প্রীতন্বিতা

জিওথার্মাল এনার্জি

প্রকৃতি থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে ও তা কাজে লাগিয়ে মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলেছে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে যেটি না থাকলে সভ্যতা একেবারেই অচল হয়ে পড়বে তা হলো শক্তি। ভূপৃষ্ঠে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও শিল্পনির্ভর নগরায়ন শক্তির চাহিদা কেবলই বাড়িয়ে তুলছে, একই সঙ্গে শক্তি উৎপাদনে মানুষ এতকাল প্রকৃতির যেসব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত তার ভান্ডার বিপজ্জনকভাবে ফুরিয়ে আসছে। আবার এসব পুনর্নবীকরণ অযোগ্য প্রথাগত জ্বালানির সঙ্গে প্রকটভাবে জড়িয়ে আছে পরিবেশদূষণ জনিত সমস্যা। তবে পরিবেশদূষণের চেয়েও বেশি জরুরী হয়ে উঠছে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার সংকট। মানুষ তাই হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেছে বিকল্প। জ্বালানি শেষ হওয়ার আগে তা খুঁজে বার না করলে রক্ষে নেই। নানারকম বিকল্প শক্তি নিয়ে পরীক্ষা চলছে জোরকদমে। এসব অনুসন্ধানের সঙ্গে এ কথাও মাথায় থাকছে যাতে খুঁজে পাওয়া নতুন শক্তি থেকে পরিবেশদূষণ না ঘটে। গবেষণা চলছে সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি নিয়ে। এ ধরনেরই একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প শক্তি হল জিওথার্মাল এনার্জি। যদি এই শক্তিকে কাজে লাগাবার উপযুক্ত উপায় খুঁজে পাওয়া যায় তো সভ্যতা থেকে শক্তিসংকট দূর হবে, কারণ এই শক্তি পুনর্নবীকরণযোগ্য, একই সঙ্গে এই শক্তি ব্যবহারে পরিবেশ বিষাক্ত হবে না।

জিও থার্মাল এনার্জি কী ? বাংলায় বলা যেতে পারে, ভূতাপীয় শক্তি। পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঘনীভূত হয়ে আছে যে বস্তুভর তা প্রচন্ড উত্তপ্ত। এই ভয়ঙ্কর উত্তাপকে যদি ঠিক ঠিক ভাবে ব্যবহার করার পদ্ধতি জানা যায় তো এটি ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে সত্যি এক অফুরন্ত ভান্ডার। আসলে এই শক্তিকেই বলা হয় জিওথার্মাল এনার্জি, অর্থাৎ ভূগর্ভে আটকে থাকা তাপ শক্তি। এই শক্তির নানা রকম প্রকাশ দেখা যায় ভূপৃষ্ঠে। এগুলি হল উষ্ণ জলাধার, তপ্ত শিলা, উষ্ণপ্রস্রবণ, বাষ্প ঝলক ইত্যাদি। এদের দেখে বোঝা যায় ভূপৃষ্ঠের গভীরে কী বিপুল পরিমাণ উত্তাপ সঞ্চিত আছে। 

জিওথার্মাল এনার্জিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে শক্তির চাহিদা মেটাবার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নানা দেশে জোরকদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ছাড়াও ইউরোপের নানাদেশ এ ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে আছে। ভারতেও তার কাজ খুব একটা পিছিয়ে নেই। বর্তমানে অধিকাংশ শক্তি উৎপাদন প্ল্যান্টে ভূগর্ভস্থ জলকে উত্তপ্ত গলিত শিলার সংস্পর্শে বাষ্পে পরিণত করা হচ্ছে। জলাধারের জলকে এভাবে বাষ্পে পরিণত করে তা কুয়োর মধ্যে জমিয়ে তাকে পরে চালিত করে তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে পাওয়া যাচ্ছে বিদ্যুৎ।

জিওথার্মাল শক্তি কেন্দ্র কোথায় তৈরি হওয়া উচিত ?

কেবল যে ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত জলের জলাধারের কাছে এসব কেন্দ্র তৈরি হবে এমন নয়। শুষ্ক অথচ উত্তপ্ত অঞ্চলেও এসব শক্তিকেন্দ্র তৈরি হতে পারে। পৃথিবী নিজেই উত্তাপের এক বিপুল আধার। ভূগর্ভে যত গভীরে যাওয়া যায় তা ক্রমশ বাড়তে থাকে, গড়ে প্রতি ১০০ মিটার গভীরে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়ে। যদিও অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলিতে এই হিসেব আরও অনেক বেশি। এসব এলাকা ছাড়াও যেসব অঞ্চলে অভ্যন্তরস্থলের উত্তাপ ভুপৃষ্টের খুব কাছাকাছি সেসব জায়গাতেও জিওথার্মাল শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। 

সৌরশক্তি মত জিওথারমাল এনার্জিও পুনর্বিকরণশক্তি। এই শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্ত প্রক্রিয়াটি পরিবেশকে দূষিত করে না। সমুদ্র জলকে ভূগর্ভের মধ্যে দিয়ে চালনা করে অভ্যন্তরের উত্তাপের সাহায্যে উৎপন্ন বাষ্প দিয়ে টারবাইন ও জেনারেটর চালাবার সম্ভাবনা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। জিওথার্মাল শক্তির উৎস খুঁজে বার করার কাজে উপগ্রহ প্রযুক্তি খুবই কার্যকরী। উৎসস্থলের অনুসন্ধান ও খনন পদ্ধতি ক্রমশই উন্নততর হয়ে উঠছে। এসব পদ্ধতিগুলি অবশ্য প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন পদ্ধতির অনুরূপ। শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী শহর ও শিল্পাঞ্চলে জিওথার্মাল শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে বহন করা হয়। তবে মানব সভ্যতার সমগ্র চাহিদার তুলনায় এই শক্তির উৎপাদন এখন পর্যন্ত খুবই নগণ্য। বিপুল পরিমাণে ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদন করার উপযুক্ত প্রযুক্তি মানুষ এখনো করায়ত্ত করতে পারেনি। পেট্রোল বা কয়লার মতো এই শক্তি যথেষ্ট দূরে বহন করার অনেক অসুবিধে বর্তমান। রাতারাতি জনবহুল শহর বা শিল্প কেন্দ্রগুলিকে জিওথার্মাল তাপ উৎসের কাছাকাছি সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। জলাধার ও তাপ বা বাষ্পকূপগুলি প্রসঙ্গেও রয়েছে অনেক অসুবিধে। এসব কারণেই এই বিকল্প শক্তি পুরোমাত্রায় নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। এসব সমস্যা সত্ত্বেও আশা করা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে সভ্যতার চাকা সচল রাখতে এই শক্তি বড় ভূমিকা পালন করবে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *