পাঠক মিত্র
পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কের বার্তা
মানুষের জীবন আজ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে । সেই সংকটের অন্যতম হল পরিবেশ সংকট । আমাদের পরিবেশ পৃথিবীর পরিবেশের যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা জীবনযাপন করছি তা বোঝার জন্য আমাদের অনুভূতিই বলে দেয় । অতি গরম, অতি বৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনা । যা পরিবেশের স্বাস্থ্য ভালো না থাকার জন্য তা আমরা এখন জানি । দূষণ শব্দটাও আজ অতি পরিচিত । এমনকি উষ্ণায়ণের কথাও সাধারণ মানুষের কাছে অজানা নয় । একেবারে নিরক্ষর মানুষও জানেন পরিবেশ আজ সংকটে । যদিও আমাদের সমাজের এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা পরিবেশের এই সংকটকে মানুষের পাপের ফল হিসেবে দেখেন । সেই পাপ হয়তো প্রকৃতির ওপর মানুষের লোভের ফল তা তাঁদের কাছে বিষয় না হলেও, মানুষের নৈতিক সংকটের ফল হিসেবে তাঁরা বিবেচনা করেন । প্রকৃতির ওপর মানুষ এমনভাবে কর্তৃত্ব করতে চেয়েছে যে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে । আসলে সেই কর্তৃত্বের ফলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে সে কথা প্রথমে ভাবতেই পারেনি । শিল্প সভ্যতা যখন মানব সভ্যতার ভোল বদলে দিতে যত উন্নত হয়েছে, তত প্রকৃতি প্রতিশোধের রূপে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে । আজকে মাটি, জল, বাতাস এমনকি মহাকাশও ওই সভ্যতার বিরুদ্ধে ক্রমশ চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে । যদিও প্রকৃতির এই চোঙরাঙানি মানুষ এখনও ধার ধারছে না । শুধু মানুষের এই ধার ধারার কথা বলা এখন সমীচীন নয় । কারণ রাষ্ট্র তার ক্ষমতাবলে প্রকৃতিকে ভেদ করে চলেছেই । পরিবেশ নিয়ে আইন আছে । সেই আইন রাষ্ট্র ও তার পোষিত প্রশাসন ও মানুষের আইন ভাঙার জন্য সেই আইন লাগু হয়েছে তা কিন্তু খালি চোখে সচরাচর দেখা যায় না । বরং পরিবেশ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে ক্ষমতাধর পরিবেশ ধ্বংসকারীরা । নাইজেরিয়ায় এমন আন্দোলনকারীদের ৯জনের ফাঁসি হয়েছে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে । এই ৯ জনের মধ্যে বিশিষ্টতম ছিলেন কবি ও নাট্যকার কেন সারো-ভিভা ।
শিল্প বিপ্লবের পরপরই বিশিষ্ট মানুষজন আশঙ্কা করে এসেছেন যে প্রকৃতির দানকে উচ্ছৃঙ্খলভাবে দখল করার বিরূপ প্রতিদান প্রকৃতি দেবে । তা আজ আমরা অনুভব করছি । আসলে উন্নয়নের চোখ-ধাঁধানো অগ্রগতি প্রকৃতির বুক চিরেই । প্রকৃতির বুক চিরে উন্নয়ন এগিয়ে গেলে তার বুকফাটা শব্দ সভ্যতাকে অসহ্য করে তুলবে । তুলছেও।
প্রকৃতির উপর নির্যাতনে পৃথিবীর সবুজ জীবনের সংকটময় পরিস্থিতির কথা এখন মানুষ ভাবছে এমন কিন্তু নয় । কিন্তু এই ভাবনার সূত্রপাতের সঠিক দিনপঞ্জিকা নিয়ে ভাবার অবকাশ আর নেই। বর্তমান প্রকৃতির বিরূপতা সে অবকাশ দেয় না । তবে শিল্পবিপ্লবের সুবাদে নগরায়ণের পথ যত প্রশস্ত হয়েছে তত গ্রাম হারিয়েছে তার গ্রামীণ কৌলিণ্য এবং মূল্যবোধ, গ্রামীণ অর্থনীতির শিরদাঁড়ার মানুষজন হারিয়েছে তাঁদের প্রজন্মকালীণ জীবিকা । শিল্পায়ণের লীলাভূমি ইংল্যান্ডে দেখা দিয়েছে নগরায়ণের স্ববিরোধিতা । উনিশ শতকের মাঝামাঝি বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী অ্যালান ম্যাকফার্লেন তা দেখিয়েছেন । ‘ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বে পয়লা নম্বরের নগরীকৃত দেশ, তবু সেখানে দেঁশগায়ের জন্য তৃষ্ণা আর গ্রামীণ মূল্যবোধের জন্য আকুতিও ছিল প্রখর । তার অদ্ভূত নগরবিমুখ পক্ষপাত লক্ষ্য করা গিয়েছিল পার্কের প্রাচুর্যে, ইতিউতি প্রকীর্ণ পুষ্পোদ্যানে, গ্রামাঞ্চলে ছুটি কাটানোর শিল্পোদ্যোগে, মধুলতিকা ঘেরা পর্ণশালায় অবসরজীবন কাটানোর স্বপ্নবিলাসে এবং রোমান্টিক ও প্রিরাফায়েলাইট আন্দোলনে ‘প্রকৃতি’ এবং গ্রামীণ মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ ।’
নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে কেবল ‘ফিরে চল মাটির টানে’ প্রকাশিত হয়নি । তা উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে সাহিত্য ঐতিহ্যে । যাঁর প্রকৃতি পর্যটনের দৃষ্টান্তে ঋদ্ধ হয়েছে ইংরেজি সাহিত্য। তিনি হলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সারা জীবনে ইংল্যান্ডে পদব্রজে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায় এক লাখ পঁচাত্তর হাজার মাইল । সেই ভ্রমণ তিনি করেছেন তাঁর কবিতায় ও। যা প্রমাণ করে প্রাকৃত বিশ্বের প্রতি তাঁর নিবিড় অনুরক্তি । সাহিত্য ঐতিহাসিক জোনাথন বেট জানিয়েছেন, ‘প্রকৃতির সাথে কিভাবে পর্যটন করতে হয় তিনি তা শিখিয়ে গেছেন তাঁর পাঠকদের । ভ্রমণের সময় ওয়ার্ডসওয়ার্থ দেখেছেন, প্রকৃতির উপর নগর ও কারখানার নারকীয় তান্ডব । ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের তাজা বাতাসে শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হয়েছে সবুজ ঘাসের উপর পা ফেলা । শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী পরিবর্তনের এই অন্ধকার দিক তিনি দেখেছিলেন । নগরজীবনের চালচলন, তার নৈর্ব্যক্তিকতা এবং বাকি মূল্যবোধের উপরে অর্থরোজগারকে শ্রেষ্ঠ বলে ভাবার প্রতি তিনি একেবারেই সহানুভূতিহীন ছিলেন । তাঁর কাব্য ও দর্শনের মধ্যে নিহিত ছিল প্রকৃতির সঙ্গে কৃষক এবং মেষপালকের সুসংবদ্ধ সমন্বয়ের জীবনচর্যার সুরের শিখা যাকে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে শিল্পায়ন আর বাজারি খামারব্যবস্থার কালো হাওয়া । ওয়ার্ডসওয়ার্থের পরিবেশবাদের পরম্পরায় এসেছেন জন ক্লেয়ার। একেবারে আলাদা ধাঁচে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন জন রাস্কিন । রাস্কিন দেখিয়েছেন, ‘আধুনিক শহরগুলো যেন এক-একটা রসায়নাগার, যেখানে পাতন প্রক্রিয়া চলে, বাতাসে মেশে বিষাক্ত বাষ্প আর কটু ঘ্রাণ ।..বাতাস কলুষিত, জলও তাই, কেননা ইংল্যান্ড পর্যবসিত হয়েছে এক সাধারণ নর্দমা…।..জল-বাতাসের দূষণ এবং ভূচিত্র ও মানবস্বাস্থ্যের উপর সেই দূষণের প্রভাব ।’ রাস্কিন শুধু লেখার মধ্য দিয়ে তিনি পরিবেশ সচেতনতার কাজে লিপ্ত ছিলেন না । যে পৃথিবী হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত তার বিশিষ্টতাকে আয়ত্ত করতে তৈরি করলেন প্রতিষ্ঠান । এমন প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁরই শিষ্য উইলিয়াম মরিস । তাঁর শিষ্য বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । কবি, নবি, স্থাপত্যবিদ এবং সমাজতন্ত্রী হিসেবে বহু শিল্প ও রাজনৈতিক আন্দোলন এবং পরিবেশ আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হয়ে গেলেন । তাঁর খেদের কথা উল্লেখ করলে দেখা যায় আজকের সময়ে পৃথিবীর সংকটের ভবিষ্যতবাণী । ‘নগরীর আগ্রাসী যেভাবে ন্যক্কারজনকভাবে গিলে ফেলছে অরণ্য, প্রান্তর আর ঝোপেঝাড়ে ভরা পোড়ো জমি, যেরকম আশাহীন আর অকরুণভাবে ধোঁয়ায় ভারী আকাশ আর কলুষিত নদী সম্পর্কে আমাদের সামান্য অভিযোগকেও মথিত করছে ব্যঙ্গবিদ্রুপ আর উপহাস ।’ মরিস ও তাঁর শিষ্য এডওয়ার্ড কার্পেন্টারের যৌথ সম্মিলনে পরিবেশ আন্দোলন আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে । সবার মনকে আন্দোলিত করতে পেরেছে তাঁদের ‘ফিরে চল মাটির টানে’ র ভাবনা।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রাস্কিন, মরিস এবং কার্পেন্টারের লেখনীর সুবাদে পরিবেশবাদী সোসাইটি গড়ে ওঠে । এই সোসাইটি অরণ্য ও জলাভূমি সংরক্ষিত করার তাগিদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সৌধ ও উদ্যান বাঁচাবার তাগিদে লন্ডন শহরের কিছু অংশ শিল্প ও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার কলুষিত প্রভাব থেকে রক্ষা পায় ।
মহাত্মা গান্ধীও এঁদের লেখনী তাঁর জীবনে নিয়ে এসেছিল তাৎক্ষণিক ও ফলিত রূপান্তর । রাস্কিনের ‘আনটু দিস লাস্ট’ বইটির জন্য রাস্কিনের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন তাঁর বই ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ । ভারতে শিল্পায়নকে বিকল্প ভাবাকে তিনি খারিজ করেছিলেন । তাঁর একটি কথা পরিষ্কার করে দেয় পরিবেশসহ পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থার নৈতিকতাকে । ”প্রত্যেকের চাহিদা মেটাবার মতো যথেষ্ট আছে দুনিয়ার, তবে কারো লোভ সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয় অবশ্যই।’ স্বাধীনতার আন্দোলনে তাঁর আত্মনিয়োগে তিনি পরিবেশবাদী হিসেবে পরিচিতি না হলেও তাঁর উক্ত পঙতির ব্যাখ্যা তিনি জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন।
পরিবেশবাদ ইতিহাসের সূচনার এই আলোকপাত করেছেন বিশিষ্ট সমাজত্ত্ববিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘পরিবেশবাদ একটি বৈশ্বিক ইতিহাস’ গ্রন্থে । বইটির আটটি অধ্যায়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পরিবেশ ভাবনার দুটি নির্দিষ্ট পর্ব লেখক চিহ্নিত করেছেন । প্রথম পর্বটি শুরু হয়েছে ১৮৬০-এর দশক থেকে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত । আর দ্বিতীয় পর্বটি শুরু করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যখন প্রথম বিশ্বের দেশগুলি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের পথ নিচ্ছে ।
কাব্য, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে পরিবেশের স্বাস্থ্য সচেতনতার ভাবনা দিয়ে প্রথম পর্বে পরিবেশের ক্ষয় ও বিকল্প ভাবনার তিনটি প্রধান ধারার উল্লেখ করেছেন লেখক- শিকড়ে ফেরার আন্দোলন, বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ এবং বনায়নের আন্দোলন । ইংল্যান্ডে ও জার্মানিতে শিল্পায়নের কুফল এবং জীবনযাত্রার যান্ত্রিকতা প্রকট হবার পর থেকেই শিকড়ে ফেরার প্রবণতা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । এই সময়ে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে পরিবেশের পুনরুদ্ধার একটা ভাবনা দানা বেঁধে ওঠে এবং বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয় ।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার সংরক্ষণের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাৎ করার কর্মসূচি নেয় । সেই সরকারের অধিকারে জল জঙ্গল জমিন থেকে ক্ষুদ্র কৃষিজীবী, মৎসজীবী ও বনবাসী মানুষের উৎখাত হয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই প্রক্রিয়া কিন্তু আজও চলছে । মানুষ প্রতিবাদ করেছে অরণ্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে । চিপকো আন্দোলন এ দেশে পরিবেশ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছে । পরবর্তী সময়ে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন আর একটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলন প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে । পশ্চিমে পরিবেশের আন্দোলনের পদক্ষেপ হিসেবে প্রাণীকুলের বিপন্ন প্রজাতি আর প্রাকৃতিক আবাসভূমিকে রক্ষা করার ইচ্ছে থেকে । কিন্তু ভারতে তা গড়ে উঠেছিল মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার গরজ থেকে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবেশ নিয়ে ভাবনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু, যখন দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের প্রয়োজনে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে । সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষও সেই পথে হেঁটেছে । সেই পথ দেশ উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও, পরিবেশের স্বাস্থ্য গুরত্ব পায়নি । তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লেখক বলছেন পরিবেশ সংক্রান্ত দ্বিতীয় ভাবনার সূচনা চিহ্নিত হয়েছে রাচেল কার্সনের ‘দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং’ এর প্রকাশ ও তার অভিঘাতের মধ্য দিয়ে । এই পর্বে পরিবেশ ও তার সংরক্ষণ নিয়ে পূর্বেকার বিশেষজ্ঞদের ভাবনায় পরিবেশ আন্দোলনে একদল সচেতন নাগরিক শ্রেণী এগিয়ে এলেন । এমনকি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে কোথাও এমন সচেতন নাগরিক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ আন্দোলনে । এমনই এক সংগঠন জার্মানির গ্রীন পার্টি পার্লামেন্টের শক্তি হয়ে উঠেছিল। গ্রীন সংসদীয় শক্তিও পরিবেশ শক্তি ধূর্ত ভোট রাজনৈতিক শক্তির বলয়ে অবস্থান করা ছাড়া সুদূরপ্রসারী কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে নি ।
যদিও প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা গ্রীন নিয়ে যতটা আবেগতাড়িত কথা বলেছেন, কাজ তার ছিটেফোঁটাও করতে পারেন নি । এমনকি সমাজতান্ত্রিক দুটি দেশ চীন ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ের কথা ভাবতেই পারেনি । ভারতবর্ষের বামেদের ক্ষেত্রেও পরিবেশবাদী দাবি উত্থাপিত হয়নি । লেখক বলছেন, অর্থনৈতিক উদারীকরণের দৌলতে পরিবেশ সংক্রান্ত রক্ষাব্যবস্থা নিয়মাবদ্ধভাবে নষ্ট করা হয়েছে ।
এ দেশে পরিবেশ ও অরণ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় ধ্বংসকারী উদ্যোগগুলিকে দেদার ছাড়পত্র দিয়েছে । পরিবেশ আন্দোলনের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের সংগে পরিবেশ রক্ষণের পরিচয় ঘটাতে । যাতে অরণ্য, জল এবং পরিবহণ সংক্রান্ত নানা নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগে পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি না হয়, অথচ অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় । এ কথা প্রশাসনিক সরকার তেমন করে মান্যতা দেয়নি । এ দেশের প্রথম সারির পত্রিকা ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ র এক রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক । রিপোর্ট বলছে, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্পোরেট ও ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে ‘পুরোপুরি কোমর বেঁধেছে’ । রাজ্যগুলির পরিস্থিতি আরোই খারাপ ।
পরিবেশের বিচারে ভারতের অবস্থা শোচনীয় । নদী মৃতপ্রায়, বাতাস কঠিনভাবে দূষিত, জলস্তর নিম্নগামী, অরণ্য ক্ষীয়মান, আবর্জনার স্তুপ আকাশচুম্বী । এমন পরিস্থিতির জন্য লেখক বলছেন, ‘ভোটমুখী রাজনীতির স্বল্পমেয়াদী অবস্থিতি, পরিসম্পদ আহরণকারী কলকারখানাগুলোর লোকনীতির ওপর জবর আধিপত্য এবং সংবাদ মাধ্যমের বেদরদ ঔদাসীন্য । এসবের কারণে পরিবেশসংক্রান্ত প্রশ্নগুলি আজ ভয়ঙ্করভাবে অবহেলিত ।
এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হলে লেখক জোর দিয়েছেন বিশ্ব সাম্যের ওপর যা প্রতিষ্ঠিত হবে সকল মানুষের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের ওপর । সার্বিক গণতন্ত্র ছাড়া পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র নিয়ে নতুন নতুন ভাবনার উন্মেষ ও রূপায়ণ সম্ভব নয় । সব ধরণের পরিবেশকে ঐক্যসূত্রে বাঁধতে চাই সংযম আর দূরদর্শিতা । তাই লেখক আশাবাদী যে একদিন বাস্তুতান্ত্রিক ঔদ্ধত্যের যুগ শেষ হবে । সেই দিন পন্ডিত ও সক্রিয় কর্মীদের এক নবীন প্রজন্ম সর্বাত্মক ভাবে এক মজবুত অর্থনীতি ও সমাজগঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন করে অবহিত হবেন’। তাঁর এই বই হয়তো তাঁদের কিছু পুষ্টি জোগাবে বা সান্ত্বনা দিতে পারে বলে তিনি আশা করেছেন ।
পরিবেশ নিয়ে প্রাথমিক ভাবনার সূচনা করেছিল কাব্য ও দর্শন যাঁর পথিকৃত ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে এ দেশে পরিবেশ সম্পর্কে গান্ধীজীর ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন লেখক । কিন্তু এ দেশে সাহিত্যে প্রথম পরিবেশ সম্পর্কে দুশ্চিন্তার কথা উঠে এসেছে কবিগুরুর কলমে । পৃথিবীর পরিবেশ সংকট নিয়ে কবির ভাবনার কথা অনুপস্থিত এই গ্রন্থে । এ দেশের পরিবেশবাদ আন্দোলন তাঁর ভাবনা একেবারে এড়িয়ে যেতে পারে না ।
তবুও তাঁর ‘পরিবেশবাদ একটি বৈশ্বিক ইতিহাস’ বইটি সারা বিশ্বে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদাহরণ ও দৃষ্টান্তে সমৃদ্ধ পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাস যা বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে বার্তা দিতে পারে । অবশ্যই পরিবেশ সম্পর্কে আগ্রহী মানুষদের। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
Environmentalism A Global History
পরিবেশবাদ এক বৈশ্বিক ইতিহাস
-রামচন্দ্র গুহ
ভাষান্তর- নীহাররঞ্জন বাগ
বুকপোস্ট পাবলিকেশন
কলকাতা-৯