প্রীতন্বিতা
জ্যোতিষ কি বিজ্ঞান ?
জ্যোতিষ বিজ্ঞান হোক আর না হোক তাতে জ্যোতিষীদের কোন ক্ষতি হবে না, কারণ জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কোন অবস্থাতেই কমবে কিনা সন্দেহ। কমা তো দূরের কথা মানুষের বিশ্বাস বরং দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। এদেশে রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ডাক্তাররা পর্যন্ত দেখা যায় জ্যোতিষীদের কথার ওপর ভরসা করে অনেক কাজে হাত দেয়। সংবাদপত্র,ম্যাগাজিন ছাড়াও টিভি চ্যানেলগুলিতে জ্যোতিষীদের ক্রমবর্ধমান দাপট খুবই পরিচিত ঘটনা।
সাধারণ মানুষের জ্যোতিষীর ওপর বিশ্বাস কেবল যে আমাদের দেশেরই ঘটনা এমন নয়। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনে জ্যোতিষ সম্পর্কে নিয়মিত কলাম ছাপা হয়। ১৯৮৪ সালে বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক আন্তর্জাতিক সংস্থা সমস্ত সংবাদপত্র সম্পাদকদের কাছে এক আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন যাতে তাদের জ্যোতিষ বিভাগের ওপর একথা লিখে দেওয়া হয় যে এই বিভাগের বিনোদন ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত কোন ভিত্তি নেই। হাতে গোণা যায় মাত্র এমন কয়েকজন সম্পাদকই এই আবেদনে সারা দিয়েছিলেন।
মানুষ কিছুটা অন্ধভাবে জ্যোতিষে বিশ্বাস করে। হয়তো মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। দেখা গেছে, জ্যোতিষীর বক্তব্যকে মানুষ সত্যি বলে ভাবতেই অভ্যস্ত, সেই বক্তব্যে যাই থাকুক না কেন। আসলে এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। তাছাড়া জ্যোতিষীরা তাদের বক্তব্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করে সেগুলি প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন কোন ব্যক্তির চরিত্র বোঝাতে হয়তো বলা হয় ‘সতর্ক’, ‘সরল’, ‘অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়’।এই শব্দগুলি যেকোনো ব্যক্তির জন্যই ব্যবহার করা যায়, আবার সবাই শব্দগুলি পছন্দও করবে। শব্দ ও বক্তব্যকে সর্বজনীন করে তোলার কৌশলই মনে হয় জ্যোতিষকে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে। যেমন, জ্যোতিষ বিভাগে প্রায়ই দেখা যায় কোন এক রাশিফলের সমস্যা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘আপনার সাময়িক অর্থকষ্ট হবে’ বা ‘আপনাকে প্রিয়জনরা ভুল বুঝবে’ ইত্যাদি। এই বক্তব্যগুলিও সমস্ত লোকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসব বক্তব্যকে বলা যেতে পারে ‘প্রসারিত মোজার তত্ত্ব’, অর্থাৎ বাজার থেকে মোজা কিনলেই তা যে কোন সাইজের পায়ে ঠিক লেগে যাবে।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের ধারণা হাজার হাজার বছরের পুরনো। চার হাজার বছর আগের ব্যাবিলনে এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা, রানি ও তাদের পাত্রমিত্ররাত্র বটেই, সাধারণ ব্যক্তিরাও জ্যোতিষকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। জাতীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও জ্যোতিষ অপরিহার্য হয়ে যায়। সাধারণভাবে বিজ্ঞান চেতনার আবির্ভাবের আগে থেকেই জ্যোতিষ শাস্ত্রের সঙ্গে মানুষের পরিচয়। এই শাস্ত্রে মানুষের জন্ম মুহূর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চন্দ্র-সূর্য ও অন্যান্য গ্রহগুলি মানুষের জীবন প্রভাবিত করবে বলে ভাবা হয়। পৃথিবীকে মনে করা হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এবং গ্রহগুলিকে নিয়ে চন্দ্র-সূর্য একে প্রদক্ষিণ করছে। নক্ষত্রগুলি স্থির আলোক উৎস হিসেবে আকাশের গায়ে অবস্থানরত। জ্যোতিষ শাস্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে এখানেই। জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান থেকে আজকাল একটি বাচ্চাও জানে যে সৌরমণ্ডলের কেন্দ্রে অবস্থিত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবী। তাছাড়া জ্যোতিষীদের ধারণা অনুযায়ী চাঁদ বা সূর্যকে গ্রহ ভাবার কোন কারণ নেই। আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে জ্যোতিষ বিদ্যায় ইউরেনাস, নেপচুন ইত্যাদি গ্রহগুলির কোন উপস্থিতি দেখা যায় না। আসলে প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্র গড়ে উঠেছিল খালি চোখে আকাশের জ্যোতিষ্কগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে। দূরবীন উদ্ভাবনের পর মানুষ ইউরেনাস, নেপচুন ইত্যাদির কথা জানতে পারে। জ্যোতিষীরা তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কিন্তু ওই অদেখা গ্রহগুলির সন্ধান পায়নি।
কোন ব্যক্তির জন্মলগ্ন নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র খুব বেশি মাথা ঘামায়। ধারণা অনুযায়ী জন্মলগ্নে গ্রহগুলির বিশেষ অবস্থান শুভ-অশুভ প্রভাবের কারণ যা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র নির্ধারণ করে। কিন্তু আজকাল যে হারে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হচ্ছে তাতে আর জন্মের সময় অনিশ্চিত থাকার উপায় নেই। আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করে জিন ও পরিবেশজনিত প্রভাব। এখানে গ্রহগুলির প্রভাবের কোন ভূমিকাই নেই। বিজ্ঞাননির্ভর অসংখ্য পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে গ্রহের দশা অনুযায়ী মানুষের ব্যক্তিত্ব, পেশা বা সাফল্য কোনভাবেই নির্ধারিত হতে পারে না।
জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণীর ব্যাপারটিও বহু পরীক্ষা থেকে ধাপ্পা বলেই প্রমাণিত হয়েছে। ‘দ্য জেমিনি সিনড্রোম’ বইটিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানী রজার কালভার ও ফিলিপ লানা কোন পাঁচ বছরে জ্যোতিষীদের করা তিন হাজারের বেশি ভবিষ্যৎবাণীর নব্বই শতাংশকেই ভুল হতে দেখেছেন। এর চেয়ে বরং কলেজে পড়া ছাত্ররা তাদের পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসতে পারে এই অনুমান অনেক বেশি সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছিল। বিজ্ঞানীরা জ্যোতিষী ও সাধারণ লোকদের এক সঙ্গে নিয়ে নানা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে কোন কিছু অনুমান করার ব্যাপারে জ্যোতিষীদের তুলনায় সাধারণ লোকরাই ভালো ফল দেখিয়েছে। জ্যোতিষীদের তৈরি করা কোষ্ঠি-ঠিকুজি নিয়েও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং সমস্ত ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে কোন এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির কোষ্ঠি অনায়াসেই অন্য ব্যক্তির কোষ্ঠি হয়ে যেতে পারে।কোষ্ঠির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বলা যায় ছদ্মবিজ্ঞান। বিষয়টিকে মজা হিসেবে ভাবলে ভালো। কিন্তু যখন মানুষ ও প্রচার মাধ্যমের প্ররোচনা বিষয়টিকে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলে ভেবে নিতে বাধ্য করে রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জড়িয়ে ফেলে তখন এটি সর্বনাশের কারণ হয়ে ওঠে।
জেনোর কূটাভাস
জেনো ছিলেন একজন গ্রীক দার্শনিক বা চিন্তাবিদ। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল অংকশাস্ত্রে। পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি এলিয়া অঞ্চলে বসবাস করতেন। বলা হয় যে তিনি ছিলেন সক্রেটিসের শিক্ষাগুরু। কূটাভাস শব্দটির ইংরেজি হচ্ছে প্যারাডক্স, যা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধাচরণ বোঝায়।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রীকরা সংখ্যাতত্ত্বের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিল। তাদের নজরে এসেছিল অসীম সংখ্যাটি। এখনো সাধারণ লোকরা মনে করে যে অসীম সংখ্যা হচ্ছে এমন একটি সংখ্যা যা যেকোনো সংখ্যার চেয়ে বড়। আসলে অসীম সংখ্যা বা ইনফিনিটি কোন সংখ্যাই নয়, একটি ধারণা মাত্র। তবে এই ধারণা এমনই শক্তিশালী যার থই আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জার্মান গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট অঙ্কশাস্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে অংকশাস্ত্র হচ্ছে অসীম সংখ্যা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। গ্রীকরাও গণিতশাস্ত্রের মূল বিষয় হিসেবে অসীম সংখ্যার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। অসীম সংখ্যা নিয়ে গ্রীকদের গবেষণা এমন অনেক বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছিল যার সদুত্তর খুঁজে পেতে গণিতজ্ঞরা পরবর্তী দু’হাজার বছর ধরে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলেন। গ্রীকরা অসীম সংখ্যাকে বেশ অপছন্দ করত। অংকশাস্ত্রে অসীম সংখ্যাকে যে কোন মূল্যে এড়িয়ে চলতে চাইত তারা। স্বয়ং গ্যালিলেও পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন অসীম সংখ্যাকে গণিতের গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গ্রীকদের এই অসীম সংখ্যা-ভীতি গণিতশাস্ত্রের অগ্রগতিকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল।
সুযোগ পেলেই গ্রীকরা প্রমাণ করে দেখাতে চাইত অসীম সংখ্যা কতটা অবাস্তব। এই প্রচেষ্টা থেকেই তৈরি হয়েছিল জেনোর কূটাভাস। চারটি কূটাভাসের সাহায্যে জেনো দেখিয়েছিলেন যে অসীমত্বের ধারণা ভিত্তিহীন। তাঁর যুক্তি মেনে নিলে স্থান-কালকে কখনোই অসীম বলে ভাবা ঠিক হবে না।
দৌড়বীরের কূটাভাস, অ্যাকিলেস ও কচ্ছপের কূটাভাস, তীরের কূটাভাস, স্টেডিয়ামের কূটাভাস—- এই চারটি হল জেনোর সুবিখ্যাত কূটাভাস। প্রত্যেকটিই উপস্থাপনার গুণে বেশ আকর্ষণীয় আর হাজার হাজার বছর ধরে পন্ডিতদের বোকা বানিয়েছে। আমরা অনেকেই এগুলি সম্পর্কে কিছু না কিছু জানি। এখানে প্রথম দু’টি কূটাভাস উল্লেখ করা হল।
দৌড়বীরের কূটাভাসে জেনো একটি উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে কোন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য দৌড় শুরু করে কখনো তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা যদি অসীমত্বের ধারণাটি আমরা মেনে নিই। এই যুক্তি অনুযায়ী দৌড়বীর কেন, কোন ব্যক্তি বা কোন বস্তু কোন অবস্থাতেই কোন সময় তাদের গন্তব্যে যেতে পারবে না। ব্যাপারটা একেবারেই বাস্তবতা বিরোধী, অথচ যুক্তি না মেনে উপায় নেই। আমি বাড়ি থেকে বার হলাম বাজারে যাব বলে, যদি অসীম সংখ্যার অস্তিত্ব থাকে তো জেনোর যুক্তি অনুযায়ী কোনদিনই বাজারে পৌঁছতে পারব না। বাজারে পৌঁছনো তো পরের ব্যাপার, জেনো দেখিয়েছেন যে অসীম সংখ্যা আছে মেনে নিলে আমার পক্ষে যাত্রা শুরু করাই সম্ভব হবে না।
দেখা যেতে পারে জেনো কিভাবে এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছেন। মনে করা যাক দৌড়বীর ১০০ মিটার অতিক্রম করবে। প্রথমে তাকে এই দূরত্বের অর্ধেক বা ৫০ মিটার যেতে হবে। তারপর সে যাবে বাকি অংশের অর্ধেক বা ২৫ মিটার। সেটুকু যাওয়ার পর দৌড়বীরকে যেতে হবে বাকি অংশের অর্ধাংশ বা ২৫ মিটারের অর্ধেক অংশ এবং এভাবে দৌড়বীরের সামনে সমগ্র দূরত্বের কিছু না কিছু অংশ অতিক্রম করা বাকি থেকেই যাবে। অনন্তকাল ধরে দৌড়েও দৌড়বীর কিছুতেই ১০০ মিটার দূরত্ব পার হতে পারবে না, সে ক্রমশ কেবল তার গন্তব্যের নিকটবর্তী হতে থাকবে। এই অদ্ভুতরে ব্যাপারটা ঘটছে যেহেতু সসীম দূরত্বকে অসীম অংশে ভাগ করা যাচ্ছে। অসীম সংখ্যার অস্তিত্ব মেনে নিলে এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
জেনোর দ্বিতীয় কূটাভাস হচ্ছে অ্যাকিলেস আর কচ্ছপের দৌড়ের সমস্যা। কচ্ছপ খুব আস্তে দৌড়য়, আর অ্যাকিলেস ছোটে দুরন্ত বেগে। তাদের দু’জনকে একটা দৌড় প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দেওয়া হল। অ্যাকিলেস যেহেতু কচ্ছপের চেয়ে জোরে ছোটে, অন্তত দশ গুণ জোরে তাই প্রতিযোগিতার শুরুতে কচ্ছপকে ১০০ মিটার আগে রাখা হল। আর এখানেই সমস্ত গন্ডগোল। দেখা যাবে, অনন্তকাল ধরে কচ্ছপের চেয়ে দশগুণ জোরে ছুটেও অ্যাকিলেস কোন জন্মে কচ্ছপকে ধরতে পারবে না। ব্যাপারটি বড়ই অবাস্তব। এমন যদি সত্যি হয় তো রাস্তায় কোন গাড়িকে কখনো পিছনে থেকে এসে সামনের গাড়িকে ডিঙিয়ে যেতে দেখা যাবে না। অথচ জেনোর যুক্তি মেনে নিলে অবাস্তব হলেও ব্যাপারটা সত্যি। কিভাবে ?
অ্যাকিলেস যখন ১০০ মিটার দৌড়ে কচ্ছপকে ধরতে যাবে কচ্ছপ ততক্ষণে ১০ মিটার এগিয়ে যাবে। এই ১০ মিটার যতক্ষণে দৌড়বে অ্যাকিলেস, কচ্ছপ সেইসময়ে আরো এক মিটার এগোবে, অ্যাকিলেস তারপর এক মিটার ব্যবধান অতিক্রম করতে থাকলে কচ্ছপ চলে যাবে এক-দশমাংশ আরো সামনে, অ্যাকিলেস যতক্ষণে এই এক-দশমাংশ দৌড়ে কচ্ছপকে ধরতে চাইবে কচ্ছপ ততক্ষণে আরও এক-শতাংশ এগিয়ে যাবে এবং এভাবেই চলতে থাকবে। দেখা যাবে, ইহজীবনে অ্যাকিলেস কখনো কচ্ছপকে ধরতে পারবেনা, কচ্ছপ সবসময়ই একটু হলেও অ্যাকিলেসের তুলনায় এগিয়ে যাবে। সসীম দূরত্বকে অসীম অংশে ভাগ করার জন্যই এই অবাস্তব ব্যাপারটা ঘটবে।
জেনোর কূটাভাসগুলির সমাধান খুঁজে পেতে পরবর্তী ২০টি শতাব্দী কেটে গিয়েছিল। কেন্দ্রাভিসারী অসীম শ্রেণীর সীমা সংক্রান্ত গণিতের বিশেষ ধারণাটির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সমস্যার উত্তর মিলেছে। গণিতজ্ঞরা এই ধারণার সাহায্যে প্রমাণ করে দেখাতে পেরেছেন যে একটি অসীম শ্রেণীতে সীমাহীন পদ থাকলেও সেসব পদের যোগফল সসীম হতে পারে। সীমাহীন সংখ্যা বিশিষ্ট কোন অসীম শ্রেণীর যোগফল যে নির্দিষ্ট সসীম সংখ্যা হওয়া সম্ভব এ ব্যাপারটা জেনো বা অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকরা জানতেন না। গণিতের এই সত্যি মেনে নিলে দেখা যাবে, কোন নির্দিষ্ট স্থান-কালকে সীমাহীন অংশে ভাগ করা সম্ভব, তাতে বাস্তবতা বিঘ্নিত হয় না। অ্যাকিলেস আর কচ্ছপের দৌড়ের ক্ষেত্রে যে অসীম শ্রেণীটি পাওয়া যায় তা গণিতের নবাবিষ্কৃত ধারণা অনুযায়ী সমাধান করলে দেখা যাবে যে একটি সসীম দূরত্বের হিসেব আসছে যা ১১১ মিটারের একটু বেশি। অ্যাকিলেস এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করলেই কচ্ছপকে ডিঙিয়ে যেতে পারবে। প্রথম কূটাভাসটির ক্ষেত্রে দূরত্বটুকু সসীম, সমস্যা হল সময় নিয়ে। দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে দৌড়বীরের সময় বেড়ে বেড়ে অসীম শ্রেণী তৈরি করছে। এখানেও অসীম পদবিশিষ্ট শ্রেণীটি এক নির্দিষ্ট সসীম সংখ্যাকে যোগফল হিসেবে দেখাবে আর এই নির্দিষ্ট সময়টুকু পেরোলেই দৌড়বীর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।
জেনোর কূটাভাসের সদুত্তর নাহয় মিলল, তা বলে অসীম সংখ্যা নিয়ে অংকশাস্ত্রের সব সমস্যা কিন্তু মিটে গেল না। অসীম সংখ্যা এখনো গণিতে এক বিরাট রহস্য, অধিকাংশ রহস্যের কোন জবাব কবে পাওয়া যাবে কেউ জানে না।
সমুদ্রের ঢেউ
সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে কবিতা হয় সবাই জানি। এখানে আবার বিজ্ঞানের কী ভূমিকা ? আসলে গভীরভাবে ভাবতে গেলে কবিতাও বিজ্ঞান মেনেই হয়। তাই সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যেও যে বিজ্ঞান থাকবে এ আর আশ্চর্য কী !
ভূপৃষ্ঠের ছত্রিশ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের দখলে, আনুপাতিক হিসেবে মোট আয়তনের তিন-চতুর্থাংশ স্থান। একেবারে সূচনায় পৃথিবীতে বিশাল এক জলাধার ছিল। মহাদেশীয় সরণ, অগ্নুৎপাত এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনা ওই বিশাল জলাধারকে বেশ কয়েকটি মহাসাগর ও সাগরে বিভক্ত করেছে। মহাসাগর মূলত পাঁচটি—- প্রশান্ত, অতলান্তিক, ভারত, উত্তর ও দক্ষিণ মহাসাগর। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু সমুদ্র যেমন বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, পারস্য উপসাগর, কাশপিয়ান সাগর ইত্যাদি। এসব সমুদ্র আসলে পাঁচটি মহা সমুদ্রেরই অংশবিশেষ।
সমুদ্রের বিপুল জলরাশি সব সময় গতিশীল। সমুদ্রজলের এই গতি কেবলমাত্র জলতলের ওপরাংশে যেমন দেখা যায় তেমনি ওপর থেকে তলদেশের গভীরেও চলমান। গতিশীল সমুদ্রের জল ঢেউ সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে. সমুদ্রে ঢেউ কিভাবে সৃষ্টি হয় বা ঢেউয়ের চরিত্র কী সেসবই এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু।
ঢেউ সৃষ্টিতে বাতাসের ভূমিকা প্রথমে বলতে হয়। গৌণভাবে হলেও বাতাস তৈরি হয় সূর্যের কারণে। ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণে চাপজনিত তারতম্য বাতাস তৈরি করে। পৃথিবীপৃষ্ঠে বড় ধরনের বায়ু প্রবাহগুলি হচ্ছে বাণিজ্য বায়ু, পশ্চিমাবায়ু ও মেরুদেশীয় বায়ুপ্রবাহ। সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় এইসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রতলের জলরাশিকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যায়। এভাবেই সৃষ্টি হয় ওপরতলের বিশাল স্রোতপ্রবাহ। বায়ুতাড়িত এই স্রোত জলতলের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের শক্তি ও স্থায়িত্বের ওপর এই স্রোতের গতি নির্ভরশীল। মহাদেশ ও দ্বীপসমূহের উপস্থিতিতে সমুদ্রস্রোত জটিলভাবে ঢেউয়ের আকৃতি নেয়। এছাড়া জলতলের ওপর বায়ুপ্রবাহ প্রত্যক্ষভাবেও ঢেউ সৃষ্টি করে। এসব ঢেউকে বড় ঢেউ এবং স্ফীত ঢেউ, এই দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ঢেউ সৃষ্টিকারী বায়ুক্ষেত্রের অভ্যন্তরে বড় ঢেউ দেখা যায় এবং এসব ঢেউ ওই বায়ুক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে শান্ত সমুদ্রে এলে তাদের বলে স্ফীত ঢেউ। এজন্যই বাতাস না থাকলেও সৈকতে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ঢেউ ভাঙছে দেখা যায়। এগুলি সবই স্ফীত ঢেউ, হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতলের বায়ুক্ষেত্র থেকে যাদের উৎপত্তি। বিশৃঙ্খল বড় ঢেউগুলি উৎপত্তিস্থল থেকে বেরিয়ে বায়ুহীন অঞ্চলে এসে সুশৃঙ্খল আকৃতি পায়। এই পরিবর্তন ঘটে বিচ্ছুরণ প্রক্রিয়ায় যেখানে দ্রুতগামী লম্বা ঢেউ ছোট ছোট ঢেউগুলিকে গ্রাস করে। অনেকটা সময় পর উৎসস্থলের অনেক দূরে এই প্রক্রিয়ায় সমান মাপের সুশৃঙ্খল ঢেউ তৈরি হয়। ঢেউ সৃষ্টির সূচনাপর্ব সম্পর্কে এখনও ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সমুদ্রের জলতলের ওপর চাপজনিত ওঠানামার ফলে বাতাস তার এলোমেলো ও ডোরাকাটা উপস্থিতি জানায় প্রথমে। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝঞ্ঝা জলতলে এলোমেলো ভাঁজ তৈরি করে। এসব ভাঁজের ওপর দিয়ে আবার বায়ুপ্রবাহ বয়ে গেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাঁজগুলি ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ঢেউ হিসেবে গড়ে ওঠে। ঢেউগুলি সমুদ্রতীরে পৌঁছলে সৈকতভূমির গঠন অনুযায়ী একসঙ্গে মিলিত হয় বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একসঙ্গে মিলিত ঢেউগুলি বিশাল ঢেউ তৈরি করে যা তীরভূমিতে ভাঙ্গনের কারণ। সমুদ্রের ঢেউগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে শক্তির বিপুল উৎস যা দূষণহীন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য। জাপান, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশে সমুদ্রের ঢেউ থেকে শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা বর্তমানে বাস্তবায়িত হতে পেরেছে।
জোয়ার-ভাঁটাও ঢেউ তৈরির কারণ। বারো বা চব্বিশ ঘন্টা পর পর তরঙ্গায়িত জলপ্রবাহ জোয়ার-ভাঁটা হিসেবে পরিচিত। জোয়ার-ভাঁটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় চোদ্দশ কিলোমিটার। চাঁদ বা সূর্যের আকর্ষণজনিত কারণে জোয়ার-ভাঁটা সৃষ্টি হয় যেখানে পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থানের জন্য চাঁদের প্রভাব তুলনায় বেশি। তার থেকে বহু দূরে গভীর সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা জনিত তরঙ্গ প্রায় নজরেই আসে না। কূলের কাছাকাছি অগভীর সমুদ্র এলাকাতেই জোয়ার-ভাঁটা জনিত তরঙ্গ দেখা যায়। জোয়ার-ভাঁটার তরঙ্গকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা আজ অনেকটাই সফল হতে চলেছে।
ঢেউ যে কেবল সমুদ্রের উপরতলেই সৃষ্টি হতে পারে এমন নয়। সমুদ্রের সমগ্র জলকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, একটি তলের নিচে অন্যটির অবস্থান। অন্তর্বর্তী জলতলের এসব ঢেউ খালি চোখে দেখা না গেলেও এরা বেশ বড় মাপের হতে পারে, কখনো কখনো উচ্চতায় পঞ্চাশ মিটারেরও বেশি হয়।
সুনামি থেকেও সমুদ্রের ঢেউ তৈরি হয়, আর এসব ঢেউ সবচেয়ে ভয়ংকর। সমুদ্রের তলদেশে ধস, ভূমিকম্প বা অগ্নুৎপাত সুনামি সৃষ্টি করে। তলদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আলোড়ন ওপরতলে বিশাল ঢেউয়ের আকারে দেখা দেয়। অবশ্য খোলা সমুদ্রে এসব ঢেউ প্রায় দেখাই যায় না, যত তীরের কাছাকাছি হতে থাকে তত ঢেউয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে পর্বত প্রমাণ হয়ে যায়।
এসব ছাড়াও আঞ্চলিক ঝড় সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে। বঙ্গোপসাগরে এমন ঝড় প্রত্যেক বছরই কিছু না কিছু খবর তৈরি করে।
রহস্যময় প্রতিবস্তু
সৌরমণ্ডলের সীমানা পার হল টিউলিয়াস। সঙ্গে সঙ্গেই সূচনা হলো মহাকাশ যাত্রার এক নতুন অধ্যায়। মানুষ অভিযাত্রী নিয়ে আর কোন মহাকাশযান আগে কখনো সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে এতদূর পাড়ি জমায়নি।
নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে অভিযাত্রী দলের নেতা রন্ কোল বিশাল পর্দায় মহাকাশযাত্রার মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করছিল। এমন সময় তার কাছে একটি বার্তা এল। প্রেরক বেতার বিশেষজ্ঞ-আরিগাতো: ‘সামনেই একটা অদ্ভুত উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে’।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টিউলিয়াসের নিয়ন্ত্রণকক্ষে সমবেত হল অভিযানের সমস্ত সদস্য। খুবই জরুরি আলোচনা। ‘অদ্ভুত উপস্থিতি’টি কোন গ্রহ নয়, উল্কা বা ধুমকেতুও নয়, নয় মহাকাশের কোন প্রাকৃতিক বস্তু। নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর বোঝা গেল ‘অদ্ভুত উপস্থিতি’টি আসলে একটি মহাকাশযান। এ এক অভাবনীয় আবিষ্কার। কারণ মানুষ ছাড়া অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এটি হলো জ্বলন্ত প্রমাণ।
টিউলিয়াস থেকে একটি ছোট ফেরিযান পাঠানো হলো ওই রহস্যযানের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরিযান অজানা মহাকাশযানের একেবারে কাছে চলে গেল। তারপর দুটি যানের স্পর্শ ঘটলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রবল বিস্ফোরণ। চোখ ধাঁধিয়ে গেল বীভৎস আলোকবন্যায়। দীর্ঘ সময় পর সব শান্ত হলে ফেরিযান বা অজানা মহাকাশযানের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। সব কোথায় হারিয়ে গেছে! আসলে অজানা মহাকাশযানটি ছিল প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি।
কল্পবিজ্ঞান কাহিনী লেখকদের কাছে প্রতিবস্তু এমনই এক জনপ্রিয় বিষয়। মনে করা হয়, এই মহাবিশ্বের কোথাও এমন অঞ্চল আছে যেখানে সমস্ত কিছুই প্রতিবস্তু দিয়ে গড়া। যদি পরিভ্রমণ কালে কখনো আমাদের গ্যালাক্সি ওই প্রতিবস্তু অঞ্চলে গিয়ে ঢোকে তো মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটবে আর সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।
এবার তাহলে দেখা যাক, প্রতিবস্তু ব্যাপারটা কী। প্রতিবস্তু বা অ্যান্টি ম্যাটার হল এমন এক পদার্থ যার প্রতিটি পরমাণু অ্যান্টি প্রোটন, অ্যান্টি নিউট্রন আর পজিট্রন দিয়ে তৈরি। স্বাভাবিক পদার্থের ক্ষেত্রে পরমাণুর মধ্যে থাকে তিন ধরনের কণা—- নিউট্রন, প্রোটন আর ইলেকট্রন। পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াস গঠিত হয় নিরপেক্ষ কণা নিউট্রন ও ধনাত্মক কণা প্রোটন দিয়ে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের প্রতিকণা হচ্ছে পজিট্রন। পজিট্রন হচ্ছে হুবহু ইলেকট্রনের মত, একমাত্র পার্থক্য হল এটি ধনাত্মক কণা। অনুরূপভাবে অ্যান্টি প্রোটন হল প্রোটনের প্রতিবস্তু কণা যা ঋণাত্মকধর্মী। নিউট্রনের প্রতিবস্তু কণার নাম অ্যান্টি নিউট্রন। দুটিই নিরপেক্ষ কণা এই অর্থে যে এদের মধ্যে বৈদ্যুতিক ধর্ম অনুপস্থিত। নিউট্রন আর অ্যান্টি নিউট্রনকে আলাদা করা যায় এদের স্পিন-এর ধর্ম দেখে।
প্রত্যেকটি মৌলিক কণারই রয়েছে প্রতিবস্তু কণা। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাই মেসন বা পাইওন, মিউ মেসন বা মিউয়ন, ফোটন, নিউট্রিনো ইত্যাদি। ফোটন এবং পাইওন কণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এরা নিজেই নিজের প্রতিবস্তু কণা।
প্রতিবস্তু কণার ব্যবহার সম্পর্কে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। শিল্প ও ওষুধ প্রস্তুতে পজিট্রনকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা আছে। ধাতব অঙ্গের অতি সূক্ষ্ম ফাটল এর সাহায্যে শনাক্ত করা যায়। মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ পরিচিতি নিখুঁতভাবে পেতেও প্রতিবস্তু কণা বেশ দরকারি। সম্প্রতি মেসন কণার সাহায্যে ক্যান্সার জাতীয় পিণ্ডকে ধ্বংস করার উপায় জানা গেছে। যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণেও এদের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
ওজোনস্তরে গর্ত
পরিবেশ ইদানীং আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা দিক থেকে .প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখার চিন্তাটা নতুন কিছু নয়। প্রাচীন যুগ থেকেই একদল মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদগুলির সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে এসেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবেশ ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অন্য কারণে। বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে মানুষ জানতে পেরেছে যে পৃথিবী ও প্রাণী জগতের প্রতিরক্ষা বলয়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। যদি এই প্রতিরক্ষা বলয় ভেঙে যায় তো পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব মুছে যাবে।
পৃথিবীর প্রতিরক্ষা বলয় টি কী ? কোথায় বা তার অবস্থান ? সামগ্রিকভাবে, পৃথিবীকে কম্বলের মত জড়িয়ে রাখা বায়ুমণ্ডল এই প্রতিরক্ষা বলয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের সমস্তটাই প্রাণী জগতের রক্ষাকবচ নয়। খুব নির্দিষ্ট অর্থে, বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে অবস্থিত ওজোন গ্যাসের আস্তরণ হচ্ছে প্রাণীজগতের আসল রক্ষক।
মজার কথা হল এই যে পাংশু নীল রংয়ের ওজোন গ্যাস কিন্তু বিষাক্ত। অল্প পরিমাণ ওজোন গ্যাস জীবনের জন্য ক্ষতিকর। বৈদ্যুতিক ডিসচার্জ থেকে ওজোন পাওয়া যায় আর এর বিশ্রী গন্ধ রয়েছে। ভূস্তরের কাছাকাছি ওজোন গ্যাস কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে জন্ম নিতে পারে। রাসায়নিক শিল্পে এবং জল জীবাণুমুক্ত করতে ওজোনের ব্যবহার থাকলেও এই গ্যাসের সংশ্রব মানুষের জন্য একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে থাকলে ওজোন জীবনরক্ষার অপরিহার্য উপাদান। যে সূর্যকিরণ ছাড়া পৃথিবী অচল, তাতে রয়েছে ভয়ংকর অতিবেগুনি রশ্মি। এই রশ্মির সংস্পর্শে জীবনের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটতে পেরেছে যেহেতু সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায় না। বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে থাকা ওজোন গ্যাসের আস্তরণ সূর্যকিরণ থেকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। পৃথিবীতে প্রাণী জগতের প্রতিরক্ষা বলয় হিসেবে ওজোন গ্যাসের স্তর এভাবেই কাজ করে যার অভাবে এখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব দেখা যেত না।
ওজোন গ্যাস কী ? ওজোন আসলে অক্সিজেনের এক বিশেষ রূপ। অক্সিজেনের একটি অণু গঠিত হয় দুটি পরমাণুর সমন্বয়ে, সেখানে ওজোনের একটি অণুতে থাকে তিনটি পরমাণু। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য এই একটি মাত্র পরমাণুর।
ওজোন স্তরের অবক্ষয়ের জন্য মূলত ক্লোরিনঘটিত রাসায়নিক ক্লোরোফ্লুরোকার্বনকে দায়ী করা হয়। সভ্য মানুষের শিল্পভিত্তিক কিছু উৎপাদন এই রাসায়নিকের জন্ম দেয়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন মন্ডলের যে ফাটল দেখা দিয়েছে সেটা প্রথম জানা গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৮২ সালে। ১৯৫৬ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা প্রত্যেক বছর বসন্তকালে উর্ধাকাশের ওজোন গ্যাসের পরিমাণ মাপা শুরু করেছিলেন। আন্টার্কটিকার হ্যালি বে নামে এক অঞ্চলকে এজন্য বাছাই করা হয়েছিল। পরিমাণ মাপা হত যে যন্ত্রে তার নাম স্পেকট্রোফটোমিটার। প্রায় ২৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ওজোন মাপার কাজটি রুটিন হিসেবে করে আসছিলেন। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা কাজটি করতে গিয়ে এক আজব ব্যাপার লক্ষ্ করলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে আন্টার্কটিকার মাথার ওপরে অবস্থিত ওজোন স্তরে একটা বড়সড় গর্ত। এই গর্ত আসলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অনেকটা জায়গা জুড়ে ওজোনের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে পাতলা হয়ে যাওয়া। প্রথমেই বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, ব্যাপারটা বোধহয় কোন যান্ত্রিক ত্রুটির ফল, কারণ যে স্পেকট্রোফটোমিটার যন্ত্র নিয়ে তাঁরা কাজ করছিলেন তা বেশ পুরনো। ইংল্যান্ড থেকে নতুন যন্ত্র এনে ব্যাপারটা ভালোভাবে পরীক্ষা না করে বিজ্ঞানীরা সবকিছু চেপে গেলেন। কিন্তু পরবর্তী দু’বছর নতুন যন্ত্রে টানা পরীক্ষা করে তাঁরা স্পষ্ট প্রমাণ পেলেন যে সত্যি প্রত্যেক বসন্তে আন্টার্কটিকায় ওজোন স্তরে গর্ত দেখা যায়।
আবিষ্কারটা প্রকাশ পাওয়ার পর চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে গর্তটা সম্পর্কে নিঃসন্দেহে হতে পারল। নাসার পরীক্ষা থেকে গর্তটার আয়তন জানা গেল। বিশালত্বে এটি মার্কিন মুলকের সমান, আর গভীরতায় মাউন্ট এভারেস্টের মতো দীর্ঘ।।
পরের কয়েক বছরে জোরদার পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জানা গেল যে প্রত্যেক বসন্তে আন্টার্কটিকায় ওজোন স্তরে এই গর্ত আসলে ক্লোরিন ঘটিত। আরও স্পষ্টভাবে, ক্লোরিন মনোক্সাইড জাত। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ভেঙেই এই ক্লোরিন বাতাসে মেশে। মজার কথা হল এটাই যে ক্লোরিনের এই ক্ষতিকর যৌগ আন্টার্কটিকা অঞ্চলে উৎপন্ন হয় না, কারণ সেখানে কল-কারখানা একেবারেই নেই। তবুও পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে এই যৌগ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে গিয়ে আটকে থাকে এবং মেরু অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে গিয়ে শীতের পর বসন্তের সৌরকিরণে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
হিসেব করে দেখা গেছে যে ওজোন স্তরের ঘনত্ব প্রতিবছরই একটা নির্দিষ্ট হারে কমে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত থাকে তো অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলেই ওজোন মণ্ডল হালকা হয়ে যাবে এবং সূর্যের ভয়ানক অতিবেগুনি রশ্মি বিনা বাধায় সরাসরি ভূপৃষ্ঠে নেমে আসবে। পৃথিবীর বুক শ্মশান হয়ে যেতে তখন আর বেশি সময় লাগবে না।
নতুন মানুষ
ভ্যান ডেম অভিনীত সাইবর্গ সিনেমার কথা মনে পড়ে ? সাইবর্গ আসলে মানুষের এক নতুন প্রজন্ম যাদের শরীরে নানা রকম কলকব্জা জুড়ে মানব দেহের অনেক দুর্বলতা দূর করা হয়েছে। শোয়ার্জেনেগার অভিনীত টার্মিনেটর সিরিজের ছবিগুলিতেও এমন সব সাইবর্গদের দেখা যায়। টারমিনেটরের সাইবর্গরা আবার চেহারা পাল্টে অন্যরূপও ধরতে পারে। আমাদের পুরাণের কাহিনীগুলিতে দেবতা ও রাক্ষসদের দেখা যেত এমন অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। যখন-তখন যেকোনো রূপ ধারণ করতে সক্ষম।
বাস্তবে জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে কল্পবিজ্ঞানের বা পুরাণের এইসব বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বা দেবতাদের আদলে গড়ে তোলার একটা চেষ্টা চলছে। মানুষের শরীর খুব একটা শক্তপোক্ত নয়। যেকোনো ছোটখাটো দুর্ঘটনাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর অসুখ-বিসুখে কাবু হয়ে পড়ে। শরীরের মাংস চট করে ছেঁড়া সম্ভব, হাড়গুলো ভঙ্গুর। চামড়ার আচ্ছাদনটাও মোটেই মজবুত নয়, একটু আঘাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহভ্যন্তরস্থ প্রত্যঙ্গগুলিও অল্প আঘাতেই নষ্ট হতে পারে আর তেমন হলে মারাত্মক। যদি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেরামত বা পুনরুৎপাদন করা যায় তো সমস্যাটা মিটতে পারে। জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন নতুন মানুষ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে যারা এসব বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবে। তার মেরুদন্ড আর শরীরের হাড়গুলো তৈরি হবে বিশেষ কোনো শক্ত পদার্থ দিয়ে। শরীর নাহয় পুনরুৎপাদন করা গেল, মনটা কিভাবে তৈরি হবে ? অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক কয়েক মিনিটের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এর উত্তর হিসেবে ছোট দুটো ফুসফুস আর হৃদপিণ্ড শিরা ও ধমনী তন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে গলার কাছে আটকে দেওয়া হবে, প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য।
মানুষের পরিপাক ব্যবস্থাও বিশেষ সবল নয়। অনেক জৈব খাদ্য কণাকে প্রয়োজনীয় এনজাইমের অভাবে আমরা হজম করতে পারি না। পেটে কিছু নতুন গ্রন্থি জুড়ে বিশেষ বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার চাষ করে এসব এনজাইম পাওয়া যেতে পারে। খাদ্যদ্রব্য সহজে হজম করতে পারলে বর্জ্য পদার্থ জমিয়ে রাখার অতবড় বৃহদান্ত্রের দরকার নেই। সাত মিটার লম্বা বৃহদান্ত্রকে কমিয়ে এক মিটার করলেই যথেষ্ট। পরিবর্তে পেটে প্রচুর চর্বি জমিয়ে রাখা যায়, খাবার না পাওয়া গেলে যাকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে বেশ কিছুদিন না খেয়েও থাকা সম্ভব।
মানুষের ইন্দ্রিয়গুলিকে আরো কর্মক্ষম করা যেতে পারে। মাছির মতো পুঞ্জাক্ষি জুরে দেওয়া গেলে দিনের মতো রাতেও মানুষ দেখতে পাবে। জীবন্ত আলোকোজ্জ্বল ব্যাকটেরিয়ার বসতি চোখের মধ্যে গড়ে তুললে নতুন মানুষ জলের তলায়ও দেখতে পারবে। বাদুড় আর সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মতো কানকে দেখার কাজে লাগানো যায়। উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পায় না, এটা শোনার জন্য কানে একটা অতিরিক্ত গ্রাহক যন্ত্র লাগানো যেতে পারে। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় নতুন মানুষকে দেওয়া যায় যাকে বলা হবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। এর সাহায্যে মানুষ অন্যের মনের কথা পড়তে পারবে, অনাগত অনেক বিষয় বুঝতে সক্ষম হবে।
নতুন মানুষ জলেও তার বসতি স্থাপন করতে পারে। তিমি, ডলফিন, সিল মাছেদের মত স্তন্যপায়ীরা যদি জলে থাকতে পারে মানুষ কেন পারবে না ? মুশকিল হল জলের চাপে রক্তে মিশে থাকা গ্যাসগুলি শিরায়, স্নায়ুতন্ত্রে আর হৃদপিন্ডে বুদবুদ তৈরি করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই সমস্যার সমাধান আগে দরকার। জলে থাকা স্তন্যপায়ীদের দৃষ্টান্ত এখানে গ্রহণ করা যায় আর দরকার উভচরদের মতো ফুসফুসের সঙ্গে একটি ফুলকা যা দিয়ে জলেও মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারবে। মানবভ্রূণে ফুলকার মতো একটি অকেজো প্রত্যঙ্গ দেখাও যায় যাকে জিন বিদ্যার সাহায্যে কর্মক্ষম করে নিলেই চলবে। এই মূল সমস্যা দুটির সমাধান খুঁজে পেলেই স্থলচরদের পাশাপাশি জলচর মানুষরাও এক সমান্তরাল সভ্যতা গড়ে তুলতে পারবে। সমুদ্রের তলায় থাকার জায়গা আর খাদ্যের কোন অভাবই থাকবে না।
নতুন মানুষ তারপর যাবে মহাকাশে। পৃথিবীর অনুরূপ একটি বায়ুমণ্ডল আর পরিবেশ ক্যাপসুলে ভরে নিয়ে গেলেও নিয়ে যেতে পারবে না পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। অন্য গ্রহ বা উপগ্রহে গেলে সেই অঞ্চলের মাধ্যাকর্ষণ সহ্য করার মতো শারীরিক অবস্থা তৈরি করতে হবে। চামড়া হবে আরও শক্ত আর মোটা। চোখগুলো ঢাকতে হবে বিশেষ লেন্স দিয়ে। মাধ্যাকর্ষণ কম হলে শরীরের ভার বহনে পায়ের দরকার নেই। পাগুলিকে নতুন দু’ জোড়া হাত বানানো যেতে পারে। দুটো অতিরিক্ত ফুসফুস দরকার। একটাতে থাকবে সঞ্চিত অক্সিজেন, অন্যটাতে বর্জ্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড রাখা যাবে।
এভাবেই ভবিষ্যতের নতুন মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলবে কোন একদিন।
সূর্যের আত্মকথা
আমি সূর্য, নৈশ আকাশের সুবিশাল প্রেক্ষাপটে বুটিদার কৃষ্ণবর্ণ যে আচ্ছাদন আমিও তার একটি বিন্দু ,আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সির একধারে স্বপরিবারে আমার অবস্থান। পরিবারের সদস্যবৃন্দকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিগত কোটি কোটি বছর ধরে প্রভূত শক্তি উৎপাদন করে চলেছি .এটা সম্ভব হয়েছে কারণ, আমার ভান্ডারে রয়েছে অফুরন্ত শক্তি উৎপাদনের রসদ। অফুরন্ত কথাটা বলার জন্য বলা, আমি অমর নই, একদিন না একদিন আমারও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
লক্ষ-কোটি তারকার মেলায় আমার মর্যাদা কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আকারে বা তুলনামূলক বিচারে আমি বেশ সাধারণ একটি তারা। এমন তারাও রয়েছে আকাশে যাদের সামনে দাঁড়ালে আমাকে খুব নগণ্য মনে হবে।
আমার মৃত্যুর কথা প্রথমেই উল্লেখ করে ফেললাম। সে তো অনেক পরের ব্যাপার। শুরুতে বলা উচিত ছিল কিভাবে আমার জন্ম হয়েছে। যে কোন তারকারই জন্মকাহিনী প্রায় একই রকম, সে আমার মত কেউ হোক বা আরও বড় কেউ। মহাশূন্যে স্থানে স্থানে সুবিশাল গ্যাস আর ধূলিকণার মেঘ ঘুরে বেড়ায় নীহারিকা নামে। এমনই অঞ্চল তারকাদের সূতিকাগার। এই মেঘের কোন স্থানে হয়তো গ্যাস আর ধুলো বিশেষ কোনো কারণে বা অকারণে চারপাশের তুলনায় ঘন হতে লাগলো। এটাই তারকার জন্ম লগ্নের সূচনা। ওই ঘনবস্তুপুঞ্জকে ভ্রূণ তারা বা প্রাক-তারকা বলা যেতে পারে। ঘনত্ব যদি যথেষ্ট বেড়ে যায় তো গ্যাস আর ধুলো মাধ্যাকর্ষণের টানে সংকুচিত হতে থাকে। এই সংকোচন শক্তি নির্গত করে যাতে গ্যাস আর ধুলো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আর তখন প্রাক-তারকা লক্ষণীয়ভাবে বিকিরণ ছড়ায়। প্রাক-তারকায় সংকোচন এভাবে চলতেই থাকে আর তার কেন্দ্রমন্ডল বা কোর অঞ্চল উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হয়ে ওঠে। একসময় তাপমাত্রা এমন স্তরে পৌঁছে যায় যা পারমাণবিক সংযোজন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পক্ষে অনুকূল। এই আদর্শ তাপমাত্রার মান এক কোটি কেলভিন। পারমাণবিক সংযোজন প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়া মানেই প্রাক-তারকাটির হৃৎপিণ্ড চালু হল। কী ঘটে এই প্রক্রিয়াতে ? চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস ওই অকল্পনীয় উষ্ণতায় একসঙ্গে মিশে গিয়ে জন্ম দেয় একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভর হারিয়ে যায় কারণ, চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মিলিত ভরের তুলনায় একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর কিছুটা কম। এই হারানো ভর বা মাস কতটা ? চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মিলিত ভরের মাত্র হাজার ভাগের সাত অংশ। এই অতি তুচ্ছ পরিমাণ ভর হারিয়ে যাওয়া কি কোন ঘটনা নাকি ? অবশ্যই ঘটনা, কারণ এখানেই লুকিয়ে আছে অমিত শক্তির আশ্চর্য ভান্ডার যা সীমাহীন মহাবিশ্বকে সচল রাখে। আমার সংসারের প্রাণময় গ্রহ পৃথিবীতে এক জীবকণিকার মেধা এই রহস্য উদঘাটন করেছে মাত্র মুহূর্তের খণ্ডাংশ সময় আগে। নামটি মনে আছে আমার, আইনস্টাইন। রহস্যের মূলকথা হল, একবিন্দু ভর হারিয়ে গেলে জন্ম দেয় প্রবল শক্তির। কতটা শক্তি ? আইনস্টাইনের দেখানো সূত্র বলে, এই হারানো শক্তি পাওয়া যাবে ভরের পরিমাণকে আলোর গতিবেগের দ্বিগুণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে। আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। যদি মনে করি, মাত্র ১ একক ভর হারিয়ে গেল তো তার জন্য কতটা শক্তি জন্ম নেবে ? উত্তর হল, ১০ সংখ্যাটিকে ১৬ বার গুণ করে যা পাওয়া যাবে সেই সংখ্যা অর্থাৎ ১০০ কোটি কোটি বা দশ-এর পর ১৬টা শূন্য বসিয়ে যে সংখ্যা পাওয়া যাবে তা। কল্পনা করলে নিশ্চয়ই থৈ পাওয়া যাচ্ছে না সংযোজন প্রক্রিয়া কী অকল্পনীয় শক্তি উৎপাদন করে ?
সংযোজনের এই শক্তি বিকিরণ চাপের সৃষ্টি করে যা অভিকর্ষজনিত কেন্দ্রাভিমুখী টানের বিপরীত। ভ্রূণ বা প্রাক-তারকা তারপরও সংকুচিত হতে থাকে যতক্ষণ না বিকিরণ আর মাধ্যাকর্ষণ চাপ দুটি পরস্পর সমান হয়ে যায়। এই দুটো চাপ সমান হয়ে গেলেই ভ্রূণটি তারায় পরিণত হয়। তারার মধ্যে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন বেড়ে গেলে অতিরিক্ত চাপের উদ্ভব ঘটে। তারাটি তখন বৃহত্তর আকৃতি পায়। অভ্যন্তরস্থ গ্যাস তাতে শীতল হয় আর শক্তি উৎপাদন কমে আসে। এটি তারাটির অবস্থান স্থিতিশীল থাকার একটি উপায়। এভাবেই তারকার অভ্যন্তরীণ সংযোজন প্রক্রিয়া একটি স্বয়ং-নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া যার কারণে তারা আলো দেয় আর নিজস্ব গঠন অক্ষুন্ন রাখে। তারকা জীবনের এটাই মূল পর্যায়, যৌবনকাল। আমি নিজেও এখন এমনই যুবক। আমার নাম মেইন সিক্যুয়েন্স স্টার। দীপ্তিতে আমার রক্ত ফোটার টগবগানি। কিন্তু এই যৌবন তো অনন্তকাল থাকবে না। আমার মত সাধারণ একটি তারার স্থিতিশীল এই যৌবন মোটামুটি দশ হাজার কোটি বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে কোর বা কেন্দ্রস্থলের সমস্ত হাইড্রোজেন রুপান্তরিত হয়ে যায় হিলিয়ামে। কিন্তু কোর অঞ্চলের চারপাশ ঘিরে যে খোল সেখানে তখনও হাইড্রোজেন মজুদ রয়েছে আর তাতে চলছে সংযোজন। তবে কোর এলাকার সংযোজন থেমে যাওয়ায় খোলে যতটুকু বিকিরণ চাপ তৈরি হয় তা কখনোই কোর বা বাইরের স্তরকে মাধ্যাকর্ষণ টানের বিরুদ্ধে ধরে রাখতে পারবে না। তখন কেন্দ্রাভূমুখী আকর্ষণে আমার কোর অঞ্চলে সংকোচন শুরু হবে। এই সংকোচন আবার শক্তি উৎপন্ন করলে কোর এলাকার জমা বস্তু উত্তপ্ত হতে থাকবে। কেন্দ্রস্থলের হাইড্রোজেন দহন বন্ধ হওয়ার অল্প সময় পরই কোর অঞ্চল আগের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তাতে খোলেরও উত্তাপ বেড়ে গিয়ে সেখানে হাইড্রোজেনের দহন-হার বেশি হবে। খোলে তখন শক্তি উৎপাদন বেড়ে যাবে। এই উৎপন্ন শক্তির একাংশ আমার শরীরের বাইরের অংশ ফুলিয়ে দেবে। নিট ফল হিসেবে বহিরাংশের তাপমাত্রা কমে যাবে। রামধনুর নিয়ম অনুযায়ী তাতে আমার গাত্রবর্ণ ক্রমশ লাল হতে থাকবে। তখন আমার শেষ সময়। বুকে হৃদ-স্পন্দন থেমে গেছে। তবুও বেঁচে আছি প্রাণটুকু শরীর থেকে বার না হয় যে কয়েক মুহূর্ত। শরীরের বাইরের স্তর ক্রমশ ভীষণভাবে ফুলে যাবে আর আমার রং হবে পুরোপুরি লাল। আমি মুমূর্ষু চোখ মেলে চেতন-অবচেতনের ঘোরে দেখব কাছাকাছি কোন গ্যাস ও ধুলোর মেঘে আবার কোন না কোন তারার ভ্রূণ বা প্রোটোস্টার তৈরি হচ্ছে। আমার চারপাশে দুরন্ত বেগে ছোটাছুটি চলবে যৌবনদীপ্ত শতসহস্র তারকার, তারা কেউ কেউ হয়তো আমার পরিণতি দেখে বিমর্ষ হবে আমাকে দেখিয়ে একে অন্যের কানে ফিসফিস করে বলবে, ‘ওই দেখো, একটা রক্ত দানব।’
কোন মানুষ কি তখন আমার এই রক্তিম গরিমা দেখে মুগ্ধ উচ্ছ্বাস জানাবে বা কবিতা বানাবে ? থাকবে কোন মানুষ তখন ? কারণ আমার আকার ফুলেফেঁপে এমন হয়ে যাবে যে আমি বুধ-শুক্রকে গ্রাস করে পৃথিবীকে ছুঁয়ে ফেলেছি। আমার গরম নিঃশ্বাসে পৃথিবী তখন একখণ্ড পোড়া কয়লা। সেই সময়েই আবার হঠাৎ বুকের ধুকপুকুনি শুরু হবে। আমার মৃত্যুর আগে শেষ জ্বলে ওঠা। কোন অঞ্চলে ক্রমাগত সংকোচন হতে হতে তা এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠবে যে আবার তাপ সংযোজন প্রক্রিয়া ঘটার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। কোর এলাকার তাপমাত্রা তখন 100 কোটি কেলভিন। এই অবিশ্বাস্য তাপে তিনটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস সংযোজিত হয়ে জন্ম দেবে একটি কার্বন নিউক্লিয়াসের। আবার প্রবল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে থাকবে। এতে কোর অঞ্চলে ঘটবে প্রসারণ আর খোলে ঘটবে সংকোচন। কিছু বছর এই প্রক্রিয়া চলবে যতদিন না কোর অঞ্চলের হিলিয়াম জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যায়।
এবার আমার প্রকৃত মৃত্যুর সময়। কেন্দ্রের সব হিলিয়াম পরিণত হয়ে গেছে কার্বনে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি শেষবারের মতো থেমে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে শক্তি উৎপাদন। কোর অঞ্চলে শুরু হবে আবার সংকোচন। আমার মত বা আমার চেয়ে কম ভরের তারাদের অন্তরে জ্বলে ওঠার আর শক্তি থাকবে না যাতে কোর অঞ্চলকে আবার যথেষ্ট উত্তপ্ত করে তুলতে পারবে পরবর্তী পর্যায়ে তাপ সংযোজন প্রক্রিয়ার জন্য যেখানে কার্বন পরিণত হবে আরও কোনো ভারী মৌলে। অভ্যন্তরস্থ মাধ্যাকর্ষণজনিত টানে আমি ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকব। মরণোন্মুখ সত্ত্বার মতো আমাকে পাংশু দেখাবে, আমার গাত্রবর্ণ হয়ে যাবে ফ্যাকাসে সাদা। আমি তখন একটি শ্বেত বামন। ওই যে বীণা নক্ষত্রমন্ডলে দেখা যাচ্ছে অঙ্গুরীয় নীহারিকাকে, সেও একটি শ্বেত বামন হতে চলেছে। তার গায়ের আংটি সেকেন্ডে ১৯ কিলোমিটার বেগে প্রসারিত হচ্ছে। তার এই মরণদশা শুরু হয়েছে ৬০০০ বছর আগে।
তারকার সংকোচন শুরু হলে ইলেকট্রনগুলি পরস্পরের কাছাকাছি আসে। আরও কাছাকাছি আসার বাধা তখন বাড়তে থাকে। খুব বেশি ঘনত্বে এই বাধা চাপ সৃষ্টি করে। এই ধরনের তারাকে বলে অধঃপতিত শ্বেত বামন। এক চামচ শ্বেত বামন তারার বস্তু নিলে তার ওজন হবে কয়েক টন। পৃথিবীর সমান আয়তনের একটি শ্বেত বামনে যে পরিমাণ বস্তুভর সংকুচিত হয়ে জমে থাকবে তা আমার মোট ভরের সমান। শ্বেত বামন তারকা জীবনের একটি স্থিতিশীল পর্যায় যার ভর আমার ভরের ১. ৪ অংশের কম হবে। এই পরিমাণ সৌরভরকে বলা হয় চন্দ্রশেখরের সীমা। শ্বেত বামন আসলে হবে আমার মৃতদেহ।
আমার মত বা আমার চেয়ে ছোট তারকার জীবন এরকমই। কিন্তু আমার চেয়ে আয়তনে আরও বড় তারার জীবনটা কেমন ?অতিকায় আয়তনের তারাদের কোর অঞ্চলের তাপমাত্রা হয় অনেক বেশি, আর তাই হাইড্রোজেনের দহন হয় খুবই দ্রুত। আমার কেন্দ্রস্থলের সমস্ত হাইড্রোজেন জলে নিঃশেষ হতে লাগবে দশ হাজার কোটি বছর, কিন্তু আমার চেয়ে ১৫ গুণ বড় যে তারা সে তার কেন্দ্রের সমস্ত হাইড্রোজেন জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলবে মাত্র এক কোটি বছরে। তাই আমার মত কম ভরসম্পন্ন নগণ্য তারাদের চেয়ে অতিকায় ভরসম্পন্ন তারাদের জীবনে মূল পর্যায় খুবই ক্ষণস্থায়ী। অতিকায় তারাদের কোর অঞ্চলের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নিজের অভিকর্ষজ টানে তারা ধসে যেতে থাকবে। কোর অঞ্চলের তাপমাত্রা তাতে ক্রমশ বাড়বে। কিছু উত্তাপ বাইরের স্তরে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। খোল বা বাইরের স্তরে হাইড্রোজেন দহন তাতে দ্রুততর হবে আর সেটা আয়তনে বাড়বে। মূল পর্যায়ের জীবন শেষ হলে অতিকায় তারা রক্তদানব তারার চেয়ে অনেক অনেক বেশি বড় আর উজ্জ্বল হবে। তাকে তাই বলা যায় রক্তিম মহাদানব। কোর অঞ্চলের উত্তাপ বেড়ে ১০০ কোটি কেলভিন হলে হিলিয়াম দহনের সূচনা ঘটবে। খুব কম সময়ে এদের কেন্দ্রস্থলে এমন ঘন ঘন পরিবর্তন চলতে থাকবে যে বুঝিয়ে বলা মুশকিল। রক্তিম মহাদানব অবস্থায় পৌঁছলে একসময় ওই অতিকায় তারায় ঘটবে বিস্ফোরণ। দেখা গেছে, কোর অঞ্চলে পরের পর তাপ সংযোজন প্রক্রিয়া যখন প্রভূত পরিমাণ লোহা উৎপন্ন করবে তখনই বিস্ফোরণ ঘটার সময়। এই বিস্ফোরণের অবস্থাকেই বলা হয় সুপারনোভা। মহাকাশের এ এক অতিকায় উৎসব। যে ক’টি দিন বা সপ্তাহ স্থায়ী হয় এই মহাবিস্ফোরণ, সুপারনোভা নির্গত আলোক বন্যায় সমগ্র গ্যালাক্সি ভেসে যায়। সুপারনোভা বিস্ফোরণ বিশালাকায় তারকার মৃত্যু ঘোষণা করে।
আমার সংসারে প্রাণ আছে কেবল পৃথিবীতে। সেখানে মানুষ যে আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলেছে তাতে তারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে কিছু সুপারনোভা বিস্ফোরণের ঘটনা। ১০৫৪ সালের জুলাই মাসে মহাকাশের সুদূর কোন অঞ্চলে এত বড় এক সুপারনোভা দেখা গিয়েছিল যে দিনেও তার উজ্জ্বল দর্শন পাওয়া যেত পৃথিবীর আকাশে। টরাস নক্ষত্রমন্ডলে দেখা যায় এক বিশেষ বস্তু যার নাম রাখা হয়েছে কর্কট নীহারিকা। এটি আসলে এক সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ। আমি যে গ্যালাক্সির হাজার কোটি তারার একজন, সেই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতে সুপারনোভা দেখা যায় ৩০ থেকে ৫০ বছর পর পর। সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষ কিন্তু নতুন ও ছোট তারাদের জন্মের সূতিকাকার। ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ।
কখনো কখনো বিশেষ অবস্থায় মৃত তারকার দেহ মহাকাশের আরেক মহা রহস্যময় বস্তুর জন্ম দিতে পারে। চলতি কথায় তাকে আমরা জানি কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল নামে। অবশ্য আমার মত বা আরও ছোট তারকাদের কৃষ্ণ গহ্বর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কোন্ তারা তাহলে কৃষ্ণ গহ্বর হতে পারে ? সে অন্য গল্প।