দীপান্বিতা 

আঁতোয়ান দ্য সান্তেস্কুপেরি

এক আশ্চর্য রাজপুত্রের কাহিনী শুনিয়েছিলেন আঁতোয়ান দ্য সান্তেস্কুপেরি বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে আর ওই এক কাহিনী তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিল। ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে তাঁর জন্ম ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৪টি বছর। স্বল্প ব্যাপ্তি হলেও তাঁর জীবন জুড়ে রয়েছে নানা রকম অ্যাডভেঞ্চার। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এমন সব কাজকর্ম যাতে পদে পদে ছিল জীবনের ঝুঁকি। সাহিত্যের ওপর তাঁর ভালোবাসা স্বাভাবিক, জোর করে নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জীবনের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাগুলি খাতার পাতায় লিখে ফেলতেন। খুব বেশি লেখার সুযোগ পাননি তিনি কিন্তু যে কটি বই লিখেছিলেন সবকটি প্রায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল ‘ছোট্ট রাজকুমার’ বা ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। মূল ফরাসি ভাষায় বইটির নাম ‘লে পেটিট প্রিন্স’, প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। এটি আসলে ছোটদের জন্য লেখা এক রূপকথাধর্মী বই, ফ্যান্টাসি বললেই ঠিক হয়। এখানে একটি ছোট ছেলে, যাকে আসলে বলা হয়েছে ছোট রাজকুমার, সে বড়দের পৃথিবীর জটিলতাগুলিকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। বড়দের জীবন, সে বলেছে, পরিচালিত হয় কতগুলি রসকষহীন সংখ্যাকে ভিত্তি করে আর এভাবেই ছোট্ট রাজকুমার বড়দের জটিল পৃথিবী আর তার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।

তাঁর সমস্ত রচনায় সান্তেস্কুপেরি গভীর মানবতাবোধের কথা প্রচার করেছেন। আরেকটি বিষয় তাঁর প্রায় সব লেখাতেই গুরুত্ব পেয়েছে, সেটা হল আকাশে ওড়ার বিষয়। আকাশভ্রমণ ছিল তাঁর জীবনের প্রধান শখ। এজন্য পেশা হিসেবে বৈমানিক হওয়াটাকেই তিনি বাছাই করে নিয়েছিলেন। পড়াশুনা শিখেছিলেন সুইটজারল্যান্ডে কিন্তু বৈমানিক হওয়ার স্বপ্নটা তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল বলে ১৯২১ সালে ফরাসি বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে তিনি এই কাজ ছেড়ে নিজে স্বাধীনভাবে বাণিজ্যিক বিমান চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ঘুরে বেড়ান আফ্রিকার উত্তরাংশ, দক্ষিণ আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চলে। কাজটা ছিল ডাক পরিবহণের আর এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি তার জীবনের প্রথম উপন্যাসটি লেখেন। ‘দক্ষিণী ডাক’ বা ‘সাদার্ন মেইল’ নামে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। ১৯৩২ সালে প্রকাশ পায় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নৈশ উড়ান’ বা ‘নাইট ফ্লাইট’ যার ফরাসি নাম ছিল বলে ‘ ভোল ডে নুইট’। ১৯৩১ সালে সান্তেস্কুপেরি বিয়ে করেন আর্জেন্টিনার বুয়েস আইরেস শহরের এক তরুণী বিধবা মহিলাকে।

সান্তেস্কুপেরির নিজের জীবনটাও প্রায় রূপকথার মতই। এত ঘটনাবহুল জীবন খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আবার ফরাসি বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। আকাশে বিমান হানায় নিয়মিত তিনি অংশ নিতেন। এরকম এক আকাশ যুদ্ধের সময় সান্তেস্কুপেরির বিমান শত্রুপক্ষের গুলিতে ভূপতিত হয়। তিনি শত্রুর হাতে বন্দী হলেও পরে আশ্চর্যজনকভাবে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। যুদ্ধকালীন এসব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই ১৯৪২ সালে ‘ফ্লাইট টু এরাস’ নামে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস প্রকাশিত হয়।

যুদ্ধে সান্তেস্কুপেরি অনেক চোট-আঘাত পেয়েছিলেন। এসব কারণে তাঁর শারীরিক ক্ষমতা একটু কমে গিয়েছিল। ইদানীং আর আগের মত ঘন ঘন আকাশ ভ্রমণে যেতে পারছিলেন না। এ সময় তাঁর কাজ হয় মূলত প্রশিক্ষকের। সেটা ১৯৪৩ সাল। জীবনে অবসর বেড়ে যায় আর তিনি লেখেন ‘ছোট্ট রাজকুমার’।

সান্তেস্কুপেরির জীবন শেষ হয় তার পরের বছর, ১৯৪৪ সালে। পৃথিবী ছেড়ে তাঁর চলে যাওয়াটাও রহস্যজনক। তিনি মারা গেছেন কিনা বা কিভাবে মারা গেছেন সেটা আর কখনো জানা যায়নি। ১৯৪৪ সালে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে এক বিমান যাত্রায় তাঁর বিমানটি কোন নিশানা না রেখে হারিয়ে গিয়েছিল। আকাশ যাত্রা ছিল যাঁর সারা জীবনের প্রধান আকর্ষণ হয়তো তিনি পার্থিব দেহটা নিয়ে আকাশের বিরাট ব্যাপ্তিতেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন।

ফ্রানজ কাফকা 

একটি মাত্র ছোটগল্পের জন্য কোন লেখকের পরিচিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা কাফকা ছাড়া আর ক’জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে সন্দেহ। কাফকা বললেই একসঙ্গে মনে হয়, দা মেটামরফোসিস, সেই অবিশ্বাস্য ছোটগল্পটির কথা। একচল্লিশ বছরের হতাশাগ্রস্থ জীবনে কাফকা দু’-একটি উপন্যাস আর কয়েকটি মাত্র ছোট গল্প লিখেছিলেন, প্রত্যেকটিই নিজস্ব ঔজ্জ্বল্যে অবিস্মরণীয়। অবশ্য আর একটি মাত্র শব্দ না লিখে কাফকা কেবলমাত্র দা মেটামরফোসিস লিখলেও পারতেন, খ্যাতি কিছুমাত্র কম হত না। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত এই একটিমাত্র ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যে নজিরবিহীন আলোড়ন তুলেছে, রীতিমত সাহিত্যের এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। অথচ গল্পটি যখন প্রকাশ পায় তখন কেউ বুঝতেই পারেনি এর রূপকধর্মী বিষয়বস্তুর অন্তরালে আধুনিক জীবনের কী নির্মম সত্যি লুকিয়ে আছে। গল্পের মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা নামের একজন সেলসম্যান। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর দেখে, সে একটা বিশাল আর বিকটদর্শন পোকায় পরিণত হয়ে গেছে। সে আর কথা বলতে পারত না, ক্রমশ তার অঙ্গবিকৃতি বাড়তেই লাগল, অথচ বোধবুদ্ধি সবই তার যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল। মানবিক চেতনা অবিকৃত অবস্থায় বাহ্যিক চেহারার এই যে অমানবিক কদর্য পরিণতি এবং তার যে যন্ত্রণা তাই নিয়েই মেটামরফোসিসের গল্প। গ্রেগরকে শেষপর্যন্ত এই অপরিসীম মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে তার বাবা তাকে মেরে ফেলে। আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তি চরিত্রের উন্মত্ততা বা পরস্পরকে বোঝার অক্ষমতা এই গল্পে প্রকাশ পায়, একই সঙ্গে আধুনিক মানুষ কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশের বাসিন্দা হতে বাধ্য হয় তাও এই গল্পের মূল বক্তব্য।

তাঁর প্রতিটি লেখারই বিষয়বস্তু এমন সব রূপকাঙ্গিক কঠিন বাস্তব, যার রসদ কাফকা নিজের জীবনের প্রতি বিন্দু থেকে আহরণ করেছেন। তাঁর বাবা হেরম্যান কাফকা ছিলেন এক অত্যাচারী পুরুষ, নিজের ঘরে প্রায় সন্ত্রাস চালাতেন। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত রাগ আর হতাশা ঝাড়তেন ছোট্ট কাফকার ওপর। ছোটবেলায় বাবার কাছে পাওয়া এসব অত্যাচারের ভয়ংকর স্মৃতি সারা জীবন কাফফাকে তাড়া করেছে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মূল রসদ তিনি জোগাড় করেছেন এখান থেকেই যেখানে বাবা ও ছেলের বিরোধ দেখা গেছে, আর দেখা গেছে নিরীহ মানুষ ক্ষমতাশালী কর্তৃত্বের কাছে সব সময় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত দা ট্রায়াল উপন্যাসেও এই বিষয়টি স্পষ্ট। উপন্যাসের নায়ক জোসেফকে একদিন অকারণে গ্রেপ্তার করা হয় আর দিনের পর দিন তাকে নিয়ে চলতে থাকে বিচারের প্রহসন। জোসেফ কোনদিন বুঝতেই পারল না কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হলো বা আইনের জটিল ব্যাখ্যাগুলি আসলে কী।  তার এই অপরিসীম ভোগান্তি আসলে বিচার ব্যবস্থার অসারত্বই ঘোষণা করে। 

জীবদ্দশায় কাফকা  তাঁর প্রতিভার কোন স্বীকৃতি পাননি। তাঁর জন্ম হয়েছিল চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে ১৮৮৩ সালে।  বাবা একটা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। কাফকারা ছিলেন ইহুদি, মাতৃভাষা ছিল জার্মান। প্রাগ শহরে এ ধরনের পরিবার সংখ্যায় অল্পই ছিল আর এদের অন্য সবাই ভালো চোখে দেখত না। প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের প্রাগে একঘরে হয়ে থাকতে হত, নিম্নশ্রেণির নাগরিক হিসেবে ছিল তাদের পরিচিতি। ঘরে বাবার অত্যাচার আর বাইরে ইহুদি বলে হেনস্থা কাফকার শৈশবকে দুঃসহ করে তুলেছিল। 

১৯০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধির সঙ্গে আইনের স্নাতক হন তিনি। কাজ শুরু করেন আইন বিষয়ক কেরানি হিসেবে ১৯০৪ সাল থেকে। তখনই তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। তাঁর কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে স্বাস্থ্যহানির বিপদ ও তার আইনগত ব্যাখ্যা সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি করা। দিনের বেলাটা কাটত তাঁর এইসব কাজে, রাতে কাফকা লিখতেন প্রাণ যা চায়। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির কাজ চলতে থাকে এভাবেই, নিজের আনন্দে। সুদীর্ঘ, কখনো কখনো অদ্ভুত সব কাহিনী লিখতে থাকেন তিনি। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত কাফকা বীমা ব্যবসার কাজ করে যথেষ্ট সাফল্য পান। তবে এই সময়েই দুর্ভাগ্যও তাঁকে নানাভাবে ঘিরে ধরে। ১৯১৭ সালে তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত হন। শরীরের রোগ নিয়েও অক্লান্তভাবে কাজ করতে থাকেন। দু’বছর পর অবস্থা আরও শোচনীয় হয় যখন মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ তাঁকে আক্রমণ করে। একইসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকেও তিনি একের পর এক প্রত্যাখ্যান পেতে থাকেন। কেউ তাঁর বই প্রকাশ করতে রাজি হয়নি, পান্ডুলিপি নিয়ে গেলে কপালে জোটে অবজ্ঞা আর অপমান। এতেই সব শেষ নয়, বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেও সফল হননি। এখানেও বারবার জুটেছিল কেবল প্রত্যাখ্যান। শেষপর্যন্ত প্রাগের প্রাচীনপন্থী ইহুদি পরিবারের মেয়ে ডোরা ডায়ামন্টকে বিয়ে করেন তিনি, মৃত্যুর দেড়-দু’বছর আগে। বিয়ের পর তাঁরা বার্লিনে চলে যান।  ততদিনে তাঁর প্রাণবায়ু ফুরিয়ে এসেছে, বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন তিনি। শুয়ে শুয়েই নানা পত্রপত্রিকার জন্য লেখা তৈরি করেন আর চিঠির পর চিঠি লেখেন বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনদের। ১৯২৪ সালে ভিয়েনার কাছাকাছি একটি স্যানাটোরিয়ামে তাঁকে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে, মৃত্যুর বাহ্যিক কারণ যক্ষারোগ। 

কাফকার দ্বিতীয় উপন্যাসটির নাম দা কাসেল, প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এটি একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, কিন্তু সাহিত্য জগতে এর মূল্য অসামান্য। উপন্যাসের নায়কের নাম কে, সে সরকারের জমি জরিপের কাজ নিয়ে একটি ছোট গ্রামে যায় যেখানে একটি রহস্যময় দুর্গ ছিল। কে নানাভাবে চেষ্টা করেও দুর্গের অধীশ্বর ক্লাম-এর দেখা পায় না। দুর্গ আসলে আমলাতন্ত্র, ভালোবাসা, অপরাধ আর আইনকানুনের প্রতীক—- এ সমস্ত বিষয় মিলিয়ে দুর্গ এক এমন পরিবেশ রচনা করে যেখানে ব্যক্তিবিশেষের কোন অস্তিত্ব থাকে না, কে-যে দুর্গে ঢুকতে পারেনা বা ক্লাম-এর দেখা পায় না এটাই তার প্রমাণ। 

এই মাত্র দেড়খানা উপন্যাস, কয়েকটি ছোট গল্প আর কিছু চিঠিপত্র ও ডায়েরি নিয়ে কাফকার সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টি—- অধিকাংশই মৃত্যুর পর প্রকাশিত। লেখক বন্ধু ম্যাক্স রডকে মৃত্যুর আগে কাফকা অভিমানে আর হতাশায় বলে গিয়েছিলেন যেন মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত পান্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলা হয়। ম্যাক্স রড বন্ধুকে বড়ই ভালবাসতেন, বন্ধুর জন্য অনেক কিছু করতেনও। তবে বন্ধুর শেষ অনুরোধটি তিনি অমান্য করেছিলেন। ভাগ্যিস করেছিলেন, আর তাই আধুনিক সাহিত্য ও সর্বকালের সাহিত্যের অন্যতম সেরা স্থপতিকে পৃথিবী শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেল। 

জোসে সারামাগো

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে পর্যন্ত জোসে সারামাগো নামটি ঔপন্যাসিক হিসেবে ইউরোপের বাইরে একেবারেই অপরিচিত ছিল। ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রাতারাতি সারামাগো ও তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে পৃথিবীজুড়ে শুরু হল মাতামাতি। তিনি প্রথম কোন পর্তুগিজ নাগরিক যিনি এই পুরস্কার পান। ব্যাপারটা আশ্চর্য হলেও সত্যি। 

জন্ম তাঁর ১৯২২ সালে পর্তুগালের আজিনহাগা অঞ্চলে। তাঁর নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল জোসে চৌচা কারণ তাঁর  বাবার নাম ছিল জোসে ডি সৌসা। সারামাগো পদবী হওয়ার পিছনে রয়েছে এক গল্প। তাঁর বাবা জোসে ডি সৌসা আর মা মারিয়া ডা পিয়েদা দে ছিলেন আজিনহাগার ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক। অঞ্চলের এক বিশেষ বুনো উদ্ভিদের নাম আসলে এই উদ্ভিদ ওখানকার অতি দরিদ্র লোক খেয়ে বেঁচে থাকে। জোসে ডি সৌসাকে সবাই সারামাগো বলে ডাকত। জন্মের পর সরকারি অফিসের লোকেরা কৌতুক করে তাঁর বার্থ সার্টিফিকেটে পদবি হিসেবে লিখে দিল সারামাগো। 

কয়েক বছর পর বাবা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে পুলিশের কাজ পেয়ে গেলেন। ছোট্ট সারামাগোকে সেখানেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। পড়াশুনায় ভালই ছিলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন এই সুযোগ তাঁর ভাগ্যে রইল না। বাবা-মা ভেবে দেখলেন, তাঁদের যা অর্থকষ্ট তাতে তাঁরা ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দিতে পারবেন না। তার চেয়ে বরং তাঁকে কোন কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করে দেওয়া ভালো। তাতে ছেলে অল্প দিনেই প্রশিক্ষণ নিয়ে রোজগেরে হতে পারবে। 

এইসব কাঠ-খোট্টা কারিগরি পড়াশুনা কি তার ভালো লাগত ? রক্তে যাঁর সাহিত্য তিনি যে এই রসকষহীন পরিবেশে অসাচ্ছন্দবোধ করবেন সে তো স্বাভাবিক। কলকব্জার ঝনঝনানির মধ্যেও তিনি সাহিত্য খুঁজে বেড়াতেন। সন্ধেবেলাটা সারামাগো পাবলিক লাইব্রেরীতে কাটাতেন। হাতের কাছে যে বই পেতেন তাই পড়তেন। কোন বাছবিচার ছিল না। এ সময় তিনি ফরাসি ভাষাও শিখতে থাকেন। 

আসলে সাহিত্যের ওপর এই ভালোবাসা সারামাগোর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সেই ছোট্ট বয়স থেকে। এর বীজ বুনেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। যিনি নিজে নিরক্ষর হলেও গল্প বলার ছিল অদ্ভুত ক্ষমতা। গ্রীষ্মের রাতে ঠাকুরদা তাঁকে নিয়ে বাড়ির সামনে বিশাল একটা ফিগ গাছের নিচে ঘুমোতে যেতেন আর প্রায় সারারাত ধরে নাতিকে আশ্চর্য সব গল্প শোনাতেন।  পরবর্তী জীবনে এসব অভিজ্ঞতা সারামাগোকে ঔপন্যাসিক হওয়ার রসদ জুগিয়েছিল। 

বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী সারামাগো কারিগরি স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছুকাল যন্ত্রকুশলী হিসেবে কাজ করেন। তারপর একটি সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগসূত্র থাকার কারণে তাঁকে  শেষপর্যন্ত এই চাকরিটি হারাতে হয়। তিনি এরপর সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং প্রকাশনী শিল্পেও কিছু কাজ খুঁজে পান। তবে সব জায়গাতেই কাজ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে তার বামপন্থী চিন্তা-ভাবনার জন্য। শেষপর্যন্ত রক্ষণশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বীতশ্রদ্ধ সারামাগো কাজকর্মের সমস্ত চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ নিজেকে পুরোপুরি উপন্যাস লেখার কাজে নিয়োজিত করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৪ বছর। পরবর্তী প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি একের পর এক অভূতপূর্ব উপন্যাস লিখতে থাকেন। এসব উপন্যাসে রয়েছে অনবদ্য বর্ণনাভঙ্গি, রাজনীতি যেখানে মূল উপজীব্য বিষয়। ল্যাটিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমও সারামাগোর উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ থেকে পর্তুগালকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন মনে হয়। তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গে। সারামাগোর রচনাতেও তাই ওরকম ছাপ।

সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে দ্য ইয়ার অফ দা ডেথ অফ রিকার্দ রেস। এই উপন্যাসে তিনি ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন যা বিংশ শতাব্দীতে পর্তুগালকে গ্রাস করেছিল। দ্য স্টোন রেস্ট উপন্যাস প্রিয় রাজনীতিভিত্তিক যেখানে সারামাগো দেখিয়েছেন ইউরোপের একটি কল্পিত দীপ হঠাৎ চলে গেল আফ্রিকার কাছাকাছি আর শোষক ও শোষিত এই দুই প্রজাতি একত্রিত হলে পর কী ঘটনা ঘটল। তাঁর গস্পেল অ্যাকোর্ডিং টু জেসাস ক্রাইস্ট  উপন্যাস যীশুকে সাধারণ মানুষে পরিণত করেছে যা ক্যাথলিক ধর্মের মূলে এক আঘাত আর এজন্য তাঁকে সরকারের কাছ থেকে অনেক হেনস্থা ভোগ করতে হয়েছে। সারামাগোর সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাসটির নাম ব্লাইন্ডনেস,  যেখানে এক অজানা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে রহস্যজনক অন্ধত্ব। এসব ছাড়াও তাঁর লেখা আরও কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম অল দা নেমস বাল্টেজার এন্ড রিমুন্ডা এবং জার্নি টু পর্তুগাল ইত্যাদি।

ন্যুট হ্যামসুন

আসল নাম ন্যুট পেটডেরসন। জন্ম নরওয়ের লম অঞ্চলে ১৮৫৯ সালে। বাবা বেডের পেডেরসন ছিলেন একজন দর্জি। 

এক বিতর্কিত চরিত্র। গুণ্টার গ্রাসের সঙ্গে নাৎসী বাহিনীর যোগাযোগ নিয়ে যেমন নিন্দে-মন্দ হয়েছিল তেমনি তাঁর সম্পর্কেও এ ব্যাপারে আশ্চর্য মিল। নোবেলজয়ী এই দু’জন সাহিত্যিকেরই জীবনের শেষ ভাগ হিটলার বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আলোড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই হ্যামসুন জার্মানদের পক্ষে ছিলেন। তাঁর দেশ নরওয়ে ও সেখানকার লোকরা কিন্তু জার্মানিকে সমর্থন করত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হ্যামসুন সরাসরি হিটলার ও নাৎসী দলের হয়ে রীতিমত প্রচার শুরু করেন। নাৎসী বাহিনী নরওয়ে অধিকার করে তাণ্ডব চালালেও হ্যামসুনের মোহ ভাঙ্গে না। উল্টে তিনি নাৎসীদের সমর্থন করে একের পর এক রচনা কাগজে-পত্রে লিখতে থাকেন। এমনকি তিনি হিটলার এবং তাঁর প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবলের সঙ্গে দেখাও করেন। তাঁর নোবেল পুরস্কারটি তিনি গোয়েবেলকে স্তুতি জানাতে উৎসর্গ করেছিলেন। 

হ্যামসুন-এর এই হিটলার প্রীতির পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল ১৮৯৪ সালে যখন তিনি প্যান বইটি লেখেন। এ সময় তিনি ফ্রেডেরিখ নিৎসের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। পরে হিটলারকেও দেখা গেছে নিৎসের আদর্শ অনুসরণ করতে। হ্যামসুন তাঁর প্যান বইটিতে নাগরিক সভ্যতা থেকে পালিয়ে প্রাকৃতিক বন্যতার মধ্যে চলে যাওয়ার ওপর জোর দেন আর এখানেই দেখা যায় নিৎসের প্রভাব। 

হিটলার ও নাৎসী বাহিনীর পক্ষ নেওয়ায় হ্যামসুনকে কম মূল্য দিতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নরওয়ে সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে প্রথমেই মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৯৪৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। গোটা মামলায় হ্যামসুন আগাগোড়া হিটলারকে সমর্থন করে যান। আদালত তাঁকে মোটা অংকের জরিমানা করে। চারদিকে সবার মুখে শুরু হয় তাঁর নিন্দা। তাঁর বইপত্রের বিক্রিও কমে যায়। অবশ্য ১৯৪৯ সালে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বই প্রকাশ করেন। নরওয়েতে সে বই খুবই জনপ্রিয় হয়। 

রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন ন্যুট হ্যামসুনের অমর সাহিত্য কীর্তিকে অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। তাঁর উপন্যাসগুলি রচনাশৈলী ও প্রকরণগত দিক দিয়ে একেবারেই ব্যতিক্রমী। ব্যক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটাই তাঁর সমস্ত উপন্যাসের মূল বিষয়। কাহিনী নির্ভর উপন্যাসের একটা নিজস্ব ভাষা হ্যামসুন আবিষ্কার করেছিলেন যেখান থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রায় সমস্ত উপন্যাস তাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। এসব কারণে অনেক সমালোচক হ্যামসুনকে আধুনিক সাহিত্য ও উপন্যাসের জন্মদাতাও বলে থাকেন। এসব ছাড়াও হ্যামসুন নরওয়ের সংস্কৃতি ও জীবনযুদ্ধকে সারা বিশ্বে তাঁর লেখার মাধ্যমে পরিচিত করে তোলেন। 

ন্যুট হ্যামসুনের সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাসটির নাম মার্কিন ্স গ্রোডি, ইংরেজিতে দা গ্রোথ অফ দা সয়েল। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাত্র তিন বছর আগে ১৯১৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। নরওয়ে ছাড়াও জার্মানিতে বইটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। এমনিতেও জার্মানরা গোড়া থেকেই হ্যামসুনের বিশেষ ভক্ত হয়ে উঠেছিল। সরল ও আদিম প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতায় জীবন এগিয়ে যাওয়ার আশ্চর্য কাহিনী দা গ্রোথ অফ দ্য সয়েল যেখানে আইজ্যাক নামের এক সাধারন মানুষ নিজের জীবনকে খুঁজে পায় অনাড়ম্বর গ্রামীণ প্রকৃতির সুষমায়। নরওয়ের সংস্কৃতির পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলির আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে এই উপন্যাসে। নিজের জীবন ও দর্শনেরও যেন এক প্রতিফলন ফুটে উঠেছে এখানে। ১৯১১ সাল থেকেই তিনি নরওয়ের একটি ছোট খামারবাড়িতে বসবাস করতে থাকেন আর বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দেন। সারাদিন কেবল লিখতেন আর খামারের কাজকর্ম করতেন। 

অধিকাংশ সমালোচকই অবশ্য এ বিষয়ে একমত যে হ্যামসুনের হাতে সেরা লেখাগুলি এসেছে বিংশ শতাব্দীর শুরু হওয়ার আগে। ১৮৯৪ সালে লেখা প্যানের কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে যা তিনি লিখেছিলেন প্যারিসে বসবাসের সময়। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত মিস্ট্রিজ ছাড়াও রয়েছে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হাঙ্গার আর এই হাঙ্গার উপন্যাসটি হ্যামসুনকে প্রথম খ্যাতির শিখরে তুলে দেয়। এখানে অসলো শহরের এক খেতে না পাওয়া লেখকের জীবনকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপন্যাসে হ্যামসুন এক অভাবনীয় বর্ণনাভঙ্গির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। কখনো কথা বলেছে উত্তম পুরুষ কখনো বা তৃতীয় পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে এই ধারা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে। 

ন্যুট হ্যামসুনের ব্যক্তিগত জীবন আরও অনেক কারণেই বেশ আকর্ষণীয়। কোন কলেজের কোন শিক্ষা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি কোনদিন। বাবা পেডের পেডেরসন তাঁর শ্যালক হেনস ওলসেনের খামারবাড়িতে কাজ করতে চলে যান। ওলসেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় নিজে কাজকর্ম করতে পারতেন না। বোনের বরের হাতে খামারের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পরে ওলসেন দাবি করেন যে তিনি পেডেরসনের কাছে অনেক টাকা পান আর বাবার ঋণ শোধ করতে বাচ্চা বয়স থেকে হ্যামসুনকে মামার পোস্ট অফিসের হিসেব দেখা, কাঠ কাটা, গ্রামের ছোট লাইব্রেরী চালানো ইত্যাদি অনেক কাজ করতে হয়। তাঁর বাবাই তাকে লিখতে-পড়তে শেখান। বছরে কয়েক সপ্তাহ গ্রামে যে ভ্রাম্যমান স্কুল আসত সেখানে খানিকটা পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। গ্রামের লাইব্রেরীর বইগুলো অবশ্য সময় পেলেই পড়তেন। শৈশব-কৈশোর জীবনের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর লেখায়। 

১৮৭৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে হ্যামসুন তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করার সুযোগ পান। উপন্যাস মোটেই সাড়া ফেলেনি। ওই বছরই এক ছোট শহরে স্কুল টিচারের চাকরি হয় তাঁর। পরের বছর আবার আরেকটি ব্যর্থ উপন্যাস প্রকাশ পায়। সাহিত্যের নেশা তাঁর মধ্যে স্থায়ীভাবে চেপে বসে আর তিনি চলে আসেন রাজধানী অসলো শহরে। প্রচন্ড দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটতে থাকে তাঁর। কিছু রোজগার হতো রাস্তা তৈরির শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অভাবের তাড়নায় হ্যামসুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ছ’-বছর সেখানে থেকে খামারবাড়ির ভৃত্য আর গাড়ির খালাসি হিসেবেও কাজ করেছেন। জীবনের এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যে অভিনব গদ্যরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল।

ওলে সোয়িঙ্কা

আফ্রিকা মহাদেশের কোন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ওলে সোয়িঙ্কা। সালটা ছিল ১৯৮৬। নাইজেরিয়ার অধিবাসী সোয়িঙ্কার জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। বাবা ছিলেন শিক্ষক, নাম স্যামুয়েল আয়োডেন। মা গ্রেস ইনিওলা সোয়িঙ্কা ছিলেন এক দোকানদার। নাইজেরিয়ার পশ্চিম অঞ্চলে ছিল তাঁদের ঘর। এমনিতে আফ্রিকার মানচিত্রে নাইজেরিয়া দেশটিরও অবস্থান পশ্চিম প্রান্তে। নাইজেরিয়ার একটি প্রধান উপজাতির নাম ইয়োরুবা। সোয়িংকার বাবা-মা দু’জনেই সেই উপজাতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত।

ওলে সোয়িঙ্কার মূল নাম আকিনওয়ান্দে ওলুওলে সোয়িঙ্কা। সারা বিশ্বে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবী লেখক-সাহিত্যিকরা স্বৈরাচারী শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে তাদের অপ্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও পাশবিক রাষ্ট্রীয় শক্তির রোষানলে পড়ে জীবনভর দুর্দশা ভোগ করতে হলেও তাঁরা নিজেদের মাথা কখনোই অন্যায়ের কাছে নত করেননি। ওলে সোয়িঙ্কা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। তাঁর রাজনৈতিক রচনাগুলি নাইজেরিয়া সরকারের কেবলই অশান্তির কারণ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধাবলীর সংকলন দ্য ওপেন সোর অফ আ কন্টিনেন্ট । নব্বইয়ের দশকে নাইজেরিয়ার ভয়াবহ অশান্ত পরিবেশের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা রয়েছে এসব প্রবন্ধে। সোয়িঙ্কার চাচাছোলা সমালোচনা সরকারকে একেবারেই সন্তুষ্ট করেনি। তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতিকে অগ্রাহ্য করে নাইজেরিয়া সরকার সোয়িঙ্কাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে অবশ্য মৃত্যুদণ্ড মুকুব করে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। 

সোয়িঙ্কা কোনদিনই তাঁর দেশের সরকারের প্রিয়পাত্র হতে পারেননি। ১৯৬৭ সালে তাঁকে আরও একবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজনের স্বাধীনতার জন্য লেখালেখি ও কাজকর্ম করার কারণে তাঁর ওই সময় দু’ বছরের কারাবাস জুটেছিল। ১৯৭২ সালে লেখা দ্য ম্যান ডায়েড: দ্য প্রিজন নোটস্ অফ ওলে সোয়িঙ্কা রচনায় তাঁর এসব অভিজ্ঞতা তিনি বলিষ্ঠ ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই গ্রন্থের মুখবন্ধে সোয়িঙ্কা লিখেছিলেন, ‘বই ও লেখালেখির সমস্ত বিষয় যারা সত্যের কণ্ঠরোধ করতে চায় চিরকাল তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে এসেছে’। বন্দীদশায় থাকার সময় গোপনে তাঁর কাছে বইপত্রের যোগান দেওয়া হতো। সোয়িঙ্কা সেসব আদ্যোপান্ত পড়ে ওইসব বইপত্রের সাদা অংশে তাঁর লেখা লিখতেন। ওইসব বই আবার গোপনে জেল থেকে পাচার করে এনে তাঁর রচনা ছাপা হত। এভাবে তিনি তাঁর অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে থেকে যেকোন বস্তুর ওপর সাহিত্য রচনা করার যে কাজ সোয়িঙ্কা দিনের পর দিন করে এসেছেন তা রীতিমতো দৃষ্টান্তমূলক। 

ওলে সোয়িঙ্কা একাধারে নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। তাঁর দেশবাসী অন্য এক বিখ্যাত লেখক চিনুয়া আচিবে-র সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই নানা বিষয়ে তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। বড় হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পান ও সেখানে লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সোয়িঙ্কা স্বদেশে ফিরে এসে নিজস্ব উপজাতি ইয়োরুবা ভিত্তিক থিয়েটার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নাট্য বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি এবং বহু তরুণকে নাট্যশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৭ সালে বন্দীদশা প্রাপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করে এসেছেন।

তিনি কিছু আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও রচনা করেছেন যেগুলি ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত নাইজেরিয়ার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছে। সোয়িঙ্কার কবিতাগুলি বেশির ভাগই রাজনীতিকে বিষয়বস্তু করে রচিত হলেও নাইজেরিয়ার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রারও পরিচয় দেয়। নাট্যকার হিসেবেই ওলে সোয়িঙ্কার বেশি নাম। উল্লেখ করা যায় ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত নাটক ডেথ অ্যান্ড দ্য কিংস্ হর্সম্যান-এর কথা। এখানে সোয়িঙ্কা ইয়োরুবা উপজাতীয় এক নেতার অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনিয়েছেন ‌।

মিলান কুন্দেরা

বুদ্ধিজীবীদের পৃথিবী যাদের পছন্দ তাদের জন্য মিলান কুন্দেরা সৃষ্টি করেছেন উজ্জ্বল সব হিউমার। তাঁর উপন্যাসগুলিতে রয়েছে বিসদৃশ্য উৎসবানুষ্ঠান, পাগলাটে বিজ্ঞানী, সুইমিং পুল ঘিরে থাকা উশৃংখল লোকজন, হতাশ কবিদের কাহিনী।  মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণার সঙ্গে তাঁর লেখায় মনোরমভাবে পরিবেশিত হয়েছে নানা অস্পষ্ট ধ্যান-ধারণা ও বিভ্রান্তি।  তাঁর মতে, পাঠককে ঔপন্যাসিক বোঝাবেন পৃথিবী একটা বড় প্রশ্ন। পৃথিবীতে সব যদি নিশ্চিত হয়ে যায় উপন্যাসের মৃত্যু ঘটবে।কুন্দেরা তাঁর চরিত্রগুলির বাহ্যিক চেহারার চেয়ে ভিতরের চেহারা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে পাঠকের কল্পনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণতা আনে। তাঁর ধারণায়, কারও চরিত্রের প্রয়োজনীয় বিষয় তাঁর বাহ্যিক চেহারা, এমনকি মানসিক গঠনও নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ সেইসব বিষয় যা চরিত্রগুলিকে ভাঙাগড়া করে। নির্বাসন, অস্তিত্ব, ভালোবাসা-শিল্প-ভাবগম্ভীর সীমানা বহির্ভূত জীবন নিয়ে রচিত কুন্দেরার চরিত্রগুলিতে অস্পষ্টতা একটা ধরন এবং প্রায়ই দেখা যায় একাধিক মূল চরিত্র। একই উপন্যাসে দেখা যাবে কোন মূল চরিত্র কোথায় হারিয়ে গেল আর উপন্যাস এগিয়ে গেল অন্য এক চরিত্র নিয়ে।

কুন্দেরার জন্ম ১৯২৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার এক শহরে মধ্যবিত্ত ও সুসংস্কৃতি সম্পন্ন পরিবারে। তাঁর বাবা লুটভিক কুন্দেরা ছিলেন সংগীত বিশারদ ও পিয়ানোশিল্পী। কুন্দেরা তাঁর কাছেই পিয়ানো বাজাতে শেখেন এবং পরে সংগীততত্ত্ব ও সংগীত রচনা নিয়ে পড়াশুনা করেন। তাঁর রচনায় সংগীত এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উপস্থিত থেকেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনা চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিলে কুন্দেরা মার্কস তত্ত্বে আকৃষ্ট হন এবং কমিউনিস্টদের দলে নাম লেখান যারা ১৯৪৮ সালে ক্ষমতায় আসে তাঁর দেশে। ১৯৫০ সালে কুন্দেরা ও অন্য লেখক জ্যান ট্রেফুলকাকে দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য অবশ্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আসলে মার্কসীয় যে দর্শন কুন্দেরাকে আকৃষ্ট করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় শাসন তেমন ছিল না বাস্তবে। তাঁর প্রথম সাহিত্যসৃষ্টি ছিল দা ওনার্স অফ দ্য কিজ, কবিতা ও নাটকের প্রকাশ, সম্পূর্ণভাবে কমিউনিজমের প্রচারসর্বস্ব হলেও রাষ্ট্রগৃহীত শাসনতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেনি। মানবতার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র মতবাদ নিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রাগ স্প্রিং নামে এক স্বল্পস্থায়ী আন্দোলন যাতে কুন্দেরা যোগ দেন এবং সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে জোড় প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।

প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কুন্দেরা পরে পড়াশুনা করেন। কিছুদিন পর  প্রাগের  অ্যাকাডেমি অফ পারফরমিং আর্টস্ বিভাগে তিনি ফিল্ম ফ্যাকাল্টিতে গিয়ে চিত্র পরিচালনা ও সংলাপ রচনা শিক্ষা নেন। স্নাতক হওয়ার পর ফিল্ম ফ্যাকাল্টিতে তিনি বিশ্বসাহিত্যে লেকচারার হন। ষাটের দশকে তিনি ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন যা লাফেবল লাভস্ গ্রন্থে সংকলিত হয়। তাঁর মতে এগুলি তাঁর পরিণত কাজের শুরু। অনেক গল্পেই দেখা যায় কোন এক নির্দোষ আড়ম্বরকে যারা তৈরি করে এবং যারা উপভোগ করে তাদের জন্য শেষপর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনে। এভাবে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন চেক কমিউনিজমের প্রকৃত চেহারা যা উদ্যোক্তাদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে কুন্দেরা আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢোকার সুযোগ পেলেও ১৯৭০ সালে আরও একবার বহিষ্কৃত হন। সঙ্গে ছিলেন ভাক্ল্যাভ হ্যাভেল-এর মত অন্যান্য বিখ্যাত লেখক ও শিল্পীরা। তবুও কুন্দেরা চেক কমিউনিজমকে পুনর্গঠন-এর চেষ্টা করে যেতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ১৯৭৫ সালে তাঁকে সংস্কারের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে হয়। ১৯৮১ সালে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন।

১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার ওপর রাশিয়া আধিপত্য বিস্তার করলে প্রাগ স্প্রিং আন্দোলনের ধ্বংস ঘটে। ১৯৬৭ সালে পার্টি থেকে বহিষ্কারের স্মৃতি নিয়ে কুন্দেরা দা জোক উপন্যাস লেখেন যেখানে এক তরুণ তার বান্ধবীকে বিরক্তিকর এক চিঠি লেখার জন্য রাজনৈতিক হেনস্থার শিকার হয়েছিল। রাশিয়ান কমিউনিস্টরা চেকোস্লোভাকিয়ায় এসে যাদের প্রথমেই অপছন্দ করে তাদের একজন কুন্দেরা। ফিল্ম ফ্যাকাল্টির পড়ানোর কাজ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর লেখা বইপত্র সমস্ত লাইব্রেরি ও বুকস্টোর থেকে শাসকরা সরিয়ে নিয়ে যায় এবং কোন নতুন বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসে। তবুও কুন্দেরা লিখতে থাকেন এবং তাঁর উপন্যাস লাইফ ইজ এলজহয়ার এবং দ্যা ফেয়ারওয়েল পার্টি দেশের বাইরে প্রকাশিত হয়।

কমিউনিস্টদের কাছে ব্লাকলিস্টেড হয়ে কুন্দেরা ফ্রান্সে গিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত আত্ম উপাখ্যানধর্মী লেখা দা বুক অফ লাফটার এন্ড ফর গেটিং যেখানে তিনি জানান সেসব চেক নাগরিকদের কথা যারা কমিউনিজম আগ্রাসনকে নানা উপায়ে বিরোধিতা করছে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর সর্বোত্তম বিখ্যাত উপন্যাস দা আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং যার চলচ্চিত্রায়ন ঘটান মার্কিন পরিচালক ফিলিপ কাউফম্যান। ব্যক্তির অনির্দিষ্ট ভাগ্য উপন্যাসের মূল বিষয়, যেখানে দেখানো হয়েছে, কোন একজন যেভাবে বেঁচে আছে হয়তো সেভাবে না-ও বাঁচতে পারত। পৌনঃপুনিকতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভুল-শুদ্ধ নির্বাচনের কোন সম্ভাবনাই নেই।

নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও কুন্দেরা জোর দিয়ে সবসময় বলে এসেছেন যে উপন্যাস সম্পূর্ণভাবে শিল্পকর্ম হওয়া উচিত, কখনোই তা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম নয়। পরবর্তী সময়ে কুন্দেরা নিজেও তাঁর উপন্যাস থেকে রাজনীতি বর্জন করতে থাকেন, পরিবর্তে মুখ্য হয়ে ওঠে বৃহত্তর দার্শনিক ধ্যান-ধারণা। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি ফরাসি ভাষায় লিখতে শুরু করেন। কুন্দেরার মতে, ইউরোপের চারজন বড় ঔপন্যাসিক হলেন ফ্রাঞ্জ কাফকা, হারম্যান ব্রখ, রবার্ট মুসিল এবং উইটোল্ড গমব্রউকজ্।

ভার্গাস লোসা

বিশ্ববন্দিত ঔপন্যাসিক। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালে। ম্যাজিক রিয়ালিজম সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ। জন্মের কিছুদিন পরই তাঁর বাবা ও মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তাঁকে নিয়ে তাঁর মা চলে যান বলিভিয়াতে নিজের বাবার কাছে যেখানে ভদ্রলোক পেরুর দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। দাদুর সঙ্গে বেশ স্বাচ্ছন্দের মধ্যেই থাকতেন তিনি ও তাঁর মা। আট বছর ছিলেন তিনি এই পরিবেশে। দিনরাত কেবল অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়তেন। গল্পগুলি যেখানে শেষ হত লোসা তা পছন্দ করতেন না। তিনি তাই প্রত্যেকটি গল্পের শেষে আরও অতিরিক্ত অধ্যায় নিজে বানিয়ে নিতেন।

শিগগিরই বাবা আর মায়ের বিরোধ মিটে যায়। লোসার বয়স তখন দশ। তাঁরা আবার পেরুতে চলে আসেন। খুব কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে অশান্তি। কবিতা মোটেই পছন্দ করতেন না ভদ্রলোক। ছেলের মতিগতি দেখে তিনি বেশ ভয় পেতেন। ছেলে না শেষে লেখক হয়ে যায় এই আশঙ্কা থেকে মুক্তি পেতে তিনি ছেলেকে লিওনাসিও প্রাদো মিলিটারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। সৈনিক স্কুলের কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে পড়লে নিশ্চয় ছেলের সাহিত্যপ্রীতি ঘুচে যাবে। ব্যাপারটাকে লোসার মনে হয়েছিল এক নিষ্ঠুরতা। সৈনিক স্কুলের পরিবেশ তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। এই বিরুদ্ধ পরিবেশ তাঁর মধ্যে এক বিপরীত প্রভাব ফেলেছিল। গোপনে তাঁর সাহিত্যপ্রীতি বজায় রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। লিখতে থাকেন প্রাণমন দিয়ে এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে এভাবেই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাবেন।

১৯৬২ সালে তাঁর বয়স যখন ২৬ তখন তাঁর প্রথম উপন্যাস দা টাইম অফ দ্য হিরো প্রকাশিত হয়। এই বইতে মিলিটারিদের খুব কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছিলেন তিনি। বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পায় এই উপন্যাস। সবাই এর উচ্চ প্রশংসা করে কিন্তু লিওনাসিও প্রাদো মিলিটারি স্কুলের কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি পড়ে প্রচন্ড খেপে যায়। তাদের হুকুমে এই বইয়ের কয়েক হাজার কপি জনসমক্ষে পোড়ানো হয়। 

উপন্যাসটির প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সেই সব ব্যক্তিবর্গ এবং বিধিনিষেধ যা পেরুর লেখকদের প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। উপন্যাসের চরিত্রগুলি ফ্যান্টাসিতে মুড়ে দিয়ে ভার্গাস লোসা এক অনবদ্য আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব জীবন ও কল্পনা পরস্পর সংবদ্ধ হয়ে কিভাবে এক বিশেষ বাস্তবতার উৎপত্তি ঘটায় যা ওই দুটি উপাদানের কোন একটিকে বাদ দিয়ে থাকতে পারে না, এই ব্যাপারটাকে অনুসন্ধান করাই আসলে লোসার লেখালেখির অন্যতম মূল আকর্ষণ।

আর এখানেই রচনাশৈলীতে ম্যাজিক রিয়ালিজমকে আশ্রয় করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে হোরহে লুইস বোর্জেস এই বিশেষ ধারার উদ্ভাবক, দার্শনিক রহস্যসমূহ আবিষ্কারের উপায় হিসেবে তাঁর গল্পগুলিতে ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর উত্তরসূরি সাহিত্যিকদের রচনায় এই প্রকরণ সমৃদ্ধ হয়ে উদ্ভব ঘটায় ম্যাজিক রিয়ালিজমের। এই বাস্তবতা দেখায় যে পৃথিবী ও মানব সমাজের স্বাভাবিক বাইরের চেহারাটার ভিতরে গোপন রয়েছে অন্য এক বাস্তবতা যা আমরা কেউ খালি চোখে দেখতে পাই না। ভার্গাস লোসা ছাড়াও এই বিশেষ সাহিত্যরীতির স্থপতিকার হিসেবে গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্টেস ও অ্যালজো কার্পেন্টিয়ের সারা বিশ্বে পরিচিত। 

১৯৬৭ সালে লোসার সঙ্গে মার্কেজের দেখা হয় ক্যারাকাস শহরে। তাঁরা দুজনে একসঙ্গে কাহিনী রচনার শিল্পকলা নিয়ে সর্বসাধারণের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় যোগ দেন। সমাজে উপন্যাসের লক্ষ্য কী এই বিষয়ে ভারগাস লোসার ধারণা এ সময় বেশ পরিণত হয়ে ওঠে। তাঁর ধারণায় উপন্যাস হলো লেখকদের লড়াই করার একটি মাধ্যম এবং এর সাহায্যে লেখকরা মানবিক বাস্তবতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। উপন্যাস একই সঙ্গে কোন ব্যক্তির অতীত সময়কে বাঁচিয়ে রাখে এবং ব্যক্তি সত্ত্বাকে অশুভ প্রভাব মুক্ত করে।

সত্তরের দশকে লোসা ভীষণভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮১ সালে তিনি লেখেন দা ওয়ার অফ দা এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড যে লেখায় ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে রাজনৈতিক গোঁড়ামির প্রবল নিন্দে করা হয়। কাহিনীর পটভূমিকায় থাকে উনবিংশ শতাব্দীর ব্রাজিল, এখানে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়। লোসা দেখিয়েছেন যে ইতিহাসও আসলে এক কল্পকাহিনী এবং এ-সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ পাল্টে দিতে পারে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভার্গাস লোসা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে কেবল লেখার জগতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করতে চান। পেরুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার নির্বাচনে তিনি আলবার্টো ফুজিমোরি-র সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। তিনি হেরে যান আর ফুজিমোরি পেরুতে কায়েম করেন স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ এক শাসনতন্ত্রের।

ভার্গাস লোসা কিন্তু লেখা থামাননি কোন অবস্থাতেই। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে দা ফিস্ট অব দ্য গোট উপন্যাস যেখানে ইতিহাস ও কল্পনার সঙ্গে রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি মিশিয়ে ভার্গাস লোসা এক স্বৈরাচারী একনায়কের শাসন বিশ্লেষণ করেছেন। এছাড়া আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দা স্ক্রিপ্টরাইটার এবং আ ফিস ইন দ্য ওয়াটার হল ভারগাস লোসার অন্য দুটি বিখ্যাত রচনা।

লু শুন

বিশ্ব সাহিত্যে আধুনিকতা বা মডার্নিজম বলতে আমরা সবাই বুঝি ইউরোপীয় সাহিত্য। যাঁরা একটু বেশি সাহিত্তানুরাগী তাঁরা লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কথাও বলবেন। ইউরোপে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আধুনিকতা ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই দেখা যায় এর সূত্রপাত। শহরের প্রসার, জীবনযাপনে ভোগবাদের বৃদ্ধি, শিল্পের অবমূল্যায়ন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ-এর জন্ম নেওয়ার প্রধান কারণ বলা যায় যার প্রকাশ ঘটে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি উপন্যাস ও বোদলেয়ার-এর লা ফ্লয়ারস দ্যু ম্যাল গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে উনবিংশ শতকের শেষে যা ছিল মূলত কাব্যকেন্দ্রিক এবং এই আন্দোলনের মধ্যমণি ছিলেন কবি রুবেন দারিও ও তাঁর অনুগামীরা।

কিন্তু আমরা অনেকেই খবর রাখি না যে চৈনিক সাহিত্যেও আধুনিকতা দেখা দিয়েছিল প্রায় স্বাধীনভাবে এবং তা ছিল ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার তুলনায় শক্তিশালী। ১৮৯৯ সালে লিয়াং চিচাও নামে এক বুদ্ধিজীবী তাঁর লেখায়-সাহিত্যে চালু ঘষামাজা সনাতন ভাষার সঙ্গে নতুন প্রচলিত মাতৃভাষার মিশেল দেওয়ার কথা বলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আধুনিকতা চৈনিক সাহিত্যে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তোলে যার প্রাণপুরুষ ছিলেন চেন দুশিউ ও তাঁর সাহিত্যপত্র নিউ ইয়ুথ । চেন দুশিউ কনফুসিয়াস যুগের সনাতন সাহিত্য ভাষার চরম বিরোধী ছিলেন এবং তাঁর পত্রিকায় হু শিহ-র একটি প্রবন্ধ সাহিত্য মহলে ঝড়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে লেখকদের মাতৃভাষা বাই হুয়াতে সাহিত্যসৃষ্টির জন্য ডাক দেন। বাই হুয়া ভাষায় তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেন। এই সময়েই নিউ ইয়ুথ পত্রিকার এক নিয়মিত লেখক ডায়েরি অফ এ ম্যাড ম্যান বা উন্মাদের দিনলিপি নামে একটি গল্প ছাপতে পাঠান। এই গল্প তার আঙ্গিক ও বর্ণনাভঙ্গির স্বকীয়তা এবং বিষয়বস্তু ভাবনার আধুনিকতায় কেবল চৈনিক সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও এক সম্পদ বলে স্বীকৃতি পায়। এটাই চীন দেশে প্রকাশিত প্রথম আধুনিক ছোট গল্প । গল্পটির তীব্র স্যাটায়ার প্রাচীন চৈনিক নৈতিকতাকে ভয়ংকর ভাবে বিদ্ধ করে। গল্পে দেখা যায় এক বিকৃতমস্তিষ্ক লোক সবসময় সন্দেহে ভুগছে যে সব লোক তাকে মেরে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এই গল্পের লেখক হচ্ছেন লু শুন। 

তাঁর আসল নাম ঝোউ শুরেন, লু শুন ছদ্মনাম। জন্ম ১৮৮১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। ঝেজিয়াং প্রদেশের শাওশিং-এ ছিল তাঁর বাবা-মায়ের বসবাস, যাঁদের অবস্থা যথেষ্ট পড়ে গিয়েছিল। লু শুন-এর ঠাকুরদা তাঁর পড়াশোনার ভার নেন। এমন একটি স্কুলে তিনি ভর্তি হন যেখানে শিক্ষাদীক্ষার ধরন-ধারন প্রাচীন চৈনিক শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় একটু উদার ছিল। এগারো বছর বয়স থেকেই তিনি সাহিত্য ও অন্য ধরনের নানা লেখা সাগ্রহে পড়তে থাকেন। কনফুসিয়াস যুগের সনাতন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মধ্যে তখন থেকেই একটা বিরাগ দেখা দেয়। 

বারো বছর বয়সে লু শুন-এর জীবনে এক পরিবর্তন আসে, ঠাকুরদার আশ্রয় ছেড়ে তিনি বাধ্য হন তাঁর মায়ের কাছে চলে যেতে। তাঁর ঠাকুরদার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে এবং আদালতে তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, ঠাকুরদাকে জেলে ধরে নিয়ে যায়। সম্পন্ন অবস্থা থেকে হঠাৎ দারিদ্র শুরু হলে তা কেমন দুঃসহ লু শুন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পান। বাস্তব পৃথিবীর দুঃখকষ্টের সঙ্গে এই যে তাঁর পরিচিতি এটাই পরবর্তী সময়ে লু শুন-এর সাহিত্যকে এত উজ্জ্বল করে তোলে।

লু শুন ও তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্প উন্মাদের দিনলিপি নিয়ে আমাদের সাহিত্যজগতেও কম আলোচনা হয়নি। যেমন আগে বলা হয়েছে, এই গল্পে এক বিকৃতমস্তিষ্ক লোক রাতদিন ভাবছে সে এক নরখাদকের সমাজে বসবাস করছে। গল্পটির বর্ণনা হয়েছে প্রথম পুরুষে যা চইনিক সাহিত্যে ইতিপূর্বে অনাস্বাদিত। নিউ ইয়ুথ সাহিত্যপত্রে গল্প ছাড়াও তাঁর কবিতা এবং প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশ পেত। পঞ্চাশটিরও বেশি ছোটগল্প তিনি এই নিউ ইয়ুথ সাহিত্যপত্রে লেখেন। দা আউটক্রাই এবং হেজিটেশন নামে তাঁর দুটি গল্প সংকলন প্রকাশ পায় যেখানে গল্পগুলিতে রয়েছে লু শুন-এর ছোটবেলায় শোনা লোক কাহিনী ও মিথের প্রভাব। দ্য ট্রু স্টোরি অফ আহ কিউ-কে বলা হয় লু শুন-এর শ্রেষ্ঠ কীর্তি যা মূলত একটি বড় গল্প বা নভেল। এখানে বলা হয়েছে গ্রাম থেকে আসা এক নিঃসঙ্গ শ্রমিকের কথা। তার সব উদ্যম ব্যর্থ হলেও আহ কিউ এমনই অন্ধ যে ভাবে তার ব্যর্থতাগুলি আসলে জয়। শেষে তার এই বোকামির জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। গল্পে লু শুন আসলে বর্ণনা করেন সমসাময়িক চৈনিক সমাজের দৃষ্টিসংকীর্ণতাকে।

একুশ বছর বয়সে লু শুন জাপানে যান। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দেশবাসীকে ডাক্তারি শিখে সেবা করা। পড়াশোনার চাপ সত্বেও সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে তিনি সবসময় মত্ত থাকেন, পশ্চিম দুনিয়ার প্রকাশিত রচনাগুলি বেশি পড়েন। রাশিয়ার লেখক গোগোল ও চেকভ তাঁকে বেশ প্রভাবিত করেন। 

প্রায় সাত বছর পর লু শুন স্বদেশে ফিরে মাধ্যমিক স্কুলে জীবন বিজ্ঞান পড়াবার কাজ নেন। ইতিমধ্যে তাঁর মনোভাব পাল্টে গিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন যে চিকিৎসাবিদ্যার চেয়ে সাহিত্য জনগণের সামাজিক উন্নয়নের অনেক বড় হাতিয়ার।এর দু’বছর পর তিনি শিল্পমন্ত্রকে এক চাকরিতে যোগ দেন ও বৌদ্ধসূত্রগুলিকে সংকলন করেন। কয়েক বছর পর জাতীয় বেইজিং বিশ্ববিদ্যালযয়ে চৈনিক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপকের চাকরি পান কিন্তু ১৯১৯ সালে ব্যক্তিগত কারণে বাড়িতে চলে আসেন ও পুরোদমে গল্প লিখতে থাকেন।

১৯২১ সালে আবার বেইজিং শহরে ফিরে এসে বেজিং নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার চাকরি পান। এসময়েই প্রতিষ্ঠিত গল্পকার হিসেবে তিনি সর্বসাধারণের স্বীকৃতি লাভ করেন। উন্মাদের দিনলিপি প্রকাশিত হয়েছিল তার এক বছর আগেই।

লু শুন আদ্যন্ত একজন কমিউনিস্ট ছিলেন, কিন্তু কখনও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন নি। অন্যদিকে যেসব তরুণ কমিউনিস্ট লেখকরা সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার পক্ষে ছিলেন তাঁদেরও তিনি সমর্থন করতে পারতেন না। ১৯২৬ সালে তিনি বেজিং ছেড়ে চলে আসেন এবং ১৯৩০ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয় লীগ অব লেফট উইং রাইটার । এরপর তিনি একের পর এক নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে থাকেন ও বহু জার্নালে সম্পাদনার কাজ পান। ১৯৩৩ সালে তাঁর যক্ষা হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। যক্ষা ধরা পড়ার পর যখন তিনি বেশ অসুস্থ

ভি এস নইপল 

অতীতের মহান ঔপন্যাসিকদের মতোই ভি এস নইপলের সাহিত্য সম্ভারও আমাদের কথা বলে। আর বলে বাস্তবের কথা। তাঁর ব্যবহৃত ভাষা যেমন নিখুঁত ঠিক তেমনি সুন্দর ও সাবলীল। শুধু তাই নয়, তাঁর ব্যবহৃত বলিষ্ঠ শব্দ এবং শব্দচয়ন প্রকাশ করে আমাদের সকলের মধ্যে বাস করা মানবতাকে।

ভি এস নইপল ১৯৩২ সালে ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা কর্মসূত্রে ভারত থেকে এই দেশে এসেছিলেন। বেড়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্তেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বস্তুভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনার সঙ্গে যার ফলস্বরূপ বোধ হয় একজন প্রকৃত সাহিত্য স্রষ্টা হওয়ার জেদ তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে। আর এই মনের ভিতর তৈরি হওয়া জেদটাই জন্ম দিয়েছিল একটি খাঁটি হাস্যরসের। তাঁর প্রথম দিককার বইগুলোতে এই হাস্যরস সম্ভারের প্রকাশ ঘটেছে। 

তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সফর করেছেন ভারতবর্ষ এবং আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই সফরগুলো থেকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের প্রকৃত অর্থ। 

আমরা তাঁর প্রতিটি বইয়ে একটু খুঁজলেই দেখতে পাবো একটা মুক্ত ব্যক্তি সত্ত্বাকে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সেই খাঁটি হাস্যরস খুঁজে পাওয়া যায়।

যদিও তার পরের দিকের সৃষ্টি সম্ভারে সময়ের প্রভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাস্যরসে যুক্ত হয়েছে বিয়োগাত্মক ট্রাজেডি। নইপল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তার মধ্যে যেমন রয়েছে দাসত্ব, বিপ্লব, জালিয়াত রাজনীতিবিদদের কথা তেমনি রয়েছে দরিদ্র ও সর্বহারাদের কাহিনী। তাঁর লেখা আমাদের সমাজে প্রোথিত হয়ে থাকা বিভিন্ন মূল্যবোধ ও সংস্কারকে সমূলে নাড়া দিয়েছে। বিগত দশকগুলি ধরে ইরান থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের ইসলাম দুনিয়ার অমানবিক ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর দিকে তীব্রতর কটাক্ষ করেছেন নইপল। ব্যক্তিগত জীবনে নইপল একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। তিনি চিন্তা এবং লেখার খোরাক খোঁজার জন্য প্রতিনিয়তই নির্জনতার আশ্রয় নিতেন।

অনেক ভারতীয় সাহিত্যস্রষ্টাই বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা আমাদের দেশে বসবাস করে আমাদের সাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন। নইপল সবার থেকে বহুলাংশেই আলাদা। তাঁর ব্যক্তিগত গল্পটা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাঁর কাজকর্মও অন্য মার্গের। তাঁর নীতিকথাও একটু অন্যরকম। সেই সৃষ্টি থেকে মানবধর্মী হাস্যরস এক স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় বার হয়ে আসে। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি বলে যায় যে মেধা ভাগ্য বিপর্যয়ের উত্থানপতন এবং বজ্জাতির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। 

১৯৭১ সালে নইপল প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত হিসেবে তাঁর বই ইন আ ফ্রি স্টেট-এর জন্য বুকার পুরস্কার পান। ২০০১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এই পুরস্কার দেওয়ার সময় তাঁর কাজের প্রশংসা করে সুইডিশ অ্যাকাডেমীর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ‘তাঁর কাজ সংবেদনশীল, বর্ণনাভিত্তিক ও সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ যা আমাদের সামনে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে ধরেছে।’

নোবেল কমিটি এই সময় নইপলের সঙ্গে পোলিশ লেখক জোসেফ কনরাড-এর মিল খুঁজে পেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কমিটি জানিয়েছিল, ‘নইপল হলেন কনরাডের যোগ্য উত্তরসূরি। একটা নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের রাজত্বের বিশ্লেষণ করেছেন, সেই রাজ্য বা রাজত্ব মানুষের সঙ্গে কী করেছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারও। সেই সময়টা আজ অতীত। সেই ইতিহাস মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে তবু তিনি তা মনে রেখেছেন, প্রকাশ করেছেন। বিশ্লেষক হিসেবে এটাই তাঁর সার্থকতা।’ নইপলের সাহিত্য, বিশেষত ভ্রমণ কাহিনীগুলি তৃতীয় বিশ্বের একটি নির্মম চিত্র তুলে ধরার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। 

ইংরেজি ভাষার দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা বৃটেনে তাঁর সাহিত্য সম্ভার অনেক বেশি জনপ্রিয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন স্কুলের পাঠক্রমে তাঁর বই পড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। 

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই নিয়মিত ভারত সফরে এসেছিলেন নইপল। প্রথমদিকে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রেখেই বিশ্লেষণ করেছেন এই দেশটাকে। তার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত অ্যান এরিয়া অফ ডার্কনেস বইটিতে। যদিও পরবর্তী সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। তাঁর মনে হয়েছে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ভারতের সভ্যতাকে আরও একবার মহত্ত্ব দিয়েছে, তার পুনরুত্থান ঘটিয়েছে। মনে করা হয়, তাঁর পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছিল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে গোরক্ষপুরে। সেখান থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা কর্মসূত্রে পাড়ি দিয়েছিলেন ত্রিনিদাদ। কয়েক দশক ধরে তিনি খুঁজেছেন তাঁর পূর্বপুরুষের বাসভিটেকে। তাঁর শিকড়কে। তাঁর এই খোঁজার কথা তিনি লিখেছেন ওপরের বইটিতে। নইপল খুব সূক্ষ্মভাবে ইসলাম ধর্মকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বেশ কিছু বইতে। এর নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরার জন্য তিনি ভীষণরকম সমালোচিত হয়েছেন। নইপলের হিন্দুত্ববাদ সমর্থনের বিষয়টিও বেশ বিতর্কিত। বাবরি মসজিদের ধ্বংসলীলাকে ইচ্ছাকৃত বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। 

১৯৬৫ সালে পতন ঘটেছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের। ওই রাজাকে সভ্যতার শেষ সুরক্ষিত দুর্গের আখ্যাটাও তাঁরই দেওয়া। ইসলাম দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি সবসময়ই তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর রচিত অ্যামঙ্গ দা বিলিভার্স বইটিতে সংকলিত হয়েছে তাঁর এই বিদ্বেষের কথা। ১৯৯৮ সালে নইপলের বিতর্কিত আত্মজীবনী পল থেরা প্রকাশিত হয়। তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বার প্রায় প্রতিটি দিক এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন। 

২০০৭ সালের প্রথম দিকে নইপল দীর্ঘদিন পর তাঁর জন্মভূমি ত্রিনিদাদে ফিরে যান। তিনি সেখানকার প্রতিটি অধিবাসীকে ভারতীয় বা আফ্রিকান তকমা মুছে ফেলে ত্রিনীদাদীয় হওয়ার এক উদাত্ত আহ্বান তোলেন। তাঁর এই দীর্ঘ ব্যবধানের পর প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানায় ত্রিনিদাদের ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ। পরবর্তী সময়ে ত্রিনিদাদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে। 

প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হেলের মৃত্যুর দু’মাস পর ১৯৯৬ সালে নইপল নাদিরা নইপলের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। নাদিরা সেই সময়ে পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। পাকিস্তানের সংবাদপত্র দা নেশান-এর সঙ্গে তিনি দশ বছর যুক্ত ছিলেন। তারপর নইপলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। কেনিয়াতে তাঁর জন্ম ও পুরো নাম নাদিরা খানুম আলভি। পাকিস্তানে নাদিরার বিয়ে হয়েছিল। নইপলকে বিয়ে করার আগে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল দু’বার। আগের বিবাহসূত্রে মালিহা এবং নাদির নামে দুটি সন্তানও রয়েছে তাঁর।

ইসলাম দুনিয়ার অমানবিক ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর দিকে তীব্রতর কটাক্ষ করেছেন নইপল। আবার সমানভাবে আক্রমণ করেছেন কমিউনিজমকে। তাঁর মতে এই দুটিই সভ্যতার বড় বিপদ। 

তাঁর স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর ছিল। তিনি বহু বছর আগে লেখা তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কী কী বিতর্কে জড়িয়েছিলেন সেগুলির পরিসংখ্যানও তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল।

আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন 

স্টালিনের রাশিয়ায় বাধ্যতামূলক শ্রমিকদের ক্যাম্পের নাম ছিল গুলাগ । লেখক নিজেও বন্দী ছিলেন এই ক্যাম্পে। এখানে থাকার অভিজ্ঞতা এক বিভীষিকা। এই ক্যাম্পে বন্দী শ্রমিকদের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালাত স্টালিনের অনুচররা তাকে ভিত্তি করেই তিন খন্ডের ঐতিহাসিক কাহিনী গুলাগ আরকিপেলাগো। এভাবে বিশ্ববাসী তাঁর লেখা থেকে জানতে পারে, ভালোমানুষ মুখোশের ছদ্মবেশে স্টালিন রাশিয়ার লেবার ক্যাম্পগুলিতে কী সন্ত্রাস চালাতেন ও তাঁর আসল চেহারা কেমন ছিল। এই বই সলঝেনিৎসিন-এর জন্য একদিকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়,অন্যদিকে জন্মভূমি রাশিয়া থেকে এই বইয়ের জন্যই তাঁকে বহিষ্কৃত হতে হয়। 

বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় বিদ্রোহী হিসেবে যে ক’জন সাহিত্যিকের নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হবে আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন   তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছিল স্টালিনের অত্যাচারে বিধ্বস্ত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার আইসেভিচ সলঝেনিৎসিন-এর জন্ম রাশিয়ার কিসলোভদস্কে ১৯১৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর। সেই সময়কার অবিভক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসক জোসেফ স্টালিনের অত্যাচার এবং দিনমজুর ও শ্রমিক শ্রেণীর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট কলমের ডগায় এনে বিপদে পড়েন সলঝেনিৎসিন এবং ১৯৭৪ সালের রাশিয়া থেকে বিতাড়িত হন। কুড়ি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে কাটিয়ে প্রিয় স্বদেশভূমিতে ১৯৯৪ সালে তাঁর পুনরাগমন ঘটে।

চরম অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করেও লেখক ভুলে যাননি নিজ জন্মভূমি রাশিয়া এবং তার সাধারণ মানুষজনকে। ১৯৭০ সালে নোবেল প্রাইজ পেয়েও পুরস্কার নিতে সুইডেনে যাননি এই ভয়ে পাছে ওখানে গেলে কমিউনিস্ট সরকার তাঁকে তাঁর প্রিয় রাশিয়াতে ঢুকতে না দেয়। নিজের দেশকে এতটাই ভালোবাসেন এই লেখক যে সন্তান-সন্ততিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও নিজে মস্কোতে থাকতেন। স্ত্রী নাতালিয়া তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। আলেকজান্ডারের পান্ডুলিপি পরিমার্জন থেকে শুরু করে প্রকাশকের কাছে দরবার করা বা বই প্রকাশ করা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই সুষ্ঠুহাতে সামলাতে এই তেজস্বিনী মহিলা সিদ্ধহস্ত। নাতালিয়া হলেন আলেকজান্ডারের ভাষায়, তাঁর পাবলিক ফেস, আবার আলেকজান্ডার প্রতিষ্ঠিত একটি রুশ সামাজিক তহবিলের সর্বময় কর্তা। লেখকের প্রকাশিত লেখা এবং বই থেকে প্রাপ্ত রয়ালিটি ওই তহবিলে জমা পড়ে। স্টালিনের আমলে অত্যাচারিত যেসব ব্যক্তি এখনো জীবিত তাঁদের ওই অর্থ থেকে পেনশন দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

ককেশাস পর্বতমালার উত্তরাংশে আলেকজান্ডারের দাদু ছিলেন বিশাল এস্টেট-এর মালিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর মা তাইসিয়া পড়াশোনা করতে মস্কো আসেন ও যুবক সৈনিক অফিসার আইজাকির সঙ্গে পরিচিত হন। পরে তাঁদের বিয়ে হয় কিন্তু লেখক যখন মাতৃগর্ভে তখন বাবা আইজাকি শিকারে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর মা তাঁকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষায় যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। মা ও মাসি মিলে তাঁকে বড় করে তোলেন। তাঁর ২২ বছর বয়সের সময় মা মারা যান।

বিশ্ববিদ্যালযয়ে তিনি অংক নিয়ে পড়লেও দর্শন-সাহিত্য-ইতিহাস শিখেছিলেন করেসপন্ডেন্স কোর্স হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেড আর্মির হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধও করেছিলেন। এ সময়েই জনৈক বন্ধুকে তিনি স্টালিনের সমালোচনা করে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি যেভাবেই হোক প্রকাশ পেয়ে যায় আর সলঝেনিৎসিনকে লেবার ক্যাম্পে আট বছরের বন্দীদশায় পাঠানো হয়। অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে আট বছর কাটার পর তিনি লেবার ক্যাম্প থেকে ছাড়া পান। এবার বাকি জীবন গৃহবন্দী হয়ে থাকার শাস্তি জোটে তাঁর কপালে। এ সময়েই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন হলে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এইসব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই তাঁর উপন্যাস ক্যান্সার ওয়ার্ড । 

লেবার ক্যাম্পের বীভৎস অত্যাচার নিয়ে গুলাগ আর্কিপেলাগো ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন অবিস্মরণীয় উপন্যাস ওয়ানডে ইন দা লাইফ অফ আইভান ডেনিসোভিচ । এই বইটিও তাঁকে রাশিয়ান স্বৈরাচারী শাসকদের কাছে বিরাগভাজন করে তোলে। স্টালিনের লেবার ক্যাম্পে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে আর তিনি লিখেছেন দ্য ফার্স্ট সার্কেল । তাদের মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ান বিপ্লবকে ভিত্তি করে রচিত দা রেড হুইল বেশ বিখ্যাত। এছাড়া আছে রিবিল্ডিং রাশিয়া এবং রাশিয়া ইন দা অ্যাবিস্।রাশিয়ান ও ইহুদি সম্পর্ক নিয়ে লেখা এই শতাব্দীর আরম্ভে তাঁর টু সেঞ্চুরিজ টুগেদার বইটি প্রকাশিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *