মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

অষ্টাদশ পর্ব 

এক একদিন চোখ বুজে শুয়ে অলস দুপুরে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। কালনার শীত-রাস্তায় ডাক দিয়ে চলেছে ‘চাই জয়নগরের মোয়া…’, সে ডাক শেষ হতে না হতেই আবার কেউ ডাক দিচ্ছে ‘মালাই কুলফি…কুলফি মালাই’।

সে কি! শীতের ঝিম দুপুরে কুলফি! হঠাৎই চটকা ভেঙে গেলে বুঝি মাঝ শীতে কোনো অলস দুপুরের লেপমুড়ি আমার মেদিনীপুরের কনকনে দুপুরটাকে বদলে দিয়েছে কালনার সেই কবেকার ইনভার্টারহীন বিদ্যুৎবিহীন গ্রীষ্মের দুপুরে। নানা রকম ফেরির ডাক বোধ হয় জন্ম থেকে আমাদের অস্হির ভেতর মজ্জা হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও তাই খুঁজে পাই বরফ বা বেলিফুল বিক্রির ডাক। এমনই একটা ডাক সকাল সকাল শুনতাম এক শাকওয়ালির ঈষৎ কর্কশ গলায়।

‘থানকুনি, কুলেখাড়া, হেলেঞ্চা… চলে গেল…’।

আমাদের পাড়ায় আর একজন আসতেন প্রায়দিনই। তিনি কোনো বাড়ির রোয়াকে বসে সংবাদপত্রের হেড লাইন মুখস্থ বলে চলতেন। না, এইসব কোনো মানুষেরই নাম বা ঠিকানা আমার জানা ছিল না। কিন্তু এই অভ্যস্ত ডাক শুনে শুনে বড় আর ব্যস্ত হতে হতে একদিন খেয়াল করলাম ডাকগুলো কবে যেন আমায় না জানিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। হয়ত পাড়ার কেউ খেয়াল করেছিল, হয়ত কেউ করেও নি। যেমন হারিয়ে গেছে ঘটিগরম খাওয়ার সেই শীতের রাতগুলো। 

তখন চুটিয়ে টিউশন করি। অনেক ব্যাচের মধ্যে এক দুটো ব্যাচ ছিল ভীষণ প্রিয়। এই কারণে নয় যে ব্যাচের সকলেই পড়াশোনায় ভালো ছিল, বরং এই কারণে যে ওদের সকলের কাছে আমি শিক্ষিকা অপেক্ষা বেশি বন্ধু হয়ে গেছিলাম। ওদের দাবী, আব্দার আমার ওপর ছিল অগাধ। রাজেশ সুলেখা বৈশাখী দেবশ্রী তনুশ্রী বিপ্লব আরও সব দুষ্টু মিষ্টি মুখ। ওরা একটু উঁচু ক্লাসের তখন। সন্ধ্যার ব্যাচ গড়াচ্ছে রাতের দিকে। 

ও দিদি, শুনছো, ঘটিগরম…

ঘটিগরম বিক্রেতার ফেরি-ডাকের সাথে ঝুমুর ঝুমুর ঘুঙুরের আওয়াজ। 

তারপর তাকে ডেকে সবাই মিলে গরম গরম ঘটিগরমের স্বাদ নেওয়া, কিছু পড়া, কিছু গল্প। স্ব-আরোপিত টার্গেট ছোঁয়ার নিত্য লড়াইয়ের মাঝে চাপ মুক্ত হবার একটু প্রয়াস। 

বছর বছর টিউশন ব্যাচের আর একটা আনন্দ ছিল শীতের চড়ুইভাতি। ছেলেপুলেগুলোর এই দাবির কাছে আমি নত হবার আগেই আমার বাবা ওদের সাথে মেতে যেত। শেষে ছাত্র ছাত্রীদের সাথে পিকনিক আর পাড়াতুতো পিকনিক সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

সেই সব কুয়াশামাখা সকালগুলো ভ্যানে সাইকেলে বাসে মোটর বাইকে যে যেভাবে পারতাম গন্তব্যে পৌঁছে জলখাবার আর দুপুরের খাবারের জোগাড়ে লেগে পড়তাম। আমাদের বাড়ির সবাইকে তো পেতামই। পেতাম মহেশকাকা, কানাইকাকাদের, সুপ্রিয়া কাকিমাদের আর ছানাপোনার অনেকের মাকে। 

ট্যাঁরাবাঁধের মতো কালনার খুব কাছাকাছি, রেললাইনের পাশে বা খোলা মাঠের ওপর দল বেঁধে একটা দিনের আনন্দ আমাদের সারা বছর অনেকটা আনন্দের খোরাক দিত। গানের লড়াই, বল ব্যাট, লোকের ক্ষেতের মটরশুঁটি বা শশা চুরি এই সবের মাঝে কখন চপ মুড়ি, ডিম পাউরুটি, মাংস, চাটনি সাবাড় হয়ে যেত। আসার বেলার কুয়াশা কেটে ঝলমলে রোদ পার হয়ে আবার ফেরার বেলার সূর্যের ঝিমঝিমে পড়ন্ত আলো মন খারাপ করে দিত। কিছু ছবি থাকত আমার সস্তা ক্যামেরার রিলে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *