পাঠক মিত্র
প্রশ্ন চলে আখ্যান ভেলায়
প্রতিটি মানুষের জীবন বিভিন্ন আখ্যানের সমাহার । তার চলার পথের চড়াই-উতরাই, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবকিছু নিয়েই এক একটি আখ্যানের জন্ম হয় । প্রতিটি আখ্যান তৈরি হয় জীবনের নানা প্রশ্নে । তা পার্থিব না অপার্থিব সে প্রশ্নও হারিয়ে যেতে পারে এমন প্রশ্নের গভীরে । বিশেষ করে যে মানুষগুলোকে বেঁচে থাকতে হয় বলে বেঁচে থাকতে হয়, তাদের নিজেদের কাছে নিজেরাই অচেনা হয়ে থাকে । আবার কখনো কখনো কারো কাছে চারপাশে নানাভাবে বদলে যাওয়া পরিবেশে নিজেরাই নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে । নিজেদের কাছে অচেনা হয়ে ওঠা এমন মানুষদের নিয়ে ‘একটি আখ্যানের জন্ম হয় তখন’ । কথাকার শান্তনু ভট্টাচার্যের নয়টি গল্পের সংকলন এটি । এই সংকলটি নিজের কাছে অচেনা হয়ে ওঠা মানুষদের গল্প । যে মানুষগুলো বেঁচে থাকার স্রোতে বিবর্ণ হয়ে যায় । বিবর্ণ এমন মানুষদের মনে এমন প্রশ্ন জাগে যার উত্তর ধোঁয়াটে আবহে মিশে থাকে । সেই ধোঁয়াটে বিবর্ণ বাতাসে মিশে থাকা মানুষরা তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলে । উত্তর খোঁজার স্রোতে শান্তনু ভট্টাচার্যের আখ্যান-ভেলা ভেসে চলে । কথাকার ভট্টাচার্যের নয়টি গল্পের চরিত্রদের প্রশ্নে প্রশ্নে আখ্যান ভেসে চলে সেই ভেলায় ।
সংকলনের নামাঙ্কিত গল্পটি সমুদ্র দেখতে যাওয়ার গল্প । উদ্যোগী বন্ধু সমুদ্রের টানে অন্য বন্ধুদের সাথে পরিকল্পনা করেও তার আগেই একলা চলে যায় সে। এই আখ্যানের প্রথম লাইন বলে দিয়েছে তার কথা । ‘একটা সমুদ্র, সমুদ্রের শরীর ছুঁয়ে একটা বেলাভূমি, বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে একটা মানুষ । এই তিনেক শৃঙ্খলে আখ্যান কথা । এই শৃঙ্খল থেকে বন্ধুদের জীবন সমুদ্র ছুঁয়ে বন্ধুদের ছাড়াই সমুদ্র তীরে একলাই পৌঁছে যায় । সমুদ্রের ঢেউ যেমন বেলাভূমি ছুঁয়ে আবার ফিরে যায় । সেই ঢেউ ভেঙে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে কি আসছে, তা বুঝতে পারছে না এ গল্পের নায়ক এক নামহীন চরিত্র। তার কাছে যাওয়া আসা ব্যাপারটাই রহস্যময় ও জটিল বলে মনে হয় । এই জটিলতা থেকে প্রশ্ন জাগে তার মনে, ফিরে আসা ফিরে যাওয়া কাকে বলে ? মানুষের ফিরে আসা যাওয়া কোথায় হয় ? মানুষের ফিরে আসা যাওয়া কেবলই আপেক্ষিক । তবু এই প্রশ্ন নিয়ে আখ্যান এগিয়ে চলে নতুনভাবে ।
‘হিটলার ও তার তিন স্বপ্ন’ গল্পের হিটলার হাড়ি ইট ভাঁটার সাধারণ শ্রমিক হলেও মানসিক শক্তি তার এতই মজবুত যে গলা-ভর্তি মদ খেলেও তাকে কেউ মাতাল বললেই তৎক্ষণাৎ তার মাথা গরম হয়ে যায় । কিন্তু তার মাথা গরম হলেও ইট ভাঁটার পার্টির কাছ থেকে বখশিস নিতে ভুলে যায় না, ইটের গুনতির গরমিল দেখিয়ে বাড়তি পয়সা নিজের পকেটে ভরতে ভুলে যায় না । তার কাজের পরিবেশে এমন মিথ্যায় তার ভুল হয় না । যে মিথ্যা তার ইটভাঁটার মালিক ও মুন্সি বাবুর থেকেই তার শেখা । বাবুয়ানার অসৎ আয়ের জন্য মিথ্যাচার শ্রমিককেও-যে প্রভাবিত করে , এ গল্পের হিটলার তার প্রমাণ । মাতাল হিটলার তাই মিথ্যার আশ্রয়ে বাড়তি পয়সা নিতে ভুল করে না । ইটভাঁটার হাড়ভাঙা খাটুনির পর ক্লান্ত শ্রমিক হিটলার চোলাই খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে রাখতে ঘুমে ডুবে যায় । ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে কিন্তু সব মনে করতে পারে না । কেবল তিনটে স্বপ্ন তার মনে আছে । প্রতিটি স্বপ্নেই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেখেছে সে । কিন্তু সেই মৃত্যুর ছবি চেনা হয়েও তার কাছে ছবিটা অচেনা । স্বপ্ন তার কাছে ধোঁয়াশা ও অন্ধকার । শ্রমিকের স্বপ্ন এর থেকে বেশি কিছুই হতে পারে না । ইটভাঁটার শ্রমিকের জীবনটাই যেখানে ধোঁয়াশাপূর্ণ, সেই স্বপ্নের স্মৃতি নিয়ে হিটলারের জীবনটাই একেবারে চলে যায় স্বপ্নের দেশে ।
শ্রমিকের কথা, শ্রমিকের দাবি আন্দোলনের কথা গল্পে এসেছে । যে গল্পে পারিবারিক সম্পর্কটা আন্দোলনের সূত্র ধরে গড়ে তুলেছেন কথাকার । ‘সোনালি বোতাম’ গল্প বলেছে সেই কথা যে কথা শ্রমিকের আন্দোলনের পথ নিয়ে পারিবারিক ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি । আর্থিক সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে শ্রমিক আন্দোলন নীতির পথে নাকি আপোষের পথে চলবে ? শুধু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নীতির প্রশ্ন থাকলে হবে না, বৃহত্তর স্বার্থে মালিক পক্ষের পাশেও শ্রমিকদের দাঁড়াতে হতে পারে বলে মত ব্যক্ত হয়েছে শিক্ষক আন্দোলনের নেত্রীর মুখে । এই চরিত্রের কথায়, এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কৌশল তৈরী না করলে বিশ্বপুঁজির প্লাবনে তলিয়ে যাবে শ্রমিকের দাবি ও তার আন্দোলন। এই কৌশল কে করবে ? আন্দোলনকারী সংগঠন ? সংগঠনের নীতি আদর্শ কোন পথে ? এই পথ নিয়ে প্রশ্ন কম নয় । কিন্তু সে প্রশ্ন এই গল্পে আসেনি । তবে বিশ্বপুঁজির প্লাবনে ভোগবাদ আজ সর্বগ্রাসী । যার গ্রাস থেকে কেউই বাঁচতে পারছে না । শ্রমিক, শিক্ষক সকলেই। সকলেরই দিশাহীন পরিস্থিতি । শিক্ষক দিশাহীন হলে ছাত্রদের অবস্থাও দিশাহীন । এ প্রসঙ্গ এসেছে । কিন্তু বিশ্বপুঁজির প্লাবনে ভাসছে এ সমাজ । রাজনীতিও আজ এই পুঁজিতে ভাসছে । শিক্ষক ও ছাত্র এ সমাজেরই । তাই দিশাহীন শুধু শিক্ষক ও ছাত্র নয় । এ গল্পে পারিবারিক আলাপচারিতায় শ্রমিক আন্দোলনের কথা থেকে চে’র কথা এসেছে, বলিভিয়া আর্মির কথা এসেছে । এসেছে দাসপ্রথার কথা । কথায় কথায় খুঁজে না পাওয়া সোনালি বোতাম শেষে খুঁজে পাওয়া গেলেও, শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলনের দিশাহীনতার প্রশ্ন থেকেই যায় । এই আন্দোলন রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং স্পর্শ কখনোই এড়িয়ে যেতে পারে না । এ প্রসঙ্গ এ গল্পে অন্যভাবে এড়িয়ে গেলেও তার অল্প ছোঁয়ায় চে ও বলিভিয়া আর্মি র ছায়া বিস্তার করেছে । তবে আদর্শের পথ কিংবা পথের আদর্শ আজ হয়তো সোনালি বোতাম খোঁজা । এ গল্পে তা পেলেও পথ ও আদর্শের প্রশ্ন থেকেই যায় । তবে সে প্রশ্ন পারিবারিক পরিমন্ডলের বিস্তারে গল্পটি অন্য মাত্রা পেয়েছে ।
‘কমরেড কপিলপ্রসাদের নিঃশ্বাস’ গল্প এমন মানুষদের গল্প যারা একসময় রাজনৈতিকভাবে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছিলেন । মানুষ ও মানুষের অধিকার নিয়ে তাদের কর্মপথ হলেও আজকে তাদের সময় ও বয়সের অস্তমিত সময়ে সেই পথ থেকে অবসরপ্রাপ্ত। এই সময়ে কপিলপ্রসাদ মনে করেছে তার কাছে তার চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। সবকিছুই তার বিক্রি হয়েছে । চোখ, কান, হৃৎপিন্ড, যকৃৎ সবই । এই কথাটা এই গল্পে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্ষমতার আবহাওয়ায় যারা বিচরণ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের প্রতীকী তুলে ধরেছেন কথাকার অত্যন্ত সুচারুভাবে কপিলপ্রসাদের চরিত্রে। এ অবস্থায় তাই সে হারিয়ে যায় হারিয়ে যেতে চায় কোন এক নির্জনতায় । হারিয়ে যাওয়া সময়ে তার ভাবনার পাখা উড়তে থাকে । যেখানে দুটো সমুদ্রপাখির লড়াই, তাদের হারজিত এবং ক্ষতবিক্ষত অবস্থার নানা প্রশ্নের ধারা বিবরণী চলতে থাকে । এমনকি তার স্বপ্নের বাগান তৈরির ব্যবস্থায় পোকাদের কায়েম করা অধিকার থেকে উচ্ছেদ করার সময় তাদের লড়াই তার ভাবনায় বিস্তার করে । যদিও এই ভাবনার সূত্র সে তার পার্টির মুখপত্রের সাংবাদিক বন্ধু নিরঞ্জনের কাছ থেকে পেয়েছে । অবসরপ্রাপ্ত পার্টিকর্মীর শেষ জীবনে সাংসারিক পরিমন্ডলে রাজনীতির স্পর্শ নেই, অথচ নিজের কাছে নিজের লড়াইয়ের প্রশ্ন ভাবনায় তা স্পর্শ করে যা গল্পটিতে কথাকারের মুন্সিয়ানা প্রমাণ করেছে ।
‘মনবিহারীর কালো নৌকো’ গল্পটিতে মনবিহারীর নানা প্রশ্ন । সেই প্রশ্নে মানুষের হিংস্রতার কথা এসেছে । কেন হিংস্র মানুষ ? তার জন্য নিজের হাতে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিজের শরীর চিরে নিজেই দেখতে চায় । সেখানেও প্রশ্ন তার । কোন প্রত্যঙ্গটি সর্বপ্রথম অস্ত্র বসানোর উপযুক্ত? মস্তিষ্ক না হৃৎপিন্ড ? এ প্রশ্ন নিয়ে যে কথাটা মনবিহারীর উত্তর হতে পারে, হৃদয় বিপথগামী করে আর মস্তিষ্ক সেই বিপথগামিতা থেকে ফিরিয়ে আনে মস্তিষ্ক। এমনকি চোখও নয় । চোখ ছাড়া মানুষ হতে পারে, কিন্তু মস্তিষ্কবিহীন মানুষ হতে পারে না । তাই মস্তিষ্কই প্রথম চেরাই হতে পারে । নদী গবেষক মনবিহারী নদীপথে আবার নদীর ইতিহাসকে জানার কথা বলে চলে । সময়ের স্রোতে নদী বদলে যায়, কখনও তার অস্তিত্ব হারায় । নদীর এই বদলে যাওয়া সময়ে না-বদলানো সমাজের ধুলোপথেই মনবিহারী চলেছে । যার শরীরজুড়ে ধুলো আর অন্ধকার । এই অন্ধকার পথ ধরে মনবিহারীর কালো নৌকো কথাকারের শব্দ স্রোতে নতুন আঙ্গিকে চলেছে ভেসে ।
এই সংকলনের প্রতিটি গল্পের চরিত্রের প্রশ্নে প্রশ্নে গল্প এগিয়ে চলেছে । সেই প্রশ্ন নিজের কাছে নিজেরাই কখন অচেনা হয়ে উঠেছে । চরিত্রের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে চলমান সময়ে না-বদলানো সমাজের নানা মত । কথাকার শান্তনু ভট্টাচার্য তাঁর বাক্য বিন্যাসের মুন্সিয়ানায় নিজস্ব ভঙ্গীর উদাহরণ তৈরি করেছেন এই সংকলনে ।
একটি আখ্যানের জন্ম হয় তখন
–শান্তনু ভট্টাচার্য
–আপন পাঠ, কলকাতা-১০ প্রতিভাস ম্যাগাজিন