আশিস ভৌমিক
লেখক পরিচিতি
(জন্ম 5 ই এপ্রিল 1974, গ্রাম -বৃন্দাবনচক , পাঁশকুড়া , পূর্ব মেদিনীপুর ।প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামে ।উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় ।সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ।গৃহ শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য চর্চা । বিভিন্ন লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন । প্রথম কাব্যগ্রন্থ “”হিরণ্ময়ী ” । দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ” কালবেলা “।
প্রথম পর্ব
সৃষ্টিলগ্ন থেকে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা অন্যতম। প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ ইরাকের তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন এই সভ্যতা। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো সুমেরীয় সভ্যতার লোকজনও বিশ্বাস করত, পৃথিবী ও মহাজাগতিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন অদৃশ্য দেব-দেবীরা। এই বিশ্বাস থেকেই সুমেরীয় সভ্যতায় জন্ম নিয়েছে তিন হাজারেরও অধিক দেব-দেবী। সময়ের সাথে সাথে মেসোপটেমিয়াতে সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়কালের (আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, ক্যালডীয়) পরিবর্তন ঘটলেও উপকথার শেকড় প্রোথিত রয়েছে এক জায়গাতেই। সেজন্য মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত বিভিন্ন সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন নামের দেব-দেবীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের কাহিনির বহমান স্রোত গিয়ে মিলেছে একই সমুদ্রে। সুমেরীয় সভ্যতা হলো মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাই ধরা যায়, মেসোপটেমীয় ধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছে এই সভ্যতার সময়েই।
সুমেরীয় দেবতাদের মানব প্রকৃতি
মেসোপটেমিয়ার ধর্মীয় চিন্তাধারায় প্রধানত জীবিকা প্রদানকারী হিসাবে প্রকৃতির শক্তির উপাসনা জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে উপাসনার বস্তুগুলিকে মূর্তিমান করা হয়েছিল। প্রাচীন সুমেরীয় ধর্মতে দেবতাদের উপস্থাপন করা হয়েছে মানব আকৃতির সাথে মিল রেখে। উপকথা অনুযায়ী, দেব-দেবীদের অলৌকিক শক্তি বিদ্যমান থাকলেও, মননে ও গড়নে এরা ছিল মানুষের মতোই।
তারা নৃতাত্ত্বিক ছিল, যার ফলে মানবিক রূপ ছিল। একইভাবে, তারা প্রায়শই মানুষের মতো কাজ করত, খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন, সেইসাথে অ্যালকোহল পান করত এবং পরবর্তীতে মাতালতার প্রভাব ভোগ করত, কিন্তু সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের পরিপূর্ণতা বেশি বলে মনে করা হয়। তারা আরও শক্তিশালী, সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞানী, অকথ্য এবং সর্বোপরি অমর বলে মনে করা হয়েছিল। তাদের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি ছিল একটি ভয়ঙ্কর উজ্জ্বলতা ( মেলাম্মু ) যা তাদের ঘিরে রেখেছিল, যা পুরুষদের মধ্যে অবিলম্বে বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। ঐতিহাসিক জে. বোটেরোর অভিমত ছিল যে দেবতাদেরকে রহস্যজনকভাবে দেখা হতো না, বরং তাদেরকে উচ্চ-উপস্থিত প্রভু হিসেবে দেখা হতো যাদেরকে মান্য ও ভয় করতে হতো, যেমন ভালোবাসতেন এবং পূজা করতে হতো।
মানবজাতির মতোই দেবতারা মনে পোষণ করতেন লোভ, লালসা, কামক্ষুধা, আবেগ, ভালোবাসা, হিংসা, ঈর্ষাপরায়ণতা ইত্যাদি। মানুষের মতো জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠলেও মানুষের সাথে ছিল তাদের একটাই ফারাক। দেবতারা ছিলেন অমর। সোজা ভাষায়, গড়নে এরা মানুষের মতো হলেও, শক্তিমত্তা এবং সৌন্দর্যে এরা মানুষের চেয়ে উৎকৃষ্ট। কোনো সুমেরীয় দেবতাই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তারা আকারে ছিলেন বিশাল।
পৃষ্ঠপোষক দেবতার ধারণা
সুমেরীয় সভ্যতার আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের ধারণা। প্রতিটি প্রধান শহর তাদের প্রধান স্থানীয় দেবতা হিসেবে আলাদা আলাদা দেবতার পূজা করত। উদাহরণস্বরূপ, উরুকের লোকেরা দেবতা আন এবং দেবী ইনানাকে শ্রদ্ধা করত। ওদিকে নিপ্পুরের বাসিন্দারা এনলিলকে তাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা বলে মনে করত। এরিদু এনকিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরা হতো। সমস্ত পরিচিত মন্দিরগুলি শহরে অবস্থিত ছিল, যদিও শহরতলিতেও কিছু উপাসনালয় থাকত।
মন্দিরটি একটি জিগুরাটের আকারে মাটির ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল , যা একটি পিরামিডের মতো আকৃতির একটি টাওয়ারের মতো ছিল এবং দৈত্যাকার ধাপগুলির সমন্বয়ে গঠিত। এটিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। টাওয়ারটিকে দেবতাদের স্বর্গ থেকে নেমে আসার এবং স্বর্গে আরোহণের জন্য এক ধরণের সিঁড়ি বা সিঁড়ি হিসাবে বিবেচনা করে। পুরো মন্দিরটিকে একটি বিশাল বেদী হিসাবে গণ্য করা হতে পারে। কিছু মন্দির, যেমন এরিদুতে এনকি মন্দিরে একটি পবিত্র গাছ ( কিসকানু ) ছিল, যা রাজার দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় বিন্দু ছিল, যিনি “মাস্টার মালী” হিসাবে কাজ করতেন।
মেসোপটেমিয়ার মন্দিরগুলি মূলত দেবতার বাসস্থান হিসাবে পরিবেশন করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যিনি শহর ও রাজ্যের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে বসবাস করতেন এবং বিচার ব্যবস্থা ধরে রাখতেন বলে মনে করা হয়। তার উপস্থিতি একটি পৃথক ঘরে দেবতার একটি মূর্তি দ্বারা প্রতীকী ছিল। মূর্তিটির মধ্যে দেবতার উপস্থিতি একটি খুব সুনির্দিষ্ট উপায়ে ভাবা হয়েছিল, দেবতার উপস্থিতির জন্য একটি মিথের আশ্রয় নেওয়া হতো।
রাজারা তাত্ত্বিকভাবে ধর্মীয় নেতা ছিলেন, তবে অনেক ধরণের পুরোহিতও বিদ্যমান ছিল। সাধারণত, সেবা বা কাজের মাধ্যমে দেবতার মঙ্গল বজায় ছিল ( দুল্লু )। ইমেজ পরিহিত ছিল এবং দিনে দুবার ভোজ পরিবেশন করা হয়. বলিদানের খাবারও নিয়মিতভাবে নির্ধারিত হত, একটি বলিদানকারী পশুকে একজন মানুষের প্রতিস্থাপন বা বিকল্প হিসাবে দেখা হত, এবং এটি বিবেচনা করা হত যে তখন দেবতা বা দানবদের ক্রোধ বলির পশুর দিকে পরিচালিত করা হোত।
সুমেরীয় সৃষ্টি তত্ত্ব
মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা। পৃথিবীর প্রথমদিককার সভ্যতাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাচীন শহর নিপ্পুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সময় বেশ কিছু মাটির ব্লক (ট্যাবলেট) পাওয়া যায়, যাতে সুমেরীয় সভ্যতায় মানব সৃষ্টির গল্প লেখা ছিল। একে ‘এরিডু জেনেসিস’ বলা হয়। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, আজ থেকে প্রায় ২,১৫০ বছর আগে ‘এরিডু জেনেসিস’ লেখা হয়, তবে অনুমিতভাবেই লোকমুখে এ গল্প বহু আগে থেকে চলে আসছে।
সৃষ্টির শুরুতে
সুমেরীয়রা মনে করত, মহাবিশ্ব একটি বদ্ধ গম্বুজের আকৃতিবিশিষ্ট এবং সেটিকে ঘিরে রয়েছে আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের এক সমুদ্র। এই গম্বুজের ভিত্তিটি হল শিলাময় পৃথিবী এবং পৃথিবীর নিচে রয়েছে একটি পাতাললোক এবং আব্জু নামে পরিচিত মিষ্টি জলের একটি মহাসাগর। আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের সমুদ্র থেকে আবির্ভূত হন নাম্মু। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পরিবেশ। আকাশ, পৃথিবী, স্বর্গ, নরক কিছুই ছিল না তখন। চারিদিক বিষাক্ত। প্রানের অস্তিত্ব ছিল না। সেই আদি সাগর থেকে উঠে এলেন নাম্মু। তিনি অযৌন যোনি প্রাপ্ত। পারথেনোকারপির মাধ্যমে তার থেকে জন্ম হলো স্বর্গ ও পৃথিবীর যুক্ত সত্ত্বার। আন এবং কি। তার দুই সন্তান।স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব করেন আনু, যিনি পুরুষ। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বকারী দেবী কি। আনু ও কি’র মিলনে তাদের পারস্পরিক প্রাকৃতিক জৈব ক্রিয়ায় উৎপত্তি হলো বায়ুদেবতা এনলিলের। আকাশ হলো কিছুটা নির্মল। বায়ুর শৈশব দশা কাটার পর তার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তার প্রভাব জোরে তিনি আনু আর কি-কে আলাদা করে ফেললেন। আনু নিজে ঊর্ধ্বমুখী হলেও সন্তানের সাথে কি নেমে এলেন নিচের দিকে। এই ভাবেই তৈরি হল স্বর্গ পৃথিবী আর চাঁদের মাঝে বায়ুমণ্ডল।
নিচে নেমে এসে একসময় এনলিল আর তার মা কি স্থির হলেন। কিন্তু চারদিক বড় অন্ধকার। আলো কোথায়! আলো পেতে কি এবং এনলিল সৃষ্টি করলেন তাদের তিন সন্তান। অর্থাৎ এনলিল তার মায়ের সাথে মিলিত হয়ে জন্ম দেন দেবতা নিনুর্তা, চন্দ্রদেবতা নান্না এবং সূর্যদেবতা উতুরকে। নিনুর্তাকে যুদ্ধ ও কৃষি দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। আবার অন্য মতে চন্দ্রের দেবতা নান্না জন্ম দিলেন সূর্যদেব, উটুর। নান্না অন্ধকার আকাশে আলো আনার জন্য দায়ী ছিলেন, যাকে একটি সমতল পৃথিবীর উপর তিনটি গম্বুজে বিভক্ত বলা হয়েছিল প্রতিটি গম্বুজ একটি মূল্যবান পদার্থ দিয়ে তৈরি। তিনি আকাশের চারপাশে নক্ষত্র এবং গ্রহগুলি ছড়িয়ে দেন এবং তার স্ত্রী নিঙ্গালের সাথে একত্রে ইনানা এবং তার যমজ ভাই উতুর জন্ম দেন।
এবার এনলিল ও কি-র সম্মিলনে বাতাস আর পৃথিবী এক হয়ে সৃষ্টি করল দেবতা এনকির। এনকি ছিলেন মিষ্টি জলের দেবতা। এছাড়াও তিনি পুরুষদের যৌন সক্ষমতা ও জ্ঞানের দেবতা হিসেবেও সুপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু, গাছপালা আর মিঠা জলের দেবতা। তার নির্দেশে মাটি চিরে প্রবাহিত হলো শক্তিমান টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদী। জলে সাঁতার কাটতে লাগল নানা প্রজাতির মাছ, জমি হয়ে উঠল কৃষিকাজের উপযোগী। ধরণীতে দেবতাদের থাকার জন্য এনকি বানালেন শহর। পত্তন হলো প্রাচীনতম নগরী এরিদু, বাদ-তিবিরা, লারসা আর শুরুপ্পাকের।
কালক্রমে আরো বহু দেবদেবীর পদচারণায় পৃথিবী মুখরিত হয়ে উঠল। তাদের কাজ তারা নিজেরাই করতেন। মাটি কাটা, ঘরবাড়ি বানানোসহ আরও বহু কাজ করতে করতে দেবতারা হয়ে পড়লেন ক্লান্ত। তারা আনুর কাছে আবেদন জানালেন, এই দিনভর কাজ থেকে মুক্তি দিতে। আনু ভেবে দেখলেন, সত্যিই তো, তার সন্তানেরা কাজ করতে করতে মরেই যাচ্ছে!
দ্বিতীয় পর্ব
মানুষের জন্ম
এনকি পরামর্শ দিলেন, দেবতাদের দাস হিসেবে তাদের আকার-আকৃতিতে একটা কিছু সৃষ্টি করবার। যে-ই কথা, সে-ই কাজ। আনুর অনুমতি পেয়ে তিনি এক দেবতাকে হত্যা করলেন। মৃত দেবতার রক্ত-মাংস কাদামাটির ছাঁচে ফেলে এনকি তৈরি করলেন প্রথম মানুষ। এদের পাঠালেন তিনি কাজ করতে, আর দেবতারা মনের আনন্দে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠলেন। মানুষ তাদের সেবা করতে লাগল। বলা হয়, প্রথম মানুষ যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল, তার নাম ইডেন- দেবতাদের বাগান। বাগানটির অবস্থান ছিল টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের মাঝে কোনো এক জায়গাতে।বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গের এডাম আর ইভের কাহিনীর সাথে এই সুমেরীয়’দের মনুষ্য সৃষ্টির গল্পের কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় ।
মানুষ সৃষ্টির পর কাজ করতে হবে না- এ খুশিতে সব দেবতারা ভোজসভায় মিলিত হলেন। এখানে নেশার ঘোরে এনকি আর প্রজননের দেবী নিন্মাহের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায়। এনকি বড়াই করলেন, নিন্মাহ যেভাবেই মানব বানান না কেন, তিনি তার জন্য সমাজে কোনো না কোনো স্থান খুঁজে দিতে পারবেন। নিন্মাহ একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। তিনি প্রথমে বানালেন এমন এক মানুষ, যার হাত সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। এনকি তাকে রাজদরবারের সভাসদ করে দিলেন। এবার নিন্মাহ সৃষ্টি করলেন এক অন্ধ ব্যক্তির, এনকি তাকে পরিণত করলেন সুকণ্ঠী গায়কে। নিন্মাহ খুঁড়িয়ে চলা এক লোক তৈরি করলে এনকি তাকে কামারের কাজ দিলেন।
নিন্মাহের রোখ চেপে গেল। তিনি পর্যায়ক্রমে বন্ধ্যা এক মানবী এবং না-পুরুষ, না-নারী এক অস্তিত্বের সৃষ্টি করলেন। প্রতিবারই এনকি তাদের কাজের জন্য কোনো না কোনো উপায় বের করে ফেলেন। হতাশ হয়ে নিন্মাহ চলে যান। এনকি এবার নিজেই এক মানুষ সৃষ্টি করেন, যার শরীর ছিল চরমভাবে বিকৃত। তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গই সঠিকভাবে গঠিত ছিল না। নিন্মাহ তাকে দেখে প্রচুর রেগে গেলেন। এনকি স্বীকার করলেন, সৃষ্টির ব্যাপারে নিন্মাহ তার থেকে অনেক ভালো। তারা বুঝতে পারলেন, মানুষকে সঠিক আকারে না বানালে তারা দেবতাদের উপাসনা করবে না।
আরেক বর্ণনায় আছে, দেবতারা ভোজসভাতেই মানব সৃষ্টি করেছিলেন। কি কাদামাটি দিয়ে যাদের বানালেন, তারা কেউ সন্তান জন্মদানে সমর্থ ছিল না। ফলে এনকি নতুন করে আরো কিছু মানুষ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তারা ছিল বেশ দুর্বল। সুমেরিয়ানরা বলত, মানুষের দুর্বলতা আর রোগবালাই দেবতাদের নেশার ঘোরে সৃষ্টি করার ফল।
আডাপার আখ্যান
প্রথমদিকে মানুষ শিশু জন্মদানে অক্ষম হলেও শীঘ্রই দেবতারা বুঝতে পারেন, মানবসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হলে প্রজননের ক্ষমতা দিতে হবে। ফলে প্রথম সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে তারা অ্যাডাপাকে সৃষ্টি করলেন। সে কাজ করত এরিদু নগরীতে। মাছ ধরে দেবতাদের মন্দিরে নিয়ে আসত। দখিনা হাওয়ার দাপটে একবার মাছ ধরতে গিয়ে সে দুর্বিপাকের শিকার হয়। তিক্ত-বিরক্ত অ্যাডাপা বায়ুকে অভিশাপ দিলে তার ডানা ভেঙে যায়। এতে করে দক্ষিণ বাতাসের উপকারিতা থেকে এরিদুর লোকেরা বঞ্চিত হতে থাকে। আনু অ্যাডাপাকে জবাবদিহিতার জন্য ডেকে পাঠালে এনকি তার প্রিয় সন্তানকে কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন।
সেই মোতাবেক অ্যাডাপা শোকের পোশাকে আনুর সামনে হাজির হলেন, যাতে দেবতাদের দেবতা তার প্রতি নমনীয় হন। আনু খুশি হয়ে তাকে স্বর্গীয় রুটি আর পানি দিতে চাইলে আডাপা এনকির পরামর্শমতো তা গ্রহণে অপারগতা জানিয়ে আনুর কাছে তেল চেয়ে নিলেন। আনু কৌতুক বোধ করলেন, তবে তিনি সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
স্বর্গীয় পানি আর রুটি গ্রহণ করে দেবতারা অমর থাকতেন। তাই তা খেয়ে আডাপাও হয়ত অমর হয়ে যেতেন। এর বিশ্লেষণে বেশ কয়েকটি মতের একটি হলো, এনকি চাননি মানবজাতি দেবতাদের মতো অমর হয়ে উঠুক। আবার অনেকে বলেন, দেবতাদের খাদ্য নশ্বর মানবের জন্য নয়। যে রুটি আর পানি দেবতাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে, সেই খাদ্যই মানব শরীরকে নিমেষে হত্যা করবে। যা-ই হোক না কেন, স্বর্গ থেকে অ্যাডাপা নেমে এলেন সুস্থভাবে। মানুষকে শোনালেন আনু আর এনকির মহিমার কথা।
সুমেরীয় পুরাণে পাতাল লোক
ব্যাবিলনীয়রা সুমেরীয় পাতালপুরীকে তাদের পুরাণে ইরকাল্লা নামক একটি নরকীয় স্থান হিসাবে বর্ণনা করেছিল । মেসিডোনিয়ান (গ্রীক) এবং পরে রোমানরা, ইরকাল্লাকে হেডিস ( গ্রীক আন্ডারওয়ার্ল্ড ) হিসাবে চিহ্নিত করে; খ্রিস্টান মূর্তিতত্ত্বে, নরক/হাডেস
এই ইরকাল্লা হল সুমেরীয় পাতাল। এর প্রবেশদ্বারটি সুদূর পূর্বে জাগ্রোস পর্বতমালায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এর সাতটি দরজা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে একজন আত্মাকে যেতে হয়।ইরেশকিগাল (ইরকাল্লা এবং আল্লাতু নামেও পরিচিত) হলেন মৃতদের মেসোপটেমিয়ার রানী যিনি পাতাল শাসন করেন। তার নাম ‘গ্রেট নিচের রানী’ বা ‘লেডি অফ দ্য গ্রেট প্লেস’ হিসেবে পরিচিত। তিনি মৃতদেরকে তার রাজ্যের মধ্যে রাখা এবং জীবিতদের প্রবেশ এবং পরকালের সত্য শিখতে বাধা দেওয়ার জন্য দায়ী ছিলেন। দেবতা নেতি হলেন তার দারোয়ান।
এরেশকিগাল তার স্বামী নেরগালের সাথে ইরকাল্লা শাসন করতেন। এরেশকিগালই একমাত্র যিনি তার রাজ্যে রায় দিতে এবং আইন দিতে পারতেন। তাকে উৎসর্গ করা মূল মন্দিরটি কুথায় অবস্থিত ছিল। প্রাচীন সুমেরীয় কবিতায় Inanna’s Descent to the Underworld এ এরেশকিগালকে ইনানার বড় বোন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরেশকিগালের সাথে জড়িত দুটি প্রধান পৌরাণিক কাহিনী হল আন্ডারওয়ার্ল্ডে ইনানার উত্তরণের গল্প এবং দেবতা নেরগালের সাথে এরেশকিগালের বিয়ের গল্প।
পাতালপুরীর ফলের বাগান
সুমেরীয় পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে , সূর্য-দেবতা উতু রাতে পাতালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেন, এবং তিনি সূর্যোদয়ের প্রস্তুতিতে পূর্ব দিকে যাত্রা করেন। একটি সুমেরীয় পুরানে উতু আন্ডারওয়ার্ল্ডকে আলোকিত করে এবং সেখানে রায় প্রদান করে। শামাশ স্তবক 31 (BWL 126) বলে যে উতু মালকু , কুসু এবং আনুন্নাকির পাশাপাশি পাতাল জগতে মৃতদের বিচারক হিসাবে কাজ করে । পাতালপুরীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথে, উতু অর্থাৎ সূর্যদেবতা একটি বাগানের মধ্য দিয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয় , যেখানে গাছ রয়েছে যা ফল হিসাবে মূল্যবান রত্ন বহন করে। সুমেরীয় স্তোত্র ইনানা এবং উতুকে নিয়ে একটি মিথ রয়েছে যেখানে উতুর বোন ইনানা তার ভাই উতুকে তাকে এই পাতালপুরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে, যাতে সে সেখানে জন্মানো একটি গাছের ফলের স্বাদ নিতে পারে, যা তার কাছে সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করবে। উতু মেনে নেয় এবং, ইনানা এই ফলের স্বাদ গ্রহণ করে এবং যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞানী হয়।
পরকাল এবং জীবনতত্ত্ব
প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা একটি পরকাল বিশ্বাস করত যা আমাদের পৃথিবীর নীচের একটি ভূমি। এটি ছিল এই ভূমি, যা পর্যায়ক্রমে Arallû , Ganzer বা Irkallu নামে পরিচিত , যার শেষেরটির অর্থ ছিল “গ্রেট নীচে”, যেটি বিশ্বাস করা হত যে প্রত্যেকেই মৃত্যুর পরে যায়, সামাজিক অবস্থান বা জীবনের সময় সম্পাদিত কর্ম নির্বিশেষে। খ্রিস্টান নরকের বিপরীতে, মেসোপটেমীয়রা পাতাল লোককে শাস্তির স্থান বা পুরষ্কার বলে মনে করত না। তবুও, মৃতদের অবস্থা পৃথিবীতে পূর্বে যে জীবন উপভোগ করা হয়েছিল তার মতো কমই বিবেচনা করা হয়েছিল: তাদের নিছক দুর্বল এবং শক্তিহীন ভূত হিসাবে বিবেচনা করা হত।
পাতালে ইশতারের বংশধরের পৌরাণিক কাহিনীটি বলে যে “ধুলো তাদের খাদ্য এবং কাদামাটি তাদের পুষ্টি, তারা কোন আলো দেখতে পায় না, যেখানে তারা অন্ধকারে বাস করে।” আডাপা পৌরাণিক কাহিনীর মতো গল্পগুলি বলে যে, একটি ভুলের কারণে, সমস্ত মানুষকে অবশ্যই মরতে হবে এবং সত্য অনন্ত জীবন দেবতাদের একমাত্র সম্পত্তি। যাইহোক, কিছু গল্প ইঙ্গিত করে যে নির্দিষ্ট কিছু দেবতা পরবর্তী জীবনে কিছুটা ভাল দিতে পারে যদি তাদের অনুগ্রহ পাওয়া যায়। অনেক দেবতা যারা তিয়ামাতকে হস্তগত করার সময় তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল তাদের একইভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নির্বাসিত করা হয়েছিল, মেগাটেনের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন উচ্ছৃঙ্খল দেবতাদের পরে দানব করা হয়েছিল।
তৃতীয় পর্ব
সুমেরীয় পুরাণের দুটি গল্প
দ্য ডিসেন্ট অফ ইনানা :-
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও প্রাচীন বিষয়
দুজন বোন ছিলেন যাঁরা একে অপরকে যারপরনাই ঘৃণা করতেন। একজন ইনানা, মর্তের এবং জীবিত প্রাণীদের দুনিয়ার দেবী। অন্যজন এরেশকিগাল, পাতালের এবং মৃতের জগতের দেবী। একবার ইনানার ইচ্ছে হল, পাতালে ঘুরতে যাবেন। তিনি পাতালের দ্বাররক্ষককে গিয়ে বললেন, তিনি তাঁর ভগ্নীপতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছুক। তবে আসলে হয়তো তাঁর এই সুযোগে পাতালের রাজত্বটিকেও হাতিয়ে নেবার ইচ্ছে ছিল। মর্ত ছেড়ে আসার আগে ইনানা তাঁর মন্ত্রী নিনশুবুরকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি যদি পাতালে কোনও বিপদে পড়েন, মন্ত্রী যেন এনলিল, নান্না আর এনকি নামক তিন দেবতার কাছে আর্জি পেশ করেন তাঁকে উদ্ধার করতে। ইনানা পাতালে গেলেন রীতিমতো জমকালো পোশাক-আশাক পরে। শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের জন্য নিতান্তই বেমানান এই পোশাকের জাঁকজমক দেখে, এবং পাশাপাশি তাঁর উদ্ধত আচরণ লক্ষ করে, পাতালের দেবীর বেশ সন্দেহ হতে শুরু করল। এরেশকিগালের কথামতো পাতালের দ্বাররক্ষক ইনানাকে জানাল, পাতালের প্রথম দরজা দিয়ে তিনি প্রবেশ করার অনুমতি পাবেন শরীর থেকে একটি কোনও পোশাক খুলে তার হাতে তুলে দেবার পরেই। ইনানা কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে জানাল, ‘পাতালের এটাই নিয়ম।’ অতএব তিনিও এ-শর্ত মেনে নিলেন।
সাতটি দরজা দিয়ে এগিয়ে চললেন ইনানা, প্রত্যেকবারই পরে আসা একটি কোনও পোশাক বা অলঙ্কার খুলতে-খুলতে। অবশেষে যখন তাঁর বোনের সামনে গিয়ে তিনি পৌঁছলেন, তখন তিনি নগ্ন, অসহায়। এরেশকিগাল ইনানাকে একটি শবদেহ বানিয়ে একটি শিকে টাঙিয়ে রাখলেন।
তিন দিন, তিন রাত কেটে যাবার পর নিনশুবুর ইনানার কথামতো এনলিল, নান্না আর এনকির মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করলেন— জীবন, জীবিত এবং প্রেমের দেবীকে যেন তাঁরা রক্ষা করেন। প্রথম দুজন দেবতা এ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, এ-বিপদ ইনানা নিজে ডেকে এনেছেন। তবে এনকির খুবই দুশ্চিন্তা হল, তিনি ইনানাকে উদ্ধার করতে রাজি হলেন। তিনি দুটি লিঙ্গবিহীন জীব সৃষ্টি করলেন (নারীও নয়, পুরুষও নয়), এবং তাঁদের বললেন, পাতালে গিয়ে এরেশকিগালকে তুষ্ট করতে। তিনি যখন প্রসন্ন হয়ে বর দিতে চাইবেন, তখন যেন তাঁরা ইনানার শবদেহে খাদ্য এবং জিয়ন-জল ছিটিয়ে দেয়।
এনকির পরিকল্পনামাফিকই সব হল, দুই লিঙ্গবিহীন জীব বাঁচিয়েও তুলল ইনানাকে। কিন্তু এরেশকিগালের রাক্ষসেরা ইনানার পিছন-পিছন ধাওয়া করে উঠে এল পাতাল থেকে, তাদের দাবি— ইনানার পরিবর্তে অন্য কাউকে না পেলে তাঁকে যেতে দেওয়া হবে না। প্রথমে তারা নিনশুবুরের কাছে এসে তাঁকে বলল, ইনানার স্থানটি গ্রহণ করতে। কিন্তু ইনানা এতে রাজি হলেন না, কারণ নিনশুবুর বাধ্যভাবেই তাঁকে সমস্তভাবে সাহায্য করেছিলেন। এরপরে রাক্ষসেরা ধরল ইনানার স্বামী দুমুজিকে। স্ত্রী পাতালে হারিয়ে গিয়েছেন জেনেও দুমুজি দিব্যি আমোদ-প্রমোদ করে জীবন কাটাচ্ছিলেন। অতএব ইনানা তাঁকে নিয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না, তিনি রাক্ষসদের দুমুজিকে ধরে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। দুমুজি তাঁর অদৃষ্টকে এড়াতে চেষ্টা করে পালালেন বটে, তবে ইনানা এবং রাক্ষসদের একটি মাছি এসে বলে দিল দুমুজি কোথায় লুকিয়ে আছেন। অতঃপর ঠিক হল, বছরের অর্ধেকটা সময় দুমুজি পাতালে এরেশকিগালের সঙ্গে কাটাবেন এবং বাকি অর্ধেকটা কাটাবেন নিজের স্ত্রী ইনানার সঙ্গে।
দ্য ম্যারেজ অফ ইরেশকিগাল
একদিন দেবতারা একটি মহান ভোজ প্রস্তুত করলেন যাতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এরেশকিগাল অবশ্য উপস্থিত হতে পারেননি, কারণ তিনি পাতাল ছেড়ে যেতে পারেননি এবং দেবতারা সেখানে তাদের ভোজ অনুষ্ঠানের জন্য নামতে পারেনি কারণ তারা পরে যেতে পারবে না। দেবতা এনকি ইরেশকিগালকে একটি বার্তা পাঠান যে একজন ভৃত্য পাঠাতে পারে যে তাকে ভোজের অংশ ফিরিয়ে আনতে পারে এবং সে তার ছেলে নামতারকে পাঠায়।
নামতার যখন দেবতাদের ভোজসভা হলে পৌঁছেছিল, তখন যুদ্ধের দেবতা নেরগাল ছাড়া তারা সবাই তার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে দাঁড়িয়েছিল। নামতার অপমানিত হয়েছিল এবং ভুলের প্রতিকার চেয়েছিল, কিন্তু এনকি তাকে কেবল আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফিরে যেতে এবং তার মাকে কী ঘটেছে তা বলতে বলেছিল। যখন ইরেশকিগাল নেরগালের অসম্মানের কথা শুনেন, তখন তিনি নামতারকে এনকির কাছে একটি বার্তা পাঠাতে বলেন যাতে নেরগালকে পাঠানো হয় যাতে সে তাকে হত্যা করতে পারে।
দেবতারা এই অনুরোধটি স্বীকার করেন এবং নেরগালকে বলা হয় তাকে অবশ্যই পাতাল ভ্রমণ করতে হবে। এনকি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি অবশ্যই ঘটবে, এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাতটি দরজার প্রতিটিতে তাকে সহায়তা করার জন্য নেরগালকে চৌদ্দাটি দানব সরবরাহ করে। যখন নেরগাল আসে, নেতি তার উপস্থিতি ঘোষণা করে এবং নামতার তার মাকে বলে যে দেবতা যিনি উঠবেন না তিনি এসেছেন। ইরেশকিগাল আদেশ দেয় যে তাকে সাতটি দরজার প্রতিটি দিয়ে প্রবেশ করতে হবে যা তার পিছনে বাধা দেওয়া উচিত এবং তিনি যখন সিংহাসনের ঘরে পৌঁছাবেন তখন তিনি তাকে হত্যা করবেন।
প্রতিটি গেট পেরিয়ে যাওয়ার পর, তবে, নেরগাল তার দুটি দানব এসকর্টকে খোলা রাখার জন্য পোস্ট করে এবং সিংহাসনের ঘরে চলে যায় যেখানে সে নামতারকে পরাস্ত করে এবং এরেশকিগালকে মেঝেতে টেনে নিয়ে যায়। সে তার মাথা কেটে ফেলার জন্য তার বড় কুড়াল তুলেছে, কিন্তু সে তাকে রক্ষা করার জন্য তাকে অনুরোধ করে, যদি সে রাজি হয় এবং তার ক্ষমতা তার সাথে ভাগ করে নেয় তাহলে তার স্ত্রী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। নেরগাল সম্মতি দেয় এবং মনে হয় সে যা করেছে তার জন্য অনুতপ্ত। কাহিনীটি শেষ হয় দুজন চুম্বন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তারা একসাথে থাকবে।
যেহেতু নেরগাল প্রায়শই তার মেজাজ হারিয়ে পৃথিবীতে সমস্যা সৃষ্টি করত এবং যুদ্ধ ও কলহ সৃষ্টি করত, তাই হয়তো এনকি তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরো দৃশ্যটি সাজিয়েছিল। যুদ্ধকে মানুষের অভিজ্ঞতার একটি অংশ হিসাবে স্বীকৃত করা হয়েছিল, এবং তাই নেরগাল স্থায়ীভাবে পাতালে থাকতে পারেনি কিন্তু বছরের ছয় মাসের জন্য তাকে পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসতে হয়েছিল। যেহেতু তিনি তার দানবকে গেটগুলিতে পোস্ট করেছিলেন, নিজের ইচ্ছায় এসেছিলেন এবং রাণীর সাহায্যে থাকার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, নেরগাল কোনও প্রতিস্থাপন না করেই চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
চতুর্থ পর্ব
গিলগামেশ মহাকাব্য
গিলগামেশ যিনি সব জানতেন, চিনতেন পৃথিবীর সব রাজ্য। জ্ঞানী ছিলেন তিনি। মুখোমুখি হয়েছিলেন রহস্যের, জানতেন অনেক গোপন কথা। মহাপ্লাবনের পূর্বের দিনগুলোর কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন। দীর্ঘ এক যাত্রায় বেরোন তিনি। পরিশ্রান্ত, অবসন্ন দেহে ফেরার পর বিশ্রাম করেন। তারপর পুরো গল্পটি লিখে রাখেন পাথরখণ্ডে।
গিলগামেশ, পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য। ইলিয়াড ও ওডিসির প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে যা রচিত হয়েছিল। এই মহাকাব্য আবর্তিত হয়েছে প্রাচীন নগরী উরুকের রাজা, গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুকে ঘিরে। দেবতা, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক ও অমরত্বের সন্ধান ইত্যাদি উঠে এলেও, এই মহাকাব্যের মূল কথা দুজন প্রায় দেবতা ও প্রায় বনমানবের মানুষ হয়ে ওঠা নিয়ে। বন্ধুত্বের জন্য মৃত্যুকে পরাজিত করার প্রচেষ্টা নিয়ে। কিন্তু মৃত্যুকে কি হারানো যায়? মানুষ কি পেতে পারে অমরত্ব?
মহাকাব্য-কথা
মহাকাব্য মানেই, তাতে উঠে এসেছে একটি সভ্যতা ও সমাজের জীবনদর্শন, মানবিকতা, শুভ ও অশুভের ব্যবধান ইত্যাদি। মহাকাব্য কিছু চরিত্রের গল্প হলেও এর ক্যানভাস জীবনের চেয়ে বড়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কারণ, এর লেখক হয়তো একজন-যেমন, রামায়ণের লিপিকার বাল্মীকি-কিন্তু তিনি নিজেই এর রচয়িতা নন। যুগে যুগে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে পুরো সভ্যতার গল্প, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি মিলে-মিশে ধীরে ধীরে তৈরি করে মহাকাব্য।
একই কথা খাটে হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসির ক্ষেত্রেও। আমরা জানি, হোমার একজন কবি ছিলেন না। যুগে যুগে একাধিক কবি, সভ্যতা ও সময়ের হাতে হাত রেখে রচনা করেছেন এই মহাকাব্য দুটি।
গিলগামেশও তেমনি কোনো একজন মানুষের রচিত নয় বলেই মনে করা হয়। কে রচনা করেছিলেন এই উপাখ্যান, আমরা জানি না। জানা সম্ভবও নয়, কেননা কোনো একজন ব্যক্তি বা কবি তো এর রচয়িতা নন। লোকের মুখে মুখে বহু পুরুষ ধরে বংশপরম্পরায় যুগে যুগে গিলগামেশকে নিয়ে অজস্র কাহিনী প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো একসময়ে তা সর্বপ্রথম ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়। কোনো একজন লোক যে একা বসে বসে লিখেছিলেন, তা মনে হয় না। বহু সময় ধরে বহু ব্যক্তি ঐ কাজ সমাধা করেছিলেন হয়তো।
গিলগামেশ মহাকাব্য-দ্য এপিক অব গিলগামেশ-এর মূল গল্প
প্রাচীন দক্ষিণ মেসপটেমিয়া অঞ্চল। ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদী দুটির মধ্যবর্তী দোআব অঞ্চলের গড়ে উঠেছে উরুক রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা গিলগামেশ। প্রচণ্ড সাহসী, সুপুরুষ এবং বীরযোদ্ধা। দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা, এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। তার বাবা উরুকের ধর্মযাজক লুগালাবান্দা, মা দেবী নিনসাল। দেবীর দিক থেকেই তার দেহে দেবত্বের ধারাটি এসেছে। গিলগামেশ তাই মানুষ হয়েও অমর, অপ্রতিরোধ্য।
সব হাতের মুঠোয় পেলে যা হয়, গিলগামেশেরও তাই হলো। তিনি খেয়ালি ও অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। প্রজারা তাকে রাজ্য রক্ষা ও সুনাম ধরে রাখার জন্য রাজা হিসেবে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার খামখেয়ালি ও অত্যাচারে তাদের জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। এমনকি, কেউ বিয়ে করতে চাইলে নববধূকে আগে রাজার সঙ্গে কিছুদিন কাটাতে হতো, তার সেবা করতে হতো। রাজা সন্তুষ্ট হলেই কেবল বধূ ফিরে যেতে পারত নিজের নতুন সংসারে।
গিলগামেশ মহাকাব্য অনুযায়ী, দেবরাজার নাম আনু। তার মন্দির ছিল উরুকে। রাজ্যের প্রজারা সেখানে গিয়ে তার কাছে বিচার চাইল। তিনি দেবী আরুরুকে ডাকলেন।
এই আরুরুই মাটি ছেনে মানুষ তৈরি করেছেন। তাই তাকেই দায়িত্ব দিলেন আনু, তৈরি করতে হবে গিলগামেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। আরুরু ঠিক গিলগামেশের মতো করে তৈরি করলেন এক বনমানুষ। এনকিদু। পার্থক্য বলতে, এনকিদুর সারা শরীর পশুদের মতো লোমে ঢাকা। তাকে তিনি ছেড়ে দিলেন বনে। বিশাল অরণ্যে, প্রকৃতি ও পশুদের সঙ্গে, সবার চোখের আড়ালে বড় হতে লাগল এনকিদু।
এনকিদুকে প্রথম দেখতে পান এক শিকারী। এরকম অদ্ভুত প্রাণী দেখে ভয় পেয়ে যান তিনি। তবে বুঝতে পারেন, প্রাণীটি মানুষ। কিন্তু সে তার মানুষ-পরিচয় জানে না।
খবর পৌঁছে গিলগামেশের কাছে। রাজা কিন্তু এসব শুনে পাত্তা দিলেন না। ঠিক বিশ্বাসও করলেন না। তবু একটা উপায় বাতলে দিলেন— দারুণ সুন্দরী কাউকে পাঠাতে হবে বনে। এনকিদু তার ক্ষতি করতে পারবে না, অন্তত সৌন্দর্যের জন্য। আর, মানুষ হিসেবে সে সেই মেয়েটির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চাইবে। তখন দেখা যাবে, বনের প্রাণীরা আর তার সঙ্গ চাইছে না। ফলে মেয়েটা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিয়ে আসতে পারবে শহরে।
ঠিক তা-ই হলো। এনকিদু চলে এল শহরে। জানতে পারল গিলগামেশের অত্যাচারের কথা। বিয়ে করতে চাচ্ছিল এক লোক। নববধূর ব্যাপারে তিনি জানালেন এনকিদুকে। বললেন, সেজন্যই তিনি বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন উরুকে, রাজার অনুমতি নিতে। সব শুনে এনকিদুও এলেন উরুকে। মুখোমুখি হলেন গিলগামেশের। প্রচণ্ড এক লড়াই বেঁধে গেল তাদের মধ্যে। একসময় তারা দুজনেই বুঝলেন, দেখতে তারা প্রায় একরকম। সাহস ও বীরত্বেও তাই। লড়াই থেমে গেল, হয়ে গেল বন্ধুত্ব। যে বন্ধুত্বের জন্য গিলগামেশ পাড়ি দেবেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, পেরিয়ে যাবেন মৃত্যুসায়র। জানতে পারবেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যটির কথা।
যাই হোক, বন্ধু এনকিদুকে নিয়ে গিলগামেশ বের হলেন অভিযানে। দৈত্য হুম্বাবাকে হত্যা করে তিনি নিজের কীর্তি রেখে যেতে চান। এই দৈত্যকে অরণ্য রক্ষায় নিয়োজিত করেছিলেন দেবতারা। গিলগামেশ সেসবের পরোয়া করলেন না। দেবী মায়ের সাহায্যে সূর্যদেবের আশীর্বাদ আদায় করে নিলেন। হত্যা করলেন হুম্বাবাকে।
এ সময় দেবী ইশরাত তাকে বিয়ের প্রস্তাব ও প্রলোভন দেখান। দেবীকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেন গিলগামেশ। ক্ষুদ্ধ ইশরাত বাবা, দেবরাজ আনুর কাছে গিয়ে স্বর্গীয় ষাঁড় চাইলেন গিলগামেশকে শায়েস্তা করার জন্য। গিলগামেশ একা কতটা করতে পারতেন, তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু ষাঁড় যখন গিলগামেশকে আক্রমণ করছিল, সেই ফাঁকে বুদ্ধি করে এনকিদু ঠিকই হত্যা করল স্বর্গীয় ষাঁড়কে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত দেবতারা গিলগামেশকে শাস্তি দেয়ার জন্য তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষটিকে সরিয়ে নিতে চাইলেন। মারা গেল এনকিদু।
এনকিদুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রথম পর্ব শেষ। শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে প্রিয় বন্ধুকে পুনর্জীবিত করতে গিলগামেশ পথে নামলেন। তিনি শুনেছেন, পৃথিবীর শেষ প্রান্তে থাকেন উৎনাপিশতিম। জ্ঞানী এই বৃদ্ধ মহাপ্লাবনেও মারা যাননি। তিনি নাকি জানেন অমরত্বের রহস্য। যে করেই হোক, তার কাছ থেকে এই রহস্য জানতে হবে।
শুরু হলো গিলগামেশের যাত্রা। বিশাল অরণ্য, পাতাল থেকে শুরু করে আকাশ ছোঁয়া মাশুপর্বত পেরিয়ে তিনি পৌঁছালেন মৃত্যুসায়রের পাড়ে। উৎনাপিশতিমের নৌকার মাঝি উর্শানাবি ছাড়া আর কেউ পেরোতে পারে না এই নদী। উর্শানাবি বললেন, তিনি ওকে পার করাবেন না। ভেলা ও বৈঠা তৈরি করে নিজেকেই পেরোতে হবে। তবে যে বৈঠা একবার পানি স্পর্শ করবে, তা আর ওঠানো যাবে না। অসম্ভবকে সম্ভব করল গিলগামেশ। হাজির হলো উৎনাপিশতিমের কাছে।
জ্ঞানী বৃদ্ধ তাকে জানালেন, মৃত্যু থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। মহাপ্লাবনের সময় দেবতা এয়ার দয়ায় তিনি বেঁচে গেছেন। আর কিছু না। শোকে কাতর গিলগামেশকে দেখে মায়া হলো উৎনাপিশতিমের স্ত্রীর। স্বামীকে তিনি তিরস্কার করলেন। সেজন্যই, উৎনাপিশতিম সত্যিটা জানালেন গিলগামেশকে। মৃত্যুসায়রের তলায় গায়ে কাঁটাযুক্ত একধরনের লতা আছে, জীয়নলতা। এই লতাই পারে মানুষকে অমরত্ব দিতে।
গিলগামেশ উদ্ধার করলেন সেই জীয়নলতা। তারপর পা বাড়ালেন উরুকের পথে। বন্ধুকে তিনি পুনর্জীবিত করবেন, দেবেন অমরত্ব।
পথে, এক দীঘির পাড়ে জীয়নলতা রেখে গোসল করতে নামলেন গিলগামেশ। এতদিনের ক্লান্তি ধুয়ে গেল শীতল জলে। আর, সেই ফাঁকে এক সাপ এসে খেয়ে গেল জীয়নলতা। গিলগামেশ গোসল সেরে উঠে দেখেন, সাপের মৃত খোলস পড়ে আছে দীঘির পাড়ে। আর, জীয়নলতা খেয়ে নবযৌবন নিয়ে চলে গেছে সেই সাপ।
ক্লান্ত, পরাজিত, পরিশ্রান্ত গিলগামেশ উরুক ফেরেন। এক উরুকবাসীকে তিনি জিজ্ঞেস করেন এনকিদুর কথা। ‘কে সে?’ জবাব দেয় উরুকবাসী। গিলগামেশ বোঝেন, যে মারা গেছে, সে হারিয়ে গেছে ইতিহাসের বাঁকে। তাকে কেউ কেউ মনে রাখে না।
গিলগামেশ মহাকাব্য আবিষ্কারের গল্প
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই বিভিন্ন লেখকদের কলমে একটি প্রাচীন সভ্যতার পতনের কথা উঠে এসেছে। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য।
শোনা যায়, সুবিশাল সেই সাম্রাজ্যের শেষ রাজা সার্দানাপলাস বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও অনেক অনেক দাসী পরিবেষ্টিত অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, সার্দানাপলাস না, সর্বশেষ সেই রাজার নাম আশুরবানিপাল। ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্যমতে, স্বয়ং স্রষ্টার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে গেছে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য। কিংবদন্তী আর গুজব ঘুরে ফেরে। আগ্রহী অভিযাত্রী থেকে শুরু করে শখের প্রত্নতাত্ত্বিক, সবাই খুঁজে ফেরে সেই সভ্যতা। ঠিক যেন উইলবার স্মিথের লেখা গল্প!
কিন্তু ১৯ শতকের মধ্যভাগে উত্তর ইরাকের মসুল শহরের কাছাকাছি আবিষ্কৃত হয় হারিয়ে যাওয়া এক শহরের ধ্বংসাবশেষ। এই শহরের নাম নিনেভেহ (Nineveh)। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। কিংবদন্তী পরিণত হয় সত্যে!
১৮৪৯ সাল। স্থান: মসুলের নিকটবর্তী এলাকা (প্রাচীন নিনেভেহ শহর)। ব্রিটিশ মিউজিয়াম গত চার বছর ধরে এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করছে। প্রজেক্টের দায়িত্বে আছেন প্রত্নতাত্ত্বিক অস্টিন হেনরি লায়ার্ড (Austen Henry Layard)। কাজকর্ম ভালই আগাচ্ছে, বলা চলে। কিন্তু চার বছর পরে এসে লায়ার্ড এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করলেন। আবিষ্কার করে বসলেন রাজা আশুরবানিপালের হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন গ্রন্থাগার।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্যানুযায়ী, এই আবিষ্কারের ফলে ৩০,০০০ ট্যাবলেট (পাথরখণ্ড) উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এসব পাথরখণ্ডের ১২টি ট্যাবলেট মিলে লেখা হয়েছে গিলগামেশ মহাকাব্য। যার ১১তম খণ্ডে লেখা আছে মহাপ্লাবন (Great Flood)-এর কথা। ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মমতে যা নূহ (আঃ) এর সময় হয়েছিল। এই মহাপ্লাবনের সবচেয়ে প্রাচীন বর্ণনাসূত্র ছিল বাইবেলের বুক অব জেনেসিস। নতুন এই ট্যাবলেট এখন সবচেয়ে পুরাতন বর্ণনাসূত্রের জায়গা দখল করে নিল।
কিংবদন্তী বনাম বাস্তবে গিলগামেশ
গিলগামেশকে (রোমান উচ্চারণে বিলগামেশ) ঐতিহাসিকরা উরুকের ‘আধা-কিংবদন্তী’ ও ‘আধা-বাস্তব’ রাজা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমরা একটু পরে দেখব। কিন্তু, শুধু গিলগামেশ মহাকাব্য থেকেই এই উত্তরের ব্যাপারে বেশ খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়।
মহাকাব্য মতে, গিলগামেশের বাবা ছিলেন মানুষ, কিন্তু মা দেবী। স্বাভাবিকভাবেই, তার মা যে দেবী- এটি ঐতিহাসিক ও যৌক্তিকভাবে সম্ভব না। আবার, দৈত্য হুম্বাবাকে হত্যা কিংবা এনকিদুর মৃত্যুর পরে পৃথিবীর শেষ মাথায় গিয়ে জীয়নলতার সন্ধান, উর্শানাবির পরামর্শে নৌকায় করে মৃত্যুসায়র পেরিয়ে উৎনাপিশতিমের দেখা পাওয়া। এসব কিছুর কোনোটারই ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। মহাপ্লাবনের কথা অবশ্য ধর্মগ্রন্থগুলোতে এসেছে। কিন্তু তাতে জীয়নলতা, মৃত্যুসায়র বা উৎনাপিশতিম কারো উল্লেখ নেই। স্বাভাবিক যুক্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এদেরকে তাই বাস্তব বলে মনে হয় না। এখান থেকে গিলগামেশের ‘কিংবদন্তী’ অংশটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, গিলগামেশ নামের কেউ কি আদৌ বাস্তবে ছিলেন?
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ছিলেন। ২৯০০-২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে তিনি সুমেরীয় শহর উরুকে রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে করা হয়। প্রাচীন প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্টেফানি ডেলি মনে করেন, সুনির্দিষ্ট কোনো সময়কাল বলা না গেলেও, ২৮০০ থেকে ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে তিনি রাজত্ব করেছিলেন।
১৯৫৫ সালে টুমাল ইন্সক্রিপশন আবিষ্কৃত হয়। এই ইন্সক্রিপশনের ভাষ্যমতে, গিলগামেশ উরুকের চারপাশে একটি দেয়াল তুলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গিলগামেশ মহাকাব্যে এই দেয়াল নির্মাণ ও এ সময় প্রজাদের প্রতি তার অত্যাচারের (অতিরিক্ত কাজ করানো, চাপ দেয়া ইত্যাদি) কথা এসেছে!
গিলগামেশের সমসাময়িক সময়কার কিশ-এর রাজা এন্মেবারাগেসিও (Enmebaragesi) গিলগামেশকে উরুকরাজ বলেছেন। এই কিশ হলো সুমেরের এক পার্বত্য রাজ্য। আবার, পাথরে খোদাই করা সুমেরিয়ান রাজাদের তালিকায়ও (Sumerian King List) পাওয়া যায় গিলগামেশের নাম। এই তালিকা বলে, গিলগামেশের রাজত্বকাল ছিল ১২৬ বছর। কিংবদন্তী অনুযায়ী, মৃত্যুর পর তার দেহ ইউফ্রেতিস নদীর তলদেশে কবরস্থ করা হয়।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)