প্রীতন্বিতা

অশ্রুমোচী গাছ

ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশের অস্তিত্বের কথা প্রমাণ করেছিলেন। সেই রোমহর্ষক গল্প আমরা জানি। তাঁর দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় কলম্বাস আরেকটি আশ্চর্য বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন। ১৪৯৬ সালে কলম্বাস সদলবলে এসে হাজির হন হাইতি দ্বীপে। সেখানকার বাসিন্দাদের তিনি একটা অদ্ভুত বস্তু নিয়ে ফুটবল খেলতে দেখলেন। বর্তুলাকার বস্তুটি জলে ভেজে না আর মাটিতে ছুড়ে মারলে লাফিয়ে ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বস্তুটি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন উপত্যকার ব্রাজিলের জঙ্গলে গজানো এক বিশেষ গাছের নির্যাস জমিয়ে তৈরি। গাছটির স্থানীয় নাম হল অশ্রুমোচী গাছ। ইংরেজ রসায়নবিদ জোসেফ প্রিস্টলে ১৭৭৪ সালে এই বস্তুটিকে কাগজ থেকে পেন্সিলের দাগ মোছার কাজে ব্যবহার করেন আর এখান থেকেই এর নাম হয় রাবার—- যে পেন্সিলের দাগ রাব অফ করে বা মুছে দেয়। এই রাবারের ব্যবহার মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতাতে একাদশ শতাব্দী নাগাদও জানা ছিল। 

রাবার পাওয়া যায় রাবার গাছের কান্ড থেকে। অনেকটা দুধের মতো সাদা রস হিসেবে যাকে বলা হয় ল্যাটেক্স। অন্তত পাঁচশ প্রজাতির রাবার গাছ এই ল্যাটেক্স উৎপন্ন করে। এদের মধ্যে হিভিয়া ব্রাসিলিয়নসিস প্রজাতির গাছটি বাণিজ্যিকভাবে রাবার উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এই গাছের আদি বাসস্থান ব্রাজিলের আমাজন উপত্যকায়। ইদানিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই গাছ ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় রাবার এক প্রধান কৃষিজ পণ্য। 

রাবার গাছের কাণ্ডের গায়ে বা কোষের মধ্যে ল্যাটেক্সবাহী নালীতে সাদা দুধের মত তরল রাবার সঞ্চিত থাকে। ছালের গা কেটে দিলে পর নালীর গা-ও কেটে যায় আর তরল রাবার বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর অবশ্য এই প্রবাহ নিজে থেকেই থেমে যায়। প্রবাহ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাটেক্সনালীতে আবার খুব তাড়াতাড়ি রাবার তৈরি শুরু হয়। ল্যাটেক্স থাকে নালীর প্রোটোপ্লাজম আর জলীয় অংশে। এই জলীয় অংশে রাবারের উৎপাদন ছাড়াও থাকে প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, চিনি ইত্যাদি। দুধসাদা তরল রাবারের অতি ক্ষুদ্র উপাদানগুলি নানা আকৃতিতে ঘুরে বেড়ায়। রাবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলি খুব পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। প্রাকৃতিক রাবারের রাসায়নিক নাম হল পলি আইসোপিন। এ থেকে পাওয়া যায় গাটাপারচা নামের পদার্থ যা দিয়ে চুইংগাম তৈরি হয়। 

রাবার গাছে রাবারের উৎপাদন ও উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের কাছে দীর্ঘকাল ধরে প্রহেলিকা হয়ে থেকেছে। রাবার উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া হালে পরিষ্কার হলেও কেন রাবার গাছ রাবার তৈরি করে তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। দুগ্ধধবল ল্যাটেক্স রাবার গাছ খাদ্য হিসেবে সঞ্চয় করে না, রাবার গাছকে বাহ্যিক কোনো আক্রমণ বা কোন রোগ থেকে রক্ষা করার কাজেও ল্যাটেক্সর কোন ভূমিকা নেই। তাহলে রাবার গাছের রাবার তৈরি করার আসল উদ্দেশ্যটা কী ? এই রহস্যের সর্বজনগ্রাহ্য কোন উত্তর এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দু’টো বিষয় বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন। একটি হলো, রাবার গাছের খাদ্য সঞ্চয় হিসেবে রাবার তৈরি হতে পারে। কিন্তু রাবার গাছ প্রয়োজনে রাবারকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে এই ঘটনার কোন প্রমাণ বাস্তবে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় অনুমানটি হল, রাবার গাছ রাবারকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে উৎপাদন করতে পারে। যাই হোক না কেন, আমরা তৃতীয় একটি অনুমানও করতে পারি। রাবার গাছ কেবলমাত্র মানুষের সভ্যতার স্বার্থেই রাবার উৎপাদন করে। এতে রাবার গাছের নিজস্ব কোন স্বার্থই নেই। রাবার না থাকলে আর যাই হোক না কেন সভ্যতার চলন বোধহয় থেমেই যেত। চাকা তৈরি হতো কিভাবে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *