অমিতাভ সরকার
দয়াল বিচার করো
অখিলবন্ধু ঘোষ
মঞ্চে গান চলছে। নতুন গান শুরু হবে, এমন সময় গায়ক বলে উঠলেন ঐ যা! সমবেত দর্শক, বাদ্যযন্ত্রীরা ভাবলেন কোথাও কিছু ভুল হয়ে গেল কি! সবার অকস্মাৎ বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই অবিচলিত সেই মানুষটি সুর ধরলেন, ওকে বলতে ভুলে গেছি সে যেন বাঁশি না বাজায়। নাঃ, ভুল কিছুই হয়নি।ওটা গানেরই লাইন। কিন্তু সুরের নাটকীয়তা সৃষ্টিতে এই মুগ্ধতা সৃষ্টি করার সহজাত ক্ষমতা ছিল যে মানুষটির তিনি অখিলবন্ধু ঘোষ। একাধারে গায়ক ও সুরকার। ওনার অননুকরণীয় গায়কীর ঢঙে এইভাবেই শ্রোতারা বুঁদ হয়ে থাকতো।
নামের সঙ্গে শিল্পীর স্বভাবেরও যেন পরিচিতি মিলে যায়। ‘অখিলবন্ধু’। হ্যাঁ, সবাইকে আপন করে নিয়ে বাঁচতেন। সঙ্গীত ছিল তাঁর সাধনা। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুব একটা ছিল না। প্রচারের হাতছানি কোনোদিনই সেভাবে ওনার মন টানেনি।
মধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। ওনার গান ভালো বাসলেও সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালি শ্রোতা সে ভাবে খোঁজ রাখেনি, খোঁজ রাখেনি তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজও।
জন্ম কলকাতার ভবানীপুর ১৯২০ সাল, ২০ শে অক্টোবর। বাবা বামনদাস ঘোষ, মা মণিমালা ঘোষ।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সঙ্গীত চর্চা না থাকলেও ভাবুক ও লাজুক স্বভাবের অখিলবন্ধু ছোটো থেকেই গান শুনতেন, এবং শুনেই গান তুলে ফেলতে পারতেন। গানের শিক্ষা নিজের মামা কালীদাস গুহ, তারপর নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নেন। রাগ সঙ্গীতে আগ্রহ ও পারদর্শিতা ছিল দারুণ। রাগপ্রধান গানে তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল দেখার মতো।
ভবানীপুরের নাসিরুদ্দীন মেমোরিয়াল স্কুলে অখিলবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু। এখানে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন আরেক সুরস্রষ্ঠা শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। উভয়ের পরিবারের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তবে মাট্রিক পাস করে লেখাপড়ার চেষ্টা না করে পুরোপুরি গানে মনোনিবেশ করেছিলেন।
‘শিপ্রা নদীর তীরে’, ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে ওঠে,
‘কবে আছি কবে নেই’, ‘ঐ যে আকাশের গায়’,
‘বাঁশরিয়া বাঁশি বাজাইও না’, ‘ও দয়াল বিচার করো’, ‘আজি চাঁদনী রাতি’, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’, ‘সেদিন চাঁদের আলো’, ‘কোয়েলিয়া জানে’, ‘মায়ামৃগ সম’ প্রভৃতি কালজয়ী বেসিক গান, ‘মিলন নিশীথে গেল ফিরে’, ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’, ‘সে কুহু যামিনী’, ‘আমি কেন রহিলাম’, ‘ওগো শ্যাম বিহনে’ প্রভৃতি রাগপ্রধান গানের পাশে অপ্রকাশিত গানও যেমন অনেক, তেমনি যেহেতু অখিলবন্ধু ঘোষ নেপথ্যে গাওয়া পছন্দ করতেন না, তাই চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রস্তাব অবলীলায় ফিরিয়ে দিতেন, ফলত চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠদান ‘মেঘমুক্তি’, ‘বৃন্দাবনলীলা’ -এ রকম হাতে গোনা নামমাত্র। মেগাফোন কোম্পানি তাঁর
দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেন,’তুমি মোর পাও নাই’, ‘কার মিলন চাও বিরহী'( যার একটি অপ্রকাশিত ও শিল্পীর মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত)। এছাড়া মেগাফোনে অখিলবন্ধুর রেকর্ড করা নজরুলগীতির মধ্যে ‘রসঘন শ্যাম’, ‘শূন্য এ বুকে’, ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, ‘নীলাম্বরী শাড়ি’,’ হে মাধব’ যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল।
তাছাড়া নিজের গানের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পীর গানেও অখিলবন্ধুর সুরসৃষ্টিও ছিল নজিরবিহীন। ৭৮ আর পি এম রেকর্ডের জে এন জি ৫৮৪০ (১৯৪৭) এবং এইচ ১৩০১(১৯৪৮) নম্বরে যথাক্রমে ‘একটি কুসুম যাবে’ এবং ‘ফাগুনের চাঁদ ডুবে গেল’ গানদুটির গীতিকার অখিলবন্ধু স্বয়ং। এছাড়া অনুপম ঘটক, দুর্গা সেন, দিলীপ সরকার, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, স্ত্রী দীপালী ঘোষ, প্রবীর মজুমদার, রতু মুখোপাধ্যায় সবার সুরেই গেয়েছেন, তেমনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,সুনীল বরণ, মধু গুপ্ত প্রভৃতি গীতিকারদের গানেও তাঁর গাওয়া অসাধারণ গানগুলি আজও চিরস্মরণীয়।
এছাড়া সেই সময়ের অনেক বিখ্যাত গান অখিলবন্ধু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজস্ব ঢংয়ে
গাইতেন, গানগুলো তাঁর কণ্ঠে প্রকাশিত হলে হয়তো গায়নের একটা বিশিষ্ট ধরন শ্রোতাদের সামনে আসতে পারতো কিন্তু কিছুদিন বাদেই গানগুলো অন্যান্য শিল্পীদের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়ে পড়তো, আর অখিলবন্ধুও এসব নিয়েও ভাবতেন না। ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাই রে’ (তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান), ‘কোন দূর বনের পাখি’ (গায়ত্রী বসুর কণ্ঠে প্রকাশিত ও বিখ্যাত), ‘ঝিরিঝিরি ঝরনা বহে’ (অজিত রায়ের কণ্ঠে প্রকাশিত) এসব গান বহু সঙ্গীত জলসায় অসাধারণ ভাবে অখিলবন্ধু পরিবেশন করতেন এবং শ্রোতারা বিমোহিত হতো। এই অজাতশত্রু
অসুয়াশূন্য শিল্পীর গানের খাতা ছাড়া এসব গানের শিল্পীকৃত রেকর্ডিং আজ আর নেই।
জন্মগতভাবে নানাবিধ গুণের অধিকারী হয়েও ক্রমাগত চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করেন। এ ব্যাপারে তাঁর গুণবতী ছাত্রী এবং পরে স্ত্রী দীপালী ঘোষের অবদানও অনস্বীকার্য। ২৫ নম্বর টার্ফ রোডের সংসারটিকে সুখে দুঃখে সঙ্গীতকে নিরন্তর সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রচারবিমুখ লাজুক চাপা স্বভাবের অখিলবন্ধু ঘোষের পাশে এইরকম উজ্জ্বল পরিণতমনস্ক স্ত্রী যিনি নিজে শিল্পী ও সুরকার হিসাবে বিদুষী হয়েও ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর প্রায় ১০ বছর সঙ্গীতচর্চাই সংসার দেখতে বন্ধ রাখেন। অনেক ছাত্রছাত্রীদের গান শেখালেও অখিলবন্ধুর আয় তেমন ছিল না। আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রবৃত্তি না থাকায় মুখ ফুটে বলতেও পারতেন না। ফাংশন, রেকর্ডের আয়ও তেমন ছিল না। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় সারাজীবন হাসিমুখে পাশে থেকে স্বামীকে আজীবন আগলে রাখা এই সুখী দম্পতিকে ঈশ্বর সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তবে সঙ্গীতপ্রাণা দীপালি ঘোষ ব্যক্তিগত জীবনেও সুরসিকা ছিলেন। শেষ জীবনে অখিলবন্ধু ঘোষকে অর্থকষ্টে পড়তে হয়। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামান্য পেনশন ছিল ভরসা। তাও দু একবার বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র সাতষট্টি বছর বয়সে হঠাৎ অখিলবন্ধু ঘোষ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ১৯৮৮ সাল ২০ মার্চ। অণ্ডালে অনুষ্ঠান করে ওইদিন সকালে ফিরে এসে দুপুরে শরীর খারাপ বোধ করায় পি জি হাসপাতালে ঘণ্টাখানেক বিনা চিকিৎসায় তাঁকে ফেলে রাখা হলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন দেখার ব্যবস্থা করা হলো তখন যা হবার হয়ে গেছে। একালের জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী যথার্থই তাঁর ‘পুরোনো দিনের গান’ -এর এক জায়গায় বলেছেন ‘অখিলবন্ধু ঘোষ যতটা প্রতিভাবান/ পেলেন না তাঁর যোগ্য সম্মান ‘; শুধু তাই নয় চলেও গিয়েছিলেন চরম অবহেলা পেয়ে তাও বাঙালীদের কাছেই। ‘সারাটি জীবন কি যে পেলাম’, বা ‘যেন কিছু মনে করো না’, ‘কেন প্রহর না যেতে মরণের বীণা বাজে’ -প্রভৃতি গানের অমোঘ কথাগুলো যে অখিলবন্ধুর নিজের জীবনের কথাই হয়ে উঠবে তা সত্যিই কেউ কি জানতো!
কৃতজ্ঞতাঃ অখিলবন্ধু ঘোষঃ মুখোপাধ্যায় ,সন্দীপ এবং গুগল
(বিঃদ্রঃ- এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য কালের গহ্বরে হারিয়ে ফেলা বরেণ্য এই সুরসাধককে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আরও ভালোভাবে চেনানো। এই লেখার দ্বারা কাউকে কোনোভাবে প্রভাবিত করা বা কারোর লেখার ভাবাবেগ ক্ষুণ্ণ হয়েছে এইরকম কিছু আদৌ না ভাবতে বিনীত অনুরোধ জানালাম।)
সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ
কৃষ্ণচন্দ্র দে
এই সংগীত সাধকের জীবন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কথা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, যখন প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রচারমাধ্যম এতটা উন্নত ছিল না, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় কীভাবে সঙ্গীত জগতে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বতন্ত্র জায়গা তিনি তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় উপেক্ষা করে সেই আমলে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটা সম্পূর্ণ ইন্সটিটিউশন। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয়, রেকর্ডকৃত গানগুলো যেন হৃদয়ের গভীর অন্তস্থল থেকে বেরিয়ে এসে শ্রোতাদের আত্মাকে প্রবলভাবে অনুরণিত করছে। এ যেন সাক্ষাৎ কোনো সাধুর ঈশ্বর ভজনা। আবার এই মানুষটিই যখন মঞ্চ আলোকিত করে অভিনয় করতেন, তখন দেখে কারোরই বোঝার উপায় ছিল না, যে মানুষটির দৃষ্টিশক্তি নেই। ওঁর সংলাপ বলা, হাঁটাচলার স্টাইল, অভিনয় এতখানি সাবলীল ছিল, যে সহ-অভিনেতারাও এই মানুষটির কর্মকুশলতা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হতেন। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার উনি কলকাতা হেদুয়ার ফুটপাত দিয়ে কারোর কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছেন। এক ভদ্রলোক ওঁকে দেখতে পেয়ে নাতিকে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, কানাকেষ্ট যাচ্ছে।’ উনি শুনতে পেয়ে বলেছিলেন,’ঠিক বলেছ ভাই, আমি কানা-ই বটে। তবে শুধু আমি না, উপরে বৈকণ্ঠে বসে যে ব্যাটা মৌজ করছে, সেই কেষ্ট ব্যাটাও তো কানা।’ যাঁর কথা বলছি তাঁর নাম কৃষ্ণচন্দ্র দে। বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে শুধুমাত্র বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র কাকা হিসাবেই জানে। এছাড়াও যে, সে আমলে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র একটা বিরাট পরিচিতি ছিল, বর্তমান প্রজন্ম সেই সম্বন্ধে আদৌ তেমন অবহিতই নয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে কিন্তু সমকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী, নিজে গাইতেন, সুর করতেন, অভিনয় করতেন, শুধু তাই নয় তাঁর সাবলীল অভিনয় -সেকালের যে কোনো চক্ষুষ্মান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকেও ছাপিয়ে যেত, নিজেও অসম্ভব পারফেকশনিস্ট ছিলেন। দর্শক, সহ-অভিনেতা গুণগ্রাহীরা তাঁর করিশমা দেখে অবাক হয়ে যেত। আজকের দিনে এসব ভাবা যায়!

জন্ম সিমলের মদন ঘোষ লেনে ১৮৯৪ মতান্তরে ১৮৯৩। জন্মতারিখ ২৪ আগস্ট। জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম বলে নাম রাখা হয় ‘কৃষ্ণচন্দ্র’। বাবা শিবচন্দ্র, মা রত্নমালা। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন মা-বাবার কনিষ্ঠ পুত্র। ডাকনাম বাবু। ছোটবেলায় পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন, এর পাশাপাশি প্রিয় বিষয় ছিল, গান শোনা, গান গাওয়া, আর ঘুড়ি ওড়ানো। বাড়িতে কীর্তনীয়ারা গান গাইতে আসতো। কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে গানগুলো আত্মস্থ করে খুব তাড়াতাড়িই তা কণ্ঠে ধারণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। একবার গরমের ছুটির সময় বাড়ির ছাদে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একভাবে আকাশের দিকে চেয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন। তখন ফোর্থ ক্লাসে (তেরো বছর বয়সে) পড়ছেন। ইস্কুলে ক্লাস করার সময় অনুভব করলেন চোখে অসহ্য জ্বালা করছে। মেডিকেল কলেজের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তারবাবু
অন্ধত্বের লক্ষণ দেখতে পেলেও সুস্থ করার চেষ্টায় আই ড্রপ দিলেন। ব্যথা তো কমলই না, উপরন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি চিরতরে চলে গেল। ঘুড়ি ওড়ানো, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল, রইলো শুধু গান। তাতেই জীবনকে সঁপে দিলেন। শৈশবে পিতাকে হারিয়েছেন। আর্থিক অভাব-অনটনও অনেকটাই। গান শেখানোর খরচও আছে। মা কিশোর কৃষ্ণচন্দ্রকে জোড়াসাঁকোর কাছে হরেন্দ্রনাথ শীলের বাড়ি রেখে দিয়ে আসতেন, সেখানে সারাদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর চলতো, অনেক নামজাদা ব্যক্তিরা আসতেন। কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো শুনতেন, মা বাড়ি নিয়ে আসলে গানগুলো অবিকল সেই ভাবে গাইতেন। হরেন্দ্রনাথ শীল নিজেও ভালো সুরবাহার বাজাতেন। তিনিই বালক কৃষ্ণচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে রেখে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু। সঙ্গীতশিক্ষার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। প্রথমে খেয়ালিয়া শশীভূষণ ঘোষ, তারপর টপ্পা গায়ক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একে একে কেরামতুল্লা খান, বদল খান, দবির খান, জমিরউদ্দীন খান, মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কীর্তনে রাধারমণ দাস প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত সব শিল্পীদের কাছে সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তালিম নেন। অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তরে অন্য কিছু একটা শক্তি অনুভব করলেন, ঈশ্বর যেন বহির্লোকের দরজা বন্ধ করে অন্তর্লোকের দরজা খুলে দিলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমী, কর্মযোগী, উদ্যমী কৃষ্ণচন্দ্র আপন দক্ষতায় একজন বড় সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠলেন। এমনকি হিন্দি, উর্দু শেখার জন্য নিজে মৌলভী রেখে শিক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। সেকালের কলকাতায় অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিদের বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসতো। নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের বেচারাম চন্দ্রের বাড়িতে ১৯১৬ সালে গুরু কেরামতুল্লা তাঁকে শিল্পী হিসেবে পরিচিত করান। কৃষ্ণচন্দ্র সেদিন বিদগ্ধজনের সভায় খেয়াল গান শুনিয়ে উচ্চ প্রশংসিত হন। আস্তে আস্তে এরকম আরো অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেতে শুরু করলেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে
এইচএমভি থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দের গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়। গান দুটি ছিল, যথাক্রমে-’’আর চলে না চলে না মাগো”, এবং ”মা তোর মুখ দেখে কি।” তবে গানদুটোর একটিও চলেনি। নিজের লেখা গান ‘’দীনতারিণী তারা” এইচএমভি থেকে বেরোনোর পর কৃষ্ণচন্দ্রকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রামোফোন কোম্পানির ভগবতীপ্রসাদ ভট্টাচার্য সেইসময় কৃষ্ণচন্দ্রের গান শুনে মুগ্ধ হন। তারপর থেকে প্রতি মাসে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের একটা করে রেকর্ড বেরোতে শুরু করে, এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় হয়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে স্থায়ী শিল্পী হিসাবে যোগদান করেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে বাংলা আধুনিক গানেও কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই একটা মহীরূহ হয়ে ওঠেন। বাংলার কীর্তনের নিজস্ব ধারাকে অক্ষুণ্ণ করে তারই আদলে প্রচুর বেসিক গান তিনি তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন, সুরারোপও করেছিলেন। ‘স্বপন দেখিছে রাধারানী’,’শতেক বরষ পরে’,’নবদ্বীপের শোভন চন্দ্র’ -র পাশাপাশি ‘ছুঁইয়ো না ছুঁইয়ো না বঁধু’-র মতো পদাবলি কীর্তন, আবার ‘মেঘ হেরি নীল গগনে’, ‘ঘন অম্বরে মেঘ সমুদ্র’,’ঘন ডম্বরু তালে এলো’ প্রভৃতি রাগাশ্রয়ী বাংলা গান, আবার ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকে কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অভিনীত ও গীত), ‘স্বপন যদি মধুর এমন’ বা স্বদেশী আন্দোলনের সময় মোহিনী চৌধুরীর কথায় নিজের করা সুরে ‘মুক্তির মন্দির সোপানো তলে’, বা ’হরে মুরারে মধুকৈটভারে’ প্রভৃতি গানগুলো কৃষ্ণচন্দ্র দের কণ্ঠে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতও রেকর্ড করেছিলেন, যেমন-’তোমরা যা বলো তাই বলো’,’আঁধার রাতে একলা পাগল’, ’হে মহাজীবন’,’আমার যাওয়ার বেলায় পিছু ডাকে’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে উনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা কৃষ্ণচন্দ্রকে পড়ে শোনাতেন, ক্রমশ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিও কৃষ্ণচন্দ্র অনুরক্ত হন। সুধীন্দ্রনাথের অনুরোধে কিছু রবীন্দ্রকবিতায় কৃষ্ণচন্দ্র সুরও বসিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো নেহাৎই ঘরোয়া পরিবেশে, তার কোনো রেকর্ড বা সেইসব সুরের কোনো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। যদি সেটা করা যেত, বাংলা সংগীত যথেষ্ট উপকৃত হতো, সেটা বলবার অপেক্ষা রাখে না। কৃষ্ণচন্দ্রের গানে কাব্যিক ভাব, আর অপূর্ব প্রেমমাধুর্যের এক রসঘন সুরমূর্চ্ছনা শ্রোতাদের এক অনাবিল আবেশে আচ্ছন্ন করে রাখতো, এবং এত বছর পরেও তার কোনোই ব্যতিক্রম হয়নি। পরবর্তীকালে
তাঁর প্রিয় ভাইপো ও শিষ্য মান্না দে(প্রবোধচন্দ্র দে) কাকার স্মরণে ‘স্বপন যদি মধুর এমন’,’ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’,’জয় সীতাপতি’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’ প্রভৃতি গানগুলো রেকর্ড করেছিলেন, এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। পাঠকেরা ভেবে দেখুন, তখনকার দিনে আজকের মতো প্রচারমাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না, কম্পিউটার, স্মার্টফোন আসেনি, youtube ছিল না, মিউজিক সিস্টেম, রেকর্ড করার যন্ত্রপাতি এত উন্নত ছিল না, তার মধ্যেও এইসব সঙ্গীত সাধকরা কী অনায়াসে তাঁদের সেরাটুকু আপামর শ্রোতাদের কাছে উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তুলনায় প্রতিদানে কিছুই পাননি বললেই চলে,পাওয়ার ভাবনাও তাঁদের মধ্যে ছিল না, ছিল শুধু নিরন্তর সাধনা আর সাধনা। মিষ্টভাষী, সদাহাস্যজ্বল, গৌরবর্ণের দেদীপ্যমান সুপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র সুন্দর বেশভূষা পছন্দ করতেন। জীবনের কোনো কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করেননি। মানুষের ব্যবহারে মর্মাহত হলেও নিজের অপূর্ব ক্ষমাগুণে তা মাফ করে দিতে পারতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম মঞ্চাভিনয়, ১৯২৪ সালে শিশির ভাদুড়ির আমন্ত্রণে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ‘বসন্তলীলা’ নাটকে বসন্তদূত চরিত্রে। তিনি মিনার্ভা, রংমহল, নিউ থিয়েটার সব জায়গাতেই কাজ করেছিলেন। থিয়েটারে অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে ‘সীতা’,’প্রফুল্ল’,’চন্দ্রগুপ্ত’,’জয়দেব’,
’দেবদাসী’, এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক উল্লেখযোগ্য। এই নাটকের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে গানও শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। থিয়েটারের পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও গান গাওয়ার পাশাপাশি সফলভাবে অভিনয়ের দক্ষতাও দেখিয়ে গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তখন নির্বাক থেকে সবাক যুগ আসতে শুরু করেছে।
১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ অবধি সিনেমার গান করেছিলেন ও তাতে সুরও দিতেন।
দেবকী বসুর ‘চন্ডীদাস’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্যাপতি’,’আলোছায়া’,’ভাগ্যচক্র’,
’বামুনের মেয়ে’,’গৃহদাহ’,’চাণক্য’,’পূরবী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সার্থকতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ‘চন্ডীদাস’ সিনেমায় ‘ফিরে চলো আজি আপন ঘরে’,’সেই যে বাঁশি বাজিয়েছিলে’,’শতেক বরষ পরে’ গানগুলো খুবই সাফল্য পায়। এই চলচ্চিত্রে কৃষ্ণচন্দ্র নায়ক দুর্গাদাসের বন্ধু অন্ধগায়ক শ্রীদামের চরিত্রে অভিনয় করে জমিয়ে দেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রণব রায়, বাণীকুমার, শৈলেন রায় প্রভৃতি গীতিকারদের গানে যেমন কাজ করেছেন, তেমন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরেও গান রেকর্ড করেছেন। রেকর্ড, নাটক, সিনেমা থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের আয় ভালোই হতো, তবে তার অধিকাংশটাই সংগীতের উন্নতিকল্পে ব্যয় করে গেছেন। অনুষ্ঠান করার জন্য যা পারিশ্রমিক পেতেন, তার পরিমাণ যত কম বা বেশিই হোক না কেন, অনুষ্ঠানের মধ্যে তা কখনোই খুলে দেখতেন না।
নিজের তিন ভ্রাতুষ্পুত্র -প্রণব দে,প্রবোধ দে, প্রভাস দে তাঁর সার্থক উত্তরসূরী। পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ সুরকার, গায়ক
কুমার শচীন দেববর্মনকে পাঁচ বছর সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাংলা হিন্দি গুজরাটি উর্দু ,আটটি নাৎ মিলিয়ে প্রায় ছশো মতো গান রেকর্ড করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। ১৯৪২ সালে অভিনয়ের জন্য দুই ভাইপো- প্রণব, প্রবোধকে নিয়ে তিনি বোম্বে(মুম্বাই) চলে যান, সেখানে বাড়ি কেনেন, এবং অভিনেতা, গায়ক সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসাবে নিজের পায়ের জমি শক্ত করেন। এখানে তিনি পরিচিত হন কে সি দে নামে। বোম্বাইতে মান্না দে-র প্লে-ব্যাকে গান গাওয়ার হাতেখড়ি তাঁর এই বাবুকাকার হাত ধরেই। ১৯৪২ সালে ‘তমান্না’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে মান্না দেকে সুরাইয়ার সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ান। অভিনয়ের পাশাপাশি
সুরস্রষ্টা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র কিশোরকুমার, মুকেশ, মহম্মদ রফিকে দিয়ে বোম্বেতে বেশ কিছু সিনেমায় গান গাইয়েছিলেন।
বোম্বেতে অল্প সময়ের মধ্যে বেশ নাম করলেও ১৯৪৬ সালে একরাশ দুঃখ নিয়ে ওখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন। বোম্বাইতে কিছু মানুষকে বিশ্বাস করে তাদের দ্বারাই তিনি
ভীষণরকম ভাবে প্রতারিত হন। তবে কলকাতায় এসে বাংলা সিনেমায় প্রযোজনা করতে থাকেন, তাতে সাফল্যও আসে। ১৯৫৭ সালে ‘একতারা’ চলচ্চিত্রে শেষবারের মতো (অতিথি শিল্পী হিসাবে) তাঁকে দেখা যায়।
অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এখানেই চারুচন্দ্র বসুর কন্যা তারকবালার (মিস লাইট নামে পরিচিত ছিলেন) সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম আলাপ হয়। পরবর্তীকালে রংমহল থিয়েটারে কৃষ্ণচন্দ্র দের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন মিস লাইট। দুজনে গোপনে শাস্ত্রমতে বিবাহ করেছিলেন বলে শোনা যায়। বিবাহিত জীবনে মিস লাইটের নাম ছিল রমা দে। তাঁদের এক সন্তানও ছিল। কিন্তু মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ছেলেটি মারা গেলে দুজনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণচন্দ্র বলে গেছিলেন, স্ত্রী তারকবালাকে যেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যায়টুকু দেওয়া হয়,(যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি) এবং কৃষ্ণচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর বাড়ির সম্পূর্ণ অংশীদার তারকবালাই থাকেন।
এবার কলকাতা বেতারের কথায় আসি। ১৯৩৬ সালে ৮ ই জুন কলকাতা কেন্দ্রের সূচনা হলে কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিতীয় শিল্পী হিসাবে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়ে ধ্রুপদী গান গেয়েছিলেন। তাছাড়া বাংলা গানে তিনিই ঠুংরি, খেয়াল, গজল ব্যবহার প্রচলন করেন। কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল প্রভৃতি গানে যশস্বী হলেও নিজেকে কীর্তনীয়া হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালের সংগীতশিল্পীরাও তাঁকে
শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ বয়সের গাওয়া কোনো গান পুনরায় রেকর্ড করতে বলা হলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ’যে গান কৃষ্ণচন্দ্র দে গেয়েছেন, সেখানে আমি আর সেই গান কী গাইবো!’ পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটি আর রেকর্ড করেননি। শচীন দেববর্মন, মান্না দে প্রমুখেরাও নানা স্মৃতিকথায় এই মহান সাধককে নানা ভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন।
শেষের দিকে ওঁর গান তেমন হিট হতো না। মাত্র ঊনসত্তর বছর বয়সে ১৯৬২ সালে ২৮ নভেম্বর কলকাতাতেই মারা যান কৃষ্ণচন্দ্র। সেইসঙ্গে একটা বর্ণময় যুগের অবসান ঘটে। সংগীতশিল্পী, সুরকার, প্রযোজক, অভিনেতা, নট এতগুলো ভূমিকায় একচ্ছত্র ভাবে একটা সময় কাজ করে গেছেন, সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু এরসঙ্গে সারাটা জীবনেই ছিল শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণা। তাই গানগুলো সেই সময় হিট হলেও তিনি কিন্তু কোনোদিনই কোনো আত্মশ্লাঘায় ভোগেননি। জীবনটাকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন। সাফল্য আর ব্যর্থতা জীবন-মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। পাওয়া, না-পাওয়া সবকিছুই তিনি প্রাণের ইষ্টদেবতা শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেছিলেন। গানই হয়ে উঠেছিল তাঁর আরাধ্য পরমেশ্বর, শ্রোতারাই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরম সখা। তাই শত্রুকেও পরম মিত্রভাবে ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন, ঈশ্বরের নামগানের মধ্যেই, যে ঈশ্বরের মানুষের মধ্যেই বাস, মানুষের মনই যেখানে তাঁর আরাধ্য মন্দির। ‘’অন্তর মন্দির মাঝে” – তাই সারাজীবন তাঁরই খোঁজ করে গিয়েছেন সুরের পথিক কৃষ্ণচন্দ্র। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এই মহান পুরুষকারকে আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
ও কেন গেল চলে
পঙ্কজকুমার মল্লিক
তিনের দশক। এক সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে খবর গেল, একটি যুবক কবির ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ খেয়া’ কবিতাটি নিজে সুর দিয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানে সুর দিতে গেলে যে কবির অনুমতি লাগে, যুবকটি সেটা জানতো না। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে রথীন্দ্রনাথ একেবারে জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠালেন। সেই প্রথমবার। রবীন্দ্রনাথকে দুরু দুরু বুকে গানটি শোনালে কবি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। কেমন লাগলো জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। তারপর অনেক বছর পরে আরেকবার। যথা সময়ে কবির কাছে রেকর্ডকৃত গানটি পৌঁছেও গেল। সেবার রবীন্দ্রনাথ নিজে এসে দেখা করলেন ।
সেদিন সে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বরানগরের বাড়ি ‘আম্রপালি’তে কবিগুরুকে গানটি শোনালে তিনি খুশি হয়ে গানটি চলচ্চিত্রে ব্যবহারের অনুমতি দেন। তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা শুরু হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিতে হতো।
রবীন্দ্রনাথের সব গানের কথা ও সুর তাঁর নিজেরই। যে সময়, অন্য কেউ তাতে সুর বসালে কথা পরিবর্তন করলে সেটা কবিগুরুকে অবমাননার সামিল হতো, সেই সময় দাঁড়িয়ে এই যুবকটি বাংলা চলচ্চিত্রে উক্ত গানটি ব্যবহারের জন্য কবির সম্মতি আদায় করেছিলেন, সে সময় ব্যাপারটা বেশ দুঃসাহসিক ছিল।
শুধু তাই নয়, আরো রবীন্দ্র-কবিতায় সুর করার সম্মতিও কবির থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিনের এই যুবকটির নাম পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পরবর্তীকালে একরকম তাঁর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে তবলার সঙ্গত করা, এমনকি হারমোনিয়াম, পিয়ানোসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে আধুনিকতা দেখানো, অর্কেস্ট্রেশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রপরিমণ্ডলের বাইরে বৃহত্তর জনমানসে রবীন্দ্রসঙ্গীত আরও জনপ্রিয় করতে পঙ্কজকুমার মল্লিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া গায়ক হিসাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, গীত, আধুনিক গান, লোকগান সবই গেয়েছেন।

সিনেমাটির নাম ছিল ‘মুক্তি’। সিনেমার গল্প তার মুখে শুনে কবিগুরুই এই নাম দেন। সিনেমার প্রয়োজনে ‘দিনের শেষে’ গানটির কিছু কথা পরিবর্তনের পরামর্শও দেন, এছাড়া ‘আমি কান পেতে রই’,’তার বিদায়বেলার মালাখানি’ গানদুটিও রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে ‘মুক্তি’ সিনেমায় ব্যবহার হয়েছিল। সিনেমাটিতে গানদুটো পঙ্কজ মল্লিক আর কানন দেবী গেয়েছিলেন। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি সিনেমায় পঙ্কজকুমারই গেয়েছিলেন। এইভাবে পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া, পঙ্কজ মল্লিক, কানন দেবী এঁদের হাত ধরে বাংলা সিনেমায় প্রথম ব্যবহৃত হয় এই তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিষয়টা আজকে ভাবলে অনেক সহজ মনে হবে। কিন্তু সেই দিনের কথা ভাবলে ব্যাপারটা বেশ বৈপ্লবিক এবং সাহসেরও ছিল। বর্তমান প্রজন্ম পঙ্কজকুমার মল্লিককে সেই ভাবে চেনেই না। চিনলেও বড়োজোর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সুরকার হিসাবে। ব্যস, ওইটুকুই। কিন্তু সেই দিনে পঙ্কজকুমার মল্লিকই ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী এসব পরিচয় বাদ দিয়েও এই বিনয়ী, নম্র, সদাশয় মানুষটির বিবিধ কর্মকাণ্ড আজ অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন।
জন্ম কালিঘাট। ১০ ই মে, ১৯০৫। বাবা মণিমোহন মল্লিক, মা মনোমোহিনী দেবী। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবার। বাবার থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর এই অনুরাগ তৈরি হয়। বাবার ইচ্ছেয় গান শেখা শুরু পণ্ডিত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। সেখানেই ‘চয়নিকা’ বই থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। পরিচিতমহলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো সুর করে গেয়ে বেড়াতেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বঙ্গবাসী কলেজ, আর সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে সঙ্গীতেই আত্মনিয়োগ করেন। ওই সময়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পঙ্কজ মল্লিকের সখ্য গড়ে ওঠে। দিনু ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে নাতি, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকার ও সঙ্গীত প্রশিক্ষক ছিলেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি পঙ্কজকুমারের আগ্রহটাও বাড়তে থাকে। প্রথম গান, ১৯২৬ সালে ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করা ‘নেমেছে আজ প্রথম বাদল’। ১৯৩১-এ রেকর্ডকৃত প্রথম রবীন্দ্র গান ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন’ আর ‘তোমার আসন শূন্য আজি’।
সেই সময় মধ্যবিত্ত পরিবারে গান গেয়ে জীবনযাপন করাটাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। তাছাড়া তখন পঙ্কজ মল্লিকের পরিবারের অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। আর্থিক কারণে বন্ধুর দোকানে দর্জির কাজ, রেলের অফিসে কেমিস্টের কাজ, এমনকি পাটের দালালি পর্যন্ত করতে হয়েছে। পরিবারে চল্লিশ জন মানুষ। সবার ভরণপোষণের চিন্তা মাথায় নিয়েও শুধুমাত্র অধ্যাবসায়, বিশ্বাস, আর সাহসের জোরে, পঙ্কজকুমার মল্লিক রেকর্ডে গান গাওয়া শুরু করেন। ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে কাজ শুরু করেন। পরে এই সংস্থার নাম হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও। এই আকাশবাণীতে অর্ধশতক কাল নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেছিলেন। রেডিওতে নাট্যকার হিসাবে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো- সঙ্গীত শিক্ষার আসরও পরিচালনা করা। সেখানে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাছাড়া নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে পঁচিশ বছর কাজ করেছিলেন। ১৯৩১ সালে বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, রাইচাঁদ বড়াল, আর পঙ্কজকুমার মিলে মহালয়ার দিনে বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু করেন। ১৯৩১ থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। যেমন- নেপথ্য কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার, ইন্টারল্যুডের ব্যবহার, দৃশ্যপট অনুযায়ী গানের আবহ তৈরি, উপযুক্ত গানের নির্বাচন ইত্যাদি। রাইচাঁদ বড়াল, নীতিন বোস এবং তিনি এই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, তামিল, উর্দু চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। কুন্দনলাল সাইগল, প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী প্রভৃতি কিংবদন্তীর সঙ্গে অভিনয়ও করেছেন যেমন, তেমনই আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, শচীন দেব বর্মন প্রভৃতি শিল্পীদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো পঙ্কজ মল্লিককে গুরু মানতেন। হেমন্তের প্রথম দিকের রেকর্ডকৃত গানগুলোয় পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁকে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলা হতো। পরে হেমন্ত গুরুর প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব গায়কী তৈরি করেন এবং যশস্বী হোন।
কে এল সায়গলকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো এবং সিনেমায় তা গাওয়ানো, কবিগুরুর অনুমতি নেওয়া – এ সবকিছুর কৃতিত্ব পঙ্কজ মল্লিকেরই। কিন্তু তিনের দশকের শুরুর দিকে বেতারে শিল্পী ও সুরকার হিসাবে পঙ্কজকুমার এবং রাইচাঁদ বড়াল দু’জনে একসঙ্গে কাজ করলেও টাইটেল কার্ডে রাইচাঁদের নামটাই বড় করে থাকতো। প্রমথেশ বড়ুয়া আসার পর তিনি বিষয়টা লক্ষ্য করে নিউ থিয়েটারর্সের বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে জানালে ‘মুক্তি’ সিনেমার সময় থেকে এই অবস্থার বদল হয়, অফিসও আলাদা করে দেওয়া হয়। যেহেতু দুঃসময়ে নিউ থিয়েটার্স তাঁর পাশে ছিল, কোনো প্রলোভনেই পঙ্কজকুমার নিউ থিয়েটারর্স ছাড়েননি। তখন বাংলা শিল্পীরা বোম্বে চলে যাচ্ছে। বোম্বে যাওয়ার পঙ্কজ মল্লিককে প্রস্তাব আসলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাজ কাপুর, জার্মান পরিচালক পল জিলস কেউই তাঁকে এই সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। কিন্তু কিছুদিন বাদে অর্থাভাবে নিউ থিয়েটারস বন্ধই হয়ে গেলে পঙ্কজ মল্লিক ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে বিনোদন বিভাগের উপদেষ্টা হিসাবে যুক্ত হন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ‘লোকরঞ্জন শাখা’য় যোগ দিয়েছিলেন।
প্রায় পাঁচ হাজারের মতো গানে সুরারোপ করেছেন, দেড়শোর মতো চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। ডাক্তার, মুক্তি প্রভৃতি তাঁরই অভিনীত চলচ্চিত্র। পরবর্তীকালে বাংলা না ছাড়াটাই পঙ্কজ কুমার মল্লিকের ভুল হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে তদানীন্তন সরকারের চাপে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রেডিওয়ে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর (১৯৩১ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি মহালয়ার দিন ভোরে রেডিওতে সম্প্রচারিত হতো, এরমধ্যে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ অবধি প্রত্যেকবার পরিমার্জন করা হতো, ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সকাল চারটে থেকে বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হতো, তবে ১৯৬৬ সালের পর থেকে রেকর্ডিং চালানো হয়, এখন আমরা যেটা শুনি সেটা ১৯৬৬ সালে রেকর্ড করা।) বন্ধ করে দেয়া হলো,
(জনগণের বিপুল রোষ আর বিক্ষোভের কারণে পরের বছর থেকে আবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হয়, আজও সেটাই চলছে) এবং যে সংগীত শিক্ষার আসরে সাতচল্লিশ বছর ধরে গান শিখিয়ে এসেছেন, কেন্দ্রীয় অধিকর্তা হঠাৎ অনুষ্ঠানটি বন্ধ করার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। দুটো ঘটনাই ওঁকে খুব আঘাত দিয়েছিল। ১৯৩১য়ে সুরসাগর, ১৯৬২তে সঙ্গীত রত্নাকর, ১৯৭০য়ে পদ্মশ্রী, ১৯৭২য়ে দাদাসাহেব ফালকে, ১৯৭৭য়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতাচার্য পাওয়া, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর সরাসরি অনুরোধে প্রথম ‘জনগণমন’ গাওয়া এবং রেকর্ড করার বিরল কৃতিত্ব যাঁর হয়েছিল, ১৯৫৯ ভারতীয় দূরদর্শনের উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন যে পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর জন্যে শেষের দিকে ওই কষ্টগুলো কি না পেলেই চলত না! পঙ্কজ মল্লিক মাত্র বাহাত্তর বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৮ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী মারা যান। ‘প্রিয়া মিলন কো জানা’(কপালকুণ্ডলা, হিন্দি), ‘ও কেন গেল চলে’, ‘চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পথে’, ‘জনম মরণ জীবনের দুটি দ্বার’, ‘চলে যায় মরীচিকা মায়া’,‘কব তক নিরাশ কি অন্ধিয়ারি’,’আয়ি নিত ন্যায়ি রুত কি বাহার আয়ি’,’মাহাক রাহি ফুলওয়ারি হামারে কি’(ডাক্তার,হিন্দি), ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মওসম’,’দো নাইয়া মতওয়ারে’(মাই সিস্টার), ‘গুজর গায়া ওহ জামানা’- অজস্র গানের মধ্যে থেকে পঙ্কজ মল্লিকের স্বকণ্ঠের কিছু গান। জলদগম্ভীর আওয়াজ, অনন্য স্বরক্ষেপন, গভীর সুরেলা ভাব -পঙ্কজকুমার মল্লিকের গানের বৈশিষ্ট্য। তাঁর গান শুনলে শ্রোতারা আজও একটা নিবিড় আবেগে সংপৃক্ত হন। নিজেও খুব নিষ্ঠাবান এবং শৃঙ্খলাপরায়ন জীবনযাপন করতেন। কোনোদিন তার অন্যথা করেননি। কিন্তু উনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীতের অনেক উপকার হতো।
শেষের কিছু কথা:
কিছু কথা শেষ হলেও শেষ হয় না। যেমন- পঙ্কজ মল্লিক স্মরণে কলকাতার রিচি রোডের নাম ‘পঙ্কজ মল্লিক সরণি’ রাখা হয়েছে। ২০০৬ সালে তাঁর নামে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১০ য়ে ম্যাডক্স স্কোয়ার পার্কে কলকাতা মিউনিসিপালিটি তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করে। জন্মশতবর্ষে তাঁর বাসভূমি ২/২ সেবক বৈদ্য স্ট্রিট, ডোভার টোরেস, বালীগঞ্জ, কলিকাতা-৭০০০১৯ -এই ঠিকানায় পঙ্কজ মল্লিক মিউজিক আর্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশন স্থাপন করা হয়।
লকডাউনের সময় সাম্প্রতিক সময়ে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া কিছু লাইভ কনসার্টের রেকর্ড আহমেদাবাদ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি ও গুজরাটি সংস্করণ, যা সারা ভারতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করবার জন্য পঙ্কজ মল্লিক গেয়েছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ -র মধ্যে। দর্শকদের অনুরোধে বাংলা রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলোর পাশাপাশি হিন্দি ও গুজরাটি অনূদিত গানগুলো গেয়েছেন। গানগুলো ছিল-’এমনদিনে তোরে বলা যায়’,’সঘনগহন রাত্রি’,’হে মোর দেবতা’,’এসো হে বৈশাখ’, ‘তুমি কেমন করে গান করো’।
ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
গানের অনুষ্ঠান চলছে। শিল্পীর কাছে বিভিন্ন রকম গানের অনুরোধ আসলেও তিনি কিন্তু সেসব গানের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের গান কিছুটা জোর করেই শ্রোতাদের শোনাচ্ছেন। এ নিয়ে কার্যকর্তারা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে দমানো যাচ্ছে না। কিছু সময় লাঞ্ছিতও হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, তবু হার মানেননি। তখন সময়টা এমন, যে বিদ্রোহী কবিকে মানুষ কার্যত ভুলতে বসেছে, ভুলতে বসেছে তাঁর অমর সৃষ্টি সেইসব অসাধারণ গানগুলোকেও। মানুষটি মনে মনে খুব ব্যথা পেয়েছিলেন। অন্তরের এই কষ্ট থেকেই শপথ নিয়েছিলেন যে, যে করেই হোক, নজরুলের গানের সেই হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনবেনই। এনেও ছিলেন। পাঠক বুঝতেই পারছেন, যাঁর কথা বলছি, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিল। গানটাকেও প্রাণ দিয়েই ভালোবাসতেন। গানের কথা আর সুর ছিল তাঁর অন্তরের আবেগ। তাই গানের অমর্যাদা তিনি সইবেন কেন! কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি নজরুল। কিশোর বয়সে মধুর কণ্ঠে কীর্তন শুনে নজরুল ওঁকে তাঁর লেখা দুটো গান শিখিয়েছিলেন, ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’, ‘হে মাধব, হে মাধব’। এসব তো গেল আগের কথা।
সময়টা এমন, কবি অসুস্থ হওয়ার সুবাদে কবির গানও মানুষ ভুলতে বসেছে। সন্তোষ সেনগুপ্ত সেইসময়ই গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিং অফিসার হয়ে আসেন। উনি পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করে
‘বেস্ট লাভ সং অব নজরুল’ নামে যে এলপি বার করেন, তাতে মানবেন্দ্রকে দিয়ে দুটো গান গাওয়ালেন,’এত জল ও কাজল চোখে’, আর ‘বউ কথা কও।’ এত হিট হলো, যে স্পেশাল ইপি হলো।
‘ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান’ রেকর্ডের লেবেলে প্রথমবার লেখা হলো ‘নজরুলগীতি’ (আগে লেখা হতো, ‘সংঙস অব কাজী নজরুল’ অথবা কথা ও সুর-কাজী নজরুল ইসলাম)। নজরুল রচিত প্রকৃত গানের সংখ্যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেয়েও অনেকটাই বেশি(সাত আট হাজার মতো)।

তবে এত অসংখ্য গান লিখলেও গানের হদিশ নেই। নজরুলও তখন অসুস্থ, বাকরুদ্ধ। হারিয়ে যাওয়া নজরুলগীতির এনসাইক্লোপিডিয়া বিমান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাগ্যিস মানবেন্দ্রের যোগাযোগ হয়েছিল। ব্যস। বিদ্রোহী কবি নজরুলের অমর সৃষ্টি আবার জনমানসে নতুনভাবে আগ্রহ তৈরি করলো, আর তা সম্ভব হলো মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের এক অপরিসীম চেষ্টার ফলে। ‘ভরিয়া পরান, শুনিতেছি গান’,’কুহু কুহু কোয়েলিয়া’,’বাগিচায় বুলবুলি তুই’-একের পর এক নজরুলগীতির বিখ্যাত সব রেকর্ড, মানবেন্দ্র হয়ে উঠলেন নজরুল সঙ্গীতের এক অনন্য পথ প্রদর্শক।
তবে নজরুলগীতির পাশাপাশি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন কঠিন রাগ-রাগিনীর গান খুব অনায়াস সাবলীলতার সঙ্গে গাইতে পারতেন, আর গুণমুগ্ধ শ্রোতারাও তাতে সম্মোহিত হয়ে পড়তেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতও শিখেছিলেন, তাও আবার দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশের পাখি’ গানটি গেয়ে সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিলেন। কিন্তু জর্জ বিশ্বাসের নির্দেশানুসারে পরবর্তীকালে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাননি। গাইলে সেটা এই প্রজন্মের অগণিত সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের কাছে একটা শিক্ষনীয় বিষয় হয়ে থাকতো।
নিজে যেমন বাংলায় সব সুরকারদের সুরেই গান গেয়েছিলেন, তেমনি মানবেন্দ্রবাবুর সুরেও অনেক তাবড় তাবড় শিল্পী গান গেয়েছেন। গীতিকার বন্ধু শ্যামল গুপ্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির লেখা গান মানবেন্দ্র-কণ্ঠের মণিমাণিক্যে আজও চিরভাস্বর হয়ে কানে বাজে।
উল্লেখ্য, যে, পরিচালক নির্মলচন্দ্র দে-র ‘চাপাডাঙার বউ’ সিনেমায় সুর সংযোজনার কাজ শুরু করেন। গল্পের কাহিনীকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নবীন সুরকারকে দেখে প্রথমে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মানবেন্দ্র তাঁর সামনেই সিনেমার সিচুয়েশন জিজ্ঞেস করে কথাশিল্পীর সদ্য রচিত দুলাইন লেখা গানে সুর করে ফেলেন, যা দেখে তারাশঙ্কর অত্যন্ত বিস্মিত হন। এভাবেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরকার হিসেবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠালাভ। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় অভিনয় করলেও আর কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি। ‘জলসাঘর’ সিনেমার সত্ত্ব তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন মিউজিক্যাল বায়োস্কোপ বানাবেন বলে। তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। সত্যজিৎ রায় পরে এই সিনেমাটি করেন।
আপাদমস্তক সঙ্গীতপাগল মানুষটি
অনেক কঠিন কঠিন গান অনায়াসে গাইতে পারতেন। গানই ছিল তাঁর অন্তরের আবেগ। গানের ভাবের অতলে গিয়ে তিনি যেমন কেঁদেও ফেলতেন, তেমনি গানের কথা, সুর ভালো না হলে চিৎকারও করতেন। যেমন, নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘বনে নয় মনে মোর’ রাগাশ্রয়ী এই গানটির রেকর্ডিংয়ের সময় গানের মুখড়াটা একদমই পছন্দ হচ্ছিল না, তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীকে দিয়ে মানবেন্দ্র গানের ওই অংশে তবলার বাজনা যোগ করেন। বাকিটা ইতিহাস। কিংবদন্তী সুরস্রষ্ঠা নচিকেতা ঘোষও আনন্দে আবেগে আপ্লুত। এত বছর পরেও সেদিনের সেই রাগাশ্রিত গানটি আজও বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের মুখে মুখে ফেরে।
আরেকবার সলিল চৌধুরী তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে একটা গান তোলাচ্ছিলেন, গানটা এত কঠিন ছিল যে লতাজি বলেছিলেন, এ গান কারো পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। সলিল চৌধুরী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিলেন, বাংলায় এ গান আগেই একজন রেকর্ড করে ফেলেছেন। তাঁর নাম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাংলা ভার্সনে গানটা ছিল, ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’,(উল্টো পিঠে ছিল ‘যদি জানতে গো’)। অসম্ভব একটি কঠিন তাল-লয়ের গান। অনেক পরে কলকাতায় এলে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে চিনতে কিন্নরকণ্ঠীর কোনোই অসুবিধা হয়নি। গজলসম্রাট মেহেদি হাসানও কলকাতায় এসে পরম শ্রদ্ধা নিয়ে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন।
আগেই বলেছি বাড়িতে রীতিমতো গানের পরিবেশ ছিল। কালীঘাটে জন্মালেও মানবেন্দ্রের আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশে বরিশালের উজিরপুরে। রাধাকৃষ্ণের কীর্তন, মনসামঙ্গলের গান তাঁদের বাড়ির চন্ডীমন্ডপে লেগেই থাকতো। ঠাকুর্দা গজেন্দ্রনাথ কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। দু’জনের সখ্যও ছিল বেশ। গজেন্দ্রনাথ নিজেও ভালো গান গাইতে পারতেন। বাবা অতুলচন্দ্রও সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। কাকা রত্নেশ্বর এবং সিদ্ধেশ্বর তো বেশ নামকরা শিল্পী ছিলেন। এই ‘মুখুজ্জে’(মুখার্জি) পরিবারে কীর্তন এবং ধ্রুপদী গানের চর্চা ছিল। কিশোর পল্টন(মানবেন্দ্রে রডাকনাম) কাকাদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে মাথুর, রূপানুরাগ, শ্রীরাধিকার মানভঞ্জন প্রভৃতি গানে খুব অল্প বয়স থেকেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
কলকাতায় থাকলেও সারাটা জীবনই জন্মভূমির দেশ-গাঁয়ের প্রতি মানবেন্দ্রের এক অমোঘ টান ছিল।
জন্ম ১১ আগস্ট ১৯২৯। কলকাতার বাড়িতে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় আসতেন। তাছাড়া জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, চিন্ময় লাহিড়ী, রবিশঙ্কর, আলী আকবর খান প্রভৃতির সংস্পর্শে মানবেন্দ্রের জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তীকালে মানবেন্দ্র নিজেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ, টপ্পা, কীর্তন সব ধরনের গান খুব সাবলীল ভাবেই গাইতে পারতেন। তাঁর সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদারের খুব নামডাক ছিল। মানবেন্দ্র ওঁকেই আদর্শ বলে মনে করতেন, রবীন মজুমদারের স্টাইলে সরু গোঁফ রাখতে শুরু করেন। ভেবেছিলেন রবীন মজুমদারের মতোই গান এবং অভিনয় দুটোই করবেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমাতেই অভিনয় শুরু এবং ওখানেই শেষ। মানুষ যা ভাবে, বিধাতা হয়তো অন্যকিছু ভেবে রাখেন। টালিগঞ্জের বাঙালপাড়ায় একসময় মহানায়ক উত্তমকুমার(তখন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) মানবেন্দ্রর কাছে তবলা শিখতেন। সেই থেকে ওঁদের বন্ধুত্বের শুরু। উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘দেয়া-নেয়া’,’মায়ামৃগ’ প্রভৃতি সিনেমায় কাজও করেছেন। ‘মায়ামৃগ’ সিনেমার ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়। এই সিনেমার সুরসৃষ্টিও তাঁর নিজের। শ্যামল গুপ্তের লেখা ‘মেটারিয়া মেডিকার কাব্য’, বা ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানগুলো তৈরীর ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ। আর ঠিক ততটাই চমকপ্রদ যে আজও এই গানগুলোর জন্যে শ্রোতাদের মনে একইরকম জায়গা রয়েছে। ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা’,’ওই মৌসুমী মন শুধু রং বদলায়’,’না যেও না মধুযামিনী’, ‘যার চুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে’, ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’, ‘বিরহিণী চিরবিরহিণী’ এইসব কালজয়ী বাংলা গানের পাশাপাশি চাঁপাডাঙার বউ’,’মণি ও মানিক’(১৯৫৪), ‘সাঁঝের প্রদীপ’(১৯৫৫),’উত্তরপুরুষ’(১৯৬৬) ’দেবী চৌধুরানী’(১৯৭৪),’ইন্দিরা’(১৯৮৩) প্রভৃতি বাংলা চলচ্চিত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে সুরসংযোজনা করেছেন। মানবেন্দ্রের যাদবপুরের নর্থ রোডের বাড়িতেও গানের মহড়া বসতো। মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত প্রভৃতি মানুষ কে না যেতেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় এসে মানবেন্দ্রর গানে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি কবি নজরুলকেও (তখন অসুস্থ মূক ও বধির) ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে গিয়ে ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ শুনিয়েছেন। এছাড়া ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, পণ্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রীও মানবেন্দ্রের সুমধুর কণ্ঠযাদুতে মুগ্ধ হয়েছেন। পঙ্কজ মল্লিক, বাণীকুমার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকৃত মহালয়ার দিনে প্রচারিত বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তে ‘তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা’ আজও আগের মতোই মুগ্ধকর। উল্লেখ্য, ‘দেবী দুর্গতিহারিণী’-তেও মানবেন্দ্র কণ্ঠদান করেছিলেন। বাংলার সঙ্গীত মহল অনেক বেশি ভালোবাসতেন, নিজে অ্যামেচারিস্ট, ভাবুক ছিলেন বলে নিজের ব্যাপারে অতটা ভাবতেন না। কলকাতাতেই থেকে গিয়েছেন, বম্বে যাননি। খুব একটা চেষ্টাও করেননি। করলে বোম্বের ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে হিন্দি চলচ্চিত্রেও গায়ক এবং সুরকার হিসেবে আমরা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে আরো ব্যাপকভাবে পেতাম। উনি যে রকম প্রতিভাবান ছিলেন, বিভিন্ন জটিল সুরের গানকে যেমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে পরিবেশন করতেন, সেই অনুযায়ী সম্মান বা কাজ তাঁর যে অনুপাতে পাওয়া উচিত ছিল, তা তাঁকে দেওয়া হয়নি, বা নিজেও অতকিছু ভাবেননি। সঙ্গীতকেই ভালোবেসেছেন, তাতেই মনপ্রাণ সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছেন। আর কিছু চিন্তা করেননি।
নিজের জীবনেও মানবেন্দ্র বেশ হৃদয়বান, উদার মনের ছিলেন। স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়, এবং একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ছিল সংসার।
হার্ট অ্যাটাকে মাত্র বাষট্টিতেই
মৃত্যু ১৯ শে জানুয়ারী ১৯৯২ সালে।
আদরের কন্যা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী মানসী মুখোপাধ্যায়ও আজও তাঁর সংগীতসাধক পিতার স্মৃতি বহন করে চলেছেন। এই কিংবদন্তী সঙ্গীত সাধককে আপামর সঙ্গীতানুরাগীদের হয়ে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শতকোটি প্রণাম জানাই। আজও ‘কে গো আমার সাঁঝগগনে’,’ভোরের ঝিলের জলে’,’কেন কাঁদে পরান’,’পলাশ ফুলের মৌ পিয়ে ওই’,’কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী’,’আধো আধো বোল’ প্রভৃতি নজরুল গীতি তাঁর রেকর্ডে আজও মন ভালো করে দেয়। আজও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় অদ্বিতীয়।
বাংলা গানের দখিন হাওয়া
শচীন দেববর্মন
গানের অনুষ্ঠান, মঞ্চে গান পরিবেশন করছেন দীর্ঘকায় একজন মানুষ, ধবধবে ফর্সা, টিকালো নাক, গলার আওয়াজ সানুসিক, শ্রোতারা মুগ্ধ, আসর জমে উঠেছে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বললে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করছেন। ব্যক্তিগতভাবে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা করলেও, সঙ্গীতপিপাসু পিতার পরিচিত হলেও ত্রিপুরা রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারগত দ্বন্দ্বের জন্য পরবর্তীকালে অভিমানী এই দৃঢ়চেতা মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গেছেন। ত্রিপুরার রাজবংশের সঙ্গে পরম কাছের সম্পর্ক হলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই মানুষটির তেমন কিছু স্মৃতিচারণও নেই।

এমনকি, ত্রিপুরা রাজপরিবারের ওই সকল আত্মীয়দের সঙ্গেও পরে আর তিনি তেমন যোগাযোগও রাখেননি।
স্বনামধন্য সুরকার নিজে, কিন্তু তাঁর গানের সুরে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তেমন খুব একটা নেই বললেই চলে।
বরং কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। নজরুলের গানে তিনি সুরও করেছেন। ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’ -তাঁর গাওয়া এইসব নজরুলগীতি আজও বেশ বিখ্যাত।
নাম শচীন দেববর্মন। ‘এসডি’ নামে বম্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসাবে
তিনি আজও অমলিন। ত্রিপুরার রাজবংশের ছেলে হয়েও সঙ্গীতকে ভালোবেসে সমস্ত বৈভব ছেড়ে তিনি সঙ্গীতের সাধনায় সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জন্ম ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর, তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কুমিল্লায়। ত্রিপুরায় চন্দ্র বংশীয় মাণিক্য রাজ পরিবারের নবম সন্তান। মা নিরুপমা দেবীও রাজ পরিবারের মেয়ে, বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মন। সঙ্গীত শিক্ষার প্রাথমিক শুরুটা বাবার কাছেই। ছোট্ট শচীনদেব আগরতলার বোর্ডিং স্কুলের পড়া শেষ করে কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর বাবার ইচ্ছেয় পঞ্চম শ্রেণীতে কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হন, এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন, তারপর কলকাতায় চলে আসলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। কুমিল্লায় থাকাকালীন হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, নজরুল ইসলামের মতো বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। ওখানে ইয়ংমেন্স ক্লাব, নাট্যশালা, টাউন হল, লাইব্রেরী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেমন ছিল, তেমনি ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, ঢপকীর্তন, কবিগান প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গানের চর্চা হতো। ১৯২৫ সালে শচীনদেব বাবার সঙ্গে কলকাতায় এলেও পড়াশোনার পরিবর্তে সঙ্গীতের দিকেই বেশি ঝোঁকটা দেখা গিয়েছিল।
সুরস্রষ্টা হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করলেও কুমার শচীনদেবের প্রথম পরিচয় বংশীবাদক হিসেবে, তারপর গায়ক হিসেবে। নিজে ভাল গাইতেন। সঙ্গীত জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রচুর সংগ্রাম, ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তবুও পিছিয়ে আসেননি। বাংলাভাষায় তাঁর গাওয়া ১৩১ টি বেসিক গানের রেকর্ড পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ১২৭ টি শচীনকর্তা নিজেই গেয়েছেন, বাকি ৪ টি স্ত্রী মীরা দেবীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। স্ত্রী মীরা দেবী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অজয় ভট্টাচার্য, রবি গুহ মজুমদার প্রভৃতির কথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেই সুর করেছেন, আবার চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে নিজেই কখনো কখনো কণ্ঠদান করেছেন। বলিউডে প্রচুর গানে সুরসংযোগ করলেও বাংলা সিনেমায় তাঁর কাজ খুবই সামান্য। প্রথমে কিন্তু ত্রিপুরা থেকে বাংলাতেই কাজের জন্য এসেছিলেন। তিনি প্রথম যে রেকর্ড করেন, তা ছিল- হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে, যার এক পিঠে ছিল ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়া’(গীতিকার শৈলেন রায়), আর অন্য পিঠে ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে’(হেমেন্দ্রকুমার রায়)। সুর নিজের। রেকর্ডটি খুব জনপ্রিয় হয়। রাগাশ্রয়ী গান এবং লোকগীতির গানে একই সঙ্গে তাঁর মুন্সীয়ানার ছাপ প্রথম রেকর্ডটিতেই বোঝা গিয়েছিল। ১৯২৩ সালে শচীনদেব কলকাতা বেতারে গান গেয়েছিলেন। তবে সঙ্গীতের একনিষ্ঠ ছাত্র শচীনদেব ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সারেঙ্গীবাদক ওস্তাদ বাদল খাঁ, সরোদবাদক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রভৃতি সঙ্গীতসাধকের কাছে কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। কলকাতায় যখন গায়ক হিসাবে তাঁর একটু একটু নাম হচ্ছে, তখনই কুমার শচীনদেবের পিতৃবিয়োগ হয়। সালটা ১৯৩১। ‘সরগমের নিখাদ’ আত্মজীবনীতে শচীনদেব উল্লেখ করেছেন, সেই সময় পিতা নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীনদেব থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। কিন্তু পিতা গত হওয়ার পর অথৈ জলে পড়ে যান। ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে একখানা ঘরে ভাড়া নিয়ে কলকাতায় সঙ্গীতকে সঙ্গী করে এক অন্যরকম সংগ্রাম শুরু করলেন। এইসময় তাঁকে জীবনধারণের জন্য গানের টিউশনিকে রোজগারের মাধ্যম করতে হয়। চাইলেই দাদাদের কথামতো ত্রিপুরার রাজকার্যে উচ্চপদে চাকরি নিতে পারতেন। কিন্তু নিজের পায়ে গান করে দাঁড়ানোটাই ছিল ওঁর মনোগত ইচ্ছা।
রঙ্গমঞ্চ থেকে ডাক পেয়ে নাটকেও সুরারোপ করেছিলেন। আবার এটাও ঠিক, ১৯৩২ সালে এইচএমভি প্রথমে তাঁর গান রেকর্ড করতে চায়নি, শচীনকণ্ঠ নাকিসুরযুক্ত বলে আপত্তি করেছিলেন (পরবর্তীকালে অবশ্যই এইচএমভি ওঁর রেকর্ড বার করেছিল)। সাফল্যও চট করে আসেনি। গানের প্রচার নিয়ে গুরু কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে মনান্তর হয়। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে গান গেয়ে শচীনদেব বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, এবং ১৯৩৫ সালে বেংগল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুংরি গেয়ে ফৈয়াজ খাঁর প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। ওই বছরই শেখ ভানু বিরচিত দেহতত্ত্বমূলক গান ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ জসীমউদ্দীনের সাহায্যে নতুন প্রেমের গানে রূপান্তরিত করে নতুন ভাবে রেকর্ড করলেন। ১৯৩৭ সালে একসময়ের ছাত্রী ও পরবর্তীকালে প্রেমিকা মীরা ধরকে বিবাহ করেন। ওই বছরই ‘রাজগী’ নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সুরকার হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। পুত্র রাহুল দেবের জন্ম ২৭ শে জুন, ১৯৩৯। একটা সময় কলকাতাতেই থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেভাবে সুযোগ আসছিল না। কতটা অভিমানে, কতকটা বাধ্য হয়েই
১৯৪৪ সালে স্ত্রী মীরা দেবী, এবং শিশুপুত্র রাহুলকে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বোম্বে পাড়ি দেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শচীনদেবের উত্থানের পিছনে মীরা দেবীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শচীন দেববর্মন এত বড়ো হতেন না, যদি স্ত্রী মীরা না থাকতেন, মীরা দেবী
নিজেও সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের মেয়ে হয়েও শচীনদেবকে ভালোবেসে বিয়ে করে, আজীবন সুখে-দুঃখে স্বামীর পাশে ছিলেন, এবং পুত্র রাহুল দেব বর্মনকেও অত বড়ো মাপের সুরকার হিসাবে তৈরি করেন। মীরা দেবী নিজেও রীতিমতো ভালো গান গাইতেন। শচীনদেবের ট্রেনিংয়ে কিছু গান রেকর্ডও করেছিলেন। মীরা দেবী একসময় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, শান্তিনিকেতনের ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে অমিতা সেনের কাছে নাচ, পরে ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের কাছে ঠুংরি, কীর্তন, অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন। তাছাড়া পরবর্তীকালে শচীনদেবের সুরসৃষ্টি, চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার, যন্ত্রাণুসঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে স্বামীকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করে গেছেন। এই নীরব সঙ্গীতসাধিকা কিন্তু সারাটা জীবন প্রচারের আড়ালেই থেকে গেলেন। সমস্ত সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, উৎসর্গ করেছেন স্বামী-পুত্রের জন্য, নিজের কথা একবারও ভাবেননি। দুর্ভাগ্য, যে মীরা দেবীর শেষ জীবন খুব কষ্টে কাটে। পুত্র রাহুলদেবের অকাল মৃত্যুর শোক তিনি সইতে পারেননি। পুত্রবধূ আশা ভোঁসলে মীরা দেবীকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। শোনা যায়, ঠিকমতো যত্নআত্তিও পাননি।(হয়তো এটাও ঠিক, কর্মব্যস্ত জীবনে আশাজির পক্ষেও সবটা সম্ভব ছিল না। তবুও মানুষের শেষ বয়সটাই তো আসল যুদ্ধ। আর সবার ভাগ্য তো একরকম হয় না। কার কপালে যে কী আছে, কেউ কী বলতে পারে! মানুষ ভালোটাই চায়। বাকিটা ভবিষ্যতের হাতে।) ওখানেই একদিন মীরা দেবী মারা গেলে প্রচারমাধ্যমের কাছে খবরটা জানাজানি হতেই কিংবদন্তি গায়িকা তড়িঘড়ি চলে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।
যাই হোক, আবার শচীনদেবের কথায় ফিরে আসি। বোম্বেতে গুরু দত্ত, দেব আনন্দের সঙ্গে আলাপ হয়। ১৯৫৩ -য় ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-ছবির সুরের জন্য ফিল্ম ফেয়ার পেয়েছিলেন। আবার শচীনকর্তার শেষ ছবি ‘অভিমান’-র জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। (পুত্র রাহুল দেববর্মনের সঙ্গেও এ ব্যাপারে শচীনদেবের মিল আছে। আর ডি বর্মনও ওঁর শেষ ছবি ‘নাইনটিন ফর্টি টু- এ লাভ স্টোরি’-র জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। কিন্তু দেখে যেতে পারেননি।)
১৯৩৪ সালে কলকাতায় বাংলা সর্বভারতীয় সংগীত সম্মেলনে স্বর্ণপদক লাভ, তাছাড়া ১৯৫৮- য় সংগীত নাটক একাডেমী, ১৯৫৯ -তে ‘পিয়াসা’-সিনেমায় সুরারোপের জন্য এশিয়াড ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার, ১৯৬২ -তে হেল সিঙ্কি, ফিনল্যান্ড আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতার বিচারক, ১৯৬৪-তে ‘ক্যায়সে কঁহু’ সিনেমার জন্য সুরশৃঙ্গার সংসদ কর্তৃক ‘সন্ত হরিদাস’ পুরস্কার, ১৯৬৯ -তে ‘পদ্মশ্রী’ পান এসডি। সহজ সুরে, গানের আবেদনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার দিকেই এসডির লক্ষ্য ছিল। বাংলার বাইরে থাকলেও বাংলার জল, মাটি, বাতাসকে কোনোদিন ভোলেননি। শচীনদেবের হিন্দি সুরেও বাংলা লোকগীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলা লোকগীতির গানে যে সব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তিনি সেগুলো ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। গানের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন সর্বাগ্রে শ্রোতাদের মতামতকে। শিল্পী নির্বাচনের ব্যাপারে ছিলেন বেশ খুঁতখুঁতে। এমনও হয়েছে, একই গান কখনো হেমন্ত, মান্না, তালাত মাহমুদ, রফিকে দিয়ে গাইয়েছেন, কিন্তু ফাইনাল রেকর্ডিং তাঁকে দিয়েই করাবেন, যাঁর গলায় গানটা সবচেয়ে ভালো লাগবে। রেকর্ডিং কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বারবার ফোন করে দেখে নিতেন শিল্পীর গলা ভালো আছে কিনা। কৃষ্ণচন্দ্র দের ভাইপো হওয়ার সুবাদে মান্না দে(ডাকনাম মানা)’র সঙ্গে অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। মান্নাদের এসডির সহকারী ছিলেন। এমন অনেক গান আছে, যেগুলো মান্না দে-কে দিয়ে তুলিয়ে
কিশোরকুমারকে দিয়েই গাইয়েছেন। গানের জগতে কিশোরকুমারকে দাঁড় করানোর পিছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসডির সুরে কিশোরকুমার প্রচুর গান গেয়েছেন। তাছাড়া, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলে, সুমন কল্যাণপুর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রফি, মান্না দে, মুকেশ -কে না তাঁর সুরে গেয়েছেন! একটা সময়ে যখন নৌশাদ, মদনমোহন, শংকর-জয়কিশান প্রভৃতি সমকালীন সঙ্গীত পরিচালকরা আগের মতো নিজের নামের সুনাম অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন না, তখন পরিণত বয়সে এসেও শচীনদেব সুরের একের পর ভেল্কি দেখিয়েছেন। ‘গাইড’,’অমর প্রেম’,’প্রেম পূজারী’ -একের পর এক
হিট। এসডির ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল লতার গান। একটা গান একবার লতাকে দিয়ে গাওয়ানোর পর এসডির পছন্দ না হওয়ায় আবারও অন্য দিন লতাজিকে গাইতে বললে লতাজি সময় দিতে পারেননি বলে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই গান এসডি আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ান। এভাবেই আশাজির সঙ্গীত জগতে সময়ের কিছু আগেই প্রবেশ ও তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা লাভ- বলা যায়।
এসডি বলিউডে গানের জগতে এসে বিভিন্ন মিথ ভেঙে দেন। যেমন, আগে গান লেখা হতো, পরে তার সুর করা হতো। এসডির আশি শতাংশ গান আগে সুরকৃত, পরে তাতে কথা বসানো। তাছাড়া বোম্বেতে নিয়ম ছিল, মুকেশ গাইবেন রাজ কাপুরের জন্য, রফি গাইবেন দিলীপকুমার, শাম্মি কাপুরের জন্য, দেবানন্দ গাইবেন কিশোরকুমারের জন্য। কিন্তু এসডি বর্মন যেমন ‘নটি বয়’ (১৯৬২) সিনেমায় নায়ক-গায়ক কিশোরকুমারের জন্য মান্না দেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন, তেমনি রফিকেও ‘অভিমান’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের জন্য গাইয়েছিলেন। ‘আরাধনা’ সিনেমায় নিজের সুরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এসডি জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন (কাহে কো রোয়ে, ১৯৭২)। কিন্তু তিনি এতটাই ভূয়োদর্শী ছিলেন, যে বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে সেভাবে তাঁর কণ্ঠের গান কেউ মনে রাখবে না। সেই জন্য ওঁর বাংলা গাওয়া অনেক গান বোম্বের হিন্দি ভার্সানে অন্যদের দিয়ে গাইয়েছেন। পোষাক-পরিচ্ছদেও তিনি ছিলেন, আপাদমস্তক বাঙালি। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, পায়ে কোলাপুরি চটি বা পাম্প সু, চোখে চশমা।
নিজে খেলাধুলাও খুব ভালবাসতেন। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস খেলেওছেন। আর ছিল খুব মাছ ধরার শখ। বোম্বেতেও পুকুর পেলেও ছিপ হাতে নিয়ে বসে পড়তেন, ঠিক মনের অতলে গিয়ে সুর খোঁজার মতোই। ইস্টবেঙ্গলের উগ্র সমর্থক ছিলেন এসডি। কলকাতায় থাকাকালীন ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলেই মাঠে দেখতে চলে আসতেন। মান্না দে ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে টানটান উত্তেজনা, বাকবিতণ্ডা এসব লেগেই থাকতো।
উনি ছোটোদের যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি মানুষ হিসেবেও বেশ রসিক ছিলেন। বিভিন্ন ঘটনা থেকে শচীনদেবের রসিকতার বিচিত্র সব প্রমাণ পাওয়া যায়। নিজে অল্প কিছু হলেও লেখালেখি করেছেন। ১৯৩৯ সালে ডি.এম লাইব্রেরি থেকে শচীনকর্তার ‘সুরের লিখন’ নামে একটি গানের বই বেরিয়েছিল। স্বরলিপি সহ মোট ২৫ টি গান এই বইটায় ছিল। বইটা তিনি বাবাকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটি গান করলেও শিক্ষিত হয়ে উচ্চপদে কর্মরত হোক। কিন্তু শচীনকর্তা সঙ্গীতেই আত্মনিয়োগ করায় বাবার এই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেননি। তাছাড়া পরিচালক মধু বসুর ‘সেলিমা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে এক ভিখারির ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ওই সময় শচীনদেব আইপিটিএ-র সঙ্গেও জড়িত এবং বাংলা লোকসঙ্গীত শাখার সভাপতিও হয়েছিলেন। এভাবে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা প্রভৃতির সঙ্গে যোগাযোগও তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সলিল চৌধুরীকে বলেছেন, ছেলে পঞ্চম(রাহুলদেব) ওঁর নিজের গানের ধরন অপেক্ষা সলিল চৌধুরীর গানের ধরন বেশি পছন্দ করে। উনি যেমন ভারতীয় রাগরাগিণীর সঙ্গে বাংলাদেশের সহজ সরল মাটির লোকসুরের আদলে অর্থাৎ পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব ভারতের পল্লীগীতির স্টাইলে সুর তৈরি করতেন, ছেলে রাহুলের পছন্দ ছিল ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য ঘেঁষা সুর। শচীনদেবের একদিকে যেমন আক্ষেপ ছিল, পরবর্তীকালে এটা ভেবে গর্বিত হয়েছেন, ছেলে বলিউডের সঙ্গীত জগতে স্বতন্ত্র ঘরাণা তৈরি করতে ভালোভাবেই সক্ষম হয়েছে, বাবাকে কপি করেনি। তবে এতকিছুর পরও শচীনদেব বাংলাকে ভোলেননি। ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’,’আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই’,’শোনো গো দখিন হাওয়া’ প্রভৃতি যেমন শচীনদেবের বাংলায় গাওয়া অবিস্মরণীয় গান, তেমনি বলিউডে হেমন্তের কণ্ঠে ‘এ রাত এ চাঁদনী’, মান্না দের কণ্ঠে ‘পুছো না ক্যাইসে ম্যায়নে’, কিশোরকুমারের কণ্ঠে ‘রূপ তেরা মস্তানা’,’ফুল কি রং সে’, রফির জন্য ‘দিন ঢল যায়’, লতাজির জন্য ‘আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়’, আশাজির জন্য ‘কালিঘাটা ছায়’ প্রভৃতি অসংখ্য গান আজও এসডির জাত চিনিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে কখনো স্বকণ্ঠেও শচীনকর্তা গান গেয়েছেন, যেমন- আল্লাহ মেঘ দে(গাইড), ওরে মাঝি(বন্দিনী) প্রভৃতি।
তবে সবকিছুরই একটা শেষ থাকে।
১৯৭৫ সালে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে শেষ ছ’মাস কোমায় চলে যান। সুরের এই কাণ্ডারী চিরকালের জন্য জীবন নদীর ওপারে নাও ভাসান ১৯৭৫ সালের ৩১ শে অক্টোবর।
আজ অনেকেই তাঁকে ঠিক ভাবে চেনে না, বা শচীনদেবের এত বৃহত্তর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত নয় । সময়ও বদলে গেছে। অনেকেই হয়তো তাকে আরডি বর্মনের বাবা হিসেবে জানে। কিন্তু এসডি নামের মহীরূহকে সঠিক ভাবে জানাটা এ প্রজন্মের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। নিজের অধ্যাবসায় দিয়ে সমস্ত রাজৈশ্বর্য্য ত্যাগ করে নিজের প্রতিভার এরকম সুবিচার করা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা কঠিন ছিল, কঠিন ছিল সেটা হয়ে দেখানো, যে যে মহীরূহের ছায়ায় আরও অসংখ্য গাছ ছায়া পেয়ে এসেছে, এবং আজও পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে, বিখ্যাত ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকারের বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন এই কিংবদন্তি সুরকারের নামেই কিন্তু, তাঁর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা থেকেই। আবার ২০০৭ সালে শচীনদেব স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। তবে আজও ইউটিউব, রেডিও, টিভি চ্যানেলে এসডির গান মানে মনের মধ্যে যেন একটা আলাদা অনুভব। আর অক্টোবর তো পুজোরই মাস। সাধনাটাই যখন পুজো, শচীনদেব বর্মন সেখানে স্বার্থক প্রেমপূজারী। সময় যেমনটাই হোক, কোনো কালেই এই প্রেমের ক্ষয় হয় না, বরং আরও বাড়ে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন সেই অন্তরের উন্মাদনাটা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে ততোটা দেখা যায় না। টানটাও যেন কমে আসছে। শচীনদেবের গানের লাইন ধার নিয়েই আজ তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘বাজে না বাঁশি গো’।
যে মালা শুকায়
তালাত মাহমুদ
বাবা চাননি ছেলে চলচ্চিত্রে গান করুক। গান গাইলে বাড়ি ছাড়তে হবে- এইরকম অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছেলে গানকেই সারা জীবনের সঙ্গী করেছিলেন(ভাবুন সেই কতদিন আগের কথা, তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত উন্নত ছিল না, আজকের এত সুযোগসুবিধা -এসব সবই তখন চিন্তার বাইরে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে তখন গান গাওয়াটাকে খুব একটা ভালোভাবে দেখা হতো না।)।
সেদিনের সেই সম্ভাবনাময় তরুণটি গানের উন্নতির জন্যে নিজের চেনা শহরও ছেড়েছিলেন। চলে আসেন কলকাতায় (প্রায় এক দশক পরে যখন চলচ্চিত্র জগতে গায়ক হিসাবে ছেলেটির বেশ নামডাক হয়, তখন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক হয়েছিল।)। বোম্বেতে তখন যেমন কারোর নামের সঙ্গে কাপুর, খান -এসব থাকলে জনপ্রিয়তার বেশি সুযোগ ছিল, তেমনি কলকাতায় তখন চলছিল ‘কুমার’ ট্রেন্ড। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্মার্ট, সুদর্শন যুবকটি আসল নাম বদলে নাম নিলেন-‘তপন কুমার’।
‘তুমি এসো, ফিরে এসো।’ বাংলায় তাঁর গাওয়া প্রথম গান। বুঝতেই পাচ্ছেন কার কথা বলছি! মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং তালাত মাহমুদ।

কী? এখনো চিনতে পারছেন না, তাইতো! আরো কয়েকটা গানের কথা বলি। ‘রূপের ঐ প্রদীপ জ্বেলে’,’তুমি সুন্দর যদি নাহি’,’ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’,’যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো’,’দুটি পাখি দুটি তীরে’ ..কি, গানগুলো শোনা শোনা লাগছে না!’ শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে শুনেছেন, তাই না? এই সমস্ত গানগুলোর মূল শিল্পী আর কেউ নন, তিনি তালাত মাহমুদ, বাঙালির প্রিয় তপনকুমার (কারণ, উনি বাংলায় তপনকুমার নামে গান গেয়ে বিখ্যাত হন।) প্রায় দেড়শো মতো বাংলা গান গেয়েছেন। গানগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছিল, যে পাঁচের দশকে বেতারে অনুরোধের আসরে যখন গানগুলো বাজতো, শ্রোতাদের মধ্যে এরকম ভাবনাও তৈরি হয়েছিল, তালাত মাহমুদ কী দুজন, বা তপনকুমার এবং তালাত মাহমুদ একই ব্যক্তি তো? সেই সময়ের নামকরা সব সুরকারদের সুরেই তালাত মাহমুদ গান গেয়েছেন- কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, কানু ঘোষ, দুর্গা সেন, রবীন চ্যাটার্জী থেকে পরবর্তীকালে সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, শ্যামল মিত্র -কে নেই! বাংলা গানগুলো শুনলে মনেই হবে না, যে শিল্পী অবাঙালি। এত স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ, নিবিড় ভাব- এত মিষ্টি আওয়াজ-যা অন্য কারোর থেকে তাঁকে আলাদা করে রেখেছে। একাধারে মন উজাড় করা গলা, আবার তেমনি চেহারা। চোখমুখে প্রতিভার দীপ্তি। তেমনি পরিশ্রমীও। কিন্তু গায়ক হয়েই যে এত বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠা পাবেন, এতদূর ভাবেননি। এমনও হয়েছিল, যে একবার গান ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। শুনবেন সে গল্প! চলুন, শুরু করি।
অন্য সবার থেকে তালাত মাহমুদের গলার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল – কাঁপা কাঁপা অদ্ভুত একটা ভাব। শ্রোতারা এটাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। লখনউ, কলকাতার পর মুম্বাইতেও যখন গান করে নাম করে ফেললেন, তালাতের চরম সুখ্যাতি দেখে নিন্দুকেরা এরকমও বলতে শুরু করলো, যে ওর কাঁপা কাঁপা গলাটা আদপে কিছুই নয়-গাইতে গেলে নার্ভাস হয়ে যান, সেইজন্য এমন হয়। কতটা তালাত মাহমুদের কানে গেল। খুবই মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু হাল ছাড়লেও যে চলবে না। তাহলে উপায়! তালাত মাহমুদ খুব কসরত শুরু করলেন, যাতে এই স্বতঃস্ফূর্ত কাঁপা কাঁপা ভাবটা একদমই না থাকে। এইসময় সংগীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস, (যাঁর হাত ধরে একদিন ফিল্ম গানের জগতে গায়ক হিসাবে ওঁর নাম হয়েছিল) তালাত মাহমুদকে ডাকলেন। কারদার স্টুডিও, সেখানে গানের রেকর্ডিং চলছে। তালাত একের পর এক টেক দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোনোটাই অনিল বিশ্বাসের পছন্দ হচ্ছে না। শেষে থাকতে না পেরে, তালাত মাহমুদের পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শরীর কি খারাপ? তাহলে অন্যদিন রেকর্ডিং হবে। তালাত সবিনয় জানালেন, শরীর ঠিক আছে। কিন্তু কোথায় ভুল হচ্ছে, সেটা যদি বলে দেন তাহলে ঠিক আমি সংশোধন করে নেব। অনিল বিশ্বাস তালাতের সেই কাঁপা কাঁপা সিগনেচার স্টাইলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। জানতে পেরে তালাত বললেন, যে নিজের কেরিয়ারকে বাঁচাতেই সচেতনভাবে যাতে কাঁপা কাঁপা ভাবটা না আসে, সেইজন্য প্রচুর পরিশ্রম করে ওই ভাবটা থেকে নিজের কণ্ঠকে বের করে এনেছেন। অনিল বিশ্বাস আশ্বস্ত করেছিলেন, লোকে ওরকম অনেক কিছু বলবে। কারোর কথায় নিজেকে বদলানোর দরকার নেই। ওই স্টাইলটা তোমার নিজস্ব, তাছাড়া শ্রোতারা সেটা যখন পছন্দও করছে, তখন তোমার অসুবিধাটা কোথায়। অনিল বিশ্বাসের কথায় তালাত মাহমুদ পুরানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। সঙ্গীত জীবনের আয়ু আরও দেড় দশক বেড়ে গেল। তালাত মাহমুদের কঠিন সময়ে অনিল বিশ্বাস এভাবেই শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন, বলেই হয়তো…। আর থামতে হয়নি। একের পর এক কাজ, আর দারুণ দারুণ সব গান। এই সুরকার অনিল বিশ্বাসই তালাতকে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ, ভয়েস ফেড ইন, ফেড আউট করা শিখিয়ে ছিলেন, যাতে গানের ভাবও বজায় থাকবে, গানের মধ্যে শিল্পী সামান্য বিরামও পাবেন, আর শ্রোতারাও আবিষ্ট হয়ে শুনতে থাকবে।
তালাত মাহমুদ বরাবরই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন-তা সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই হোক বা সংগীত সাধনার ক্ষেত্রেই হোক। কলকাতায় এসে বাংলাকে ভালোবেসে ফেলেন, বাংলাভাষাকে ভালবেসে ফেলেন, বাংলার মানুষজনদেরও আপন করে নেন, যেমন -নিজের ছোটো ভাইয়ের মতো সাহায্য করেছেন গায়ক সুবীর সেনকে। (সুবীর সেন তখন বোম্বেতে গানের ক্যারিয়ারে মাথা তোলার চেষ্টা করছেন।)। আর একজনের কথা এই আলোচনায় স্বভাবতই এসে যায়। তিনি বাংলার মেয়ে লতিকা মল্লিক। ‘কাশীনাথ’-এর মতো কিছু বাংলা সিনেমায় অভিনয় করে অভিনেত্রী হিসেবে লতিকার কিছু নামডাক হচ্ছে। আবার উভয়েই পরস্পরের গুণগ্রাহী। কিন্তু লতিকা যে বাঙালি, তার ওপর খ্রিস্টান! বাড়ির লোক মেনে নেবে না। তালাত মাহমুদ কারোর পরোয়া করেননি। প্রেমঘটিত এই ‘নিকাহ্’(বিবাহ)-র খবর শুনে ওঁর বাবা প্রাথমিকভাবে অনেকটা মুষড়ে পড়লেও কয়েক বছর পরে পুত্রবধূকে গ্রহণ করেন, ভাঙা সংসারটা আবার ভালোভাবে জোড়া লাগে এবং এই দম্পতি বাকি জীবনটা বেশ সুখেই কাটিয়েছিলেন। লতিকার ১৯৫১ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘নাসিমা’ নামকরণ হয়, এবং ১৯৫৩ সালে পুত্র খালিদ আর ১৯৫৯ সালে কন্যা সাবিনার জন্ম হয়। তালাত মাহমুদের নাতনি সাহার জামান বর্তমানের একজন নামকরা সাংবাদিক(২০২৪ সালে তালাত মাহমুদের জন্মশতবর্ষে ‘তালাত মাহমুদ, দ্য ডেফিনিটিভ বায়োগ্রাফি’ বইটি লিখেছেন।)
তালাত মাহমুদের জন্ম ১৯২৪ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী লখনউয়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা শের মনজুর মেহমুদ, মা রফিউন্নিসা। বাবা ছিলেন রামপুর এস্টেটের কর্মচারী, ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে গৃহবধূ রফিউন্নিসার সংসারে সংগীতের চল ছিল না। কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই উদারমনা পিসির উৎসাহে তালাত গানকে ভালোবেসে ফেলেন। হাতের কাছে যা রেকর্ড পেতেন, সব মনোযোগ সহকারে শুনতেন, এমনও হয়েছে, এমনকি সারারাত জেগেও শাস্ত্রীয় সংগীতের রসাস্বাদন করেছেন। কুন্দনলাল সায়গল ছিলেন তালাতের আইডল। বাবার আপত্তি থাকলেও ১৯৩০ সালে মরিস সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের পণ্ডিত এস.সি.আর.ভাটের কাছে ধ্রুপদ সংগীত শেখা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে গজল গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। মাত্র ষোলো বছর বয়সে অল ইন্ডিয়া রেডিও লখনউতে
দাগ, মির, জিগরের গজল গাওয়ার সুযোগলাভ। স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের জন্য তাঁর এইচএমভি ৭৮ আরপিএম রেকর্ড রিলিজ করে (ফৈয়াজ হাসমির লেখা কমল দাশগুপ্ত সুর করা ‘সব দিন এক সমান নাহি থা)।
১৯৪৪ সালের সবচেয়ে বেশি তাঁর গানের রেকর্ড বিক্রি হয়। সারা ভারতব্যাপী গজল গায়ক হিসাবে তালাত মাহমুদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। লখনউ থেকে গজল গানের
পরিচিতির সুবাদে কলকাতায় আসা।
কলকাতায় এসে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া, সায়গল, এম এ রাউফ- এঁদের সুনজরে পড়ে যান। কলকাতা, লখনউ দুই জায়গাতেই সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন তখন। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তত সাড়া পাচ্ছেন না। নায়কোচিত চেহারার জন্য অনেকে শশী কাপুর, দিলীপ কুমাররা প্রথম প্রথম ওঁকে সিনেমার নায়কও ভাবতেন। নায়ক হিসাবে অভিনয়ের সুযোগও পেয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার কলকাতায় এলে গান হিট হলেও ছবি হিট হচ্ছিল না বলে আরও ভালো সুযোগের আশায় ১৯৪৯ সালে মুম্বাই চলে আসেন। এতে গায়ক হিসাবে আরও নাম ছড়িয়ে পড়লো। ১৯৫০ সাল তালাত মাহমুদের জীবনে একটি স্মরণীয় বছর। অনিল বিশ্বাসের ‘আরজু’-তে ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যাইসি জাগা লে চল’, নৌশাদের সুরে ‘বাবুল’ সিনেমায় ছয়টি গান, দিলীপ কুমারের লিপে ‘মেরা জীবন সাথী বিছড় গায়া’, খেমচন্দ্র প্রকাশের সুরে ‘জান পহেচান’ সিনেমায় ‘আরমান ভরে দিল কি লাগান’(গীতা দত্তর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে, যাতে প্রথম রাজ কাপুর নার্গিস জুটি পর্দায় ঠোঁট মেলান)-প্রভৃতি সুপার হিট সব গান এই বছরই মুক্তি পায়। এরপর একে একে মদনমোহন, শংকর জয়কিষান,সাজ্জাদ হুসেন, গুলাম মহম্মদ, খৈয়াম, শচীনদেব বর্মন, সলিল চৌধুরী সবার সুরেই বাজিমাত। হিন্দি গানের পাশাপাশি তালাত মাহমুদের উর্দু গজল, আধুনিক গান ছিল খুব বিখ্যাত। ‘কবে সে বুতকাদে সে’,’রাত তারোঁ নে সব’ -প্রভৃতি গজল আজও তেমনি মনোগ্রাহী। ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’,‘দিল ইয়ে নাদান’,’রাহি মতওয়ালে’,’যায়েঁ তো যায়েঁ কাহা’, ‘ফির ওহি শাম’ প্রভৃতি ফিল্মসংগীত চিরস্মরণীয়। মাড়োয়ারী, তেলেগু,অসমীয়া, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ভোজপুরি ইত্যাদি বারোটি ভাষায় গান গেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর, শামশাদ বেগম, গীতা দত্ত -অনেকের সঙ্গেই যেমন দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন, তেমনি -দেব আনন্দ, ভারতভূষণ, সুনীল দত্ত প্রকৃতি প্রচুর নায়কদের লিপেও গান গেয়েছিলেন।
তবে এটা না বলে উপায় নেই, আজ যখন বাঙালিরাই বাংলাটা ঠিকঠাক শিখতে চায় না, সেই কত বছর আগে তালাত মাহমুদ লখনউ থেকে এসে স্রেফ বাংলাকে ভালোবেসে, গানকে ভালোবেসে বাংলা ভাষাটা ভালো করে শিখেছিলেন। ‘যে মালা শুকায়’,’এলো কি নতুন কোনো’,’আলোতে ছায়াতে’,’আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে’,’যেথা রামধনু ওঠে’,’চাঁদের এতো আলো’,’নত মুখে কেন’- চিরকালীন এই সব গানে একটা শান্ত, পরিশীলিত ভাব, তেমনি ব্যঞ্জনাময়-শ্রোতাদের মধ্যে একটা নিবিড় অনুভব জাগিয়ে তোলে। (আশ্চর্য লাগে, যিনি এতো ভালো বাংলা বলতেন, তাঁকে দিয়ে কেন রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি রেকর্ড করানোর কথা ভাবা হলো না? খুব জানতে ইচ্ছে করে, সমসাময়িক কালে কারোর কেন এই বিষয়টা মনে আসেনি? নাকি মনে আসলেও সেটা কোনো না কোনো কারণে কার্যকরী হয়নি?)
নিজেও খুব বেছে বেছে গান করতেন, গানের কথা, সুর মনোমত না হলে সে সব গান গাইতেন না। গানের ব্যাপারে কোনোরকম উচ্চাকাঙ্খা, সমঝোতা- এসব নিয়ে কোনোদিনই ভাবেননি। ভালোবাসা থেকেই গান গেয়ে গেছেন, এবং দেশবিদেশে অগুনতি শ্রোতাদের জয় করেছেন। (এমনও হয়েছে, অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠান করবেন। দেড়দিন আগেই তালাত মাহমুদের কনসার্টের সব টিকিট শেষ। তখন তালাত সাহেব সিনেমাতে খুব একটা গাইছেন, তাও না, প্রচারেও নেই- তবুও এত উন্মাদনা। একেই মনে হয় বলে শ্রোতাদের শিল্পীর প্রতি টান।)
তালাত মাহমুদের কণ্ঠ মানে এক ধরনের নিবিড় প্রশান্তি, যেখানে হইচই নেই, অনাবশ্যক আড়ম্বর নেই, আছে শুধু রুচিবোধ, শিক্ষা, মানুষের পাশে মানুষকে এক রাখার, প্রেমে বাঁধার নিটোল বাতাবরণ। এ প্রেম শাশ্বত, লোকদেখানো নয়, চাকচিক্য, অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছলতা এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। সমকালে তাঁর মতো শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চ সংগীতশৈলী সম্পন্ন গায়ক দ্বিতীয় আর কেউ ছিলেন না। হিন্দুস্থানী গজলকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা, গজলের শ্রুতিগ্রাহ্য রূপদান-ইত্যাদি কারণে তালাত মাহমুদকে কিং অব গজল, গজল-ই-শাহেনশাহ ইত্যাদি নাম দেয়া হয়। (উল্লেখ্য, ভারতীয় সংগীতে অবদানের জন্য তালাত মাহমুদ ১৯৯২ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।)
সেসময়ের চল অনুযায়ী তালাত মাহমুদ অভিনেতা-গায়ক হতেই চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অভিনেতা হিসেবে বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ষোলোটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়িকারা ছিলেন, কাননবালা(কানন দেবী), ভারতী দেবী, মধুবালা, সুরাইয়া, মালা সিনহা, নূতন, শশীকলা, রূপমালা, নাদিরা,শ্যামা। সিনেমাগুলো ছিল- রাজলক্ষ্মী(১৯৪৫), তুম অর ম্যায়(১৯৪৭), সমাপ্তি(১৯৪৯), আরাম(১৯৫১),ঠোকর(১৯৫৩), দিল-ই-নাদান(১৯৫৩),ডাকবাবু(১৯৫৪), ওয়ারিস(১৯৫৪), রাফতার(১৯৫৫), দিওয়ালি কি রাত(১৯৫৬), এক গাঁও কি কাহানি(১৯৫৭), লালা রুখ(১৯৫৮), মালিক(১৯৫৮), সোনে কি চিড়িয়া(১৯৫৯)। এরমধ্যে তিনটে সিনেমা বক্স অফিসে হিট ছিল।
অভিনেতা হিসেবে সেরকম নাম করতে পারেননি, বলে ১৯৬০ সালের পরে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে গানের দিকেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।
তাছাড়া সময়টাও তখন বদলে গেছিল। তালাত মাহমুদ সেটা অনুভবও করেছিলেন। ১৯৬০ সালের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির ফলে গজল, ব্যালাড, রোমান্টিক বা ট্রাজিক -এই সব ধরনের গানের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহ যেমন কমতে থাকে, মুকেশ, রফি প্রভৃতি ফিল্মি গায়কদেরও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, গভীর মেজাজের সিরিয়াস গান তৈরিও আগের তুলনায় কম হতে থাকায় তালাত মাহমুদের মতো প্রশিক্ষিত গায়কদের মানানসই গানও কম হতে থাকলে ফিল্মে গান করা কমিয়ে দেন, আগের তুলনায় বেছে বেছে সীমিত সংখ্যক গান রেকর্ড করা শুরু করেন। প্রথম রেকর্ড যেখানে ১৯৪১ সালে, তার ত্রিশ বছর পর ১৯৭১ সালে হিন্দি ফিল্মে শেষবারের মতো গাইলেও ১৯৮৭ তে উর্দু সিনেমায় হেমলতার সঙ্গে ভ্যালি-ই-আজমে ওঁকে কণ্ঠ দিতে শোনা যায়।
১৯৪১ থেকে ১৯৮০ সাল- এই চার দশকে তালাত মাহমুদের গানের সংখ্যা মোটে আটশো মতো। কিন্তু সংগীত সাধনা ছাড়েননি। প্রথম ভারতীয় ফিল্ম গায়ক হিসেবে ১৯৫৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পূর্ব আফ্রিকা সফর করেছেন। লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন -প্রভৃতি জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, যেটা কোনোদিনই কমেনি। রেকর্ডিং ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পরে ১৯৯১ সালের নেদারল্যান্ড সফরেও ছিল শ্রোতাদের উপচে পড়া ভিড়।
মানুষ হিসেবে তালাত মাহমুদ ছিলেন সহৃদয়, সহনশীল, এবং উদারমনস্ক। মানুষ হিসেবে খুব নম্র, ভদ্র ছিলেন। কিছু সেবামূলক কাজেও জড়িত ছিলেন(যেমন- সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে কোনোদিন পারিশ্রমিক নেননি। যাদের ভালবেসেছেন, তাদের জন্য নীরবে ত্যাগ স্বীকারও করেছেন, মুখে কিছু বলেননি।)। দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, পোশাক-আশাকও ছিল ফিটফাট, শুট-বুট টাই-কোট পরেও যেন সোজাসাপ্টা নিপাট ভালো মানুষ। কোনোদিন প্রচারের জন্য কাজ করেননি। পরবর্তীকালে প্রতিভা অনুযায়ী হয়তো সেভাবে প্রচারও পাননি, কিন্তু তা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। তালাত মাহমুদের ঘনিষ্ঠরা বরাবরই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার আসনেই বসিয়ে এসেছেন। সমকালীন সব শিল্পীদের সঙ্গে
ছিল তাঁর নিবিড় সখ্য। হেমন্তজায়া বেলা মুখোপাধ্যায় একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অনেকেই হেমন্তর গলা নকল করে গান গেয়েছেন, বা হয়তো ভবিষ্যতেও গাইবেন, কিন্তু তালাত মাহমুদের গলা অনুকরণ আজ অবধি কেউ করতে পারেন নি আর ভবিষ্যতে পারবেনও না। ওই গলার এমনি মাধুর্য, এমনই দরদ, যেন স্রষ্টা তাঁর সমস্ত আবেগ ওখানেই ঢেলে দিয়েছেন। এখানেই ওঁর শ্রেষ্ঠত্ব, তাও এত পরিমিত সংখ্যক গান গেয়েও।
১৯৯৪ সালে ৯ই মে চুয়াত্তর বছর বয়সে তালাত মাহমুদ মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এতদিন হয়ে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগীত স্রষ্টাদের নিয়ে নানান অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু কোথাও তালাত মাহমুদকে নিয়ে সেভাবে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় না, বিভিন্ন রিয়েলিটি শোয়ে তালাত মাহমুদের গান তেমন গাইতে দেখা যায় না, আর গাইলেও গানগুলোর মূল শিল্পী হিসাবে তালাত মাহমুদের নামটুকু অনেকে উচ্চারণ করার সৌজন্যটুকু দেখাতে ভুলে যান, আজকাল অধিকাংশ শ্রোতা তালাত মাহমুদকে চেনেন, জানেনই না-রিমেক গানের আড়ালে কার্যত ঢাকা পড়ে গেছেন, কিন্তু আবরণটা সরানোর আন্তরিক ইচ্ছে ঠিক কারোরই যেন নেই, আগ্রহেরও যথেষ্ট অভাব।
একজন নিষ্ঠাবান শিল্পী যদি জন্মের শতবর্ষ পরেও এরকম অবহেলিত থাকেন, তাহলে তার দায় কি বাঙালি হিসেবে আমাদের নয়?
ভারতীয় সঙ্গীতের পিতামহ
অনিল বিশ্বাস
কিংবদন্তি কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর প্রয়াতা হলে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন মানুষজন ওঁর স্মৃতিচারণে অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য সাজিয়েছিলেন। দীর্ঘ জীবনের নানান সময়ে এই মহান গায়িকা বিভিন্ন বিদগ্ধ মানুষজনের সংস্পর্শে এসেছেন। এতদিন বাদে সবাইকে চেনাজানাও বর্তমান প্রজন্মের কাছে খুব একটা সহজসাধ্য নয়।
এসব কিছুর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে একটা পোস্ট সবার খুব নজর কেটেছিল। টেলিভিশন অভিনেত্রী তুহিনা বোহরা তাঁর দাদুর সঙ্গে লতাজির পারিবারিক কিছু ছবি তাঁর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ওঁর দাদু খালি গায়ে সস্ত্রীক উনুনে রান্না করছেন, লতাজি দাদুর ঠিক পাশে বসে। আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লতা মঙ্গেশকরকে ওঁর দাদু গান রেকর্ডিং করাচ্ছেন। উল্লেখ্য, যে ছবিদুটি খুবই পুরনো। লতা মঙ্গেশকর তখন সবে গান করতে এসেছেন। তুহিনা বোহরা আরও লিখেছেন, যে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লতা মঙ্গেশকর তখন খুব পরিশ্রম করছেন। তারদেও থেকে দাদরে গানের প্রশিক্ষণ নিতে তিনি দীর্ঘ পথ হেঁটে আসতেন। লতা মঙ্গেশকরের তখন সংসার চালানোর জন্য দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বেশ হিমসিম অবস্থা। সেসময় লতাজি তার দাদুর বাড়িতে এসে গানের চর্চা করতেন। দাদু-দিদার পারিবারিক ঘনিষ্ঠ ‘লতাদিদি’ খেতে খুব পছন্দ করতেন বলে, দাদু কিন্নরকণ্ঠীর জন্য আমিষ রান্না করে রাখতেন, লতাজিও তাই পরম তৃপ্তিভরে খেতেন। দাদুও জানতেন, লতাজির এই সময়ে নিজের আর্থিক অভাব-অনটন যথেষ্ট। লতা মঙ্গেশকর তাঁর প্রথম জীবনের এই ‘মেন্টর’-য়ের কথা চিরদিনই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে গেছেন, শুধু তাই নয়, সঙ্গীতের এই কিংবদন্তি ওঁর দাদুকে চিরদিনই গুরুর আসনে বসিয়েছেন। পাঠকরা ভাবতে পারছেন, সেদিন মানুষের জীবন কত সহজ সরল, অনাড়ম্বর ছিল। সবাই সবাইকে চিনতো, সবার বাড়ি আসতো, সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতো, মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় ছিল, আর তা নিয়ে এখনকার মতো এরকম জটিলতা ছিল না। অভিনেত্রী লিখেছিলেন, গান গাওয়ার সময় কিভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কীভাবে শব্দ উচ্চারণ করার সময় অক্ষর না ভেঙে একসঙ্গে উচ্চারণ করা যায়, লতা মঙ্গেশকরকে তাও শিখিয়েছিলেন, তাঁর এই বিখ্যাত দাদু। তুহিনা বোহরার বক্তব্য, দাদুর শেখানো সরস্বতী বন্দনার দু পংক্তির সুর দীর্ঘ ঊনসত্তর বছর পরেও ‘লতাদিদি’ ওঁর মায়ের সামনে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। গানটির সুর সম্পূর্ণ হয়নি, রেকর্ডও হয়নি। পুরনো দিনের অনেক কথাও সেই স্মৃতিচারণে উঠে এসেছিল। তুহিনা বোহরার এই সঙ্গীতজ্ঞ দাদুটি হলেন, অনিল বিশ্বাস। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, সুরকার অনিল বিশ্বাস। ভারতীয় সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘পিতামহ ভীষ্ম’ বলে এই স্রষ্টাকে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৬৫ সাল অবধি বোম্বের হিন্দি সিনেমা জগতে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক এবং পরবর্তী কালের বিখ্যাত সব গায়ক-গায়িকাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে এই মানুষটি ভারতীয় সঙ্গীত জগতে তাঁর অজস্র অবদান রেখে গেছেন।

অনিল বিশ্বাসের জন্ম বাংলাদেশের বরিশালের একটি ছোট্ট গ্রামে। অনিল বিশ্বাসের ১৯১৪ সালের ৭ই জুলাই। প্রকৃত নাম অনিলকৃষ্ণ বিশ্বাস। জে সি বিশ্বাসের পরিবারের এই ছোট্ট সম্ভাবনাময় ছেলেটির খুব অল্প বয়স থেকেই গান শোনার শখ ছিল। শিশু তারকা হিসেবে স্থানীয় এলাকায় থিয়েটারে অভিনয়ও করতেন। চোদ্দ বছর বয়সে তবলা বাজানোয় পারদর্শী হয়ে ওঠেন, এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের সুযোগ লাভ করেন। সেই সঙ্গে গানে সুর করাও শুরু করেন। তখন বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনও জোরদারভাবে চলছে। অনিল বিশ্বাস তখন ম্যাট্রিকুলেশন পড়ছেন। এই স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী হিসাবে সরকার বিরোধী কাজ করার ফলে বারবার কারাবন্দী হয়েছেন, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। অবশেষে পিতার মৃত্যুর পর গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ছদ্মবেশে ১৯৩০ সাল নাগাদ কলকাতায় চলে আসেন। তাছাড়া সঙ্গীতের টান তো ছিলই। প্রথমে কলকাতায় এসে নাটকের জন্য গান লিখতেন। এই সময়ে মেগাফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন। গান লেখা ও সুর করার জন্য গান প্রতি পাঁচ টাকা করে পেতেন।
পাশাপাশি রংমহল থিয়েটারে গায়ক, সহকারী সঙ্গীত পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন। তখন রংমহলে কুন্দনলাল সাইগল, শচীনদেব বর্মনও কাজ করতেন।
অনিল বিশ্বাসও সঙ্গীত জীবনের শুরুর এই দিনগুলোতে নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন। এই রংমহলে নাটকের গান, অভিনয়, অর্কেস্ট্রশনের দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত থাকতো। ১৯৩২-৩৪ সাল নাগাদ বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রযোজনায় অভিনয় এবং গান করে নাম করতে থাকেন। তখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গীতেও পারদর্শী হতে হতো। এই সময় কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, খেয়াল, ঠুংরি প্রভৃতি গানেও তিনি দক্ষ হয়ে ওঠেন। হিন্দুস্তান রেকর্ডিং স্টুডিওতে গায়ক, গীতিকার, সুরকার হিসেবে কাজ করার সময় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ হয়, তখনকার বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক হীরেন বসুর সুনজরে চলে আসেন এবং তারই নির্দেশে ১৯৩৪ সাল নাগাদ বোম্বে(এখনকার মুম্বাই) চলে যান। তখন ভারতীয় সিনেমায় নেপথ্য গান গাওয়া অর্থাৎ প্লেব্যাক সিঙ্গিংয়ের যুগ শুরু হচ্ছে।
১৯৩৫ সালে ইস্টার আর্টসের ব্যানারে ‘ধরম কী দেবী’ সিনেমায় তাঁর প্রথম সংগীত পরিচালনা। এই সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন, এবং সিনেমাতে গানও গেয়েছিলেন। গানটি ছিল-’কুছ ভি না ভারোসা’। (এর আগে অবশ্য রাম দরিয়ানীর ‘বাল দারিয়া’,’ভারত কি বেটি’-র গান রচনাতেও যুক্ত ছিলেন।
তবে সুরস্রষ্ঠা হিসাবে হিন্দি চলচ্চিত্রে এটাই ওঁর প্রথম কাজ।) ১৯৩৬ সালে ‘সাগর মুভিটোনস’ প্রয়োজনা সংস্থায়-এ সুরকার হিসেবে যোগদান করেন এবং ‘মনমোহন’,’ডেকান কুইন’ চলচ্চিত্রে যথাক্রমে অশোক ঘোষ এবং প্রাণসুখ নায়েকের সরকারি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তী দু’বছর মোট এগারোটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। মেহবুব খানের ‘জায়গির’ বাণিজ্যিকভাবে হিট হওয়ায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অনিল বিশ্বাসের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরো নতুন নতুন ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব আসতে থাকে। ‘ওয়াতন’, ‘আলিবাবা’,’অওরত’,’বহেন’,’রোটি’ প্রভৃতি সিনেমাতে তাঁর সুরকৃত গান পরিচিতি লাভ করতে থাকে। ‘রোটি’(১৯৪২) চলচ্চিত্রের জন্য উনি বিখ্যাত হয়ে যান। এই সিনেমায় ‘ক্যান্টালা’-র ব্যবহার এবং আবৃত্তিযোগ্য গদ্যগানের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। (তাছাড়া ভারতীয় সঙ্গীতে ‘রাগমালা’-র ব্যবহার ওঁরই কীর্তি।) বেগম আখতারের অনেক গান এই সিনেমায় সংযুক্ত ছিল, কিন্তু চুক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে সেগুলো বাদ দিতে হয়। (কারণ গানগুলো এইচএমভিতে রেকর্ড করা হয়েছিল, তখন অনিল বিশ্বাস মেগাফোনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন)।
এরপর ১৯৪২ সাল থেকে উনি দেবিকা রাণীর আহ্বানে বম্বে টকিজের হয়ে কাজ করতে শুরু করেন। এই ব্যানারের ‘জোয়ার ভাটা’(১৯৪৪) সিনেমায় দিলীপ কুমার প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। তাছাড়াও অনিল বিশ্বাস বিভিন্ন সিনেমায় সাফল্যের সঙ্গে সুরসৃষ্টি করতে থাকেন।
‘জাগিরদার’,’গ্রামোফোন সিঙ্গার’,’মহাগীত’ প্রভৃতি হিট সিনেমায় তাঁর উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত পরিচালনা সেই সময়ে যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করেছিল। অনিল বিশ্বাসী প্রথম ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে টুয়েলভ পিস অর্কেস্ট্রার ব্যবহার করেন। ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে তাঁর সুরারোপিত ’আরাম’, ‘আরজু’,’অঙ্গুরীমাল’, ‘কিসমত’, ‘পহেলি নজর’, ‘তরানা’, ‘পরদেশী’, ‘ওয়ারিশ’, ‘হামদর্দ’, ‘চার দিল চার রাঁহে’ প্রভৃতি সিনেমার গান আজও জনপ্রিয়। ‘কিসমত’(১৯৪২) সিনেমা হলে টানা তিন বছর চলেছিল। অনেক বছর পরে ‘শোলে’ সিনেমা একটা সিনেমা হলে টানা এতদিন সিনেমা চলার এই রেকর্ড ভাঙতে সক্ষম হয়। অনিল বিশ্বাসই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিদেশী মিউজিক ‘ক্যান্টালা’ এবং সঙ্গে সঙ্গে
পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার প্রবর্তন করেন। বোম্বে চলচ্চিত্রে বিদেশি অর্কেস্ট্রেশন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং বাংলা লোকসঙ্গীতের (বিশেষত বাউল, ভাটিয়ালি) মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, হিন্দি সিনেমায় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং ছবির গল্পের প্রয়োজনে বৃন্দসঙ্গীতের সঠিকরূপে ব্যবহার -এসব এই সুরসাধকেরই অবদান। তাঁর হাত ধরেই মুকেশ তালাত মাহমুদ প্রভৃতি শিল্পীর নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
(মুকেশ ‘পেহলি নজর’ সিনেমায় ‘দিল জ্বলতা হ্যায়’, তালাত মাহমুদ ‘আরজু’ সিনেমায় ‘অ্যায় দিল মুঝে আইসি জাগা লে চল’ গানের মাধ্যমে প্লে ব্যাক করেন, অনিল বিশ্বাসের সুরে।) এছাড়া লতা মঙ্গেশকর, রোশন আরা বেগম, নিজের বোন পারুল ঘোষ, আমির বাই কর্নাটকি প্রভৃতি শিল্পীদের সাফল্যের পিছনে এই সুরসাধকেরই ভূমিকা ছিল। ১৯৪৬ সালে উনি বম্বে টকিজ ত্যাগ করেন। স্ত্রী আশালতার মালিকানাধীন ‘ভ্যারাইটি পিকচার্স’-য়ের চারটি সিনেমায় সুর করেন। এছাড়া অবসর নেওয়ার আগে বিভিন্ন ব্যানারে ‘পরদেশী’,’চার দিল চার রাঁহে’, ’সৌতেলা ভাই’,’ছোটি ছোটি বাঁতে’, ’জিন্দেগী খোয়াব হ্যায় থা হামেন ভি’(ফ্লপ হলেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়)-প্রভৃতি ওঁর কিছু কাজও উল্লেখ্য।
সারাজীবনে নব্বইটিরও বেশি হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি সুররচনা এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন।
তাঁর সুরে ‘ধীরে ধীরে আ রে বাদল’,’নয়ন মিলে নয়ন হুয়ে বাওরে’, ‘রাহি মতওয়ালে’, ‘জানা না দিল সে দূর’,’রিমঝিম বরসে পানি’,’এ দিল মুঝসে আইসি জাগা লে চল’,’অ্যায় জান-ই-জিগর দিল মে’,’শুকরিয়া শুকরিয়া এ পেয়ার তেরা’ প্রভৃতি গান আজও সু-সংস্কৃতিমনস্ক যে কোনো শ্রোতাদের মন সহজেই ভালো করে দেয়।
১৯৬০ সালে অনিল বিশ্বাস সুরকার হিসাবে ভালো জায়গায় ছিলেন ঠিকই, তবে ১৯৬০ সালের পর থেকে বলিউডি গানের ধরন আস্তে আস্তে পাল্টে যাওয়ায় নিজেও ফিল্ম সঙ্গীতের তখনকার নতুন ধারার সঙ্গে নিজের মনকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, তার ওপর সেই সময়ে হঠাৎ ১৯৬১ সালে ছেলে প্রদীপ বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে ভগ্নহৃদয়ে এই সুরস্রষ্ঠা কয়েক বছর পরে চলচ্চিত্রের আলো-আঁধারি রঙিন জগৎ থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নেন।
‘ছোটি ছোটি বাঁতে’(১৯৬৫) ওঁর সুরকৃত শেষ হিন্দি ছবি। ১৯৬৩ সালে মুম্বাই শহর ত্যাগ করে দিল্লিতে চলে আসেন এবং দিল্লি আকাশবাণীর প্রধান প্রযোজকের পদে কাজ করেন, ১৯৭৫ সাল অবধি এই পদে ছিলেন। পরে অবশ্য দূরদর্শনের জন্যে টিভি সিরিজ ‘হাম লোগ’ (১৯৮৪), এবং আরও কয়েকটি তথ্যচিত্রের জন্য সঙ্গীত রচনা করেন। ১৯৯১ সালে চলচ্চিত্র বিভাগে দু’বছর ধরে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগের উপদেষ্টা নিযুক্ত ছিলেন।
তবে শিক্ষণীয় এটাই যে, এত বছর বাংলার বাইরে থাকলেও বাংলাকে তিনি ভোলেননি, ভোলেননি বাংলাভাষাকেও। লোকসঙ্গীতকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও ছোটবেলায় বরিশালে সোনা কিছু লোকগান রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। সেটা অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি।
ভারতীয় সঙ্গীতে সারা জীবনের অবদানস্বরূপ ১৯৮৬ সালে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী মেহরুন্নিসাকে(১৭ অক্টোবর ১৯১০-১৯৯২)। মেহরুন্নিসা ‘আশালতা’ নাম নিয়ে তখন অভিনয় করতেন।(কারণ তখন মুসলিম সমাজে একজন মহিলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন, সেটা আদৌ ভালো চোখে দেখা হতো না)। ১৯৩৬ সালে অনিল বিশ্বাসকে বিয়ের পর উনি ‘আশালতা’ নামটিই গ্রহণ করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি আশালতা হিন্দি ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন, পাশাপাশি ‘ভ্যারাইটি পিকচারস’ নামক ফিল্ম কোম্পানির মালিক ছিলেন। এই দম্পতির তিন ছেলে ও একটি মেয়ে- যথাক্রমে, প্রদীপ, অমিত, উৎপল ও শিখা। (শাহেনশাহ (১৯৮৮), ম্যায় আজাদ হু- নামক দুটো চলচ্চিত্রে অমর-উৎপল সঙ্গীত পরিচালকের মধ্যে অনিলপুত্র উৎপল বিশ্বাস ছিলেন। তাঁর মেয়ে শিখা বোহরা হলেন এখনকার জনপ্রিয় তথ্যচিত্র নির্মাতা পারমিতা বোহরার মা।) ১৯৫৪ সালে অনিল বিশ্বাস ও আশালতা বিশ্বাসের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হওয়ার পাঁচ বছর পর ১৯৫৯ সালে হিন্দি সিনেমার গায়িকা মীনা কাপুরকে (১৯৩০-২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭) পুনরায় বিবাহ করেন। এঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। (মীনা কাপুর ১৯৫০ এর দশকে বোম্বেতে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে বেশ নাম করেছিলেন। ইনি গায়িকা গীতা দত্তের বন্ধু ছিলেন, দুজনের গলার ধরনও অনেকটাই একই রকম ছিল। ১৯৫০ সালে ‘পরদেশী’ সিনেমায় ‘রসিয়া রে মন বসিয়া রে’, বা ‘চার দিল চার রাঁহে’ সিনেমার ‘কাঁছি হ্যায় উমারিয়া’ গানে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ওঁর শেষ জীবনে প্যারালিসিস হয়ে যায় এবং জন্মস্থান কলকাতার বাড়িতেই সকাল ২:২০ মিনিটে ২০১৭ সালে ২৩ শে নভেম্বর মারা যান।)
অনিল বিশ্বাস ২০০৩ সালের ৩১ শে মে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী অনিল বিশ্বাসকে একজন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের পিতামহ ভীষ্ম বলে অভিহিত করেন। মহাভারতের ভীষ্ম যেমন সারাটা জীবন ধরে শুধুই আত্মত্যাগ করে গেছেন, সুরস্রষ্ঠা অনিল বিশ্বাসও তেমনি নিষ্ঠার সঙ্গে সারা জীবন হিন্দি ফিল্ম সঙ্গীতে নিজের সবটুকু দিয়ে গেছেন, পরিণামে তেমন কিছুই পাননি। এখন অনেকে তাঁর নামটাই জানে না। অনেকে আবার একই নাম হওয়ার জন্য সমকালীন বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (সিপিএম পার্টির) প্রয়াত অনিল বিশ্বাসের সঙ্গেও তার নাম গুলিয়ে ফেলে। সুরকার অনিল বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে গুগল ছাড়া তেমন ভাবে আর কিছু সুযোগ থাকে না। এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাঙালি হয়েও আমাদের কাছে স্মরণীয় বরণীয় এইসব বাঙালিরা তাই এই ভাবেই ব্রাত্য থেকে যান।
পরিশেষে তাই বলতেই হয়, এক সময়ের সোনালি যুগের অনেক সুপারহিট ফিল্ম গান এবং স্বনামধন্য গায়ক-গায়িকাদের জন্ম যাঁর হাত ধরে হয়েছে, সেই মানুষটিকে নিয়ে আরও চর্চা আজ খুব বেশি করে প্রয়োজন। তাই বর্তমানের এই অবক্ষয়ের যুগে আমাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের তাগিদেই ভারতীয় চলচ্চিত্র তথা সঙ্গীতের গৌরবময় অতীতকে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। আর সেই সূত্র ধরেই বিস্মৃতপ্রায় সঙ্গীতসাধক অনিল বিশ্বাসের সাঙ্গীতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের আরও চর্চা প্রয়োজন।
বাংলা গানের ‘পাগল হাওয়া’
সুবীর সেন
পাড়ায় দুর্গাপুজোর জলসা। উপস্থিত সবাই একজন স্কুলপড়ুয়া ছেলের গান শুনতে চাইছে। ছেলেটি তো হারমোনিয়াম বাজাতে জানে না, জ্ঞানগম্যিও তত নেই, গানের কথার মানেও ওই বয়সে যা হয়, তেমন কিছু বোঝে না, তবু সবাই চাওয়ায় গাইলো, সলিল চৌধুরীর কথা-সুরে হেমন্তর ’গায়ের বধূ’। তাও অর্ধেকটা। ব্যস, শ্রোতারা তাতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল। সবাই ওই ছোটো ছেলেটির গলার প্রশংসায় মশগুল। সেই থেকেই গানের শুরু।
তরুণ বয়সে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গেয়ে জলসা মাতাতে তাঁর ডাক পড়তো । সুদর্শন, মার্জিত চেহারা দেখে অভিনয় করার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন।
যেমন চেহারা, তেমনি কণ্ঠের আবেদন -মেয়েরাও সহজেই প্রেমে পড়ে যেত। বাঙালির প্রেমের গান বলতে ওঁর গাওয়া ‘মোনালিসা’ কিংবা ‘এ যেন সেই চোখ’, কিংবা ‘হয়তো তোমার অনেক ক্ষতি করেছি’ আজও কালজয়ী। এ যুগের প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও মনের ঠিকানা – কিছুটা গম্ভীর, মিষ্টি, সহজাত রোমান্স ভরা অথচ কোমল কণ্ঠ- সুরসাগর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকটা মিল থাকলেও যথেষ্ট স্বতন্ত্র, সুধা ঢালা আবেগ মেশানো ঘরোয়া আমেজে ভরপুর। যার কথা বলছি, সেই গায়কের নাম সুবীর সেন। ’ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’,’স্বর্ণ ঝরা সূর্য রঙে’- গানগুলো শোনেননি এমন কেউ নেই। সুবীর সেন নামটা বললেই এই দুটো গানই যেন বিশেষ করে কানের সামনে বাজতে থাকে। দীর্ঘ ষাট বছরের সঙ্গীত জীবনে গানের সংখ্যা দেড়শো মতো হবে। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে মনে হয়, সব কিছু বিচার হয় না, অনেক কিছু মনের ভিতর থেকে অনুভব করবার থাকে। সুবীর সেনের গানও তাই।

বোহেমিয়ান মনটা গানের হিসাব করেনি কোনোদিন, ভালোবেসে গান শুনিয়ে গেছে-আর সবাইকে আপন করেছে। ব্যস, এতেই স্বার্থকতা। আর কিছুর দরকার পড়ে না।
জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪শে জুলাই, অসমের ডিব্রুগড়। বাবা ডাঃ শৈলেশ চন্দ্র সেন, মা লিলি সেন। গুয়াহাটিতে ওদের পারিবারিক একটা ফার্মেসিও ছিল। পৃথ্বীশ সেন, গৌরী সেন, সুনীল সেন, অরুণ সেন- ওঁর ভাই বোনের নাম (সুবীর সেন গায়িকা রুণা লায়লার সম্পর্কে মামা হন, রুণা লায়লার মা অনিতা সেনও সুবীর সেনের বোন ছিলেন)।
ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কিশোর বয়সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গেয়ে শ্রোতাদের মাত করে দিতে পারতেন। ছাত্র অবস্থায় ১৯৫১ সালে লখনৌয়ের মরিস কলেজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতন ঝংকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর কলকাতায় গান শিখতে চলে আসেন। কলকাতায় প্রথমে মামার বাড়িতে ওঠেন। সেখানে সবাই
রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালোবাসতো। বাবার খুড়তুতো ভাই
রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষক নীহারবিন্দু সেন। মামারবাড়িতে থাকতেই সুবীর সেনের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু। আর পাবলিক ফাংশনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গাইতে হতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো বটেই, তাছাড়া তালাত মাহমুদ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ছিল সুবীর সেনের আইডল। গীতা দত্ত ছিলেন প্রিয় গায়িকা এবং প্রিয় মানুষ।
কলকাতার আশুতোষ কলেজে পড়বার সময় এইচএমভি আয়োজিত কেরেজু সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১৪০০ প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কলকাতায় থাকাকালীন সুবীর সেনের সঙ্গীতগুরু ছিলেন পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী; ইনিই পরে পণ্ডিত উষারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের(১৯২০-১৯৯২)
কাছে সুবীর সেনকে ঠুংরি শিখতে পাঠিয়েছিলেন। সুরকার অনুপম ঘটকের কাছেও গানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
প্রথম রেকর্ড ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কলম্বিয়া লেবেলে বেরোনো রেকর্ডের(GE24715) এক পিঠে ছিল- ‘জীবন বাতি নিভিয়ে যেদিন’, আরেক পিঠে ‘আর কত জানাবো তোমায়।’ কথা শ্যামল গুপ্ত, সুর চিত্ত রায়। গানদুটো শ্রোতাদের সে ভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে সুধীন দাশগুপ্তের কথায় ও সুরে ’ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’,’স্বর্ণ ঝরা সূর্য রঙে’- রেকর্ড দুটো বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সুবীর সেন অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
তৃতীয় রেকর্ড সুধীন দাশগুপ্তের সুরেই -’এত সুর আর এত গান যদি কোনোদিন থেমে যায়’। এ গান যেন সুবীর সেনের নিজের জীবনেরই আখ্যান। শেষ জীবনে হয়েও ছিল তাই। সে সব কথায় পরে আসছি।
তেইশ বছর বয়সে চিত্র পরিচালক গুরু দত্তের আহ্বানে সুবীর সেন বোম্বে চলে আসেন। সুধীন দাশগুপ্তও গুরু দত্তের প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করার জন্য বোম্বে গিয়েছেন। সুবীর সেন, সুধীন দাশগুপ্ত দুজনে ‘তারাদেও সোনাওয়ালা’ নামক বাড়িতে কিছুকাল ছিলেন। বোম্বে অবস্থান কালে সেই সময়ের এক নম্বর সুরকার জুটি শংকর-জয়কিষানের নজরে পড়ে যান, এই জুটির হাত ধরেই ‘কাঠপুতলি’(১৯৫৭) সিনেমায় কিংবদন্তী অভিনেতা বলরাজ সাহানির লিপে গাইলেন ‘মঞ্জিল ওহি হ্যায় প্যার কি, রাহি বদল গয়ে’। জীবনের প্রথম ছবিতেই গান গেয়ে সুপারহিট। এ একটা রেকর্ড। এ ব্যাপারে পিছনে ফেলে দেন তালাত মাহমুদকে। তালাত মাহমুদের দ্বিতীয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তৃতীয় ছবিতে গাওয়া গান সুপারহিট হয়েছিল।
শংকর- জয়কিশান তাঁদের সুরারোপিত পর পর আরো তিনটে ছবিতে সুবীর সেনকে দিয়ে
গান গাইয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘ম্যায় রঙ্গিলা পেয়ার কা রহি’, ‘আশ কি পনছী’(১৯৫৬) সিনেমায় জুবিলি স্টার রাজেন্দ্রকুমারের লিপে ছবি সেন কণ্ঠ দিয়েছিলেন ‘দিল মেরা এক আশ কা পনছী, উড়তা হ্যায় উঁচি গগন পর’। বোম্বে থাকাকালীন ‘ছোটি বহেন’(১৯৫৯), ‘বয়ফ্রেন্ড’(১৯৬১), ‘পাসপোর্ট’(১৯৬১) ইত্যাদি বেশ কিছু ছবিতে গান গেয়েছিলেন।
‘হামে উন রাহো পে চলনা’ হ্যায়(মাসুম), ‘প্যার মে মিলনা সনম’(অর্ধাঙ্গিনী),’ইয়েহ পুকার কিসকে লিয়ে’(রানী চন্দ্রাবতী), ‘বুঝ গ্যায়া দিল কা দিয়া’(জাদু আঙ্গুঠী),‘কোই মেরা হো গ্যায়া’(মিডনাইট), ‘জাগো আনজানি রাজদুলারী’(এক সুরাত দো দিল)- প্রভৃতি সুবীর সেনের বলিউডে প্লে-ব্যাক করা কয়েকটি সুপারহিট গানের উদাহরণ।
বোম্বেতে ন’ বছর থাকার পর কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৬৬ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরে সুবীর সেনের আরেক বিখ্যাত রেকর্ড বেরোলো-’নয় থাকলে আরো কিছুক্ষণ’। তাছাড়া, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ১৯৫৬ সালে পুজোর গান হিসেবে রেকর্ড করা ‘এত সুর আর এতো গান’, ১৯৬৭ সালে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও সুরে ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’ কিংবা সলিল চৌধুরীর সুরে ১৯৮০ সালে ‘ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে, কিংবা সলিলেরই সেই বিখ্যাত সৃষ্টি ‘পাগল হাওয়া’-
আজও সবার মুখে মুখে ফেরে। বাংলা, হিন্দি ছাড়াও ওড়িয়া, অসমীয়া প্রভৃতি প্রাদেশিক ভাষাতেও গান গেয়েছেন এবং অগণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের মন জয় করেছেন। অবশ্য কলকাতা চলে আসার পরেও বোম্বেতে গান গাইতে গিয়েছেন। বলিউডে শংকর-জয়কিশান তো বটেই, এছাড়াও কল্যাণজি- আনন্দজি, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল- এঁদের সবার সুরেই গান গেয়েছেন। আধুনিক বেসিক গানের থেকেও বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত
গেয়েছেন এবং শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, সুবীর সেনের আরো বেশি করে রবীন্দ্রসঙ্গীতে মনোনিবেশ করা উচিৎ। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘিরেই
হয়তো দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে সুবীর সেনের গভীর সখ্য তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে সুবীর সেন বোম্বের ফ্ল্যাট জলের দরে বিক্রি করে কলকাতায় নানা জায়গায় থাকতে থাকতে শেষমেশ পণ্ডিতিয়া প্লেসের নিবাসে থিতু হন।
তা বলে বোম্বের গানের টান কিন্তু পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেননি। যখনই অন্তর থেকে ডাক পেয়েছেন, চলে গিয়েছেন।
এমনকি বোম্বে এবং কলকাতায় কিছু ছবিতে সুরস্রষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।
কলকাতায় ১৯৬৭ সালে ‘মিস প্রিয়ংবদা’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ‘মিডনাইট’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মহম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, গীতা দত্তকেও গান গাইয়েছেন। ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্রটি বোম্বে এবং লন্ডনে মুক্তি পায়।
সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সাবলীল বাচনভঙ্গি, সহজাত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন- সুবীর সেনকে চিত্রপরিচালকরা অভিনেতা হিসেবেও দেখতে চাইতেন। একাধিক প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বার অভিনয়কে এড়িয়ে গেলেও ‘মোমের আলো’(১৯৬৪) সিনেমায় উত্তমকুমারের বিপরীতে দ্বিতীয় নায়ক হিসাবে, আবার বোম্বেতে বাসু ভট্টাচার্যের ‘অনুভব’(১৯৭১) সিনেমায় নায়ক সঞ্জীবকুমারের বাঙালি বন্ধু হিসেবে সুবীর সেন স্বনামেই অভিনয় করেছেন(এই সিনেমায় কানু রায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় প্রথম কোনো হিন্দি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়- সুবীর সেন এই সিনেমায় স্বকণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’, পুরোটা অবশ্য সিনেমায় ব্যবহৃত হয়নি।)
এরকমও শোনা যায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিমান’(১৯৭৩) সিনেমায় নায়ক সুবীর কুমারের ভূমিকায় প্রথমে সুবীর সেনকে ভাবা হয়েছিল, সুবীর সেন অভিনয় করতে অসম্মতি জানালে অমিতাভ বচ্চন এই ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত হন।
লেখক হিসেবে সুবীর সেন আরেক বিখ্যাত শিল্পী শ্যামল মিত্রের স্মরণে শ্যামল মিত্রের স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, ‘শ্যামল মিত্র- এ কম্পাইলেশন অফ এসেসেস’-গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে।
সুবীর সেন বাংলা আধুনিক গানে এক নিজস্ব আধুনিক ধারার প্রবর্তক। পশ্চিমী সঙ্গীতের জিম রিভস, ন্যাট কিং কোলের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিদেশী ভাষার গানেও সুবীর সেনের কণ্ঠ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতপ্রেমিদের অপূর্ব লেগেছিল।
আসলে ওঁর কণ্ঠের অদ্ভুত সহজ সরল অথচ গভীর একটা আবেদন ছিল, যে জাদুতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, হিন্দি ফিল্মের যে গানই হোক না কেন, শ্রোতারা তা সানন্দে গ্রহণ করতো।
দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনের সঙ্গীত সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৭ সালে হারমোনিকা সঙ্গীত সম্মান, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সঙ্গীত মহা সম্মান, ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে বঙ্গবিভূষণ সম্মান লাভ করেন।
জীবনের শেষ বছরগুলোতে সুবীর সেন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীরে নানা অসুখ বাসা বাঁধে, এমনকি গান গাওয়ার ক্ষমতাটুকুও চলে যায়। দিনগুলোও তখন বেশ কষ্টে কেটেছে।
শেষমেশ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান।
বিরাশি বছরের আয়ুষ্কালে রেখে গেছেন অগণিত শ্রোতা, বন্ধু -দেশবিদেশের অগণিত প্রিয়জনকে।
ওঁর কন্যা সুপ্রিয়া সেন ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিতে পেশাগত থেরাপির অধ্যাপনা করেন।
সুবীর সেনকে বাঙালি ভোলে নি। যতদিন প্রেম থাকবে, ততদিন ভালোবাসার আবেদনে সুবীর সেন
বেঁচে থাকবেন,- ‘আকাশ যেখানে গল্প বলে’,’যখন হাত বাড়ালেই আকাশ’, ‘চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল’, কিংবা ‘তোমার হাসি লুকিয়ে’,’তোমরা আমার গান শুনে’,’তোমারে পেয়েছি বলে’,’কি ভালো লাগলো চোখে’
-এই ব্যস্ত ’নগর জীবনে’ ‘ছবির মতো, হয়তো…’
এক ব্যক্তিত্বময়ী বিদুষী শিল্পী
গীতা ঘটক
রবীন্দ্র সদনে গান গাইবেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে। উপলক্ষ্য কাকা বিখ্যাত সুরকার গায়ক অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দের জন্মদিন। হলে তিল ধরনের স্থান নেই। বোম্বে, কলকাতাসহ সারা দেশজুড়ে সে সময় থেকেই মান্না দের বিশাল নাম। আবার আয়োজকদের মধ্যেও তিনি আছেন। প্রিয় বাবু কাকার কাছেই যে তাঁর গানের হাতেখড়ি, এবং কাকার প্রদর্শিত পথ ধরেই বড়ো হওয়া। অন্তরের এই অমোঘ টান উপেক্ষা করা যায় কখনো?
যাই হোক, আসল ঘটনায় ফিরে আসি। মান্না দের অনুরোধে একজন গুণী শিল্পী স্টেজে উঠলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইবেন। শ্রোতারা মান্না দের গান শুনতে এসেছে। কিন্তু মান্না দে স্বয়ং যে ওঁর গান শুনতে চাইছেন। তিনি শিল্পীর বহুবিধ প্রতিভার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। তাছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া সবকিছুই যে অসম্পূর্ণ। কিংবদন্তী কৃষ্ণচন্দ্র দে নিজেও রবীন্দ্রসঙ্গীত খুবই ভালোবাসতেন, কিছু রেকর্ডও করেছিলেন। তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগান হবে না, তাও কি হয়?
অবশেষে গান ধরলেন শিল্পী । একটু অন্য ধরনের গলা, স্পষ্ট উচ্চারণ, খাদসপ্তক থেকে তারাসপ্তকে অনায়াসে উঠে যায়, তেমনি গলার কাজ- যেন রাগরাগিণীর সুরসাধনায় এক্কেবারে দারুণভাবে রেওয়াজ করা, পাকাপোক্ত করে বানানো। একের পরে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেছেন। শ্রোতারাও মন দিয়ে গান শুনছেন, সমাহিত হচ্ছেন। কিন্তু একে একে তিনটে গান গাওয়ার পর চতুর্থ গানের সময় শ্রোতারা আর শুনতে চাইছে না৷ ‘গুরুদেব মান্না দে মান্না দে’ বলে চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। নাহ, আর তো ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না। কিছু তো বলা দরকার। যেখানে শিল্পেরই সম্মান নেই, সেখানে নিজেকে সামলে চলারও কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সব সময় চুপ থাকা মানে নিজের আত্মাকেই অসম্মান করা। সেদিনের অপমানিত শিল্পীটি হারমোনিয়াম দূরে রেখে ক্ষুব্ধ হৃদয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,’এখানে গানের শ্রোতাও যেমন নেই, তেমনি সৌজন্যতাটুকুও নেই।’ এই ব্যক্তিত্বময়ী বিদুষী শিল্পীর নাম গীতা ঘটক।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তী হিসাবে আজও তিনি বিপুল সমাদৃত। এক অপূর্ব কণ্ঠ গুণে তিনি সমকালীন শিল্পীদের চেয়ে আলাদা। তাঁর গান শুনলে মনে এক অপূর্ব আবেশের ঘোর লেগে যায়, যা আর মন থেকে ছাড়ে না- থেকেই যায়।

সারাটা জীবন সোজা কথা সোজা ভাবে বলার সৎসাহস সবার মধ্যে থাকে না। তাঁর ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপমান উনি কোনোদিন সহ্য করেননি। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী এই সাধিকা সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি শ্রোতাদের কাছে অনেকটা অবহেলিতই রয়ে গেছেন।
মাতৃভাষা বাংলা হলেও মুখে প্রথম বোল ফোটে কিন্তু জার্মান ভাষায়। জন্ম ২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৩১ সালে রাজশাহীতে জন্ম। জন্মের পরেই বার্লিনে চলে যেতে হয়, (জাপানেও ছিলেন) সেখানে শৈশব অতিবাহিত করে তারপর লখনউতে ফিরে আসা। মাতাপিতা দু’জনেই ছিলেন বিদগ্ধ মানুষ।
পিতা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায়, মা ব্রাহ্ম স্কুলের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে চমৎকার ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন, মাতামহ ছিলেন কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের পরম সুহৃদ, নিজেও ভালো পাখোয়াজ বাজাতেন। ফলে গীতা ঘটক পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রেই সাঙ্গীতিক গুণগুলো লাভ করেছিলেন। ছোটোবেলাটা বাংলার বাইরে কাটলেও মায়ের কণ্ঠে প্রতিদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন। পিতা কানাইলাল গ্যোটের ‘ফাউস্ট’-র বাংলায় অনুবাদ করে জার্মানিতে সম্বর্ধিত হন। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পণ্ডিতজির অনুরোধেই ন্যাশনাল হেরাল পত্রিকা জেনারেল ম্যানেজার হয়ে সপরিবারে লখনউতে চলে আসেন। সঙ্গীতজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রত্যহ ওঁদের বাড়িতে আসতেন। এই বিদগ্ধ মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন শান্তিনিকেতনে না গেলে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যেমন ভালোভাবে তার পরিচিতিটা ঘটবে না, আবার সেই সঙ্গে কিশোর গীতা বাংলাটাও ভালোভাবে শিখবে না।
এইভাবে ধূর্জটিপ্রসাদের ইচ্ছাতেই কিশোরী গীতার শান্তিনিকেতনের পাঠভবন ও সঙ্গীতভবনে পড়াশোনা করতে আসা। এই দু’বছর শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে গুরু হিসেবে লাভ করেন। শান্তিনিকেতনে গানের অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। এদিকে পিতাও কন্যা বিরহে কাতর। ফলে কিশোরী গীতাকে আবার লখনউ ফিরে আসতে হলো। নাচে প্রতিষ্ঠিত হবেন বলে লখনউয়ের মরিস কলেজে ভর্তি হন। আশা ওঝার কাছে কত্থক শেখার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও গান গাওয়া চলছে পুরোদমে । কর্তৃপক্ষ গীতার পরিণত কণ্ঠশৈলীর জন্য তাকে কিশোরী বয়সেই বড়দের বিভাগে উন্নীত করলেন। ছোটোর থেকেই পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিলেন। ক্লাসে প্রতিবারই প্রথম হতেন। ইসাবেলা বোয়ান কলেজ থেকে ইংরেজি সাম্মানিক বিষয় নিয়ে স্নাতক হন। একটা সময়ে নাচ না গান কোন দিকে যাবেন তা নিয়েও ধন্দে পড়ে গেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে আসা কিন্তু কথাকলি নাচ শেখার উদ্দেশ্য নিয়েই। নাচের শিক্ষক চাইতেন, গানের জন্য সময় না দিয়ে নাচটা ভালো করে করুক, আর গীতার প্রিয় ‘শৈলজাদা’ বলতেন, বেশি নাচ করলে গলার সূক্ষ্মতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কার গলা নষ্ট হবে? ছোটো বয়স থেকেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়ে তালিম নিয়ে গীতার গলা যে তৈরি! ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পড়ার পাশাপাশি ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, প্রিয় ‘শৈলজাদা’ (শৈলজারঞ্জন), কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখা চলতে থাকলো। বিবিদির(ইন্দিরা দেবী) কাছে শিখেছিলেন- ‘চিরসখা হে’,’আজি যে রজনী যায়’-এর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত। আগেই রেডিওতে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল, মুখ্যত গুরু শৈলজারঞ্জনের কথাতেই ১৯৫২ সালে আবার বেতারে গান গাওয়া শুরু। তারপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামোফোনে রেকর্ড বেরোলো-’দুজনে দেখা হলো’, ‘সখী বহে গেল বেলা’। ভীষণ জনপ্রিয় হয় রেকর্ড দুটো। পড়াশোনা চলাকালীনই সাহিত্যিক মনীষ ঘটকের পুত্র অনীশ ঘটককে বিবাহ করেন (অনীশ ঘটক মহাশ্বেতা দেবীর ভাই ছিলেন) এবং সেইসূত্রেই বোম্বে চলে আসা। তবে গান ছাড়া একদমই ভালো লাগছিল না। অনীশ ঘটক মানুষ ভালো ছিলেন, কিন্তু বংশপরম্পরায় সুরাসক্ত হয়ে পড়েন, ফলে গীতা ঘটকের বিবাহিত জীবন তেমন ভাল ছিল না।
১৯৬১ সাল। কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ। কন্যা পরমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় চলে এলেন৷ শৈলজারঞ্জন ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে গীতা ঘটককে দিয়ে গান গাওয়াতেন। ১৯৭২ সালে ‘কী ধ্বনি বাজে’,’গেল গো, ফিরিলো না’ রেকর্ডটা খুব বিখ্যাত হলো। ‘তুমি যেওনা এখনি’ এবং ‘যা হবার তাই হবে’ গানদুটো বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আবারও জনপ্রিয়তার শিখরে। গীতা ঘটকের মতো ব্যতিক্রমী শিল্পী খুব কমই দেখা যায়, যিনি কোনো রাবীন্দ্রিক ছক বাঁধা গৎ-য়ে আটকে থাকেননি।
অন্তর দিয়ে গাইতেন, শ্রোতাদের বিমোহিত করতেন, গানের গায়কি, টেকনিক ওসব নিয়ে অযথা ভেবে গানটার মাধুর্য রসহীন করা থেকে বিরত থেকেছেন। চাটুকারিতা, ফাঁকিবাজি, আত্মপ্রচার কোনোদিনই পছন্দ করেননি। তবে আত্মপ্রত্যয় যথেষ্টই ছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীতটা যেমন সুন্দরভাবে গেয়ে গেছেন, তেমন এই গানের বিষয়ে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বপূর্ণ মতামতও দিয়েছেন- তা সে গৃহীত হোক বা না হোক। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর দলের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে চীন, রাশিয়া ওয়ারশও গিয়েছেন। পেশায় কলকাতা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, এখানে ইংরেজি অংকের পাশাপাশি মিউজিক ছাড়াও অন্যান্য সাবজেক্টেও পড়াতেন। সহজ সরল মনের, স্টাইলিশ, সুন্দরী এই মানুষটি দীর্ঘকাল অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক কঠিন কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীত অবলীলায় যেতে পারতেন। গীতবিতানের সমস্ত গান ওঁর কণ্ঠস্থ ছিল। পরিণত বয়সেও বই বা খাতা না দেখে বিশুদ্ধ স্বরলিপি সহযোগে কী অসাধারণভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো পরিবেশন করতেন, তা ওঁর রেকর্ড বা লাইভ অনুষ্ঠান দেখলেই বোঝা যায়। শ্রোতাদের দিকে সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে, সোজা হয়ে বসে একমুখ হাসি নিয়ে হাসতে হাসতে গাইতেন। কখনো গানের ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাচের মুদ্রাতেও শরীর হাত, পা আন্দোলিত হতো। শ্রোতাদের যে কোনো ধরনের অনুরোধের গান শোনাতেও কোনোরূপ কুণ্ঠাবোধ করতেন না, তা সে যেকোনো ধরনের যত কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীতই হোক না কেন। সঙ্গীত পরিবেশনকালে যেমন হাই পীচে সাবলীলভাবে গলা চলে যেত, তেমনি গানের ভাবে শ্রোতারাও মুগ্ধ, আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। এক অনিন্দ্যসুন্দর আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি হতো। গীতা ঘটকের চোখ-মুখে ফুটে উঠতো সেই আনন্দঘন প্রতিচ্ছবি।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একনিষ্ঠ অনুধ্যান ছিল বলে কোনো ধরনের গান গাইতেই ওঁর কোনোরকম অসুবিধা হতো না। সে যুগে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনাতেও কিছু আধুনিকতার নজির রেখে ছিলেন।
মায়া সেন, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, রাজেশ্বরী দত্ত প্রভৃতি খ্যাতনামা শিল্পীদের পাশাপাশি গীতা ঘটক নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক স্বতন্ত্র নাম। ’প্রভু তোমা লাগি’,’সখী আঁধারে একেলা ঘরে’,‘যেদিন ফুটলো কমল’,’কী রাগিনী বাজালে’, ‘এখনো গেল না আঁধার’,’ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’,’শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’- ওঁর কণ্ঠে গানগুলো কি ভোলা যায়?
গানটা ভালো বুঝতেন, সঙ্গীতে যথেষ্ট গভীরতা ছিল বলেই তা নিয়ে কোনোপ্রকার ভুল, অন্যায়ের কাছে কোনোদিন আপোষ করেননি। নিজের নীতি নিয়ে চলেছেন আজীবন, কষ্ট পেয়েছেন, মানুষের ব্যবহারে মর্মাহতও হয়েছেন, কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি একটি বারের জন্যেও।
এমনও হয়েছে, দেবব্রত বিশ্বাসকে যখন শান্তিনিকেতনে গান গাইতে দেওয়া হতো না, এই দৃঢ়হৃদয় শ্রদ্ধেয়া শান্তিনিকেতনে ওঁর নিজের বাড়িতে ডেকে এনেও গানের আসর বসিয়েছেন- ভয় পাননি, বা কোনো প্ররোচনায় প্রভাবিত হননি।
উনি নিজেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানবাড়ি, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জলসা সব জায়গায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সেটা অর্থের বিনিময়েই। (তবে এটা রোজকারের জন্য নয়। কারণ শিক্ষিকা হিসাবে পাওয়া মাইনেই তো তাঁর রোজগার। উনি মনে করতেন, শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা, তাঁর পরিশ্রম -এগুলোর মূল্য আছে। জগতে যা সহজে পাওয়া যায়, মানুষ তার যথোপযুক্ত মূল্য দিতে ভুলে যায়।) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরে কবিগুরুর গানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এ এক প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। মহানায়ক উত্তমকুমারও গীতা ঘটকের গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন।
নাচ, গানের প্রতিভা তো ছিলোই, তাছাড়া নিজেও ভালো অভিনয় করতে পারতেন। স্বামী অনীশ ঘটকের ছোটোকাকা ঋত্বিক ঘটক পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়াতেন। আইপিটিএর ‘বিসর্জন’ নাটক ঋত্বিক ঘটক গীতাকে ‘অপর্ণা’-র চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। তাছাড়া খুড়োশ্বশুর ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় সুপ্রিয়া দেবীর ছোট বোনের ভূমিকায় গীতা ঘটক অভিনয় করিয়েছিলেন।(এই সিনেমায় মহিলা কণ্ঠের সবকটি গানও গেয়েছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে একসঙ্গে গাওয়া ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ আজও বিখ্যাত।’)
অভিনয়ের জন্য প্রচুর আমন্ত্রণ এলেও স্বামীর আপত্তি থাকায় কয়েকটি সিনেমা ছাড়া আর অভিনয় করেননি। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’,’তিতাস একটি নদীর নাম’,’সীমানা ছাড়িয়ে’-ইত্যাদি চলচ্চিত্রে গীতা ঘটককে অভিনয় করতে দেখা গেছে। বোম্বে থাকাকালীন ‘আমরা’ নামের একটা দল তৈরি করেন(পরে যার নাম হয় ইউথ কয়ার)।
ছোটো থেকেই বিভিন্ন রকম পরিবেশে ওঁকে থাকতে হয়েছে। সব রকম পরিবেশেই মানিয়ে নিয়ে চলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি কেন জানি না সবার কাছ থেকেই উপেক্ষিত হয়ে পড়েন। কিংবদন্তী দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনের সঙ্গে গীতা ঘটকের শেষ জীবনের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। শেষের দিকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠানে ওঁকে সম্মান জানানো দূরে থাক, গান গাওয়াটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুণমুগ্ধ প্রিয়জন, এমনকি পরিচিত নিকট গুণীজনরাও সেসময় কেউ তাঁর খোঁজ নেননি। কেবল উত্তমকুমারের শিল্পী সংসদ থেকে মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাতাপ্রদান করা হতো। কোনো পুরস্কারও এই বঞ্চিত অবহেলিত শিল্পীকে দেওয়া হয়নি। এইসব যন্ত্রণা, কষ্ট নিয়েই ১৭ই নভেম্বর ২০০৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে গীতা ঘটক রবীন্দ্রলোকে পাড়ি দেন। রেখে যান কিছু স্মৃতি, তাঁর অনবদ্য সব গান, আর ভাবীকালের কাছে কিছু প্রশ্ন: ভবিষ্যতে রবীন্দ্রসঙ্গীত কি মানুষ অন্তর থেকে গ্রহণ করবে, নাকি তাঁর মতো সুধাকণ্ঠী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে আবারও তাঁকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে- বিভিন্ন চটকদার গানের বাহ্যিক আড়ম্বরে রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর সৃষ্টি কলুষিত হবে- শিল্পী শিল্পভাবনা থেকে সরে গিয়ে বাণিজ্যিক প্রচারেই নিজেদের ব্যস্ত রাখবেন- দেবব্রত বিশ্বাস, গীতা ঘটক, মায়া সেনের মতো শিল্পীদের যথাযথ কদর করতে বাঙালিরা বারবার ভুলে যাবে, সুরবিকৃতির আসুরিক তাণ্ডবে যান্ত্রিকভাবেই রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কি রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনা-সুরকৃত সৃষ্টি বলে মনে হবে, সত্য সুন্দরের নীরব সাধনা কি সত্যিই ব্রাত্য থেকে যাবে আপামর বাঙালি শ্রোতাদের সুকুমার মন থেকে?