অরিত্রী দে

চতুর্দশ পর্ব

ইকোফেমিনিজম : পর্ব এক

“Eco-feminism is a recent development in feminist thought which argues that the current global environmental crisis is a predictable outcom of patriarchal culture.”

-Ariel Salleh, অষ্ট্রেলিয়ান সমাজবিজ্ঞানী

প্রথমে ছিল কৃষি উৎপাদনের শান্তিপূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক যুগ, খৃঃপূঃ ৪৫০০ বছর আগে ইউরেশিয়া থেকে যাযাবর জাতির ইন্দো-ইউরোপীয় অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালানোর সময় থেকেই প্রকৃতি ও নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যের সূত্রপাত হয়, তথা কৃষিযুগের শেষ বা বলা ভালো কৃষি-জমি অধিকারের যুগ শুরু। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই আসলে পুরনো পৃথিবীর ধ্যান-ধারণা পাল্টে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততার সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কে মোড় নেয়। জন্ম হয় যুক্তিবাদী যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বিজ্ঞানের। 

মানবী নিসর্গবাদ বা ‘Eco feminism’ পরিভাষাটি ১৯৭৪ সালে প্রথম ব্যবহার করেন ফ্রাঁসোয়া দ্য ওবোন (Françoise d’Eaubonne, ১৯২০-২০০৫)। এই দর্শনের ধারণাটি মূলধারায় আসে ১৯৮৭ সালে ইকোফেমিনিস্ট ইনেস্ত্রা কিং (Ynestra King) রচিত একটি নিবন্ধ ‘What is Ecofeminism?’-এর মাধ্যমে। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা আসলে মিথোজীবীতা বা ‘সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ’- এর ওপর ভরসা করেন। মূলতঃ নিসর্গ ন্যায়ের সমস্যামূলক অবস্থান থেকেই নিসর্গনীতি, যেখানে মনে করা হয় প্রকৃতি-মানুষ ও  নারী-পুরুষের কোনো এক পক্ষ দুর্বল হলে অপর পক্ষ তার উপরে আধিপত্যমূলক শাসন চালাবেনা। এমনকি কোনো এক পক্ষের মতামত অপর পক্ষকে নির্বিশেষে পরিচালনা করবে না। অর্থাৎ প্রতিষিঠত সামাজিক বিন্যাসকে অন্যভাবে, বলা ভালো নতুনভাবে পারষ্পরিকতার সম্পর্কে সাজাতে বলা হয় এখানে। কোনো একাধিপত্যের বদলে স্থান পাবে বহুত্ববাদ (Pluralism) ও সাম্য। নিসর্গ নারীবাদে সমাজকে অস্বীকার করা  হয়নি, বরং মানুষের সাথে প্রকৃতির প্রয়োজনের সম্পর্ককে সামাজিক নির্মাণের ফসল বলে স্বীকার করে নেওয়া আছে। সমাজের বদল ঘটানোতে, আসলে বিপল্প দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে বিশ্বাস স্থাপনের কথা পাই। ‘ইকোফেমিনিজমে’র দর্শন কতকগুলি নৈতিকতার অনুশীলনে গুরুত্ব আরোপ করে- 

প্রথমত, মানবী ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ে কোনো কাব্য বা রহস্যময় আবরণ তৈরি করা নয়, বরং তাকে দৃশ্যায়িত করে তোলা। নারী ও প্রকৃতি উভয়কেই যে কোনো রকম আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে হবে। ‘ওম্যান-নেচার’ (woman-nature) সম্পর্কই ইকোফেমিনিজমের মূল ভিত্তি। 

দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক প্রভেদ থাকলেও বিসম আচরণ থেকে নিবৃত্ত থাকার অনুশীলন,

তৃতীয়ত, নব সামাজিক বিন্যাসের চাহিদা থেকেই (ধ্বংস ও সামাজিক পচনশীলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে) শীল ও চর্যার অনুশীলন। মানবিক নানা গুণাবলি, যেমন- ‘সম’ আচরণ করা, দুর্বলের প্রতি নিপীড়নের সমাপ্তি ঘটিয়ে দরদপূর্ণ মনোভাবের চর্চা করা ইত্যাদি। আমাদের যাকিছু মানবিক মূল্যবোধ, তাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করতে হবে। অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা লাভ করেছিলাম কিন্তু শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদ আমাদের সরল সাধারণ জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিত্বকেও নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব যেহেতু ব্যক্তিত্ব জন্মদত্ত নয়, সৃজিত। 

মানবী নিসর্গবাদ অনুযায়ী প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সম্পর্কের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যা পুরুষ (বা ক্ষমতা) নিয়ন্ত্রিত সমাজের ইতিহাস। এই ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সমার্থক ‘আইডেন্টিটি’ বোঝা সম্ভব৷ পরিবেশবিদ বন্দনা শিবার মতে- “Eco feminism is to redifine how societies look at productivity and activity of both women and nature who have mistakenly been deemed passive, allowing for them be ill-used.”

তৃতীয় বিশ্বের মানুষের শ্রম, ঘাম, রক্ত ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে প্রথম দুনিয়ার একনায়কতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে- এই ভাবনায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নারীর অবমূল্যায়ন পরস্পরের সমার্থক হয়ে যায়। পণ্য ও পুঁজিবাদ প্রভাবিত সমাজ কিভাবে দেখে প্রাকৃতিক উর্বরাশক্তি ও নারীর উৎপাদন ক্ষমতাকে, যে নদীর জল বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেমন কাজে লাগানো যায়নি, যে অরণ্যের সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করে ‘ডলার’ উপার্জন করা যায়নি, তার গুরুত্বকে? নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে বোঝা শুরু হল সেসব। যায়নি, সেই অরণ্য ও নদীর কোনো মূল্য নেই। রিলায়েন্স কোম্পানি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে শাকসব্জির জোগান বাড়াতে ‘রিটেইল শপ’ খুলতে চলেছে। ফলে চাষযোগ্য জমির ফসল হচ্ছে ‘রিলায়েন্স’ নামক কোম্পানির, জন্ম নিচ্ছে অদৃশ্য মালিক। কোম্পানি নির্দিষ্ট করে দেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল ফলাতে কতজন শ্রমিক চাষী লাগবে, এবং অবশ্যই সেখানে ছেলে চাষি অগ্রাধিকার পাবে ছাঁটাই পড়বে মেয়েরা। কোম্পানি নির্দিষ্ট সারে জমির বিপুল ক্ষতি হতে থাকে। জলের ধারা বেঁধে শিল্প ও পণ্য-পুঁজির কাজে লাগানোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় নদীর আশেপাশে থাকা অভাবী মানুষেরা বা অরণ্যচারী সম্প্রদায়গুলি;বিশেষত পরিবারের মেয়েরা। কেননা ঘরে-সংসারে জলের যোগান তাদেরই দিতে হয়, খাদ্য সরবরাহের দায়ও তাদেরই। 

প্রথম বিশ্বের উন্নয়ন ও শিল্পায়ন সম্পর্কিত নানা নীতিসমূহের ফলে নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। আর প্রাচীনকালে আদিম মানুষের যা কিছু সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠেছিল, সেই সবই নারীদের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। পুঁজি ও পণ্য তাকে আঘাত করলে যে সংকটের সৃষ্টি হয়, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফেলে আসা চর্যার নিরিখে সমাজের নববিন্যাসের উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। এখানেই চর্চা করতে হয় ‘ইকোফেমিনিজম’-এর-

“Ecofeminism is then presented os as offering alternative Spiritual symbols (e.g- Gaia, os goddess symbols), spiritualities, theo logies & even utopian Societies.” 

-J. Waren 

‘লিবারেল ফেমিনিজম’-এ (Liberal Feminism) প্রকৃতি আধিপত্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চোখে কল্পিত। আবার ‘মার্ক্সিস্ট ফেমিনিজম’-এ (Marxist Feminism) নারী নিপীড়নকে শ্রেণী নিপীড়নের দৃষ্টিতে বিচার করা হয়। মানুষের প্রয়োজন মেটাতে আধুনিক পুঁজিবাদের যে গতিশীল চরিত্র, তা প্রকৃতিকে দোহন করেই সম্ভব হয়েছে। আবার ‘র‍্যাডিকাল নারীবাদ’ (Radical Feminism) নারী ও প্রকৃতির উপর অত্যাচারের মূল সূত্র খুঁজে পায় প্রজনন জীববিজ্ঞান ও যৌন-লিঙ্গ ব্যবস্থায় (Reproductive biology and Sex gender system)। নারীর সমস্যাকে পরিবেশ সমস্যার অন্তর্ভুক্ত করে নিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হয়। নারী-নিপীড়ন ও প্রকৃতি-ধ্বংস একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। জৈবিক চাহিদা মেটাতে নারী দেহের উপর চাপ সৃষ্টি, উত্তরাধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণে প্রকৃতি আর তার উপাদানের  অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আর নারী-প্রকৃতির স্ব অধিকারে মুক্তির দাবি  নারী নিসর্গবাদী ভাবনায় ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটায়। ‘ইকোফেমিনিজম’-এর একটি মৌলিক সমস্যার সঙ্গে বহুস্তরীয় বিন্যাস যুক্ত হয়ে যায়, ক্ষমতা-অত্যাচার-শোষণ  ও প্রকৃতি-নারী-তৃতীয় বিশ্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *