মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
একবিংশ পর্ব
একটা রেডিও, একটা একপায়া গোল টেবিল, একটা লাল অ্যাটাচি, একটা তিন থাকের কাঠের তৈরি কাচের দরজা দেওয়া ছোট্ট আলমারি, দেওয়ালের তাক ভর্তি ডাক্তারী বইপত্রর সাথে সার সার রবীন্দ্রনাথ, সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবী কাট কলার দেওয়া শার্ট আর আনন্দবাজার পত্রিকা। একটা বাক্যে এই আমার দাদু। সেই নেই হয়ে যাওয়া বাড়িটা সবাই যাঁর নামে চিনত। আমার পুরোনো পাড়ার গল্পে বার বার যাঁর কথা ঘুরে ফিরে আসে।
এই যে বসন্তের মৃদু হাওয়া…ওড়না, চুল, মেলে রাখা গামছা সব কিছুর সাথে এলোমেলো করছে মনটাকে। একটু হঠাৎই পাওয়া অবসরে বিছায়ায় এলিয়ে আছি। লালচে জামপাতা নাচছে ও পাশের বাড়ির ছাতের ওপর। দমকা বাতাসে বেলপাতা ঝরার খসখস আওয়াজ আসছে কানে। যেন একটা তন্দ্রালু মায়া, একটা চৈতালি দিনের স্বপ্ন। চার্লস ল্যাম্ব না উইলিয়াম শেক্সপীয়র কে যে ডাক দিলেন জানি না। পুরোনো পাড়ার এ রকম কত ছবির টুকরো ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।

দাদু চলে যাবার পর দাদুর এই সম্পত্তি আমার হয়েছিল। কারণ ঘরটায় আমরা দুই ভাই বোন থাকতাম। খুব প্রিয় সেই গোল ছোট টেবিলটা ভেঙে গেছিল একেবারেই। রেডিওটাও বাতিল হয়েছিল। কিন্তু থেকে গেছিল একটা একা মানুষের মাপের সুন্দর পালঙ্ক। আর সেই কাঠের আলমারিটা। পালঙ্কের পাশে বেঞ্চ জোড়া দিয়ে একটু বড় করা হয়েছিল কয়েক বছর, ভাই বোন এক সাথে আশ্রয় নিতাম। আর যোগ হয়েছিল টেবিল চেয়ার। একটা দেওয়াল আলমারি, একটা শোকেস। তিন দরজা, চার জানালার কি আলোময় ঘরখানা! আমি এখনও ভাবি আমার ঘর।
অনেক পরে আমার বিয়ের পরে ঘরখানা থেকে সময়ের দাবি মেনে সরে গেছিল সেই সব পুরাতন আসবাব। আমার প্যাকেট বাক্সে রাখা গণ্ডা গণ্ডা বই। আলমারিটা স্হান পেয়েছিল রাস্তার দিকের টানা বারান্দায়। আর পালঙ্কটার ও বাড়িতে কোনো জায়গা হচ্ছিল না বলে আমার ভাড়াবাড়িতে নিয়ে আসি। কারণ এটার মায়া আমি ত্যাগ করতে পারছিলাম না, এবং আজও পারি নি। সাথে করে নিয়ে এসেছি মেদিনীপুর। পালঙ্কটা আত্মজীবনী লিখতে পারলে মাগুরা থেকে শান্তিপুর- কালনা হয়ে মেদিনীপুর আসার আশ্চর্য যাত্রার কথা লিখতো। এখন বেঁচে থাকলে দাদুর বয়স হতো একশ কুড়ি। আমার মনে হয় এ পালঙ্কও শত বছর পার করে ফেলেছে।
বারান্দায় শেষ বয়সে ধুলো মেখে থাকা আলমারিটা আর আছে কি না আমার জানা নেই। ছোট ছোট কত জিনিসের ওপর মানুষের মায়া আর অধিকারবোধ থাকে তা হয়ত এমন প্রবল ভাবে অনুভূত হতো না, যদি না আমার ছোটবেলার বাড়িটা ঘটনাচক্রে নেই হয়ে যেত। একটা ওয়াকম্যান, একটা ন্যাশান্যাল প্যানাসোনিক টেপ রেকর্ডার, কিছু প্রিয় বই আর ম্যাগাজিন (ভাই আর আমার লেখা যাতে যাতে প্রকাশিত হতো আলাদা করে রাখতাম) আর অগুন্তি ক্যাসেট, বহু কষ্টে জমানো অল্প কিছু পয়সা লুকিয়ে রাখার ছোট্ট একটা ব্যাগ এইসব রেখে ছিলাম তাতে। পরে একটা ক্যামেরাও কিনেছিলাম টিউশনির টাকায়। সেটাও ছিল। মাথার ওপর ভাইয়ের আঁকার সরঞ্জাম, টুকিটাকি কিছু জিনিস। অনেক অনেক ছবির অ্যালবামও ছিল। সেইসব ছবি প্রায় সবই আমার সাথে আছে এখন। ফেলে আসতে পারিনি ভাইয়ের অপরিণত বেলার লেখার খাতা বা নাটকের ফাইলকে। মঞ্চস্থ হওয়া, না হওয়া স্ক্রিপ্ট, খসড়া নাটক, যেসব সে কোনো আরও বেশি সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখতে চেয়ে ভুলতে বসেছিল; যাদের আমি কখনও ছেলেবেলার পাগলামি বলে ভুলতে পারিনি- সে সবই আমার কাছে গচ্ছিত আছে।
কিন্তু ফেলে এসেছি সেই অঢেল ক্যাসেট, বাবার বহু শখের সব সংগ্রহ – বছর বছর পুজোর গান, নবদ্বীপ হালদার থেকে ভানু, অনুপ জালোটা থেকে রফি, রোমান্টিক ডুয়েট থেকে ‘মীরার বঁধুয়া’, ‘ছোটদের রামায়ণ’ থেকে অনুপ ঘোষালের ‘আবোল তাবোল’। পরের দিকে আমার বা ভাইয়ের পছন্দের মুভির গান।
টেপটা বহুবার সারানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বৃদ্ধ রোগীর মতো সেরে উঠতে তার আর চেষ্টা ছিল না। ক্যাসেটগুলো তবু ছিল অনেক বছর।
ওই ঘরে কত বন্ধুর সাথে কত আলাপের স্মৃতি, রাগ অভিমান, ভাই বোনের খুনসুটি আজও তেমনি স্পষ্ট আমার চোখে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)