রাজীব তন্তুবায়
গোড়ালি ক্ষয়ে যাওয়া রবারের চটিতে ফট্ ফট্ আওয়াজ তুলে আনমনে হাঁটছে তারু কুমার। মাথায় বাঁশের ঝুড়ি। ঝুড়িতে গোটাকয়েক পোড়া মাটির হাঁড়ি, ঘট ভাঁড় আর সরা — সুকৌশলে সাজানো ।
এদিকে পিঠফাটা রোদ মেলেছে জলখাওকি-বেলায়। পুয়ানের আগুনের মতো তেজ। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাষট্টি বছরের জীবনে এমন কত কত রোদবেলা মাথার উপর দিয়ে পার করে দিয়েছে তার কি কোনো হিসেবে আছে?
এই সবে পাড়ার গলি ছেড়ে পিচঢালা রাস্তায় উঠল তারু। পিচও তেতে আগুন। দূরে তাকালে মনে হয় ধোঁয়া উঠছে। প্যাঁচানো সে ধোঁয়া। যেন সংসারের সমস্ত প্যাঁচ — জটিলতা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আর তার আত্মা ধোঁয়া হয়ে পাক খেয়ে কেঁপে কেঁপে উপরে উঠে যাচ্ছে।
তবে রাস্তা আজ ফাঁকা। একটা সাইকেলও পেরোয়নি। কেউ বেরোয়নি ঘর থেকে। চারিদিক সুনশান। তারুকেও বেরোতে বারণ করেছিল লতিকা — “যাইও না। পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে। বুড়া হাঁড়ে ঠ্যাঙা খাল্যে দমটা বেইরাই যাবেক।” কথা শোনেনি তারু । সেদিন আটচালায় বসে পাড়ার ছেলেদের মোবাইলে দেখেছে, কেমন লাঠিপেটা করছে পুলিশ। কান ধরে উঠবস করাচ্ছে কাউকে কাউকে। হি হি করে হাসছিল সে। কিন্তু আজ বুকটা ঢিপঢিপ করছে তার। যদি পুলিশের গাড়ি আসে?
আসুক পুলিশ গাড়ি। সে কি আর এমনি এমনি বেরিয়েছে? পেটের টানে বেরিয়েছে। পেট বড়ো বালাই, পুলিশ কি সেটা বোঝে না? নাকি ওদের পেট নেই?
বোশেখ মাসে অমিয় দত্তের ছোট ছেলের বিয়ে। ‘এখভাঁড়’ ছাড়া কি আর বিয়ে বাড়ি হয়? বরাবরই দত্ত বাড়ির কাজঘরে হাঁড়ি কলসীর বরাত পড়ে তারু কুমারের উপর। তার যথাযোগ্য সম্মানও রাখে তারু । সানন্দে চাকা ঘুরিয়ে মাটির উপর মাটি লেপে বড় যত্ন করে বানায় সেসব। নতুন নতুন নক্সা তোলে তাদের উপর। ভারী সুন্দর তার হাতের কাজ! তাচ্ছিল্য করেও কেউ যদি প্রশংসা করে তো সে সঙ্গে সঙ্গে গলে জল।
আজকাল আর ক’জন এসবের কদর বোঝে? ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায় তারু কুমারের। বাপ-ঠাকুরদার আমলে, এমনকি এই সেদিন পর্যন্ত, সপরিবারে লেগে পড়ত মাটির কাজে। কী সেই উন্মাদনা! যেন চোখের সামনে সব সময় ভাসে। অঘ্রান মাসে যেই ধান ঝাড়ার কাজ শেষ হতো, অমনি মাটি পোড়ানোর ধুম লেগে যেত কুমোর পাড়ায়। হাঁড়ি, কলসী, মুড়ি ভাজা খোলা, চালমুজা — সুকায়দায় খড় দিয়ে সাজিয়ে গরুর গাড়িতে বোঝাই করে চলত অনেক অনেক দূরের গ্রামে। গাড়ির ডোগায় হ্যারিকেন ঝুলিয়ে মাঝরাতে সেই যে গাড়ি জুড়ত, ভিনগাঁয়ে এসে থামতো ভোর বেলায়। ছোটবেলায় নিতাইও যেত তার সাথে। একবার তো কৌতুহল বশত জিজ্ঞেসই করে বসেছিল, “বাবা, রবি ঠাকুর কি আমাদের গাড়ি দেখেই লেখেছিল — কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি, বোঝাই করা কলসী হাঁড়ি?”
ফ্যালফ্যাল করে হেসেছিল তারু। তারপর যেই একবার ‘হাঁড়ি… মুড়ি ভাজা খোলা…’ বলে হেঁকে দিত, অমনি পাড়াগাঁয়ের মহিলাদের ভীড় একেবারে হামলে পড়ত তাদের গাড়িতে। দেখতে দেখতে শেষ। যদিও বা দু-একটা ভাঙা-ভাঙি হাঁড়ি পড়ে থাকত, মাটির উনুন বানাবে বলে তাও তুলে নিত গৃহস্থের বউরা। বিনিময়ে নতুন ধানের বস্তায় বোঝাই হয়ে যেত গাড়ি। যারা পেতো না, তারা আফশোস করে জিজ্ঞেস করত, “আর কবে আইসবে গো কুমার?”
তারু তখন হাসি হাসি মুখে হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে বলত, ” পরের সপ্তায় গো।” আবার গাড়ি জুড়ত ঘরমুখে।
ইদানিং কে আর ঘরে মুড়ি ভাঁজে, যে মাটির খলার আশায় সপ্তাহভর কুমোরের জন্য অপেক্ষা করবে? এখন তো গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজা মেশিন। মোড়ে মোড়ে ছোলা-বাটোরা, ফাস্টফুডের দোকান। আজকালকার ছেলেরা কি আর সেভাবে মুড়ি খায়?
ভাবতে ভাবতে কখন যে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে খেয়াল নেই তারু কুমারের। চৌমাথার বটতলে দাঁড়িয়ে একটুখানি জিরিয়ে নিলে হয়। মাথা থেকে ঝুড়িটা যদি নামানো যেত! কিন্তু নামালে পরে যদি একা একা তুলতে না পারে? চারিদিকে কেউ কোথাও নেই। কে ধরে তুলে দেবে মাথায়? আর কিছুটা গেলেই তো দত্ত পাড়া। থাক, নামানোর দরকার নেই। তবুও ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নেয় তারু। না, পুলিশ গাড়ির বা দেখা নেই।
বোশেখ মাসে চাকা বন্ধ। সেই যে চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার দিন চাকার উপর মাটির শিব গড়ে পুজো হবে, থাকবে সারা মাস। এই এক মাস পুরোপুরি চাকার বিশ্রাম। কুমোরদের মাটির কাজও বন্ধ। পূর্বপুরুষের নিয়ম। তারু কি আর অমান্য করতে পারে? তাই আগে ভাগেই দত্ত বাবুদের বিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র বানিয়ে ফেলেছে সে। যা হয় দুটো টাকা। এই অসময়ে এটাই বা কম কিসে? যেটুকু হাতে ছিল তাও তো খালি হয়ে আসছে। এখন কতদিন লকডাউন চলবে কে জানে?
কুমোর হলেও সারাবছর শুধু মাটি নিয়েই পড়ে থাকে না তারু। জিজ্ঞেস করলেই বড় অনুশোচনা নিয়ে বলে, “ওতে কি আর আজকালকার দিনে পেট চলে হে?” সে এখন রোজ বিকেলে মোড়ের মাথায় চপ-ঘুগনির ঠেলা লাগায়। রান্নার হাতটিও নেহাত মন্দ নয়। সেই সুবাদে লোকের বড়সড় কাজঘরে রাঁধুনিদের সাথে হেলপারির কাজেও লেগে পড়ে মাঝেসাঝে। তাতেই ওর চলে যায় কোনোমতে।
তবে বাপুতে পেশাটা ছাড়তে পারেনি আজও। সে এক আলাদা টান। ভেজা মাটি থাসতে বসলেই বাপ ঠাকুরদার গন্ধ পায়। মনে মনে বিড়বিড় করে কথাও বলে তাদের সাথে, “আইসো, দেখে যাও হে তুমাদের শিল্পকর্ম কেমন চইলছে এখন। সবাই ছাড়্যে দিলেও আমি ছাড়ি নাই চাঁদ। গতর যতদিন, মাটিও ঘাইটবো ততদিন।” তাই তো সময় পেলেই দিব্য লেগে পড়ে। চাকা ঘুরায়। পুয়ান জ্বালায়।
মাঝে মাঝে খুব আক্ষেপ হয় তারু কুমারের। কেন যে দাদু দৌহিত্র পেয়ে পাঁচমুড়া থেকে সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এই রুখাশুখা শালগড়ে আসতে গেল? আজ যদি পাঁচমুড়াতেই থাকত, ওখানকার সব নামিদামি শিল্পীদের সঙ্গে কত সুন্দর মাটির কাজ শিখতে পারত। কত নাম-ডাক হতো। তার তৈরী পোড়া মাটির ঘোড়াও ছুটে বেড়াত দেশে বিদেশে। সেও হয়তো টেরাকোটার কাজে ওস্তাদ হয়ে উঠতো। সে সুযোগ আর পেল কই? তবে ঘোড়া যে একেবারে বানায় না , তা কিন্তু নয়। আখ্যান দিনে তেঁতুল তলায় যখন চুকাইসিনির পূজা হয়, তখন তো হাতি-ঘোড়ার অর্ডারটা তার কাছেই আসে। তার সাথে আরও দু-চার জন বরাত দেয়। মনের সুখে সেসব বানিয়েই সাধ মেটায়। যদিও পাঁচমুড়ারর মতো অতো সৌখিন হয় না। আর কেউ না জানুক, তারু তা জানে। আর জানে বলেই আক্ষেপ ঘুচে না তার।
তবে গ্রীষ্মকালে রাতের বেলায় যখন ভীষণ গরম লাগে, ঘরের ভেতরে শুয়ে থাকা অসহ্য হয়ে উঠে, তারু তখন উঠোনে বাবুই দড়ির খাট পেতে শোয়। একদৃষ্টিতে তারাভরা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন তেঁতুল গাছের উপর পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠে, ফুরফুরে বাতাসে গায়ের ঘাম শুষে নেয়, তখন যেন জীবনটা জুড়িয়ে যায়! আনন্দে গদগদ হয়ে ভাবে, এতবড় উঠান, এতবড় খোলা আকাশ, এতো সুন্দর ফুরফুরে বাতাস কি আর পাঁচমুড়ায় পেতাম?
আবার যখন মাটি বিলে মাটি খুঁড়তে গিয়ে দেখে, ক্ষেতের আলে মস্ত বড় ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছটার উপর রামধনু উঠেছে, তখন মনে হয় এতো রঙ কি আর অন্য কোথাও আছে? আবেগ তখন উথলে উঠে। সমস্ত আক্ষেপ, সমস্ত অতৃপ্তি যেন গলে জল হয়ে যায়। সেই সুখ বুকে নিয়েই কোদালের পর কোদাল মাটি তুলে তারু কুমার। বাড়িতে এসে মাটি থাসে — চাকা ঘোরায়।
তবে সেই আনন্দটা আর লতিকাকে বোঝানো গেল না কোনদিন। বেচারি সংসারে সুখ বলে কিছু বুঝলো না। ভেবেছিল ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌ আনলে যদি একটু আসান হয়। সেইমতো বিয়েও দিয়েছিল নিতাইয়ের। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, কপালে নেই ঘী, ঠক্ ঠকালে হবে কী? সেই হয়েছে লতিকার অবস্থা। বছর তিনেক বিয়ে হতে না হতেই বৌয়ের কথায় ভিনু হয়ে গেল নিতাই। ভিনু কি আর সাধে হলো? গুরগুরানিতে। মেয়ে বাড়ি থেকে নাতিটাকে নিজের কাছে এনে রেখেছে কিনা!
দেখে শুনে ভালো ঘরেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল তারু । বিঘা দশেক ষোল জমি। পালুইকে পালুই ধান। গোয়াল ভর্তি গরু। অভাব তো ছিল না কিছুই। কিন্তু তখন তো আর জানা ছিল না জামাইটা নেশাখোর, মাতাল। সেরকম কোনো কাজ টাজ করে না। যতদিন শ্বশুরটা বেঁচে ছিল সব ঠিকঠাকই ছিল। শ্বশুরটাও মরল, সংসারটাও ভেঙে গেল। অন্য ভাইয়েরা সব নিজের নিজের আখের গুছিয়ে নিল। মাতাল স্বামীকে নিয়ে খালে পড়ল মেয়েটা। তারপর আবার তিন তিনটে ছেলেমেয়ে। সংসার চালাতে বেচারি মেয়েটা যেন হিমসিম খেয়ে যায়।
বছর দুই হল, মকর সংক্রান্তির আগের দিন লতিকাই থাকতে না পেরে বলেছিল, “যাও লাতিটাকে লিয়ে আইস। আমাদের কাছেই রাইখব। ইখেনেই দুটা খাঁইয়ে পইরে মানুষ হয় ত হোক। মিয়াটার আমার যদি টুকু আসান হয়।”
দেরি করেনি তারু কুমার। পরদিন সকাল সকাল মকর ডুব দিয়ে বছর দশের নাতিকে নিয়ে এল ঘরে। তাতেও কি আর শান্তি আছে? বৌমাটা একদিনও আর দেখতে পারল না তাকে। মনের ভেতর সেই যে গুরগুরানি শুরু হল, আজও ঘুচল না। মেয়েমানুষের মনে একবার গুরগুরানি ঢুকলে কি আর সংসার টিকে? লতিকার সংসারও টিকল না।
ভাবতে ভাবতে রাস্তার মাঝেই থমকে দাঁড়ায় তারু। ঝিমঝিম করে উঠে মাথাটা। পিচগলা রাস্তার মরিচিকায় চোখে যেন ঝাপসা দেখে । ঠিক সেদিনও এমনটাই দেখেছিল।
গত বছর শুনুকপাহাড়ীর হাঁট থেকে একটা বেশ বড়সড় দেশী মোরগ এনেছিল নিতাই। চৈত গাজনের দিন বেয়াই আসতেই কেটে মাংস করেছিল তারু কুমার। খুশি মনে রান্না করেছিল লতিকা। খেতে দিতে গিয়ে বেছে বেছে ‘মেটে’ আর ‘জিরানগুটি’টা দিয়েছিল নাতিটাকে। ছেলেটা মাংসের চেয়ে মেটে আর জিরানগুটিই খেতে বেশি পছন্দ করে। আর সেটাই কিনা কাল হল। খাবার সময় পাতে জিরানগুটি না পেয়ে বৌমা মাংসই খেল না সেদিন।
বৌ মাংস খায়নি শুনে মায়ের উপর ভীষণ চটে গিয়ে গন্ডগোলে পাহাড় ভেঙে দিয়েছিল নিতাই। রাগে অভিমানে কোলের মেয়েটাকে নিয়ে বাবার সাথে সেদিন বিকেলেই বাপের বাড়ি চলে গেল বৌমা। কিছুদিন পর যখন ফিরে এল, নিতাইয়ের হাবভাব যেন অনেক বদলে গেল। ওরা কী চায় তারু কুমারের আর বুঝতে বাকি রইল না। থাকতে না পেরে নিজে থেকেই বলে বসল, “তোদের যখন এতটাই অসুবিধা হচ্ছে, তখন তোরা আলাদাই খা বাপ। আমরা বুড়াবুড়ি ছোট লাতিটাকে লিয়ে পেটের ভাত ঠিক জুটাই লিব।”
সেই তখন থেকে পেটের ভাত জুটাতে লতিকাকে যে কী না কষ্ট করতে হয়, তা একমাত্র সেই জানে। ভাবতে ভাবতে যেন শিউরে উঠল তারু। বিড়বিড় করে নিজের মনটাকেই গালি দিতে শুরু করলো। শালা, সব সময় শুধু পিছনের ঘটনাই টেনে আনবে! ভালো কিছু ভাবতে পারে না?
কে যেন সাইকেল নিয়ে এদিকে আসছে? দেখেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো তারু কুমারের। সিভিক পুলিশ ছেলেটা নয় তো? একটু ভালো করে নজর করতেই আর বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। ও পাড়ার বিমল মাস্টার।
“কি হে তারু, কোথায় চললে?” পা নামিয়ে দাঁড়াল বিমল মাস্টার। তারুও ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
“ঐ যে দত্ত বাবুর ঘরে। উনার বেটার বিয়াতে আইখভাঁড় লাইগবেক ন!” পান গাবানো দাঁত বের করে হেসে হেসে বলে তারু কুমার।
“সে কী হে, এই লকডাউনে বিয়া-ঘর? পুলিশে ঠ্যাঙাবেক যে!”
“কী জানি? আমাকে সেদিন বলেছিলেন বলেই ত লিয়ে যাচ্ছি। তা কোন দিকে গেছিলেন?”
“আর বইলো না, তুমার বৌদির মাথাটা ধরেছে। সেই জন্যই হাবলু ডাক্তারের কাছে দুটা বড়ি নিয়ে আইলম।” বলেই একটু এগিয়ে গিয়ে আবার থামলেন মাস্টার। “দেখো মনে পড়ল, বলছিলাম তোমার গাছের ইঁচড় কিন্তু খুব মিষ্টি। আর আছে?”
“না মাস্টার। আর নাই। যা ছিল সব বিকে দিয়েছি। চারটা আছে। থাক, কাঁঠাল হবেক।”
“আচ্ছা” বলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল বিমল মাস্টার। ততক্ষণে তারু কুমারের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে মস্ত বড় একটা কাঁঠাল গাছ। এক মাথা ঝাঁকড়া ডালপালা নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মাটি বিলের আলের উপর। ডালে ডালে কত পাখি। পাতার আড়ালে পাখির বাসা, বাসায় বাসায় পাখির ডিম, ছোটো ছোটো ছানা। ঝাপসা চোখেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তারু।
ইদানিং কয়েকবছর বেশ ভালো ফলন দিচ্ছে গাছটা। ঘাড়ে-মুড়ে ছোটো ছোটো জালি। একটাও পড় যায় না। কালী পুজোর ঝাড়বাতির মতো আলো করে ধরে থাকে ডালে ডালে। বাজারে আবার ইঁচড়ের চাহিদাও খুব। এই বছরও পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে থুয়েও প্রায় চল্লিশ কেজির মতো ইঁচড় বিকেছে তারু কুমার। হবেই না বা কেন? সে কি যে সে জায়গার বীজ? পাঁচমুড়ার বীজ কিনা!
সেবার, দাদু যখন পিছলে পড়ে পা ভাঙালো, তারু তখন খুব ছোট। খবর পেয়েই পাঁচমুড়া থেকে দাদুর ছোট ভাই ছুটে এসেছিল দাদুকে দেখতে। সেই তখনই এনেছিল মস্ত বড় একটা কাঁঠাল। কাঁঠাল তো নয় যেন অমৃত। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। তা থেকেই কয়েকটা কোষ খেতে খেতে বাবার সাথে মাটি বিলে মাটি খুঁড়তে গিয়েছিল তারু। মুখের শেষ বীজটা সেখানেই ফেলেছিল আলের উপর। এঁটেল মাটিতে বর্ষার জল পেয়ে ঝোঁপের মধ্যে কখন যে বীজ ফুটে গাছ হয়েছিল, আর কখন যে সেই গাছ তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছিল খেয়ালই করিনি কেউ। খেয়াল হল যখন লম্বায় তারুর বাবাকেও ডিঙিয়ে গেল। দেখা মাত্রই এক অনাবিল হাসি ফুটে উঠেছিল বাবার মুখে। “ই যে দেখছি পাঁচমুড়ার লোক রে বাপ। মাটি বিল আগলাতে মাথা তুলেছে নকি!” বলেই নিজে থেকেই তড়িঘড়ি বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল বাবা। আজ সেই গাছের দিকে তাকালে যেন তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়।
দত্তবাবুদের বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াল তারু। এ কী ব্যাপার! সদর দরজা লাগানো রয়েছে যে। ডান হাতে মাথার ঝুড়িটা ধরা। বাম হাতে হাল্কা করে ঠেলা দিল তারু। খুলল না কপাট। ভিতর থেকে খিল দেওয়া। দিনের বেলায় তো সাধারণত দত্ত বাড়িতে কপাট দেওয়া থাকে না! কী করবে খুঁজে না পেয়ে একটু একদিক ওদিক তাকাতে থাকে।
দত্তবাবু তখন নির্মীয়মান দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্লাস্টার না হওয়া দেয়ালের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। দেখতে পেয়েই “বাবু” বলে হাঁক পাড়ে তারু।
“কী ব্যাপার তারু? হঠাৎ এই রোদ বেলায়?”
“আজ্ঞে, আইখভাঁড় লিয়ে আসেছি। আপনি বললেন যে সেদিন…!” চেঁচিয়ে বলল তারু কুমার।
“ও আচ্ছা, দাঁড়াও। আমি যাচ্ছি।” বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই নীচে নেমে এসে সদর দরজার ছোট গেটটা খুলে দাঁড়ালেন। মুখে মাস্ক, মাথায় গামছাটা ঘোমটার মতো করে জড়ানো। তারু যেই ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়ায়, অমনি রে রে করে উঠলেন, ” আহা! আহা! ভেতরে এসো না। বাইরেই দাঁড়াও। তার আগে মুখে গামছাটা বেজাও। জানো না কী সব হচ্ছে?”
থমকে দাঁড়াল তারু কুমার। এ কী করছেন দত্তবাবু? বাবার আমল থেকে দেখে আসছে কুমোর বাড়ির লোকের কাছে দত্ত বাড়ির দরজা সব সময় খোলা। আজ তাতে দত্তবাবু নিজে বাঁধা দিচ্ছেন! লকডাউন চলছে বলে দুয়ারে এলে মানুষ মানুষকে এমনি করবে? ভাবতে ভাবতে আনমনে গলার গামছাটা মুখে টেনে নিল তারু।
দত্তবাবু টেনে টেনে বললেন, “এখন আর আনার কী দরকার ছিল? বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানই তো আর করা যাবে না হে, তার কি আইখভাঁড় লাগবে?”
“তবে যে সেদিন বইললেন ?” নিরুৎসাহের সুর শোনা গেল তারু কুমারের গলায়। মুখের গামছাটাও হুস্ করে নেমে গেল গলার কাছে।
“হ্যাঁ বলেছিলাম। তখন তো আর এমনটা হবে জানা ছিল না।”
“তাহলে?” রোদে পোড়া মুখটা আরও যেন কুঁকড়ে গেল তারু কুমারের।
“সেই তো হে…” একটু যেন চিন্তা করে বললেন দত্তবাবু, “ঠিক আছে। এনেছো যখন, তখন রেখেই যাও। ওই বাইরেই নামাও। আমরা নিয়ে নেব। তবে এলে যখন সঙ্গে করে একটা ইঁচড় আনতে পারলে না?”
এতোক্ষণে চওড়া হাসি ফুটে উঠল তারু কুমারের মুখে। ঝুড়িটা গেটের সামনে নামিয়ে জিব কামড়ে বলল, “ইস্! আগে যদি বলতেন?”
“না, না। আমি এমনি বললাম।” হাসতে হাসতে বললেন দত্তবাবু, “খেয়েছি তোমার গাছের ইঁচড়। খুব মিষ্টি।”
“তা বটে। খুব খাওয়া হল ইবছর।” ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলল তারু।
“খাও খাও। এই বছরই তো পাবে। পরের বছর থেকে তো আর পাবে না হে।”
কথাটা শুনতে কেমন লাগল বটে। তবে তা পাত্তা না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে হাসতে লাগল তারু কুমার।
“ভালোই করেছো বুঝলে, অনেক দিনের গাছ। কোন দিন শুকিয়ে মরে যাবে। তাছাড়া ফাঁকা মাঠের মাঝে গাছ। যা বাজ পড়ছে ইদানিং। তার চেয়ে আগ ভাগে বেঁচে দিয়েছো, ভালোই করেছো।”
কী বলছেন দত্তবাবু? মুখের হাসিটা ম্লান হয়ে গেল তারু কুমারের। “বুঝলাম না বাবু।”
“সে কি হে, তুমি জানো না?”
ঘাড় নাড়ল তারু কুমার।
” এই যে তোমার ছেলের সাথে দশ হাজার টাকায় রফা হয়েছে। তুমি জানো না?”
“নিতাই আমাকে না বলে গাছটার রফা করেছে? তাও আরো হয় নকি?” ভ্রু কুঁচকে গেল তারু কুমারের।
সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন দত্তবাবু। মাস্কটা চিবুকের কাছে টেনে এনে বললেন, “লকডাউনের আগেটাতে একদিন মোড়ের চা দোকানে বসে আলোচনা করছিলাম। দোতলাটার দরজা জানালার জন্য কাঠের দরকার তো। তারই খোঁজ করছিলাম। নিতাই হয়তো সেদিন শুনেছিল। তারপর এই তো গত পরশু, ও নিজে থেকেই আমাদের বাড়িতে এসে কাঁঠাল গাছটার কথা বলল। আমি শুনেছি কাঁঠাল পাটার দরজা জানালা খুব মজবুত হয়। তাই সেদিন দর দাম করে এক হাজার টাকা বায়না দিয়ে দিলাম। তোমাকে বলেনি?”
থরথর করে কাঁপতে থাকে তারু কুমার। আর দাঁড়াতে পারে না সেখানে। কাঁপা কাঁপা গলায় “আমি আসছি বাবু” বলে হন হন করে এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে।
“ওহে তারু, ভাঁড়গুলোর দামটা নিয়ে যাও..” হাঁক পাড়েন দত্ত বাবু। কানে ঢুকল না তারু কুমারের।
(২)
উঠোনে বসে দাঁড়ি কামাচ্ছিল নিতাই। পাশেই ঝুপড়ির রান্নাঘর থেকে ধুসর ধোঁয়া দলা পাকিয়ে বেরিয়ে এসে উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর। ভাত চাপিয়েছে নিতাইয়ের বৌ। তাদের তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটি একাই ধুলোবালি নিয়ে খেলছে উঠোনে। তারুকে আসতে দেখেই দাদু দাদু করে সামনে এগিয়ে আসে। অন্য দিন হলে কোলে নিয়ে আদর করত তারু। আজ সেদিকে মন নেই তার। তাকে পাশ কাটিয়ে নিতাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “হে বাপ, কী শুনছি? তুই নকি মাটি বিলের কাঁঠাল গাছটা দত্তবাবুকে বিকে দিচ্ছু?”
বাবার আচরণে প্রথমে একটু অবাক হলেও ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগেনি নিতাইয়ের। “কে বইলল?” রেজার চালাতে চালাতেই একটুখানি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল নিতাই।
“কে বইলল মানে? দত্তবাবু নিজে বইললেন আমাকে। তুই নকি হাজার টাকা বায়নাও লিয়েছু?”
মনে মনে একটা চাপা আশঙ্কা ছিলই নিতাইয়ের। বাবা জানলে আপত্তি যে করবেই তা সে ঠিক জানত। ভেবেছিল বাবাকে না জানিয়েই একদিন লোক আনিয়ে গাছটা কেটে ফেলবে। তখন যদি আপত্তি করে তো করবে। গাছ তো আর জোড়া লাগানো যাবে না! কিন্তু দেখা হলে দত্তবাবু যে আগেই বলে দেবেন সেটা আন্দাজ করতে পারেনি। মনে মনে একটু রাগ হয় নিতাইয়ের। রাগের বশেই জবাব দেয়, “হঁ, বায়না লিয়েছি। তাতে কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে?” জ্বলে উঠল তারু কুমার। “তোর বাপটা এখনও জলজ্যান্ত বাঁচে। তার আগেই সবকিছু ঘুঁচাই দিব ভাবেছু?”
“কী ঘুঁচাই দিচ্ছি? মাটি বিলটা তো আর বিকি নাই!”
“উটা তার চাইতে কম কিসে রে? দাদুর আমলের গাছ। কত কাঁঠাল ধরে। আর তুই উটাকেই বিকে দিচ্ছু! কিসের অত অভাব পড়ল রে বাপ?”
হাতটা একটু কেঁপে উঠল নিতাইয়ের। ব্লেডটা লেগে গেল গালটায়। ভরভর করে রক্ত বেরিয়ে এল সেখান দিয়ে। আঙুল দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরে উত্তেজিত স্বরে বলল, “আমার অভাবের কী খোঁজ রাখ তুমি? তুমার বৌমা যে সাত মাসের পুয়াতি সে খেয়াল আছে? আজ দু’মাস ঘরে বসে আছি। এই একটা কাজের সন্ধান পাইয়েছিলম, আর এদিকে লকডাউন শুরু হয়ে গেল। কবে ইটা শেষ হবেক কেউ জানে নাই। হাতে টাকা পয়সাও সেরকম নাই। বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলে কার কাছে হাত পাতব? কোনোদিন জানতে চাইয়েছ সেটা?”
থতমত খেয়ে গেল তারু কুমার। কী বলবে খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চুপচাপ। নিতাই তখন কাটা জায়গায় ফিটকিরি ঘসছে। তারু কুমার আমতা আমতা করে বলল, “তা বলে গাছটা? আর অন্য কোন উপায় ভাবতে পারলি নাই?”
“কী উপায় ভাবব? অতই যখন গাছটাকে মায়া, তখন দাও ন হাজার দশেক টাকা জোগাড় করে। তবেই ত ল্যাঠা চুকে যায়।” বলেই দাঁড়ি কাটার সরঞ্জাম গুটিয়ে তেজ দেখিয়ে ঘরে ঢুকে গেল নিতাই। নিতাইয়ের বৌ এতক্ষণ রান্না ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বাপ বেটার কথপোকথন শুনছিল। তারু কুমার তার দিকে তাকাতেই সেও আবার ঢুকে গেল রান্না ঘরে।
উনোনের পুরো ধোঁয়াটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তারু কুমারের শরীরে। শুষে নিচ্ছে একটু একটু করে। আবার যেন ঝাপসা দেখছে তারু কুমার। হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। বুকের ভেতর চাপা ক্ষোভ যেন বল না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসছে নাক বেয়ে।
কথাটা যে একেবারে মন্দ বলছে নিতাই, তা তো নয়। গতবার নাতনিটা হবার সময কম কষ্ট পায়নি বৌমা। ঠিক সময়ে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সিজার না করালে মা-ছা কাউকেই আর বাঁচানো যেত না। এবারও যে তেমনটা হবে না কে বলতে পারে?
কিন্তু দশ হাজার টাকা সে পাবে কোথায়? না পেলে গাছটা থাকবে না। ভাবতে ভাবতে মাথার ভেতরটা যেন ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে। একটু যেন টলে যায় তারু। এক কপাল চিন্তার ভাঁজ নিয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে খাট পেতে।
কিছুক্ষণ পর উঠে পড়ে তারু কুমার। কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ কোদালটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটা দেয় মাঠের দিকে। সোজা এসে থামে মাটি বিলের কাঁঠাল তলায়। এসেই গাছটার গায়ে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।
মাটি বিলের জল প্রায় শুকিয়ে গেছে। যদিও বা একটু আধটু তলানিতে পড়ে আছে, তাও আবার ঘোলাটে। সেই ঘোলা জলেই দু একটা বক এসে একদৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। দু’দিন আগে কাদা ঘেটে গাবান করে ছোট ছোট চ্যাং, গড়ুই, চুনোপুটি— যা মাছ ছিল সব ধরে নিয়েছে তারু কুমার নিজেই। শেষ হলেও সব শেষ হয়না কখনও, বকেরা তা জানে। দেখতে দেখতে হঠাৎ কোথা থেকে একটা ক্ষুদে মাছরাঙা ছপাৎ করে একটা চুনো মাছ ঠোঁটে তুলে নিয়ে উড়ে এসে বসে কাঁঠাল গাছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি মাছরাঙা কিক্ কিক্ করে ডেকে উঠে এদিক সেদিক। বুকটা ধ্বক করে উঠে তারু কুমারের। চোখের সামনে ভেসে উঠে বাবার মুখ। আলের উপর বসে বাবা বলত, “মাটি বিল কি শুধুই মাটির খাল রে? ইটা আমাদের ভাতঘর।”
বাবার কথা কি কখনও মিথ্যা হয়? আর কিছু নাই থাক, মাটি তো আছে। দশ হাজার কেন, হাজার হাজার টাকার মাটি।
কোদালটা হাতে তুলে নেয় তারু। এগিয়ে যায় মাটি বিলের দিকে। দশ হাজার টাকার মাটি খুঁড়বে সে। পাচমুড়ার ঘোড়া বানাবে, হাঁড়ি কলসী বানাবে, চালমুজা খোলা বানাবে… দশ হাজার টাকার। নিতাইয়ের বৌয়ের পেটের সন্তান বাঁচবে, কাঁঠাল গাছ বাঁচবে, তারু কুমারের সম্মান বাঁচবে। গলার গামছাটা শক্ত করে কোমরে বেঁধে কোদাল নিয়ে নেমে পড়ে মাটি বিলে। ঝপাঝপ ঝপাঝপ মাটি তুলতে থাকে একনাগাড়ে। পাড়ের কাঁঠাল গাছে তখন হাওয়া লেগেছে…. সন সন সুর উঠেছে পাতায় পাতায়… পাখিরাও গান জুড়েছে ভিন্ন সুরে। কোদালে কোদালে সুর মিলাচ্ছে তারু কুমার, ঝপাঝপ ঝপাঝপ….. চলছেই…. অবিরাম…
চমৎকার লেখা।