প্রীতন্বিতা
সৃষ্টিরহস্য ও হব্বিট গ্যালাক্সি
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও তার বৃদ্ধির প্রচলিত তত্ত্বটির নাম কোল্ড ডার্ক ম্যাটার থিওরি। এই তত্ত্ব গ্যালাক্সিগুলির উৎপত্তিরও ব্যাখ্যা দেয়। এটি গ্যালাক্সি সৃষ্টির সাম্প্রতিক তত্ত্ব। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী এই তত্ত্ব থেকে করা হয়েছে। তার একটি হল আমাদের ছায়াপথ বা মিল্কি ওয়ের মত বড় গ্যালাক্সিগুলি একঝাঁক খর্বাকার বামন গ্যালাক্সি পরিবেষ্টিত, যেগুলি সংখ্যায় কয়েকশো পর্যন্ত হতে পারে। এই বামন গ্যালাক্সিগুলি বড় গ্যালাক্সির অভিকর্ষের আওতাধীন থেকে তাকে উপগ্রহের মতো প্রদক্ষিণ করবে। কিন্তু এই তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটার নাম দিয়েছিলেন মিসিং স্যাটেলাইট প্রবলেম। এই সমস্যাটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন যে বামন উপগ্রহ গ্যালাক্সিগুলিতে তারকার সংখ্যা খুব কম থাকবে বা থাকবেই না। গ্যালাক্সিগুলির পুরোটা বা অনেকটা জুড়ে থাকবে ডার্ক ম্যাটার। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী মহাব্রহ্মাণ্ডের মোট ভর যা হওয়া উচিত সমস্ত গ্যালাক্সি, ধূলিকণার মেঘ ও অন্যান্য বস্তুপিণ্ড মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে আসল ভর তার তুলনায় অনেক কম। এই হিসেব গড়মিল করা বাকি ভর কোথায় গেল? বিজ্ঞানীরা তখনই রহস্যজনক ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের কথা ভাবলেন, যারা মহাব্রহ্মাণ্ডে থাকলেও মানুষের জানা কোন পদ্ধতি দিয়ে তাদের এখনোও পর্যন্ত দেখা সম্ভব হচ্ছে না। এই অদৃশ্য রহস্যজনক ডার্ক ম্যাটারই ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভর গরমিল হওয়ার জন্য দায়ী।

বেশ কিছু বছর আগে স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভে নামে এক সমীক্ষক দল ক্রমাগত মহাকাশ পর্যবেক্ষণের পর একটি চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন যা তারা সিয়াটেল শহরে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ২০৯ তম অধিবেশনে জানিয়েছিলেন। আমাদের লোকাল গ্যালাক্সি গ্রুপে তাঁরা অসম্ভব অনুজ্জ্বল ও খুবই ক্ষুদ্র আটটি গ্যালাক্সি খুঁজে পেয়েছিলেন যেগুলি বহুকাঙ্খিত সেইসব ডার্ক ম্যাটার দিয়ে গঠিত গ্যালাক্সি। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে বিষয়টির পুরো বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞানীরা আশা করেছিলেন যে এই আবিষ্কার ব্রহ্মাণ্ডের ভর সংক্রান্ত হিসেবে গড়মিল সমাধান করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের স্বস্তি দেবে এবং একই সঙ্গে বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করবে।
লোকাল গ্যালাক্সি গ্রুপ হচ্ছে চল্লিশটি গ্যালাক্সির এক সমন্বয়, যাদের মধ্যে আমাদের মিল্কি ওয়ে এবং প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দুটি সবচেয়ে বড়। বাকি গ্যালাক্সিগুলি তুলনামূলকভাবে খর্বাকার বলে এদের বলা হয় বামন গ্যালাক্সি, যারা বড় গ্যালাক্সিদুটির অভিকর্ষাধীন উপগ্রহবিশেষ। মিল্কি ওয়ের উপগ্রহ গ্যালাক্সি হিসেবে দুটি বামন গ্যালাক্সি হল লার্জ ও স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড। এরা বেশ সুপরিচিত। কিন্তু বামন গ্যালাক্সির উপগ্রহ তত্ত্ব কোল্ড ডার্ক ম্যাটার থিওরিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না একেবারেই, যে সম্ভাবনা ইদানিং সৃষ্টি হয়েছে অতিবামন গ্যালাক্সিগুলির আবিষ্কারের পর। লোকাল গ্যালাক্সি গ্রুপে খুঁজে পাওয়া এই আটটি অতিক্ষুদ্র গ্যালাক্সির মধ্যে সাতটি মিল্কি ওয়ের উপগ্রহ আর অষ্টমটি মনে করা হচ্ছে স্বাধীনভাবে মহাকাশে ঘুরছে। এই গ্যালাক্সিগুলি ঔজ্জ্বল্যে ও আয়তনে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সমস্ত গ্যালাক্সির চেয়ে কম। এদের ঔজ্জ্বল্য সূর্যের চেয়ে কয়েকশ বা সর্বোচ্চ কয়েক লক্ষ গুণ মাত্র বেশি। সমীক্ষক দলের এক সদস্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল জুকের বলেছেন, ‘এরা মনে হয় এর আগে গ্যালাক্সি হিসেবে চিহ্নিত যেকোনো বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি অনুজ্জ্বল। ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি বলে যাদের জানি এরা তাদের চেয়েও অনেক ছোট বলে আমাদের উচিত এদের হব্বিট গ্যালাক্সি নামে ডাকা।’
হব্বিট গ্যালাক্সিগুলির কম ঔজ্জ্বল্যের কারণ হিসেবে বলা যায় যে এদের মধ্যে যেসব তারকা রয়েছে তাদের বয়স অনেক বেশি। সাতটি গ্যালাক্সিতেই অধিকাংশ তারকা বয়সে খুবই প্রাচীন। এই সাতটি গ্যালাক্সির মধ্যে দুটি রয়েছে ক্যানিস ভেনাটিচি তারকাগুচ্ছের কাছে, একটি করে অবস্থান করছে বুটস্, লিও, কোমা বেরেনিসেস, উর্সা মেজর ও হারকিউলিসে।
অষ্টম গ্যালাক্সিটির অস্তিত্ব জানা গেছে খুবই সম্প্রতি এবং এর আচরণ বড়ই রহস্যমণ্ডিত। একে নাম দেওয়া হয়েছে লিও টি, পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ১৪ লক্ষ আলোকবর্ষ। এত দূরে থাকার জন্যই হয়তো মিল্কিওয়ের অভিকর্ষ এর ওপর কাজ করে না। দূরত্ব আবার সমস্ত হব্বিট গ্যালাক্সির মধ্যে এর ঔজ্জ্বল্য সবচেয়ে কম হওয়ার কারণ। জুকের বলেছেন, ‘মাত্রা অনুসারে আমাদের জানা সমস্ত তারকা নির্মাণকারী গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে এটি হচ্ছে ক্ষুদ্রতম ও মলিনতম।’ লিও টি অন্য কারণেও বাকি সব হব্বিট গ্যালাক্সিগুলির চেয়ে আলাদা। এখানে পুরনো তারার পাশাপাশি রয়েছে নতুন তারা। তারকা তৈরির মূল উপাদান নিউট্রাল হাইড্রোজেন গ্যাসও লিও টি-তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। এ থেকেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে লিও টি হচ্ছে নতুন তারকা জন্মের একটি সক্রিয় সূতিকাগার।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল যে পরিমাণ নিম্নতম ভর একত্রিত হওয়ার কারণে এবং সৃষ্টির পর সেই ভরের অনেকটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার রহস্যের সন্তোষজনক উত্তর হতে পারে এই হব্বিট গ্যালাক্সি। তবে এই আবিষ্কার মূল রহস্যের এক বিন্দু উত্তর মাত্র। সমীক্ষক দলের অন্য সদস্য উইন ইভান্স বলেছেন, ‘রাতের আকাশের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ স্লোয়ান ডিজিটাল স্কাই সার্ভে দেখতে পায়। সমস্তটা দেখতে পেলে আরও অনেক বামন গ্যালাক্সি খুঁজে পাওয়া যেত।’
যাই হোক না কেন, হব্বিট গ্যালাক্সিগুলি খুঁজে পাওয়ার পর মিল্কি ওয়েকে প্রদক্ষিণরত বামন উপগ্রহ গ্যালাক্সিগুলির প্রকৃত ও সম্ভাব্য সংখ্যার মধ্যে ব্যবধানটি দূর হওয়ার উপায় দেখা দিয়েছে। সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে হব্বিট গ্যালাক্সিগুলি বেশিরভাগটাই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি। হাওয়াইয়ের কেক 2 টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ক্যালটেকের জোশুয়া সাইমন ও হার্জবার্গ ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের মারলা গেহা হব্বিট গ্যালাক্সিগুলির ভর নির্ণয় করেছেন। অভ্যন্তরস্থ তারকাগুলির গতিবেগ নির্ভর করে গ্যালাক্সিগুলির প্রত্যেকটির ভর যা পাওয়া গেছে তা মিল্কি ওয়ের ভরের তুলনায় দশ হাজার গুণ কম, এ পর্যন্ত মাপা সবচেয়ে কম কোন গ্যালাক্সির ভর। আরোও দেখা গেছে যে হব্বিট গ্যালাক্সিগুলির মোট ভর তাদের অভ্যন্তরস্থ তারকাগুলির মোট ভরের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি। সাইমন জানিয়েছেন যে গ্যালাক্সিগুলির এই অতিরিক্ত ভরের কারণ নিশ্চয় অন্য কিছু অদেখা বস্তু। হতে পারে তা ডার্ক ম্যাটার। অনেক গ্যালাক্সি, এমনকি আমাদের মিল্কি ওয়েতেও স্বাভাবিক বস্তুগুলির পাশাপাশি রয়েছে অনেকটাই ডার্ক ম্যাটার। তবে হব্বিট গ্যালাক্সিগুলিতে ডার্ক ম্যাটার থাকার হারটা সর্বাধিক।
হব্বিট গ্যালাক্সিগুলি আবিষ্কার থেকে এখন পর্যন্ত মোট অনেক বামন গ্যালাক্সির হদিস পাওয়া গেছে যারা মিল্কি ওয়েকে কেন্দ্র করে ঘোরে। আশা করা যাচ্ছে যে এমন আরও বহু বামন গ্যালাক্সির খবর অচিরেই জানা যাবে। তখন মহাব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য অনেকটাই সমাধান হবে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন