সুদীপ ঘোষাল
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন ব্রিটিশ ভারতে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুরের লালমাটির কোলে বড় হয়েছেন লেখক,ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর। লাভপুরের যাদবলাল স্কুলে সকল ছাত্রদের একত্রিত করে অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য মিছিল বের করে সকলকে অবাক করে দেন তিনি। বাড়িতে বাবা, মা তাকে কয়েকদিন ঘর থেকে বেরোতে দেন নি কারণ চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় আবার তিনি আন্দোলনে যোগ দেন । তখন ১৯১৬ সাল। কলকাতায় শুরু করেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।
তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালিকলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি,পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশ পায়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু। বড় সংসার। এদিকে মাসে তখন বাঁধা রোজগার চল্লিশ টাকারও কম। ফলে সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছে। এর মধ্যেই কবি সমর সেনের ঠাকুরদাদা দীনেশ সেনের মাধ্যমে এক প্রস্তাব এল মুম্বই গিয়ে কেরিয়ার শুরু করার। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই অফার। বোম্বাইবাসী হিমাংশু রায় ডাক পাঠিয়েছেন। তাঁর একজন বাঙালি গল্পকার প্রয়োজন। শুরুতেই মাইনে ৩৫০টাকা। প্রতিবছর ১০০ টাকা করে বাড়বে। অভাবের সংসারে এত টাকা! রাজি হয়ে যাওয়ারই তো কথা। কিন্তু গেলেন না সাহিত্যসাধক তারাশঙ্কর। বললেন– আমি যাব না ঠিক করেছি। আমার মন চাইছে না। মনে হচ্ছে সব হারিয়ে যাবে।
মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নিজে জমিদারবংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এই নীরব পরিবর্তন তাঁর রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন।
অসুস্থতা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষ করতে পারেননি। কলেজের এই বছরগুলিতে, তিনি একটি উগ্র জঙ্গি যুব গোষ্ঠীর সাথেও যুক্ত ছিলেন এবং তাকে গ্রেফতার করে তার গ্রামে আটক করা হয়েছিল।
বিপ্লবকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করার জন্য ১৯৩০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল , কিন্তু পরে মুক্তি পান।মায়ের কথা মাথায় নিয়ে, এরপর তিনি সাহিত্যে নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩২ সালে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম দেখা করেন। একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঝুরি ।
১৯৪০ সালে কলকাতার বাগবাজারে একটি বাড়ি ভাড়া নেন এবং তার পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। ১৯৪১ সালে তিনি বরানগরে চলে আসেন। ১৯৪২ সালে, তিনি বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং বাংলায় ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সমিতির সভাপতি হন। ১৯৪৪ সালে, তিনি সেখানে বসবাসরত অনাবাসী বাঙালিদের দ্বারা আয়োজিত কানপুর বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ সালে, তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন; বোম্বেতে রজত জয়ন্তী প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভা থেকে শরৎ মেমোরিয়াল মেডেল লাভ করেন । ১৯৪৭ সালে তারাশঙ্কর লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা। ১৯৪৮ সালে, তিনি কলকাতার টালা পার্কে নিজের বাড়িতে চলে আসেন।
আপামর বাঙালির মরমী লেখক শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর অমর থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।