প্রীতন্বিতা
হারানো অঙ্গের পুনরুৎপাদন
সেই আশ্চর্য পর্যটক গিয়ে হাজির হয়েছিল নিষিদ্ধ দেশে। ঘন-জঙ্গল আর ভয়ানক সব জন্তু-জানোয়ারের বসবাস সেখানে। খবর পাওয়া গেছে, সে দেশে নাকি মানুষও আছে কিন্তু তারা ভয়ানক হিংস্র। বাইরের পৃথিবীর কেউ গেলে আর রক্ষে নেই। পর্যটক নিষিদ্ধ দেশে পা দিয়েই হিংস্র মানুষগুলির খপ্পরে পড়ে গেল। তারা তাকে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে এক খোলা প্রান্তরে এনে একটা খুঁটির গায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে নাচানাচি করল খানিকটা সময়। তারপর হঠাৎই একটি জংলি ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পর্যটকের একটি পা কেটে ফেলল। অন্য লোকগুলি উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। পা কাটা যাওয়ায় পর্যটকের কষ্ট দেখে তাদের খুব আনন্দ। কিন্তু সত্যিই কি কষ্ট হল পর্যটকের ? তাকিয়ে দেখা গেল একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। পর্যটকের কাটা পা আবার গজিয়ে গেছে। জংলিদের চোখ ছানাবড়া। তারা এবার পর্যটকের একটি হাত কেটে ফেলল। আবার সেই অদ্ভুত ঘটনা। কাটা হাতটিও আবার গজিয়ে গেল পর্যটকের। তাই দেখে জংলিরা হাউমাউ চিৎকার করতে করতে যেদিকে পারে পালাতে লাগলো।

এটা অনায়াসে একটা কল্পবিজ্ঞান কাহিনী হতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা যে অবিশ্বাস্য এমন নয়। আমাদের ঘরের দেয়ালে যে টিকটিকি ঘুরে বেড়ায় তাদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে থাকে। কোন টিকটিকির লেজটা কেটে দিলে সেই লেজ আবার গজিয়ে যায়। স্যালাম্যান্ডার জাতীয় উভচর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এভাবে হারানো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনরুৎপাদন করার ঘটনা সুপরিচিত। এরা যে কেবল পা এবং চোখ হারালে আবার তৈরি করতে পারে এমন নয়, হৃদপিণ্ড, মেরুদন্ড এমনকি মস্তিষ্কের কিছু অংশও নষ্ট হলে আবার বানিয়ে ফেলতে পারে।
মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি সম্ভব কিনা এই নিয়ে একদল বিজ্ঞানী বেশ কিছুদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। দুর্ঘটনায় হারানো হাত-পা-চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষও যদি নিজেরাই তৈরি করে ফেলতে পারত তো কোন চিন্তাই থাকত না। বিজ্ঞানীদের দাবি, স্যালাম্যান্ডার জাতীয় প্রাণীরা কিভাবে এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনরুৎপাদনের কাজটি সম্পন্ন করে সেই রহস্য তাঁরা জেনে ফেলেছেন এবং অচিরেই মানুষের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনরুৎপাদনের অনুকূল পরিবেশটি রচনা করতে পারবেন।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুনরুৎপাদনের ব্যাপারটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। দেখা গেছে যে কোন প্রাণীর, এমনকি মানুষেরও ক্ষতস্থানে একটি দুর্বল অথচ বোধগম্য বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের অস্তিত্ব দেখা যায়। এই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের চারিত্রিক পরিবর্তনই পুনরুৎপাদনের কারণ হিসেবে কাজ করে থাকে। বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করার জন্য বিজ্ঞানীরা স্যালাম্যান্ডার ও ব্যাঙ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। দুটি প্রাণীরই একটি করে সামনের পা কাটা হয়। দিন তিনেক কোন পার্থক্য দেখা যায় না। দুটো উভচরই কর্তিত পায়ের সীমানায় শক্তিশালী ধনাত্মক তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে ও কাটা অংশ আরোগ্য লাভ করতে থাকে। কিন্তু চতুর্থ দিনে স্যালাম্যান্ডারটির তড়িৎপ্রবাহ হঠাৎ ধনাত্মক থেকে ঋণাত্মক হয়ে যায় ও চামড়ার নিচে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা দেয়। কাটা অঞ্চলের স্নায়ুগুলো সজীব হয়ে স্থানীয় কোষগুলির সঙ্গে এক বিশেষ মেলবন্ধনে যুক্ত হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই কুঁড়ির মত প্রত্যঙ্গটি গজাতে থাকে। তিন সপ্তাহের মধ্যে হারানো অঙ্গটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত হয়। নতুন গজানো পায়ের মধ্যে প্রত্যেকটি আঙুল অবিকৃত থেকে যায়। স্যালাম্যান্ডারের অনুকরণে ব্যাঙটির কাটা পায়ের অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে ধনাত্মক থেকে তড়িৎ প্রবাহকে ঋণাত্মক করে একই ফল পাওয়া গেছে। ব্যাঙের কাটা পা-ও আবার গজিয়েছে। একই পরীক্ষা অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে না হলেও একটি ইঁদুরের কাটা অঙ্গ আবার গজিয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা প্রয়োগ করে ইতিমধ্যে কিছু আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে। মারাত্মক রকম ভাঙ্গা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিকিৎসায় ডাক্তাররা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে কৃত্রিম তড়িৎক্ষেত্র তৈরি করেছেন। ভাঙ্গা হাড় জোড়া দিতে এসব পরীক্ষা যথেষ্ট কাজ দিয়েছে।
সম্প্রতি জানা গেছে যে জীবিত মানুষের মাথা ঘিরে থাকে একটি বিশেষ বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র যার তরঙ্গ প্রত্যক্ষভাবে মানসিক কার্যকলাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। দেবতাদের মাথা ঘিরে রাখা জ্যোতির্বলয়ের যেসব ছবি পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে দেখা যায় তা কি এমনই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে ইঙ্গিত ?