বিদিশা বসু
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
দোলের ছুটিতে একদিনের জন্য মনের খোঁজে “মনচাষা”
গত বছর থেকে দোলের সময় বাড়িতে বা জন্মভিটেতে থাকতে মন চায় না। বাবা….. বড্ড ভালবাসতো রঙ মাখতে, ঐ দিন উঠোনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে বাচ্চা বুড়ো সবার হাত থেকে রঙ মেখে খুব খুশি মনে মিষ্টি চকলেট ভাগাভাগি করতো। তাঁর সেই স্মৃতি দোলের অনুভূতির সাথে মিশে,তাই গতবছর সে চলে যাওয়ার পরে পালিয়ে বেড়াই ঐ দিনটা চেনা গন্ডি থেকে অন্য কোথাও,দূরে অচেনার মাঝে।।
2024 সালে খুঁজতে খুঁজতে এক নতুন ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম দোলের দিন সকালে… আমরা ৫ জন। সুন্দর সাজানো এক গ্রাম্য পরিবেশে নদীর পাড়ে “মনচাষা গ্রামীণ পর্যটন কেন্দ্র “। চারটি বাঁশের এবং চারটি মাটির তৈরি কটেজে রয়েছে সব রকম আধুনিক সুবিধার আয়োজন,কিন্তু সেই সাথে গ্রাম বাংলার আবেগ মেখানো।

পূর্ব মেদিনীপুরের এক ভিতরের গ্রাম পাউশিতে বাগদা নদীর ধারে এই অনন্য ভাবনার মিশেলে তৈরি ” মনচাষা ইকো ভিলেজ “। গেট পেরিয়ে দুপাশে বাঁধানো পুকুর, তার মাঝে গাছ গাছালি ঘেরা এক বাঁশের মাচানের খোলা বৈঠকখানায় এসে রাস্তার সব ধকল নিমেষে ঘুচলো। তারপর শুরু আতিথেয়তা, মহিলারাই এখানের সব দেখভাল করেন,সাথে অবশ্য ম্যানেজার মশাই ছেলেটি অমায়িক ব্যবহারের। মনে হলো যেন,কোন এক আত্মীয়ের গ্রামের বাড়িতে এসে বসলাম। খাটের দুপাশে বড় বড় পাখা দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে দুপাশের হাওয়ায় চোখ বুজে আসছিল। সামনে সেই আমার ঠাকুমা যেমন চেয়ারে বসতো,আমাদের সেই পুরনো বাড়ির মত খোলা বারান্দায় রাখা চেয়ারগুলো আর টেবিলের সাজসজ্জা। সামনে অবশ্য ক্যারাম বোর্ড, লুডো, দাবার মত সব অবসর কাটানোর খেলার জিনিস মজুত। রান্নাঘর সহ সংলগ্ন ঘরগুলোর নামও বেশ মনকাড়া। ” তালা ভাঙার পাঠ”, “পাকশালা” এমন সব নামকরণ মাটি লেপা ঘরগুলোতে। আয়েশ করার জন্য ঐ বারান্দায় ছোট ছোট জলচৌকি, আবার দড়ির দোলনা রাখা,সাথে দেওয়াল জুড়ে গ্রাম বাংলার নানা ঐতিহ্য… ঝুড়ি,কুলো,খড়ের চাল, এর সাথে আবার বাচ্চাদের আঁকার জন্য একটা ক্যানভাসে সাদা আর্ট পেপার সহ রঙ পেনসিল।
আমাদের বসতে বলে এক দিদি লেবুর সরবত নিয়ে এলেন যখন, শরীর সহ মন জুড়ে বড় প্রশান্তি এলো।

এরপর ঐ দাওয়ার সামনের দুটো উঁচু মাচানের উপরে বাঁশের তৈরি ঘরে আমাদের একদিনের বসত ব্যবস্হা। চারপাশে ছোট্ট জলে পদ্মপুকুর, কিংবা ছোট্ট ছোট্ট ঘড়ের চালের নীচে দোলনা বা বসার মাচান করা। কতরকম ফলফুলের গাছ। এ সব ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখার পালা চললো।একটা মাটির বাড়ির সামনে ঢেঁকি রাখাও ছিল। এরপর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া…কিন্তু ঘরে গিয়ে তার আদল দেখে বেশ অবাক হলাম। কত্ত বড় বাঁশের ঘর। দুপাশে বড় বড় দুটো খাট, উঁচু সে ছাদ গম্বুজের মত, পরিষ্কার গামছা রাখা আমাদের জন্য, সাথে দুপাশের বিছানায় মশারীর ব্যবস্হা। ঘরের প্রতিটা কোণে যেমন যত্নের ছাপ,তেমনই ব্যালকনিতে বসার আলাদা রকম ব্যবস্হা। সব মিলিয়ে আমাদের ক্লান্তি কেটে গেল এমন কলুষমুক্ত নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে!! সবচেয়ে দেখার বিষয় হলো… ঘরের কোণে বা মাঝের বারান্দায় বসে থাকার জায়গায় “সহজ পাঠ” এর নানা ছোট্ট ছোট্ট উক্তি লেখা..
তারপর একটু সাজগোছ করে পুকুর পাড়ে গিয়ে আবির রঙে রাঙা হলাম আমরা। নির্জন পরিবেশে নিজেদের মধ্যে এই রঙ খেলা… এক অন্য অনুভব জাগালো। হঠাৎ দেখলাম গ্রাম থেকে একদল কিশোরী দল এসে আমাদের গালে রঙ ছুঁয়ে গেল। তারপর একজন অল্প বয়সী মহিলা এসে পায়ের জুতো খুলে আমাদের আবির রাঙা প্রণাম জানালেন,সাথে মিষ্টিমুখ করাতে চকলেট দিলেন। এমন আন্তরিকতায়,সত্যি মুগ্ধ হলাম… বাড়ির বাইরে এসেও এমন করে কেউ সেই পাড়ার রঙ খেলার আমেজ এনে দিতে পারে!!
এরপর দুপুরে স্নান সেরে দুপুরের ভোজের আয়োজন দেখে কেমন পেটে ইঁদুর দৌড়তে লাগলো। বলে রাখি,বাথরুমে গিজার সহ কমোডের সব ব্যবস্হা ছিল। তাই স্নানের কোন অসুবিধাও হয় নি।
কাঁসার থালায় সাজানো গয়না বড়ি সহ নানা রকম ভাজা শাক ডাল, সাথে দুই রকম মাছ, চাটনি, মিষ্টি, লাউ চিংড়ি, পাঁচমিশালি সবজি সহ প্রতিটা পদ ভীষণ উপাদেয় এবং ঘরোয়া। সেই সাথে ঐ দিদিদের আতিথ্য, বারে বারে খাবারের খোঁজ নেওয়া… বহুদিন পরে দুপুরের একসাথে এমন খোলা পরিবেশে বসে খাবার অভ্যাসকে উপভোগ্য করলো।
বিকেলের পরিবেশ কেমন মায়া জড়ানো,সামনে ছোট নদী, রোদ পড়ে যাচ্ছে… চারপাশে কোথাও যেন সেই সহজপাঠের গল্পগাঁথা সত্যি হয়ে উঠছে। সন্ধ্যায় চায়ের আসর, সাথে নানা বয়ামে রাখা ঝুড়ি ভাজা,চানাচুর, বিস্কুটের বাহার। সেদিন আমরা ছাড়াও আরও দুটো পরিবার ওখানে সন্ধ্যার আসরে এলো। বাচ্চা সহ বড়রা নানা রকম খেলায় মেতে উঠলো,মনেই হলো না যে এরা সদ্য পরিচিত,ঐ খোলা বারান্দা কখন যেন আমার ছোট্ট বেলায় দেখা বিকেলের উঠানের মত হয়ে গেলো,যেখানে বাবা কাকারা ক্যারাম খেলতো, মায়েদের সাথে আমরা লুডো, আবার দাদারা দাবা খেলতো। ঠিক এমন পারিবারিক পরিবেশে গল্প করার ফাঁকে ঐ দিদিরা সবাইকে চা এর সাথে তেলে ভাজা মেশানো মুড়ি মাখা দিলেন। সন্ধ্যার আসর জমে গেল এমন করেই জমজমাটি… তবে সেদিন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চারপাশে অন্যরকম আবহাওয়াও তৈরি হয়। এরপর রাতে আবারও রুটি অথবা ভাতের সাথে একই রকম সবজি ডাল সহ মাংসের ঝোল,সাথে রাবড়ি। ঘরোয়া এমন খাওয়া দাওয়া, সাথে কাঁসার থালা গ্লাসে পরিবেশন… আলাদা রকম এক ছোঁয়া এনেছে।

আবার ঘরে ঘরে ঐ দিদিরা রাতে গিয়ে মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আমাদের আরও আপনজনের অনুভূতি জাগালেন।
আমাদের সঙ্গী আমার বান্ধবীর সেদিন খুব শরীর খারাপ ছিল। ওখানের দিদিরা অত্যন্ত যত্নের সাথে ওর দেখভাল করেন। গরম জলের ভাঁপের ব্যবস্হা সহ রাতে সরষের তেল হাতে পায়ে দেওয়া… সবটায় খুব আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন ওরা।
পরের দিন সকালে চারপাশে নানা রকম পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। তারপর ঘুম চোখে সামনের নদীর দিকে তাকিয়ে চোখের আরাম এলো। এমন দৃশ্য তো আমাদের রোজের জীবনে ঘটে না!! তারপর সকালের চা বিস্কুট খেয়ে স্নান সেরে একেবারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি। সকালের জলখাবারে আবারও নতুনত্ব। ছোট্ট ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে কলা রাখা, তারপর লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। সেই সাথে কতরকমের আচারের আয়োজন। মিষ্টিও এলো বাহারি। জিভে লেগে থাকা এমন সুন্দর লুচি আলু চচ্চড়ি খেয়ে এবার বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম । আরেকবার চারদিক ঘুরে যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছি,তখন ঐ দিদিরা কত আপনজনের মত বললেন যে, আবার আসবেন।। মনে হলো… একটাদিন আত্মীয় বাড়ি কাটিয়ে ফিরছি। ওনাদের আতিথেয়তায় আরও ভালো কাটলো এই একটা দিন।
কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে মনচাষাতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। ওখানে পৌঁছানোর ঠিকানা —–
কোলাঘাট ছাড়িয়ে নন্দকুমার হয়ে দীঘা যাওয়ার রাস্তায়, হেড়িয়া পেরিয়ে কালিনগর বাসস্টপ থেকে ডান দিকে গ্রামের রাস্তায় মনচাষা গ্রামীন পর্যটন কেন্দ্র।
থাকা সহ সমস্ত বেলার খাবার খরচ – তিনজনের ৯০০০ টাকা মত। এছাড়া গাড়ি নিয়ে গেলে ড্রাইভারের আলাদা থাকার ব্যবস্হা আছে।
এমন ঘরোয়া গ্রাম্য পরিবেশ তৈরি করে অপূর্ব থাকার ব্যবস্হাপনা করার ধারণা রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে। এর জন Nilanjan Basu মহাশয়কে অনেক শুভকামনা রইলো। প্রতিভাস ম্যাগাজিন