বিদিশা বসু

একবেলা মহাকুম্ভ মেলাতে

বেনারসে পৌঁছে প্রথম দিনই কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া সহ সন্ধ্যারতি দেখা… সবটাই সম্পূর্ণ করা হয়েছিলো। এর সাথে সাথে আমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ হলো,যা এবারের সফরের মূল উদ্দেশ্য। তাই হোটেলে কথা বলে ঠিক হলো,পরের দিন অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারী প্রয়াগরাজে যাওয়া হবে… মহাকুম্ভে। ড্রাইভার বললেন যত সকালে বেড়োনো যাবে তত সুবিধা, নাহলে জ্যামে আটকে পৌঁছাতে দেরি হবে৷ সে মত আমরা ভোর ৬ টায় স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম বেনারস থেকে। হোটেল থেকে সকালের জল খাবার গুছিয়ে দিয়েছিলো,যাতে পথে যেতে যেতেই আমরা খেয়ে নিই,রাস্তায় কোথাও থামতে না হয়। বেনারস থেকে প্রয়াগের দূরত্ব ১২৫ কিমি মত, মোটামুটি ২.৫ ঘন্টা পথ খুব সুগম যাওয়ার পরে প্রয়াগে প্রবেশের মুখে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়ার জন্য সোজা যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। তারপর ড্রাইভার দাদা বামদিকের একটা রাস্তা ধরলেন যা কোন স্হানীয় জনপদ মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু সেই রাস্তার মুখে মুখে ছোট বড় গাড়ির জটলা, ফলে আমরা আটকে যেতে লাগলাম। এরপর সেই ছোট বাধা সব কাটিয়ে প্রয়াগের মুখে যখন গাড়ি ঢুকলো চারপাশে মানুষের ঢল নজরে এলো। সে এক অন্য দৃশ্য। রাস্তার পাশে বড় বড় সব বাস দাঁড়ানো। বাসের জানলায় শাড়ি গামছা বা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ঝোলানো দেখে মনে হলো,দূর দূর প্রান্ত থেকে মানুষ এই বাসে চেপে এসেছে, আপাতত কয়েকদিনের সংসার এখানেই। তারপর দলে দলে বাচ্চা বড় সব ধরনের মানুষ ঝোলা ব্যাগ বাক্স কাঁধে মাথায় হাতে নিয়ে চলেছে কুম্ভ মেলার দিকে৷ সেখান থেকে হয়ত মেলার দূরত্ব ১২-১৪ কিমি। কিন্তু মানুষের উৎসাহে কোন খামতি নেই। তারা চলেছে কোন এক অজানা আকর্ষণে। প্রয়াগে প্রবেশের মুখে শাস্ত্রী ব্রিজের উপরে যখন গাড়ি উঠলো,সে এক অদ্ভুত দৃশ্য নজরে এলো। নদীর দুপাড় জুড়ে শুধু মেলার তাঁবু আর তা্ঁবু। যতদূর চোখ যাচ্ছে নানারকমের প্যান্ডেলের আকারের তাঁবু কিংবা গম্বুজের মত দেখতে মাথা উঁচু করে আছে থাকার নানা আস্তানা। নদীতে চড়া পড়েছে, তার সাদা বালির উপরে মানুষের আনাগোনা, এত বিশাল আকার আয়োজন আমি এ জন্মে কখনো দেখি নি। সেই সাথে নজরে এলো নদী পারাপারের জন্য পর সমান্তরালভাবে অনেক ব্রিজ আর তার উপরে পিলপিল করে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। আমরা দূর থেকে ব্রিজের উপরের এ দৃশ্য দেখছিলাম.. তাই মনে হচ্ছিলো কেউ যেন কোন এক তাঁবু খাটানো নতুন নগরী স্হাপন করেছে এ জায়গায়। এবার শুরু হলো কুম্ভ মেলায় ঢোকার আসল সমস্যা…  চরম জ্যাম। শহরে ঢুকে পর পর এত এত জায়গায় গাড়ি আটকে গেল যে, ২.৫ ঘন্টার রাস্তা ৫ ঘন্টার উপরে লাগলো। এই জ্যামে আটকে রাস্তার দুপাশে নজরে এলো..দেশের নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া মানুষের ঢল। বয়স্কদের সঙ্গে নিয়ে চলেছে ছেলে মেয়ের দল,আবার অসুস্হ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে বাবা মা,কোথাও আবার নানা রকম বসনধারী সন্ন্যাসী দল চলেছে নামগান করতে করতে। কিছু লোক বাইকে করে আসছে,তাদের সাথে নতুন যুগের রুকস্যাক ব্যাগ,যোগা ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ।আবার দেহাতি মানুষের দল সাথে নিয়ে চলেছে তার জরাজীর্ণ কম্বল বালিশ চাদর নিয়ে। অধিকাংশ মানুষের হাতে জল নেওয়ার ডিব্বা। কেউ কেউ তো খালি পায়ে পথ চলছে নির্দ্বিধায়।বোট ঘাটের উদ্দেশ্যে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিলো। সে পথে যাওয়ার পাশে যে অস্হায়ী ব্রিজ তাতে শুধু মানুষ পায়ে হেঁটে চলেছে। কেউ মাঝপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিশ্রাম নিচ্ছে,কেউ বা স্নান সেরে বাড়ির পথে ফিরছে তাদের পিঠে বোঝা,হাতে বড় বড় ড্রামে গঙ্গাজল। আমরা অবশেষে যমুনা ঘাটের কাছে যখন পৌঁছালাম দূর থেকে ত্রিবেণী সঙ্গমস্হলে ভীড় উপচে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়লো। ওখান থেকে বোটে করে ত্রিবেণীতে নিয়ে যায়,সেখানে স্নানের ব্যবস্হা আছে।গঙ্গাজল ভরে ওখান থেকে লোকজন স্নান সেরে ফিরছে। তবে আমরা যখন গেলাম,শুনলাম এখন নৌকা পারাপার বন্ধ। ও দিকে মানুষের ভীড় বেশি। তাই প্রশাসন থেকে আপাতত নৌকা যাওয়া বন্ধ রেখেছে। সঙ্গম থেকে নৌকাগুলো ফিরে আসার পরে পুলিশ ওদিক থেকে সিগনাল দিলে তবে আবার নতুন করে নৌকা ত্রিবেণীতে যাবে। কিন্তু ওখানে উপস্হিত মাঝিরা কেউ কোন নির্দিষ্ট সময় জানাতে পারলো না যে কখন আবার নৌকা চলাচল শুরু হবে। সময়টা ১ ঘন্টাও হতে পারে আবার ২ ঘন্টাও,কোন নিশ্চিত করে বলা যায় না। এর মাঝে পুলিশ কিছু লোককে স্পেশাল বোটে এদিকে পাঠালো,পরে জানলাম যে তারা বিশেষ পাস নিয়ে এসেছে, কেউ প্রশাসন বা পুলিশের আত্মীয় কিংবা সাংবাদিক। কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষ ঐ নদীর পাড়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন আবার নৌকা নিয়ে যাবে সেই পুণ্য স্নান করার জায়গায়। এবার আমরা উপলব্ধি করলাম যে,এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের দিনের মধ্যে পুরো সময়টাই চলে যাবে। আমাদের তারপর আবার বেনারসে ফিরেও যেতে হবে। আর আমাদের মহাকুম্ভে আসার উদ্দেশ্য তো এই পুণ্যস্নান নয়,আমরা এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের মেলা দেখতে।মেলার মধ্যে ঢুকে পায়ে হেঁটে তার চারপাশকে চাক্ষুষ না করলে এখানে আসাটা ব্যর্থ। এইদিকটা মেলার অন্যপ্রান্ত,এখান থেকে নৌকা করে ত্রিবেণী সঙ্গমে গিয়ে স্নান করে ফিরে আসতে হয়,কিন্তু মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকতে গেলে ঐ অস্হায়ী ব্রিজ গুলোতে উঠে যেতে হবে,যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য,বিশেষ করে মায়ের পক্ষে তা অসম্ভব। অগত্যা ড্রাইভার দাদাকে অনুরোধ করা হলো যে,এমন কোথাও গাড়ি দাঁড় করাতে যেখান থেকে পায়ে হেঁটে মেলার একটা দিক দেখা সম্ভব। সে কথা শুনে ড্রাইভার দাদা একটু অবাক এবং মনোক্ষুণ্ণ হলেন যে,এরা কেমন লোক, পুণ্য স্নানের এমন ভালো ব্যবস্হা ফেলে রেখে এরা মেলা ঘুরবে শুধু। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু অপেক্ষা করে ওখানে যেতে,আর আমরা সেখানে দাঁড়াতে চাইলাম না৷ তবু উনি যাত্রীদের কথানুযায়ী রাস্তার কিছুটা আগে গিয়ে মিন্টো পার্কের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। সেখান থেকে আমাদের কুম্ভ মেলায় পায়ে হেঁটে দেখার শুরু।
এবার আসি এবারের কুম্ভ মেলা প্রসঙ্গে। এতকাল পর্যন্ত কুম্ভমেলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। কিন্তু কোথাও ঘুরতে গেলে সে সম্পর্কে স্বল্প হলেও জানতে হয়। সাধারণত প্রতি ১২ বছরে চার জায়গায় ঘুরে ঘুরে কুম্ভ মেলা হয়। এর মধ্যে প্রতি ১২ বছরে একবার পূর্ণ কুম্ভমেলা হয়। সাধারণত হরিদ্বার এবং এলাহাবাদ ( বর্তমানে প্রয়াগরাজ) এই পূর্ণ কুম্ভ হয় ১২ বছর অন্তর অন্তর। কথিত আছে যে, হিন্দু পৌরাণিক গাঁথা অনুযায়ী সমুদ্র মন্হনের সময়ে দেবতা এবং অসুরের অমৃত নিয়ে লড়াইয়ে যখন অমৃত ঘড়া উত্থিত হচ্ছিল তখন কয়েক ফোঁটা অমৃত এই স্হানেও পড়ে। তার ফলে নির্দিষ্ট তিথি বা সময়ে এই জলে স্নান করলে পুণ্য লাভ হয়৷ হিন্দু পুরাণের এই বিশ্বাসের উপরে আস্হা রেখে প্রতি কুম্ভমেলায় লাভ লাভ লোক এক জায়গায় হয়ে অমৃত স্নান করে। এই স্নানের মূল লক্ষ্য হলো… মোক্ষ লাভ করা। এর মধ্যে প্রয়াগের সাগর সঙ্গম যা তিনটি নদী গঙ্গা যমুনা এবং সরস্বতীর মিলনস্হল সেই ত্রিবেণী সঙ্গমে ডুব দেওয়াকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অতি পুণ্য হিসেবে গণ্য করে। এবারের কুম্ভ মেলা ১২ বারের পরে ১২ বছরের তফাতে ১৪৪ বছর পরে সংঘটিত হচ্ছে যা নাকি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ,একে তাই মহাকুম্ভ নাম দেওয়া হয়। লোকের মধ্যে বিশ্বাস যে,এ জন্মে এই বিশেষ সন্ধিক্ষণ আর কখনও আসবে না। তাই সারাবিশ্বে এই মেলাকে নিয়ে এক আলোড়ন পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাগম, এত বড় মেলা ভারতবর্ষে আর কোথাও হয় না। প্রায় ৪০০০ হেক্টর বিস্তৃত নদীর দুপাড় জুড়ে এ মেলা বসেছে। পুরো মেলাকে ২৫ টি সেক্টরে ভাগ করা এবং ৩০ টি অস্হায়ী পল্টন ব্রিজের ব্যবস্হা আছে। এত বড় মেলা একবেলা তো নয়ই একদিনেও ঘুরে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো… কুম্ভমেলা দেখার এক এবং একমাত্র উপায়, পায়ে হাঁটা। এই সব সেক্টর গুলো থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে সঙ্গমে এসে স্নান করতে হয়,তাই এত এত মানুষ হেঁটে হেঁটে চলেছেন পুণ্য স্নানের উদ্দেশ্যে। সারাবিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে ৪৫ দিন ব্যাপী,যেখানে আন্দাজ প্রায় ৩০-৪০ কোটি মানুষের সমাগম হবে। ছয়দিনের শাহীস্নান সহ ১৩ই জানুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন।

আমরা যে পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম সেটা ছিল সেক্টর ৩-৪, সেখানেই সঙ্গম যাওয়ার রাস্তা। মানুষের মাঝে নিজেরাও মিশে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে। এ এক বিচিত্র মেলা। এত এত সব বড় বড় এক একটা স্টল। আমাদের স্কুল বিল্ডিং সহ মাঠ নিয়ে যতটা জায়গা তত জায়গা জুড়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অস্হায়ী অফিস। রেলের কাউন্টার খোলা..  সেখানের ডিজিটাল স্ক্রিনে কখন কোন ট্রেন কোন প্লাটফর্মে তার সংবাদ। ভোটার তালিকা সংশোধন সহ ভারতীয় ডাক বিভাগ, বিএস এন এল এর সহায়তা কেন্দ্র।  এছাড়া পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আর্মি সহ নানা রকম সরকারি পরিসেবার অস্হায়ী আস্তানা অনেক অনেক জায়গা জুড়ে। এছাড়া বায়ো টয়লেট,পানীয় জলের পরিসেবা কিছুটা পথের অন্তর অন্তর। আমরা হনুমান মন্দির যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম ভারতের নানা রাজ্যের মানুষের সাথে পায়ে হেঁটে। কিন্তু মা এতটা পথ হেঁটে আর চলতে পারছিলো না,সেই সাথে মানুষের ভীড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পরে নজরে আসে বিভিন্ন রকমের ব্যাঙ্কের অস্হায়ী কাউন্টার খুলেছে,যেখানে ATM সহ সব রকমের পরিসেবা দেওয়ার ব্যবস্হা আছে। কোন ছোট ব্রাঞ্চ যেমন হয়,ঠিক সেরকম কাঠামো নির্মিত। দেবাংশু মানে আমার স্বামী স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরত।সেই পরিচয় দিয়ে ওখানের ব্যাংক কর্মীদের সাথে কথা বলে মা কে ওখানে বসানোর ব্যবস্হা করা হলো। ওঁনারা খুব আন্তরিকতার সাথে মাকে ওখানে বসিয়ে রাখলো। আমরা তিনজন এবার চললাম সঙ্গমের উদ্দেশ্যে।
যত সামনে এগোচ্ছি,তত উপলব্ধি হচ্ছে আমাদের দেশের বিচিত্রতা। নানা ভাষাভাষী, নানা পোশাকের মানুষ এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দুপাশে নানা রকম বড় বড় স্টল। খাবারের ফুড জোন পরপর। অনেকটা শপিং মলগুলোতে যেমন পর পর নানা রকম খাবারের স্টল থাকে, টাকা দিয়ে কিনে সামনে খাবার টেবিলে রেখে তেমনই ব্যবস্হা। জামা কাপড়ের আলাদা একটা বড় জায়গা জুড়ে মেলা বসেছে, যেখানে দেশের নানা প্রান্তের পোশাকের সম্ভার। কিছুদূর যাওয়ার পরে নজরে এলো সঙ্গম আর ৫০০ মিটার দূরে। চারপাশ থেকে মানুষ এক জায়গায় যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রচুর বিদেশী পর্যটককে নজরে এলো,কেউ আমাদের দেশীয় পোষাকে সেজে কপালে তিলক কেটে ঘুরছে,কেউ বা ক্যামেরা বন্দী করছে নানা মুহূর্ত। সঙ্গম ঘাটে যাওয়ার আগে নন্দী ঘাটের আরেক প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এ দিকে আসছে।কোথাও সবাই পর পর একে অপরের হাত ধরে লাইন দিয়ে চলেছে,কারোর গলায় আই কার্ড ঝোলানো,আবার এক জায়গায় নজরে এলো ছেলের ব্যাগের সাথে গামছার একপ্রান্ত,আরেক প্রান্ত মায়ের হাতে বাঁধা। তবে আমরা কোন শাহী স্নান বা কোন পুণ্য তিথিতে যাই বলে সেই ভয়ংকর ভীড় বা ঠেলাঠেলির সম্মুখীন হই নি। উল্টে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা জুড়ে যাওয়ার ব্যবস্হা ছিল।কিন্তু রাস্তার মাঝখান দিয়ে পুলিশের গাড়ি কিংবা জলবাহী গাড়ির আনাগোনার দরুন কিছুটা অব্যবস্হা হচ্ছিল। আবার একদল পুলিশ বাহিনী ঘোড়সওয়ার হয়ে পুরো মেলা চত্ত্বর টহল দিচ্ছিলো। কোথাও রাস্তার মাঝে ফল, ফুল বা কোন অন্য দোকানের ভ্যান গাড়ি দাঁড়াতে দেখলে তাদের কোণায় নিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার নির্দেশ দিচ্ছিলো। এর সাথে চলছিলো মাইকে নানা রকম সর্তকতামূলক বার্তা এবং কেউ কোথাও পরিবার থেকে নিখোঁজ হলে তার অনুসন্ধান সংক্রান্ত খোঁজ খবর। সঙ্গম দ্বারের মুখে এসে দুপাশে আখড়া নজরে এলো,কাছে গিয়ে সেখানে বসে থাকা সন্ন্যাসীদের দেখতে গেলে পুলিশ এসে সরিয়ে দেয়,কারণ এটা নাকি restricted area!! অগত্যা তাদের কারোর আর দেখা মিললো না, মনে হলো সাধু বাবারা এখন অনেক বেশি ভি,আই,পি… তাদের বক্তব্য বা চিন্তাভাবনা সাধারণের জন্য নয়,তাহলে কিসের সাধনা বা মোক্ষলাভ যা অন্য মানুষের মধ্যে না ভাগ করা যায়!! আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসেবে ভাবি, ওখানে গিয়ে বুঝলাম তিনি কেন বিশ্ববরেণ্য, নমস্য।

যাই হোক, সঙ্গম ঘাটের কাছে গিয়ে দেখলাম স্নান সেরে জামা বদলের অস্হায়ী অনেক ব্যবস্হা। সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে জলে ডুব দেওয়া এবং জল থেকে উঠে পোশাক বদলের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। জলের কাছে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম,পাশ থেকে বাচ্চা বুড়ো মহিলারা সব ডুব দিচ্ছে, জলে নেমে এক একজনের এক একরকমের প্রার্থনা করার ধরণ। কেউ মন্ত্র উচ্চারণ করছে,কেউ পূর্ব পুরুষকে তর্পণ, কেউ বা আগামীর জন্য নানা ইচ্ছার কথা বলছে। এর মাঝে কিন্তু প্রায় সবাই নানা ভঙ্গিতে মোবাইলে ভিডিও, রিলস্ বা লাইভ করতে ব্যস্ত।ওখানে এক ছোট বাচ্চা মেয়ে ফুল প্রদীপ বিক্রি করছিলো জলে ভাসানোর জন্য, তার থেকে একটা সেট কিনে আমার মেয়ে হাঁটু জলে নেমে তা ভাসিয়ে দিলো। তারপর আমরাও সেখান থেকে ফিরে এলাম বিনা জলে নেমে। দূরে নৌকা করে ত্রিবেণী সঙ্গমের স্নানের জায়গাটা দেখলাম,সেখানে নৌকার লাইন আর মানুষের জলের মধ্যে ভীড়। সঙ্গম ঘাট থেকে ফেরার পথে এক সাংবাদিক আমাদের কাছে আসেন,জিজ্ঞেস করেন কোথা থেকে এসেছি এবং কেন কিসের উদ্দেশ্যে এখানে। যখন শুনলেন যে,আমরা কোন পুণ্যস্নান করতে বা কোন মানসিকপুজো বা ইচ্ছে পূরণ করতে আসি নি,উনি বেশ হতাশ হলেন। শুধুমাত্র সর্ববৃহৎ মেলা এবং মেলার পরিবেশ দর্শন করাই আমাদের যাত্রার উদ্দেশ্য…  এ কথা শুনে উনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অন্য পুণ্যার্থীর কাছে গেলেন। ফেরার পথে মেয়ের বায়না বাকিদের মত কপালে নাকি ট্যাটু বানাবে। ওখানে চন্দন তিলক পড়ানোর জন্য পরপর লোক বসে আছে,টাকার বিনিময়ে তারা নানা রকমের তিলক কেটে দিচ্ছেন। এছাড়া রুদ্রাক্ষ, নানা রকম ধর্মীয় মালা,জল ভরার পাত্র,ফুল মোমবাতি এসব বিক্রির অসংখ্য লাইন দিয়ে নীচে বসার জায়গা। আবার গরুকে খাবার খাইয়ে পুণ্য অর্জন করতে গরু সহ চাল খাবার নিয়ে বসেছে কেউ। এছাড়া পাশের আখড়াগুলোতে খাবার ও জল বিনা খরচায় বিলি করা হচ্ছে। এই সব নানা রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা আবার ফিরে যেতে লাগলাম। প্রায় ৩ -৪কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে সঙ্গম ঘাটে পৌঁছে ছিলাম।সেই এক রাস্তাই আবার হেঁটে ফিরতে হবে ভেবে এবার বেশ কষ্ট হতে লাগলো। মা কে প্রায় ২ ঘন্টা বসিয়ে রাখার পরে সাথে নিয়ে কিছু খাবার খেয়ে গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় ফিরতে লাগলাম। কিছুটা যাওয়ার পরে নজরে এলো, ঠেলা গাড়িগুলো যাত্রী বহন করছে,৫০ টাকা জন প্রতি। সেটা করে প্রায় ১.৫ কিমি রাস্তা এলাম। তারপরেও কিছুটা হেঁটে আমাদের গাড়িতে উঠলাম। ফেরার পথেও প্রয়াগ শহর থেকে বেড়োতে অনেক সময় লাগলো জ্যামে আটকে। তখনও কাতারে কাতারে মানুষের দল চলেছে সেই অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। ব্রিজে ওঠার পরে আবার সেই বিস্ময়কর দৃশ্য চোখে পড়লো। তখন সন্ধ্যা নামবে প্রায়,তাই তাঁবুগুলোতে আলোর সারি। দূর থেকে ব্রিজের দুপাশে শুধু তাঁবু নগরী,যার কোন শেষ নেই। তার মাঝে মাঝে মানুষ কিলবিল করছে,গাড়ি চলছে।
কুম্ভমেলা ঘুরে বেনারস শহরে ঢুকতে প্রায় রাত ৯ টার বেশি হয়ে গেলো। কিন্তু মনের মধ্যে এক অপার বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলাম। এমনও বড় মানুষের মেলা বসতে পারে!! আমরা তো মেলার ২৫ ভাগের এক ভাগ দেখলাম। সেই সব বাবাজিদের আখড়া,নানা অনুষ্ঠান, তাঁবু আস্তানা কোনোটাই দেখি নি।সেগুলো অন্য সেক্টরে।

কিন্তু যতটুকু দেখলাম তা এত দীর্ঘ জায়গা জুড়ে, তা অবাক করা ছাড়া কিছু নয়। তবে মেলা প্রাঙ্গনে কোথাও প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। এছাড়া পরিচ্ছন্নতা যথেষ্ট ভালো। নাহলে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ আসছে,সেখানে নোংরা আবর্জনা পড়ে থাকার সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু এত সংখ্যক পরিষ্কার করার লোক,ঝাড়ুদার ছিল যে সেই আন্দাজে কোনো অপরিষ্কার পরিবেশ ছিল না। তবে আমি যেহেতু একটা জায়গায় ঘুরেছি এবং বিশেষ দিনে যাই নি, তাই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি একরকম হয়েছে। তবে হা, পুলিশের মধ্যে ট্রাফিক সিস্টেম একেবারেই শৃঙ্খলা পরায়ণ নয়৷ এছাড়া কোন বিশিষ্ট লোকজন এলেই এরা পায়ে হাঁটা রাস্তায় মানুষের ঢলের মধ্যে সেই গাড়িগুলোকে প্রবেশ করাতে ব্যস্ত থাকছে,তার ফলে মানুষ যে এক ছন্দে যাচ্ছিলো সেই ছন্দ ভঙ্গ হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে বাধ্য। কুম্ভ মেলা সম্পর্কে আমরা আগেও জানি যে,কুম্ভ অন্য সাধারণ মেলার মত নয়। এখানে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার।এখানে এসে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আর এবারের কুম্ভ তো মহাকুম্ভ,যা নিয়ে দেশ বিদেশের মানুষের মধ্যেও আগ্রহের শেষ নেই। শারীরিক সমস্যা থাকলে এখানে না যাওয়াই শ্রেয়। পুণ্য অর্জনের খাতিরে প্রাণটাই চলে যাক তা তো কাম্য নয়৷ তেমন হলে বয়স্ক অসুস্থ মানুষকে কোথাও বসিয়ে সক্ষম রা ঘুরে আসতে পারেন। এ মেলায় গেলে অতি প্রয়োজনীয় হলো… পায়ে হেঁটে যাওয়া। আমরা আসা যাওয়া মিলিয়ে প্রায় ৮-৯ কিমি হেঁটেছিলাম। তবে যেটুকু দেখেছি তা এ জন্মে ভুলবো না। এক টুকরো ভারতবর্ষকে এক জায়গায় হতে দেখলাম। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে চাক্ষুষ করলাম। এতটা অঞ্চল জুড়ে কয়েককোটি জন সমাগম ৪৫ দিন ধরে আয়োজন করা হয়েছে,তা নিজ চোখে দেখে এলাম। সর্বোপরি, ভারতের বৈচিত্র্যতা একজায়গায় হতে দেখলাম। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

সমাপ্ত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *