তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায়: এগারো 

মা আমাকে শিখিয়েছিল,

‘কাউকে কোনোদিন ঘাড়ে চাপতে দিবি না।’

তার জন্য কিছু একটা জিনিস দরকার সেটাও মা যত্ন করে শিখিয়েছিল। কী যে সেটা তা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। 

মা আমাকে হাচিম কুলিয়ার গল্প শুনিয়েছিল। কুলিয়াপাড়ায় তার বসবাস। শক্তসমর্থ মানুষ। তিনকাল পেরোতে তার তখনও বাকি। তার ছিল একটা পোষা খান্দাশ। সবাই জানত, কেউ দেখতে পেত না। খালিচোখে কি আর দেখা যায়? ওইজন্যই হাচিম চোখে রোদচশমা পড়ত। তা সেটা কিন্তু মামুলি রোদচশমা নয়। তার কিছু বিশেষ ব্যাপার অবশ্যই ছিল। লোকে চোখে দূরবীন লাগিয়েও যা দেখতে পায় না তা একটা চশমা লাগিয়ে দেখে ফেলবে এমন হেলাফেলার বিষয় নাকি? খান্দাশটা থাকত একটা হর্তুকি গাছে। ঘন পাতার আড়ালে। রাত-বিরেতে তাকে ক্কচিৎ-কদাচিৎ দেখে ফেলত কেউ। সে দেখা দিতে চাইত না যদিও। হাচিমের ডেরা ছিল সেই হর্তুকি গাছের অনেকটা তফাতে। একটা ঢিবির ওপর কুঁড়ে। সেখানে সে আগে একাই থাকত। লোকে বলে, ঢিবিটা আসলে ঢিবি নয়। সোনাদানা-জহরত চাপা দেওয়া আছে সেখানে। হাচিমের অনেক ক্ষমতা। এমন একটা লোক ঢিবির ওপর বাড়ি বানাতে গেল কি এমনি এমনি? ঢিবিটা যদি নেহাৎ মাটির ডেলা হত হাচিম বাড়ি বানাবার বান্দা? দেখেশুনেই সে ডেরা বানিয়েছিল। সে তো ঢিবির ওপর বাড়ি না বানিয়ে সমতলের ওপর বানাতে পারত, যেমন আর দশটা লোক বানায়। ঢিবির তলায় গুপ্তধন গোপন রাখতেই ওই লোকদেখানো বাড়ি বানানো।  

সবাই জানত হর্তুকি গাছটার রহস্য। হাচিমও জানত। তবে সে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যায়নি। তার ক্ষমতা ছিল, তবুও ভালমন্দ কিছুই বলেনি। আর পাঁচটা লোকের মতোই সে হর্তুকিতলা দিয়ে দিনেরাতে চলাচল করত। ওইরকমই  একদিন গভীর রাতে খান্দাশটার কী দুর্মতি হল, হাচিমকে সে ভয় দেখাতে গেল। তার এমন ইচ্ছে হত না কোনদিন। হর্তুকিগাছে থাকত সে চিরকাল হর্তুকিপাতার ঘেরাটোপে। মানুষকে দেখে তার নিজেরই ভয় লাগত, মানুষকে সে ভয় দেখাতে যাবে কোন্ দুঃখে? সে কিনা গেল হাচিম কুলিয়াকে ভয় দেখাতে! দুর্মতি আর কাকে বলে? তা ফলটাও পেল হাতেনাতে। সাদামাটা লোক হলে অন্য কথা ছিল। ভয় খেয়ে বাবারে-মারে বলে চিৎকার ছেড়ে নির্ঘাৎ পালিয়ে আসত। কিন্তু সে হাচিম কুলিয়া, ভয় খাওয়ার লোক হলে কি গুপ্তধনের ঢিবির ওপর ডেরা বানিয়ে থাকে? খান্দাশটা তার লম্বা মূলো-মূলো দাঁত আর চিচিঙ্গেমার্কা নোখ দেখিয়ে হর্তুকিগাছ থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে নেমে ভয় খাওয়াবার তালে ছিল। হর্তুকিগাছে পাতার গহীনে লুকিয়ে থাকত সে, খবরাখবর রাখত না কিছুই। তাই জানত না যে জন্মে একবার যদি কাউকে ভয় খাওয়াবার সাধ জাগে মনে তো হাচিম কুলিয়াকে নয়। ভুলটা করে সবাই বোঝে ভুল, খান্দাশটাও তাই বুঝল। ততক্ষণে কি আর পিছিয়ে যাওয়ার জো আছে? হাচিম তার দেখা পেয়েই বন্দী করে ফেলল। খান্দাশটার হর্তুকিগাছের বাসা গেল চিরকালের জন্য। সে সেই থেকে হাচিম কুলিয়ার পোষ্য হয়ে থাকল। ছিল মুক্ত, খোলাবাতাসে ঘুরে বেড়াত, কর্মফল ভুগতে হল তাকে। সেইদিন থেকে হাচিম চোখে রোদচশমা লাগাল, খান্দাশটাকে দেখবে বলে। 

কুলিয়াপাড়ার বাচ্চাবুড়ো জানত সবাই এই গল্প। হর্তুকিগাছে সেই খান্দাশটার হদিশ আর কেউ পায়নি সেইদিন থেকে। কেন পায়নি? না, সে তখন হাচিমের পোষ্য হয়ে তার ডেরায় বাস করছে। লোকে বলে, কুঁড়েঘরের মেঝেতে ছিল গোপন সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গপথে ঢিবির তলায় গুপ্তধনের কক্ষে ছিল হাচিমের নিত্য যাতায়াত। খান্দাশটাকে পোষ্য হিসেবে পেয়ে লাভই হল তার। রোজ রোজ আর সুড়ঙ্গ বেয়ে পাতালকক্ষে যেতে হত না নিজেকে। যাতায়াতের ধকল কিছু কম নয়। কয়েকশ’ সিঁড়ি তো হবেই। সহস্রাধিকও হতে পারে। কেউ তো আর নিজে নেমে যাচাই করে দেখেনি। সকলেই শুনেছে সেসব এর-তার মুখে। এখন সে হররোজ নিজে না গিয়ে গুপ্তধন কেমন আছে দেখতে পাতালকক্ষে খান্দাশটাকে পাঠাতে লাগল। এছাড়া আরও নানান কাজ রয়েছে। সেসব সে আর নিজে কিছুই করে না এখন। সব জানে কুলিয়াপাড়ার বাসিন্দারা, কে করে দেয় হাচিমের যাবতীয় কাজ।

স্বচক্ষে দেখেছে সবাই, সেই থেকে হাচিম আর কোন কাজকর্ম করত না। কেবল ঘুরে বেড়াত আর বাড়িতে শুয়েবসে দিন কাটাত। হাটেবাজারে যেত না, নিজের জন্য রান্নাবান্নাও করত না। বেঁচে থাকতে হলে খেতে হবে। খাওয়াদাওয়া তাকে করতে হত অবশ্যই। সেই খাবারদাবার জুটত কোত্থেকে? লোকে বলে, তার জন্য নানান মুলুক থেকে উপাদেয় খাদ্য নিয়ে আসত খান্দাশ, সে যেমন যেমন খাবার খাবে বলে আদেশ করত। সত্যিমিথ্যে না জানলেও অস্বীকার করতে পারবে না কেউ যে খান্দাশটা সঙ্গী হওয়ার পর থেকে কেউ আর হাচিমের ডেরা থেকে কোনরকম ধোঁয়া উঠতে দেখেনি কোনদিন। তার মানে সে আর রান্নাবান্না করত না। তার আচার-আচরণও পাল্টে গিয়েছিল। এখন সে বাইরে গেলেই সর্বক্ষণ চোখে থাকে রোদচশমা আর অদেখা কারো সঙ্গে বিড়বিড় করে কী সব কথা বলে। আগে যদি তুমি কথা বলতে তো তোমার সঙ্গেই কথা বলত, এখন তা নয়। তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে অন্য কাউকে কিছু বলতে থাকে যখন-তখন, কাকে বলছে তুমি দেখতে পাবে না। 

যতই ক্ষমতাবান হও, খান্দাশের মত এক অপশক্তিকে সর্বক্ষণ নিজের কাছে আটকে রাখা আর খাটানো কোনক্রমেই উচিত কাজ হতে পারে না, বলাবলি করত সবাই। কোনদিন না কোন অঘটন-কুঘটন ঘটে। যতই হোক, সে তো আর মানুষ নয়, মানুষের গোলামি করে মরছে। তারও তো রাগজ্বালা আছে? এই নিয়ে অবশ্য কুলিয়াপাড়ার কারো সঙ্গে কথাবার্তা হত না কখনো। হলেও বা কী, হাচিম কি কারো কথায় পাত্তা দিত?

সবই অবশ্য লোকের মুখে শোনা। হাচিমকে দেখত সবাই, দেখত তার পাল্টে যাওয়া চালচলন। খান্দাশটাকে দেখত না কেউ। আন্দাজে তার গতিবিধি বোঝা যেত।  সে যে হাচিমের পোষ্য হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ ছিল না তিলমাত্র। অবস্থা শেষে এমন দাঁড়াল যে কেবল তাকেই হুকুম করে না, হাচিম নিজেও তারও নানান আবদার কান পেতে শোনে। আবদার রাখা না-রাখা পরের কথা, শুনছিল তো? গোড়ায় খান্দাশ কোন কথা বলবে আর হাচিম শুনবে তার জো ছিল না। সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেল। হাচিম শুনতে লাগল খান্দাশটার কথা। তাতে যে খারাপ কিছু হচ্ছিল এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাচিম দেখল, তার উপকারই হচ্ছে। ক্রমে তার মনোভাব নরম হতে লাগল। শত হোক, একসঙ্গে থাকা দিনের পর দিন। মানুষের মনে তার ছাপ পড়তে বাধ্য। হাচিমেরও তাই হল। লোকে বলে, নাকি তার মধ্যে মায়ামমতা জন্ম নিয়েছিল। হতেও পারে। কালে দেখা গেল, হাচিম আর নিজের ইচ্ছেতে চলে না, সে চলে খান্দাশের মর্জিমাফিক। খান্দাশ উত্তরে বললে সে উত্তরে যায়, দক্ষিণে বললে দক্ষিণে। তবুও যে সব কথা শুনত এমন নয়। শুভাশুভ অনুমান করার ক্ষমতা ছিল তার। খান্দাশটা কেবলই আবদার ধরত তার ঘাড়ে চড়বে বলে। হাচিম রাজি হত না। মানুষের ঘাড় এক জবর স্থান, সেখানে যাকে-তাকে চড়তে দেওয়া অনুচিত। বিশেষত, খান্দাশের মত কাউকে। সে যতই বিশ্বস্ত হোক, ভুললে চলবে না যে সে মানুষ নয়। তাকে আর যেখানেই রাখ ঘাড়ে চাপতে দেওয়া চলে না। তার দু’-চারটে কথা শোন ঠিক আছে, এক-আধটু আশকারাও দিতে পার। কিন্তু ঘাড়ে ওঠার আবদার কক্ষনো বরদাস্ত করবে না।   

মানুষের মন বলে কথা, সে চিরকাল সবল থাকে না। উপরন্তু, কেউ যদি সদাসর্বদা তোমার সঙ্গে বাস করে তুমি তার জন্য নরম হয়ে যাবে। সেই ঘটনাই ঘটল। খান্দাশটা দিনরাত ঘ্যানঘ্যান করে, ঘাড়ে চড়ব-ঘাড়ে চড়ব বলে, শুনে শুনে হাচিমের মতিভ্রম হল। সে ভাবল, ব্যাটা তো পুরোপুরি আমার বশেই আছে, আমাকে ছাড়া একদণ্ড থাকতে পারে না, এত যখন আবদার করছে দিই ঘাড়টা পেতে। ভিতর থেকে তবুও কেউ আপত্তি জানাচ্ছিল। হাচিম তাতে আমল দিল না। খান্দাশকে ঘাড়ে চড়তে দিল শেষমেষ। 

ঘাড়ে একবার চড়ল তো আর নামল না। হাচিমও যে জোরজার করত নামার জন্য এমন নয়। ভাবত, ঘাড়ে আছে যখন থাক। ক্ষতি কী আর করছে? খান্দাশটা তার ঘাড়েই চড়ে রইল। কতদিন? কেউ বলে দু’দিন, কেউবা বলে বড়জোর দিন তিন-চার। সঠিক হিসেব দিতে পারেনি কেউ। জানে না তো কবে খান্দাশটা ঘাড়ে চড়েছিল। তবে সেই রাতটার কথা মনে রেখেছে কুলিয়াপাড়ার সবাই। ঘন ঘন পেঁচা ডাকছিল এদিক-ওদিক। আর শেয়ালগুলিও হুক্কা-হুয়া করে মরছিল থেকে থেকে। সঙ্গে পাড়ার কুকুরগুলির কুই-কুই আর্তনাদ। আকাশে অবশ্য চাঁদ ছিল, তবে সেই চাঁদের ওপর একসময় চেপে বসেছিল অদ্ভুত এক কৃষ্ণছায়া। চন্দ্রগ্রহণ নয়, কালচে একটা ছায়া ঢেকে দিয়েছিল চাঁদের গা। কুলিয়াপাড়ার সবাই দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। আর পরদিন ভোরবেলাতেই পাওয়া গেল হাচিম কুলিয়ার মৃতদেহ, ঘাড় মটকানো অবস্থায় পড়েছিল নিজের ডেরার সামনে, ঢিবির ওপর থেকে নিচের দিক বরাবর। ডেলা ডেলা চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছিল চোখের কোটর থেকে। 

গল্পটা মায়ের কাছে শুনেছিলাম কোন্ কালে, গল্পের যে শিক্ষণীয় বিষয় সেটাই গ্রহণ করতে পারলাম না দৈব দুর্বিপাকে মোটা মাথার অধিকারী হওয়ার কারণে। 

ছোটবেলায় বুঝতাম না, বড় হওয়ার পর টের পাচ্ছি যে আমার মধ্যে কী যেন একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু একটা যে নেই তার অভাব অহরহ আমি অনুভব করি। আমার চলনে-বলনে, লোকের সঙ্গে মেলামেশায় সেই অভাব বড় হয়ে দেখা দেয়। কিসের অভাব বুঝতে পারি না। হাতড়ে বেড়াই। এটুকু টের পাই যে ওই বিশেষ জিনিসটা না থাকায় আমি স্বাভাবিক মানুষ হতে পারছি না। আমি কেন ঠিক মানুষ নই তার উত্তর এটা হতেই পারে। এই কারণে আমার মধ্যে নানা অসুখ দেখা যাচ্ছে। আমি যখন-তখন এমনসব কাজ করে ফেলছি পরে যা নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। কেবল তাই নয়, যেসব কথা বলে ফেলছি নিজেই তাতে বিরক্ত হয়ে পড়ছি। কিছুর একটা অভাব তো অবশ্যই আছে, নাহলে এমন করব কেন?

যেমন, ঘাড়ে চড়ার ব্যাপারটা। কেউ চায়না তার ঘাড়ে অন্য কেউ চেপে বসুক। আমিও চাই না। ঘাড়ে একের পর এক লোক চেপে বসলে দৃশ্যটা মোটেই ভাল লাগবে না। দেখতে কেমন বড় কথা নয়, আমার ঘাড়ে অন্য লোক চেপে বসলে চলাফেরাটা যথেষ্ট অসুবিধের হয়ে যাবে। আমি চলব আমার মত, অন্য কেউ আমার ঘাড়ে চেপে থাকবে কেন? তার সুবিধে হবে বলে আমি কেন মুশকিলে পড়ব? তাছাড়া আমার ঘাড়ে চেপে বসে কেউ তার পছন্দমত আমাকে চালাবে সেটাই বা মেনে নেব কেন? অথচ সেই কথাটা বলতে যত ঝামেলা আমার। সোজাকথাটা সোজাভাবে বললেই সব ল্যাঠা চুকে যায়। বলতে পারি না। একদিন উবিন এসে বলল,

‘তোমার ঘাড়টা চড়ার জন্য বেশ আরামদায়ক। চড়ে বসব?’

আমার তাকে তক্ষুনি সপাটে বলা উচিত ছিল,

‘কক্ষনো না। আমার ঘাড়টা অত শস্তা নয়। তোমার ইচ্ছে হলে নিজের ঘাড়ে চড়ে বসো। নয়তো অন্য কারোর ঘাড় খুঁজে নাও। আমার ঘাড়ে চড়ার ধান্দা ছেড়ে দাও।’

এই সোজা কথাগুলি স্পষ্টভাবে বলার জোর পাই না। কিছুটা বোকার মত বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকি, এমনভাবে যে দেখলে মনে হবে যেন সে আমার ঘাড়ে চাপলে বর্তে যাব। যদি চুপ করে থাকতাম তাহলেও বোঝা যেত যে ভিতরে কিছুটা হলেও অনিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু বক্তার আবদার শুনে জোরদার আপত্তি জানানো তো দূরের কথা বরং খাতির করতে থাকি। বেশ কুন্ঠিতভাবে অপরাধীর মত গলায় মিউ-মিউ করে বলি,

‘ইয়ে, মানে, আমার ঘাড়ে চড়বে? চড়তে পারবে?’

নিজের অনিচ্ছাটা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ না করে ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করি। ‘ভাগ্, আমার ঘাড়ে চড়তে দেব না’, সোজাভাবে সোজাকথাটা বলতে পারি না। কেউ ঘাড়ে চেপে বসুক সেই ইচ্ছেও নেই। তাই তাকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করি, ‘চড়তে পারবে?’  অর্থাৎ বোঝাতে চাই যে আমার ঘরে চড়তে গিয়ে তোমার যদি কষ্ট হয় তাই না চড়াই ভাল। আমার কষ্ট হবে কিনা সেটা বলার সাহস পেলাম না। উবিন তাতে ভাল আস্কারা পেয়ে গেল। পরিষ্কার বলল,

‘চড়তে পারব না কেন, খুব পারব।’

আমার তখনও সময় ছিল আপদ বিদেয় করার। কিন্তু পারলাম কই? রাজ্যের ভালমানুষি মুখে এনে বললাম,

‘তোমার যদি অসুবিধে হয়? ঘাড়টা তেমন ভাল নয়তো, তাই বলছিলাম।’

উবিন পেয়ে গেল আমাকে। সে কি আর ছাড়ে? যেন ঘাড়ে চেপে উদ্ধার করে দেবে এমন গলায় বলল,

‘সে একটু-আধটু অসুবিধে আমি মানিয়ে নেব। তোমার ভাবতে হবে না। সবসময় সুবিধে পাওয়ার কথা ভাবলে চলে না। একবার উঠতে দাও, দেখবে তোমার ভালোই হবে।’

কাউকে ঘাড়ে চাপাতে আমার অপছন্দের কথাটা বলতেই পারলাম না। বরং ঘাড়টা হেলিয়ে রাখলাম এমনভাবে যাতে অনায়াসে কেউ চড়ে বসতে পারে। উবিন আর ভদ্রতা করার ধার ধারল না। কায়দামত আমার ঘাড়টা পেয়ে আরামসে চেপে বসল তাতে। ব্যস, আমার বারোটা বেজে গেল। ঘাড়ে চেপে উবিন আমাকে তার পছন্দমত চালাতে লাগল। সে একের পর এক হুকুম করে আর আমি তা মেনে চলি। দুর্দশার একশেষ! তার বায়নাক্কা মেটাতে মেটাতে আমি অস্থির। একে তো ঘাড়ে একটা গোটা মানুষের বোঝা, তার ওপর সেই মানুষটার হুকুম তামিল করা, হেনস্থার চূড়ান্ত হতে লাগল আমার। তবুও তাকে বলতে পারি না নিজের অসুবিধের কথা। বরং তার কাছে কৃতার্থ হওয়ার ভঙ্গিতে জানতে চাই,

‘না চড়লেই পারতে। কী যে মুশকিলে পড়লে!’

সেই ঘুরিয়ে নিজের মুশকিলটা প্রকাশ করার চেষ্টা। স্পষ্টভাবে নিজের সমস্যাটা জানাবার ক্ষমতা নেই। উবিন তাতে আরও পেয়ে বসল আমাকে। বেশ অসন্তোষ জানিয়ে বলল,

‘কেউ চড়তে পারবে কিনা ভাবোনি তো। ঘাড়টা যা করে রেখেছ! যদি ভাবতে এখানে কেউ চড়ে বসবে তাহলে ঘাড়টার ঠিকঠাক যত্ন করতে।’

আমার উচিত ছিল তক্ষুনি আপদটাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার। অন্যায়ভাবে জবরদস্তি করে ঘাড়ে চেপে আছে আবার লম্বাচওড়া কথা শোনাচ্ছে। প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই উচিত ছিল না। রাগ যে হচ্ছিল না ভিতরে এমন নয়। কিন্তু প্রকাশ করার সাহসটারই পাত্তা পাচ্ছিলাম না। উপরন্তু তার অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পেরে যেন মরমে মরে যাচ্ছি এমন ভাব প্রকাশ করতে বললাম,

‘জানতাম তো তোমার কষ্ট হবে। তাই বারণ করছিলাম। তুমি তো শুনলেই না। এখনও যদি চাও তো নেমে যেতে পার। তোমার যদি ইচ্ছে হয়।’

আসলে আমি একান্তভাবে ঘাড় থেকে তাকে নামিয়ে দিয়ে রেহাই পেতে চাই। সেই ইচ্ছেটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওভাবে জানানো। স্পষ্টভাবে বলে দিলেই হয়ে যায়, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। নামো এবার ঘাড় থেকে। না যদি নামো তো ঝেড়ে ফেলে দেব।’ এই সোজা কথাগুলি সোজাভাবে বলব সেই জোর কোথায় আমার? টের পাচ্ছিলাম প্রতি পদে পদে, কিছু একটা নেই আমার মধ্যে। সেটা নেই বলেই এত বিপত্তি। উবিন বুঝতে পেরেছিল আমি বস্তুটা কী। আমার ঘাড় থেকে নামার কোন ইচ্ছে সে দেখাল না। বলল,

 ‘একবার যখন উঠেছি আর নামব? যা কষ্ট করার তো করেই ফেলেছি। আর মানিয়ে তো নিচ্ছি ভাই। তুমি কেন আপত্তি করছ তখন থেকে?’

‘না-না, আমি আপত্তি করলাম কোথায় ? আসলে তোমার কথা ভেবে…….’

‘আমার কথা ভাবতে হবে না তোমাকে। সেটা আমি ভাবব। ঘাড়ে যখন চেপে বসেছি একবার আর নামানামির প্রশ্ন নেই।’  

আমি বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা সত্যিই নেই আমার আর তার জন্যই যে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছি তার শেষ কোথায় কেজানে!

আমার অবস্থা না আবার ওই হাচিম কুলিয়ার মত হয়। মা আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমি শিখলাম কই? কী যেন একটা থাকার কথা বলেছিল, ভুলে বসে আছি। উবিনকে ঘাড়ে তুলেছি, ঘাড় থেকে নামাতে পারছি না। চেষ্টাও কি তেমন করছি? সে তো আমার ঘাড়ে দিব্যি ঘর-সংসার সাজিয়ে বসে আছে। শেষে না ঘাড় মটকায়!

ওই যে কী একটা নেই আমার মধ্যে, তার জন্যই যত বিপদ। সোজা হয়ে চলতে পারি না, সোজা কথা বলতে পারি না। আমি কিভাবে চলি নিজেও জানি না। এঁকেবেঁকে, নাকি দুলে দুলে ? যেভাবেই চলি না কেন, ঘাড়টা থাকে এমনভাবে যে সবাই চড়ে বসতে আরাম পায়। আর আমি কারো ইচ্ছেতে বাধা দিতে পারি না। কেউ যদি ঘাড়ে চড়ে বসে তো তাকে নেমে যাওয়ার কথাও বলতে জানি না। এই যেমন উবিন, সে আমার ঘাড়ে চড়ে বসল তো বসেই থাকল। তার যত শখ যত আবদার মেটাতে লাগল আমাকে দিয়ে। কখনো বলে, 

‘ইচ্ছে ছিল সোনার পাথরবাটিতে আপেলের মোরব্বা খাব।’

যেমন সে ইচ্ছে প্রকাশ করল আমি তা মেটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কোথায় সোনার পাথরবাটি পাওয়া যায়? খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান। আপেলের মোরব্বা তবু নাহয় তৈরি করা গেল, কিন্তু সোনার পাথরবাটি? সে ঘাড়ে বসে চালায় আমাকে আর বলে,

‘খোঁজ, খোঁজ। খুঁজলে ঠিক পাওয়া যাবে। ফাঁকিবাজি করলে পাবে কোথায় ?’

শপিং মল, রেলস্টেশন, মাছের আড়ৎ থেকে শুরু করে পোস্টাপিস, পার্ক, এমনকি কোর্ট-কাছাড়ি পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে খুঁজে মরলাম। পেলাম না সন্ধান। সে আমার ঘাড়ে চেপে থেকে আদেশ দেয়, এখানে যাও ওখানে যাও। আমি যেতে থাকি আর খুঁজতে থাকি। ফল হয় না কিছুই। সে বিরক্তি জানায় আর অন্য নতুন ইচ্ছে প্রকাশ করে,

‘মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার শখ ছিল। পারবে কি নিয়ে যেতে?’

যেন মাউন্ট এভারেস্টে চড়াটা আমার ঘাড়ে চড়ার মত সহজ ব্যাপার। আমি নিজে কোনদিন মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার কথা ভাবিনি, চড়তে যাওয়ার চেষ্টা করা তো দূরের কথা। এখন উবিনের আবদারে তাই করতে যাব? মাউন্ট এভারেস্টে চড়ব আমি, ছেলেখেলা নাকি? তাও তার মত একটা বেয়াক্কেলে বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে? জানি ব্যাপারটা অসম্ভব, তবুও চেষ্টা করে যেতে থাকি। অন্তত খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি, মাউন্ট এভারেস্টটা ঠিক কোথায় আর কিভাবে তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। উবিনকে খুশি রাখার জন্যই সব চেষ্টা। যেন সে না খুশি হলে আমার চোদ্দপুরুষ নরকবাস করবে। 

এমনিভাবেই দিন কাটতে লাগল, ঘাড়ে-চাপা উবিনের হুকুম তামিল করে। মনে মনে বেশ প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম, কবে সে আমার ঘাড়টা মট করে ভেঙে দেয় তার জন্য। কিন্তু উবিন চালাক লোক। ঘাড় ভাঙলে যদি মরেটরে যাই তো তাকে জেল-জরিমানার হাঙ্গামায় পড়তে হবে। ঘাড় সে ভাঙল না, ঘাড়ে চড়ে থেকে তার যত শখ-আল্হাদ মিটিয়ে নিল। তারপর যখন দেখল আর বিশেষ কিছু লাভ নেই আমার ঘাড়ে চেপে থেকে তখন সে টুক করে নেমে হাওয়া। 

উবিন গেল তো ঘনাই এল। তারও দেখলাম খুব ইচ্ছে আমার ঘাড়ে চড়ার। আসলে অন্যের ঘাড় দেখলে সবাই চড়ে বসতে চায়। ঘাড়টা এমনিতেও খুব স্পর্শকাতর এলাকা। ভূতেরা ঘাড় মটকায়, বাঘ-সিংহেরা শিকারের ঘাড় চেপে ধরে। ঘাড়ের ওপর লোভ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ঘনাই আমাকে বলল,

‘তোমার ঘাড়ে চড়তে দেবে আমাকে?’

উবিনের কাছে ভুগেও আমার শিক্ষা হয়নি। ঘনাইকেও আমি স্পষ্টভাষায় কিছুই বলতে পারলাম না। হ্যাঁ হলে হ্যাঁ, না হলে না—- যাই বলি না কেন, স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল। ভিতরের আপত্তি মুখ ফুটে না প্রকাশ করলে লোকেরা শুনবে কেন? অতএব ঘনাই আমার ঘাড়ে চেপে বসল। তারপর আবার শুরু হল দুর্দশার নিত্যনতুন অধ্যায়। 

ঘনাই বিদেয় হল তো কোরক এল। তারপর দেখি, একা কোরক নয়, তার সঙ্গে এসে হাজির হল কয়েকজন। সবাই একসঙ্গে আমার ঘাড়ে চড়তে চায়। ভাগাভাগি করে চড়তে হলেও তাদের আপত্তি নেই। এমনি পছন্দের ঘাড় বানিয়ে ফেলেছি আমি। আসলে সহজে ঘাড়ে চড়তে দেওয়ার মত বেয়াকুব বলে দিকে দিকে আমি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছি ততদিনে। 

তো এটা আমার জবরদস্ত একটা রোগ, ওই যে গুরুতর একটা জিনিস নিজের আছে কিনা খুঁজে পাচ্ছি না, তার জন্যই এসব কাণ্ড। জিনিসটা কী মনে করতেও পারছি না। ওটার অভাবে আমার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। আমার যেভাবে চলা উচিত চলতে পারছি না, যা বলা উচিত না বলে হাবিজাবি কথা বলে ফেলছি, এমনসব কাজ করে বসছি যা নিজের কাছেই পছন্দসই নয়। 

প্রশ্ন হল, আমার মত অন্য লোকরাও এমন অসুখের শিকার কিনা। সবাই কি এই রোগে ভোগে? তার জন্য অন্যদের কার্যকলাপ লক্ষ করতে হয়। আর নাহলে দেখতে পারি আমার মধ্যে কোন্ জিনিসটা খুঁজে পাচ্ছি না যা এ-সমস্ত কিছুর কারণ। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *