তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায়: পাঁচ  

আমি রিক্তকে গিয়ে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা, আমি কি মানুষ ?’

রিক্ত আমার দিকে সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকাল। জানতে চাইল,

‘এই প্রশ্ন কেন করছিস ?’

‘তোর সঙ্গে থেকে দেখেছি অনেকেই দেখতে মানুষের মত হলেও অন্যরকম কিছু ব্যাপার থাকে। আমার মধ্যেও দেখছি কিছু অস্বাভাবিক বিষয়। তাই সন্দেহ হচ্ছে আমিও মানুষ কিনা।’

‘কী বিষয় দেখলি তোর মধ্যে ?’

‘একটা নয়, অনেকগুলো বিষয়।’

‘একটাই বল্ শুনি।’

‘যেমন, আমার রঙ পাল্টে যাচ্ছে।’

‘রঙ পাল্টায় সবাই। এতে ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। কেউ বাচ্চা বয়সে ফর্সা থাকে, বড় হলে কালো হয়ে যায়। কেউ আবার মেকাপ করেও রঙ পাল্টায়।’

‘মেকাপের ব্যাপার নয়।’ আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, বাচ্চা বা বড়োর কথাও বোঝাচ্ছি না। তাতে সময়ের ফারাক থাকে। আমি বলছি অন্যরকম রঙ পাল্টানোর কথা। একটা নির্দিষ্ট বয়সে কেউ কি ঘন ঘন রঙ পাল্টায় ?’

‘পাল্টাতে পারে। নির্ভর করছে পরিবেশ আর পরিস্থিতিটা কী।’

‘কী বলছিস ? একটা লোক কালো, সে হঠাৎ সাদা বা সবুজ হয়ে যেতে পারে ?’

‘পারে।’

‘আমি কোনজন্মে দেখিনি।’

‘দেখিসনি কারণ তুই ভালমত লক্ষ রাখিসনি। ঠিকমত নজরে রাখলে দেখতে পেতিস যে হামেশাই লোকেদের রঙ পাল্টে পাল্টে যায়।’

‘একটা ফর্সা লোক। সে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই ফস করে কালো হয়ে যাবে ?’

‘কালো বা হলদে বা সবুজ বা লাল, পাল্টে যেকোন রঙের হয়ে যেতে পারে।’

 রিক্ত নির্বিকার ভাবে বলল। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিজের অবিশ্বাস আর বিস্ময়টা প্রকাশও করলাম,

‘একটা লোক যখন-তখন রঙ পাল্টে পাল্টে সবুজ, হলুদ, বেগুনি, লাল হয়ে যেতে থাকে আর তুই বলছিস দেখেও সেটা আমি বুঝতে পারি না ?’

‘তুই একা কেন, কেউ বুঝতে পারে না। বা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভাণ করে। আর নয়তো দেখেও দেখে না।’

‘কেন ? এমন কেন করে ?’

‘না করে উপায় কী ? বলতে গেলে হাজার ঝামেলা। কেউ যে রঙ পাল্টে ফেলছে সেটা তো প্রমাণ করার কোন রাস্তা নেই। তাই সবাই চুপচাপ থাকে।’

আমিও চুপচাপ হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হজম করতে পারছিলাম না। আমার অসহায় অবস্থা দেখে রিক্ত বলল,

‘ব্যাপারটা না দেখলে তুই বুঝতে পারবি না। চল্, তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।’

আমরা ত্রিলোচন সমাদ্দারকে বাছাই করলাম। ত্রিলোচন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে অফিসে যাচ্ছে। সকালবেলা। রিক্ত তাকে দেখিয়ে আমাকে বলল,

‘লোকটার রঙ এখন কেমন দেখে রাখ্।’

দেখলাম। বাসে চেপে অফিসে ঢোকার আগে পর্যন্ত তাকে দেখেই গেলাম। তার রঙ যেমন ছিল তেমনই রইল। অফিসে ঢোকার পরও পাল্টালো কই ? নিত্যদিনের মত নিজের জায়গায় নিজের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করল। সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা হল কিছু। তারপর তার ডাক এল বড়সাহেবের ঘর থেকে। তড়িঘড়ি উঠে সে পা বাড়াল। বড়সাহেবের ঘরে গিয়ে সে ঢুকল, অনুমতি নিয়ে। আর তখনই আমার অবাক চোখের সামনে তার রঙ পাল্টে গেল। 

বড়সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তখন তার আবার অন্য রঙ। একটু পর সহকর্মী মলয় এসে বসল তার পাশে। বড়সাহেবের প্রশংসা করতে লাগল দু’জনে মিলে। ত্রিলোচনের রঙ তখন অন্যরকম। তার আধঘন্টা পরে ভূদেব এল তার কাছে। তারা দু’জনে নিচু গলায় বড়সাহেবের নিন্দে করতে লাগল। ত্রিলোচনের রঙ আবার পাল্টে গেল। দ্বিতীয়ার্ধে অফিসে কাজের চাপ কম, লোকজনও আগের মত নেই। বড়সাহেব অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায় ঢিলেঢালা ভাব। ত্রিলোচনের সঙ্গে দেখা করতে এল একজন বাইরের লোক। রঙ আবার পাল্টে গেল। লোকটার কথা শুনে বোঝা গেল যে তার ফাইল আটকে আছে ত্রিলোচনের টেবিলে। সেই নিয়ে কথাবার্তা চলল খানিকটা সময়। তারপর দু’জনেরই গলার স্বর খাদে নেমে এল। নানারকম আকার-ইঙ্গিত আর ফিসফাস। বোঝা গেল, লোকটার সঙ্গে কিছু রফা হল। ফাইল ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে আর্থিক লেনদেনের। এবারও ত্রিলোচনের অন্য রঙ পাল্টে গেল।

গুপ্ত সাহেবের পিছু নিলাম এরপর। গাড়ি চেপে অফিসে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তাঁর মেয়ে, যাওয়ার পথে তাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। তখন ভদ্রলোকের এক রঙ আর মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর রঙ একটু অন্যরকম। সেই রঙ পুরোপুরি পাল্টে গেল অফিসে ঢুকলেন পর। নিজের চেম্বারে এলেন। আধঘন্টা পর তাঁর সেক্রেটারি মিস হাইনি এসে হাজির। ভদ্রলোকের রঙ আবার পাল্টে গেল। একসময় মিস হাইনির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ আলাপ হতে লাগল। তখনই ফোন বেজে উঠল। শোনা গেল গুপ্ত সাহেবের  স্ত্রীর গলা। ফোন ধরেই ভদ্রলোকের রঙ আবার আরেক জাতীয়। 

এভাবেই একের পর এক মানুষ দেখে গেলাম আমরা। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। সবার ক্ষেত্রেই এক কাণ্ড। বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা গেল, তারা অন্য মহিলা, বিশেষ করে বান্ধবীদের সঙ্গে যখন থাকে তখন তাদের এক রঙ। আবার ঘরে ঢুকলে নিজের স্ত্রীর সামনে তাদের রঙ আমূল পাল্টে যায়। ছেলেমেয়েদের সামনেও তাদের একেকরকম রঙ। অন্য পুরুষদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল যে ব্যক্তি বা অবস্থা বা অবস্থান অনুযায়ী সবাই রঙ পাল্টিয়ে নেয়। ঘরে থাকলে এক রঙ বাইরে গেলে অন্য রঙ। বন্ধুদের সঙ্গে তার যা রঙ তা পাল্টে যায় শত্রু বা অচেনা লোকদের সঙ্গে থাকলে। মহিলাদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, তারা একইভাবে রঙ পাল্টাতে ওস্তাদ। 

বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত লোকদের দেখলাম এক এক করে। এমন একটাও ক্ষেত্র পেলাম না যেখানে থাকা লোকেদের রঙ পাল্টাবার অবকাশ নেই। রিক্ত জানাল,

‘রাজনৈতিক নেতাদের দেখলে বুঝবি রঙ পাল্টানো কাকে বলে।’

এইরকম বেশ কয়েকজনকে বাছাই করা গেল। দেখলাম সবাইকে। তাদের মধ্যে একজন বিকলরথ। যিনি দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একজন ডাকসাইটে নেতা। খুব তাঁর দাপট। তাঁকে ঘিরে চব্বিশঘন্টা লোকের ভিড়। রঙের কী বাহার তাঁর, তাকালে চোখে ধাঁধা লাগে। তবে সবসময় তাঁর রঙও এক থাকে না। যখন জনসভায় গলা ফুলিয়ে বক্তৃতা দেন তখন তাঁর এক রঙ, দলীয় কর্মীদের সঙ্গে যখন গোপন বৈঠক করেন তখন আবার রঙ পাল্টে যায়। দিনে যে কতবার তাঁকে রঙ পাল্টাতে দেখা গেল ! অন্য সব রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখলাম তাঁর মতোই চরিত্র। জনগণের মধ্যে থাকলে তাঁদের এক রঙ, অন্যসময় অন্য রঙ। সাধারণভাবে, দেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে তাঁদের রঙ পাল্টানোর ক্ষমতা দেখলে তাকে লেগে যায়। 

রিক্ত আমাকে জিজ্ঞেস করল,

‘তুই কি আরও লোক দেখতে চাস ?’

‘আর দেখে কী হবে ?’

ম্লান গলা আমার। রিক্ত বলল,

‘তাহলে তুই বুঝলি যে রঙ পাল্টানো মানুষের একটা স্বাভাবিক ধর্ম।’

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

‘তোর যে রঙ পাল্টানোর স্বভাব, সেটাকে অসুখ ভাবার কোন কারণ রইল কি ?’

‘না।’

‘তুই মানুষ কিনা এই সন্দেহও নিশ্চয় আর নেই তোর ?’

প্রশ্নটা শুনে চট করে উত্তর দিলাম না। একটু ভেবে বললাম,

‘কিন্তু আমার আরও কিছু ব্যাপার আছে। সেসব আরও অস্বাভাবিক। সেসব ধরলে নিজেকে কিছুতেই মানুষ বলে ভাবতে পারব না।’

‘যেমন ?’

‘আমার চেহারাটাও ঘন ঘন পাল্টিয়ে যায়।’

‘তাতে চিন্তা করার কী আছে ?’

‘চিন্তা করব না, বলিস কী ?’

‘যত খুশি চিন্তা করতে পারিস, কোন বাধা নেই। প্রশ্ন হল, এটাকেও তুই অসুখ বলে ভাবিস কিনা।’

‘এটা তো অবশ্যই অসুখ। চেহারা পাল্টালে আমি তো আর মানুষ থাকি না। বা মানুষ থাকলেও নিজেকে চিনতে পারি না।’

‘কেন চিনতে পারিস না ?’

‘ধর্, আমি এতটুকু একটা বাচ্চা হয়ে গেলাম……’

‘সে তো খুব ভাল ব্যাপার।’

‘একদমই ভাল নয়। আমি কিছুই খেতে পারি না, কেবল বোতলে দুধ খাই।’

‘তাতে তো অনেক হাঙ্গামা কমে যায়। বাজারহাট করতে হবে না, রান্নার ঝামেলা নেই।’

‘আমি অনেক সময় হাঁটতেও পারি না। হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে হয়।’

‘মন্দ কী ? সবাই তোকে কোলে নিয়ে বেড়াবে।’

বুঝতে পারলাম রিক্ত মজা করছে। গম্ভীরভাবে বললাম,

‘আমি কিন্তু সিরিয়াস, আর আমাকে নাজেহালও হতে হচ্ছে।’

‘তোর অত ভাবিত হওয়ার কারণ নেই। বাচ্চা হতে চায় বা হয়ে যায় এমন লোকের অভাব নেই। তারা তাতে আনন্দও পায়।’

‘এতে আবার আনন্দের কী আছে ?’

‘চল্, তোকে দেখাচ্ছি।’ 

আবার আমি রিক্তর সঙ্গী হলাম, অন্যরকম অভিজ্ঞতার সন্ধানে। এক সুবিশাল ও সুরক্ষিত কার্যালয়ের ভিতরে আমাদের এবারের অভিযান। এই বাড়ি এখন দেশের ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর। সভাকক্ষে দেখা গেল দলীয় নেতৃবৃন্দ এক গোলটেবিল ঘিরে বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন। সভাপতির চেয়ারে বসে একটি বাচ্চা ছেলে। তার চোখে পুরু কাচের চশমা, মাথায় টাক, মুখে গোঁফদাড়ির আভাস এবং পাকা পাকা চেহারা। এ কি কোন বামন নাকি ? রিক্ত অস্ফুট স্বরে বলল,

‘বামন নয়, বয়স্ক ব্যক্তির বাচ্চা সংস্করণ। দ্যাখ্ না, কী হয়।’

দেখলাম। সেই বাচ্চা একটি নামের তালিকা বানিয়েছে। তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধী কিছু ব্যক্তির নাম। বাচ্চাটি বলছে,

‘এদের সবাইকে জেলে ঢোকাও। তিনমাসের মধ্যে।’

সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগল তালিকার নামগুলি। বাচ্চাটি কড়া চোখে আক্রোশের গলায় একটি একটি করে নাম দেখিয়ে বলতে লাগল,

‘এই লোকগুলো সব বদমাইশ। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম না তখন এরা প্রত্যেকে আমার কিছু না কিছু হয়রানির কারণ হয়েছে। ও আমাকে একবার প্রকাশ্য জনসভায় কাতুকুতু দিয়েছিল, ওর পিছনে ইনকাম ট্যাক্সের লোক লাগাও। এই ব্যাটা দু’-দু’বার আমাকে খিমচে দিয়েছিল, একে জালিয়াতির কেসে ফাঁসাও। ওই লোকটা একবার আমাকে ল্যাং মেরেছিল, আমি সপাটে আছাড় খেয়েছিলাম। একে পুরো দেশদ্রোহিতার অপরাধে জেলে ভরে দাও। আর এই যে বদমাইশটাকে দেখছ, এ আমাকে একসময় দেখতে পেলেই কেবল ভেংচি কাটত। এর পিছনে গুপ্তপুলিশ লাগিয়ে দাও। এবার দেখ এই ব্যাটাকে, এ একবার আমাকে দানব বলেছিল আর পচা ডিম ছুঁড়েছিল। এটাকে যে কোন কেসে ফাঁসিয়ে তিন বছরের জন্য জেল খাটাও।’

বাচ্চাটি তার বলা শেষ করতেই দেখি আজব কাণ্ড, সে আর বাচ্চা রইল না। সে হয়ে গেল কক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইটে নেতা বিকলরথ। তিনি দেশের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। সবাই তাঁকে ভয় পায়। তিনি বাচ্চা হলেন কেন আর কিভাবে ? প্রশ্ন করার আগেই রিক্ত বলল,

‘আসলে বিকলরথের প্রতিশোধস্পৃহা আর আক্রোশ এক ধরণের অবুঝপনা। ঠিক বাচ্চাদের মত। ওই স্বভাবের প্রকাশ তাঁকে বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছিল।’

দশরথের বউ পালিয়েছিল। পরদিন থেকে দশরথ নিজেও বেপাত্তা। পাড়ায় ঢি-ঢি পড়ে গেল। প্রতিবেশীদের মধ্যে কানাঘুষো। তার বাড়ির দরজা তালাবন্ধ। লোকের কৌতূহলের শেষ নেই। নানা খবর রটতে লাগল। দশরথ প্রচুর খোঁজাখুঁজি করে বউকে ধরে আনল। পালিয়েছিল বেপাড়ার এক চ্যাংড়া ছেলের সঙ্গে। বেশ দূরের এক শহরে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল দু’জনে। দিন কয়েক পর সন্ধান পেল দশরথ। বউকে ঘাড় ধরে নিয়ে এল। চ্যাংড়া ছেলেটা পালাল। কিন্তু পাড়ায় পালানো বউকে নিয়ে সবার চোখের সামনে ঢোকে কী করে ? বাড়ি ফিরল গভীর রাতে। সে আর তার বউ মিলে চোরের মত লুকিয়ে। লোকেরা যে কিভাবে জেনে গেল ! সবাই উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। দশরথ বউকে নিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে রইল। বন্ধু পরামর্শ দিল,

‘এমন করলে লোকেরা আরও পেয়ে বসবে। বরং বউকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যা। পারলে সবাইকে ডেকে বল্, সেই বউই পালায় যার প্রচুর ডিমান্ড। আর সেই লোক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার যে চঞ্চলা হরিণীর মত পালিয়ে যাওয়া বউকে ধরে আনে।’

পরদিন দশরথ বউকে নিয়ে সদর্পে বাড়ির বাইরে এল। পাড়ার প্রত্যেকটি বারান্দায় ঘরের ভিতর থেকে সব লোক ভিড় করে দাঁড়াল তাদের দেখার জন্য। লোক কোথায়, সব বাচ্চা ! সব খোকাখুকু। দশরথ আর তার বউ চোখের আড়ালে চলে যেতেই বাচ্চারা সব চেহারা পাল্টে ধাড়ি -ধাড়ি পুরুষ-মহিলা হয়ে গেল।

তারপর আমরা নিকুঞ্জনিবাসে বেড়াতে গেলাম। নিকুঞ্জবাবু স্ত্রী মনোরমা আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন সেখানে। নিজের নামেই বাড়ির নাম রেখেছেন। তাতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হল তাঁর স্ত্রী মনোরমাকে নিয়ে। নিকুঞ্জবাবুর বয়স যদি পঞ্চাশ হয় তো তাঁর স্ত্রীর বয়স পঁয়তাল্লিশ। তাতেও কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হল, নিকুঞ্জনিবাসে গিয়ে আমরা মাঝবয়সী কোন মহিলাকে খুঁজে পেলাম না যে মনোরমা হতে পারে। নিকুঞ্জবাবুকে পেলাম, পেলাম তাঁর মেয়ে এবং ছেলেদেরও, কিন্তু মনোরমা কোথায় ? একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই বাচ্চা মেয়েটাকে আবার নিকুঞ্জবাবুর ছেলেমেয়েরা ‘মা-মা’ বলে ডাকছে। বলছে সবাই, ‘মা, খেতে দাও’ বা ‘মা, বাইরে যাচ্ছি’ ইত্যাদি। আর সেই বাচ্চা মেয়েটা ছেলেমেয়েগুলোকে, এমনকি নিকুঞ্জবাবুকে পর্যন্ত বকাবকি করছে। পরে একসময় বোঝা গেল যে এই বাচ্চা মেয়েটা আসলে নিকুঞ্জবাবুর স্ত্রী মনোরমা। রিক্ত বলল,

‘মনোরমার বদভ্যাস, সে সবাইকে নিজের বয়স কমিয়ে কমিয়ে বলবে। প্রত্যেক নতুন বছরে সে নিজের বয়স কমায়। সবাইকে তাই বলে। এই করে করে তার কী হাল হয়েছে দ্যাখ্।’

হিসেবে করে দেখা গেল, তার মেয়ে সুবর্ণার বয়স বারো। আর বিগত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বয়স কমিয়ে আসছে মনোরমা। প্রত্যেকবার অন্তত ছ’-মাস বা একবছর। এই বদভ্যাস চালিয়ে এসে সে এখন নিজের মেয়ে সুবর্ণার চেয়ে দু’-বছরের ছোট হয়ে গেছে। দশবছরের এক খুকি। রিক্ত আমাকে জানাল,

‘মেয়ে সুবর্ণাকেও মায়ের রোগে পেয়েছে। সে-ও নিজের বয়স কমিয়ে বলে। তার আসল বয়স এখন হওয়া উচিত উনিশ। অথচ কমিয়ে কমিয়ে বারো করে ফেলেছে। অবস্থা এখন এমন যে কোন বছর মনোরমার বয়স মেয়ের চেয়ে কমে যায় আবার কোন বছর মেয়ে সুবর্ণার বয়স তার মায়ের চেয়ে কম থাকে। মা আর মেয়ে এভাবে পাল্লা দিয়ে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। কে আটকায় ওদের ?’

‘এমন চলতে থাকলে তো দু’-জনেই একদিন এক-দু’দিনের বাচ্চা হয়ে যাবে। তারপর কী হবে ?’

আমি আঁতকে উঠে প্রশ্ন করলাম। রিক্ত বলল,

‘এক-দু’ ঘন্টা বা এক-দু’ মিনিটের বাচ্চাও হয়ে যেতে পারে।’

‘শেষপর্যন্ত কী হবে ? বাচ্চা হওয়ার তো একটা লিমিট আছে ?’

‘এইসমস্ত লোক, যাদের এমন বাচ্চা সাজার স্বভাব তাদের কোন লিমিট নেই। এরা মায়ের পেটেও চলে যেতে পারে। বা তারও আগের কোন অবস্থায়।’

বিপিনের কসমেটিক্সের দোকান। কুড়ি বছরের যুবক। হার, মালা, চুড়ি, দুল, লিপস্টিক, নেলপালিশ বিক্রি করে। তার দোকানে পাউডার কিনতে এল সুনীতা। সাতাশ বছরের যুবতী। এসে বলল,

‘কাকু, আমাকে একটা লজেন্স দাও।’

বিপিন অবাক, আমরাও অবাক। বিপিনকে যেমাত্র সুনীতা ‘কাকু’ বলে ডাকছে অমনি সে হয়ে যাচ্ছে পাঁচ বছরের এক বালিকা আর ‘পাউডার দাও’ বলতে পারছে না কিছুতেই, বলে ফেলছে, ‘লজেন্স দাও’ .এই নিয়ে মহা গণ্ডগোল। 

ব্যাঙ্কে চাকরি করে অনুপ্রাস। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তসমর্থ যুবক। বাইরে থাকলে বা ব্যাঙ্কে গেলে তার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু বাড়িতেই তার সব গুবলেট। তার মা সবাইকে বলেন,

‘আমার অনু দুধের বাচ্চা। কিছুই করতে পারে না। সব আমাকে করে দিতে হয়।’

বাড়িতে থাকলে অনুপ্রাস সত্যিসত্যিই বাচ্চা ছেলে হয়ে যায়। তার মা তাকে খাইয়ে দেন, চান করিয়ে দেন, প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে বিছানায় শুইয়ে পিঠ চাপড়ে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়ান। সারা বাড়িতে বাচ্চা অনুপ্রাস ছোটাছুটি-দাপাদাপি করে, তার প্রায়ই কোমর থেকে প্যান্ট খুলে খুলে পড়ে যায়। বাইরে গেলেই সে আবার যুবক, বাড়িতে বাচ্চা হয়েই তার জীবন কাটে। তবুও যাই হোক না কেন, বাচ্চা সেজে থাকা লোকগুলোর দলে তাকে ফেলা যায় না। সে বাচ্চা হয়ে থাকে তার মায়ের জন্য। 

কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। অনুপ্রাসের বিয়েটা হচ্ছে না। পাত্রীর অভাব নেই, তবুও। বিয়ে ঠিক হয় অনেক, মেয়ে দেখাশোনাও হয়ে চলেছে একের পর এক, কাজের কাজ আর হয়ে উঠছে না। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেলেই মা তার সঙ্গে যান, আর ওইজন্যেই যত গণ্ডগোল। মা সঙ্গে থাকলেই অনুপ্রাস বাচ্চা হয়ে যায়। তার কোমর থেকে প্যান্ট নেমে যেতে থাকে, মা টেনে টেনে তুলে দেন। তার চুল এলোমেলো হয়ে যায়, মা ব্যাগ থেকে চিরুনি বার করে আঁচরে ঠিক রাখেন। মেয়ের বাড়ির লোকরা এসব পছন্দ করে না। মাকে সঙ্গে নিয়ে অনুপ্রাস মেয়ে দেখতে গেলেই মেয়ের বাড়ির লোকরা বলে,

‘অরে এ তো বাচ্চা ! অতটুকু বাচ্চা কী বিয়ে করবে ? আগে বড় হোক।’

রিক্ত আমাকে বলল,

‘বাচ্চা সেজে থাকা আর বাচ্চা হয়ে যাওয়া লোকগুলোর মধ্যে তফাৎ থাকলেও তারা কিন্তু আসলে সবাই বয়স্ক লোক। তোর সমস্যাটার উত্তর নিশ্চয় পেয়ে গেছিস ? দুমদাম বাচ্চা হয়ে যাওয়া তোর একার রোগ নয়, এটা সব মানুষেরই একটা কমন অসুখ, বলতে পারিস, গণরোগ। সব মানুষই কমবেশি এই রোগের  শিকার।’

আমি জানতে চাইলাম,

‘কিন্তু এর উল্টো ব্যাপারটা হয় যখন ? বয়সটা যে ছাই আমার বেড়েও যায় !’

রিক্ত আমাকে নিয়ে গেল আরেক জায়গায়। সেখানে দেখলাম সুবোধ তার বন্ধুদের কাছে বরফট্টাই দেখিয়ে প্রচার করছে যে এটা জানে, সেটা জানে, সবটা জানে। সুবোধ যত বলছে তত দেখছিলাম তার বয়স বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত সে হয়ে গেল নব্বই বছরের থুথ্থুরে এক বুড়ো। আর কথা বলারও ক্ষমতা রইল না। সে নিরুপায় হয়ে চুপ করল। বন্ধুরাও সব চলে গেল। এবার দেখি, ও হরি ! সুবোধের বয়স বড়জোর বছর চল্লিশ। 

আমাকে অবাক হতে দেখে রিক্ত জানাল,

‘দুমদাম বয়স বেড়ে যাওয়াটাও তোর একার রোগ নয়। এটাও একটা গণরোগ। আমাদের মধ্যে সবজান্তা গামছাওলাদের কোন অভাব নেই। সবাই ভাবে সে অন্যদের চেয়ে সবকিছু বেশি জানে, বেশি বোঝে। সবাই মনে করে, তার মত জ্ঞানী ব্যক্তি পৃথিবীতে তার আগে আর কখনও জন্ম নেয়নি। এদের সবারই বয়স দুমদাম বেড়ে যায়। সমস্যাটা তোর একার নয়। তোর এত ভাবনারও কারণ নেই। চাস যদি আরও দেখতে পারিস।’

প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়ে গিয়েছিল। যা সব কাণ্ড দেখছিলাম হজম করারও একটু অবকাশ চাই। তাছাড়া খিদেও পেয়েছিল বেশ। রিক্তকে তাই বললাম,

‘আপাতত এই থাক ভাই। আমার এখন একটু বিশ্রাম দরকার। তবে আমার অসুখ আরও আছে। বাকিগুলোর কথাও তোকে জানতে হবে।’

‘ঠিক আছে, পরে জানাস। শুনব। উত্তরটাও পেয়ে যাবি।’

আমরা তখনকার মত আমাদের অভিযান থামালাম। আরও বড় যাত্রার জন্য রসদ সংগ্রহ করে নেওয়া আগে দরকার। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *