মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
পর্ব – ২৩
যখন সেভেনে পড়ি তখন আমার সাইকেল হল। বড় হচ্ছি। টিউশন যেতে সুবিধা হবে। মহেশকাকা আর আরও দু একজনের সাহায্যে কোনোক্রমে ব্যালেন্স করে দু’চাকা ছোটাতে শিখে গেলাম।
আমাদের বাড়ি থেকে ষষ্ঠীতলার দিকে সাইকেলে গেলে রাস্তার আপ ডাউন ভালোই বোঝা যেত। প্রথম প্রথম আপে প্যাডেল করতে বেশ কষ্ট হয়, কিন্তু ফিরতি পথে দারুণ আনন্দে প্যাডেল থেকে পা তুলে নিতাম।
প্রতি বছর মাধ্যমিক শেষ হয়ে এলে আমার নিজের মাধ্যমিক শেষের কথা মনে হয়। কি ফুরফুরে দিনগুলো ছিল! বাতাসে শিরিষের গন্ধ, কৃষ্ণচূড়ার রং। সাইকেল নিয়ে এদিক ওদিক চক্কর কাটার আলাদাই আনন্দ ছিল।
সেই হারকিউলিস ক্যাপ্টেনকে আমি এখনও মিস করি।
পরে ভাইয়ের যখন পৈতে হল, উপহার হিসাবে পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে ভাইয়ের আর আমার নতুন সাইকেল কেনা হল। তখন কিন্তু আর প্রথমটার মতো অসম্ভব আনন্দ হলো না। কারণটা কি কে জানে! কলেজ পড়ুয়া হয়ে গেছিলাম বলে হয়ত।

পাড়ার গল্প মাঝে মাঝেই একান্ত নিজের গল্প আর মাঝে মাঝে সারা শহরের গল্প হয়ে ওঠে। আর লিখতে লিখতে মনে হয়, একই কথা নানা সময় নতুন নতুন হয়ে মনে বাজে।
হারিয়ে যাওয়া কত ঘর বাড়ি মানুষ জন কারণে অকারণে আবছা থেকে ক্রমে স্পষ্ট হয় আধ জাগরণে। আবার তলিয়ে যায় মন সাগরে। পঁচিশে তাঁর দিনে মনে পড়ল আমাদের রবীন্দ্রসদনের পুরনো চেহারাটা। দোতলায় ইউ বি আই এর শাখা, নিজে শণিবারের তাঁতের হাট আর দক্ষিণমুখো স্টেজ। আমাদের স্কুলের প্রায় সামনে বলে স্কুলের অনেক অনুষ্ঠানের জন্য এটিকে বাছা হতো। এই স্টেজে প্রথম বার ওঠার অভিজ্ঞতা অবশ্য অনুষ্ঠানে কিছু উপস্থাপন করতে নয় বরং কিছু একটা হয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার পুরস্কার নিতে, প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ সমিতির অনুষ্ঠানে। পুরস্কার একটি বই, আকাশ প্রদীপ – এখনও সযত্নে আমার কাছে রাখা আছে। তবে সম্ভবত পরের বছর একই বই পেয়ে একটু দুঃখ হয়েছিল। এই স্টেজে মানসী দিদিমণির দলের অনেক অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য ছোট বয়সেই হয়েছিল আর সেই অভিজ্ঞতাগুলো আজও জীবনের সম্পদ।
তখন কালনায় জনগণের জন্য আর দ্বিতীয় কোনো স্টেজ ছিল না। মনে আছে মহকুমা স্তরে বৃত্তি পরীক্ষার পুরস্কার নিয়েছিলাম পূর্ণ সিনেমার সাদা স্ক্রিনের সামনে। ওই পর্দার সামনে স্টেজের মতো অংশ আছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আর পুরস্কার নেবার উত্তেজনায় পা থেকে নিউ কাট জুতোও খুলতে পারছিলাম না স্টেজে ওঠার আগে।

পূর্ণ সিনেমার সাথে তৎকালীন কালনাবাসীর অতি মনোরম আবেগ জড়িয়ে আছে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ এই হলটার কোনো অস্তিত্বই নেই। নেই তার স্মৃতিচিহ্নটুকুও। আধুনিক মল- মাল্টিপ্লেক্স আর রেঁস্তোরায় হারিয়ে গেছে আমাদের ছেলেবেলায় শিশু চলচ্চিত্র দেখতে আসার অথবা কলেজের হাফ ক্লাস কেটে বন্ধুদের সাথে ‘কুচি কুচি রকমা পাশ আয়ো না’ ইত্যাদিতে হারিয়ে যাবার মুহূর্তরা।
ইতিমধ্যেই কালনায় আরও একটি মঞ্চের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছিল। রবীন্দ্র সদনের পাশেই। তার নাম হলো পুরশ্রী। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণি। করুণা দিদিমণির উদ্যোগে ‘হযবরল’ মঞ্চস্থ হলো। কি সুন্দর সব মুখোশ করেছিলেন মনোজকাকু (মনোজ বিশ্বাস)। আমি ছুঁচোর ভূমিকায় ছিলাম। সঞ্জীবদার (বাগচী) বোন সঙ্গীতা ছিল ব্যাকরণ সিংয়ের ভূমিকায়। রিহার্সাল থেকে ফাইন্যাল সব দিনটি ছিল দারুণ আনন্দের। তখন জেরক্সের রমরমা ছিল না। সবাই হাতে হাতে নিজের নিজের ভূমিকা টুকে নিতাম। অবশ্য সে নাটকে আমার মুখে একখানাও কথা ছিল না।
হিন্দু বালিকার এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই ছিল পুরশ্রীর প্রথম অনুষ্ঠান, যদিও স্টেজে তখন ইটের ওপর সিমেন্টের প্রলেপও পড়ে নি। এরপর একরকম আমাদের স্কুলের বড় অনুষ্ঠান হলেই কর্তৃপক্ষ পুরশ্রীর কথাই ভাবতো। আমাদের স্কুলের নিজস্ব স্টেজ থাকলেও এতে অনুষ্ঠান পরিচালনা করা অনেক সুবিধাজনক হতো। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)