তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায়: নয়
বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই। রাস্তায় নেমে প্রথমেই একজন লোকের মুখোমুখি হলাম যার সঙ্গে সাতজন্মে দেখা হয়নি কোনদিন। লোকটাকে নিঃসন্দেহে চিনি না। অথচ আমাকে দেখেই সে পরিচিতের মত হাসল। খামোখা একটা অচেনা লোক আমাকে দেখে কেন হাসল চট করে বুঝে উঠতে পারলাম না। ভাবলাম, হাসুকগে। মাথা ঘামাবার কী আছে ? কিন্তু ধাক্কা খেলাম দ্বিতীয় লোকটার সঙ্গে দেখা হতেই। সেও আমাকে দেখে একইভাবে হাসল, এবং শুধু হাসলই না, এগিয়ে এসে বেশ বিনীত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
‘স্যার কি এদিকে কোন বিশেষ কাজে এসেছেন ?’
হ্যাঁ-না গোছের কিছু একটা বলে লোকটাকে এড়িয়ে গেলাম। তারপরই একের পর এক ঘটতে লাগল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে আসে, পরিচিত লোকের মত কথা বলার চেষ্টা করে আমার সঙ্গে। কী যে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ সব লোকের এত চেনা হয়ে গেলাম কী করে ? অথচ আমি কাউকে চিনি না। বিপত্তির একশেষ !
কারো দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালাম। পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এক জায়গায় গিয়ে দেখি বেশ জনতার ভিড়, সামনেই সাজানো রয়েছে একটা মঞ্চ। আমাকে দেখেই লোকজন হৈ-হৈ করে উঠল। বলাবলি করতে লাগল,
‘এসে গেছেন! এসে গেছেন!’
সবাই মিলে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। লোকগুলোর হাত থেকে রেহাই পেলাম না কিছুতেই। তারা সবাই জোর করে আমাকে মঞ্চে তুলে দিল। একজন লোক মাইক হাতে নিয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলল,
‘জগঝম্পবাবু আমাদের মধ্যে এসে গেছেন। আপনারা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। এবার শুনুন উনি কী বলেন।’
তারপর লোকটা মাইক ধরিয়ে দিল আমার হাতে। ঘামতে ঘামতেও আমি দেখলাম মাইক মুখের কাছে পেয়েই বলতে শুরু করেছি,
‘বন্ধুগণ, এ লড়াই আমাদের অধিকার রক্ষার লড়াই। কোন অশুভ শক্তির ভয়ে আমরা পিছু হটব না। আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাব, আজ এই অঙ্গীকার করার দিন। আমি সবসময় আপনাদের সঙ্গে আছি এবং আমার বিশ্বাস যে আপনারাও সদাসর্বদা সঙ্গে থাকবেন।…..’
একটানা বলেই গেলাম। কিভাবে কী বলছিলাম নিজেই জানিনা। নিজের এই ক্ষমতা দেখে নিজেরই চমক লেগে গেল। কোনদিন জানতামই না যে আমার এমন লম্বা বক্তৃতা দেওয়ার প্রতিভা রয়েছে। আমার কথা শুনে জনতা সহর্ষে হাততালি দিতে লাগল। বক্তৃতা শেষ হলে পর সবাই ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। জনতা উত্তাল হয়ে গেল। অনেকেই বড় বড় মালা এনে পরিয়ে দিল গলায়। সবাই বলতে লাগল যে বক্তৃতায় জনজাগরণের যে ডাক দিলাম তা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। শুনতে মন্দ লাগছিল না। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছিল। জানতামই না যে এত লোক আমাকে নিয়ে মাতামাতি করতে পারে। আবার আমার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে সমস্বরে সবাই চিৎকার করছিল ‘জগঝম্প জিন্দাবাদ’ বলে। এই জায়গাটাতে একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। সবাই আমাকে কেন জগঝম্প বলছে ? আমি আবার কবে থেকে জগঝম্প হলাম ? আসলে জগঝম্প কে আমি জানতামই না। তবে সবাই যখন জগঝম্প ভেবেই আমাকে নিয়ে মাতামাতি করছিল তাতে কোন আপত্তিও করলাম না। ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছিলাম। নিজেকে নিয়ে মাতামাতি কার না পছন্দ ?
শিগগিরই একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল। জনতার উল্লাসের একপ্রান্তে দেখা গেল একটা বিজাতীয় হট্টগোল। তাদের মুখেচোখে দেখতে পেলাম ত্রাস এবং তারা হঠাৎ সবাই পালতে শুরু করল। সবার মুখেই ‘পালাও-পালাও’ রব। এমনকি, মঞ্চে উপস্থিত এবং আমার কাছাকাছি থাকা লোকগুলিও দেখলাম পিঠটান দিতে ব্যস্ত। তখন বুঝতে পারলাম কারা যেন বাঁশ-লাঠিসোটা নিয়ে রে-রে করে তেড়ে আসছে। সেই মারমুখী জনতাকে দেখে জগঝম্প-প্রেমী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। প্রচুর ইট-পাথর বৃষ্টি হতে লাগল। মারমুখী জনতার মুখে আস্ফালন,
‘ধর্ ব্যাটা জগঝম্পকে। ওটাই যত নষ্টের গোড়া। লোকজনকে খেপিয়ে দিচ্ছে।’
আমি দেখলাম, মহা বিপদ। আমার অনুগামী জনতা হাওয়া হয়ে গেছে। মঞ্চে কেবল আমি একা। আমাকে দেখতে পেল মারমুখী জনতা। আমার দিকে তেড়ে আসতে আসতে তারা বলছিল,
‘ওই তো, ওই তো জগঝম্প। ধর্ ধর্, মার্ ব্যাটাকে। মেরে শুইয়ে দে।’
বেগতিক দেখে আমি পালাবার কথা ভাবলাম। কিন্তু পালাব কোথায় ? আমাকে ঘিরে ধরেছে মারমুখী জনতা। ওদের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছিল তক্ষুণি ধরে আমায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি নিজেকে লুকোবার জন্য মাইক স্ট্যান্ডটার আড়ালে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। মোটেই জুতসই হলনা। উপায়ান্তর হয়ে একটা চেয়ারের তলায় ঢুকতে গেলাম। তাতেও বিশেষ সুবিধে হল না তেমন। তখন যা হয় হোক ভেবে মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নামলাম। নেমে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম মারমুখী জনতার হাতে। এইবার গেছি, আর রক্ষে নেই ভাবছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, মারমুখী জনতা আমাকে হাতে পেয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল। আমাকে ঘিরে তারা একের পর এক বলছিল,
‘এইযে শার্দুলদা, তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ ? তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান।’
‘তোমাকে দেখতে না পেয়ে ভাবছিলাম শার্দুলদা, বুঝি জগঝম্পর লোকরা ধরে নিয়ে গেছে।’
‘বল শার্দুলদা, এবার কী করব ?’
জনতা বেশ উত্তেজিত। আমাকে নিয়ে তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। সবাই আমি কী বলি শোনার অপেক্ষায়। দেখে মনে হচ্ছিল, আমি বললে তারা আমার জন্য যেকোন কাজ করে ফেলতে পারে। আমি কিছু বলছি না দেখে তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। আমাকে উত্তক্ত করে মারছিল কিছু বলার জন্য। আমার কাছে তারা কোন নির্দেশ পেতে চায়। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগছিল আমার। তারপর অপেক্ষমান জনতাকে উদ্দেশ্য করে নেতার মত হাত তুলে বললাম,
‘ব্যাটা জগঝম্প পালিয়ে গেছে। ওটাকে ধরতে পারলাম না। ধরা উচিত ছিল।’
নিজের এই পরিবর্তন দেখে নিজেই চমকে গেলাম। একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম যে পরিবর্তনটা জোরাজুরি করে নয়, আপনা থেকেই হয়ে গেছে। যে কথাগুলি বললাম তা নিজে থেকেই মুখে এসে গিয়েছিল। আমার কথা শুনে জনতার কয়েকজন আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক শার্দুলদা, জগঝম্পটাকে ঠিক ধরে ফেলব। পালাবে কোথায় ? এখন তুমি যা বলবে তাই করব।’
আমি নিজের মধ্যে বিজাতীয় উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। কেমন একটা উল্লাস আর আক্রোশের মিশ্রণ। আমার মানসিকতা পাল্টে গেছে। রণং দেহি মনোভাবের শিকার মনে হচ্ছিল নিজেকে। বিদ্বেষের গলায় চিৎকার করে বললাম,
‘মঞ্চ ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’
জনতা হৈ-হৈ করে ভাঙচুর চালাতে লাগল। নিজেকে আমার বড় বেশি অশান্ত লাগছিল। ভিতরে প্রবল ধ্বংসাত্মক ইচ্ছে। সেই ইচ্ছের প্রকাশ ঘটালাম পরবর্তী নির্দেশের মাধ্যমে,
‘সবকিছুতে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও।’
আদেশ শোনামাত্রই জনতা আগুন ধরিয়ে দিল। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আগুন। উন্মত্ত জনতার সঙ্গে আমিও নৃত্য করতে লাগলাম।
এমনই সময় হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। নতুন একটা কিছু ঘটতে চলেছে বোঝা যাচ্ছিল। হিংসাশ্রয়ী জনতার মধ্যে অন্যরকম চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল। কয়েকজন চেঁচিয়ে বলল,
‘পুলিশ আসছে, পুলিশ আসছে।’
মারমুখী জনতাকে দেখলাম পালিয়ে যাচ্ছে। যারা এতক্ষণ আমাকে নিয়ে লাফালাফি করছিল তারা দেখা গেল আমার কথা ভুলে নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত। পুলিশের ভয়ে যে যার মত পিঠটান দিতে লাগল। কয়েকজন নিজেরা পালাবার আগে আমাকে বলে গেল,
‘শার্দুলদা পালাও। পুলিশ এসে গেছে। পুলিশে ধরলে কিন্তু আর রক্ষে নেই।’
আমি কেমন যেন বোকা বনে গেলাম। কেন পালাব, কোথায় পালাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি কে বা কী সেটাও নিজের কাছে রহস্য হয়ে ঝুলে রইল। আমি জগঝম্প, নাকি শার্দুল ? কেমন এক ছন্নছাড়া সমস্যার শিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বোকার মত। আমার অনুগামী জনতা পালিয়ে গেছে আমার কথা ভুলে। তখন আমার চেতনা ফিরল। বুঝতে পারলাম যে এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেই উচিত কাজ হচ্ছে না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আমাকেই সবকিছুর জন্য দায়ী বলে ধরে নেবে। আমি জগঝম্প হই আর শার্দুল হই, তার জন্য কোন খাতির পুলিশের কাছে পাব না। এসব ভেবে পালতে যাব তো পুলিশ এসে আমাকে ঘিরে ধরল। পালাবার আর কোন উপায় রইল না।
এবার গিয়ে জেলে ঘানি ঘোরাতে হবে, ভাবছিলাম। কিন্তু পুলিশের ব্যবহার আমাকে তাজ্জব করে দিল। তারা কোথায় এসে আমাকে হাতকড়া পরাবে, কোমরে দড়ি বেঁধে গাড়িতে নিয়ে তুলবে তা নয়, উল্টে সবাই মিলে আমাকে স্যালুট ঠুকতে লাগল। সবাই মিলে আমাকে এসে বলছিল,
‘স্যার, সবক’টা শার্দুলের লোক। পালিয়ে গেছে।’
‘খুন-জখম হয়নি কিছু স্যার। মারামারিও হয়নি।’
‘জগঝম্পর মিটিঙে শার্দুলের হামলা, এ তো নতুন কিছু নয় স্যার।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন পুলিশগুলি সবাই আমাকে ‘স্যার-স্যার’ করছে, কেনইবা সবাই মিলে আমাকে স্যালুট ঠুকছে। এমন সময় একজন পুলিশ এসে আমার হাতে একটা মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘স্যার, বড়সাহেবের ফোন। আপনাকে আপনার মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না বলছেন। জরুরি কথা আছে।’
সবকিছু ঘটে যাচ্ছে যেন কেমন-কেমন! বড়সাহেবটা কে, কোনজন্মে তাকে চিনিনা। সে কেন আমার সঙ্গে কথা বলবে ? আর কী বা বলবে ? যদি বা বলেও আমি কী বলব ? কিছুই বুঝতে না পেরেও মোবাইল ফোনটা হাতে নিলাম। কানে দিয়েই দেখলাম ফোনের সামনে কে যেন আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল,
‘হ্যালো স্যার, এখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। শার্দুল তার দলবল নিয়ে পালিয়ে গেছে। কোন ক্যাজুয়ালটি নেই স্যার। কেউ চোট-আঘাতও পায়নি।’
ও প্রান্ত থেকে বড়সাহেব জিজ্ঞেস করল,
‘সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ?’
‘শার্দুলের লোকরা আগুন-টাগুন লাগিয়েছে, ভাঙচুর করেছে।’
‘কাউকে কি ধরতে পেরেছ ?’
‘না স্যার।’
‘শোন কাশ্যপ, ধরতে পারলেও ধরবে না। ভাব দেখাবে যেন ধরতে চেষ্টা করেছ অথচ ধরতে পারোনি। তোমার সঙ্গে যারা গেছে তাদের ওখানে পোস্টিং করে তুমি একা জীপ নিয়ে চলে এস আমার কাছে।’
‘ওকে স্যার।’
বুঝলাম যে আমার নাম কাশ্যপ আর আমি এক পুলিশ অফিসার। ঘটনা যা যা ঘটছে আর যেভাবে ঘটছে কোনটাই আমার বিরুদ্ধে যাচ্ছে না। ঘটনাগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার পরিবর্তন ঘটে চলেছে কেবল আমারই অনুকূলে। যাতে আমি বিপদে না পড়তে পারি তেমনভাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাকে কী করতে হবে বা বলতে হবে সেসব নিজে থেকেই হয়ে যাচ্ছিল। আমাকে একেবারেই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছিল না।
বড়সাহেবের নির্দেশমত জীপ নিয়ে আমি একা বেরিয়ে গেলাম, অধঃস্তন ঘোষবাবুকে ওখানে থাকার দায়িত্ব দিয়ে। আমি তো জীপ নিয়ে একা চললাম, কোন চিন্তা না করে নিজেই গিয়ে বসলাম ড্রাইভারের আসনে। আর স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে গাড়িটা চালু করলাম। পা অ্যাক্সিলারেটরে রাখতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। নিজেই নিজের কীর্তি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বারে বা, আমি গাড়ি চালাতে শিখলাম কবে ? দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, পুরোদস্তুর পাকা হাত। জীবনে এই প্রথম আমার গাড়ি চালানো, এই প্রথম স্টিয়ারিং-এ হাত। নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না।
একটা জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে এসে জীপ থামালাম। জঙ্গলটা গোড়ায় হালকা মনে হলেও আসলে তা নয়। শহরের পরিবেশ ছেড়ে কেন এখানে এলাম নিজেও জানিনা। কেউ আমাকে দিয়ে করিয়ে যাচ্ছে কাজগুলো। আমি এক বা একাধিক অদেখা অস্তিত্বের ইচ্ছের অধীন। তাদের ইচ্ছেগুলিই মনে হচ্ছে নিজের ইচ্ছে। আমার কোন মৌলিক ইচ্ছে আছে কিনা তার হদিশ জানা নেই আমার।
জীপ থেকে নেমে সাবলীল পায়ে মনের আনন্দে জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। কেন ঢুকলাম তা অবান্তর প্রশ্ন। বেশ পা চালিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম গভীরে। তারপর একটা মোটাসোটা গাছ সামনে পেয়ে তাতে চড়তে শুরু করলাম। এর আগে আমি আর কোনদিনও গাছে উঠিনি। গাছে কিভাবে চড়তে হয় শিখিওনি কোনদিন। কিন্তু এখন দেখলাম, তার জন্য কোন অসুবিধেই হল না। দিব্যি তরতরিয়ে গাছে উঠে গেলাম। তারপর মগডালে উঠে অবলীলাক্রমে এ-ডাল থেকে লাফিয়ে অন্য ডালে চলে যেতে লাগলাম। তারপর এ-গাছ থেকে অন্য গাছে। এমনভাবে ডালে ডালে আর গাছে গাছে ঝাঁপাঝাঁপি করছিলাম যে মনে হচ্ছিল চিরকাল এভাবে থাকতেই আমি অভ্যস্ত।
একদল বাঁদরের সঙ্গে আমার দেখা হল। তারাও আমার মতোই গাছে গাছে দাপাদাপি করছিল। আমাকে দেখে সবক’টা বাঁদর এসে ঘিরে ধরল। তারা প্রবল বিক্রমে কিচির-মিচির শুরু করে দিল। বুঝতে পারলাম, আমাকে তারা একেবারেই পছন্দ করছে না। সবাই মিলে আমার চারপাশে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিয়ে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। ভেংচি কাটছিল, দাঁত খিঁচিয়ে নিজেদের অপছন্দ প্রকাশ করছিল। কিচ-মিচ করে বাঁদরের ভাষায় তারা বলছিল,
‘যা যা ভাগ্, এটা আমাদের এলাকা। এখানে তোর জায়গা হবে না। তোর এলাকায় তুই যা।’
‘জায়গাটা তোদের কেনা নাকি ? আমার খুশি আমি এখানেই থাকব।’
বললাম কথাগুলি এবং বলেই অবাক হয়ে বুঝলাম যে কথাগুলি মানুষের ভাষায় বলছি না। বলছি বাঁদরদের মত কিচমিচ করে। ব্যাপারটা কী হল বুঝে ওঠার আগেই বাঁদরগুলি মারমুখো হয়ে তেড়ে এল। বলছিল তারা,
‘মেরে দাবনা ভেঙে দেব। আমাদের এলাকায় এসে মস্তানি ? কেন, নিজের এলাকা ছেড়ে এলি কেন ? লেজ তুলে ভাগ্ এখান থেকে।’
তখন খেয়াল হল, বাঁদররা কী বলছে সেটাই বা আমি বুঝতে পারছি কিভাবে ? আর বাঁদরগুলো এলাকা-এলাকা বলছে কেন ? কেনইবা আমার লেজের কথা উল্লেখ করল ? হাত দিয়ে দেখি, ও হরি, সত্যিই আমার একটা লেজ গজিয়ে গেছে। প্রবল বিস্ময়ে নিজেকে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। দেখি, কিভাবে কখন আমিও একটা বাঁদর হয়ে গেছি। এখন বুঝলাম, কেন অত সহজে গাছে উঠে গিয়েছিলাম আর কেনইবা ডালে ডালে বা গাছে গাছে অত সহজে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারছিলাম। আসলে আমি নিজেই একটা বাঁদর হয়ে বসে আছি !
বাঁদরগুলি দল বেঁধে সত্যিই আমাকে মারধর করতে উদ্যত হল। তাদের মতিগতি একেবারেই সুবিধের ঠেকছিল না। এতগুলি বাঁদরের সঙ্গে একা লড়াই করে পেরে উঠব না কিছুতেই। অতএব আমি পালতে লাগলাম। লাফ দিয়ে এ-গাছ থেকে ও-গাছে। কিন্তু রেহাই পেলাম না। সবগুলি বাঁদর আমাকে প্রায় ধরে ফেলল। মরীয়া হয়ে আমি একটা শেষ লাফ দিলাম, অনেকদূরের একটা গাছ লক্ষ্য করে। বাঁদর হলেও লাফিয়ে অতোদূরের গাছে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। মাঝপথেই আমি নিচে পড়তে লাগলাম। অত উঁচু থেকে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত জানতাম। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললাম। আর তখনই অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমি দিব্যি পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছি।
আমি একটা পাখি হয়ে গেলাম। কী পাখি কেমন পাখি বুঝতে না পারলেও উড়তে পারছিলাম স্বচ্ছন্দে। বাঁদরগুলোর হাত থেকে এভাবেই বেঁচে গেলাম। ততক্ষণে বিকেল এসে গেছে। একটু পরই বিকেল ফুরিয়ে রাত হয়ে যাবে। পাখি তো হয়ে গেলাম, এবার যাব কোথায় ? এখন তো উড়ে বেড়াচ্ছি দিব্যি, কিন্তু অন্ধকার আকাশে তো উড়ে বেড়ানো যাবে না। কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজতে হয়। কোন একটা গাছ, যেখানে অন্য পাখিরা থাকে একসঙ্গে। কিন্তু ওই পাখিগুলি যদি বাঁদরদের মত তাদের ঝাঁকে আমাকে না থাকতে দেয় ? উড়তে উড়তে চিন্তা করতে লাগলাম। কোথায় যে উড়ে যাচ্ছি তা-ও বুঝতে পারছিলাম না। তারপর সন্ধের একটু আগে এক কাণ্ড হল। নিজেরই অজান্তে আমি নেমে এলাম মাটির কাছাকাছি। চারপাশ কেমন চেনা-চেনা ঠেকল। আর তখনই ঝুপ করে আমি পড়লাম মাটিতে এবং আবিষ্কার করলাম যে আমি আবার আমি হয়ে গেছি। দাঁড়িয়ে আছি আমারই বাড়ির দরজায়।
সারাদিন এভাবে আমি এক চেহারা থেকে অন্য চেহারায় রূপান্তরিত হতে হতে নানা পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাম। এইযে আমার এত চেহারা পাল্টানো তা কেন ঘটল যদিও তার আপাত কারণ কিছু ছিল কিন্তু কিভাবে ঘটল তার উত্তর একেবারেই খুঁজে পেলাম না। একেক পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে আমার চেহারা এভাবেই পাল্টে যায়। এই পাল্টে যাওয়া অবশ্যই আমার অনুকূলে থাকে। চেহারা না পাল্টালে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাকে বিপদে পড়তে হত। কিন্তু যতটুকু জানি, কোন অবস্থাতেই আমি নিজের ক্ষমতায় নিজের চেহারা পরিবর্তন করতে পারিনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চেহারা পরিবর্তনের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি জানতাম না কী ঘটতে যাচ্ছে। তাহলে কে আমার চেহারা এভাবে পাল্টে পাল্টে দিচ্ছিল ? যেহেতু আমার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এসব পরিবর্তন ঘটল না আমি তাই ভিতর থেকে কোনটাকেই মেনে নিতে পারিনি। যদিও প্রতিকূল অবস্থা থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য অজান্তে কেউ এভাবে আমার বহিরঙ্গের রূপ পাল্টে ফেলছিল, কিন্তু সে তো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এরকম অনিচ্ছাকৃত বাধ্যতামূলক পরিবর্তনকে কোনমতেই সমর্থন করা যায় না। আমি তাই মনে করি, এমন পরিবর্তন এক ধরণের বিপর্যয়। এই বিপর্যয় অহরহ ঘটে চলেছে আমার জন্য আর এটাকেই আমি অসুখ বলে ভাবি। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)