অরিত্রী দে

ত্রয়োদশ পর্ব

ইকোক্রিটিকাল ওয়েভ

বিংশ শতকের ছয়ের দশকে (১৯৬০) পরিবেশগত আন্দোলনের সূচনা এবং ১৯৬২ সালে রাচেল কারসনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রকাশের মাধ্যমে ‘ইকো’ (Eco) সম্পর্কিত ‘ক্রিটিসিজমে’র (criticism) আবির্ভাব ঘটে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই ধরনের সমালোচনা শুরু হয় আটের দশকে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে কয়েকটি ধারায় তা বিকাশ লাভ করে। এখনও পর্যন্ত পরিবেশ-সমালোচনার যে তরঙ্গ দেখা দিয়েছে – একটি ১৯৮০ সালে এবং অপরটি ১৯৯০ তে। লরেন্স বুয়েল ও চেরিল গ্লটফেল্টির মতো পরিবেশবাদী তাত্ত্বিকরা মোটামুটি এই দুই তরঙ্গকেই চিহ্নিত করেছিলেন। ‘ইকোক্রিটিসিজম’- এই বিশেষ ধরনের সমালোচনাগত অধ্যয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পাঠ্য সীমার বাইরে বিশ্ব-সাহিত্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়। এমনকি অভিব্যক্তিগত দিক থেকে সাহিত্যের সেই ফর্মগুলির সন্ধান চালানো হয়, যা খুব শক্তিশালী পরিবেশগত বার্তা রাখতে সক্ষম। ‘The environment imagination’-এ লরেন্স বুয়েল (১৯৩৯) একটি পরিবেশ-ভিত্তিক কাজের বিষয়ে চারটি ‘উপাদানের’ চেকলিস্ট তৈরি করেন:

১। ‘Non human environment’ তথা অ-মানুষী পরিবেশ শুধুমাত্র একটি ফ্রেমিং ডিভাইস হিসাবে পৃথিবীতে উপস্থিত নয়। বরং তার ইতিহাসের সাথে মানব ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত, 

২। মানুষের স্বার্থই একমাত্র বৈধ স্বার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে না,

৩। পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা কোনো টেক্সটের নৈতিক অভিযোজনের দিক, 

৪। কোনো ধ্রুবক নয়, তার পরিবর্তে একটি প্রক্রিয়া হিসাবে পরিবেশের উপস্থিতির অনুভূতি (sense of environment as process) অন্তত টেক্সটের অন্তর্নিহিত ব্যাপার হবে।

স্পষ্টতই এই চেকলিস্ট পরিবেশ সংক্রান্ত সমালোচনার প্রতি লক্ষ্য রেখে তৈরি। পরিবেশের প্রতি কোনো টেক্সটের ‘নৈতিক  অভিব্যক্তি’র দিকটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে লরেন্স বুয়েল ‘ইকোক্রিটিসিজমে’ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে নির্দেশ করেন- ‘পরিবেশবাদী অনুশীলন অঙ্গীকারের চেতনা’ (Spirit of commitment to environmentalist praxis)। একটি তাত্ত্বিক ক্ষেত্র হিসাবে সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এই চিন্তা ও চেতনার চর্চা। ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র প্রথম তরঙ্গটি দু’টি মাত্রায় পরিবেশ-প্রকৃতি সম্পর্কে লেখালেখির উপর জোর দেয়- ক. অধ্যয়ন (Study) এবং খ. একটি অর্থপূর্ণ অনুশীলন (Meaningful Practice)-এর ক্ষেত্রে। 

‘ইকো-ক্রিটিসিজমে’র প্রথম তরঙ্গ প্রকৃতির মূল্য এবং প্রকৃতির পক্ষে কথা বলার ও দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে উন্নীত করেছিল। এই সময়ে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে মানবিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের দায়িত্ব একসাথে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের সমাধান নিয়ে আসা। আমেরিকায় ‘ইকোক্রিটিসিজম’ মূলত: ‘নন ফিকশন’ জাতীয় লেখাপত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তাই বলে সর্বত্র এরকমটা হয়নি, কোথাও কোথাও কবিতার মাধ্যমে ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র চর্চা হয়েছে। জোনাথান বেট তাঁর ‘Romantic Ecology: Wordsworth and the environmental tradition’ (১৯৯১) এবং ‘The song of Earth’ (২০০০) বইতে রোমান্টিক কবি হিসাবে পরিচিত উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে ‘প্রকৃতির কবি’ তথা ‘Poet of nature’ অভিধায় ভূষিত করেন। ফলে ‘ইকোক্রিটিসিজম’কে আগে রোমান্টিকতায়, বন্য আখ্যান (Wild narrative) সহ নানা প্রকৃতিকেন্দ্রিক লেখালেখি দিয়ে বিশেষিত করা হত। বলতে বাধা থাকেনা যে এই পর্বে ‘Nature’ বা ‘প্রকৃতি’ মানব বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই এক ‘romanticised idea’ বা ‘ধ্যান’ হয়ে থেকে যায়। 

প্রায় কাছাকাছি সময়পর্বে আরো এক গোষ্ঠীর ‘ইকোলজিস্ট’ আমাদের অতিপরিচিত প্রিয় গ্রহ ‘পৃথিবী’তে মানুষ-প্রকৃতির অবস্থানের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁরা ‘ইকো’কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থিত ‘বায়োস্ফিয়ারিক্যাল সমতাবাদ’কে গ্রহণ করলেন। এখানে আর এককের স্বার্থ না, বরং সমগ্র বায়োস্ফিয়ারের স্বার্থ সমর্থিত হল। নিজের গভীর ‘আত্ম’কে পরিবেশের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করতে চাইলেন যাতে পরিবেশ সচেতনতা স্বতঃস্ফূর্ত নৈতিকতার অংশ হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক বিশ্ব আধুনিক মানব সভ্যতার ‘সম্পদ’ (Resource), ইচ্ছে মতো ভোগের অধিকার মানুষের আছে- এই আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি চ্যালেঞ্জ তৈরি হল। আমরা, তথাকথিত সভ্যতাধারী মানুষেরা যে বৃহৎ ‘জীবন চক্রে’র (Life circle) অন্তর্ভুক্ত, আমাদের সংসার শুধু আমাদের নিজেদের নিয়ে নয়- চিন্তার পরিধি ব্যস এতদূর বাড়াতে পারলেই প্রাকৃতিক বিশ্বের প্রতি আচরণগত বিপুল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব; আমরা আদপেই এক বৃহত্তর বৃত্তের অন্তর্গত। সামাজিক পরিবেশবিদরা (social environmentalist) বিশ্বাস করলেন ও করালেন যে প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্য লাভের ধারণাটি মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত। এখানেই ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র দ্বিতীয় তরঙ্গের যৌক্তিকতা। পন্ডিতেরা (literary scholars) বুঝতে শুরু করলেন প্রথম তরঙ্গে প্রকৃতিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক জীবনের জায়মান পরিবেশগত সমস্যা ও সংকটের সমাধানগত আলোচনায় অক্ষম। ফলে তাঁরা ‘পরিবেশ’- এই পরিভাষাটির পরিসীমাকেই বর্ধিত করলেন; মানুষ ছাড়াও অপরাপর প্রাণ, এমনকি অজৈব উপাদানও এই বৃত্তেরই। বাস্তুতন্ত্রে (Ecology) সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হচ্ছে সমাজ দ্বারা পরিবেশের প্রভাবিত, বলা ভালো ক্ষতি হওয়ার সমস্যাটি উত্থাপিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের উদগাতা রূপে মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার না করলে ‘ইকোক্রিটিসিজম’ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।  বদলে যাওয়া অভ্যাস ও ক্রমবিবর্তিত সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া আর পণ্যের বিস্তৃত পরিসরে মনোযোগ এসে পড়েছে, যেখানে ও যার মাধ্যমে প্রকৃতি আর সংস্কৃতির জটিল আলোচনা সংঘটিত। চেরিল গ্লটফেল্টি তাঁর বইতে ১৯৯৬ তে বলেন- শ্রেণি, লিঙ্গ বৈষম্য বিশ শতকের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়; কিন্তু আমরা জানতে পারিনি যে আমাদের পৃথিবীর লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমটাই সঙ্কটাপন্ন। আমরা আসলে ভেবেই দেখিনি যে আমাদের এই ভোগ, ভোক্তা, উৎপাদন, উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তির বাইরে পৃথিবী বলে কিছু আছে। প্রথম তরঙ্গ থেকে দ্বিতীয় তরঙ্গে ‘ইকোক্রিটিসিজম’ ও পরিবেশচিন্তার ফোকাসের কিছু পরিবর্তন হল। একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল এই যে, পরিবেশগত সমালোচনা পরিবেশগত সমস্যাগুলিকে উপস্থাপন করার জন্য নির্দেশিত হল। এরই উত্তরাধিকারে একবিংশ শতাব্দীতে ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র একটি বাস্তব সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রইল। 

লরেন্স বুয়েল নিজে ‘ইকোক্রিটিসিজম’ তরঙ্গের প্রবক্তা হলেও তরঙ্গগুলি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল যে সাহিত্যের অধ্যয়নে পরিবেশগত সমালোচনার কোনো নির্দিষ্ট মানচিত্র সম্ভব না। তবুও ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র প্রথম তরঙ্গ থেকে দ্বিতীয় বা নতুনতর সংশোধনবাদী তরঙ্গে বিবর্তনকে চিহ্নিত করে বেশ কয়েকটি প্রবণতা-রেখা নির্দেশ করা যেতে পারে। 

“No definitive map of environmental criticism in literary studies can be drawn. Still, one can identify several trend-lines marking an evolution from a ‘first wave’ of ecocriticism to a ‘second’ or newer revisionist wave or waves increasingly evident today. This first-second wave distinction should not, however, be taken as implying a tidy, distinct succession. Most currents set in motion by early ecocriticism continue to run strong, and most forms of second-wave revisionism involve building on as well as quarreling with precursors.” (‘Future of ecocriticism’, 17)

অনেকে এমন যুক্তিও দেন যে দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদী চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিসর্গ নারীবাদকে যথাযথ মূল্য দেয়নি। এখন বুয়েলীয় বক্তব্য অনুসারে ‘ইকোক্রিটিসিজমে’র দ্বিতীয় তরঙ্গটি পরিবেশ-সমালোচনাকে সংশোধিত করেছিল বটে, তবে এটি প্রথম তরঙ্গের উপাদানগুলির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *