মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

ষোড়শ পর্ব 

আমাদের বাড়ির কথা ভাবলে মনে ভিড় করে আসে অসংখ্য মুখ। ভজাকাকা মদনকাকা আর পাণ্ডেকাকা তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের চেম্বারে বাবার সাথে এই তিনজনকে আমি জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখেছি। আগেও হয়ত বলেছি, তখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কালনায় না থাকায় চেম্বারে খুব চাপ ছিল। কাশি থেকে কলেরা সব রকম সমস্যার সমাধান পাবার আশায় মানুষ ছুটে আসত। কোমরের ব্যাথা থেকে কার্বঙ্কল সব রোগের কষ্ট উপশমের চেষ্টায় কাজ করে চলতেন এই মানুষগুলো। স্প্যাচুলার চাপে গুঁড়ো হচ্ছে ট্যাবলেট, নানা পরিমাণের দুই বা তিন রকম ট্যাবলেট মিলে চারচৌকো কাগজে কাগজে মাপে মাপে উঠে পুরিয়া হয়ে যাচ্ছে, প্রথমে লম্বা তারপর ওপর নিচে দুই ভাঁজে সমান তিন অংশের ঠিক পেটে চলে আসছে গুঁড়ো। কাগজের কোণে কোণে মিলে হয়ে যাচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট পুরিয়া।  খামের ওপর লেখা দিনে কয় বার কখন খেতে হবে।

এই টেবিলের পাশে একটা উঁচু কাঠের র‌্যাক, সার সার বোতলে কালো খয়েরি সাদা ঘন ট্যালট্যালে নানা সিরাপ, মেজ়ার গ্লাস।
তৈরি হচ্ছে মিক্সচার, কাগজের কাঁচিতে হচ্ছে মেজ়ার লেবেল। গরম জলে পরিস্কার করা কাচের বোতলে মিক্সচার ঢেলে দাগ মারা হচ্ছে। দিনে কয় বার কয় দাগ বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগীকে। বঁটিতে কাটা আঙুল, ইটে ফাটা কপাল, গরম জলে পোড়া চামড়া সেলাই হচ্ছে, ড্রেসিং হচ্ছে…সে এক কর্মযজ্ঞ! কখনও দেখতাম কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে রোগীর মাথায় ঢালা হচ্ছে। প্রবল জ্বরকে কাবু করতে এর কোনো বিকল্প নেই। অল্প জ্বরে জলপটি কাজে আসতে পারে। তরকা হয়ে যাওয়া বাচ্চাদের নিয়ে ছুটে আসতো মা বাবা। তখন জল ঢালাই একমাত্র উপায়। ঘরে ঘরে ফ্রিজে ঠান্ডা জল বা বরফও তখন কষ্ট কল্পনা। এই সব নানা কাজে রত থাকতেন আমার ওই তিন কাকা। ভজাকাকা (মধুসূদন চক্রবর্তী) সম্পর্কে আমার বাবার মামাতো ভাই হন। বাঘনাপাড়া কেশবপুর অঞ্চলে পৈতৃক বাড়িতে কাকা আজও ডিসপেনসারি চালান গ্রামের মানুষজনের ভালোবাসায়। সেই প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগের অনুন্নত কাঁচা রাস্তায় প্রতিদিন সাইকেলের ওপর নির্ভর করে রোদ বৃষ্টির বারো মাস তিনি কালনা আসতেন। মদনকাকা (নবব্রত মুখোপাধ্যায়) তালবোনা থেকে একই ভাবে যাতায়াত করতেন। সমীর পাণ্ডেকাকার বাড়ি ছিল কালনার লালবাগানে। এর মধ্যে পাণ্ডেকাকা অনেক দিন আমাদের সবার মায়া কাটিয়েছেন।
ভজাকাকা ছিল আমি আলাদিনটার আব্দার মেটানোর আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য। ‘হরতাল’ দেখার বায়না নিয়ে উঠে বসতাম সাইকেলের রডে। ডোবা থেকে পানাফুল তুলে দেবে কে? কাকাই তো।

মদনকাকাকে নিয়ে একটা ঘটনা আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। হাতে পায়ে কাটাকুটি,  মাথা ফাটাফাটি কেস এলে সময় সুযোগ মতো আমি বাবার টিমের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। খানিকটা গ্যালারিতে থাকার মতো আর কি! আমার এইসবে একটুও ভয় লাগতো না। রক্ত মুছে ক্ষতস্থান পরিস্কার করে প্রয়োজনে চামড়া চেঁছে সেলাই দিতে হতো। ছোট্ট অর্ধ বৃত্তাকার সূঁচে মেডিকেটেড বিশেষ সুতো পড়িয়ে বাবা কেমন সেলাই দিতেন ক্ষতর পরিধি বুঝে। গভীর ক্ষত হলে ওষুধমাখা গজ ভরতে হতো শরীরে। রোগীর চিৎকার, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যন্ত্রনার তাড়নায় গালাগালি ধেয়ে আসতো। প্রয়োজন না থাকলে শুধু ওষুধ আর ব্যান্ডেজ। তারপর অ্যান্টি টিটেনাস ইঞ্জেকশন। তৈরি হতো ওষুধের তালিকা।

আমার মনে হতো একদিন আমি নিজেই পারব এই সব করতে।
তেমনি এক সন্ধ্যায় চৌকিতে এক আহত ব্যক্তি। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল।  বাবা সম্ভবত  সেলাই শুরু করছিলেন। মদনকাকা আহত ব্যক্তিকে ধরে ছিলেন চৌকিতে বসে। হঠাৎই পেছন দিকে ঢলে পড়লেন। রোগীকে ছেড়ে সবাই হই হই করে উঠলো। এত রক্ত দেখে কাকার মাথা ঘুরে গেছিল সম্ভবত।
এই তিন কাকার বাড়িতেও নানা কারণে গিয়ে নানা উৎপাত করেছি। ভজাকাকার বাড়ি তো সুযোগ পেলেই যেতাম। মদনকাকার বিয়েতে যে পরিমাণ আনন্দ করেছিলাম তা ভোলা অসম্ভব। মদনকাকাদের উঠোনের তিনদিক ঘিরে বাড়িটি আমায় আজও টানে। দুদিকে বসত আর একদিকে রান্নাচালা। পেছনে বাগান, বাঁশঝাড় আর আর এক শরিকের ঘর। কতদিন আগে দেখা অথচ কি স্পষ্ট আজও মনের চোখে! কই,  আজকাল যা দেখি এমন করে তা ছাপ ফেলো কি মনে?

এনারা যে কিভাবে এই ডিসপেনসারির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়েছিলেন, আবার কিভাবে কখন নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে দূরে চলে গেলেন তার ব্যাখ্যা রাখা আছে কালের কুলুঙ্গিতে। কিন্তু এই কথা খুব জোর দিয়ে বলতে পারি এই তিনজন মানুষের কাছে আমার শৈশবের সিংহভাগ রক্ষিত আছে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *