেলনা পাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার মধ্যে।
পৃথিবীর কোন এক অচেনা অঞ্চলে ছিলাম আমি একসময় মায়ের সঙ্গে। কোন এক মলিন বিকেলের কথা ভাসে আমার চোখে। আজ মনে হয় বিকেলটা মলিন, সেদিন কি তেমন মনে হয়েছিল ? পশ্চিম ভিটের ঘরের উত্তর দিকে বোধহয় কখনো অন্য একটা ঘর ছিল, কবে ছিল জানিনা। ঘরটার অস্তিত্ব আর নেই, আছে কেবল উঁচু ভিৎ। ওখানে মায়ের সবজি বাগান আর নানারকম আগাছা। মা বড় যত্ন নেয় ওই ভিটেতে জন্মানো গাছগুলির। ডাঁটা আছে, বেগুন-লঙ্কা তো রয়েছেই। আর অন্য সব শাকের গাদাগাদি ভিড়। মা তাতে জল দেয়, নিড়ানি দিয়ে আগাছা বাছে। সেদিনও বিকেলে মা ওই ভিটের গাছগুলির সঙ্গে সমানে বেড়ে ওঠা ঘাস-আগাছা সাফ করছিল। আমি পায়ে পায়ে দাঁড়ালাম গিয়ে মায়ের কাছে। মায়ের মনোযোগ ছিল নিড়েন দেওয়ার কাজে, তবুও আমার উপস্থিতি টের পায় আর মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে বাবা, কিছু বলবি ?’
আমি কুন্ঠিত ভাবে মায়ের কাছে বায়না জানিয়েছিলাম,
‘একবার মেলায় যাবো মা বেড়াতে ?’
আজ স্পষ্ট খেয়াল নেই কিসের মেলা ছিল সেটা। হবে হয়তো রথের মেলাই, উল্টোরথও হতে পারে। সব মেলাতেই যে যেত মা তেমন নয়। মা তখন অকাজে ঘুরে বেড়াতে যায়ও না তেমন। মাকে কেবল কাজেই ব্যস্ত থাকতে দেখি, ভোর থেকে রাতে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত মুখে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ছায়া-ছায়া দুশ্চিন্তার আভাস। দুশ্চিন্তা মায়ের অনেক রকম। সংসার চালাবার দুশ্চিন্তা, দাদা পড়ছে হোস্টেলে থেকে, সেই খরচ জোগাড় করা আছে। দিদিও বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তা আছে আমাকে নিয়েও। জমিজমা ফেলে হঠাৎ বাবা মারা গেছে, সবই রয়েছে বেনামে, সেসব আবার গায়ের জোরে জবরদখল করতে চাইছে প্রতিবেশীরা। দুশ্চিন্তার অন্ত নেই মায়ের।
আমার আবদার শুনে মায়ের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো কিনা বুঝতে পারলাম না। সেই একইভাবে কাস্তে দিয়ে মাটি আলগা করে আগাছা সাফ করতে লাগলো মা আর শান্ত গলায় জানতে চাইল,
‘একা একা পারবি যেতে ?’
মায়ের অনুমতি পাওয়া গেছে ভেবে আমার মনে তখন খুব ফুর্তি। উচ্ছ্বাসের গলায় বলে উঠলাম,
‘খুব পারবো।’
‘যা তাহলে। তাড়াতাড়ি চলে আসিস সন্ধের মধ্যে।’
তারপর মা হাতের কাজ থামায়। কাস্তে রেখে সোজা হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে স্নেহের গলায় বলে,
‘মেলায় যাবি কি একেবারে খালি হাতে ?’
কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠে ছিল কাপড়ের আঁচল, টেনে মা সামনে আনে। দেখি সেখানে গিঁট দিয়ে বাঁধা পয়সা। গিঁট খুলে মা একটা আধুলি বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে হাসি উদ্ভাসিত মুখে বলে,
‘নে, যা ইচ্ছে হয় কিনবি।’
আধুলিটা মা আগে থাকতেই আচলে বেঁধে রেখেছিল আমাকে দেবে বলে। কিভাবে মা বুঝতে পেরেছিল আমি মেলায় যেতে চাইবো ?
সেদিন কিন্তু মায়ের হাত থেকে আধুলিটা নিয়ে আমি এক অদ্ভুত মানসিকতার শিকার হয়েছিলাম। একটা আধুলির দাম তখন অনেক আমার কাছে। ওই পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে যা তখন আমি কিনতে পারতাম আজ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েও তা কিনতে পারি না। একটা ধূসর-রঙা হাতি পঁচিশ পয়সা, একটা মাটির ঘোড়া ত্রিশ পয়সা, একটা বাঁশি দশ পয়সা। পঞ্চাশ পয়সা আমার জন্য তখন রাজার সম্পদ। একটা গোটা আধুলি মা আমাকে ইচ্ছেমতো খরচ করতে দিয়েছে ভাবতেও অবাক লাগছিল। কিন্তু কেন জানিনা আমি খুশি হতে পারছিলাম না। মেলায় গিয়েছিলাম ঠিকই, গোটা মেলা ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। লোভনীয় অনেক খেলনাও ছিল মেলাতে। পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে কেনা যেত অনেককিছু। কিন্তু কোনকিছুই কিনতে পারিনি আমি। পকেট থেকে মায়ের দেওয়া আধুলিটা খরচ করতে পারিনি কোনমতেই। সন্ধেবেলা মেলা থেকে বাড়ি ফিরে আসে খালিহাতে। মা জিজ্ঞেস করে,
‘কী কিনে এনেছো সোনা ?’
আমি কুন্ঠিতভাবে পকেট থেকে আধুলিটা বার করে মাকে ফিরিয়ে দিই। মা খুব অবাক হয়ে বারবার জানতে চেয়েছিল, কেন পয়সাটা খরচ করিনি। এড়িয়ে গিয়েছিলাম, বলতে পারিনি নিজের মনের গোপন কথা। এই পঞ্চাশটি পয়সা মাকে কত কষ্ট করে জমাতে হয়েছে, এই ভাবনা ছিল আমার মনের মধ্যে। কেবলই মনে হচ্ছিল, মায়ের রক্ত জল করে জমানো এই পয়সা কিছুতেই আমি আজেবাজে জিনিস কিনে খরচ করতে পারি না।
যে কোন মেলা নয়, রথের মেলা আমাকে বড় বেশি মায়ের কথা মনে পড়ায়।
আরও বেশ কিছুদিন আগের কথা। মায়ের মুখে গল্প শুনেছিলাম। বাবা তখন বেঁচে আর ও-বঙ্গ ছেড়ে ভারতে চলে আসা হয়নি। কুমিল্লা শহরে বাবা বাড়ি করলেও বছরে দু’-একবার সিঙ্গুলা গ্রামে বেড়াতে যেত। ওখানে জমিজমা, জ্ঞাতি-কুটুম্বের এলাহি আয়োজন। বর্ষাকালে গ্রামেগঞ্জে মাঠ-ঘাট জল থৈথৈ, নদী-নালা ভেসে যায়। সেবার এমন সময় সদলবলে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে সবাই। খুব বিখ্যাত রথের মেলা হয় কাছাকাছি। জায়গাটার নাম বোধহয় সাচার। মায়ের ওই মেলায় যাওয়ার শখ। মায়ের উৎসাহেই সদলবলে মেলায় যাওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। সারা পথ যাওয়া হবে নৌকায়। দেশের বাড়িতে অনেক নৌকা ছিল আমাদের। শুনেছি ওইসব নৌকোয় লোকজন হাটে-বাজারে যাতায়াত করে আবার ফসলটসলও বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কেবল যে বর্ষাকালেই নৌকো চলে এমন নয়। নৌকো ভরসা অন্য সময়ও। নিম্নবঙ্গে মানুষ অনেকটাই জলচর।
ওই বিখ্যাত সাচারের রথের মেলা কি সাতদিন ধরে হতো ? মা থাকলে মনে করে বলতে পারতো। যেদিন সবাই মিলে মেলায় যাবে বলে ঠিক করল সেদিন আকাশ সকাল থেকেই ঘন অন্ধকার। বৃষ্টি হয়েই চলেছে একটানা। অনেকটা বৃষ্টির পরপর অবশ্য কিছুক্ষণ থম মেরে থাকছিল প্রকৃতি। ওইরকম এক বিরতির অবকাশে সবাই মিলে নৌকোয় চড়ে বসা হলো। যাত্রীবাহী নৌকোগুলি আকারে বেশ বড়, ছই দিয়ে ঘেরা এমনভাবে যে নৌকো কি বাড়ির ঘর ভিতর থাকলে বোঝা যায় না। নৌকো যে কত কত প্রকৃতির হয় মায়ের মুখে গল্প শুনতাম। এক জাতীয় নৌকোর নাম ছিল গয়নার নৌকো। আমি ভাবতাম, ওই নৌকো করে বুঝি গয়নাগাটি বয়ে নেওয়া হয়। মা আমার ভুল ভেঙ্গে দিয়েছিল। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আমার জ্যাঠামশাই ব্যবসা করে বিশাল পারিবারিক ধনসম্পত্তি বানিয়েছিলেন। নাকি আমাদের উপাধি বর্তমানে যা তা হওয়ার কারণ ওইসব ধন-সম্পদ আর জমিজমা। জ্যাঠামশাইয়ের মূলত ছিল বোধহয় পাট চালান দেওয়ার ব্যবসা। বড় বড় গয়নার নৌকো ভর্তি পাট শহরে যেত। নদী ধরে এমনই এক যাত্রাপথে প্রবল ঝড়ে জ্যাঠামশাইয়ের পাটভর্তি সমস্ত নৌকো নদীর জলে তলিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই অবস্থার অবনতি।
দেশের বাড়িতে সারা বছর কাজকর্ম করার জন্য বেশ কয়েকজন লোক থাকতো। তারা জমিজমা চাষবাস করা ছাড়াও গরুবাছর দেখাশোনা করত, পুকুর থেকে মাছটাছ ধরত, নৌকো বেয়ে বাজার-টাজারে যেত। এসব কাজের লোককে কথ্য ভাষায় বলা হত মুনি বা মুনিমজুর। আমার বুকে জলকষ্ট হয় যখন দেখি এসব কথ্য ভাষা আর বলতে পারি না। জন্ম থেকে যে ভাষা আমাকে বড় করেছিল আজ সে ভাষাকে আমি বর্জন করতে বাধ্য হয়েছি। মনে পড়ছে, পূর্ববঙ্গে দেশের বাড়িতে লোকরা বাজারকে বলতো আড়ং এবং ত্রিপুরাতেও তারা কেউ কেউ এই নামেই বোঝাত বাজারকে। হারিয়ে ফেলা ভাষার স্মৃতিতে আমি অবশ হয়ে বসে থাকি। একটা-দুটো করে ভুলে যাওয়া ভাষা আমার মনে পড়ে, মনে পড়ে আর বুকে শোক জাগে। জীবন থেকে কত কিছুই যে জন্মের মতো হারিয়ে গেল। মা যতদিন ছিল মায়ের সঙ্গে এই ভাষায় কথা হতো আমার। মা নেই, প্রাণের ভাষাও আমার নেই হয়ে গেছে।
এমনি করেই জীবনে কত কিছু নেই হয়ে গেল। যা দেখছি আজ চোখের সামনে সবই তাই অচেনা লাগে, পরিচিত অনেক কিছু যেহেতু হারিয়ে গেছে। দেশকালের পুরনো গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা যদিও ক্লান্তি আনে তবুও সেই চেনা পরিবেশ হারিয়ে গেলে বুকে শ্বাসকষ্ট হয়। সেই কষ্ট সর্বাঙ্গে জড়িয়ে দিনযাপন চলে। এমনি করে আমিও এগিয়ে যেতে থাকি নাম না জানা কোন প্রদেশ অভিমুখে। আমারও সর্বস্ব এবার নেই হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
সেই মেলায় যাওয়ার গল্প মা ঘটা করে শোনাত আমাদের। আমরা তখন ত্রিপুরাতে আছি। জল কেটে নৌকো এগিয়ে যাচ্ছিল মেলার পথে। ছইয়ের ভিতর থেকে বোঝার উপায় ছিল না প্রকৃতি চারপাশে কেমন। বৃষ্টি প্রবল না হলেও হয়েই যাচ্ছিল একটানা। নৌকোয় বোধহয় অনেকেই ছিল। তাদের কথা মা বলেছিল। এখন আর খেয়াল নেই।
মাঠঘাট সবই জলে ডোবা। মানুষের হাঁটার পথ ধরে চলছিল সেই নৌকো। তারপর একটা খালের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে।ছইয়ের আচ্ছাদন সরিয়ে চারপাশের প্রকৃতি দেখছিল মা মাঝেমধ্যেই। ক্রমশ রথের মেলার কাছাকাছি চলে আসে নৌকো, তখনই আবার শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি , প্রবল তোড়ে। নৌকো বাইছিল ওক্কাস আলী, সে সারা বছর দেশের বাড়িতে থেকে কাজকর্ম করতো। ঝমাঝম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ওক্কাস নৌকো চালিয়ে নিয়ে এলো রথের মেলার ঘাটে। নৌকো থামলো কিন্তু নামার উপায় নেই। মা ছইয়ের ভিতর থেকে ওক্কাসকে ডেকে বলল,
‘ও ওক্কাস, ভিতরে এসে বসো। এই বৃষ্টিতে নামবো কী করে ? তুমিই বা ভিজবে কেন ?’
ওয়ক্কাস ভিতরে এসে বসে। বাইরে বৃষ্টি হয়েই যেতে থাকে। ভিতরে বসে নানা জল্পনা-কল্পনা চলে সবার মধ্যে। কতক্ষণ এভাবে থাকতে হয়েছিল তা তাদেরও খেয়াল ছিল না। একসময় নাকি কেউ একজন বাইরে থেকে জোরে চেঁচিয়ে ডাকলো সবাইকে। প্রথমে সে ডাক কারও কানে যায়নি বৃষ্টির আওয়াজে। ডাক শুনতে পেয়ে ওক্কাস হুড়মুড়িয়ে বাইরে গিয়ে দেখে বৃষ্টির জল পড়ে নৌকো ভরে উঠেছে, প্রায় ডুবু ডুবু। ছইয়ের ভিতরে বসে কেউ বুঝতেই পারেনি বিপদের কথা। ওক্কাস তড়িঘড়ি নৌকোর জল ছেঁচতে লাগলো আর মা আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে বলেছিল,
‘ভাগ্যিস লোকটা ডেকে বলল। না হলে নৌকা ডুবে গেলে কী হতো ?’
পরক্ষণেই মা আবার সবাইকে জানিয়েছিল,
‘আমি অবশ্য সাঁতার জানি। এই জল আর কী এমন ? বুড়িগঙ্গা নদীতে কত সাঁতার কাটতাম। বর্ষাকালে সেই নদীর কী জল, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না।’
বুড়িগঙ্গা মায়ের কৈশোরের সঙ্গিনী। ঢাকা শহরে যেখানে মায়েদের বাড়ি তার ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে যেত ওই নদী। সে নদীর কথা বলতে গিয়ে মায়ের গর্বের অন্ত ছিল না।
আজও বর্ষাকালে রথের মেলা এলে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কর্মহীন বসে থাকলে মনে পড়ে সেইসব কথা। মনে হয়, মা বসে ওই গল্প শোনাচ্ছে। মনে হয় মা কত কাছে অথচ নাগাল পাই না। অন্তরের সমস্ত প্রাঙ্গণ জুড়ে ভাসতে থাকে মায়ের হাসি হাসি মুখ, দেখি চোখে গর্বের চিকচিক। সব হারিয়ে ফেলেছি যদিও এই স্মৃতিটুকুকেই প্রাপ্তি মনে হয়।