সৌমিতা রায় চৌধুরী
পরাধীন ভারতবর্ষের যুবসমাজকে দেশপ্রেম, নাগরিকত্ববোধ এবং শরীর চর্চার ব্রতে দীক্ষিত করার জন্য ১৯৩২ সালে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯৩৫ সালে ‘বেঙ্গল ব্রতচারী সমিতি’ স্থাপিত হয়। বাংলার ব্রতচারী সমিতির উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে ‘বাংলার শক্তি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। কলকাতার ১২, লাউডন স্ট্রিটে ব্রতচারী সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর ব্রতচারী সমিতির মুখপত্র হিসেবে ‘ব্রতচারী বার্তা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সাউথ ইন্ডিয়া ব্রতচারী সোসাইটি’ এবং ‘সর্বভারতীয় ব্রতচারী সমাজ’।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে গুরুসদয় দত্ত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ওই বছরই কলকাতার উপকণ্ঠে জোকায় তাঁর নিজের ১০১ বিঘা জমিতে ব্রতচারী গ্রাম প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৪১ সালে গুরুসদয় দত্ত মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা ব্রতচারী গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রতচারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ব্রতচারীকে বিদ্যাশিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
পরাধীন ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য ব্রতচারী চর্চা শুরু হয়েছিল। বীরভূমের জেলা শাসক থাকাকালীন ব্রতচারীর জনক গুরুসদয় দত্ত প্রধানত শারীরিক কসরত এবং বিশেষ ধরনের নাচগানের মাধ্যমে ভারতীয় যুবসমাজকে সুশৃঙ্খল নিয়মানুবর্তিতার চলমান স্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একদিকে প্রচন্ড প্রতিবাদ এবং অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর মাঝখানে দেশের সাধারণ যুবসমাজকে আত্মমর্যাদায় দীক্ষিত করার এক প্রচেষ্টা ছিল এই ব্রতচারী আন্দোলন।
ব্রত লয়ে সাধব মোরা বাংলাদেশের কাজ
তরুণতার সজীব ধারা আনবো জীবন মাঝ
চাই আমাদের শক্ত দেহ, মুক্ত উদার মন
রীতিমতো পালবো মোরা মোদের প্রতিপণ।
ব্রতচারীকে আরও তিনটি পণ করতে হত।
আমি বাংলাকে ভালবাসি
আমি বাংলার সেবা করবো
আমি বাংলার ব্রতচারী হবো।
পঞ্চব্রত পালন করার ব্রত নিয়ে ব্রতচারী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন ব্রতচারীরা। সেই পঞ্চব্রত হল ‘জ্ঞান’, ‘শ্রম’, ‘সত্য’, ‘ঐক্য’ এবং ‘আনন্দ’। ‘জ্ঞান’ অর্থাৎ কোনো বিষয়ের প্রতি সঠিক ধারণা। ‘শ্রম’ অর্থাৎ শ্রমের প্রতি সম্মান। ‘সত্য’ অর্থাৎ সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়া। ‘ঐক্য’ অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা। ‘আনন্দ’ অর্থাৎ ব্রতচারীগণ আনন্দের সঙ্গে এই ব্রত এবং দায়িত্ব পালন করবেন।
পঞ্চব্রত ধারণকারী ব্রতচারীগণের সাধনা চারটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। ‘চরিত্র’, ‘কৃত্য’, ‘সঙ্ঘ’ ও ‘নৃত্য’। ‘চরিত্র’ অর্থাৎ সৎ, উদার, কঠোর এবং চরিত্রবান হতে হবে। ‘কৃত্য’ অর্থাৎ ব্রতচারীগণকে কিছু সামাজিক ক্রিয়াকর্ম পালন করতে হবে। ‘সঙ্ঘ’ অর্থাৎ ব্রতচারীরা নিজেদের সঙ্ঘকে মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলবে এবং সঙ্ঘের মধ্যে পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখবে। ‘নৃত্য’ অর্থাৎ আনন্দের সঙ্গে গীতিনৃত্যের মাধ্যমে ব্রতচারীর বৈশিষ্টকে প্রচার করবে।
শিশু বয়সে ব্রতচারীর ব্রতকে শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তাদের শেখানো হতো ব্রতচারীর এই গান —
ছুটব, খেলব, হাসবো,
সবাইকে ভালবাসবো,
গুরুজনকে মানবো,
লিখব পড়ব জানবো,
জীবে দয়া দানবো,
সত্য কথা বলবো,
সত্য পথে চলবো,
হাতে জিনিস গড়বো,
শক্ত শরীর করবো,
দলের হয়ে লড়বো,
গায়ে খেটে বাঁচবো,
আনন্দেতে নাচবো।।
শিশুরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বৃত্তের মাঝখানে এক একজন করে এসে এক একটি লাইন বলবে এবং বাকিরা সমস্বরে ওই লাইনটি আবৃত্তি করবে।
নিম্নলিখিত চারটি বিশেষ লাইন আবৃত্তি করে শিশুদের এই শপথও নিতে হতো —
আমরা মুকুল চাই ফুঁটে উঠতে,
আমি আমার সংঘকে ভালবাসব,
তার আদর্শ মেনে চলব
তার হয়ে লড়ব।
‘ব্রত’ শব্দের অর্থ প্রতিজ্ঞা এবং ‘চারী’ শব্দের অর্থ যে চলে। অর্থাৎ প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে ব্রতকে এগিয়ে নিয়ে চলাই হল ব্রতচারী।
ব্রতচারী হয়ে দেখো,
জীবনে কী মজা ভাই,
হয়নি ব্রতচারী যে সে,
আহা কী বেচারীটাই!
জমিদারের লাঠিয়ালদের লাঠি খেলার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ‘রায়বেঁশে’ নৃত্য এবং ‘রণপা’ নৃত্য ব্রতচারীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। যা প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি রণকৌশল।
বীরভূম জেলাতেই ‘রায়বেঁশে’ বা ‘রাইবেশে’ নৃত্যভঙ্গির উদ্ভব। এই নৃত্যশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য হল ডানপায়ে ঘুঙুর সহকারে নৃত্য। আর হাতে থাকত ধনুক, বর্শা অথবা তলোয়ার। হাতের কৌশলে অস্ত্র ব্যবহারের ভঙ্গি প্রদর্শন এর প্রধান আকর্ষণ। এই নাচে বাদ্যের তালে তালে একই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হয়। বাদ্য ও নৃত্যের এই সম্মীলিত গতি ও ছন্দে ‘রায়বেঁশে’ নাচের স্বাতন্ত্র্য ও সৌন্দর্য নিহিত থাকত। বলা হত, লেঠেলরা নাকি যুদ্ধের ক্লান্তি দূর করতে এই নৃত্য করত। ঘাগড়া পরে নৃত্য ছন্দে বাদ্যের তালে তালে দস্যু দমনে যেত এই ‘রায়বেঁশে’ দল। গুরুসদয় দত্ত এই লুপ্তপ্রায় নৃত্য ক্রীড়াকে পুনরুজ্জীবিত করেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও রায়বেঁশের প্রতি দূর্বল ছিলেন।
প্রাচীনকালে দ্রুত যাওয়ার জন্য রণপায়ের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। দুটি মজবুত বাঁশের ওপর সমকোণ আকারে একটি বাঁশের টুকরো লাগিয়ে পা রাখার জায়গা তৈরি করা হত। সেই জায়গায় পা রেখে দ্রুত গতিতে চলাফেরা করা যেত। তবে রণপা চলার কৌশলটিও যথেষ্ট কঠিন ছিল। উপযুক্ত অনুশীলনের মাধ্যমে রণপা ব্যবহার করতে হত। পরবর্তী সময়ে ব্রতচারীতে রণপাকে নৃত্যশৈলী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
চল কোদাল চালাই
হবে শরীর ঝালাই
খাব ক্ষীর আর মালাই
চল কোদাল চালাই……
শিশুকাল থেকে ব্রতচারীর এই ছড়া গানটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। শারীরিক কসরত এবং তার সঙ্গে উপযুক্ত আহার গ্রহণ হল এই ছড়াটির মূল বক্তব্য। এছাড়া এখানে শ্রমকেও যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বর্ধমান জেলায় ঘোড়া নাচের জনপ্রিয়তা দেখা যায়। ঘোড়া নাচ হল রাজা-রানির সাজে নকল ঘোড়ার পিঠে চড়ে নাচ। নয় দশ জনের একটি দল ঘোড়া নাচ করে। দু’জন রাজা ও দু’জন রানি থাকে। শিল্পীদের কোমরের সাথে বাঁধা থাকে নকল ঘোড়া। এই সাজে ঘোড়া ছোটানোর ঢঙে শিল্পীরা মঞ্চে প্রবেশ করেন।
বিভিন্ন বয়সের কিশোর কিশোরীদের পঞ্চব্রত, বারো পণ, যোল পণের পাশাপাশি শারীরিক কসরতের বিভিন্ন খেলা ও নৃত্য শেখানো হয় ব্রতচারীতে। এইসব খেলার মধ্যে বাদ্যের তালে দু’হাতে মশাল নিয়ে বিশেষ ধরনের খেলা প্রদর্শন করা হয়। জ্বলন্ত রিং-এর মধ্য দিয়ে শরীরকে একপাশ থেকে অপর পাশে ছুঁড়ে দেওয়াও হল ব্রতচারীর একটি বিশেষ শারীরিক কসরত। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কাঠি নাচ এবং পিরামিড গঠনও ব্রতচারীর এ