পাঠক মিত্র

‘রক্তকরবী’ ফুটে আছে আজও ! 

রক্তকরবী নামের সাথে ফুলের কথা মনে আসার আগে কবিগুরুর কথা মনে পড়ে । যদিও সবার কাছে তেমন হবে তা নয় । একশো বছর আগে প্রকাশিত কবির সৃষ্টি ‘রক্তকরবী’ আজও কেন ভাবনাকে ধাক্কা দেয় । কবির এ সৃষ্টি প্রথম থেকেই আলাদাভাবে মানুষকে ভাবনা যুগিয়েছে । একটা রূপক ধর্মী নাটক তার রপকের সাজঘর থেকে বাস্তব মাটিতে আজও আলো ফেলে । এখনও সেই আলো দিয়ে বর্তমানকে দেখা যায় । 

কবিগুরু নাটকটি রচনা করেছিলেন ১৯২৩ সালে শিলং-এ । তদানীন্তন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘রক্তকরবী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে । ১৯২৬ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয় । সেই সময়ে কবির এই সৃষ্টি সম্পর্কে কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বর্তমান সময়কে দেখা যেতে পারে । ‘রক্তকরবী’ সৃষ্টির আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও তার বারুদের গন্ধ তখনও বাতাসে মিশে আছে । সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন চেহারায় তার আগমন । নভেম্বর বিপ্লবে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র সূর্যের আলো দুনিয়ার পরাধীন দুর্বল দেশের মানুষকে ভরসা দিতে শুরু করেছে । ভারতেও তার প্রতিফলন পড়েছে। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবের জোয়ার আরও তীব্র হয়েছে তখন । ঠিক এই সময়কালীণে কবির সৃষ্টি এই নাটক । 

‘বই আকারে প্রকাশিত হবার পরপরই জয়গোপাল ব্যানার্জি নামে এক অধ্যাপকের সমালোচনা প্রকাশিত হয় । তিনি লিখেছিলেন, এই নাটকটির মধ্য দিয়ে একটা political regeneration হতে পারে । এর মধ্য দিয়ে দেশের সমগ্র রাজনৈতিক উত্থান হতে পারে । মাননীয় অধ্যাপকের এই সমালোচনার তিন বছর পর তদানীন্তন বোম্বাই অধুনা মুম্বাইয়ে নাটকটির মঞ্চস্থ ইংরেজিতে হয়েছিল ১৯২৯ সালে । অভিনয় করেছিলেন মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত যাঁরা। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তরা Youth Progress Circle নামে একটি সংঘ চালাতো তখন যেখানে বিভিন্ন চর্চার পাশাপাশি তাঁরা একটি study circle চালাতো । এই study circle এ কম্যুনিজম-এর মূল সূত্র কি তা নিয়ে চর্চা করতো তাঁরা । কবি’র এই নাটকে মীরাট ষড়যন্ত্রে অভিযুক্তরা খুঁজে পেলেন তাঁদের সমকালকে (শঙ্খ ঘোষের লেখা-ঋক প্রকাশনী)।’ সমালোচক অধ্যাপকের কথা অনুযায়ী political regeneration এর প্রথম নিদর্শন তৈরি করলেন মীরাট ষড়যন্ত্রকারী অভিযুক্তরা ।

রক্তকরবী বই আকারে প্রকাশিত হবার পনেরো বছর পর ‘রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা’ নামাঙ্কিত রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনার বই প্রকাশিত হয় । আলোচক নীহারঞ্জন রায় । তিনি যে কথাটা বললেন তা হল- ‘রক্তকরবী গীতধর্মী নাটকীয় কাব্য । তবে নাটকীয় রস অনুপস্থিত। এই নাটকে সমাজচেতনার অস্তিত্ব প্রচ্ছন্নভাবে ঘোষনা করে ।’ তিনি আরো বলেছেন যে এই নাটক ‘রক্তকরবী’ নামের থেকে ‘যক্ষপুরী’ নাম সার্থকতর ছিল (যা এই নামেই রচিত হয়েছিল)। এই নাটকে ঘটনার আবর্তন নেই বলে তিনি মনে করেছেন । যেহেতু নাটকটি যক্ষপুরীকে ঘিরেই। যেখানে রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ । তার চরম অর্থলোভ । সেই লোভের আগুনে পুড়ে মরে সোনার খনির কুলিরা । রাজার মতে কুলিরা মানুষ নয়, তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র । তারা জড়-যান্ত্রিকতার যন্ত্র-কাঠামোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, মানুষ হিসেবে তাদের কোন মূল্য নেই। মনুষ্যত্ব, মানবতা এই যন্ত্রবন্ধনে পীড়িত ও অপমানিত । জীবনের প্রকাশ সেই যক্ষপুরীতে নেই। জীবন প্রকাশের যে রূপের প্রতীক নন্দিনী, সেই নন্দিনীর আনন্দ-স্পর্শ থেকে যক্ষপুরীর রাজা বঞ্চিত তাঁর লোভের মোহে, সন্ন্যাসী বঞ্চিত তাঁর ধর্মসংস্কারের মোহে, অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে মজুর বঞ্চিত, আর পন্ডিত পায়নি তাঁর পান্ডিত্য ও দাসত্বের মোহে । অথচ সেই যক্ষপুরীতে সমস্ত মোহ ছিন্ন করার মন্ত্রে নন্দিনীর প্রেমিক রঞ্জন অবস্থান করেছে বলেই তাঁকে যান্ত্রিকতার যুপকাষ্ঠে বলি হতে হল । রঞ্জন মরতে পারে না- এই আত্মবিশ্বাসে শেষে তাঁর ও নন্দিনীর প্রেম জীবনানন্দের স্পর্শে যক্ষপুরীর মোহগ্রস্ত মানুষদের এমনকি রাজাকেও মোহজাল কেটে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাকুল করে তুলতে পেরেছিল । প্রেমানন্দে কঠিন হৃদয় কে জয় করা যায়, সেই প্রেমের সন্ধান রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বলে উল্লেখ করেছেন নীহারঞ্জন রায় । 

যক্ষপুরীর রাজার মত ব্রিটিশ রাজের লোভ আর এ দেশের মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখার যে নিদর্শন কবি দেখেছেন তার রূপক অর্থে এই নাটকের সৃষ্টি । যা মানুষের মধ্যে জাগরণ তুলতে পারে বলেই মীরাট ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই নাটক মঞ্চস্থ করেছে । এই নাটকে যে political regeneration তৈরি হতে পারে সে সম্পর্কে প্রথমেই অধ্যাপক ব্যানার্জি বলেছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মঞ্চস্থ করলেন সেই নাটক সুদূরে তদানীন্তন বোম্বাই-এ । 

এখন দেশ স্বাধীন । লোভী ব্রিটিশ রাজ নেই। তাহলে এই নাটক আজকের সমাজে আলোড়ন তুলতে পারে না । তাই স্বাধীনতার আটাত্তর বছরে এই নাটকের প্রসঙ্গ নতুন করে বলার কিছু নেই বলে দাবি করতে পারেন কেউ। সে কথা ঠিক । কিন্তু স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষ একেবারে অবহেলিত নয় তা কি বলা যায় ? সমাজে যাঁদের উঁচু তলার মানুষ বলে মনে করে এই সাধারণ মানুষ, সেই উঁচু তলার মানুষরা সকলেই লোভী নয় তা কি আজ পরিষ্কার? এমনকি যাঁরা মানুষের কথা বলা ছাড়া কথা বলেন না, চালু রাজনৈতিক উন্নয়নের কথা ছাড়া কথা ভাবতে পারেন না তাঁরা সকলেই লোভী নয় তা ও কি পরিষ্কার ? পরিষ্কার কি পরিষ্কার নয় এই প্রশ্ন নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষের উল্লেখ করা ২০০৬ সালের একটি ঘটনা (শঙ্খ ঘোষের লেখা-ঋক প্রকাশনী) বলা যেতে পারে । কবির কথায় ‘…. লন্ডন শহরে ইংরেজীতে ‘রক্তকরবী’র একটা আশ্চর্য অভিনয় হয়ে গেছে । কেভিন রাউন্ডট্রি নামের বছর চল্লিশের এক ইংরেজ যুবক পরিচালনা করেছেন নাটকটি । ইজরায়েল, জাপান, নাইজেরিয়া, ইতালি, এইসব দেশের লোকেরা অভিনয় করেছে । তারা ওখানে দশ-এগারোটি অভিনয় করার পর সারা পৃথিবীতে নাটকটি নিয়ে ঘুরবে  বলে ঠিক করেছে ।….জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এই ২০০৬ সালে  হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটক করার ইচ্ছে হল কেন ? তার উত্তরে সেই পরিচালক বলেছিলেন : কেননা, এটা আমাদের এই মূহুর্তের কথা । কেননা, গোটা পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রের পরিচালনায় যে নিষ্পেষণ চলছে, সেই নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ, এমনকী বিপ্লব আছে এখানে ।: Nandini is a revolution, এই তার মনে হয়েছে ।’

১৯২৯ সাল ও ২০০৬ সাল সময় এক নয় । অথচ মানুষের ওপর নিষ্পেষণ সময়ধারায় কোন পরিবর্তন হয়নি । পরিবর্তন শুধু তার রূপ বদলেছে মাত্র । সেই নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এই নাটক বিদ্রোহ তৈরি করার প্রাসঙ্গিকতা রাখে । সে ব্রিটিশ-রাজ হোক আর স্বাধীন দেশীয় রাষ্ট্র-রাজ হোক । আজকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চেহারায় যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব । আবার এই মূহুর্তে যুদ্ধরত রাষ্ট্রের নাম আজকে কারো অজানা নয় । এমনকি যুদ্ধ পর্দার পিছনের রাষ্ট্রের নামও অজানা নয় । যুদ্ধে রাষ্ট্র জেতার গর্ব করে ঠিকই কিন্তু অসংখ্য সাধারণ মানুষ গৃহহীন ও খাদ্যহীন হয়ে পড়ে সে জ্বলন্ত উদাহরণ ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ । যুদ্ধ বাদ দিয়ে স্বদেশীয় মানুষের ওপর রাষ্ট্রই আজ যক্ষপুরীর রাজার মত সাধারণ মানুষকে নিষ্পেষণ করছে তা কি পরিষ্কার নয় ? আবার বলতে হয় শুধু তার রূপ বদলেছে মাত্র ।

আজকের রাষ্ট্র নিষ্পষণ করতে পারে তখন, যখন মানুষকে নানাভাবে প্রলোভনে আটকে দিতে পারে । যেখানে মানুষ যন্ত্রণায় ছটফট করবে অথচ যন্ত্রণার উৎস জানতে পারবে না । রক্তকরবী’র কয়েকটি চরিত্রের কথোপকথন তুলে ধরলে তা বোঝা যেতে পারে যক্ষপুরীতে আটকে থাকা মানুষের যন্ত্রণা আর আজকে রাষ্ট্রের মানুষের জীবন ।

নন্দিনী বিশ্রী জালটাকে ছিঁড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করার কথা বললে, তার উত্তরে অধ্যাপক বলছে আমাদের মরা ধনের প্রেতের যেমন ভয়ংকর শক্তি, আমাদের মানুষ-ছাঁকা রাজারও তেমনই ভয়ংকর প্রতাপ । রাজার এই প্রতাপ যক্ষপুরীর অধ্যাপকসহ রাজার গুনকীর্তনকারীদের বানানো বলে নন্দিনী প্রত্যুত্তরে বলে। অধ্যাপক তা স্বীকার করে বলতে থাকে উলঙ্গের কোন পরিচয় থাকে না, বানিয়ে তোলা কাপড়েই কেউ-বা রাজা, কেউ-বা ভিখিরি । নন্দিনীর কথায় অধ্যাপক যুক্তির পর যুক্তি দিতে দিতে একটা কথা বলে যে রাজার মত জালের পিছনে থেকে সেও ভয়ংকর, কারণ মানুষের অনেকখানি বাদ দিয়ে তার পন্ডিতটুকু জেগে আছে । 

মানুষের এই অনেকখানি বাদ যাতে যায় তার ব্যবস্থা কি আমরা আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি না ? 

সকাল থেকে মদ খাওয়া নিয়ে ফাগুলাল ও তার স্ত্রী চন্দ্রার কথোপকথনে ফাগুলাল ছুটির দিন বলে সকাল থেকে মদ খাচ্ছে । কাল ওদের মারণচন্ডীর ব্রত গেছে, আজ ধ্বজাপূজা তারপর অস্ত্রপূজা আছে বলে ফাগুলালের কথা শুনে চন্দ্রা অবাক হয়ে বলে যে রাজার লোকেরা ঠাকুরদেবতা মানে ! তার উত্তরে ফাগুলাল বলে ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির গায়ে গায়ে ।

মদ নিয়ে বিশুর কথা চমৎকার, বিধির কৃপায় মদের বরাদ্দ জগতের চার দিকেই, রাজার নেশা সোনা যেমন মদ, নারীর বাহু, বনের সবুজ রোদের সোনা তেমনই। জীবলোকে মজুরি করতে হয় আবার মজুরি ভুলতে হয় । মদ না হলে ভোলাবে কিসে ।

একদিকে ক্ষুধা মারছে চাবুক, তৃষ্ণা মারছে চাবুক, তারা জ্বালা ধরিয়েছে, বলছে কাজ কর । 

প্রাণের মদ, নেশা ফিকে কিন্তু দিনরাত লেগে আছে । এ রাজ্যে এলুম, পাতালে সিঁধকাটার কাজে লাগলুম, সহজ মদের বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেল । অন্তরাত্মা তাই তো হাটের মদ নিয়ে মাতামাতি করছে । সহজ নিঃশ্বাসে যখন বাধা পড়ে, তখনই মানুষ হাঁপিয়ে নিশ্বাস টানে ।…নরকেও সুন্দর আছে কিন্তু সুন্দরকে কেউ সেখানে বুঝতেই পারে না ।

সেই নীল চাঁদোয়ার নীচে, খোলা মদের আড্ডায় । রাস্তা বন্ধ । তাই তো এই কয়েদখানার চোরাই মদের ওপর এমন ভয়ংকর টান । আমাদের না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ । তাই বারো ঘন্টার সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে চুঁইয়ে নিয়েছি এক চুমুকের তরল আগুনে । যেমন ঠাস দাসত্ব, তেমনই নিবিড় ছুটি । 

আজকের মানুষের জীবন এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে উঠছে সত্যিই তাদের না আছে আকাশ না আছে অবকাশ । এই অবস্থায় প্রাণের প্রকৃতি আনন্দ নষ্ট হয়ে গেছে । তাই অন্তরাত্মা হাটের মদ নিয়ে মাতামাতি করছে । এই মদ আজ শুধু মাদক দ্রব্য নয়, কেউ ভোট মদে, ক্ষমতা মদে, দুর্নীতি মদে, ধর্ম মদে উগ্রভাবে মেতে থাকার পরিবেশের মধ্যে আমরা আছি । 

আজকে সময়ে কবির এ সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কবির দূরদৃষ্টি প্রসঙ্গে আমরা পান্ডিত্য জাহির করতে পারি । কিন্তু সেই পান্ডিত্য নিয়ে আমরা সমাজে তাঁর প্রভাব কি আদৌ ফেলতে পেরেছি? প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *