পাঠক মিত্র
মানুষের সংকটে ‘অন্তহীন ছায়াপথ’
মানুষের বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ার কারণ কমবেশি সকলেই জানেন । কিন্তু সেই কারণের গভীরতা নিয়ে ভাবার মানুষের অভাব না থাকলেও প্রশাসনিক ভাবনার দীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রতি ঘটনায় । প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সমাজ উন্নয়নের স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষ নিজভূমি হারিয়ে যখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তখন তাঁদের একপ্রকার দয়ায় বেঁচে থাকতে হয় । বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের । তবে এমন মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হলেও তাঁদের উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করা হয় না বা যায় না । কারণ তাঁদের নিজভূমি হারানোর বিষয় দেশহীন হয়ে পড়ার বিষয় থাকে না । তবে নিজের দেশে ভূমিহীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা আর উদ্বাস্তু হিসেবে দেশহীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা আলাদা হলেও নিজদেশে ভূমিহীন মানুষরা একপ্রকার উদ্বাস্তু। তাঁদেরও উদ্বাস্তুদের মতোই হীন হয়ে বেঁচে থাকতে হয় । সাহিত্যের জমিতে তাঁদের জীবন যন্ত্রণা ঠিকভাবে রোপিত হতে সচরাচর এ প্রতিবেদকের চোখে পড়ে না, যতটা উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণার লিপি চোখে পড়ে । এই যন্ত্রণার এক লিপি ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ ।
রাজনৈতিকভাবে একটা দেশ যখন খন্ডিত হয়ে যায়, তখন খন্ডিত দেশের পরিচয় নামক সম্পর্কিত বিষয়ে খন্ডিত সীমানার মানুষজন কখনো উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে । ভারত ভূখন্ডে দেশভাগের রাজনৈতিক কারণের সাথে ধর্মীয় কারণ সম্পৃক্ত হয়ে পড়ায় মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার দুর্বিষহ নিদারুণ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী মানুষ ছাড়া তার অনুভূতি কাকেই বা স্পর্শ করতে পারে । দেশভাগ হলেই যেন মানুষ ভাগ হয়ে যায় । সেই ভাগে মানুষ যেন আর মানুষ থাকে না । এমনকি ধর্মীয় হিংসা বা জাতিগত হিংসার সক্রিয়তার কাছে মানুষের পরিচয়ও মানুষ আর থাকে না । এই হিংসা সংখ্যালঘুদের জীবন জীবিকা সংখ্যাগুরুর নামে একদল গ্রাস করে চলে প্রতিনিয়ত। প্রশাসনের নীরবতা কিংবা উদাসীনতায় যে দলের বল দিকে দিকে প্রকাশিত হয়। যেখানে একই ধর্মের মানুষ রক্ষা করতে পারে না সেই ধর্মেরই মানুষদের, সেখানে বিধর্মী মানুষদের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। এমন সংকটময় অবস্থার জন্য ভুক্তভোগী মানুষরা আদৌ দায়ী নয় । এমন ঘটনায় বর্তমান বাংলাদেশ তার উদাহরণ ।
বিশ্বজুড়ে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে স্ব-রাষ্ট্রীয় কিংবা ভিন-রাষ্ট্রীয় মদতে । এ কথা আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। জাতি দাঙ্গার রূপ মণিপুরে একরকম, আবার গাজা ভুখন্ডে আর এক রকম । আজ দেশভাগের এতদিন পরও এই দেশ উদ্বাস্তু বা ভূমিহীন মানুষ সংখ্যাহীন হয়ে পড়েনি । এমন ভূমিহীন মানুষের অস্তিত্ব সংকট ও তার থেকে বেঁচে থাকার লড়াই নিয়েই এক কাহিনী ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ । ভূমিহীন মানুষদের শুধু বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে এই কাহিনী গড়ে তোলেননি কথাকার অমিয় কুমার জানা, কাহিনীর চরিত্রের লড়াই দিয়ে দেখিয়েছেন এক পথ যা চেনা পথ নয় । কিংবা ছকে বাঁধা পথ নয় । এ পথ বিশ্বজুড়ে মানুষের পরিচয় মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লড়াই। আজকে মানুষের পরিচয় মানুষ হিসেবে কোন রাষ্ট্রই দেখে না । জাতপাত-ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু কে, তার পরিসংখ্যানে জাতি গড়ে তোলার একটা প্রক্রিয়া চলছে বিশ্বজুড়ে । রাষ্ট্রের ধর্ম আজ লুন্ঠিত হচ্ছে ধর্মের রাষ্ট্র নামে । এই মানসিকতার গুঞ্জন এশিয়া মহাদেশের প্রান্তরে ঢেউ তুলছে । এই গুঞ্জন আবার কোন দেশে হুংকার বেশে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সম্পর্কে এই হুঙ্কার একপ্রকার গা সহে গিয়েছে । কিন্তু ভারত সম্পর্কে যেন তা গা পুড়িয়ে দিচ্ছে । মন পুড়ে যাচ্ছে । এই পোড়া মন নিয়ে মানুষের বাঁচার লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই । যে লড়াই ধর্মীয় ইন্ধনে উগ্রতার বিরুদ্ধে মানবিক বন্ধনকে সুদৃঢ় তৈরী করার লড়াই। ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ এই লড়াইয়ের কথাই বলেছে । আব্দুল ও অদ্রিজা তাদের প্রেমের বন্ধনে সেই লড়াইয়ের পথ করে নিতে চেয়েছে । আব্দুল রোহিঙ্গা মুসলমান । আর অদ্রিজা বাংলাদেশী হিন্দু । আব্দুলের পরিবার নিজভূমি আরাকান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে ঠাঁই নিয়েছে । প্রতি মুহুর্তে অস্তিত্বের সংকটে এক দেশ থেকে আর এক দেশে বেঁচে থাকার লড়াই তাদের । অথচ এই সংকট তাদের তৈরি করা নয় । আব্দুল ও অদ্রিজা তাদের জীবনধারায় তারা অনুভব করেছে । কিন্তু সেভাবে তাদের বোধগম্য হয়নি । অদ্রিজার পরিবার উদার হলেও তাদের তবুও বাস্ত্তুচ্যুত হতে হয়েছিল । এই অবস্থার মধ্য থেকে আব্দুলের বাবা রফিকুলের শিক্ষা বোধ তাদেরকে বাস্তুচ্যুত মানুষ সহ সাধারণ মানুষের সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার নেপথ্য কারণ তারা বুঝতে পেরেছে । রফিকুলকে শিক্ষকতার জীবিকাসহ নিজ বাসভূমি বিসর্জন দিয়ে আজ পথে বসতে হয়েছে । তাদের অবস্থা সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যত কথাই থাক না কেন, আসলে তা যে কেবল কথার কথা । এ কথাটাই আব্দুল অদ্রিজাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে রফিকুল দেখিয়ে দিয়েছে । এই বিশ্লেষণে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ সংকট থেকে তাদের মুক্তি নেই। আজকের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আদর্শের জায়গা নেই বলেই রফিকুল যুক্তি দিয়ে তাদের বিচার করতে শিখিয়েছে । পুঁজিবাদ সমাজ ব্যবস্থার শেষ স্তরে সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদের চরিত্র নতুনরূপে প্রতিনিয়ত হাজির হচ্ছে । এমনতর পরিস্থিতিতে বামপন্থী রাজনীতি আদর্শের পথ থেকে বিচ্যুত হলে বিপ্লব বিপ্লব করে আওয়াজ তুললেই সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি বদলে যাবে না । এ কথার তাৎপর্য আব্দুল ও অদ্রিজা’র কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে রফিকুল । তার শিক্ষকতার জীবন হারিয়ে গেলেও আজ যেন অদ্রিজাদের কাছে সে রাজনৈতিক শিক্ষক । ক্ষমতা রাজনীতি যখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে ক্রমশ সংকটময় করে তুলছে, তখন সাংস্কৃতিক স্তরকে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর লড়াইয়ের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে পেরেছে । ধর্ম ও মতের মিল না হলে মানুষ হিসেবে পরিচয়ে বেঁচে থাকা যেখানে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে যে পরিবেশে, সেই পরিবেশ তথা রাজনৈতিক পরিবেশকে বদলে দিতে শুধু দেশের মধ্যেই লড়াই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, সেই লড়াইকে দেশের সীমানার বাইরে তারা ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। এমনকি নিজেদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৈষম্যসৃষ্টিকারী হায়নাদের সাথে একপ্রকার লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাদের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলে । দিকে দিকে নাটক গান সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় চলমান শাসক রাজনীতি ও ভোট রাজনীতির দূরভিসন্ধি সম্পর্কে মানুষদের সচেতন করার কাজে আদ্রিজারা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে ।
অসমধর্মী প্রেমে নিছক প্রেম কাহিনীর উপাখ্যানের ছায়া দিয়ে ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ গড়ে তোলেননি কথাকার । প্রেম একটা আদর্শ, উচ্চ সংস্কৃতির আদর্শ। যে আদর্শ রাজনীতির উচ্চ আদর্শের স্পর্শে আরো সমৃদ্ধ হতে পারে । শুধু তাই নয়, সেই আদর্শের লড়াই মানবিক প্রেমকে সুদৃঢ় করার লড়াই হয়ে ওঠে । এই লড়াইয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে প্রেমের পথে আদর্শ রাজনৈতিক পথকে প্রশস্ত করার এক অঙ্গীকার ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ ।
আদর্শহীন ক্ষমতা রাজনীতির ছায়াপথে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে । স্বধর্ম কিংবা বিধর্ম নিয়ে মাতামাতি এই আদর্শহীনতার জমি থেকেই প্রতিফলিত হচ্ছে। এই প্রতিফলনের আলো থেকে রফিকুল স্পষ্ট করে দিয়েছে রাজনীতির জটিল খেলাকে । আব্দুল, আব্দুলের সহোদরা রূপসানা, আদ্রিজা এই জটিলতা মানুষের বিবেক ও চেতনায় দেখিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় মানুষকে সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছে । প্রেম আর রাজনীতির মেলবন্ধনে আদর্শের পথে মানুষের সংকটের কারণ উদ্ভাসিত করেছে ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ । চলমান রাজনীতির ছায়াপথে মানুষের সংকট অন্তহীন । সেই সংকটের রোজনামচার ছবি এঁকেছেন কথাকার অমিয় কুমার জানা তাঁর ‘অন্তহীন ছায়াপথ’-এ । এ ছবি সংকেত দেয় কোন পথে মানুষের সংকটমোচনের সম্ভাবনা । আব্দুল অদ্রিজা’র প্রেম মুক্ত ও উদার মনের পরিচয় দিয়ে শুধু গড়ে তোলেননি কথাকার । সেই মুক্ত ও উদার মন দিয়ে রাজনীতির অন্ধকারকে চিনিয়ে দিতে তাদের লড়াই। যে লড়াই রাজনীতির কথা বলে । তাহলে তাদের এই আখ্যান কি রাজনৈতিক ? পাঠকের কাছে এই প্রশ্ন হয়তো তুলতে পারে ‘অন্তহীন ছায়াপথ’। তবে মানুষের সংকটাপন্ন অবস্থা চলমান রাজনৈতিক ছায়াপথে, সে কথা বলেছে ‘অন্তহীন ছায়াপথ’ । এই কাহিনীর বিন্যাসে কথাকার অমিয় কুমার জানা সত্য কথাটা অত্যন্ত সহজভাবে তাঁর চরিত্রদের দিয়ে বলিয়েছেন । আজকের সাহিত্যধারায় এত সহজভাবে সত্যটা বয়ে আসে না । কথাকারের বলিষ্ঠতা এখানেই। সাহিত্য সত্য কথা সহজভাবে বলতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, তর্ক উঠতে পারে । কিন্তু সে তর্কের পথে থেকেও ‘অন্তহীন ছায়াপথ’-এ রাজনৈতিক চলমান পথ চেনা হয়ে উঠবে মুক্ত মনের পাঠকের কাছে । কথাকারের সৃষ্টি এখানেই সার্থক হয়ে উঠবে ।
অন্তহীন ছায়াপথ
–অমিয় কুমার জানা
নিউ পাবলিশিং কনসার্ন
কলকাতা-৯