দীপান্বিতা

 ভি এস নইপল 

অতীতের মহান ঔপন্যাসিকদের মতোই ভি এস নইপলের সাহিত্য সম্ভারও আমাদের কথা বলে। আর বলে বাস্তবের কথা। তাঁর ব্যবহৃত ভাষা যেমন নিখুঁত ঠিক তেমনি সুন্দর ও সাবলীল। শুধু তাই নয়, তাঁর ব্যবহৃত বলিষ্ঠ শব্দ এবং শব্দচয়ন প্রকাশ করে আমাদের সকলের মধ্যে বাস করা মানবতাকে।

ভি এস নইপল ১৯৩২ সালে ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা কর্মসূত্রে ভারত থেকে এই দেশে এসেছিলেন। বেড়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্তেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বস্তুভিত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বঞ্চনার সঙ্গে যার ফলস্বরূপ বোধ হয় একজন প্রকৃত সাহিত্য স্রষ্টা হওয়ার জেদ তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে। আর এই মনের ভিতর তৈরি হওয়া জেদটাই জন্ম দিয়েছিল একটি খাঁটি হাস্যরসের। তাঁর প্রথম দিককার বইগুলোতে এই হাস্যরস সম্ভারের প্রকাশ ঘটেছে। 

তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সফর করেছেন ভারতবর্ষ এবং আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই সফরগুলো থেকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের প্রকৃত অর্থ। 

আমরা তাঁর প্রতিটি বইয়ে একটু খুঁজলেই দেখতে পাবো একটা মুক্ত ব্যক্তি সত্ত্বাকে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সেই খাঁটি হাস্যরস খুঁজে পাওয়া যায়।

যদিও তার পরের দিকের সৃষ্টি সম্ভারে সময়ের প্রভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাস্যরসে যুক্ত হয়েছে বিয়োগাত্মক ট্রাজেডি। নইপল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তার মধ্যে যেমন রয়েছে দাসত্ব, বিপ্লব, জালিয়াত রাজনীতিবিদদের কথা তেমনি রয়েছে দরিদ্র ও সর্বহারাদের কাহিনী। তাঁর লেখা আমাদের সমাজে প্রোথিত হয়ে থাকা বিভিন্ন মূল্যবোধ ও সংস্কারকে সমূলে নাড়া দিয়েছে। বিগত দশকগুলি ধরে ইরান থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের ইসলাম দুনিয়ার অমানবিক ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর দিকে তীব্রতর কটাক্ষ করেছেন নইপল। ব্যক্তিগত জীবনে নইপল একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। তিনি চিন্তা এবং লেখার খোরাক খোঁজার জন্য প্রতিনিয়তই নির্জনতার আশ্রয় নিতেন।

অনেক ভারতীয় সাহিত্যস্রষ্টাই বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁরা আমাদের দেশে বসবাস করে আমাদের সাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন। নইপল সবার থেকে বহুলাংশেই আলাদা। তাঁর ব্যক্তিগত গল্পটা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাঁর কাজকর্মও অন্য মার্গের। তাঁর নীতিকথাও একটু অন্যরকম। সেই সৃষ্টি থেকে মানবধর্মী হাস্যরস এক স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় বার হয়ে আসে। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি বলে যায় যে মেধা ভাগ্য বিপর্যয়ের উত্থানপতন এবং বজ্জাতির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। 

১৯৭১ সালে নইপল প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত হিসেবে তাঁর বই ইন আ ফ্রি স্টেট-এর জন্য বুকার পুরস্কার পান। ২০০১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এই পুরস্কার দেওয়ার সময় তাঁর কাজের প্রশংসা করে সুইডিশ অ্যাকাডেমীর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ‘তাঁর কাজ সংবেদনশীল, বর্ণনাভিত্তিক ও সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ যা আমাদের সামনে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে ধরেছে।’

নোবেল কমিটি এই সময় নইপলের সঙ্গে পোলিশ লেখক জোসেফ কনরাড-এর মিল খুঁজে পেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কমিটি জানিয়েছিল, ‘নইপল হলেন কনরাডের যোগ্য উত্তরসূরি। একটা নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের রাজত্বের বিশ্লেষণ করেছেন, সেই রাজ্য বা রাজত্ব মানুষের সঙ্গে কী করেছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারও। সেই সময়টা আজ অতীত। সেই ইতিহাস মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে তবু তিনি তা মনে রেখেছেন, প্রকাশ করেছেন। বিশ্লেষক হিসেবে এটাই তাঁর সার্থকতা।’ নইপলের সাহিত্য, বিশেষত ভ্রমণ কাহিনীগুলি তৃতীয় বিশ্বের একটি নির্মম চিত্র তুলে ধরার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। 

ইংরেজি ভাষার দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা বৃটেনে তাঁর সাহিত্য সম্ভার অনেক বেশি জনপ্রিয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন স্কুলের পাঠক্রমে তাঁর বই পড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। 

বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই নিয়মিত ভারত সফরে এসেছিলেন নইপল। প্রথমদিকে তিনি একটা দূরত্ব বজায় রেখেই বিশ্লেষণ করেছেন এই দেশটাকে। তার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই তাঁর রচিত অ্যান এরিয়া অফ ডার্কনেস বইটিতে। যদিও পরবর্তী সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। তাঁর মনে হয়েছে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ভারতের সভ্যতাকে আরও একবার মহত্ত্ব দিয়েছে, তার পুনরুত্থান ঘটিয়েছে। মনে করা হয়, তাঁর পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছিল উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে গোরক্ষপুরে। সেখান থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা কর্মসূত্রে পাড়ি দিয়েছিলেন ত্রিনিদাদ। কয়েক দশক ধরে তিনি খুঁজেছেন তাঁর পূর্বপুরুষের বাসভিটেকে। তাঁর শিকড়কে। তাঁর এই খোঁজার কথা তিনি লিখেছেন ওপরের বইটিতে। নইপল খুব সূক্ষ্মভাবে ইসলাম ধর্মকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বেশ কিছু বইতে। এর নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরার জন্য তিনি ভীষণরকম সমালোচিত হয়েছেন। নইপলের হিন্দুত্ববাদ সমর্থনের বিষয়টিও বেশ বিতর্কিত। বাবরি মসজিদের ধ্বংসলীলাকে ইচ্ছাকৃত বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। 

১৯৬৫ সালে পতন ঘটেছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের। ওই রাজাকে সভ্যতার শেষ সুরক্ষিত দুর্গের আখ্যাটাও তাঁরই দেওয়া। ইসলাম দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি সবসময়ই তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর রচিত অ্যামঙ্গ দা বিলিভার্স বইটিতে সংকলিত হয়েছে তাঁর এই বিদ্বেষের কথা। ১৯৯৮ সালে নইপলের বিতর্কিত আত্মজীবনী পল থেরা প্রকাশিত হয়। তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বার প্রায় প্রতিটি দিক এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন। 

২০০৭ সালের প্রথম দিকে নইপল দীর্ঘদিন পর তাঁর জন্মভূমি ত্রিনিদাদে ফিরে যান। তিনি সেখানকার প্রতিটি অধিবাসীকে ভারতীয় বা আফ্রিকান তকমা মুছে ফেলে ত্রিনীদাদীয় হওয়ার এক উদাত্ত আহ্বান তোলেন। তাঁর এই দীর্ঘ ব্যবধানের পর প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানায় ত্রিনিদাদের ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ। পরবর্তী সময়ে ত্রিনিদাদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে। 

প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া হেলের মৃত্যুর দু’মাস পর ১৯৯৬ সালে নইপল নাদিরা নইপলের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। নাদিরা সেই সময়ে পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। পাকিস্তানের সংবাদপত্র দা নেশান-এর সঙ্গে তিনি দশ বছর যুক্ত ছিলেন। তারপর নইপলের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। কেনিয়াতে তাঁর জন্ম ও পুরো নাম নাদিরা খানুম আলভি। পাকিস্তানে নাদিরার বিয়ে হয়েছিল। নইপলকে বিয়ে করার আগে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল দু’বার। আগের বিবাহসূত্রে মালিহা এবং নাদির নামে দুটি সন্তানও রয়েছে তাঁর।

ইসলাম দুনিয়ার অমানবিক ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর দিকে তীব্রতর কটাক্ষ করেছেন নইপল। আবার সমানভাবে আক্রমণ করেছেন কমিউনিজমকে। তাঁর মতে এই দুটিই সভ্যতার বড় বিপদ। 

তাঁর স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর ছিল। তিনি বহু বছর আগে লেখা তাঁর বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কী কী বিতর্কে জড়িয়েছিলেন সেগুলির পরিসংখ্যানও তাঁর ঠোঁটস্থ ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *