তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায় : এক
ইদানীং আমার কী যে হয়েছে আমি নিজেই জানিনা।
আমার কোনকিছুতেই মন বসে না। ভালো লাগে না। কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কোন কাজে উৎসাহ খুঁজে পাই না।
ভুক্তভুগী না হলে আমার এই সংকট বুঝতে পারবে না কেউ। কোন কাজ ভাল না লাগলে বসে থাকতে পারি। বসে বসেই যদি জীবন কেটে যায় তো ক্ষতি কী? আসলে এখানেই যত গন্ডগোল। খানিকটা সময় কিছু না করে বসে থাকলেই মনে হতে থাকে, কিছুই তো করা হচ্ছে না, অথচ দিন কেটে যাচ্ছে। তখন আবার কিছু না করে বেকার বসে থাকার জন্য হা-হুতাশ করতে থাকি। এই হয়েছে আমার অবস্থা। কিছু করতে ভাল লাগে না, আবার কিছু না করলেও ভাল লাগে না।
এইভাবেই চলছিল দিনগুলি, এইরকম বিপদের মধ্যে। বিপদ বলে বিপদ! আসল বিপদের কথা তো বলাই হয়নি। শুনলে সবাই বুঝবে কী যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছে আমার। কিভাবে বলব বুঝতেও পারছি না। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ আছে। এই ভয়েই এতদিন মুখ খুলিনি। দেখছিলাম, সবকিছু যদি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি, বরং যত দিন যাচ্ছে সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে। মুশকিলটা তো এখানেই, কোনকিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। সমস্যা বেড়ে যাচ্চ্ছে নাকি একই আছে বুঝতেও গণ্ডগোল। তবে কমছে না নিঃসন্দেহে। সারাদিন মনে হয় ঘাড়ে একটা বোঝা চেপে আছে। সমস্যার বোঝা। এই বোঝাটা কিছুক্ষণের জন্য নামিয়ে রাখতে পারলে স্বস্তি পেতাম।অ্যাটলাসের ঘাড়ে গোটা পৃথিবী ! বোঝাটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। কার ঘাড়ে চাপাব ? সেই লোকটাকে পাই কোথায় ?
এইরকম এক মনোবাঞ্ছা থেকে নিজেকে জানাবার এই প্রয়াস। যদি কোথাও একজন এমন লোক পাওয়া যায় যার কাঁধে আমার সব সমস্যার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যেত ! পাব কি ? ঝামেলা পাকিয়ে ফেললাম গোড়াতেই। অভিসন্ধিটা জানিয়ে দিলাম। এবার সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। হয়তো কেউ আর পড়তেই চাইবে না কী বলছি। কিজানি বাবা, শুনতে গেলে যদি কোন ফ্যাসাদে পড়তে হয় ! বলেই তো ফেলেছি যে আমার ঘাড়ে যে সমস্যার বোঝা তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্তি পেতে চাই। আসলে ওটা কথার কথা। যার বোঝা তারই, অন্যের হয় না। বড়জোর আমি বলতে পারি, আমার চুলটা পাকা, গায়ের রঙটা কালো। এই নিয়ে যদি কারো কাছে দুঃখ করি, আর সেই লোকটার গায়ের রঙ ফর্সা চুলের রঙ কালো হলে তা কি উল্টে যাবে ? সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারে, তাতে আমার চুল কালো আর গায়ের রঙ ফর্সা হয়ে যাবে না। তাই বলছি, আমার সমস্যা একান্ত আমারই। তা আমি অন্যকে দিয়ে দেব কোন্ কৌশলে ?
তাছাড়া সারা পৃথিবীর লোকেরা কম চালাক নয়। আমি আমার ঘাড়ের বোঝা লোককে ডেকে কায়দা করে দিয়ে দেব আর লোকেরা তা কিছু না বুঝেই ভালমানুষের মত নিয়ে নেবে এমনটা হয় নাকি ? আজ পর্যন্ত যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি প্রত্যেককে মনে হয়েছে আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। পৃথিবীর কোন মানুষেরই আমি আজ অব্দি গোটাটা বুঝে উঠতে পারিনি। গোটা তো দূরের কথা, খানিকটাও কি বুঝতে পেরেছি ? এই পৃথিবীতে মানুষরাই আমার কাছে বেশি রহস্যজনক। আমি একজন লোকেরও চরিত্র বুঝতে পারি না।যাকে যেমন ভাবি পরে দেখি সে ঠিক তার উল্টো। মানুষকে যত দেখি তত আমি অবাক হই। মানুষের কাজকর্মের ধারাই বিচিত্র। তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন কিছুর হদিশ পাই নি জগতে। সাধে কি আর নিজেকেই নিজে সে বলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি !
মানুষের চিন্তাভাবনার রকমসকমও বিস্ময়কর। প্রত্যেকেই মনে করে সে অন্যের চেয়ে বেশি জানে। বেশি জানুক বা কম জানুক, কাউকে ছোট করে বোকা বানানো যায় না। সারাজীবনই দেখেছি। অন্যের কথা জানিনা, আমি নিজে চিরকাল কাউকে বোকা বানাতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেছি। অহরহ এমন ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ দিতে চাইছি না, তালিকাটা খুব লম্বা হয়ে যাবে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হয়েছে যে পৃথিবীতে আমিই একমাত্র বোকা।
এসব কথা কেন বলছি ? আসলে সবাইকে বোঝাতে চাইছি যে আমার লেখা পড়লে ভয়ের কোন কারণ নেই। যারা আমার লেখা পড়বে আমি কোনদিক থেকেই তাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নই। আমার মত এমন একজন উৎকৃষ্ট বোকা লোক লিখে এমন ফাঁদ পাতব যে কেউ বুঝতে না পেরে ফেঁসে যাবে এমন ভাবনা অবান্তর। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্য নেই আমার। যা বলব সব সাদাসিধে। কোন লুকোন মতলব নেই।
হ্যাঁ, নিজের সমস্যাগুলির কথা দশজনকে বলতে চাই। এই কারণে যে বলে যদি কিছুটা হালকা হওয়া যায়। তার মানে এই নয় যে আমি চাই অন্যেরাও আমার মত সমস্যায় পড়ুক। আমি কী ঝামেলায় পড়েছি তারই বিবরণ দিতে যাচ্ছি। কেউ ধৈর্য ধরে পড়লেই বর্তে যাব। সান্ত্বনা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তো কথাই নেই। আর আন্তরিকভাবে বলছি, আমি চাইনা অন্য কেউ আমার মত বিপদে পড়ুক। এই লেখা তৈরি করার এটাও একটা উদ্দেশ্য। যাতে আমার সমস্যাগুলির কথা জেনে সবাই সাবধান হতে পারে।
বিপদ কার না হয় ? মানুষের বিপদের অন্ত নেই। সব বিপদের চরিত্র কি জানে সবাই ? আমি অন্তত জানি না। ইদানীং নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ বেয়াক্কেলে সব বিপদের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারছি বিপদ কত রকমের হয়। আবার মনে এই প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে, আমার বিপদগুলির সঙ্গে অন্যদের বিপদের মিল আছে কিনা। অন্যরা কী কী বিপদে পড়ে ? আগে এসব নিয়ে ভাবিনি কখনও। তাই নিজের বিপদগুলি এত বিচিত্র মনে হচ্ছে। আসলে এই লেখাতে নিজের বিপদগুলির কথা বলে আমি জানতে চাই অন্য কেউ কখনো এসব বিপদের মোকাবিলা করেছে কিনা।
ওপর-ওপর দেখে তো কিছুই বোঝা যায় না। কে যে কিভাবে আছে বা কী করছে। কেউ ঢাক পিটিয়ে বলতেও যায় না নিজের সব গোপন কথা। হ্যাঁ, ঢাক পেটায় অনেকেই নিজেকে জানাতে, তবে সেই ঢাক পেটানো সত্যিসত্যি যে যা তার উল্টোটাই প্রকাশ করে। চোর ঢাক পিটিয়ে জানায়, সে সাধু। সত্যিকারের সাধুরা ঢাক পেটায় কিনা জানা নেই। তবে আমি যতবার ঢাক পিটিয়ে কোন লোককে নিজের কথা ঘোষণা করতে শুনেছি ততবার খোঁজ নিয়ে দেখেছি, লোকটা আসলে যা ঢাক পিটিয়ে বলে মোটেই সে সেটা জানাতে চায় না।
ওই যে বললাম, দেখে বোঝা মুশকিল কে কী বা কী করছে। রোজ রাস্তায় নামলে হাজার হাজার লোক দেখা যায়। এই লোকরা সবাই যেমন দেখছি তেমন কি ? প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গোপন চেহারা আছে যেটা বাইরে প্রকাশ পায় না। দেখে যাকে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না সে-ই হয়তো কোন এক সময় মাছটি ভেজে রেখেছে। এই যে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে রোজ কর্মব্যস্ত সময়ে আমার দেখা হয় তাদের প্রত্যেকেরই একটা অন্য চেহারা আছে। একটা কেন, একাধিকও হতে পারে। রহস্য ঘিরে রেখেছে প্রত্যেকটি মানুষকে। কেউ আমরা টের পাই না। এই দুনিয়ায় এটাও সম্ভব, এই যে হাজার হাজার মানুষের দেখা পাচ্ছি রোজ, অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলছি আবার নানা কাজেকর্মে জড়িয়ে পড়ছি তারা সবাই হয়তো মানুষ নয়। মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আসল মানুষদের চোখে ধুলো দিয়ে।
রিক্তর স্বভাব হল লোকের পিছু নেওয়া। না জানিয়ে। পথচলতি যে কোন লোককে সে বেছে নেয় আর গোপনে অনুসরণ করে। দেখে সারাদিন সেই লোকটা কী করে, কোথায় যায়, কোথায় থাকে। তার কাছেই আমার এই কথাটা শোনা। সে আমাকে একদিন বলেছিল,
‘তুই যে মানুষগুলোকে রোজ দেখছিস তারা সবাই কিন্তু মানুষ নয়।’
আমি ভারী অবাক হয়ে চমকে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম,
‘মানুষ নয় তো কী ?’
‘কী সেটা তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। এটুকুই জেনে রাখ্ যে হাজার মানুষের ভিড়ে অনেকেই আছে যাদের দেখলে মনে হবে মানুষ, কিন্তু আসলে তারা অন্যকিছু। মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না।’
রিক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আমি প্রশ্ন করেছিলাম,
‘তারা কি ভিনগ্রহী ?’
‘না, ঠিক ভীনগ্রহীও নয়। এই পৃথিবীই তাদের বাসস্থান। হলেও তারা ঠিক মানুষ নয়। সবার চোখের সামনে মানুষ সেজে থাকে। দেখে বোঝে সাধ্যি কার !’
কাকপক্ষিতেও টের পাবে না এই শর্তে রিক্ত একদিন রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখিয়ে জানাল,
‘ওর কিছু রহস্য আছে। ও ছাড়া কেউ জানে না।’
মেয়েটির নাম স্বাদিতা সেন। বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে। দেখতে-শুনতে খারাপ নয়। একটা ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে চাকরি করে। এসব কথা রিক্তর কাছেই শুনলাম। তারপর আমাকে নিয়ে একদিন বিকেলের দিকে সে মেয়েটির অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। অফিস ছুটির পর মেয়েটি ব্যস্ত রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রিক্ত আমার কৌতূহলটা জাগিয়ে রাখতে বলল,
‘দ্যাখ্ না কী হয়।’
মেয়েটি অনলাইনে একটি ক্যাব ভাড়া করল। রিক্ত হাতের কাছে পেয়ে আমাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। মেয়েটিকে অনুসরণ করে ঘন্টাখানেক পর আমরা একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে এলাম। মেয়েটি, অর্থাৎ স্বাদিতা ক্যাবের ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে চলে গেল। সে এই কমপ্লেক্সের কোন এক বাড়ির কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। রিক্ত আমাকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। শহরে ইতিমধ্যে সন্ধে নেমে গেছে। এলাকাটা মোটামুটি নিরিবিলি হলেও লোক চলাচল মন্দ ছিল না। বাইক-রিকশা যাচ্ছিল একটু পর পর। আমরা অপেক্ষা করেই গেলাম। বিরক্তি ধরে গেল আমার একসময়। রিক্ত নির্বিকার। আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘কোন রহস্য জানতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। এত ছটফট করিস বলেই তোরা কিছু দেখিস না।’
সন্ধে পেরিয়ে রাত তখন আটটা। দু’ঘন্টার ওপর অপেক্ষা করা হয়ে গেছে ততক্ষণে। মনে মনে রিক্তর মুণ্ডুপাত করছি আর ভাবছি, রহস্য চুলোয় যাক। আর ঠিক তখনই দেখলাম, স্বাদিতা নামের মেয়েটি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। আবার সে একটি ক্যাব ভাড়া করে তাতে চড়ে বসল। রিক্তও তৈরি ছিল। সে-ও একটা ক্যাব ডেকে নিয়ে এল। আমরা স্বাদিতাকে আবার অনুসরণ করতে লাগলাম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর শহরের প্রান্তে বাইপাসের ধারে জল থৈ-থৈ বিশাল ভেরিগুলির সামনে এলাম। স্বাদিতা তার ক্যাব ছেড়ে দিল। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, গাড়িঘোড়া অনেক চলাচল করলেও পায়ে-হাঁটা লোকজন নেই-ই প্রায়। আলো থাকলেও একটা অন্ধকারাচ্ছন্নতা চেপে বসে আছে চারপাশে। রাট ন’টা বেজে গেছে। স্বাদিতা ভেরির জলের খানিকটা দূরে একটা বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসল। চুপচাপ বসেই রইল।আলো কম থাকায় তাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কাছাকাছি আর কোন লোকের চিহ্ন নেই। আমরা একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে সব দেখছিলাম। সময় কেটে যাচ্ছিল। আমার ধৈর্যের বাঁধ আবার ভাঙ্গতে লাগল। ভেরির জলের কাছাকাছি বেঞ্চিতে স্বাদিতা বসে আছে তো বসেই আছে। কী তার মতলব বোঝা যাচ্ছিল না। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেও নাহয় কিছু বোঝা যেত। এভাবে অনন্তকাল অপেক্ষা করে যাওয়ার কোন মানে আছে ? রাস্তায় পুলিশের পেট্রল ভ্যান টহল দিচ্ছিল। তাদের নজরে পড়লে কী যে হবে ! কিন্তু রিক্ত আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে যেতে বলল।
রাট তখন প্রায় এগারোটা। স্বাদিতা বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ভেরির জলের কাছাকাছি। তারপর সে ঝাঁপ দিল জলে। রাস্তা জুড়ে প্রচুর আলো, তবুও এলাকাটার সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়নি। ভেরির জলকে আলোকিত করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু যতটুকু আলো ছিল তাতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়া স্বাদিতাকে দেখা যাচ্ছিল, অস্পষ্টতা থাকলেও। আমার চোখের সামনে মিনিটখানেকের মধ্যেই সে একটা প্রকাণ্ড মাছে পরিণত হয়ে গেল আর মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেল অনেক দূরে, জলের অনেক গভীরে।
তারপর আমাদের বাড়ি ফিরে আসা উচিত ছিল। কিন্তু রিক্ত আমাকে সারারাত ওখানেই বসিয়ে রাখল। খুব ভোরে, রাতের অন্ধকার পুরো কাটেনি তখনও, দেখলাম একটা বিশাল মাছ জলের গভীর থেকে পারের কাছে এগিয়ে আসছে। ওখানেই সে ঘোরাফেরা করতে লাগল ঘন্টাখানেক সময় ধরে। অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হতে লাগল, আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল। ওই বিরাট মাছটা এবার জল থেকে এক লাফ মেরে ডাঙায় উঠে এল। এক মিনিটের মধ্যেই মাছটা আবার স্বাদিতা হয়ে গেল, ঠিক কাল রাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাকে যেমন দেখেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনলাইনে আবার একটা ক্যাব ভাড়া করে নিজের হাউজিং কমপ্লেক্সে ফিরে গেল। বেলা দশটার সময় তাকে দেখলাম অফিসের দিকে রওনা দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে কারোও সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে।
তারপর আমি রিক্তর চ্যালা হয়ে গেলাম। বলতে গেলে তাই বলতে হয়। অন্তত কিছুদিনের জন্য তো অবশ্যই। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব মানুষের সন্ধান পেলাম। তারা সবাই মানুষ হলেও ঠিক মানুষ নয়। তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু রহস্য আছে। রাস্তার ভিড় থেকে একজন লোক বেছে নিয়ে তাকে অনুসরণ করে যাওয়া। কারো পিছনে দিনের পর দিন লেগে থাকতে হত। কাউকে আবার কিছুক্ষণ নজরে রাখলেই তার গোপন রহস্যটা বোঝা যেত।
কতরকম বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে লোকজনের। আগে এসব সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। মানুষকে দেখলে ভাবি আমরা সে মানুষই। সে যে অন্যকিছু হতে পারে ভাবি কি কেউ ? রিক্ত আমার সামনে একটা অজানা জগতের দরজা খুলে দিল। আমি জানতে পারলাম, মানুষরা সব মানুষ নয়। তারা অন্যকিছু হলেও হতে পারে।
গদাধর পাকড়াশির কথাই ধরা যাক। দুই ছেলেমেয়ের বাবা এই ভদ্রলোক সকালে বাজার করে খেয়েদেয়ে অফিসে যান। সারাদিন মন দিয়ে অফিসের কাজকর্ম করেন, সহকর্মীদের সঙ্গে সময় পেলে আড্ডা মারেন, মিটিং-মিছিলেও যান দরকার হলে। রোজ সন্ধেবেলা নিয়ম মেনে বাড়ি ফেরেন। তাঁর কী গোপন রহস্য থাকতে পারে ? একমাত্র রিক্ত জানত সেটা। দিন তিনেক তাঁর পিছনে আমাকে নিয়ে লেগে রইল ব্যাপারটা দেখাবার জন্য। একদিন অফিস ছুটির পর গদাধরবাবু বাড়িতে যাওয়ার বাস না ধরে ময়দানের দিকে হাঁটা দিলেন। আমরাও লুকিয়ে তাঁর পিছু নিলাম। খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে তিনি এমন একটা জায়গায় গেলেন যেখানে বেশ কিছু গাছপালা, ঝোপঝাড় রয়েছে। পারতে কেউ আসে না এখানে, আবার এই সময়ে, বিকেল ফুরিয়ে যখন সন্ধে আসতে চলেছে। এই নির্জন এলাকাতে এসে গদাধরবাবু ঘাসের ওপর বাবু হয়ে বসে পড়লেন। তারপর নাক দিয়ে সশব্দে শ্বাস গ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁর শরীরটা ক্রমশ ফুলে উঠছিল। ফুলতে ফুলতে ভদ্রলোক একটা গোল বস্তুতে পরিণত হয়ে গেলেন। তাঁকে আর আলাদা করে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছিল না। তখনও তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন আর কেবলই ফুলছিলেন। তারপর একসময় ফটাস করে ফেটে গেলেন। ফেটে যাওয়ায় শরীরের মধ্যে থেকে একটা খোলা ছাতার মত বস্তু তীব্রবেগে সাঁ-সাঁ করে উঠে গেল আকাশের দিকে। অনেকটা ওপরে ওঠার পর বস্তুটা হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল। তখন দেখলাম, ছাতাটার বাঁট ধরে ঝুলছে লেজওয়ালা একটা প্রাণি। ওটা যে কী প্রাণি বুঝতে পারলাম না।
কতটা সময় ছাতাটা আকাশে ভাসমান ছিল ? আধঘন্টা ? হলেও হতে পারে। তারপর সেটা নিচে নেমে আসতে লাগল। সঙ্গে ওই উদ্ভট প্রানিটাও ছিল। সেটা যে কী চেনা গেল না। একসময় ছাতা নেমে এল মাটিতে ঘাসের ওপর। ঠিক সেখানটায় যেখানে গদাধরবাবু বসেছিলেন। খাড়া দাঁড়িয়ে রইল মিনিটখানেক। অদ্ভুত প্রাণিটা ছাতার বাঁট বুকে আগলে জড়িয়ে রেখেছিল। ছাতা তারপর গুটিয়ে যেতে লাগল এবং গুটিয়ে গেল ওই প্রাণিটাকে নিজের ভিতরে রেখে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার গদাধরবাবুর আবির্ভাব। স্বমূর্তিতে নয়, বিকট ফোলা চেহারায়। এবার তিনি নাক দিয়ে ক্রমাগত শ্বাস ছাড়তে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আবার সেই অবিকল আগের মত গদাধরবাবু ফিরে এলেন। চটপট উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলেন বাসরাস্তার দিকে। তারপর রোজদিনের মত বাড়ি ফেরার বাস ধরলেন।
আমি রিক্তকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এই মানুষগুলি কি সত্যি মানুষ ?’
সে আমার প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘সত্যি মানুষ বলতে তুই কী বুঝিস ?’
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। ভেবেচিন্তে বললাম,
সত্যি মানুষ বলতে বুঝি যারা সবসময় মানুষই থেকে যাবে। কখনও কোন অবস্থাতে স্বাদিতা বা গদাধর পাকড়াশির মত অন্য কিছু হয়ে যাবে না।’
‘তুই তাহলে কিছুই বুঝিস নি। গোড়াতেই গণ্ডগোল। তোর মত সবারই এই একই অবস্থা। সবাই তোর মতোই ভাবে। তোর মতোই দেখে।’
আমি রিক্তর দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম।
অধ্যায় : দুই
আমার কী বিপদ বলতে যাচ্ছিলাম। বিপদ একটি নয়, একাধিক। বিপদগুলির কথা বলতে হবেই। কিন্তু মুশকিলটা অন্য। রিক্তর সঙ্গে ঘুরে যেসব মানুষকে দেখছি মানুষ নয় আমাকে কি তাদের মত মনে হচ্ছে না ? আমার বিপদগুলির জন্য ? সত্যি যারা মানুষ তাদের কি এমন আজব বিপদ হয় ? এখন আমার মনে ক্রমাগত এই সন্দেহ জোরদার হচ্ছে, আমিও সত্যি মানুষ কিনা। আমার মধ্যে যেসব বিপদ ঘটছে, যেসব সমস্যার শিকার হয়ে চলেছি আমি তাতে তো নিজেকে আর সত্যি মানুষ বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি মানুষ তাহলে কে ?
রিক্তকে গিয়ে ধরলাম আমি।
‘তুই তো আমাকে আচ্ছা ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছিস ! সব লোককে দেখলেই মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক। কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। এমনকি, নিজেকেও মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’
রিক্তকে চিন্তিত দেখাল। একটু সময় নিয়ে ভেবে সে বলল,
‘এক কাজ করি চল্। আমাদের খোঁজার দৃষ্টিকোণটা উল্টে দিই।’
‘কী রকম ?’
‘এতদিন কী দেখলাম ? হাজার হাজার মানুষের ভিড় থেকে খুঁজে বার করছিলাম কারা ঠিক মানুষ নয়। এবার বরং খুঁজে দেখি এই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কারা ঠিক ঠিক মানুষ।’
‘তাতে কী হেরফের হবে ?’
একটু উষ্ণ ছিল আমার গলার স্বর। রিক্ত বোঝাবার চেষ্টা করল।
‘এতে সান্ত্বনার জায়গা থাকবে। এখন তুই প্রথমেই সবাইকে মানুষ ভেবে এগোচ্ছিস। পরে মানুষ নয় দেখে হতাশ হয়ে যাচ্ছিস। আর উল্টোভাবে চললে তুই প্রথমেই ভেবে নিবি যে এই হাজার হাজার মানুষের কেউ ঠিক মানুষ নয়। তারপর দেখতে হবে তার মধ্যেও কেউ ঠিক মানুষ কিনা। যদি দু’-একজনও ঠিক ঠিক মানুষ পেয়ে যাস তো তোর সব দুঃখ কেটে যাবে। মনে হবে পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর এবং এখানে বেঁচে থাকা যায়।’
কথাটা আমার পছন্দ হল। কে মানুষ নয় খোঁজার চেয়ে কে মানুষ সেটা খোঁজা অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। সেই কাজটা কিভাবে শুরু করা যেতে পারে ?
‘এতদিন আমি লোক বাছাই করতাম। সেই লোকগুলিকে আমি জানতাম ঠিক মানুষ নয়। তোকে তাই দেখাতাম। এবার তুই লোক বাছাই করে নে। এমন লোক যাদের আমি চিনি না। তারপর খোঁজ নিয়ে দেখব তারা আসলে কী।’
কোন্ লোক বাছাই করব ? লোকে লোকারণ্য এই শহর থেকে লোক বেছে নিতে গিয়ে দেখলাম, কাজটা মোটেই সহজ নয়। ওপরে দেখে তো সবাইকে মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু এই ক’দিন রিক্তর সঙ্গে থেকে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষ দেখলেই মনে হয়, এটা একটা ছদ্মবেশ। আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য। লোক বাছতে গিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পরে গেলাম। কয়েকদিন কয়েকজন লোককে যথাসম্ভব দেখে গেলাম। কোন অস্বাভাবিক আচরণ নজরে এলোনা কারোরই। মনে হল, এদের সবাই ঠিক ঠিক মানুষ। এদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিলে হয়ে যায়। বাছাই করেই সন্দেহ হল, রিক্তর মত দেখার ক্ষমতা নেই আমার। তাই, যাকে বাছাই করেছি সে ঠিক তো ? প্রথমে ঠিক মনে হলেও এখন কেমন সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে লোকটার দু’টো শিং আছে, কখনো গজায় কখনো লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ লোকটা ঠিক মানুষ নয়। সবার ক্ষেত্রেই এইরকম মনে হতে লাগল আমার। আজ একে বাছি তো কাল বাদ দিই। এই করে করে কাউকে আর বাছাই করা হয়ে ওঠেই না।
আসলে আমার মধ্যে একটা ভয় ধরে গিয়েছিল। যাকে বাছাই করছি সে যদি ঠিক মানুষ না হয় ? রিক্তর কল্যাণে এই ভয়। তার সঙ্গে এই ক’দিন ঘুরে ঘুরে যাদের দেখেছি তারা সবাই কোন না কোনভাবে অন্যরকম। ওপরে তাদের দেখে কে বলবে তারা ঠিক মানুষ নয় ? কেউ চব্বিশঘন্টা লেগে থাকলেও বলতে পারবে না। একেবারে অতি আপনজনের পক্ষেও কারো গোপন রহস্য জানা প্রায় অসম্ভব। আমি বাজি রেখে বলতে পারি যে গদাধর পাকড়াশির স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়েরা কেউ জানেই না ভদ্রলোকের গোপন ব্যাপারটা। কিন্তু রিক্ত জানে, আর তার কল্যাণে জেনেছি আমি। আসলে এইসব গোপন বিষয় জানতে হলে দরকার বিশেষ চোখ, বিশেষ অনুভুতি। সেটা সবার থাকে না।
ইন্দ্রায়ুধ মুখুজ্জেকে শেষপর্যন্ত আমি বেছে নিলাম। আমার পাড়াতেই থাকেন। অনেকদিন ধরে লোকটাকে আমি দেখে আসছি। মৌখিক আলাপও আছে তাঁর সঙ্গে। তেমন কিছু দহরম-মহরম ভাব না থাকলেও কোনদিন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। বেশ সুপুরুষ, বয়স চল্লিশের কোঠায়। ইঞ্জিনীয়ার। রোজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে কাজে বেরোন। সঙ্গে স্ত্রী দ্রোহিনীকে নিয়ে যান। ভদ্রমহিলা সুন্দরী এবং কোন একটা অফিসে চাকরি করেন। তাঁদের কোন ছেলেমেয়ে নেই। পাড়াতে রয়েছে সুন্দর দোতলা বাড়ি। ছুটির দিন ছাড়া রোজ সকালে দু’জনে একই সঙ্গে বেরিয়ে যান, রাতে ফেরেনও একসঙ্গে। বাড়িতে এছাড়া আর কেউ থাকে না।
দিন কয়েক রিক্ত আর আমি বাইরে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পিছনে লেগে রইলাম। তেমন কিছুই নজরে এল না। নিয়ম করে অফিসে যাওয়া, অফিস সংক্রান্ত কাজেই অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি, এক-দু’দিন কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁতে খাওয়া-দাওয়া—- এর বাইরে আর কিছু নেই। রাতে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে গাড়ি একতলার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে যান। আবার পরদিন সকালে একসঙ্গে কাজে বেরোন। তাহলে কি এঁদের কোন রহস্য নেই ? এঁরাই কি ঠিক ঠিক মানুষ ? রিক্ত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে যে কী বোঝে কেজানে ! আমাকে বলল,
‘বাড়ির বাইরে এঁদের কোন রহস্য নেই। এঁদের সব রহস্য রাত্তিরে, বাড়ির ভিতর।’
‘তুই কি ভাবছিস এঁরাও ঠিক মানুষ নয় ?’
আমার প্রশ্ন শুনে রিক্ত দায়সারা ভঙ্গিতে জানাল,
‘মানুষের আসল রূপ কখন প্রকাশ পাবে কেউ জানে না। অন্যের কথা বাদ দে, সে নিজেও অনেক সময় জানে না সে আসলে কে।’
বড়োই গোলমেলে ব্যাপার। বুঝতে চেষ্টা করলে পাগল হয়ে যাব। তার চেয়ে ভাল রিক্ত যা করে তার সঙ্গে তাই করে যাওয়া। আমরা এবার ইন্দ্রায়ুধ ও তাঁর স্ত্রী দ্রোহিনী বাড়ি ফেরার পর সারা রাত কিভাবে কাটান, কোন রহস্যজনক কাজে লিপ্ত হন কিনা সেইদিকে মনোযোগ দিলাম। বড়জোর দু’দিন পরই ঘটনাটা ঘটল। রাত তখন একটা হবে। অনেক আগেই তাঁরা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুমিয়েও গিয়েছিলেন অবশ্যই। হঠাৎই ইন্দ্রায়ুধ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরে হালকা নীল আলো জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ভদ্রলোক বাথরুমে গেলেন। আলো জ্বালালেন। বাথরুমের মধ্যে রয়েছে একটা জলভর্তি বাথটাব। ইন্দ্রায়ুধ সেই জলে সারা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দ্রোহিনী বাথটাবের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে একটা বোতল। ছিপি খুলে সেই বোতল থেকে হলদে রঙের কিছু একটা তরল পদার্থ জলে ঢেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। গিয়ে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর ওদিকে বাথরুমে কী কাণ্ড ঘটছিল ? ইন্দ্রায়ুধের শরীর একটু একটু করে জলের মধ্যে গলে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল তাঁর শরীরটা যেন চিনির ডেলা। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সমস্তটা শরীর জলে গুলে মিশে গেল। ইন্দ্রায়ুধের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রইল না। বাথটাবের জল যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল। জলের রঙ বা পরিমাণের কোন পরিবর্তন ঘটল না।
ভোরবেলা দ্রোহিনী আবার বাথরুমে এলেন। প্রথমেই বাথটাবের ছিপি খুলে দিলেন। গলগল করে সব জল বেরিয়ে গেল। পরে রইল সাদামতন কী একটা পদার্থ। অন্য একটা বোতল থেকে দ্রোহিনী তাতে সবুজ রঙের তরল ঢেলে দিলেন খানিকটা। সেই থকথকে সাদা পদার্থটা ফুট ফুট করে ফুটতে লাগল। খানিকটা সময়ের মধ্যেই বাথটাবে আবার ইন্দ্রায়ুধ ফিরে এলেন। অবিকল আগের চেহারায়।
পরদিন রাতে একই কাণ্ড ঘটতে দেখলাম দ্রোহিনীর ক্ষেত্রে। আমরা তারপর আবিষ্কার করলাম যে ইন্দ্রায়ুধ আর দ্রোহিনী সপ্তাহে অন্তত একদিন রাতের বেলায় চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য জলের সঙ্গে মিশে যান। এবং এভাবেই তাঁরা বেঁচে থাকেন।
আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হল রাধামাধব বস্ত্রালয়ের মালিক জনার্দন সাহা। ভদ্রলোক ঘোর সংসারী, পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী। কল্পনা-টল্পনা তাঁর ধাতে নেই। চা ভেবে চা-ই খান, মুড়িকে মুড়িই বলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। এমন কাঠখোট্টা লোক, আবেগ বলে কোন বস্তুর সঙ্গে যাঁর কোন পরিচয় নেই তাঁর ক্ষেত্রে কী আর রহস্য থাকতে পারে ? রিক্ত আমার কথা মন দিয়ে শুনল এবং বলল,
‘একটা কথা তুই বারবার গুলিয়ে ফেলছিস। ওপর দেখে মানুষ চেনা যায় না। মানুষের আসল রূপ একটা অন্য ব্যাপার। সব ধারণা গোলমাল করে দেয়।’
আমি উত্তর দিলাম না, প্রতিবাদ জানাবার কোন কারণ ছিল না বলে। এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে আমার কোন ধারণা দাঁড়াতেই পারছে না। রিক্ত যা সন্দেহ করছে মিলে যাচ্ছে যেমন করেই হোক।
জনার্দনবাবুর তিন ছেলেমেয়ে। বিশাল তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী ছাড়াও বাবা আছেন তাঁর। কাজের লোকও আছে একজন। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। স্ত্রী ভদ্রমহিলার দশাসই চেহারা, সবসময় সেজেগুজে থাকেন। আর ব্যবহারও বিশেষ মধুর নয়। সবার সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলেন। যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী।
বাড়ির একতলায় গোডাউন। সেখানে কর্মচারীদের আনাগোনা। দোকান বন্ধ করে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে একতলার একটা ঘরে বসে জনার্দনবাবু ঘন্টাখানেক কর্মচারীদের সঙ্গে কাটান। হিসেবে-নিকেশ করেন। যাই হোক না কেন, রাত বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত কাজকর্ম সেরে বাড়ি অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই মিলে। এটাই নিত্যদিনের নিয়ম। কোন ব্যতিক্রম হয় না।
বাড়ি তো অন্ধকার হয়ে যায়, তারপর কী হয় ? কী আর হবে, সবাই মিলে অবশ্যই ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। সবাই তাই ভাববে। রিক্তর ভাবনা অন্যরকম। তার ধারণা, বাড়ি অন্ধকার হওয়ার পরই কিছু ঘটে। কী ঘটে সেটাই রহস্য। সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।
তিনতলায় একটা বড় হলঘর আছে। দোতলার সব আলো নিভিয়ে জনার্দন সেই ঘরে উঠে এলেন। সঙ্গে তাঁর তিন ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং বাবা। একতলার আলো আগেই নেভানো ছিল। সারা বাড়িতে তখন কেবল তিনতলার ঘরেই আলো জ্বলছে। ঘরের দুই প্রান্তের দুই দেয়ালে একটা করে মোটা হুক পোঁতা। শক্তপোক্ত ও লম্বা একটা দড়ির একপ্রান্ত জনার্দন একদিকের দেয়ালে হুকের সঙ্গে বাঁধলেন। দড়ির অন্যপ্রান্ত বাঁধলেন অন্যদিকের দেয়ালটার হুকে। দু’প্রান্তে হুকের সঙ্গে বাঁধা দড়ি টানটান হয়ে রইল। জনার্দন এবার তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন। বাচ্চা ছেলেটা দু’হাতে দড়ি আঁকড়ে ঝুলে পড়ল। তাঁর বড়ছেলে আর মেয়ে ওপরদিকে লাফ মেরে মেরে দড়িটা ধরে নিয়ে ঝুলতে লাগল। স্ত্রী দু’হাত তুলেও একটুর জন্য দড়ির নাগাল পাচ্ছিলেন না। জনার্দন কোমর ধরে একটু তুলতেই ভদ্রমহিলা দড়িটা দু’হাত দিয়ে ধরে ফেললেন। তাঁর বাবা পায়ে ডিঙি মেরে দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। সবশেষে জনার্দন। তিনি প্রথমে ঘরের আলো নেভালেন। চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতে প্রথমে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ সয়ে যাওয়ার পর জনার্দন সতর্ক পায়ে তাঁর বাবার পাশে এসে দু’হাত তুলে একটু চেষ্টাতেই দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। অন্ধকার হলঘরে সবাই এভাবে দড়ি ধরে ঝুলতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর জনার্দনের গলা শোনা গেল। অস্ফুট গলায় তিনি বলছিলেন,
‘হিটিঙ্গা ফিচিফিচি নাটিঙ্গা। নাটিঙ্গা হিচিহিচি ফিটিঙ্গা।’
তারপর দেখা গেল আজব কাণ্ড। জনার্দনের বউ হয়ে গেলেন একটা শাড়ি, ছেলে দু’জন দু’টো শার্ট, মেয়েটা ফ্রক, বাবা ধুতি আর জনার্দন নিজে একটা লুঙ্গি। সারারাত দড়িতে মেলে দেওয়া অবস্থায় ধুতি, শার্ট, লুঙ্গি, ফ্রক আর শাড়ি হয়ে ঝুলতে লাগল জনার্দন সাহার গোটা পরিবার। বাড়ির কাজের লোকটার যে কী হল বা সে কোথায় কিভাবে থাকল তা অবশ্য বোঝা গেল না।
একসময় রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে এল। পাখিটাখি ডাকতে লাগল। তিনতলার হলঘরে ঘষা কাচের জানলা দিয়ে আলোর আভাষ পাওয়া গেল। বোঝা যাচ্ছিল ভোর হয়ে আসছে। ঘরের ভিতর থেকে অন্ধকার কেটে যেতেই দড়িতে ঝুলন্ত লুঙ্গি হয়ে গেল জনার্দন, ধুতি তাঁর বাবা, শাড়ি আবার স্ত্রী এবং শার্ট ও ফ্রক ছেলেমেয়েরা। দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে নেমে এল সবাই মেঝের ওপর। হুক থেকে খুলে দড়িটা জনার্দন ঘরের কোণায় গুটিয়ে রাখলেন।
এরপর আর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার ভরসা পাচ্ছিলাম না। রিক্ত আমার অবস্থা বুঝে বলল,
‘আর একটু দেখতে পারিস।’
‘আর দেখে কী হবে ? আমার তো মনে হচ্ছে কেউই ঠিক মানুষ নয়।’
হতাশ গলায় বললাম আমি। রিক্ত আশা দিয়ে জানাল,
‘না রে, আছে। কেউ না কেউ ঠিক মানুষ হতে বাধ্য। তাদের খোঁজ পাওয়াটাই শক্ত কাজ। তবুও তারা আছে। তারা না থাকলে মানুষের চেহারা বরাবরের জন্য অন্যরকম হয়ে থাকত। কোন মানুষকেই তুই মানুষের চেহারায় দেখতে পেতিস না। সে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যেত।’
রিক্তর কাছে উৎসাহ পেয়ে ভাবলাম, আরও একটু দেখাই যাক। আবার আরেকজন কাউকে বেছে নিতে হবে। পছন্দ করার দায়িত্বটা আমার ওপরই থাকল। খুব একটা ভাবনা-চিন্তা করতে গেলাম না। হাতের কাছে পেয়ে গেলাম মৌনাক্ষিকে। রিক্তকে বললাম তার কথা।
মৌনাক্ষি গুহ। একাই ভাড়া থাকে একটা বাড়ির একতলাতে। এই বাড়িতে থাকছে সে তার জন্ম থেকে। বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন তার বাবা। তিনি চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন অন্তত সাত-আট বছর হবে। বাড়িটা ছেড়ে সে অন্য কোথাও যায়নি। বাড়িওয়ালা মাসিমা-মেশোমশাইও তাকে স্নেহ করেন। নিজে মৌনাক্ষি একটা স্কুলে পড়ায়।
তার তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুলে সহকর্মীদের সঙ্গেও খুব যে ভাব-ভালোবাসা এমন নয়। কারো স্বভাব এরকমই, খুব একটা মিশুকে হতে পারে না। মৌনাক্ষি তাই একা হয়ে আছে। নিজের একাকিত্ব দূর করতে সে অনেকগুলি বেড়াল পোষে। ঘটা করে আবার নাম রেখেছে প্রত্যেকের। কেউ কুচি, কেউ ঘোলা, কেউ হামি, কেউ ঝোলা—- এমনধারা নাম সবার। স্কুল না থাকলে সারাদিন কাটে তার বেড়ালগুলির সঙ্গে। তাদের জন্য সে রান্না করে, খাওয়ায়-দাওয়ায়। গল্পগুজব করেও সময় কাটায়। পাড়ার সবাই মৌনাক্ষিকে চেনে তার বেড়ালগুলির জন্য।
রিক্ত আর আমি তার অলক্ষে তার পিছনে লেগে রইলাম। অবশ্য লেগে থাকার আর কী আছে ? স্কুলে ছাড়া সে কোথাও যায় না। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে সে বাড়িতেই থাকে সবসময়। প্রথমদিন তার সঙ্গে গেলাম, আবার বাড়ি পর্যন্ত ফিরে এলাম। দ্বিতীয়দিন আবার সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছে আমরা তার পিছু নিলাম। যেতে যেতে রিক্ত আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
‘গতকাল তুই মেয়েটিকে ভাল করে দেখেছিলিস ?’
‘হ্যাঁ।’
একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলাম। রিক্ত পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘আজকেও ভাল করে দেখছিস ?’
‘দেখছি তো। হয়েছেটা কী ?’
আসলে তুই ওকে ঠিকমত কালও দেখিস নি, আজও দেখছিস না।’
রিক্ত গম্ভীর গলায় তার অভিমত জানাল। আমি উত্তর দিতে গিয়ে একটু রেগেই গেলাম,
‘মানে ? কী বলতে চাইছিস ?’
‘ভাল করে দেখলে তুই বুঝতে পারতিস, কালকের মৌনাক্ষি আর আজকের মৌনাক্ষি এক নয়।’
ব্যাপারটা আমার কেমন গোলমাল পাকিয়ে গেল। হতভম্ব গলায় প্রশ্ন তুললাম,
‘তুই কী করে বুঝলি ?’
‘দেখে। এমনি দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হবে একজন মৌনাক্ষিকেই দেখছিস। কিন্তু একজন নয় মোটেও। সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে। এইযে অদল-বদল, আমার বিশ্বাসটা ঘরেই হয় এবং রাত্তিরে।’
বাড়ি ফেরার পর সেদিন রাতে আমরা তার ওপর নজর রাখলাম। বেড়ালদের নিয়ে তার ব্যস্ততা চলল রাত ন’টা পর্যন্ত। রান্নাবান্না, গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া। নিজেও খেয়ে নিল সে। বেড়ালদের সঙ্গে নিয়ে টিভিও দেখল কিছুক্ষণ। রাত দশটা নাগাদ ঘুমোবার আয়োজন করল। বেড়ালদের শোওয়ার জন্য খাট আর বিছানারও ব্যবস্থা আছে। সবাইকে তাদের বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর কুচি নামের বেড়ালটাকে তুলে নিল তাদের মধ্যে থেকে। কুচিকে নিয়ে সে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। দেখা গেল, সে জড়িয়ে ধরে আছে কুচিকে এবং কুচিও তার সামনের দু’টো পা দিয়ে তাকে ধরে রাখল। তারপর দেখা গেল একটা রূপান্তর প্রক্রিয়া। মৌনাক্ষি আস্তে আস্তে কুচি হয়ে গেল আর কুচি পাল্টে গেল মৌনাক্ষির চেহারায়। এই কাণ্ডের পর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে বাড়িতে থেকে গেল আর তার চেহারা নিয়ে কুচি চলে গেল স্কুলে। বিকেলে বাড়ি ফেরার পর মৌনাক্ষিরূপী কুচি অন্য বেড়ালদের নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল, যেমন দেখেছিলাম আগের রাতে। রাত দশটার পর মৌনাক্ষি, অর্থাৎ কুচি অন্য বেড়ালদের তাদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘোলাকে নিয়ে এল নিজের সঙ্গে। তারপর আবার সেই রূপান্তর প্রক্রিয়া। ঘোলা পেয়ে গেল মৌনাক্ষির শরীর আর কুচি হয়ে গেল ঘোলা। পরদিন মৌনাক্ষিরূপী ঘোলাই গেল স্কুলে পড়াতে।
আমার কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। রিক্তর কাছে জানতে চাইলাম,
‘রোজ রাতেই তো পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। একেকটা বেড়াল পেয়ে যাচ্ছে মৌনাক্ষির শরীর। কোন্ বেড়ালটা ছিল আসল মৌনাক্ষি, যেখান থেকে এই পরিবর্তনের সূচনা ?’
রিক্ত কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে জানাল,
‘আসল মৌনাক্ষি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার বেড়ালদের মধ্যেই। তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
অধ্যায় : তিন
এবার আমার সত্যি সন্দেহ হচ্ছে, আমিও ঠিক মানুষ কিনা। হয়তো নিজের অগোচরেই আমি অন্যকিছু।
আমার মধ্যে যেসব উদ্ভট ব্যাপার ঘটে চলেছে এগুলিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এসব তো মানুষের লক্ষ্মণ নয়। যদি আমি সত্যিই মানুষ না হই তো কী করা উচিত ? এমন কোন ব্যবস্থা আছে কি যার আশ্রয় নিলে মানুষ নয় এমন কেউ মানুষ হয়ে যেতে পারে ?
ধরা যাক, আমি সত্যিই মানুষ নই। মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে দু’টো প্রশ্ন আছে। আমার এই গোপন রহস্যটা আমি নিজেই কেন জানি না ? যদি আমি মানুষ না হই তো আসলে কী ? এই দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশি গোলমাল পাকিয়ে দিল। মানুষ না হলে কী হতে পারি ? জন্তু-জানোয়ার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-প্রেত অথবা অপদেবতা এমনও বলতে পারি না নিজেকে। ভিনগ্রহীও হব না অবশ্যই, কারণ নিজেই জানি পৃথিবীতেই আমার বসবাস। কোনজন্মে অন্য কোন গ্রহে-টোহে ছিলাম বলে জানিনা। তাহলে আমি কী ?
কলম ধরেছিলাম নিজের সমস্যাগুলি বলব বলে। সমস্যা অথবা বিপদ। এখন দেখছি নতুন আরেক বিপদ জুটল কপালে। নিজেকেই নিজে চিনতে পারছি না। নিজের কাছেই নিজের পরিচয়টা অস্পষ্ট। তাহলে এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তারাও কি আমার মতোই বিপদগ্রস্ত ? তারা কি তাদের অন্যরকম অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ? নাকি তারাও তাদের আসল পরিচয় হাতড়ে বেড়াচ্ছে ?
আজকাল আমি আর কোন মানুষকেই মানুষ বলে ভাবতে পারি না। কাউকে দেখলেই মনে হয় সে আসলে অন্যকিছু, মানুষ সেজে আছে। অথবা কেউ হয়তো এখন মানুষ, কিন্তু যেকোন সময় অন্যকিছু হয়ে যাবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে কারো সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি না। মনে হতে থাকে, যার সঙ্গে কথা বলছি সে মানুষ তো ! মানুষ হোক বা না হোক, আমার ক্ষতিবৃদ্ধির কোন ব্যাপার নেই। বোঝাতে চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু ভিতরে কী যে একটা কাঁটা খচ খচ করতেই থাকে, তাকে ভুলতে পারি না।
এমনিতেও যে লোকজনের সঙ্গে আমার মেলামেশা বা যাদের দেখছি রাস্তায় নামলে অথবা যাদের কথা শুনিটুনি তারা সবাই মানুষ হলেও স্বভাবে বা আচরণে হামেশাই অন্যরকম হয়ে যায়। কোন মানুষের চেহারা বা চালচলন দেখে তাকে প্রায়ই অচেনা মনে হয়। কারো সম্পর্কে আমরা বলেও থাকি যে অমুক ব্যক্তি কেমন পাল্টে গেছে। চেনা লোককে প্রায়ই বিশেষ কারণে অচেনা মনে হতে থাকে। সেসব তো আছেই। আমি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, এই যে কোন পরিচিত ব্যক্তির কারণে-অকারণে চেহারা-চরিত্রের অপরিচিত প্রকাশ এটাওতো কম বিস্ময়কর নয়। অথবা করোও চারিত্রিক স্খলন, যাকে যা ভাবতে পারি না তার তা হয়ে যাওয়া, যাকে যেমন ভাবি তার তেমন না হওয়া, এসব বিষয়ওতো প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করছে যে প্রত্যেকেরই অন্যরকম প্রকাশ রয়েছে। তাহলে আমি ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন এত ভাবছি ?
সকালবেলাতেই বাড়ির সামনে রাস্তায় চেঁচামেচি। যদুপতি বাজারের ব্যাগ হাতে নেমেছে রিকশা থেকে। রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তার ঝগড়া। চালক বলছে, ভাড়া এগারো টাকা। যদুপতি দশ টাকার বেশি দেবে না কিছুতেই। একটাকার জন্য তুলকালাম কাণ্ড। প্রায়ই হয় এমন। যদুপতি রিকশায় চাপবে আর ভাড়া নিয়ে সব রিকশাচালকের সঙ্গেই ঝামেলা পাকাবে। চালক যা ভাড়া বলবে সবসময় যদুপতি তার চেয়ে একটাকা কম দিতে চাইবে। ওই একটাকা নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে ঝামেলা হবেই হবে। এটা চেনা দৃশ্য। এই যদুপতিরই আবার অন্যরকম একটা চেনা চেহারা আছে। রোজ অফিসে যাওয়ার সময় স্টেশনের পাশে কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে যুক্তকরে প্রণাম করবে। তারপর পকেট থেকে একটাকা বার করে প্রণামী বাক্সে ফেলে দেবে। দু’টোই চেনা দৃশ্য, তবুও চেনা যায় না।
বাজারে হরিপদ মুরগির মাংস বিক্রি করে। পোল্ট্রি মুরগির দোকান। খাঁচায় থাকে মুরগিগুলো। বটি নিয়ে নিজেই বসে হরিপদ। খদ্দের এসে দাঁড়ায় আর সে কচাৎ-কচাৎ করে মুরগির গলা কাটে। গলাকাটা মুরগিগুলির ছটফট করতে থাকা শরীর পা চাপা দিয়ে সে মাংস কাটতে থাকে। সকাল-বিকেল দু’বেলাই সে দোকান খোলে। ভাবলেশহীন মুখে মুরগির গলা কেটেই যায়। রাতে ঘুমোবার আগে বসে বসে হিসেবে-নিকেশ করে। সারাদিনের বেচাবিক্রির হিসেব। সে নাহয় হল। কিন্তু হিসেব শেষ করেও কেন সে ঘুমোতে যায় না ? অন্য একটা খাতা নিয়ে কী আবার লিখতে বসে ? অন্য কোন হিসেব ? এই অন্য হিসেবের কথা একমাত্র হরিপদই জানে। সে জানায় না কাউকে। সংকোচে অথবা ভয়ে। কারণ, ঘুমোবার আগে সে কবিতা লেখে। হিসেব মেলে না।
চন্দ্রিকার ছিল পুতুল খেলার শখ। ছোটবেলায়। শখ না বলে নেশা বলাই উচিত। পুতুল ছিল দু’-চারটে। তাদের সে রোজ সাজাত-গোজাত, খাওয়াত, স্নান করাত, ঘুম পাড়াত। তাদের সঙ্গে কথা বলত, খেলা করত। এই নিয়ে মায়ের কাছে রোজ বকুনি খেত বেচারা। পড়াশুনা পড়ে থাকত, মা কিছু কাজ করতে বললে ফাঁকি দিত, এমনকি স্কুলেও যেতে চাইত না। ওই এক পুতুল খেলার নেশায়। তার মা তাকে আর পুতুল কিনে দিত না। দোকানে রঙ-বেরঙের কত কত পুতুল ! সে কান্নাকাটি করত, বায়না ধরত। মা শুনত না। বাবাও ছিল কড়া ধাতের লোক। তার কাছে আবদার করার সাহস পেত না। চন্দ্রিকা ভাবত, বড় হয়ে সে দোকানের সব পুতুল কিনে নেবে। সারাদিন কেবল পুতুল খেলবে। সেই চন্দ্রিকা এখন বড় হয়েছে। তার মেয়ের নাম ইত্রিশা। সে এখন স্কুলে পড়ে। সকাল আটটায় স্কুলে যায়, ফেরে বিকেল পাঁচটায়। স্কুল থেকে ফিরে ঘন্টাখানেক ঘুমোয়। ঘুম থাকে উঠে ইত্রিশা খেলতে চায়। তার শোকেস ভর্তি প্রচুর পুতুল। সবই জন্মদিনের উপহার। চন্দ্রিকা মেয়ের কথায় কান দেয় না। ঘুম থেকে তুলেই তাকে পড়াতে নিয়ে বসে। পুতুলরা শোকেসে থেকে যায়। ইত্রিশা সজল চোখে তাদের দিকে তাকায়, ভয়ে ভয়ে, মাকে লুকিয়ে। তার মা ভীষণ কড়া। সব পড়া তৈরি না হলে রেহাই নেই। পুতুল খেলবে কখন ইত্রিশা ? সে জানে না তার মা চন্দ্রিকার ছোটবেলাটা কেমন ছিল। ওইসময়ে মাকে তো সে দেখেনি। আর মেয়েকে নিজের ছোটবেলার সব গল্প শোনায় নি চন্দ্রিকা, বিশেষ করে নিজের পুতুল খেলার গল্প। পড়িয়েই সময় পায় না, গল্প শোনাবে কখন ?
কিছু কিছু লোক আছে যারা সঙ্গে থাকলে স্বচ্ছন্দে সময় কেটে যায়। রত্নেশ তেমনই একজন। সে থাকলে আর কারো কথা বলার দরকার হয় না। অনুকৃতি জানে, প্ৰায়ণ জানে, সবাই জানে যে রত্নেশ সঙ্গে থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারে জোরসে। কথা ফুরোতেই চায় না। বাড়িতে আসর জমিয়েই হোক বা পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে। সপ্তাহে না হোক মাসে অন্তত এক-দু’বার দেখা হত ওদের। অনুকৃতি আর প্ৰায়ণ যেত তার বাড়িতে, তাদের বাড়িতেও আসত সে। কত যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্প হত তাদের ! তারপর একদিন রত্নেশ কর্মসূত্রে হঠাৎ শহরের বাইরে চলে গেল। দূরে গেলে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে যায়। রত্নেশের আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। প্ৰায়ণ আর অনুকৃতি কখনো-সখনো নিজেদের মধ্যে বলে রত্নেশের কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক বছর। চারপাশে অনেক কিছু পাল্টে গেল। তারপর একদিন হঠাৎই আবার রত্নেশ ফিরে এল শহরে। সে নিজেই যোগাযোগ করল অনুকৃতি আর প্ৰায়ণের সঙ্গে। নিজের বাড়িতে যেতে নেমন্তন্ন করল তাদের। একদিন সময় করে তারা দু’জনে গেল রত্নেশের বাড়ি। ঘন্টাখানেক থাকল। এই এক ঘন্টা সময় তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে গেল। তারা দেখল, রত্নেশ কথা বলতে ভুলে গেছে। সেই যে তার আড্ডা মারার অফুরন্ত দম তা আর নেই। এখন সে কথা বলে থেমে থেমে, সাজানো-গোজানো কথা। সে আর আগের মত নিজে থেকে অনর্গল কথা বলতে পারে না। তাকে কথা বলাতে হয়। বললেও একটি-দু’টি কথা বলেই সে চুপ করে যায়, বেশি বলার কিছু খুঁজে পায় না।
অনেকদিন পর দৃকের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার পর নির্লিপ্তার মনে হল, দেখা না হলেও ভাল হত। কারণ, ‘কেমন আছো’, ‘ভাল আছি’, এইরকম মাপা মাপা ভদ্রতা বিনিময় করেই তাদের কথা ফুরিয়ে যাবে ভাবা যায়নি। দৃক তাদের বাড়িতেই মানুষ, জন্ম থেকে। দাদা থাকত দেশের বাইরে, বউদি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে। বাচ্চা বয়স থেকেই তার নিজের মায়ের চেয়েও নির্লিপ্তা তার বেশি আপন। পিসিমণিকে সে চোখে হারাত। বাইরে কোথাও গেলে নির্লিপ্তার হাত ধরে দৃক, ঘরে থাকলেও তার পিছন পিছন ঘুরঘুর। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করত সে পিসিমণির পক্ষ নিয়ে। নির্লিপ্তার বন্ধুরা তার চেয়ে দৃককেই বেশি চিনত। তাকে ফেলে নির্লিপ্তা কোথাও গেলে সে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকত পথের দিকে তাকিয়ে। বউদি তারপর চলে যায় দাদার কাছে, দৃক হোস্টেলে। নির্লিপ্তারও বিয়ে হয়ে যায়। সাংসারিক কারণে দাদার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। তবুও নির্লিপ্তা ভাবত, দৃক সেই ছোট্টবেলার দৃকই আছে, যদিও যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। তার ভুল ভাঙ্গে চাকরি পেয়েও দৃক যখন তাকে জানায় না, খবরটা সে শোনে অন্যের কাছে। আর এতদিন পর দৃককে মুখোমুখি দেখে নির্লিপ্তা বোঝে যে ফেলে আসা ওই সম্পর্কটা জাদুঘরে চলে গেছে।
ঘরে যে লোকটা চরিত্রবান সেজে থাকে আর বউকে সারাক্ষণ শোনায় সে কতটা ধন্য এমন স্ত্রী পেয়ে, সেই ব্যক্তি দেখি বাইরে গিয়ে অন্য মহিলার মন ভেজাতে বলে যাচ্ছে তার স্ত্রী তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। যে লোকটা পকেটমারকে পেটায়, চোরকে ধরে, তাকে কি দেখছি না ঘুষ খেতে ? আজকে যে লোকটা একরকম কালকে তার আরেকরকম হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো ঘটে চলছে হরদম। এসব দেখে প্রায়ই যদি মনে হয়, যাকে এখন দেখছি তাকে সত্যিই তখন দেখেছি কিনা বা যাকে দেখে আসছি সেই লোকটিকেই দেখছি কিনা তাতে কি খুব একটা দোষ দেওয়া যায় ? মানুষের পরিচিতি বড়ই গোলমেলে ব্যাপার, এতদিনে এটাই বুঝতে পারলাম যে কাউকে আমি চিনি বলে বড়াই করতে পারি না।
হরেনের মুদিখানার দোকান। দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে সোমেন বড়, মেয়ে কাকলি ছোট। দু’-আড়াই বছরের তফাৎ। হলে কী হবে, সোমেন তার বোনকে খুবই ভালবাসে। তাকে ভাল খাবার দিলে আগে সে বোনকে খাওয়ায়। পুজোয় তার নিজের জামাকাপড় হোক না হোক বোনের জন্য নতুন জামা-জুতো কেনা হল কিনা তাই নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। ছোটবেলায় সে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরত বোনকে এই পুতুল সেই পুতুল বা খেলনা কিনে দিতে। বড় হওয়ার পরও তার এই ভালবাসা অটুট ছিল। নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে সে বোনের জন্য নানা জিনিস কিনে আনত। মেয়ের বিয়েতে হরেন যা খরচ করবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলল, কারণ তার ছেলে। সোমেনের দাবি মেনে গয়নাগাটি ও অন্য উপঢৌকন বাড়াতে হল, জাঁকজমক ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও কম করা গেল না। দুর্ভাগ্যক্রমে বোনের বিয়েটা টিঁকল না। তিন বছরের মাথায় কাকলি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে হরেনের বাড়ি চলে এল। সঙ্গে তার দু’বছরের একটি ছেলে। হরেন আর কী করে, মেয়ের জন্য বাড়ির একতলায় দু’খানা ঘর নির্দিষ্ট করে দিল। মেয়ে যাতে চাকরি পায় তার জন্য এক-দু’লাখ টাকা খরচ করে কোন একটা কোর্স করাতে লাগল। ততদিনে সোমেনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। চাকরিও জুটিয়েছে একটা। একদিন গভীর রাতে সে তার বউকে বলল,
‘বাবা তো দেখছি কাকলিকে সবই দিয়ে দেবে। আমাদের জন্য কী আর থাকবে ? বাড়ির একতলাটা তো গেল, দোকানটাও না যায়! একটা বুদ্ধি করেছি শোন। তুমি এখন থেকে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসো। বাবার বয়স হয়েছে, তুমি বলবে যে তুমি তাকে সাহায্য করবে দোকানে থেকে। আমি পারব না, চাকরি আছে। কিন্তু তোমাকে গিয়ে দোকানে বসতে হবে, দোকানটার দখল রাখতে হবে।’
হরেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথা মেনে নিল। সন্ধের পর ছেলের বউ তার সঙ্গে দোকানে বসতে লাগল। সোমেন এখন নিশ্চিন্ত। দোকানটা তার দখলে থেকে যাবে এভাবেই। বোন সেটা দাবি করতে পারবে না কোনদিন। আর এভাবেই পুরোনো সোমেন এখন অন্যরকম সোমেন হয়ে গেল। ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় জীবনের সূচনালগ্ন।
কেউ অন্যরকম হয়ে যায় কোন এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, কেউ আবার যখন-তখন অন্যরকম। রিমঝিম বোঝে না দু’দিন পর পর কী হয় সিক্তার। আলাপ তাদের অনেকদিনের। সিক্তার বিয়ে হয়নি, হবে বলেও মনে হয়না। এনজিও-টেনজিও অনেককিছু করে বেড়ায় সারাদিন। কোনটাই তেমন কাজের কাজ নয়, তবে সবসময় এমন ভাব দেখায় যেন সে জগতে সবচেয়ে ব্যস্ত কেউ। এর সঙ্গে চেনা, ওর সঙ্গে চেনা, শুনলে মনে হয় উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর মধ্যে যত দেশ আছে সব দেশের লোক তাকে চেনে। এত ব্যস্ত এবং সময়ের এত অভাব হলেও সে নিজেই রিমঝিমকে যখন ফোন করে কথা ফুরোতেই চায় না। রিমঝিমের নিজের সংসার আছে, সে সত্যি ব্যস্ত হলেও সিক্তার সঙ্গে আড্ডা মারার সুযোগ পারতে ছাড়ে না। সময় করে কোন কাফেতে বা রেস্টুরেন্টে যায় দু’জনে, আবার সিক্তা তার বাড়িতেও আসে। এটা হল সিক্তা যখন চেনা চেহারায় থাকে তার কথা। হঠাৎ সে একদিন নোটিশ না দিয়ে অচেনা হয়ে যায়, রিমঝিম ফোন করলে ধরে না, পরে কলব্যাকও করে না। রহস্যজনকভাবে সে চুপ করে থাকে, কোন যোগাযোগ রাখে না রিমঝিমের সঙ্গে। এক-দু’মাস, কখনও বা তারও বেশি সময় এভাবে হারিয়ে থাকে, আবার একদিন নিজেই যোগাযোগ করে।
করুণাশিসবাবুকে সবসময় হাসিখুশিই দেখতাম। খুব আমুদে মানুষ, অচেনা লোকের সঙ্গেও ভাব জমাতে ওস্তাদ। আমরা আবার তাঁর উৎসাহের বহর দেখে মাঝেমধ্যে বিরক্তও হতাম। মেজাজ তো সবসময় সবার প্রসন্ন থাকে না, হতেই পারে কখনো কেউ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার মত অবস্থায় থাকত না। সেসব ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাঁর। সবাইকে নিয়ে মজা করেই যেতেন। এই স্বভাবের জন্য পিছনে অনেকে তাঁর সমালোচনাও করত। কেউ কেউ আবার তাঁকে এড়িয়েও চলত। সেই করুণাশিসবাবুকে কয়েক মাসের ব্যবধানে কিছুদিন আগে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক হাসতে ভুলে গেছেন। কেউ কথা বললেও তিনি কথা বলতে চান না। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে গেছেন। একজন প্রাণবন্ত লোক কিভাবে এমন নীরব হয়ে যেতে পারেন মাথায় ঢোকে না।
এভাবেই সব মানুষকে চলাফেরা করতে দেখছি সবসময়। তাদের চেনা চেহারা কখনো অচেনা হয়ে যায়, কখনো অচেনা চেহারা চেনা-চেনা ঠেকে। কেউ ঘরে একরকম, বাইরে অন্যরকম। কারো চেহারা ব্যক্তি বা স্থান বা সময়বিশেষে পাল্টে পাল্টে যায়। একেক পরিস্থিতিতে একেকরকম। লোকেরা পাল্টে যায় জানা ছিল, কিন্তু কী আকৃতি ধারণ করতে পারে জানতাম না। যতই অন্যরকম হোক না কেন, ভাবতাম মানুষ সবসময় মানুষই থাকে। রিক্ত আমাকে দেখিয়ে দিল একটা অন্য জগৎ। মানুষ কতভাবে অন্যরকম হয়ে যায় এবং কতভাবে তার সেই বিচিত্র প্রকাশ ঘটায় এসব আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। আগে আমি জানতাম যে সবাই ঠিক মানুষ, আর এখন আমি বুঝেছি যে জীবনে একজনও ঠিক মানুষ দেখিনি। ঠিক মানুষ সত্যিই কি কেউ আছে ? ক্রমশ এই সন্দেহ বদ্ধমূল হতে চলেছে। এটা আমার জন্য ভাল না খারাপ বুঝতেও সমস্যা হচ্ছে। তবে কেমন যেন হতাশা গ্রাস করেছে আমাকে। গোড়াতেই তার কথা উল্লেখও করেছি। এতকিছুর মধ্যে এটুকুই আশার কথা যে রিক্ত বলেছে, কেউ না কেউ ঠিক মানুষ সত্যিই আছে। রিক্তর কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই বলেই ভরসা পাই। সে যে আমার চেয়ে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখে তা তো প্রমাণিত সত্য।
রহস্যের অন্য আরও দিক আছে, সেটাও আমি জানতাম না। রিক্ত জানত, আর আমাকে একদিন বলল,
‘এমনও হতে পারে, তুই যাকে দেখছিস সে হয়তো অন্য কেউ, সে নয়।’
‘সে তো দেখলামই, মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে গেছে, বা বেড়াল হয়ে গেছে মৌনাক্ষি।’
রিক্ত বাধা না দিয়ে শুনল আমার কথা। তারপর ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মানুষরা সব ঠিক মানুষ নয় সেটা তো তুই দেখেছিস। এই বিষয়টা তোর আর বোঝার বাকি নেই। আমি এখন সেই প্রসঙ্গটা বলছি না। তোকে বলতে চাইছি আরেকটা নতুন বিষয়। এখানে মানুষ অন্যকিছু বা অন্যরকম হয়ে যায় না। মানুষরা মানুষই থাকে, পরিচয়টা ওলোট-পালোট হয়ে যায়। আমাকে হয়তো তুই রিক্ত বলে জানিস, কিন্তু আমি আসলে রিক্ত নই। আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে অন্য কেউ।’
আমার সব গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। চোখমুখ দেখে রিক্ত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারল। থেমে গিয়ে সময় দিল আমাকে ধাতস্থ হওয়ার জন্য। সে থামতেই আমি সপাটে প্রশ্ন করলাম,
‘তাহলে তুই রিক্ত কোথায় আছিস ?’
‘আমি হয়তো অন্য কোন পরিচয়ে আছি।’
‘যেখানে খুশি থাক্। তোকে যখন তোর চেহারায় দেখছি, তাকে তুই ভাবতে সমস্যাটা কী ? আমার জেনে কী লাভ আসল তুই কার মধ্যে ঢুকে আছিস ?’
রিক্ত চিন্তিত গলায় বলল,
‘লাভক্ষতির ব্যাপার নয়। বিষয়টা অন্য। তুই রেগে যাচ্ছিস। আমি তোকে জোর করতে চাই না। কেবল জানাচ্ছি যে মানুষের মধ্যে অনেকরকম রহস্য আছে। মানুষ যে পাল্টে অন্যকিছু হয়ে যায় তাই নয়, অন্যকিছু না হয়ে সে শুধু তার পরিচয়টা পাল্টে নিতে পারে। বিশ্বাস করবি কি করবি না সেটা তোর ব্যাপার।’
আমার উষ্ণতা কমে গিয়েছিল। বললাম,
‘বিশ্বাস করব না কী রে ! হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করছি। কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে। বুঝিয়ে দে, বা দেখিয়ে দে।তাহলে আর অস্পষ্ট থাকবে না।’
‘বুঝিয়ে দিতে পারি। মনে করতে পারিস, তুই জন্ম থেকে একজনকে জানিস ভুবনবাবু বলে। আর একজন আছে রবিনবাবু। তাকে তুই চিনতে পারিস বা না পারিস। একটা সময় পর ভুবনবাবু হয়ে গেল রবিনবাবু, আর তুই জানতেও পারলি না পরিবর্তনটা। ভুবনবাবু তারপর থেকে রবিনবাবু হয়েই বাঁচতে লাগল। কেউ ব্যাপারটা টেরই পেল না। এই পরিবর্তনের পর সবাই যাকে রবিনবাবু বলে ভাবল সে আসলে ভুবনবাবু।’
‘রবিনবাবু গেল কোথায় ?’
‘এই ব্যাপারটাই গোলমেলে। রবিনবাবু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ভুবনবাবু হয়ে যেতে পারে, আবার না-ও পারে।’
‘কিন্তু তাকে তো কোথাও যেতেই হবে, ভুবনবাবু তো তার মধ্যে ঢুকে গেছে !’
‘সে না যেতেও পারে, যেমন ছিল তেমন থেকে গেলেও ক্ষতি নেই। আবার সে দরকার হলে অন্য কেউ হয়ে যেতে পারে। সেটা যে ভুবনবাবু হতেই হবে এমন নয়।’
গোটা ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় নিলাম। রিক্ত সেই সুযোগটা দিল। নানা প্রশ্ন জাগছিল মনে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ভুবনবাবু তো রবিনবাবু হয়ে গেল। কিন্তু ভুবনবাবুর চেহারা নিয়ে কে থাকল ?’
‘বোঝাপড়া থাকলে রবিনবাবু চলে আসবে। এখানটা একটু গোলমেলে। ভুবনবাবু নিজেও থেকে যেতে পারে দু’জায়গায়। তৃতীয় অন্য কেউও আসতে পারে।’
‘এই ব্যাপারটা কি প্রত্যেকের জীবনে একবারই ঘটে ?’
‘একদমই না। কারো জীবনে বারবার, এমনকি দিনে কয়েকবারও ঘটতে পারে ঘটনাটা। নিজের মধ্যে যখনই আমার থাকতে ভালো লাগে না আমি তখন ভুবনবাবু, রবিনবাবু, মধুবাবু, হরিবাবু ইত্যাদি নানাজন হয়ে যেতে থাকি। ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় থাকতে ভাল লাগে। কার মধ্যে যাব তার কোন বাধা নেই। বিখ্যাত-অখ্যাত যে কোন লোকের মধ্যেই যেতে পারি। কেউ এভাবে ঘন ঘন অন্য লোকের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয় বা নিজেকে অন্য লোকের সঙ্গে পাল্টে নেয়। আবার কেউ হয়তো একবারই জীবনে এমন পাল্টাপাল্টি করে। যাই হোক না কেন, প্রত্যেকের জীবনে এই ঘটনা ঘটবেই। একবার বা হাজারবার। কেউ নিজেকে সম্পূর্ণ পছন্দ করে না। ভুবনবাবু হয়ে যায় রবিনবাবু বা মধুবাবু বা হরিবাবু বা যোগেনবাবু। চলতেই থাকে পাল্টাপাল্টি। কেউ সারাজীবন কেবল ভুবনবাবু হয়ে বাঁচে না।’
বুঝলাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঘটে কিভাবে ?’
‘সেটা না দেখলে বুঝবি না। সবসময় দেখে যে বোঝা যাবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই, কারণ কেউ হয়তো যদুবাবু হয়ে গেল, সারাজীবন থেকে গেল যদুবাবু হয়েই। তাকে দেখতে তোরও সারাজীবন কেটে যাবে। এসব দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন। তবে ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। সেসব দেখা যেতেই পারে। দেখলেই বুঝবি কিভাবে ঘটে।’
রিক্তকে নিয়ে শুরু করতে চলেছি এবার এক নতুন অনুসন্ধান। এবার আমরা দেখব কিভাবে মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি চোখের সামনে ঘটে চলেছে সবার অজান্তে।
অধ্যায় : চার
আমার অসুখগুলির কথা বলছিলাম। আর সেই কারণে কী কী বিপদ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
একটি-দু’টি নয়, নানারকম উদ্ভট অসুখের শিকার হয়েছি আমি। নাম জানিনা কোনটারই। লক্ষ্মণ দেখে বুঝি। একেবারে মাল্টিপল ডিজিজ সিনড্রোম। কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি ? সবগুলোর কথাই বলা উচিত। আবার ভাবি, এত এত অসুখের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে কার ভাল লাগে ? তবুও কয়েকটির কথা তো বলতেই হয়। বিশেষ করে, যেগুলি খুব বেশি ভোগাচ্ছে অহোরাত্র।
আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাচ্ছে। এই অসুখটা প্রথম দেখা গিয়েছিল আমার মধ্যে। তারপর এতদিনে এর প্রকোপ কিছুমাত্র কমেনি। বেড়েছে কিনা বলতে পারব না। অসুখটা বেশ কাবু করে রেখেছে আমাকে। যখন-তখন এর ধাক্কায় আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। অপদস্থও হতে হয় যথেষ্ট। রঙ পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটা কি ভাল ? গায়ের রঙের কথাই ধরা যাক। বাড়ি থেকে বার হওয়ার সময় দেখলাম রঙটা কালো, বাড়ি ফেরার পর দেখি লালরঙা হয়ে গেছি। ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম কি? মনে হচ্ছে, এটুকু শুনে কেউ বুঝতে পারছে না এই রঙ পাল্টে যাওয়ার মধ্যে কী বিপদ থাকতে পারে। বরং অনেকেই ভাববে, এতে তো বেশ মজাই আছে। একটা কথা বলে রাখছি, রঙ পাল্টানো মানে গায়ের রঙই হবে তা না-ও হতে পারে। তবে কেবল গায়ের রঙের কথা ভাবলেও ব্যাপারটা বিশেষ সুবিধের নয়। এই আমার রঙ হলুদ, দেখতে দেখতে রঙ পাল্টে আমি সবুজ হয়ে গেলাম। এক-আধবার এমন ঘটলে মজা পেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন ব্যাপার যদি ঘটতেই থাকে এক নাগাড়ে ? আর এই রঙ পাল্টে যাওয়া যদি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়ে যায় ? মনে করি, ব্যাপারটা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটছে না। আমি যখন-তখন স্বেচ্ছায় নিজের রঙ পাল্টে ফেলতে পারছি। যদি তাই হয় তো সেটাও কি সুখের কথা ? আমি কি আমাকে সুস্থ বলে দাবি করতে পারি ? মুশকিল হল এই যে আমার রঙ পাল্টানোটা স্বেচ্ছায় না অনিচ্ছায় ঘটছে সেটাই আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কেবল দেখছি রঙ পাল্টে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে কিভাবে যাচ্ছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। রঙ পাল্টে যাচ্ছে, এটুকুই জানি। আর এই অশান্তির কোন শেষ নেই। কী অশান্তি তা সব না বললে বোঝা যাবে না।
এটা এক ঘোরতর বিপদ, আমার জন্য। এই রঙ পাল্টে যাওয়াটা। আমাকে এভাবে রঙ পাল্টাতে দেখে সবাই অবাক হয়, আবার ভ্রূ কোঁচকায়। আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ। প্রশ্ন তো রয়েছে আমার নিজের মধ্যেও। এটা কি কোন প্রাণির স্বাভাবিক ধর্ম ? এই ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাওয়া ? যদি অন্যদেরও দেখি ঘন ঘন রঙ পাল্টায় তো আশ্বস্ত হতে পারি। তাহলে সব মানুষকে দেখে যেতে হয়। ক্রমাগত দেখলে বোঝা যাবে, রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটছে কিনা। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। যদি দেখি অন্যদের মধ্যেও রঙ পাল্টানোর অভ্যেসটা রয়েছে তাতে কি আমার বিপদ কাটবে ?
প্রথম প্রথম আমি বুঝতেই পারিনি যে আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টিয়ে যাচ্ছে। নানাজনের মুখে অভিযোগটা শুনতাম, বিশ্বাস করতাম না। তারপর একদিন বুঝতে পারলাম যে অভিযোগটা মিথ্যে নয়। নিজের রঙ পাল্টানোর বহর দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। নিজের ওপর নিজে নজর রাখতে লাগলাম। সবাই এভাবে নিজেকে দেখে কি ? দেখুক না দেখুক আমার কিছু যায়-আসে না। আমি নিজের কথাটাই বলছি। নিজেকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখে বুঝতে পারলাম যে আমি রঙ পাল্টাই। এই কাজটাতে আমার অসম্ভব দক্ষতা। ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারলাম না। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। নিজেকে নিজে গবেষণা করে। আর এখন আমি নিশ্চিত যে এটা আমার একটা অসুখ।
আরও কিছু অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছিল আমার মধ্যে। মাথা ঘামাতে লাগলাম। এক এক করে সবগুলি অসুখের চরিত্র বোঝা গেল। এদের কেমন চেহারা সে সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার।
একটা অসুখ হল, আমি যা-তা কথা বলে ফেলছি। অধিকাংশ সময় দেখা যাচ্ছে, যা বলতে চাইছি তা বলা হল না, যা বলার কথা ভাবছি না তা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। মনে আমার কী আছে লোকেরা তা দেখে না, মুখে যেটা বলছি সেটাই ধর্তব্য হয়ে যায়। মুখ দিয়ে যদি ভাল কথা বার হয় তো ভাল, আর মন্দ কথা বার হলে হয়রানির একশেষ। মুশকিল হল এই যে একবার খারাপ কথা বলে ফেললে তা আর পাল্টানো যায় না। পঞ্চাশটা ভাল কথা বললে লোকেরা শোনে না, কিন্তু একটা মন্দ কথা বললেই সবাই ঠিক শুনে নেয়। একবার খারাপ কী বললাম সেটাই লোকে মনে রাখে, হাজারটা ভাল কথা বললেও তাকে ঢাকা যায় না। উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলার অসুখটা খুবই ভোগাচ্ছে আমাকে। মনে হয়, এর চেয়ে কথা বলতে না পারা ভাল ছিল। যেসব প্রাণি কথা বলতে পারে না তারা এদিক থেকে বেশ নিরাপদ। আমি নিজেও জানি না কেন মুখ থেকে এমন সব কথা বেরিয়ে যায় যা কাউকে চটিয়ে দেবে। অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার মত কথা বলে আমার কিছু লাভ হয় কিনা তাও বুঝি না। কেবল যে অন্যকে চটিয়ে দেওয়ার কথা বলি এমন নয়, মুখ থেকে তেমন কথাও বেরিয়ে আসে যা অস্বাভাবিক, যা কোন অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, কোন বিপর্যয় ঘটাতে পারে। না, এসব কথা বলে আমার কোন উপকার হয় না। তাহলে কেন বলি ? আমার নিজেরই তা বোধগম্য নয়। আসলে এটাই তো অসুখ।
প্রায় এমনই আরেকটা অসুখ হল, আমি যা নয় তা খেয়ে ফেলছি। খাওয়ার জিনিস নির্দিষ্ট। মানুষ স্বাদ বুঝে খায়। সেভাবেই খাদ্যাভ্যাস তৈরি হতে থাকে। কিন্তু এমন যদি হয়, কেউ হাতের কাছে যা পাচ্ছে বাছবিচার না করে খেয়ে ফেলছে ? রাক্ষসরা শুনেছি এমন করে থাকে। তাদের নামটা এজন্যই, আর ওই নাম তাকেই দেওয়া যার তেমন স্বভাব। আমাকে কি রাক্ষস বলা যেতে পারে ? আসলে যেমন আমার খাওয়ার প্রকৃতি তাতে রাক্ষস বললেও কিছু বাকি থেকে যায়। রাক্ষসের খাবারে পরিমাণগত দিকটা বিবেচ্য। আমার খাওয়াতে পরিমাণের ব্যাপারটা প্রধান নয়। এমন সব বিষয় আমার খাদ্য তালিকাতে চলে আসছে যে নিজেই দেখে চমকে যাচ্ছি। কী না খাচ্ছি আমি ? নিজের এবং অন্যের ভবিষ্যৎ, বর্তমান, সুখস্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি কোনকিছুই বাদ পড়ছে না। এমনসব জিনিস আমি অক্লেশে খেয়ে ফেলছি যাতে দেশের ও দশের বারোটা বেজে যায়। মানুষ সর্বভুক প্রাণি। সেই হিসেবে সে যা খুশি খেতে পারে। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু খাবার নয় এমন কিছু, ধরাছোঁওয়া যায় না এমন কিছু খেতে পারা যায় বলে শুনিনি। আমি তো সেই বিচারে মানুষও হতে পারছি না। রাক্ষসও নই, মানুষও নই, আমি তাহলে কোন্ আজব বস্তু ? নিজেকেই তো নিজে চিনে নিতে পারছি না।
অন্য একটা অসুখও আমাকে খুব ভোগাচ্ছে, আর তা হল আমি যেখানে-সেখানে চলে যাচ্ছি। অনেকেই এটাকে অসুখ বলবে কিনা সন্দেহ আছে, তবে আমি মনে করি, এটাও আমার একটা অসুখ। রাতে ঘুমোলাম আমার বাড়িতে, সকালে ঘুম ভাঙলে দেখলাম আছি মাধববাবুর বাড়িতে, এটা কি খুব সুখের ? যাচ্ছি দিল্লিতে, পৌঁছোবার পর দেখা গেল জায়গাটা মুম্বাই, ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের হবে না। অথবা এমন ঘটনাও ঘটতে দেখেছি যে কোথাও যেতে না চাইলেও চলে যাচ্ছি। যাওয়ার কথা হয়তো ভাবছিও না, তবুও দেখছি, যেখানে থাকার কথা সেখানে থাকছি না। উপস্থিতি নিয়ে সবসময় একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। এতে লোকের কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠছে। আমি কে, কখন কোথায় থাকব সেটা যেমন কেউ বুঝতে পারছে না তেমনি আমিও অনিশ্চয়তায় ভুগছি। নিজেকে আজব আজব সময়ে এমন সব আজব আজব জায়গায় হাজির থাকতে দেখছি যে আমি যেমন চমকে যাচ্ছি সংশ্লিষ্ট লোকেরাও বেসামাল হয়ে পড়ছে। এসব কি মানুষের কাজ ? মানুষের মত দেখতে কেউ যদি এমন অমানুষিক কাণ্ড করতে থাকে তো তাকে তার অসুখ বলাটা কি অন্যায় হবে ? আসলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না যে এসব কাজ একান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত। এই কারণে আমার বিপদ অন্যকে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না।
এই যে অসুখটার কথা বললাম, যেখানে-সেখানে চলে যাওয়ার অসুখ, এর আনুষঙ্গিক একটা উপসর্গও আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। হতেও পারে এটা সম্পূর্ণ অন্য একটা অসুখ। চুলচেরা বিচার করে বলতে পারব না, এটার সঙ্গে আগে বলা অসুখটার কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’টোর উপসর্গে মিল পাওয়া যেতেও পারে। সেসব তুলনা-টুলনার ব্যাপার পরে হবে, আগে অসুখটার কথা বলা যাক। আমি যখন-তখন অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছি। এই আমি আছি, এই আমি নেই। একদল লোকের সঙ্গে বসে হয়তো জমিয়ে গল্পগুজব করছি, হঠাৎ সবার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। ভৌতিক কাণ্ড বলেই ভাববে সবাই। তারপর ওইসব লোকেরা যদি আমাকে আবার দেখতে পায় ? পরিস্থিতিটা আমার এবং তাদের জন্য খুব একটা উল্লাসের হবে কি ? এটাকেও অনেকেই অসুখ বলে মানতে নারাজ হলেও হতে পারে, কিন্তু এর জন্য ভুগতে তো হচ্ছে আমাকেই। কেন এটা অসুখ হবে না ?
নিজের ওপর আস্থা না থাকলে যা হয়, ওপরে বলা রোগগুলি তারই উদাহরণ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না বলেই কখন কী করে ফেলব নিজেও জানিনা। এটাও একটা অসুখ, যা-তা করে ফেলছি যখন-তখন। তাই কিছু করতে গেলে ভাবনা-চিন্তা দরকার, মানুষ ভেবেচিন্তেই কাজ করে। পরিণামের কথা খেয়াল না রেখে কাজ করে কে ? কিন্তু এমন রোগ হয়েছে আমার যে দুমদাম উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলছি। তাতে হামেশাই নানারকম গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সব ঝামেলা পাকিয়ে যায় যে মনে হয় আর বাঁচার উপায় নেই। যা-তা কাজ করে ফেলার কথা বললে শেষ হওয়ার নয়। অকারণে হয়তো কাউকে মেরে বসলাম, হয়তো করোও ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলাম—- এমনই সব সৃষ্টিছাড়া কাজকর্ম। কেন করছি কোন ব্যাখ্যা নেই। কাজগুলি করে কোন আনন্দও পাই না, দুঃখ হয় এমনও নয়। করে ফেলি কোন এক অজ্ঞাত কিছুর তাড়নায়। এটা অবশ্যই একটা অসুখ, কারণ আমি আমাকে এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না এবং অস্বাভাবিক আচরণের শিকার হই।
এগুলি সব আমার ছোটখাটো খুচরো অসুখ, একটি-দু’টি ছাড়া। এদের মধ্যে জবরদস্ত অসুখ হল ঘন ঘন রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা। অন্য অসুখগুলি আমাকে ভোগায়, কিন্তু তত বড় আকারে নয়। সবচেয়ে বড় কথা যে অসুখগুলির মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্কও রয়েছে। হামেশাই দেখি, একটার সঙ্গে আরেকটা কোন না কোনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললাম বা বলে ফেললাম তো লোকেরা রেগে যায় আর তখন আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি। এতে আমার উপকারই হয়। লোকেরা আর আমার নাগাল পায় না। কিন্তু মুশকিল হল এই যে সবসময় সবকিছু আমার ইচ্ছেমত ঘটবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। অনেকসময় দেখেছি, বেকায়দায় পড়লেও আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারছি না। আবার অন্যক্ষেত্রে হয়তো এমনসময় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি যে আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও বলব, এইসমস্ত অসুখগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রবল যতটা না রঙ পাল্টানোর অসুখটা। পরে নাহয় এর কথা বিশদে বলা যাবে। তার আগে বরং এর মত বা এর চেয়েও জবরদস্ত আরেকটা অসুখের কথা বলি। বৈচিত্রে আর প্রাবল্যে এই অসুখটাও কিছু কম যায় না।
আমার ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাচ্ছে।
এই ঘন ঘন চেহারা পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটার মধ্যে যে কত রকমফের রয়েছে তা না বললে বোঝা যাবে না। প্রথমেই বলা যাক লিঙ্গভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর কথা। হয়তো আমি বাড়ি থেকে বার হলাম গোঁফদাড়িওয়ালা পুরুষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সুস্থভাবে, হাঁটতে হাঁটতেই একসময় বুঝতে পারলাম যে আমি মহিলা হয়ে গেছি। মহিলা মানে নিখাদ মহিলা। এ যে কী বিপর্যয় তা বলে বোঝাতে পারব না। পুরুষ থেকে মহিলায় রূপান্তর তো ঘটে গেল হঠাৎ, নাম-ধামের কী হবে ? তো মহিলা হয়ে গেলাম তো মহিলা হয়েই যদি থাকতাম তাহলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। আবার দেখি, মহিলা থেকে কোন একসময় পুরুষে রূপান্তর ঘটে গেছে। কখনো আবার মাঝামাঝি অবস্থাতেও থেকে যাই। লোকেরা আমাকে নিয়ে মজা করবে কী, কাণ্ড দেখে চমকে চমকে যায়। আমিও খাবি খেতে থাকি। নিজেই বুঝতে পারি না কখন ছেলে হব আর কখন মেয়ে হব, কখন বা দু’টোর মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে যাব, আর ছেলে বা মেয়ে যা-ই হই না কেন হলেও ওই অবস্থায় কতক্ষণ থেকে যাব। ছেলে থেকে মেয়ে বা মেয়ে থেকে ছেলে বা তাদের মাঝামাঝি চেহারায় আমার রূপান্তর যখন-তখন ঘটে যাচ্ছে। একেবারেই বেসামাল অবস্থা। কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। এমনও ঘটনা ঘটছে যে ঘন্টায় ঘন্টায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর হয়ে চলেছে। আমি নিজেও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি না আমি কে, ছেলে না মেয়ে নাকি তাদের মাঝামাঝি কোনও একজন। এটা যে কোন্ চরিত্রের অসুখ কেউ বলতেও পারছে না।
ঘন ঘন চেহারা পাল্টানোর এইতো গেল এক অবস্থা। এর অন্য প্রকারভেদও আছে। একটা হল বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানো। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গোলমেলে। মনে করি, আমি একজন যুবক, হঠাৎ দেখি হয়ে গেছি পাঁচ বছরের এক বাচ্চা, বা তারও চেয়ে ছোট সদ্যোজাত এক শিশু। তা এভাবে কমবয়সী হয়ে যাওয়াটা মন্দ নয়। অনেকেই ভাববে আশীর্বাদ। কিন্তু এর যে উল্টো দিকটাও আছে ? নিজেরই অজান্তে হঠাৎ আবার দেখি কখন চেহারা পাল্টে হয়ে গেছি আশি বছরের এক বৃদ্ধ। যখন-তখন এভাবেই বয়স পাল্টাতে থাকে আমার। এই আমি বৃদ্ধ তো পরক্ষণেই যুবক, যুবক থেকে আবার হয়ে গেলাম প্রৌঢ় বা বালক বা বাচ্চা, আবার হয়তো বৃদ্ধ। কখন কী হবে কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। ব্যাপারটা আমার হাতে নেই। মুশকিল হল, আসলে আমি যুবক না শিশু নাকি বৃদ্ধ তা নিজেই জানি না। আবার এই বয়সভিত্তিক চেহারা পাল্টানোর সঙ্গে জুড়ে যায় লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। শুরু করলাম হয়তো নব্বই বছরের বৃদ্ধ থেকে, ঝটাস করে হয়ে গেলাম এক যুবতী, সেখান থেকে চেহারা পাল্টে হলাম হয়তো এক কিশোর, তারপর আবার হয়ে গেলাম হয়তো এক প্রৌঢ়া মহিলা বা একটি বাচ্চা মেয়ে। এইসব পরিবর্তন যদি গোপনে ঘটত তা-ও নাহয় কথা ছিল, জনসমক্ষে ঘটে যায় বলেই হয়রানির একশেষ। সবার চোখের সামনে যদি আমি কখনো ছেলে কখনো মেয়ে, কখনো শিশু কখনো বৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকি তো ব্যাপারটা কেমন হবে অনুমান করা খুব একটা কঠিন নয়।
চেহারা পাল্টানোর এই রোগটা আমাকে এমন পেয়ে বসেছে যে কোথায় গিয়ে থামবে কেজানে ! এর দু’টো প্রকারভেদের কথা বললাম। অন্যরকম প্রকাশও আছে। একেবারে সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার। বলে কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত। আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না যদি নিজেই না শিকার হতাম। মানুষ হিসেবেই আমি কেবল চেহারা পাল্টাই না, চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণিও হয়ে যাই।
জানি সবাই বলবে, আজগুবি ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি ঘটছে। হামেশাই আমি হাতি, ঘোড়া, কুকুর, জিরাফ, সাপ, হনুমান হয়ে যাচ্ছি। আমার এই মানুষের চেহারাটা বেমালুম পাল্টে যায় যখন-তখন। মনে করি, গরু হয়ে গেলাম। দেখে তখন কেউ বুঝবে না কোনকালে আমি মানুষ ছিলাম। গরু হলাম তো আগাগোড়া গরুই হয়ে গেলাম, মানুষের ‘ম’-ও থাকবে না চেহারাতে। আচরণটাও হবে গরুর মতোই। গরুর মত ঘাস খাব, জাবর কাটব, ‘হাম্বা-হাম্বা’ ডাকব। এভাবে যেকোন প্রাণি হয়ে যেতে পারি যখন-তখন। এই হয়তো বাঘ হয়ে গেলাম, দু’-চারটে পশু শিকার করে খেলাম, তারপরই দেখা গেল গণ্ডার হয়ে গেছি। তখন আবার বাঘের আচরণ ভুলে গণ্ডারের মত কাজকর্ম শুরু করে দেব। কেন, কখন, কিভাবে মানুষের চেহারা থেকে অন্য কী হব নিজেও জানিনা। পাল্টে যেতে পারি যেকোন জন্তু-জানোয়ারের চেহারাতেই, কোন বাছ-বিচার নেই। এখানে আমার পছন্দ কাজ করে কিনা পরিষ্কার নয়। এই হয়তো মানুষ থেকে হাতি হয়ে গেলাম, পরক্ষণেই চেহারা পাল্টে ইঁদুর বা মাছ। মাছেরও আবার নানা ধরন আছে। যে কোন রকম মাছই হতে পারি—- রুই, কাতলা, কই, বোয়াল, ইলিশ ইত্যাদি। মাছ হওয়ার একটাই মুশকিল, জল চাই। তো এদিক থেকে আমার এই চেহারা পাল্টানোর রোগটা বেশ সমজদার। কোন ডাঙার প্রাণি থেকে মাছ-টাছ জলচর প্রাণি হওয়ার সময় সে বুঝে বুঝে কাজ করে। কখনও আমাকে সমস্যায় ফেলে না। মাছ বা হাঙড় যাই হোক না কেন, হওয়ার সময় হিসেব করে দেখে নেয় কাছাকাছি পুকুর, খালবিল আছে কিনা। হঠাৎ মরুভূমির মাঝখানে উট হয়ে গেল ইলিশ মাছ, এমন ঘটনা কোনদিনও ঘটেনি। তেমন ঘটনা ঘটলে কি আর এই বিবরণ লেখার সুযোগ পেতাম ? তাই বলছি, চেহারা পাল্টানোর ব্যাপারটা যতই বেয়াক্কেলে হোক না কেন, তার মধ্যে কিছু হলেও একটা কাণ্ডজ্ঞান আছে।
মানুষের চেহারা পাল্টে আমার কেবল নানারকম জীবজন্তু হয়ে যায়, এমন নয়। অন্য কিছুও হতে পারে। যেমন, মাছ বললাম এক্ষুনি। এছাড়া ব্যাঙ, কেঁচো, পোকামাকড়, কী না হতে পারি ! হয়েছিও এমন অনেক কিছু। মাছি হয়েছি, মশা হয়েছি, আরও কতসব কীটপতঙ্গ। চেহারা পাল্টানোর চক্করে আমি নাজেহাল। কী হইনি বলা শক্ত। পাখিও হয়েছি কতরকম—- কাক, শালিক, বাজ, শকুন, চড়ুই। কিসের থেকে কখন কোন্ চেহারা পাব বোঝা মুশকিল।
মানুষের চেহারা পাল্টে অন্য প্রাণি বা জীবজন্তু হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আবার লিঙ্গ বা বয়সভিত্তিক ব্যাপারটাও যুক্ত হতে পারে। হলাম হয়তো মানুষ থেকে একটা ছাগল, সেখান থেকে একটা কুমিরের ছানা, তারপরই হয়তো হয়ে গেলাম একটা ময়ূরী। আমার চেহারা পাল্টানোর এত বৈচিত্র্য আর ঘনঘটার বহর ভাবলে বা দেখলে নিজেরই মাথা ঘুরে যায়, অন্যের কথা কী আর বলব !
এভাবেই আমার চেহারা ঘন ঘন পাল্টে যাচ্ছে। এর পিছনে কী কারণ বা কোন নিয়মকানুন আছে কিনা জানিনা। রহস্যটা রহস্যই। তবে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক এবং অবশ্যই একটা রোগ। মানুষের চেহারা পাল্টে পাল্টে সাপ-ব্যাঙ অথবা ইঁদুর-বাঁদর হয়ে যাওয়া কি ভাল ? মানুষ কখনো পুরুষ কখনো মহিলা হয়ে যাবে, এটাও স্বস্তির কথা নয়। আমাকে দেখে বোঝা যাবে না আমি কখন বৃদ্ধ থাকব বা কখন বাচ্চা হব, এমন ব্যাপারও কেউ পছন্দ করবে না। এই চেহারা পাল্টে যাওয়ার অসুখটা সব শান্তি কেড়ে নিয়েছে। আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছে বিপুলায়তন এক নৈরাশ্য। ঘন ঘন রঙ পাল্টে যাওয়ার মতোই এর চরিত্র, বা তার চেয়েও বোধহয় বেশি ভয়ঙ্কর। আবার এই দু’টো রোগের মধ্যে যোগসূত্র আছে। ঘন ঘন চেহারা পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে বা আগেপরে ঘন ঘন রঙও পাল্টাতে থাকে।
মানুষ হয়ে বাঁচার আনন্দটাই আমার হারিয়ে গেছে। এতসব রোগের কারণে। মানুষ যদি মানুষই থাকে, সরল সাদাসিধে মানুষ, তার মত সুখ আর কোথায় আছে ? ঘন ঘন আমার রঙ পাল্টে যাবে এটা মোটেই ভাল কথা নয়। আমার খাদ্যাখাদ্য গরমিল হয়ে যাবে, কী করব না করব তার কোন ঠিক থাকবে না, বিচরণক্ষেত্র অনিশ্চিত হবে—- এর কোনটাই আমাকে শান্তি দিতে পারে না। আমি মানুষটা হঠাৎ অন্য কোন পোকামাকড়, জীবজন্তু হতে যাব কেন? যদি পরিস্থিতি আমাকে তেমন কিছু হতে বাধ্য করে তো তার চেয়ে বড় কোন অসুখ আর কী হতে পারে ?
অধ্যায়: পাঁচ
আমি রিক্তকে গিয়ে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
‘আচ্ছা, আমি কি মানুষ ?’
রিক্ত আমার দিকে সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকাল। জানতে চাইল,
‘এই প্রশ্ন কেন করছিস ?’
‘তোর সঙ্গে থেকে দেখেছি অনেকেই দেখতে মানুষের মত হলেও অন্যরকম কিছু ব্যাপার থাকে। আমার মধ্যেও দেখছি কিছু অস্বাভাবিক বিষয়। তাই সন্দেহ হচ্ছে আমিও মানুষ কিনা।’
‘কী বিষয় দেখলি তোর মধ্যে ?’
‘একটা নয়, অনেকগুলো বিষয়।’
‘একটাই বল্ শুনি।’
‘যেমন, আমার রঙ পাল্টে যাচ্ছে।’
‘রঙ পাল্টায় সবাই। এতে ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। কেউ বাচ্চা বয়সে ফর্সা থাকে, বড় হলে কালো হয়ে যায়। কেউ আবার মেকাপ করেও রঙ পাল্টায়।’
‘মেকাপের ব্যাপার নয়।’ আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, বাচ্চা বা বড়োর কথাও বোঝাচ্ছি না। তাতে সময়ের ফারাক থাকে। আমি বলছি অন্যরকম রঙ পাল্টানোর কথা। একটা নির্দিষ্ট বয়সে কেউ কি ঘন ঘন রঙ পাল্টায় ?’
‘পাল্টাতে পারে। নির্ভর করছে পরিবেশ আর পরিস্থিতিটা কী।’
‘কী বলছিস ? একটা লোক কালো, সে হঠাৎ সাদা বা সবুজ হয়ে যেতে পারে ?’
‘পারে।’
‘আমি কোনজন্মে দেখিনি।’
‘দেখিসনি কারণ তুই ভালমত লক্ষ রাখিসনি। ঠিকমত নজরে রাখলে দেখতে পেতিস যে হামেশাই লোকেদের রঙ পাল্টে পাল্টে যায়।’
‘একটা ফর্সা লোক। সে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই ফস করে কালো হয়ে যাবে ?’
‘কালো বা হলদে বা সবুজ বা লাল, পাল্টে যেকোন রঙের হয়ে যেতে পারে।’
রিক্ত নির্বিকার ভাবে বলল। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিজের অবিশ্বাস আর বিস্ময়টা প্রকাশও করলাম,
‘একটা লোক যখন-তখন রঙ পাল্টে পাল্টে সবুজ, হলুদ, বেগুনি, লাল হয়ে যেতে থাকে আর তুই বলছিস দেখেও সেটা আমি বুঝতে পারি না ?’
‘তুই একা কেন, কেউ বুঝতে পারে না। বা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভাণ করে। আর নয়তো দেখেও দেখে না।’
‘কেন ? এমন কেন করে ?’
‘না করে উপায় কী ? বলতে গেলে হাজার ঝামেলা। কেউ যে রঙ পাল্টে ফেলছে সেটা তো প্রমাণ করার কোন রাস্তা নেই। তাই সবাই চুপচাপ থাকে।’
আমিও চুপচাপ হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হজম করতে পারছিলাম না। আমার অসহায় অবস্থা দেখে রিক্ত বলল,
‘ব্যাপারটা না দেখলে তুই বুঝতে পারবি না। চল্, তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।’
আমরা ত্রিলোচন সমাদ্দারকে বাছাই করলাম। ত্রিলোচন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে অফিসে যাচ্ছে। সকালবেলা। রিক্ত তাকে দেখিয়ে আমাকে বলল,
‘লোকটার রঙ এখন কেমন দেখে রাখ্।’
দেখলাম। বাসে চেপে অফিসে ঢোকার আগে পর্যন্ত তাকে দেখেই গেলাম। তার রঙ যেমন ছিল তেমনই রইল। অফিসে ঢোকার পরও পাল্টালো কই ? নিত্যদিনের মত নিজের জায়গায় নিজের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করল। সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা হল কিছু। তারপর তার ডাক এল বড়সাহেবের ঘর থেকে। তড়িঘড়ি উঠে সে পা বাড়াল। বড়সাহেবের ঘরে গিয়ে সে ঢুকল, অনুমতি নিয়ে। আর তখনই আমার অবাক চোখের সামনে তার রঙ পাল্টে গেল।
বড়সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন তার আবার অন্য রঙ। একটু পর সহকর্মী মলয় এসে বসল তার পাশে। বড়সাহেবের প্রশংসা করতে লাগল দু’জনে মিলে। ত্রিলোচনের রঙ তখন অন্যরকম। তার আধঘন্টা পরে ভূদেব এল তার কাছে। তারা দু’জনে নিচু গলায় বড়সাহেবের নিন্দে করতে লাগল। ত্রিলোচনের রঙ আবার পাল্টে গেল। দ্বিতীয়ার্ধে অফিসে কাজের চাপ কম, লোকজনও আগের মত নেই। বড়সাহেব অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায় ঢিলেঢালা ভাব। ত্রিলোচনের সঙ্গে দেখা করতে এল একজন বাইরের লোক। রঙ আবার পাল্টে গেল। লোকটার কথা শুনে বোঝা গেল যে তার ফাইল আটকে আছে ত্রিলোচনের টেবিলে। সেই নিয়ে কথাবার্তা চলল খানিকটা সময়। তারপর দু’জনেরই গলার স্বর খাদে নেমে এল। নানারকম আকার-ইঙ্গিত আর ফিসফাস। বোঝা গেল, লোকটার সঙ্গে কিছু রফা হল। ফাইল ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে আর্থিক লেনদেনের। এবারও ত্রিলোচনের অন্য রঙ।
গুপ্ত সাহেবের পিছু নিলাম এরপর। গাড়ি চেপে অফিসে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তাঁর মেয়ে, যাওয়ার পথে তাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। তখন ভদ্রলোকের এক রঙ আর মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর রঙ একটু অন্যরকম। সেই রঙ পুরোপুরি পাল্টে গেল অফিসে ঢুকলেন পর। নিজের চেম্বারে এলেন। আধঘন্টা পর তাঁর সেক্রেটারি মিস হাইনি এসে হাজির। ভদ্রলোকের রঙ আবার পাল্টে গেল। একসময় মিস হাইনির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ আলাপ হতে লাগল। তখনই ফোন বেজে উঠল। শোনা গুপ্ত সাহেবের স্ত্রীর গলা। ফোন ধরেই ভদ্রলোকের রঙ আবার আরেক জাতীয়।
এভাবেই একের পর এক মানুষ দেখে গেলাম আমরা। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। সবার ক্ষেত্রেই এক কাণ্ড। বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা গেল, তারা অন্য মহিলা, বিশেষ করে বান্ধবীদের সঙ্গে যখন থাকে তখন তাদের এক রঙ। আবার ঘরে ঢুকলে নিজের স্ত্রীর সামনে তাদের রঙ আমূল পাল্টে যায়। ছেলেমেয়েদের সামনেও তাদের একেকরকম রঙ। অন্য পুরুষদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল যে ব্যক্তি বা অবস্থা বা অবস্থান অনুযায়ী সবাই রঙ পাল্টিয়ে নেয়। ঘরে থাকলে এক রঙ বাইরে গেলে অন্য রঙ। বন্ধুদের সঙ্গে তার যা রঙ তা পাল্টে যায় শত্রু বা অচেনা লোকদের সঙ্গে থাকলে। মহিলাদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, তারা একইভাবে রঙ পাল্টাতে ওস্তাদ।
বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত লোকদের দেখলাম এক এক করে। এমন একটাও ক্ষেত্র পেলাম না যেখানে থাকা লোকেদের রঙ পাল্টাবার অবকাশ নেই। রিক্ত জানাল,
‘রাজনৈতিক নেতাদের দেখলে বুঝবি রঙ পাল্টানো কাকে বলে।’
এইরকম বেশ কয়েকজনকে বাছাই করা গেল। দেখলাম সবাইকে। তাদের মধ্যে একজন বিকলরথ। যিনি দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একজন ডাকসাইটে নেতা। খুব তাঁর দাপট। তাঁকে ঘিরে চব্বিশঘন্টা লোকের ভিড়। রঙের কী বাহার তাঁর, তাকালে চোখে ধাঁধা লাগে। তবে সবসময় তাঁর রঙও এক থাকে না। যখন জনসভায় গলা ফুলিয়ে বক্তৃতা দেন তখন তাঁর এক রঙ, দলীয় কর্মীদের সঙ্গে যখন গোপন বৈঠক করেন তখন আবার রঙ পাল্টে যায়। দিনে যে কতবার তাঁকে রঙ পাল্টাতে দেখা গেল ! অন্য সব রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখলাম তাঁর মতোই চরিত্র। জনগণের মধ্যে থাকলে তাঁদের এক রঙ, অন্যসময় অন্য রঙ। সাধারণভাবে, দেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে তাঁদের রঙ পাল্টানোর ক্ষমতা দেখলে তাকে লেগে যায়।
রিক্ত আমাকে জিজ্ঞেস করল,
‘তুই কি আরও লোক দেখতে চাস ?’
‘আর দেখে কী হবে ?’
ম্লান গলা আমার। রিক্ত বলল,
‘তাহলে তুই বুঝলি যে রঙ পাল্টানো মানুষের একটা স্বাভাবিক ধর্ম।’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘তোর যে রঙ পাল্টানোর স্বভাব, সেটাকে অসুখ ভাবার কোন কারণ রইল কি ?’
‘না।’
‘তুই মানুষ কিনা এই সন্দেহও নিশ্চয় আর নেই তোর ?’
প্রশ্নটা শুনে চট করে উত্তর দিলাম না। একটু ভেবে বললাম,
‘কিন্তু আমার আরও কিছু ব্যাপার আছে। সেসব আরও অস্বাভাবিক। সেসব ধরলে নিজেকে কিছুতেই মানুষ বলে ভাবতে পারব না।’
‘যেমন ?’
‘আমার চেহারাটাও ঘন ঘন পাল্টিয়ে যায়।’
‘তাতে চিন্তা করার কী আছে ?’
‘চিন্তা করব না, বলিস কী ?’
‘যত খুশি চিন্তা করতে পারিস, কোন বাধা নেই। প্রশ্ন হল, এটাকেও তুই অসুখ বলে ভাবিস কিনা।’
‘এটা তো অবশ্যই অসুখ। চেহারা পাল্টালে আমি তো আর মানুষ থাকি না। বা মানুষ থাকলেও নিজেকে চিনতে পারি না।’
‘কেন চিনতে পারিস না ?’
‘ধর্, আমি এতটুকু একটা বাচ্চা হয়ে গেলাম……’
‘সে তো খুব ভাল ব্যাপার।’
‘একদমই ভাল নয়। আমি কিছুই খেতে পারি না, কেবল বোতলে দুধ খাই।’
‘তাতে তো অনেক হাঙ্গামা কমে যায়। বাজারহাট করতে হবে না, রান্নার ঝামেলা নেই।’
‘আমি অনেক সময় হাঁটতেও পারি না। হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে হয়।’
‘মন্দ কী ? সবাই তোকে কোলে নিয়ে বেড়াবে।’
বুঝতে পারলাম রিক্ত মজা করছে। গম্ভীরভাবে বললাম,
‘আমি কিন্তু সিরিয়াস, আর আমাকে নাজেহালও হতে হচ্ছে।’
‘তোর অত ভাবিত হওয়ার কারণ নেই। বাচ্চা হতে চায় বা হয়ে যায় এমন লোকের অভাব নেই। তারা তাতে আনন্দও পায়।’
‘এতে আবার আনন্দের কী আছে ?’
‘চল্, তোকে দেখাচ্ছি।’
আবার আমি রিক্তর সঙ্গী হলাম, অন্যরকম অভিজ্ঞতার সন্ধানে। এক সুবিশাল ও সুরক্ষিত কার্যালয়ের ভিতরে আমাদের এবারের অভিযান। এই বাড়ি এখন দেশের ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর। সভাকক্ষে দেখা গেল দলীয় নেতৃবৃন্দ এক গোলটেবিল ঘিরে বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন। সভাপতির চেয়ারে বসে একটি বাচ্চা ছেলে। তার চোখে পুরু কাচের চশমা, মাথায় টাক, মুখে গোঁফদাড়ির আভাস এবং পাকা পাকা চেহারা। এ কি কোন বামন নাকি ? রিক্ত অস্ফুট স্বরে বলল,
‘বামন নয়, বয়স্ক ব্যক্তির বাচ্চা সংস্করণ। দ্যাখ্ না, কী হয়।’
দেখলাম। সেই বাচ্চা একটি নামের তালিকা বানিয়েছে। তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধী কিছু ব্যক্তির নাম। বাচ্চাটি বলছে,
‘এদের সবাইকে জেলে ঢোকাও। তিনমাসের মধ্যে।’
সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগল তালিকার নামগুলি। বাচ্চাটি কড়া চোখে আক্রোশের গলায় একটি একটি করে নাম দেখিয়ে বলতে লাগল,
‘এই লোকগুলো সব বদমাইশ। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম না তখন এরা প্রত্যেকে আমার কিছু না কিছু হয়রানির কারণ হয়েছে। ও আমাকে একবার প্রকাশ্য জনসভায় কাতুকুতু দিয়েছিল, ওর পিছনে ইনকাম ট্যাক্সের লোক লাগাও। এই ব্যাটা দু’-দু’বার আমাকে খিমচে দিয়েছিল, একে জালিয়াতির কেসে ফাঁসাও। ওই লোকটা একবার আমাকে ল্যাং মেরেছিল, আমি সপাটে আছাড় খেয়েছিলাম। একে পুরো দেশদ্রোহিতার অপরাধে জেলে ভরে দাও। আর এই যে বদমাইশটাকে দেখছ, এ আমাকে একসময় দেখতে পেলেই কেবল ভেংচি কাটত। এর পিছনে গুপ্তপুলিশ লাগিয়ে দাও। এবার দেখ এই ব্যাটাকে, এ একবার আমাকে দানব বলেছিল আর পচা ডিম ছুঁড়েছিল। এটাকে যে কোন কেসে ফাঁসিয়ে তিন বছরের জন্য জেল খাটাও।’
বাচ্চাটি তার বলা শেষ করতেই দেখি আজব কাণ্ড, সে আর বাচ্চা রইল না। সে হয়ে গেল কক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইটে নেতা বিকলরথ। তিনি দেশের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। সবাই তাঁকে ভয় পায়। তিনি বাচ্চা হলেন কেন আর কিভাবে ? প্রশ্ন করার আগেই রিক্ত বলল,
‘আসলে বিকলরথের প্রতিশোধস্পৃহা আর আক্রোশ এক ধরণের অবুঝপনা। ঠিক বাচ্চাদের মত। ওই স্বভাবের প্রকাশ তাঁকে বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছিল।’
দশরথের বউ পালিয়েছিল। পরদিন থেকে দশরথ নিজেও বেপাত্তা। পাড়ায় ঢি-ঢি পড়ে গেল। প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষো। তার বাড়ির দরজা তালাবন্ধ। লোকের কৌতূহলের শেষ নেই। নানা খবর রটতে লাগল। দশরথ প্রচুর খোঁজাখুঁজি করে বউকে ধরে আনল। পালিয়েছিল বেপাড়ার এক চ্যাংড়া ছেলের সঙ্গে। বেশ দূরের এক শহরে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল দু’জনে। দিন কয়েক পর সন্ধান পেল দশরথ। বউকে ঘাড় ধরে নিয়ে এল। চ্যাংড়া ছেলেটা পালাল। কিন্তু পাড়ায় পালানো বউকে নিয়ে সবার চোখের সামনে ঢোকে কী করে ? বাড়ি ফিরল গভীর রাতে। সে আর তার বউ মিলে চোরের মত লুকিয়ে। লোকেরা যে কিভাবে জেনে গেল ! সবাই উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। দশরথ বউকে নিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে রইল। বন্ধু পরামর্শ দিল,
‘এমন করলে লোকেরা আরও পেয়ে বসবে। বরং বউকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যা। পারলে সবাইকে ডেকে বল্, সেই বউই পালায় যার প্রচুর ডিমান্ড। আর সেই লোক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যে চঞ্চলা হরিণীর মত পালিয়ে যাওয়া বউকে ধরে আনে।’
পরদিন দশরথ বউকে নিয়ে সদর্পে বাড়ির বাইরে এল। পাড়ার প্রত্যেকটি বারান্দায় ঘরের ভিতর থেকে সব লোক ভিড় করে দাঁড়াল তাদের দেখার জন্য। লোক কোথায়, সব বাচ্চা ! সব খোকাখুকু। দশরথ আর তার বউ চোখের আড়ালে চলে যেতেই বাচ্চারা সব চেহারা পাল্টে ধাড়ি -ধাড়ি পুরুষ-মহিলা হয়ে গেল।
তারপর আমরা নিকুঞ্জনিবাসে বেড়াতে গেলাম। নিকুঞ্জবাবু স্ত্রী মনোরমা আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন সেখানে। নিজের নামেই বাড়ির নাম রেখেছেন। তাতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হল তাঁর স্ত্রী মনোরমাকে নিয়ে। নিকুঞ্জবাবুর বয়স যদি পঞ্চাশ হয় তো তাঁর স্ত্রীর বয়স পঁয়তাল্লিশ। তাতেও কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হল, নিকুঞ্জনিবাসে গিয়ে আমরা মাঝবয়সী কোন মহিলাকে খুঁজে পেলাম না যে মনোরমা হতে পারে। নিকুঞ্জবাবুকে পেলাম, পেলাম তাঁর মেয়ে এবং ছেলেদেরও, কিন্তু মনোরমা কোথায় ? একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই বাচ্চা মেয়েটাকে আবার নিকুঞ্জবাবুর ছেলেমেয়েরা ‘মা-মা’ বলে ডাকছে। বলছে সবাই, ‘মা, খেতে দাও’ বা ‘মা, বাইরে যাচ্ছি’ ইত্যাদি। আর সেই বাচ্চা মেয়েটা ছেলেমেয়েগুলোকে, এমনকি নিকুঞ্জবাবুকে পর্যন্ত বকাবকি করছে। পরে একসময় বোঝা গেল যে এই বাচ্চা মেয়েটা আসলে নিকুঞ্জবাবুর স্ত্রী মনোরমা। রিক্ত বলল,
‘মনোরমার বদভ্যাস, সে সবাইকে নিজের বয়স কমিয়ে কমিয়ে বলবে। প্রত্যেক নতুন বছরে সে নিজের বয়স কমায়। সবাইকে তাই বলে। এই করে করে তার কী হাল হয়েছে দ্যাখ্।’
হিসেবে করে দেখা গেল, তার মেয়ে সুবর্ণার বয়স বারো। আর বিগত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বয়স কমিয়ে আসছে মনোরমা। প্রত্যেকবার অন্তত ছ’-মাস বা একবছর। এই বদভ্যাস চালিয়ে এসে সে এখন নিজের মেয়ে সুবর্ণার চেয়ে দু’-বছরের ছোট হয়ে গেছে। দশবছরের এক খুকি। রিক্ত আমাকে জানাল,
‘মেয়ে সুবর্ণাকেও মায়ের রোগে পেয়েছে। সে-ও নিজের বয়স কমিয়ে বলে। তার আসল বয়স এখন হওয়া উচিত উনিশ। অথচ কমিয়ে কমিয়ে বারো করে ফেলেছে। অবস্থা এখন এমন যে কোন বছর মনোরমার বয়স মেয়ের চেয়ে কমে যায় আবার কোন বছর মেয়ে সুবর্ণার বয়স তার মায়ের চেয়ে কম থাকে। মা আর মেয়ে এভাবে পাল্লা দিয়ে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। কে আটকায় ওদের ?’
‘এমন চলতে থাকলে তো দু’-জনেই একদিন এক-দু’দিনের বাচ্চা হয়ে যাবে। তারপর কী হবে ?’
আমি আঁতকে উঠে প্রশ্ন করলাম। রিক্ত বলল,
‘এক-দু’ ঘন্টা বা এক-দু’ মিনিটের বাচ্চাও হয়ে যেতে পারে।’
‘শেষপর্যন্ত কী হবে ? বাচ্চা হওয়ার তো একটা লিমিট আছে ?’
‘এইসমস্ত লোক, যাদের এমন বাচ্চা সাজার স্বভাব তাদের কোন লিমিট নেই। এরা মায়ের পেটেও চলে যেতে পারে। বা তারও আগের কোন অবস্থায়।’
বিপিনের কসমেটিক্সের দোকান। কুড়ি বছরের যুবক। হার, মালা, চুড়ি, দুল, লিপস্টিক, নেলপালিশ বিক্রি করে। তার দোকানে পাউডার কিনতে এল সুনীতা। সাতাশ বছরের যুবতী। এসে বলল,
‘কাকু, আমাকে একটা লজেন্স দাও।’
বিপিন অবাক, আমরাও অবাক। বিপিনকে যেমাত্র সুনীতা ‘কাকু’ বলে ডাকছে অমনি সে হয়ে যাচ্ছে পাঁচ বছরের এক বালিকা আর ‘পাউডার দাও’ বলতে পারছে না কিছুতেই, বলে ফেলছে, ‘লজেন্স দাও’ .এই নিয়ে মহা গণ্ডগোল।
ব্যাঙ্কে চাকরি করে অনুপ্রাস। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তসমর্থ যুবক। বাইরে থাকলে বা ব্যাঙ্কে গেলে তার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু বাড়িতেই তার সব গুবলেট। তার মা সবাইকে বলেন,
‘আমার অনু দুধের বাচ্চা। কিছুই করতে পারে না। সব আমাকে করে দিতে হয়।’
বাড়িতে থাকলে অনুপ্রাস সত্যিসত্যিই বাচ্চা ছেলে হয়ে যায়। তার মা তাকে খাইয়ে দেন, চান করিয়ে দেন, প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে পিঠ চাপড়ে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। সারা বাড়িতে বাচ্চা অনুপ্রাস ছোটাছুটি-দাপাদাপি করে, তার প্রায়ই কোমর থেকে প্যান্ট খুলে খুলে পড়ে যায়। বাইরে গেলেই সে আবার যুবক, বাড়িতে বাচ্চা হয়েই তার জীবন কাটে। তবুও যাই হোক না কেন, বাচ্চা সেজে থাকা লোকগুলোর দলে তাকে ফেলা যায় না। সে বাচ্চা হয়ে থাকে তার মায়ের জন্য।
কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। অনুপ্রাসের বিয়েটা হচ্ছে না। পাত্রীর অভাব নেই, তবুও। বিয়ে ঠিক হয় অনেক, মেয়ে দেখাশোনাও হয়ে চলেছে একের পর এক, কাজের কাজ আর হয়ে উঠছে না। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেলেই মা তার সঙ্গে যান, আর ওইজন্যেই যত গণ্ডগোল। মা সঙ্গে থাকলেই অনুপ্রাস বাচ্চা হয়ে যায়। তার কোমর থেকে প্যান্ট নেমে যেতে থাকে, মা টেনে টেনে তুলে দেন। তার চুল এলোমেলো হয়ে যায়, মা ব্যাগ থেকে চিরুনি বার করে আঁচরে ঠিক রাখেন। মেয়ের বাড়ির লোকরা এসব পছন্দ করে না। মাকে সঙ্গে নিয়ে অনুপ্রাস মেয়ে দেখতে গেলেই মেয়ের বাড়ির লোকরা বলে,
‘অরে এ তো বাচ্চা ! অতটুকু বাচ্চা কী বিয়ে করবে ? আগে বড় হোক।’
রিক্ত আমাকে বলল,
‘বাচ্চা সেজে থাকা আর বাচ্চা হয়ে যাওয়া লোকগুলোর মধ্যে তফাৎ থাকলেও তারা কিন্তু আসলে সবাই বয়স্ক লোক। তোর সমস্যাটার উত্তর নিশ্চয় পেয়ে গেছিস ? দুমদাম বাচ্চা হয়ে যাওয়া তোর একার রোগ নয়, এটা সব মানুষেরই একটা কমন অসুখ, বলতে পারিস, গণরোগ। সব মানুষই কমবেশি এই রোগের শিকার।’
আমি জানতে চাইলাম,
‘কিন্তু এর উল্টো ব্যাপারটা হয় যখন ? বয়সটা যে ছাই আমার বেড়েও যায় !’
রিক্ত আমাকে নিয়ে গেল আরেক জায়গায়। সেখানে দেখলাম সুবোধ তার বন্ধুদের কাছে বরফট্টাই দেখিয়ে প্রচার করছে যে এটা জানে, সেটা জানে, সবটা জানে। সুবোধ যত বলছে তত দেখছিলাম তার বয়স বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত সে হয়ে গেল নব্বই বছরের থুথ্থুরে এক বুড়ো। আর কথা বলারও ক্ষমতা রইল না। সে নিরুপায় হয়ে চুপ করল। বন্ধুরাও সব চলে গেল। এবার দেখি, ও হরি ! সুবোধের বয়স বড়জোর বছর চল্লিশ।
আমাকে অবাক হতে দেখে রিক্ত জানাল,
‘দুমদাম বয়স বেড়ে যাওয়াটাও তোর একার রোগ নয়। এটাও একটা গণরোগ। আমাদের মধ্যে সবজান্তা গামছাওলাদের কোন অভাব নেই। সবাই ভাবে সে অন্যদের চেয়ে সবকিছু বেশি জানে, বেশি বোঝে। সবাই মনে করে, তার মত জ্ঞানী ব্যক্তি পৃথিবীতে তার আগে আর কখনও জন্ম নেয়নি। এদের সবারই বয়স দুমদাম বেড়ে যায়। সমস্যাটা তোর একার নয়। তোর এত ভাবনারও কারণ নেই। চাস যদি আরও দেখতে পারিস।’
প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়ে গিয়েছিল। যা সব কাণ্ড দেখছিলাম হজম করারও একটু অবকাশ চাই। তাছাড়া খিদেও পেয়েছিল বেশ। রিক্তকে তাই বললাম,
‘আপাতত এই থাক ভাই। আমার এখন একটু বিশ্রাম দরকার। তবে আমার অসুখ আরও আছে। বাকিগুলোর কথাও তোকে জানতে হবে।’
‘ঠিক আছে, পরে জানাস। শুনব। উত্তরটাও পেয়ে যাবি।’
আমরা তখনকার মত আমাদের অভিযান থামালাম। আরও বড় যাত্রার জন্য রসদ সংগ্রহ করে নেওয়া আগে দরকার।
অধ্যায়: ছয়
কিছু কিছু লোক কঠিন প্রকৃতির। তারা হাসলেও কেউ ভরসা পায় না , ভাবে এই হয়তো ধমক-ধামক শুরু করবে। সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পায়, সমঝে চলে। ভালমুখে কথা বললেও সবাই অকারণে ঘাবড়ে যায়। তাদের নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। মানুষ তাদের তুষ্ট করার চেষ্টায় সবসময় ব্যস্ত থাকে। পান থেকে চুন খসলে তারা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে। আর যদি তাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তো আরও বিপদ। কখন যে কী করবে কেজানে !
বলতে যাচ্ছি হামবড়াই ঘপাৎ সম্পর্কে দু’-চার কথা। উনি ওইরকম লোক। কঠিন-কঠিন চেহারা, রসকসহীন, কথাও বলেন পিলে চমকে দেওয়া গলার আওয়াজে। আবার হাতেও আছে প্রবল ক্ষমতা। পলিটিক্সের লোক। দেশের এক মান্যগণ্য নেতা এবং মাথা। তিনি চললে খবর তৈরি হয়, তিনি বলতে থাকলে অন্যেরা থেমে যায়। এমনই তাঁর দাপট। অবশ্য সত্যিসত্যিই তিনি কিছুই করেন না, যদিও সবাই মনে করে যা হচ্ছে সেসব তাঁরই ইচ্ছানুযায়ী। বলেন তিনি সদাসর্বদা অনেক কিছু করবেন এবং তারপরই কিছু না করলেও লোকেরা ভাবে যা বলেছিলেন করবেন বাস্তবে সবই করা হয়ে গেছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই—- জনসাধারণ, সংবাদমাধ্যম, স্বপক্ষ ও বিপক্ষের নেতা-নেত্রী। তিনি কী করবেন বা কী বলবেন এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। তবে যেমন বললাম, তাঁকে কিছু করতে হয় না, সবই তাঁর ইচ্ছেমত হয়ে যায়। তিনি এক পা চললেই লোকেরা ভাবে অনেক দূর চলে যাবেন, তাঁর মুখ থেকে একটি বাক্য বার হলেই সবাই মনে করে সমস্ত কথা শোনা হয়ে যাবে।
আমরা হামবড়াই ঘপাৎ-এর সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম কয়েক দিন। তিনি কী করেন, কোথায় যান, কাদের সঙ্গে কী বলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সবসময় তাঁকে ঘিরে রাখে জনমণ্ডলী। তিনি যেখানে, জনসমাগমও সেখানে। আবার উল্টো ব্যাপারটাও সত্যি হতে পারে—- জনসমাবেশ থাকলেই তাঁর উপস্থিতি দেখা যাবে। তিনি সবসময় ঘুরে বেড়ান, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। যেখানে যান সঙ্গে থাকে অনুগামী দল। দেশে নানারকম সংকট দেখা যায়, নানা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তিনি কী বলেন সেসব ক্ষেত্রে সেদিকে নজর রাখে সবাই। তাঁকে হরদম বিভিন্ন মিটিং-মিছিল আর জনসভাতে হাজির থাকতে দেখা যায়। রোজই একাধিক সাংবাদিক সম্মেলন রয়েছে তার ওপর। দেশে নীতি-নির্ধারণে তিনিই মূল ব্যক্তি। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা, তাঁর জনসভাতে তিল ধরণের জায়গা থাকে না। তিনি যা বলেন স্পষ্ট বলেন, কে কী ভাবল তোয়াক্কা করেন না। তাঁর রুক্ষ-কঠিন পরিচয় থাকলেও লোকেরা ভরসা পায়। এটাও ঠিক কথা যে মুখে যতই হুমকি দেন না কেন আজ পর্যন্ত এমন কোন পদক্ষেপ তিনি করেননি যাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যাতে জনসাধারণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে। জনসমর্থন বজায় রাখার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর, নিজে কখনও এমন কাজ করেন না যাতে কোন যৌক্তিকতা নেই বা যা আখেরে বুমেরাং হতে পারে। দলীয় লোকদেরও কঠিন শাসনে রাখেন যাতে জনসমর্থন কোনক্রমে ক্ষুণ্ণ না হয়।
রিক্ত বলল,
‘হামবড়াই ঘপাতের দাপট দেখেছিস ? এইরকম লোকেদের মুশকিল কী জানিস, কেউ এদের কব্জা করতে পারে না। এদের জীবনযাপন পছন্দ করে বহু বহু লোক। হাজার হাজার অনুগামী চায় হামবড়াই ঘপাৎ হতে, তারা তার মধ্যে ঢুকে বসবাস করতেও চায়। অনেকেই পারে, অনেকেই পারে না। যারা হামবড়াইকে আশ্রয় করতে পেরেছে তারা তার পছন্দ অনুযায়ী চলতে চাইছে বলে নিজেদের প্রকাশ ঘটাতে পারছে না। আসলে হামবড়াই খুব কড়া ধাতের লোক, তেমন সবল ইচ্ছে যদি অন্যের না থাকে সে নিজের ইচ্ছে দিয়ে হামবড়াইকে চালাতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারব না কত কত লোক হামবড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে বসে আছে।’
মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি কিভাবে ঘটে এই নিয়ে আমরা অভিযান শুরু করেছিলাম। সূচনাটা হয়েছিল এভাবেই। হামবড়াই ঘপাতের সঙ্গে নানা জনসভা আর মিটিং-মিছিলে ঘুরতে লাগলাম। তাঁর বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনও আমাদের দ্রষ্টব্য তালিকার মধ্যে থাকল। দেখছিলাম রোজ কিভাবে হাজার হাজার লোক তাঁকে আশ্রয় করছে, তাঁর মধ্যে নিজেদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আকাঙ্খিত জীবনযাপন চালাচ্ছে। তারা সবাই তাঁর পছন্দকেই মেনে নিচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে আগ্রহী নয় কেউ। এজন্যই হামবড়াইয়ের আচরণে কোন পরিবর্তন ঘটছে না। তাঁর সবল ব্যক্তিত্ব তাঁর মধ্যে আশ্রয় নেওয়া লোকগুলিকে গ্রাস করে ফেলছিল। রিক্ত জানাল,
‘আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের মধ্যে ঢুকে পড়া লোকরা যার মধ্যে ঢুকল তার মতোই বাঁচতে চায়। নিজেকে নিয়ে ক্লান্ত বলেই কেউ অন্যের মধ্যে ঢোকে। তাই নিজের চরিত্র সে মনে রাখতে চায় না।’
‘তাহলে কেউ কারো মধ্যে ঢুকল কিনা জানব কিভাবে ?’
‘সেক্ষেত্রে অন্যের মধ্যে ঢুকে সে নিজের ইচ্ছে বা চরিত্রের বিশেষ কিছু বিষয় প্রকাশ করতে চাইবে। তখনই বোঝা যাবে কে কার মধ্যে ঢুকল।’
হামবড়াই ঘপাতের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এক জনসভাতে আমরা একদিন ভূপতির খোঁজ পেলাম। এক ছাপোষা মানুষ, আর দশজনের মত। বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। সকালে উঠে নিয়ম করে বাজারে যায়, মাছের ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে অফিসে দৌড়োয়। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তার কাজের শেষ নেই। বউ বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখে , ফেসবুক করে, মোবাইলে আড্ডা মারে। ভূপতি চা-টা বানায়। কাচুমাচু মুখ করে টিভির সামনে বসে। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা আর হৈ-হুল্লোড় করে। সে শাসন করতে সাহস পায় না।
সমস্যা হল এটাই যে ভূপতি বড় বেশি গোবেচারা। তার ধারণাই নেই, ব্যক্তিত্ব ব্যাপারটা কী। সে ঠিকঠাক কথা বলতে পারে না, সবসময় ভয়ে-ভয়ে থাকে। ঘরে-বাইরে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। পাত্তা না দিলেও চলত, কারণ পাত্তা দিলে আবার অন্য মুশকিল, মতামত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রশ্ন এলে সে গলা শুকিয়ে মরেই যাবে। কেউ পাত্তা দেয় না বলে সে সেই বিপদ থেকে বেঁচে আছে। কিন্তু তাতেও কি সম্পূর্ণ রেহাই পায় ? পাত্তা দেয় না ঠিকই, লোকরা হরদম তার পিছনে লাগে। এই পিছনে লাগাটা বাইরে একরকম, ঘরে অন্যরকম। হাড়মাস কালি হয়ে যায় তার লোকের উপদ্রবে। মুখে প্রকাশ করে না ঠিক, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে রাগে জ্বলতে থাকে। অফিসের লোকেরা, চেনাপরিচিত ও বন্ধুবান্ধবরা তাকে নিয়ে মজা করে, সে বোকার মত হাসে। সেই হাসি দেখেও ঠাট্টাতামাশার অন্ত নেই। বাড়িতে উঠতে-বসতে বউয়ের বকুনি, ছেলেমেয়েরাও তাকে একেবারেই গ্রাহ্য করে না। নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়না ভূপতির। এর চেয়ে রাস্তার কুকুর-বেড়ালগুলিরও মর্যাদা আছে। জগতে নিজের কোন ভূমিকা রয়েছে, ভাবতে পারে না সে। আত্মসম্মান খুইয়ে কেউ এভাবে বাঁচে ? কখনও সে প্রতিবাদ জানবার সাহস পায় না।
আবার তার মরতেও ভয় লাগে। নাহলে সে মাঝেমধ্যে ভাবে আত্মহত্যা করার কথা। হেনস্তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। কিন্তু মৃত্যুকেও তার বেজায় ভয়। আসলে তার জীবনে এই ভয়টাই প্রধান শত্রু। নিজের ওপরই তার রাগ হয়, নিজের এমন ভীতু চরিত্রের জন্য। আর রাগ হয় বিশ্বসংসারের ওপর। যখন বাইরের লোকজন তাকে নিয়ে ঠাট্টাইয়ার্কি মারে আর খেপায়, ঘরে বউ কারণে-অকারণে ধমকায় আর খাটায় আর নাস্তানাবুদ করে, ছেলেমেয়েরা কথা শোনে না তখন সে বাইরে ভালমানুষি হাসি বজায় রাখলেও ভিতরে রাগে-আক্রোশে জ্বলেপুড়ে যায়। কেউ দেখতে পায়না গোপনে কী পরিমাণ দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে। কেবল সে নিজেই বোঝে নিজের নিষ্ফল আক্রোশ। আর সে মনে মনে বলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে,
‘দাঁড়া, কোনদিন যদি তোদের বাগে পাই তো ঘাড় মটকে দেব সব ক’টার। আমাকে নিয়ে মজা ! তোদের একদিন এমন শিক্ষা দেব যে নাকাল হয়ে যাবি।’
কেউ শুনতে পায় না তার ভিতরে থাকা রাগের এই আস্ফালন, কতটা যন্ত্রণা থেকে এই রাগের জন্ম বুঝতে চেষ্টা করে না কেউ। সবাই মনে করে ভূপতি এইরকমই, তার গণ্ডারের চামড়া। সে বোধবুদ্ধিহীন এক জীব। তাকে যতই বকো, যতই মারো কিছুতেই কিছু তাপ-উত্তাপ নেই তার।
ভূপতি বরাবরই হামবড়াই ঘপাৎকে পছন্দ করে। তার এক্কেবারে বিপরীত মেরুর লোক। সে ভীরু, মিনমিনে। হামবড়াই ঘপাৎ ঠিক তার উল্টো, দাপুটে আর সাহসী। সেদিন জনসভাতে তাঁকে দেখে ভূপতি আরও মোহিত। জীবনে প্রথম চাক্ষুষ দেখা। হামবড়াই ঘপাতের বলিষ্ঠ বাচনভঙ্গি, দৃঢ়তা ও কাঠিন্য তার ভেজা প্রাণে আগুন ধরিয়ে দিল। বাঁচতে হলে এমনভাবেই বাঁচা উচিত। নিজের এই ন্যুব্জ-কুব্জ জীবনটাতে আবার তার ঘেন্না ধরে গেল। সে ভাবল, যেভাবেই হোক সে হামবড়াই ঘপাৎ হয়েই বাকি জীবন কাটাবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভূপতি নিজেকে হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে প্রবেশ করাবার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে দিল। লম্বা লাইন। হাজার হাজার লোক নিজেকে পাল্টে হয়ে যেতে চায় হামবড়াই ঘপাৎ। প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা আর ধাক্কাধাক্কি। ভূপতি এমনিতেই ভীতু প্রকৃতির। এত প্রতিযোগিতা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে মরীয়া হয়ে গেল। কিছুতেই সে লাইন ছাড়ল না, কামড় খেয়ে লেগে রইল। আর সেদিনই গভীর রাতে কোন এক সুযোগে গোটা ভূপতি নিজেকে পাল্টে হয়ে গেল হামবড়াই ঘপাৎ। আসল ভূপতি এখন হয়ে থাকল নকল ভূপতি, অর্থাৎ ভূপতি এখন এক দ্বৈত সত্ত্বা। কেউ অবশ্য তা টের পেল না।
‘এবার কেমন কাণ্ড ঘটবে দ্যাখ্।’
রিক্তর কথা শুনে আমি উৎসুক হলাম। জানতে চাইলাম।
‘কী কাণ্ড ঘটবে ?’
‘দেখতে থাক। দেখলেই বুঝবি।’
‘হামবড়াইয়ের মধ্যে ভূপতি ঢুকে গেল। এটাইতো বড় কাণ্ড। অন্য আর কী ঘটবে ?’
‘ভূপতি যে হামবড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে গেল এটা মামুলি ব্যাপার। এমন তো কত লোকই ঢুকছে। ঢোকাটা তেমন কিছু নয়। ঢোকার পর কী ঘটে সেটাই কাণ্ড।’
‘কিন্তু ভূপতি ঢুকল বলেই কাণ্ড ঘটবে বলছিস কেন ? অন্যরাও তো দেখছি ঢুকে চলেছে। তাদের বেলায় কাণ্ড ঘটছে না কেন ?’
‘আসলে ভূপতির চরিত্রটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে চিরকাল মুখ বুজে মার খেয়ে এসেছে। এইরকম লোকরা যদি কোনক্রমে নিজেদের প্রকাশ করার কোন সুযোগ পায় তো কিষ্কিন্ধা কাণ্ড ঘটে যায়। তাই বলছি। দ্যাখ্ না, নিজেই দেখতে পাবি।’
দু’টো দিন নিরুপদ্রবে কেটে গেল। এমন কোন ঘটনাই ঘটল না যাকে কাণ্ড বলা যেতে পারে। একটু একটু হতাশ হতে শুরু করেছিলাম। তৃতীয় দিন এল সেই শক্তিশেল বাণ। হামবড়াই ঘপাৎ ঘোষণা করলেন, দেশের সমস্ত পুরুষদের মাথার চুল এক ইঞ্চির বেশি লম্বা রাখা যাবে না। ঘোষণাটা একেবারে আইন হয়ে গেল। হুলুস্থুলুস কাণ্ড শুরু হল দেশজুড়ে। অধিকাংশ লোকই চুলওয়ালা। মাথার চুল যদি এক ইঞ্চির বেশি বড় না রাখা যায় তো মহা যন্ত্রণা। শুরু হয়ে গেল দিনরাত স্কেল আর ফিতে নিয়ে চুল মাপামাপি আর সেই সঙ্গে ঘন ঘন চুল কাটাকাটি। আইনে পরিষ্কার বলা হল, কারো মাথায় যদি এক ইঞ্চির চেয়ে লম্বা চুল একটিও পাওয়া যায় তো তাকে পাগলাগারদে পুরে দেওয়া হবে। প্রথমে মনে হয়েছিল, আইনটা বুঝি কথার কথা। পাত্তা না দিলেও চলবে। তারপর শুরু হল ধরপাকড়। এক ইঞ্চির বেশি লম্বা চুলওয়ালা লোকেদের সত্যিসত্যি ধরে পাগলাগারদে ঢুকিয়ে দেওয়া হতে লাগল। তখন সবার টনক নড়ল। এই ফরমান জারি হতে দেখে টাকমাথা লোকেরা বেশ খুশি হয়েছিল, কারণ চুলওয়ালা লোকেদের ওপর তাদের বেজায় রাগ। তারা নিজেদের মধ্যে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলতে লাগল, কেমন জব্দ। তবে তাদের এই খুশি দেড়দিনের। চুলওয়ালা লোকেদের জন্য বিধান দেওয়ার দেড়দিনের মাথায় হামবড়াই ঘপাৎ আবার আরেক আইন চালু করে জানালেন, টাকওয়ালা লোকেদের পুরো টাক জুড়ে কালো মার্কার কালি দিয়ে ‘টাক আছে’ কথাগুলি পরিষ্কার লিখে রাখতে হবে। এটুকু হলেও রক্ষে ছিল, এর সঙ্গে যে লেজুড়টুকু জুড়ে দেওয়া হল সেটা আরও ঝামেলার। বলা হল, টাকওয়ালা লোকেদের যে সত্যিই টাক আছে এই মর্মে ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে সঙ্গে রাখতে হবে সর্বসময়। তারপর থেকে টাকওয়ালা লোকদেরও শান্তি উধাও হয়ে গেল হয়রানির ঠ্যালায়।
রিক্ত বলল,
‘দ্যাখ্ কেমন একুশে আইন চালু হচ্ছে একের পর এক।’
‘হামবড়াই ঘপাৎ করছে কী এসব ? তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল ?’
আমি বেশ উদ্বেগের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করলাম। রিক্ত মুচকি হাসল আর বলল,
‘এবার কাণ্ড ঘটছে কিনা বল্ ?’
‘ঘটছে।’ আমি স্বীকার করলাম এবং একইসঙ্গে প্রশ্নও রাখলাম, ‘কিন্তু কেন ?’
‘আগে দ্যাখ্ আরও কী ঘটে। কেন-টা তুই নিজেই বুঝতে পারবি।’
এর পরের আইন জারি হল দেশের সমস্ত গোঁফওয়ালা লোকেদের জন্য। হামবড়াই ঘপাৎ এক আদেশে জানালেন, যাদের গোঁফ গজাবে তাদের অবশ্যই গোঁফ রাখতে হবে এবং গোঁফের মোট আয়তন হতে হবে সাড়ে তিন বর্গ সেন্টিমিটার। আরও বলা হল যে বাঁদিকের গোঁফের তুলনায় ডানদিকের গোঁফ সবসময় এক সেন্টিমিটারের কম ছোট রাখা চলবে না।
গোঁফওয়ালা লোকেদের তুমুল হয়রানি শুরু হল। চব্বিশঘন্টা চলল কেবল গোঁফ মাপামাপি আর কাটাকাটি। ইতিমধ্যে আরেক আইন ঘোষণা করা হল দাড়িওয়ালা লোকেদের জন্য। বলা হল, কোন লোক দাড়ি কাটতে পারবে না। কেউ দাড়ি কাটলেই মোটা অংকের জরিমানা। দাড়ি কাটা অবৈধ বলে জানানো হল। এর পাশাপাশি নির্দেশ দেওয়া হল, প্রত্যেকে তার একেকটি দাড়ি এক ইঞ্চি লম্বা হওয়ার পর একটি করে গিঁট দেবে। সারাদিন ধরে দাড়িওয়ালা লোকেদের স্কেল দিয়ে মেপে মেপে এক ইঞ্চি করে লম্বা দাড়িগুলিকে গিঁট দিতে দিতে সময় কাটতে লাগল।
এই সমস্ত আইন কেবলই পুরুষদের জন্য। মহিলারা কি বাদ গেল ? একদমই নয়। হামবড়াই ঘপাৎকে এদিক থেকে বিচার করে সমদর্শী লোক বলা উচিত। তাঁর একুশে আইনের কোপ কেবল পুরুষদেরই কাঁপিয়ে দিল না, মহিলারাও ত্রাহি-ত্রাহি করতে লাগল। হামবড়াই ঘপাৎ মহিলাদের জন্য একগুচ্ছ আইন চালু করলেন, একের পর এক। প্রথম নিয়মটি মেয়েদের চুল নিয়ে। বলা হল, জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন মহিলা একবারের জন্যও তার চুল কাটতে পারবে না। এই পর্যন্ত শুনলে মনে হবে নিয়মটার মধ্যে তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। মেয়েরা চুল যদি না কাটতে পারে তো তা বড় হতে থাকবে, আর এমনিতেও মেয়েদের লম্বা লম্বা চুল হওয়া তেমন কিছু অশোভন নয়। কিন্তু এই আইনের পরবর্তী নির্দেশটাই বিপজ্জনক। তাতে বলা হল, কোন মহিলাই তার চুল পিঠের দিকে রাখতে পারবে না। সবাইকে চুল মুখের দিকে রাখতে হবে এবং তাতে মুখ যদি ঢেকে যায় তো যাক। মহিলাদের চুল লম্বা হয়ে ঝুলবে সামনের দিকে, পিছনদিকে নয়।
দ্বিতীয় আরেকটি আইন জারি হল মহিলাদের পোশাক নিয়ে। হামবড়াই ঘপাৎ পরিষ্কার জানালেন, সমস্ত মহিলাকে এমন পোশাক পরতে হবে যার পিছনে দু’ফুট লম্বা একটি লেজ থাকবে। ছোটবড় সব বয়সী মেয়েদের জন্য লেজওয়ালা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। ঘরে অথবা বাইরে মহিলারা প্যান্ট অথবা শাড়ি যাই পরুক না কেন তাতে দু’ফুট লম্বা লেজ থাকতেই হবে। এই লেজ লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টা করা চলবে না। পোশাকের মধ্যে লেজটা এমনভাবে থাকবে যাতে সবাই স্পষ্ট সেটা দেখতে পায়।
মহিলাদের টিভি দেখা নিয়েও একটি অনবদ্য আইন জারি করলেন হামবড়াই ঘপাৎ। আইনে বলা হল, কোন মহিলা টিভিতে সিরিয়াল বা সিনেমা জাতীয় কিছু দেখতে চাইলে তাকে তা দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। বসে দেখা চলবে না। ঘরে বা বাইরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে না কোথাও। আর যদি খেলা বা খবরজাতীয় কিছু দেখতে চায় কেউ তো তাকে টিভির সামনে ক্রমাগত হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
আমি বললাম,
‘জনতা এবার হামবড়াই ঘপাৎকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যা চটছে লোকজন ! এ তো অকারণে সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে তোলা।’
আমার মতামত শুনে রিক্ত প্রশ্ন রাখল,
‘এবার তাহলে তুই মানবি যে কিছু একটা কাণ্ড অবশ্যই ঘটছে ?’
‘হ্যাঁ, ঘটছে। সে তো বললাম আগেই।’
সত্যিটা স্বীকার করলাম আবারও নির্দ্বিধায়। পরক্ষণেই প্রশ্ন তুললাম,
‘কিন্তু হামবড়াই ঘপাৎ কেন করছে এসব ?’
‘তোকে কে বলল, হামবড়াই ঘপাৎ করছে কাজগুলো ?’
‘তাই তো দেখছি। দেশের সমস্ত আইনকানুন, নিয়মনীতি সব তো তার কথা অনুযায়ীই ঠিক হচ্ছে। এইযে এতসব নিয়মকানুন সে তো দেখলাম সে-ই চালু করল।’
রিক্ত চুপ করে শুনল আমার কথা। তারপর বলল,
‘একটা কথা জানবি, পৃথিবীতে কেউ কোন কাজ নিজে বা নিজের ইচ্ছেতে করে না। দেখে আমাদের মনে হবে, কেউ কোন একটা কাজ বুঝি নিজেই ভেবেচিন্তে করছে। কিন্তু তার পিছনে সবসময় অন্য গল্প থাকে। আমরা সবাই কাজ করি অন্যের ইচ্ছেমত। আমরা কেউ কোন কাজ নিজে করি না, আড়াল থেকে কেউ করায়।’
‘তাহলে যে একুশে আইনগুলি হামবড়াই ঘপাৎ চালু করছে দেশজুড়ে সেগুলো সে নিজের খেয়াল-খুশিমত চালু করছে না বলতে চাস ?’
‘একদম তাই। হামবড়াই ঘপাৎ যেমন লোক, সে কিছুতেই চাইবে না তার জনপ্রিয়তা নষ্ট হোক। জনসমর্থন তার মূলধন। জনতাকে সে অকারণে খেপিয়ে দেবে কেন ?’
‘কিন্তু একুশে আইনগুলো তো তাকেই দেখছি চাপিয়ে দিতে ?’
”যা দেখছিস তা ঠিকই, তবে ওটা ওপর-ওপর দেখা। এর পিছনে অন্য গল্প আছে।’
‘কী গল্প ?’
‘গল্পটা হল এই যে কাজগুলো হামবড়াই ঘপাৎ নিজে করছে না, যদিও সবাই দেখছে তাকেই কাজগুলো করতে। আসলে তাকে দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে অন্য কেউ।’
‘কে সেই অন্য লোকটা ?’
‘সে ভূপতি। দু’দিন আগে সে ঢুকেছে হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে। এই যে একুশে আইন চালু করে পুরুষ ও মহিলাদের নাজেহাল করা পদে পদে, এটা আসলে নিজের মধ্যে ভূপতি যে আক্রোশ গোপন রেখেছিল দিনের পর দিন, তারই প্রকাশ। হামবড়াই ঘপাতের মত কোন ক্ষমতাবান লোকের মধ্যে তাই সে আশ্রয় নিয়েছে, যাতে তার মাধ্যমে সবাইকে সে মনের মত শিক্ষা দিতে পারে। অন্যদিকে মজাটা দ্যাখ্, সে যে লোকগুলিকে নাজেহাল করছে সেটা কিন্তু কেউ টের পাচ্ছে না। সব দোষ গিয়ে চাপছে হামবড়াই ঘপাতের ঘাড়ে।’
আমি শুনে প্রথমটায় তাজ্জব বনে গেলেও একটু সামলে নিয়ে চুপ করে ভাবতে লাগলাম। মনে হল, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। হামবড়াই ঘপাৎকে দেখে ইদানীং কেমন বদলে যাওয়া লোক বলে ঠাহর হচ্ছিল। খানিকটা তলিয়ে চিন্তা করে বুঝলাম, সত্যিই হামবড়াই ঘপাতের চালচলনে আজকাল যেন ভুপতিরই প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন বেশি মাত্রায়। রিক্ত বলল,
‘ভূপতি বিশ্বসংসারে সমস্ত লোকের ওপর বিরক্ত। ঘরের লোকদেরও সে পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই সে সবাইকে শিক্ষা দিতে চায়। নিজের তার সেই ক্ষমতা নেই। হামবড়াই ঘপাতের মধ্যে ঢুকে সে এখন নিজের অপূর্ণ সাধ মেটাচ্ছে। যারা তাকে নিয়ে মজা করেছে এতদিন, তারা কেউ তার একুশে আইনের হাত থেকে রেহাই পাবে না। আসলে ভূপতি সংসারের কোন মানুষকে ভাল ভাবতে পারে না। সে সবাইকে দুর্জন ভাবে। সে তাই হামবড়াই ঘপাৎকে দিয়ে এমন সব কাজ করাচ্ছে যাতে জগতের সব লোকের চূড়ান্ত ভোগান্তি হয়। হামবড়াই ঘপাৎকে আশ্রয় করে ভূপতি নিজের অসুস্থ বাসনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর হামবড়াই ঘপাতের এইসব সৃষ্টিছাড়া একুশে আইন চালু করা দেখে আমরা বুঝতে পারছি যে ভূপতি তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে।’
এটাই ছিল আমাদের প্রথম অভিযানের বিবরণ, যেখানে আমরা দেখেছিলাম কেউ কিভাবে অন্যের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে নিজের প্রকাশ ঘটায়।
অধ্যায়: সাত
রঙ পাল্টানোর কথা বলছিলাম।
ইদানীং রিক্তর কল্যাণে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে দেখেছি, সব মানুষরাই কমবেশি রঙ পাল্টায়। রঙ পাল্টানোই মানুষের ধর্ম। সেইসঙ্গে আমার মনে পড়ল, মানুষরা যে রঙ পাল্টায় সেটা আমি আগেই জানতাম, কিন্তু বুঝতাম না। ছোটবেলা থেকেই তো দেখে আসছি বিষয়টা। এখন গভীরভাবে ভাবলাম এই জীবনে দেখা পরিচিত সব মানুষের মুখগুলো। এমন একজনকেও খুঁজে পেলাম না যাকে রঙ পাল্টাতে দেখিনি। রোজ রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, বাজারে, বাসে, ট্রেনে যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারা সবাই কি রঙ পাল্টায় ? এই শহরে ঘুরতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে দেখি। তারা সবাই রঙ পাল্টায় কিনা বা পাল্টালেও কখন কিভাবে পাল্টায় তা তো বলতে পারব না। তাহলে লেগে থাকতে হয় সবার পিছনে। সে কি সম্ভব ? চেনা লোকদের কথা তবুও বলা যায়। অচেনা লোকেদের কথা কী বলব ? অহরহ যেসব মানুষ দেখছি তার প্রায় সবই অচেনা। কোনদিন সারা শহরে টৈ-টৈ করে ঘুরলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের ক’টা পরিচিত মুখ ? দু’-পাঁচটা হবে বড়জোর। রোজই শ’য়ে-শ’য়ে এমন মানুষ দেখি যাদের আগে কখনও দেখিনি। গড়ে রোজ যদি এক হাজার মানুষের সঙ্গে দেখা হয় ধরে নিই তো পঞ্চাশ বছরের জীবনে কেউ সর্বমোট এক-দেড় কোটি মানুষের দেখা পাবে। তার এক শতাংশও চেনা মুখ নয়। এই এত এত অচেনা লোকের রঙ পাল্টানোর গল্প কার পক্ষে জানা সম্ভব ? মুষ্টিমেয় যে ক’জন পরিচিত মুখ রয়েছে তাদের বারবার দেখি, আর তাই তাদের চরিত্রও কিছুটা জানি। তারা সবাই যে বিভিন্ন সময়ে রঙ পাল্টায় তাতে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
আমি নিজে কখন রঙ পাল্টাতে শুরু করেছিলাম ?
উত্তরটা আমার নিজেরই জানা নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা আমার মা পছন্দ করত না। মা আমাকে ডেকে প্রায়ই বলত,
‘রঙ পাল্টে ফেলার বদভ্যাসটা আবার কী ? যার যেমন রঙ সেটা থাকলেই তো চলে। রঙে কী আসে-যায় ? তুমি কী করছি সেটাই আসল। সাদা লোকরাও কাজ করে, কালো লোকরাও কাজ করে। তাহলে খামোখা কেন রঙ পাল্টাপাল্টি ? তুমি যদি ঠিক হও, আর ঠিকঠাক কাজ কর তো রঙ পাল্টাবার প্রশ্নই থাকবে না।’
আমাকে নিয়ে মায়ের খুব দুশ্চিন্তা ছিল—- আমিও যদি অন্যদের মত রঙ পাল্টাপাল্টি করতে থাকি। আমাকে বলত,
‘নিজেকে সবসময় মানুষ ভাববি। মানুষ হলে তার রঙ পাল্টাবার দরকার নেই। গিরগিটির ঘন ঘন রঙ পাল্টায়। তুই গিরগিটি নোস্, এটা সবসময় মনে রাখবি। তোকে ঈশ্বর একটা মাথা দিয়েছেন, সেটা গিরগিটিদের মাথা নয়। গিরগিটি কেন, মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণি এই মাথাটা পায়নি। মানুষের মাথাটা একেবারেই মানুষের, কপিরাইট মানুষেরই হাতে। এমন মাথা যার আছে তার গিরগিটি হওয়ার প্রয়োজন নেই।’
মায়ের কথাগুলো শুনতাম আর মাথাটায় হাত বুলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম কী এর বিশেষত্ব। আমাকে মা চোখে চোখে রাখতে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছি জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিত। ওই বয়সেই আমি দেখতাম আমার অনেক সহপাঠী বা সঙ্গী রঙ পাল্টাবার কৌশল শিখে গেছে। কারো কারো রঙ এমনি এমনিই পাল্টে যায়, কেউবা নিজের ইচ্ছ্যেতে রঙ পাল্টায়। মা আমাকে ঐসব বন্ধুর সঙ্গে একেবারেই মিশতে দিত না।
আমার এক বন্ধু ছিল কৌলিক। সে আমার খুব প্রিয়। অনেক গোপন রহস্য জানত সে। বর্ষাকালে পিঁপড়েরা কোথায় লুকিয়ে থাকে, কোন্ কোন্ বাদুড় ভ্যাম্পায়ার গোত্রভুক্ত হতে পারে, মাছেদের ঘরবাড়ি কেমন হয়, প্রেতাত্মারা পঞ্চমাত্রিক কোন জগতের বাসিন্দা কিনা—- এমনই সব আকর্ষণীয় বিষয়ে তার ছিল প্রভূত জ্ঞান। আমাকে নিয়ে নানা রহস্য সমাধানের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াত সে আজব আজব জায়গায়। হুঁশিয়ারি মাজার ছিল তেমন এক উদাহরণ। ইলাক্কাস মিঞার কবর। কোমরসমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারধার। প্রচুর ইঁদুর গর্ত করে থাকত সেখানে। তার মধ্যে একটা ইঁদুরের ছিল সাদা দাড়ি। সে আসলে ইলাক্কাস মিঞা। তাকে কেউ দেখতে পেত না। ইঁদুরের গোঁফ হতে পারে, দাড়ি ব্যাপারটা বেমানান। কিন্তু দাড়িওয়ালা ইলাক্কাস যেহেতু মরার পর ইঁদুর হয়ে গিয়েছিল তাই তার দাড়িটাও ছিল গোঁফের পাশাপাশি। দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার দেখা না পেলেও সবাই জানত সে আছে। কৌলিক আমাকে নিয়ে সেই ইঁদুর খুঁজতে গিয়েছিল। খোঁজাখুঁজি চলছিল বিস্তর, কোন সমস্যা ছিল না। দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার দেখা পেয়েই যাব ভাবছিলাম। বাদ সাধল মগা। সে আমার মাকে গিয়ে নালিশ করল,
‘কী বলব মাসিমা, বললে বিস্যেস করবেন না। কৌলিকটার পাল্লায় পড়ে ও গোল্লায় যাচ্ছে। হুঁশিয়ারি মাজারে গিয়ে ইলাক্কাস মিঞার খোঁজ করে বেড়ায়। সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুর খোঁজে। ওই ইঁদুরের সাক্ষাৎ পেলে রক্ষে আছে !’
মা আমার বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। হুঁশিয়ারি মাজার এক নিষিদ্ধ স্থান। নানা দুর্নাম আছে তার, এমনই রটনা সর্বত্র, নাকি জিন-পরী-অপদেবতা আর আপদ-বিপদের আস্তানা। যদিও লোকেরা মুশকিল আসানের জন্য যায় সেখানে। তবে যাওয়ার সময়-অসময় আছে। মগাটার কোন্ পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম জানিনা। গোপন ব্যাপারটা মাকে জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে কী আনন্দ পেল কেজানে ! মা আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করল একদিন,
‘তুই কৌলিকের সঙ্গে হুঁশিয়ারি মাজারে যাস ?’
অস্বীকার করতে যাচ্ছিলাম এই বলার চেষ্টায়,
‘ন্-না তো….’
মা তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। বলল,
‘তোর কিন্তু রঙ পাল্টিয়ে যাচ্ছে।’
অতএব আর অস্বীকার করতে পারলাম না। মা হুকুম জারি করল,
‘আর যাবি না ওখানে।’
মহা মুশকিল। সেদিনই সন্ধেবেলা কৌলিকের সঙ্গে হুঁশিয়ারি মাজারে যাওয়ার কথা ছিল। সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুরটা হয়তো সেদিনই দেখা দেবে। কিন্তু মা যেমন আদেশ জানাল তা অমান্য করি কী করে ?
চিন্তায় চিন্তায় একবেলাতেই চিবুকের তিলটা সাইজে ডবল হয়ে গেল। তারপর ভাবলাম, যা হয় হবে, মাকে লুকিয়ে বেরোতেই হবে। কৌলিকের সঙ্গ ছাড়তে পারব না। সন্ধের একটু আগে বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছি, মা ডেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় যাচ্ছিস ?’
‘সুনীত স্যারের বাড়ি। ম্যাথস্-এর কয়েকটা প্রব্লেম ছিল দেখাবার।’
মা আমার দিকে তাকিয়েছিল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে, হঠাৎ দেখি তার চোখ গোল গোল হয়ে গেল। এগিয়ে এসে গভীরভাবে তাকাল মা আমার দিকে। বলল,
‘তোর রঙ পাল্টে গেছে।’
‘কী যা-তা বলছ ! চোখটা নির্ঘাৎ খারাপ হয়েছে।’
কথাগুলি বলেই পালিয়ে গেলাম। ফিরলাম রাত আটটা নাগাদ। হুঁশিয়ারি মাজারে আমি আর কৌলিক অনেক খুঁজেও সাদা দাড়িওয়ালা ইঁদুরটার পাত্তা পেলাম না। বাঁশঝাড় আর ঝোপড়া গাছের পটভূমিকায় গা-ছমছমে পরিবেশে কাটালাম প্রায় দেড়-দু’ঘন্টা। পেঁচার ডাকে আর জোনাকির জ্বলা-নেভায় বুক কাঁপছিল ধুপুস-ধুপুস। কোথায় ইঁদুররুপী ইলাক্কাস মিঞা ? দেখা পেলে অনেক গোপন রহস্যের চাবিকাঠি পাওয়া যেত। হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা অপেক্ষা করছিল। দেখেই জিজ্ঞেস করল,
‘হুঁশিয়ারি মাজারে গিয়েছিলিস ?’
চমকে গেলেও সামলে নিলাম। বললাম,
‘দুর্, কী যে বলনা ! সুনীত স্যারের কাছে অঙ্ক করছিলাম…..’
‘তোর রঙ কিন্তু আবার পাল্টে যাচ্ছে।’
মা গম্ভীরভাবে জানাল। আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না।
আমার যে রঙ পাল্টে যায় সেটা এভাবেই প্রথম জেনেছিলাম কিনা বলতে পারব না। কবে রঙ পাল্টানোর পালা শুরু হয়েছিল আমার তাও স্পষ্ট জানিনা। তবে সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রায়ই যে আমার রঙ পাল্টায় তা মায়ের চোখে ধরা পড়েছিল। আমি উড়িয়ে দিতাম, বিশ্বাস করতে চাইতাম না, কিন্তু মা আমাকে নিয়মিত নানা পরিস্থিতিতে জানাত যে আর দশটা লোকের মত আমারও রঙ পাল্টে পাল্টে যায়।
হুঁশিয়ারি মাজারে যাওয়ার মিথ্যেটা বলে রঙ পাল্টানোর ঘটনাটির পর মা আমাকে বারণ করে দিল যাতে কৌলিকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখি। এতে খুব মুশকিল হয়ে গেল। কৌলিক তখন আমার প্রাণের বন্ধু, তার সঙ্গে না মিশে থাকা যায় ? রোজ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মা বলত,
‘কৌলিকটার সঙ্গে মিশবি না কিন্তু।’
আমি বলতাম, ‘আচ্ছা’। রোজ বাড়ি ফিরলে মা প্রথমেই জিজ্ঞেস করত,
‘কৌলিকের সঙ্গে যাস নি তো কোথাও ? কথা বলিসনি তো ওর সঙ্গে ?’
আমি গলায় জোর এনে জবাব দিতাম,
‘পাগল ! তুমি বারণ করে দিয়েছ, আর মিশি ওর সঙ্গে ?’
এবং ওই কথা বলতেই আমার রঙ পাল্টে যেত বুঝতাম আর তাই বলার আগে যে করেই হোক মায়ের চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতাম।
গল্পের বইয়ের নেশাটা প্রবল হয়েছিল স্কুলে পড়ার সময়। রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ আর ভূতের গল্প পেয়ে বসেছিল আমাকে। অদম্য নেশা। বইগুলো জুটেও যেত যেভাবেই হোক। স্কুলের ব্যাগে রক্তমাখা ছুড়িহাতে মর্কটমার্কা একটা লোকের ছবিওয়ালা ওইরকম একটা বই ছিল, ধরা পরে গেলাম সত্যস্যারের হাতে। বই তো বাজেয়াপ্ত হলোই, উপরন্তু মাকে ডেকে নালিশ জানালেন স্যার,
‘ট্যালেন্ট ছিল, প্রসপেক্টও ছিল, কিন্তু রেজাল্টটা খারাপ হচ্ছে। এইসব ছাইভস্ম পড়লে এমনটাই হবে। নজরে রাখবেন।’
মা আমাকে বকাবকি করল, ভাল কথায়ও বোঝাল। অনুতাপও হল আমার খুব। মাকে কথা দিলাম, আর ছোঁব না ওইসব রদ্দি বই। দু’দিন কাটল, তিনদিন কাটল। নেশা যে কী বস্তু ! লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বাড়িতে থাকলেই মা চোখে চোখে রাখত। পড়তে বসছি কিনা আর বসলেই বা কী বই পড়ছি। পড়ার বই নিয়ে বসে থাকলেও লোভ আর নেশা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকত। আমার ঘন ঘন রঙ পাল্টে যেত। মা সন্দেহের চোখে তাকাত। বুঝতে পারত আমার মনোভাব। তবে রঙ পাল্টালেও স্থায়ী হত না বলে তেমন কিছু বলত না। কেবল সুযোগ পেলে বোঝাত যাতে আমার সুবুদ্ধি হয়। সুবোধ ছেলের মত ঘাড় কাৎ করে মায়ের কথা শুনতাম। তারপর লোভের কাছে হার মানলাম। কুবুদ্ধি চাপল মাথায়। পড়ার বই নিয়ে বসতাম, তলায় রাখতাম গল্পের বই। মা আমার ছলনাটা বুঝতে পারত না। মাকে এইভাবে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে দিব্বি পরে যেতাম রহস্য-রোমাঞ্চ আর ভূতের গল্প। মা সামনে থাকলে বা আড়ালে গেলে যা পড়তাম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তা আসলে আগে থেকেই মুখস্থ করে রাখা পড়া। মা ভাবত, আমি বোধহয় সত্যিই পড়ছি। কিন্তু আমার রঙ পাল্টানোর বহর দেখে সন্দেহও করত। মায়ের চোখে সেই সন্দেহ অনবরত দেখতে পেতাম। আমার রঙ পাল্টানো চলতেই থাকত। সন্দেহ করলেও মা কিছুই বুঝতে পারত না।
এই ছলনা আর ফাঁকিবাজির ফল ফলতে দেরি হল না। পড়াশুনায় ছিলাম ক্লাশে একনম্বর, এখন অত্রি সে জায়গাটা দখল করে নিল। সব বিষয়েই আমার নম্বর কমতে লাগল। অত্রি ছাড়াও সরোজ, পুলকরা পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আমার তুলনায় বেশি বেশি নম্বর পেয়ে গেল। ক্লাশটিচার সুধীরবাবু স্যার একদিন সবার সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে বললেন,
‘দ্যাখ্, তোর কী অধঃপতন ! অংকে আর ইংরেজিতে তুই এবার ক্লাসে সবচেয়ে কম মার্কস্ পেয়েছিস। ভাবতে পারছিস ?’
আমার খুব রাগ হল। কার ওপর জানিনা। হয়তো নিজের ওপর অথবা বিশ্বসংসারের সবার ওপর। আমার রঙ পাল্টাতে লাগল। স্যাররা সবাই অত্রির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আগে এই প্রশংসা পেতাম কেবল আমি। অত্রি কেন কী আক্কেলে আমার চেয়ে ভাল হবে ? আমি অত্রিকে হিংসে করতে লাগলাম। আমার আবার রঙ পাল্টে গেল। একা অত্রি কেন, সরোজ আর পুলকের ওপরও আমার খুব রাগ হল। সবাইকে আমি বিদ্বেষের চোখে দেখতে লাগলাম। মনে হল, ওরা সবাই আমার শত্রু। রঙ কেবলই পাল্টে যাচ্ছিল আমার। অত্রি, সরোজ আর পুলকের অমঙ্গলের চিন্তা এখন আমার মাথায়। কেবলই ভাবি, ওদের বড় কোন ক্ষতি হোক। এসব কথা যত ভাবি তত আমার রঙ পাল্টাতে থাকে।
এসব ব্যাপার ঘটেছিল সেই কোন্ কালে। মনে ছিল না আমার। তেমনভাবে তলিয়েও ভাবিনি ব্যাপারগুলো। রঙ পাল্টানোর কথাটা তখন মাথাতেও ছিল না। বলছি এখন রঙ পাল্টানো, তখন বলা হত অন্যরকম। মা-ও ঠিক রঙ পাল্টানো বলত না, বলত অন্যকিছু। এখনও কেউ বলে না রঙ পাল্টানো। বলছি কেবল আমি, আর অবশ্যই রিক্ত। অন্যেরা যে যা-ই বলুক, আমি রঙ পাল্টানোই বলে যেতে থাকব। আর এই রঙ পাল্টানোর অভিজ্ঞতাটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। রঙ পাল্টে যেত আমার আগে, রঙ পাল্টে যায় আমার সবসময়। প্রশ্ন হল, রঙটা কি নিজে নিজে পাল্টায় নাকি রঙ পাল্টাই আমি আমার ইচ্ছেমত। আগে সন্দেহ ছিল। ভাবতাম, রঙ পাল্টানোর ওপর আমার কোন হাত নেই। আমি চাই বা না চাই, পরিস্থিতি অনুযায়ী আমার রঙ আপনা থেকেই পাল্টে যাবে। কথাটা একশ’ ভাগ সত্যি। তবে অন্য এক অভিজ্ঞতাও হচ্ছে ইদানীং। দেখছি আজকাল, আমি ইচ্ছে করলে যেমন চাই তেমন রঙ ধরে ফেলতে পারছি। অর্থাৎ রঙ পাল্টানোটা এখন কেবল নিজে নিজেই ঘটছে না, ঘটছে আমার ইচ্ছে বা পছন্দ বা প্রয়োজন অনুযায়ী। অন্যকথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে দু’টো ব্যাপারই সত্যি। রঙ পাল্টায় তার নিজের নিয়মে, আবার রঙ পাল্টানো রয়েছে আমার নিজেরই নিয়ন্ত্রণে। আমাকে না জানিয়ে যেমন আমার রঙ পাল্টে যেতে পারে তেমনি আমি যখন খুশি আমার রঙ যেমন খুশি পাল্টে ফেলতে পারি।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বাচ্চাদের আমি একেবারেই পছন্দ করি না। সবাই বাচ্চা দেখলে গলে জল হয়ে যায়, মুখেচোখে বিকৃতি এনে বাচ্চাদের আদর করতে থাকে। এসব আদিখ্যেতা আমার একেবারেই সহ্য হয় না। আমি পারতে কোন বাচ্চার কাছাকাছি যাই না। আসলে বাচ্চা বা শিশুদের নিয়ে আমার তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতা আছে। যতবার আমি কোন বাচ্চার সংস্পর্শে গেছি ততবারই একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। একবার একটা বাচ্চা আমার কান কামড়ে দিয়েছিল। আমার কান বেশ কয়েকবার বিভিন্ন বাচ্চার আক্রমণের শিকার হয়েছে। একবার ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম কোথাও। বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম, জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম অন্যমনস্কভাবে। হঠাৎ আমার একটা কান কিসে যেন খাবলে ধরল। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা দুধের বাচ্চা, আমার পিছনে বসা তার বাবা বা মায়ের কাঁধে চাপা অবস্থায় কানটাকে আমার পাকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। আরেকবার একটা বাচ্চা আমার নাক এমন আঁচড়ে দিয়েছিল যে ডাক্তার দেখিয়ে ও মলম লাগিয়ে তা সারাতে লেগেছিল দশদিন। আমি যেখানে থাকি তার পাশের ফ্ল্যাটবাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে দুর্ভাগ্যক্রমে প্রত্যেক বছর একটা করে নতুন বাচ্চা জন্ম নেয়। তাতে আমাকে কী যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা কাউকে প্রাণ খুলে বলারও উপায় নেই, কারণ বলতে গেলেই সবাই ভাববে যে আমি একটা পাষণ্ড আর তাই বাচ্চাতে এত অরুচি। কিন্তু এটা তো সত্যিকথা যে গত কয়েকবছর ধরে যখনই রাতে আমি ঘুমোতে যাই কোন না কোন ফ্ল্যাটের কোন না কোন বাচ্চা চিলচিৎকার জুড়ে দেয় আর আমার ঘুমের দফারফা হয়ে যায়। বাচ্চাদের সত্যি বলছি, আমি দু’চোখে দেখতে পারি না। মুশকিলে পড়ে যাই যদি কেউ তার বাচ্চার অন্নপ্রাশনে বা জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করে। আপ্রাণ চেষ্টা করি না যাওয়ার, আর যেতেই যদি হয় তো আমার দুর্দশা দেখে আমারই চোখে জল চলে আসে। গোবদা-গোবদা বাচ্চাগুলোর হাত-টাত ধরতে হয়, গালে আলতো টিপ দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলতে হয়, ‘উতু-পুতু-মুতু ছোনাটা আমাল’ ! আবার অন্যদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হয় ডাহা মিথ্যেকথাটা, ‘কী মিষ্টি ! আমি বাচ্চাদের খুব ভালবাসি’। এইসব কথা বলতে বলতে বুঝতে পারি যে আমি নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী গায়ের রঙ পাল্টিয়ে ফেলছি। সবার সামনে বাধ্য হয়ে যে বাচ্চাটাকে অত আদর করলাম একটু সুযোগ পেলেই গোপনে এমন এক রামচিমটি দেব না ! এমন কাণ্ড করি আমি হামেশাই। আড়ালে পেয়ে কত বাচ্চাকে যে চোরা চিমটি কেটেছি তার কোন হিসেবে আছে ? কেন যে অনেক বাচ্চাই অকারণে হঠাৎ-হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বোঝে না তাদের মা-বাবারা। আসলে আমার মত লোক কি কিছু কম আছে জগতে ? অবস্থা বুঝে রঙ পাল্টাতে পারে সবাই ইচ্ছে অনুযায়ী।
ছিলাম এমনই, বাচ্চাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে। তাদের নিয়ে কিছু বলিও না, কাছাকাছিও হই না। আড়াল থেকে সুযোগ পেলেই চোরাচিমটি চালাই। বাচ্চারা কাঁদে, তাদের মা-বাবারা বুঝতে হিমশিম খেয়ে যায় কী হল ভেবে ভেবে। গবা আমাকে বেশ বিপদে ফেলে দিল। গবার একটা ভাল নাম আছে, গৌরবানন্দ আচার্য। সে নানারকম জনহিতকর কাজকর্ম করে বেড়ায়। কী সব এনজিও-টেনজিও চালায়। সে কার কাছে কুবুদ্ধি পেল, আয়োজন করল এক শিশুমেলার। করুক, তাতে কোন সমস্যা ছিল না। শিশুমেলা-পশুমেলা যার যা খুশি করতে পারে, আমার কী আসে-যায় ? আমাকে না জড়ালেই হল। কিন্তু গবা আমাকেও ফাঁসিয়ে দিল। আমার নামটা জুড়ে দিয়ে করে দিল শিশুমেলার সভাপতি। আপত্তি জানালে হাড়বিচ্ছু গবাটা গম্ভীরভাবে বলল,
‘তোমার নামটা বাদ দিতে পারি। কিন্তু শিশুদের তুমি পছন্দ কর না ব্যাপারটা প্রচার হলে খুব কি মঙ্গল হবে তোমার ? সমাজে শিশুদরদী হিসেবে সুনাম অর্জন করার একটা সুযোগ পেয়েছ, ছেড়ে দেবে ? আমি অন্তত জানি, তুমি গোপনে শিশুদের চোরাচিমটি কেটে বেড়াও।’
কী আর করি, রাজি হতেই হল। এলাহি আয়োজন করল গবা। জগতে এত শিশু ছিল কে জানত ? সবাই এসে হাজির হল ময়দানে। সঙ্গে তাদের বাবা-মা। আর সংবাদমাধ্যম, বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ ও লোকজন। সেই আসরে আমাকে বক্তব্য রাখতে হল। রঙ পাল্টে নিয়ে আমি বললাম,
‘শিশুরা নির্মল, পবিত্র। তারা ভগবানের দূত। আমি শিশুদের খুব ভালবাসি। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। যারা শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে আড়ালে-আবডালে চোরাচিমটি কেটে বা খোঁচা মেরে তাদের কান্নার কারণ ঘটায় সেইসব দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে হবে। ওইসব দুর্জন ব্যক্তিরা সমাজের কলঙ্ক।’
জোর হাততালি পেলাম। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। কথাগুলি বলার সময় আমার গায়ের কালো রঙ যে গাঢ় হলুদ হয়ে গেল কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না।
সেবার এক কাণ্ড হল। কোথাও যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে রাস্তায় এক জায়গায় জটলা দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। উত্তেজিত জনতা। একদল দুষ্কৃতীকে ধরে সবাই গণপ্রহার চালাচ্ছিল। নাকি ওরা পাচারকারী, এলাকায় এসেছিল সেই উদ্দেশ্যে। সবাই পেটাচ্ছিল, আমিও দলে ভিড়ে গেলাম। প্রচুর পেটালাম লোকগুলিকে। তাদের কোন কথা বলতে দেওয়া হল না। পুলিশ এল শেষপর্যন্ত। ভিড় তখন পাতলা। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মার খাওয়া লোকগুলি সব মারা গেল। তদন্ত শুরু হল। জানা গেল, লোকগুলি মোটেই পাচারকারী নয়। এই নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু হল। ধরপাকড় চলল। প্রতিবাদে আবার সেই একই জনতা, যাদের অধিকাংশই ছিল সেদিন পেটানোর দলে। বেগতিক দেখে আমিও তাদের দলেই ভিড়ে গেলাম। এখানে-ওখানে জনসভায় হাজির হতে লাগলাম, নিন্দে করলাম হিংস্র জনতার আক্রোশকে। নিরীহ মৃত মানুষগুলির স্মৃতিতে শোকসভা হতে লাগল, সব জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম। নিজের উদ্যোগে আমি মোমবাতি মিছিলের আয়োজন করলাম। নাগরিকরা আমার নেতৃত্বে সন্ধেবেলা মোমবাতি হাতে দশ কিলোমিটার হাঁটল। আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই বলল,
‘এই ভুল আর না।’
রাতের অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় কেউ বুঝতেই পারল না যে আমি আমার রঙ পাল্টে নিয়েছি।
আমার মায়ের কথায় ফিরে আসা যাক। আমারও রঙ অন্যদের মত পাল্টে পাল্টে যাক এটা মা অন্তর থেকে মানতে পারত না। সে কথা বলা হয়ে গেছে। মা ছিল খুব ভক্তিমতী। ভগবানে মায়ের ছিল অগাধ বিশ্বাস। দু’বেলা নিয়ম করে নানা স্তবস্তুতি করত। মা আজ নেই আমার জগতে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। সেইসব স্তবস্তুতি, যেসব মা তার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিয়মিত নিবেদন করত আজও তার অনেক কিছু ভুলে যাইনি। মনে পড়ে, মা তার ভগবানকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই বলত,
‘সর্প হয়ে দংশ তুমি ওঝা হয়ে ঝাড়ো।’
তার মানে কি এই যে ভগবানও স্বয়ং রঙ পাল্টায় ? মা আজ নেই। থাকলে এই কথাটা মাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)