অরিত্রী দে
পর্ব – ২০
এনভায়রনমেন্ট – নীতি ও নৈতিকতা
গ্রীক ‘এথোস’ থেকে আগত ‘এথিক্স’, ‘এথনিক’ (Ethics, Ethnic) অর্থাৎ অভ্যাস (Habit)। ‘এথিক্স’ আক্ষরিক অর্থেই দড়ি, যা মানুষকে নিয়ে যায়, যার মাধ্যমে মানুষ নীত হয়। নিজেকে নিজে উপদেশ দেওয়াটা যেখানে ‘এথিক্সে’র ব্যাপার, অপরকে উপদেশ দিয়ে পরিচালিত করাটা ‘এথিকাল’। পরিবেশগত নীতিশাস্ত্রের আধুনিক দর্শন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিকশিত হয়। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, পরিবেশ ও পরিবেশগত সম্পদের অবক্ষয়, সংকট ইত্যাদি সমস্যা পরিবেশগত উদ্বেগের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল সেই সময় থেকেই। তবে, সমসাময়িক পরিস্থিতিতে পরিবেশগত নীতিশাস্ত্র নির্ধারণের সময় কিছু চ্যালেঞ্জও উত্থাপিত হয়। সমাজ, জাতি এবং অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য; দৈনন্দিন জীবিকার জন্য সম্পদ সংগ্রহের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি ছিল পরিবেশগত নীতিশাস্ত্র নকশার মূল চ্যালেঞ্জ। এর ফলে পরিবেশগত নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। পরিবেশগত নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে মূলত তিন রকমের দৃষ্টিভঙ্গি পাই :
১. উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি (Libertarian view)
২. পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি (Ecological view)
৩. সংরক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি (Conservation view)
একটি নদী বনভূমির অভ্যন্তরে খাল এবং পাথুরে গিরিখাতের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। রাজ্য জলবিদ্যুৎ কমিশন এই জলপ্রবাহকে অব্যবহৃত শক্তি হিসেবে দেখে। গিরিখাতের উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করলে এক হাজার লোকের জন্য তিন বছরের কর্মসংস্থান এবং বিশ বা ত্রিশ জন লোকের দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান হতে পারে। এই বাঁধ পর্যাপ্ত জল সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য পরবর্তী কয়েক দশক ব্যাপী প্রয়োজনীয় ‘এনার্জি’ তথা শক্তির চাহিদা কতটা মেটাতে পারবে। এর ফলে ‘এনার্জি ইন্টেন্সিভ ইন্ডাস্ট্রি’র ধারণা দৃঢ় হয়, যাতে কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে পারে।
হয়তো নদী উপত্যকার গভীরতর এলাকায় এমন অনেক গাছ রয়েছে, যা হাজার বছরেরও বেশি পুরানো। উপত্যকা এবং গিরিখাতগুলি অনেক পাখি এবং প্রাণীর আবাসস্থল, যার মধ্যে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীও। অন্যান্য বিরল উদ্ভিদ এবং প্রাণ থাকতে পারে, কিন্তু কেউ জানে না। কারণ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সেই অঞ্চল উঠে আসেনি তখনও।
এখন প্রশ্ন হল- বাঁধটি কি তৈরি করা উচিত? এখানে এমন এক পরিস্থিতি উপস্থিত, যেখানে সমাজ সমর্থিত বহুজনের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে হবে। এমন উদাহরণ আমাদের চারপাশের যে কোনো ঘটনা থেকে তৈরি করা যায়, যেমন- অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপীয় এলাকায় তাসমানিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে ফ্র্যাঙ্কলিন নদীর উপর প্রস্তাবিত বাঁধ, কিংবা বিশ শতকের ছয়ের দশকে দামোদর ভ্যালির উপর ডিভিসি’র বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পকালীন দ্বন্দ্ব। পরিবেশ নীতি বা মূল্যবোধের ‘চয়েজ’ সংক্রান্ত প্রশ্নে উপস্থাপিত করা যায় একাধিক বিষয়- অরণ্যে বৃক্ষ নিধন, কাগজের কল স্থাপন যা জলে দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, অথবা নতুন খনির সন্ধান পাওয়া ইত্যাদি।
সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি যে যারা বাঁধ নির্মাণের পক্ষে, তারা অরণ্য, অরণ্য-সম্পদ, উদ্ভিদ ও প্রাণী (সাধারণ এবং বিপন্ন প্রজাতির সদস্য উভয়ই) সংরক্ষণ এবং ‘আউটডোর রিক্রিয়েশনাল অ্যাকটিভিটি’-এর তুলনায় কর্মসংস্থান এবং রাজ্যের জন্য মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আর তৈরি করতে গেলে অসংখ্য প্রাণীর আবাসস্থল ভেসে যাবে, তারা উদ্বাস্তু হবে। মানুষের বিশিষ্টতা এখানেই যে সে সংবেদনশীল এবং নীতিপ্রবণ। বাঁধ নির্মাণের কারণে একজন মানুষের ভেসে যাওয়ার বর্ণনা যতখানি ভয়ানক, একটা গরু-ছাগল কিংবা অন্যান্য বসবাসকারী প্রাণীর ভেসে যাওয়ার কথা, কোনো এলাকায় গাছের গোটা ‘কমিউনিটি’র মৃত্যুর কথা ততটা বীভৎসতা তৈরি করে না। কার্যতই মানুষ নামক প্রাণীর বাইরেও নীতিশাস্ত্রকে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রসারিত করা একটি কঠিন কাজ।
প্রকৃতির প্রতি পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি বাইবেলের প্রাথমিক বইগুলিতে বর্ণিত হিব্রু জনগণের এবং প্রাচীন গ্রীকদের দর্শন, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলের দর্শনের মিশ্রিত রূপ। হিব্রু এবং গ্রীক উভয় ঐতিহ্যই মানুষকে নৈতিকতার কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্যই এখানে যে ‘আত্ম’ জ্ঞান সবার থাকলেও একমাত্র মানুষই ‘এথিকাল’ (ethical)।
আদিপুস্তকে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে বাইবেলের গল্পটি ঐশ্বরিক পরিকল্পনায় মানুষের বিশেষ স্থান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে:
ঈশ্বর বললেন, “আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টি করি; তারা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখি, পৃথিবী এবং পৃথিবীতে গমনশীল সমস্ত সরীসৃপের উপর কর্তৃত্ব করুক।” এইভাবে ঈশ্বর মানুষকে তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করলেন, তাদের আশীর্বাদ করলেন- “তোমরা ফলবান হও, বহুবংশ হও, পৃথিবীকে পরিপূর্ণ কর, বশীভূত কর; সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখি এবং পৃথিবীতে বিচরণশীল সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর উপর কর্তৃত্ব কর।”
সেই অনুসারে ঈশ্বর যখন মানুষকে অবাধ্যতার জন্য শাস্তি দিতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রাণীকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন তখন ঈশ্বর যে উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মানুষ একটি নদী উপত্যকার বন্যা নিয়ে চিন্তা করার মতো কিছু পাবে না।
এইরকম ‘অধিকার’ প্রদানের অর্থ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে বহু; এবং পরিবেশ সম্পর্কে যারা উদ্বিগ্ন তারা দাবি করে যে এমন ‘ডিক্রি’কে আমাদের চারপাশের অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীর সাথে ইচ্ছামত আচরণ করার অনুমতি হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। পরিবর্তে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে আমাদের পরিবেশ এবং তার সম্পদের যত্ন নেওয়ার, তাদের সাথে আমরা যেভাবে আচরণ করি তার জন্য ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি করার নির্দেশ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। এর তাৎপর্য স্পষ্ট- এমনভাবে কাজ করা যা পৃথিবীতে চলাচলকারী সবকিছুর জন্য ভয় এবং আতঙ্কের কারণ হয়; এটি আসলে ঈশ্বর-প্রদত্ত বিধানেরই অনুসরণ।
এমনকি মানব কেন্দ্রিক নৈতিক কাঠামোর (Human centred ethical structure) মধ্যেও, আমাদের পরিবেশের সংরক্ষণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফসল ফলানো এবং পশুপালনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে, মরুভূমিকে পতিত ভূমি, অকেজো এলাকা বলে মনে হতে পারে যাকে উৎপাদনশীল করার চেষ্টা মানুষই করতে পারে। একটা সময় ছিল যখন কৃষিজমি দ্বারা বেষ্টিত গ্রামগুলিকে ঢালাও অরণ্যের মধ্যে, মরুভূমির মধ্যে কিংবা রুক্ষ পাহাড়ি ঢালের মধ্যে মনে হতো কৃষির মরূদ্যান। আধুনিক সময়ে আধুনিক হওয়ার মূল্যে আমাদের কাছে থেকে যাওয়া অরণ্যের অবশিষ্টাংশ মানব সভ্যতার কর্মকাণ্ডের সমুদ্রে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এখানেই অরণ্য, অরণ্যসম্পদের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘স্কারসিটি ভ্যালু’ (Scarcity Value) তথা অভাবের নীতি, যার ফলে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত যুক্তির ভিত্তি দৃঢ় হয়। তা মানবকেন্দ্রিক নীতির শর্তাবলির মধ্যেও প্রযোজ্য, দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে এই যুক্তি আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাজস্থানের ‘ট্রি ম্যান’ সুরেন্দ্র আওয়ানা, ‘ট্রি টিচার’ হিম্মতারাম ভম্ভু প্রমুখ মাঝে মাঝে কয়েকজনের উদ্যোগ সামনে আসলেও আসলে একটা গোটা রুক্ষ শূন্য এলাকার ‘কালচার’ পাল্টে দিতে প্রয়োজন ‘কমিউনিটি’র এথিকাল পরিবর্তন।
চিত্র – ‘বাংলা লাইভ.কম’, ‘উইকিপিডিয়া’
আমরা সবাই জানি আমাদের বাগানের গাছপালার জন্য কী ভালো বা কী খারাপ। জল, সূর্যালোক এবং সার ভালো, অতিরিক্ত তাপ বা ঠান্ডা চরম ক্ষতিকর। যে কোনো অরণ্য বা প্রান্তরের গাছপালার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, তাহলে কেন তাদের বিকাশকে নিজেদের ভালো লাগা বলে বিবেচনা করা হবে না! প্রাচীন অরণ্য কেউ লাগায়নি, তাকে সংরক্ষণ করতে হয় না। অথচ আজ আমরা এমন জায়গায় উপনীত হয়েছি যে বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও পরিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়ার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন সুযোগ তৈরি করে যেতে পারি, এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করে যেতে পারি (বই, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে) যা আমাদের সন্তানদের এবং তাদের সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। অর্থাৎ অত্যাধুনিক ধূসর পৃথিবীর উল্টোদিকে হস্তান্তর যোগ্য পৃথিবীর বিকল্প রেখে যেতে পারি। রুক্ষ এলাকায় মিলিতভাবে জল সংরক্ষণ করার প্রকল্প যখন এলাকার ‘কমিউনিটি’ নিজের ঘাড়েই নিত, এলাকার পুকুর গুলির রিচার্জ করার ব্যবস্থা থাকত, পুকুরের তলদেশে এক কোণে কুয়ো খুড়ে রাখার ফলে জল কখনও শুকোত না- সেগুলোই ‘এনভায়রনমেন্টাল এথিক্স’। যদি আমরা মনে করি যে কম্পিউটার গেম খেলার চেয়ে
অরণ্যের পথে হেঁটে একটি দিন কাটানো গভীরভাবে ফলপ্রসূ, অথবা যদি মনে করি যে এক সপ্তাহের জন্য ব্যাকপ্যাকে খাবার এবং তাবু বহন করে আদিম প্রকৃতিতে থাকা, হাইকিং করা টেলিভিশন দেখার চেয়ে চরিত্রের বিকাশে আরও বেশি অবদান রাখবে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতি সহাঅনুভূতি ও সমানুভূতি রাখতে উৎসাহিত করা উচিত। যদি তারা বিকল্প হিসেবে কম্পিউটার গেম পছন্দ করে, তবে আমরা ব্যর্থ হব। অবশেষে, যদি আমরা বর্তমানে বেঁচেবর্তে বনভূমি অক্ষত রাখি, নদীতীর, সমুদ্রের তটকে বুঝতে পারি, মানুষ ছাড়াও অপরাপর প্রাণীর ন্যূনতম চাহিদাটুকু উপলব্ধি করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্তত তাদের কম্পিউটার গেম থেকে উঠে এমন একটি পৃথিবী দেখার বিকল্প পাবে যা মানুষের দ্বারা তৈরি করা হয়নি। যদি আমরা ধ্বংসই করি, তাহলে সেই পছন্দ বা ‘চয়েজ’ চিরতরে চলে যাবে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন