তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায়: আট
‘যে লোকগুলো রোজ ঘর থেকে বেরোয় সকালবেলা তারা কি সবাই আবার ঘরে ফেরে রাতের আগে বা রাতে ?’
রিক্ত প্রশ্নটা রাখল আমার জন্য। আমরা যথারীতি অভিযানে বেরিয়েছি। মানুষ দেখার অভিযান। সব মানুষ তার নিজের চেহারায় বাস করে না সারাজীবন। সবাই তার নিজের পছন্দমত ব্যক্তি বাছাই করে হামেশাই তার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে জীবন কাটায়। সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। এই যে মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি, এক মানুষের অন্য মানুষ হয়ে যাওয়া, এটা কিভাবে ঘটে চলেছে তারই অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম আমরা। কখন কে কোন্ মানুষ হয়ে যাবে তার কোন নিয়মনীতি নেই। যে কেউ হতে পারে যে কেউ। কেউ কারোও যে কেউ হয়ে যাওয়া আটকাতে পারে না। জানলে তো আটকাবে। কে কী হবে কেউ জানে না। এমনকি, যে হচ্ছে অন্য কেউ সে পর্যন্ত কে হতে যাচ্ছে কেন হতে যাচ্ছে হওয়ার আগে বা হলে পরেও বোঝে না। আর সেই অন্য কেউও বোঝে না কে বা কারা তার মধ্যে এসে আশ্রয় নিল। প্রকৃতির এ এক আজব খেলা। এই খেলায় সামিল সমস্ত মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষ অনবরত এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছে। অভিযানে বেরিয়ে আমরা দেখেছিলাম ডাকসাইটে নেতা হামবড়াই ঘপাতকে। তাঁর মধ্যে ছাপোষা মানুষ ভূপতি এসে বাসা বেঁধেছিল, তারপর নিজের ইচ্ছে আর আক্রোশ বাস্তবায়িত করছিল হামবড়াই ঘপাতের মাধ্যমে। ভুপতিই যে চালাচ্ছে হামবড়াই ঘপাতকে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল তাঁর বেয়াক্কেলে কর্মকাণ্ডের চরিত্র দেখে, যা ছিল ভূপতির ইচ্ছে আর আক্রোশের প্রতিফলন।
মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি কিভাবে ঘটে সেটা দেখতে আজ আবার বেরিয়েছি আমরা। পথ চলতে চলতে কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। একসময় রিক্ত আমাকে ওপরের ওই প্রশ্নটা করল। প্রশ্ন শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। পাল্টা প্রশ্ন তুললাম,
‘ঘরে না ফিরলে যায় কোথায় ?’
‘কোত্থাও যায় না, ঘরেই ফিরে আসে।’
পরস্পরবিরোধী কথা। আমি জানতে চাইলাম,
‘ঘরে ফেরে কিনা সেই সন্দেহ তো তুইই জানালি। আবার এখন বলছিস, ঘরেই ফিরে আসে। ঠিক কী বলতে চাইছিস তুই ?’
‘বুঝতে পারছিস না ? যারা ঘর থেকে বেরোয় তারা ঘরেই ফিরে আসে। আসবেই, যাবে আর কোথায় ? প্রশ্ন হল, ঠিক সেই মানুষগুলোই কিনা।’
‘তার মানে ?’
‘যারা ঘর থেকে বেরোয় আর যারা ঘরে ফেরে তারা দেখতে এক মানুষ হলেও আসলে এক মানুষ থাকে না। অন্য কেউ হয়ে যায়।’
‘তার মানে হরি ঘর থেকে বেরোল হরি হয়ে, ঘরে ফিরল যখন তখনও হরিই। কিন্তু সে আসলে হয়তো মাধব বা নেপাল হয়ে গেছে।’
‘ঠিক তাই।’
‘আর সেটা হরি বুঝতেও পারে না যে সে হরি নয়। সে আসলে মাধব বা নেপাল।’
‘বুঝতে পারে না বলেই মাধব বা নেপাল, যে হরির মধ্যে আশ্রয় নিল সে তার সাধ হরিকে দিয়ে মেটায়। হরি তখন যা করে তা আসলে হরি করে না, মাধব বা নেপাল করায় হরিকে দিয়ে।’
আমি কথা না বলে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। রিক্তও কিছু একটা ভাবছিল। খানিকটা সময় পর নীরবতা ভেঙে সে আপনমনে বলতে লাগল,
‘এই দুনিয়াতে কেউ নিজে কিছু করে না, তাকে দিয়ে অন্য কেউ কিছু করায়। কেউ নিজের ইচ্ছেয় চলে না, তাকে অন্য কেউ চালায়।’
আমি অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলাম,
‘এ আর নতুন কথা কী ? সাধক রামপ্রসাদ সেনই তো বলে গেছেন, তোমার কর্ম তুমি কর মা লোকে বলে করি আমি।’
‘তফাৎটা হল এই যে সাধক রামপ্রসাদ সব কাজের জন্য দায়ী করেছিলেন মা কালীকে। সার কথা হল, কালী মা একা দায়ী নয়, দায়ী অন্য লোকেরাও।’
‘তার মানে, আমি যে কাজ করছি তা আমি করছি না ?’
‘আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে অন্য লোক।’
‘আর আমি ভাবছি, আমি যা করছি সব স্বেচ্ছায় করছি। বুঝতেও পারছি না আমার মধ্যে ঢুকে বসে অন্য লোক তার নিজের ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিল আমাকে দিয়ে।’
‘সেটা তো তুই দেখলি ভূপতি আর হামবড়াই ঘপাতের ক্ষেত্রে।’
আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। রিক্ত একটু সময় কিছু একটা ভাবল। তারপর খানিকটা উদাসীন ভঙ্গিতে জানাল,
‘এই পৃথিবীতে সব মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। কেউ চায় না তার কোন বদনাম হোক, কেউ তাকে খারাপ বলুক। তবুও রোজ খবরে দেখা যায় খুনোখুনি, মারামারি, হিংসে, চুরিডাকাতি, রাহাজানি, অত্যাচার, উৎপীড়ন, অবিচার ঘটেই চলেছে। মানুষই করছে সেসব। কোন্ মানুষ ? সেই মানুষ যে চায় সবাই তাকে প্রশংসা করুক এবং যে জানে এসব অসামাজিক কাজ গর্হিত অপরাধ, যা করলে সবাই তাকে কেবলই নিন্দে করবে। ব্যাপারটা তোর অদ্ভুত মনে হচ্ছে না ? মনে হচ্ছে না বৈপরীত্যে ভরা ?’
‘অর্থাৎ কেউ যদি বিশুদ্ধ নিজের ইচ্ছেয় চলতে পারত তাহলে জগৎ জুড়ে এতসব খুনোখুনি, হিংসে, অত্যাচার, অপরাধ ঘটত না।’
‘কারণ কোন মানুষ চায় না সমাজ ছেড়ে বাস করতে।’
‘এবং অসামাজিক কাজ করতে।’
‘কেবল অসামাজিক নয়, কেউ চায় না এমন কোন কাজ করতে যা তাকে অন্যের চোখে খারাপ করে তুলবে। যে কাজের জন্য তার ভবিষ্যৎ নড়বড়ে হয়ে যাবে সে কাজ মানুষ কখনও করতে চাইবে না, কারণ তার বুদ্ধি আছে।’
‘অথচ জগৎ জুড়ে তেমন সব কাজই ঘটে চলেছে, মানুষই ঘটাচ্ছে।’
‘হামবড়াই ঘপাতের ক্ষেত্রেই দেখলি। অমন ঝানু লোক কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নিজের ভবিষ্যৎটা নিজেই মনের সুখে ধ্বংস করল।’
আমার মাথায় নতুন একটা কথা খেলল। রিক্ত থামতে বললাম,
‘ষড়রিপু বলেও একটা ব্যাপার কিন্তু আছে। তার তাড়নায় শুনেছি মানুষ হাবিজাবি কাজকর্ম করে। মানুষের মধ্যেই গভীরে লুকিয়ে থাকে ষড়রিপু। ডক্টর জেকিলের মধ্যে মিস্টার হাইড। সে ষড়রিপু প্রবল হলে তার তাড়নায় মানুষ নিজের বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। আর তখনই করে সব অসামাজিক কাজ। অর্থাৎ মানুষের নিজের গভীরেই ষড়রিপু হিসেবে বোনা আছে অসুস্থ অস্বাভাবিকতার বীজ। এমনটাও কিন্তু বলে সবাই। সেই বীজ থেকে চারা গজায় বিশেষ অনুকূল পরিবেশ আর পরিস্থিতি পেলে।’
‘সেই ষড়রিপু তো সবার মধ্যেই সুপ্ত। কিন্তু সবাই তো অসামাজিক হয় না ? সবাই কি খুন করে ? সবাই কি অন্যকে অত্যাচার করে নিজের আনন্দের জন্য ?’
রিক্ত যুক্তি দেখাল। আমিও পাল্টা যুক্তি সাজালাম।
‘আসলে সব মানুষের প্রকৃতি তো এক নয়। কেউ অপরাধপ্রবণ, কারো মধ্যে হিংসে বা আক্রোশ বেশি, কেউ নিরীহ প্রকৃতির। কেউ সাত চড়েও রা’ কাড়ে না, কেউ অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে যায়। কার কী মানসিক গঠন তার ওপর নির্ভর করে কে কী করবে বা কেমন হবে।’
‘সেটা অন্য ব্যাপার। তুই যা বলছিস তা ঠিক। কিন্তু আমি অন্য একটা অজানা দিক নিয়ে বলছি। আমি বলছি, যে যতই খারাপ হোক বা যতই তার কুবুদ্ধি থাকুক বা যতই সে ষড়রিপু বা নিজস্ব অশুভ প্রকৃতির তাড়নায় বাধ্য হোক না কেন অন্তর থেকে নিজেকে খারাপ ভাববে না বা সমাজ তাকে বহিষ্কার করে দিক চাইবে না। প্রত্যেক মানুষেরই বুদ্ধি আছে, তার পুরোটাই অশুভ হতে পারে না। উচিত-অনুচিত বোঝে মানুষ। ষড়রিপুর তাড়নায় বা প্রকৃতিগত অস্বাভাবিকতায় কোন অনুচিত কাজ করতে গিয়ে একবার হলেও পরিণাম নিয়ে ভাববে, নিজের ভালমন্দ মাথায় থাকবে। তবুও সে যদি অসামাজিক কিছু করে বসে তো তুই বলবি সেটা শুভবুদ্ধির তুলনায় অশুভ বুদ্ধি প্রবল হল বলে। কিন্তু আমি অতদূর যাচ্ছি না, থাকছি আরও আগে। জন্ম থেকে মানুষের মানসিক গঠন ঠিক হয়ে যায় না। কোন্ মানুষ কেমন প্রকৃতির হবে তা ঠিক হয় পরবর্তী সময়ে। আমি বলছি, এই পরবর্তী সময়েই গোলমালটা হয়। ষড়রিপুর প্রাবল্য কারোও বেশি হলেও সেটা তার নয়, অন্যের। যত মানুষ বড় হতে থাকে তত তার মধ্যে অন্য মানুষরা বাসা বাঁধে একের পর এক। অন্যের বাসনা, অন্যের কামনা, অন্যের হিংসে-বিদ্বেষ, অন্যের অস্বাভাবিকতা তাকে তার নিজের মত থাকতে দেয় না। তাকে বানিয়ে দেয় অন্য মানুষ।’
‘তাহলে তুই বলতে চাস যে মানুষের চরিত্র পরিবেশ বা বংশগতির নিয়মে ঠিক হয় না ?’
‘আমি সেটা বলছি না। পরিবেশ বা বংশগতি কী করে কতটা করে সেসব অন্য বিতর্ক। আমি বলছি সম্পূর্ণ অন্য কথা। মানুষের রাগ, আক্রোশ, হিংসে, বিদ্বেষ, লোভ কোনোটাই তার নিজের নয়। তার মধ্যে ঢুকে বসা অন্য লোকেদের। তুই যে ষড়রিপুর কথা বললি সেটা হয়তো চরিত্রের একটা দিক, কিন্তু তা নিজে থেকে অত প্রবল হতে পারে না যার প্রভাবে মানুষ তেমন অপকর্ম করে ফেলবে যা তাকে অসামাজিক বানিয়ে দেবে। মানুষকে অমানুষ করে তোলে তার মধ্যে ঢুকে বসা অন্য লোকেদের অসুস্থ ইচ্ছে।’
আমি ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিন্তু কেউ বেশি অপরাধপ্রবণ হয় কেন ? কেউ আবার বেশি নিরীহ, তাই বা কেন ?’
‘সেটা নির্ভর করছে কার মধ্যে কোন্ স্বভাবের লোক বেশি এন্ট্রি পাচ্ছে তার ওপর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক লোক অন্য লোকের মধ্যে চলে যায় কেবল নিজেকে ছেড়ে অন্যত্র যেতে ভাল লাগে বলে। বিশেষ কোন অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই অন্য লোককে কেউ আশ্রয় করে নিজের সুপ্ত বাসনা মেটাবার জন্য, সেটা অপরাধমূলক হতে পারে আবার না-ও পারে। যদি আমি অপরাধপ্রবণ হই আর আমার মধ্যে যে এল তারও মনে সুপ্ত বাসনা রয়েছে অপরাধ ঘটাবার এবং যদি আমার ইচ্ছে আর তার ইচ্ছে মিলে যায় তো আমাকে দিয়ে অপরাধটা সংঘটিত হবেই।’
এইসব কথা বলতে বলতে আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। ইচ্ছে ছিল, কোন একজন লোক বাছাই করে নেব, তারপর দেখব সে কী করে। কোন বিশেষ লোককে বাছাই করার ইচ্ছে ছিল না, যে কোন লোক হলেই হয়ে যায়। তবে লোক বেছে নেওয়ার দায়িত্বটা আমি রিক্তর হাতেই ছেড়ে দিলাম। লোক তো আছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি। লোকের কোন অভাব নেই। কোন্ লোকটাকে বেছে নেব ? আমার আজকাল মানুষ দেখলেই অদ্ভুত সব অনুভূতি হতে থাকে। কোন মানুষকেই মানুষ মনে হয় না। আবার যাকে দেখছি তাকে ঠিক দেখছি কিনা, নাকি সে অন্য কেউ এই নিয়েও সন্দেহ হতে থাকে। চেনা লোকদেরও মনে হয় অচেনা। সবসময় এক ঘোর লাগা অবস্থা। কোন মানুষকেই মানুষ বলে মনে হয় না, মানুষ না হলে কী তাও বুঝতে পারি না। নিজেকেও সন্দেহ হয়। ভাবি, আমি লোকটা সত্যি আমি তো !
আমাকে নিয়ে আমার এই গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষ দেখার অভিযানে বেরিয়ে পড়েছি। মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি ঘটার বিষয়টা প্রত্যক্ষ করা খুবই আকর্ষণীয় ব্যাপার, দেখতে শুরু করলে নেশা ধরে যায়, দেখেই যেতে হয়। একটা গোটা মানুষ নিজেকে হারিয়ে অন্য মানুষ হয়ে গেল, তারপর সেই অন্য মানুষটার মত আচরণ করতে লাগল—- এই অদ্ভুতুড়ে প্রক্রিয়াটা চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না। আর অবিশ্বাস্য বিষয়ের ওপর আকর্ষণ তো থাকবেই।
আমরা যেতে যেতে এক জায়গায় খুঁজে পেলাম ধনপতি আর গণপতিকে। তারা একই পাড়ার বাসিন্দা। বাড়ি তাদের আলাদা হলেও পাশাপাশি অবস্থান। বয়স খুব একটা কমবেশি নয়। পার্থক্য রয়েছে চেহারাতে, তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্য টাকাপয়সার। ধনপতি যতটাই বড়লোক, গণপতি ততটাই গরীব। তাতে কোন সমস্যা ছিল না, কারণ ধনপতি যেমন কোনদিন ভেবে দেখতে যায়নি গণপতি কেন গরীব আর সে কেন ধনী তেমনি গণপতিও প্রথম প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাত না। সমস্যা তৈরি হল সেদিন থেকে যেদিন গণপতি ভাবতে লাগল কেন ধনপতি এত ধনসম্পদের মালিক হবে আর সে কেন তেমন বড়লোক হতে পারবে না। তার যেমন দু’টো হাত, দু’টো পা, একটা শরীর আর একটা মাথা ধনপতিরও তাই। তবে কেন তাদের অবস্থা এমন ভিন্ন হবে ?
এভাবেই একটা সমস্যার জায়গা তৈরি হল, ধনপতি সম্পর্কে গণপতির এমনিধারা ভাবনা থেকে। তার জন্য গণপতিকে যতটা দোষ দেওয়া যায় ধনপতিও খুব একটা কম দায়ী নয়। একই পাড়ায় পাশাপাশি বাড়ি দু’জনের। ধনপতির আগ্রহ না থাকতে পারে, কিন্তু তার সম্পর্কে গণপতির কৌতূহল থাকাটা নিন্দনীয় হতে পারে না। ধনপতির অঢেল সম্পদ, দোতলা বাড়ি প্রাসাদোপম, একাধিক শৌখিন গাড়ি। রোজ সে পাঁচতারা-সাততারা হোটেলে ঘুরে বেড়ায়, পোলাও-কোর্মা জাতীয় উপাদেয় খাবার খায়। আর গণপতি দু’বেলা পেট ভরাতেও পারে না ঠিকমত। ধনপতি আজ পর্যন্ত কোনোদিনও খোঁজ করেনি গণপতি কোথায় থাকে। কোনোদিনও ডেকে বলেনি,
‘অরে গণপতিবাবু, আসুন আসুন। আসুন আমার বাড়িতে। দু’টো ফিশফ্রাই এনেছি। একটা আপনার জন্য আর একটা আমার। চলুন, খেতে খেতে গল্প করা যাক।’
রাগ হওয়াটা কি অন্যায় ? একই পাড়ায় পাশাপাশি বসবাস দু’জনের। একজন ভীষণ উৎসুক, অন্যজনের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। গণপতি কেবলই চাইত ধনপতির খাতির পেতে অথচ ধনপতি ফিরেও তাকাতো না। ডেকে ভালমন্দ খাওয়ানো দূরের কথা, দু’টো কথাও তো বলতে পারত? পাড়ায় তো প্রায় রোজই মুখোমুখি হয় দু’জন, ধনপতি পাশ দিয়ে গাড়িতে চড়ে চলে যায় হুস্ করে আর গণপতি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে ভ্যাবলার মত। পাড়ার কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল, বাইরে কোথাও দেখা হলেও কি ভদ্রতা করেছে ধনপতি ? বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে শহরের অফিসপাড়ায় সেদিন বিকেলে বাস ধরে যাচ্ছিল গণপতি। পাশেই সারি সারি পার্কিং করা গাড়ি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সে দেখে ধনপতি এগিয়ে আসছে তার দিকে। চারপাশে সব অচেনা মুখ, একমাত্র চেনা মুখ ধনপতিকে দেখে তার খুব আনন্দ হল। খুব সে আশা করেছিল যে তাকে দেখে ধনপতি আল্হাদে আটখানা হয়ে যাবে। ধনপতি কী করল ? গটগট করে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল, একবার তাকাল না পর্যন্ত তার দিকে, সটান গিয়ে নিজের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে বসল। তাকে ডেকে একবার বলল না, ‘আরে গণপতিবাবু, আসুন আমার গাড়িতে। বাড়ি যাবেন বুঝি ? চলুন, একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাক।’ এসব তো আকাশকুসুম কল্পনা। শৌখিন গাড়িতে চেপে ধনপতি বাড়ি চলে গেল রাজকীয় মেজাজে আর গণপতি বাড়ি ফিরল ভিড়ের বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে। এরপর রাগ হওয়াটা কি অন্যায় ?
এরকম আশাভঙ্গের ঘটনা অনেক আছে। গত বছরই কী প্রবল অসুখে পড়েছিল গণপতি। একসময় মনে হয়েছিল আর বোধহয় বাঁচবে না। বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন, মাসের পর মাস। দু’-দু’বার হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল। কারো কাছেই তেমন কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। যারা তার জন্য সহানুভূতি জানিয়েছিল, কমবেশি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল তাদের অবস্থা তার চেয়ে ভাল ছিল না। এটা এক বিচিত্র ব্যাপার, সারাজীবন দেখেছে সে। যারা খুব দয়ালু মনে হয়, যারা উপযাচক হয়ে না বলতেই এগিয়ে আসে তাদের কারোরই তেমন কিছু ক্ষমতা নেই। তারা সব তার মতোই পথেঘাটে ঘোরা লোক। যাদের ক্ষমতা আছে তারা কখনও তার সঙ্গে ভাব জমাতে আসেনি। সে চিরকাল দেখেছে, যত ফালতু লোকজন তাকে সবসময় সহানুভূতি জানবার জন্য রেডি থাকে। যত বেকার লোক সে না চাইতেই সহানুভূতি জানাতে এগিয়ে আসে। একজনও কাজের লোকের সহানুভূতি পায়নি সে কোনদিন। যেমন, ধনপতি। একই পাড়ায় পাশাপাশি বাড়িতে থাকে তারা। একদিনও কি তার খোঁজ নিতে এসেছিল সে ? ডাক্তার দেখানো, ওষুধপথ্য কিনে দেওয়ার কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল। একবার অন্তত এসে একটু খোঁজ নিয়ে দু’টো কথা বললেই তো প্রাণ জুড়িয়ে যেত।
এক এক করে এমনসব ঘটনা বলতে গেলে শেষ হওয়ার নয়। বছরের পর বছর ধরে ঘটেছে এসব ঘটনা। গণপতি কি প্রথম থেকেই এমন ক্রুদ্ধ ছিল নাকি ? ধনপতিকে সে আগে একদমই হিংসে করত না। তার সম্পদের ওপরও কোন লোভ ছিল না। তবুও বেয়াক্কেলে ধনপতি তার আচারে-ব্যবহারে নিজেকে গণপতির কাছে অপ্রিয় করে তুলেছে। এখন এমনই অবস্থা যে ধনপতিকে দেখলে তার মুখ ঘুরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। মুখ ঘুরিয়ে নেয়ও, আবার পরক্ষণেই ধনপতি কী করছে কোথায় যাচ্ছে জানার আগ্রহ জেগে ওঠে মনের ভিতর। এ এক হরিবোল সমস্যা। ধনপতিকে সে বিন্দুমাত্র পছন্দ করে না, অন্যদিকে সব ফেলে সারাদিন ধনপতির খোঁজখবর রাখে। অবশ্য মুখোমুখি হওয়ার বা যেচে কথা বলার কোন বাসনা সে অনুভব করে না, সাহসও পায় না।
ধনপতির প্রাসাদোপম দোতলা বাগানওয়ালা বাড়ি। পুরো বাড়ি চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটে বসে বা দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় পাহারাওয়ালা। দূর থেকেই দেখে গণপতি। বেশি কাছাকাছি যাওয়ার সাহস পায় না। দু’-একবার চেষ্টা করেছিল গেটে দাঁড়ানো পাহারাওয়ালাটার সঙ্গে ভাব জমানোর। লোকটা পাত্তাই দেয় নি। তাতে তার রাগ আরও বেড়ে গেছে। বাড়ির গেটে পাহারাদার কেন ? ধনপতি কি মনে করে বাড়ির গেটে পাহারা না বসালে গণপতি বাড়ির ভিতরে ঢুকে যাবে ? এ কেমন অন্যায় ভাবনা ? আরে বাবা, গণপতি তোর প্রতিবেশী। সে চোর-ছ্যাঁচোড় নয়। প্রতিবেশীর সঙ্গে এ কী রকম ব্যবহার ? তুই কি বুঝতে পারছিস না এতে গণপতির রাগ উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছে ? রাগ যদি এভাবে বাড়তেই থাকে তোর কি তাতে বিপদের আশঙ্কা নেই ? নাকি ধনসম্পদের প্রাবল্য তাকে শিখিয়েছে সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে ?হয়তো সে ভাবে, গণপতি আবার একটা মানুষ নাকি ! তার থেকে আবার বিপদের ভয় ? গণপতির নামটাও সে জানে কিনা সন্দেহ, তাকে দেখেওনি সম্ভবত কোনওদিন। এতটাই হেলাফেলা, এতটাই দম্ভ। এসব কথা ভাবলে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে যায়। রাগটাও বাড়তেই থাকে।
আরও অনেক লোকজন রয়েছে ধনপতির। ড্রাইভার, রাঁধুনি, চাকর ইত্যাদি। তারা সব মাইনে করা লোক, সবসময় মনিবের মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী কাজ করে। খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই, কাজকর্মের চিন্তা নেই। ধনপতির সারাটা জীবন কেবল সুখ আর সুখ। সকালে ঘুম থেকে উঠে ছোটরে, চেঁচাওরে, মাথা কোটরে জাতীয় কিছুই করতে হয়না তাকে। সে একবার বাক্যব্যয় করলেই হাতের কাছে সব হাজির। লোকরা সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য, তার কাজ করতে পারলে ধন্য মনে করে নিজেদের। আহা, কতজন্মের পুণ্য থাকলে এমন জীবন পাওয়া যায়! গণপতি দূর থেকে দেখে লোলুপ দৃষ্টিতে আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। রাগ আর হিংসে আছে তার ষোলআনা, তবে মাঝেমধ্যে সে দার্শনিক ভাবনাতেও আচ্ছন্ন হয়। ভাবে, হিংসে করে কী হবে, রাগ করাটাও অর্থহীন। আসলে তার নিজের ভাগ্যটাই খারাপ। তার কপালে কিছুই নেই। সে তো ধনপতির মত সম্পদের অধিকারী হতেই পারত। তারও যদি দশজনের কাছে প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকত তো কে আটকাত ? তার জন্য কপাল চাই। ভাবে আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে।
ধনপতি আর গণপতির পিছু নিয়েছিলাম আমরা। দিন কয়েক দেখে বুঝতে পারলাম, ধনপতির জীবনযাপন গণপতির কাছে কতটা আদরণীয়। সে যদি ঐরকম কেউ হতে পারে তো বর্তে যাবে। আমি নিশ্চিত হলাম, গণপতি প্রবলভাবে ধনপতি হতে চায়। আর চোখের সামনে ঘটতে চলেছে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া। ঘটবেই, এবং কিভাবে ঘটে তা দেখার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। একদিন ঠিক দেখতে পাব, গণপতি হয়ে গেছে ধনপতি। রিক্তকে বললাম,
‘গণপতি তো বোঝাই যাচ্ছে ধনপতি হয়ে যাবে। ধনপতি কী হতে চায় বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্যই গণপতি হবে না। তবে গণপতি নিজেকে পাল্টে ধনপতি করে নেবে এটা পরিষ্কার।’
রিক্ত আমাকে কিছুটা তিরস্কারের গলায় বলল,
‘তুইও যেমন! দেখছিস ধনপতি লোকটাকে গণপতি রীতিমত ঘেন্না করে। সে যাবে ধনপতির মধ্যে থাকতে ? পাগল নাকি!’
আমি হকচকিয়ে গেলাম। মাথা চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তাহলে পাল্টাপাল্টি হবে কী করে ? এই দু’জনের পিছনে এত ঘোরাঘুরি করাটা কি মাঠে মারা গেল ?’
‘পাল্টাপাল্টি হবেই। কাদের মধ্যে হবে কিভাবে হবে এখনই তা বোঝা না গেলেও খুব শিগগিরই তা ঘটবে। তার জন্য আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
মাথায় কিছু ঢুকল না। গণপতি খুবই পছন্দ করে ধনপতির জীবন আবার একইসঙ্গে সে তাকে প্রচণ্ড অপছন্দও করে। সে তাই ধনপতি হবে না রিক্তর যুক্তি অনুসারে। আবার ধনপতি কোনদিন চোখ তুলে দেখেওনি গণপতিকে। সে তাই গণপতি হওয়ার ইচ্ছে দেখাতেই পারে না। তাহলে পাল্টাপাল্টিটা হবে কী করে ?
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)