সুতপন চট্টোপাধ্যায়

     হিমেল

বাড়িতে যে মেয়েটি ফুল দিতে আসে রোজ সকালে, তার মুখটি খুব মায়া মাখানো। বয়স কত? বারো কি তেরো হবে। রোগা, লম্বা বিনুনি, গভীর চোখ আর সহাস্য মুখ । বেল বাজিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুললে বলে, ফুল। কথাটা জানা তবু ও বলে। আর বললেই তার এক মুখ সরল হাসির ছটায় দিনটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গালে একটা ছোট্টো টোল পরে । মুখটা প্রতিমার মত দেখায়।

নাম তার হিমেল। প্রথন দিন তার নাম বলতে আমি চমকে উঠে ছিলাম। হিমেল কারো নাম হয় নাকি? শুনিনি তো? তোর ভালো নাম কী? 

-হিমেল। একটা’ ই নাম। 

-কে রেখেছে? 

-মা কোথায়? 

আকাশের দিকে আঁঙ্গুল তুলে দেখাল। ওই হোথায়। আমার জন্মের দু বছর বাদেই ওপরে চলে গেছে।

ওহো। মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল । 

হিমেলের বসার জায়গা আমাদের আবাসনের উল্টো দিকের একটা ধাপিতে। দূর বড় কাছারি থেকে সে ভোরবেলা ফুল এনে বসে । এ তার নিত্য দিনের দোকান। কোন দিন সঙ্গে বাবা আসে, কোনদিন তাও আসে না। বার বছরের হিমেল রাস্তার উল্টো দিকে সাজিয়ে বসে ফুলের সঙ্গে  তুলসীপাতা, বেল পাতা, জবা,গাঁদা ফুলের মালা আর দুর্বা ।

প্রথমে যাদের রোজের  অর্ডার তাদের আলাদা করে তবেই সওদাগিরি। দোকান শেষে বাড়ি বাড়ি তার ফুল দেওয়া। এই হিমেল একদিন আর এলো না। সকালে বেল বাজায় আটটায় । সেদিন আটাটা  বেজে গেছে । নয়টা ছুঁই ছুঁই । তাও হিমেলের  দেখা নেই। সুমনা বলল, কী হল বলত, কী দিয়ে পূজো করব! মেয়েটার কী যে আক্কেল ? 

আমি বললাম, দেখ, হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। ওদের কী শরীর নয়? খারাপ হতে পারে না? আমি গিয়ে ফুল নিয়ে এলে পুজো হল। তার আর দেখা নেই এক সপ্তাহ। খুব চিন্তায় পড়লাম আমি। ফুলের জন্য না। কেমন আছে মেয়েটা? সুমনা বলল, তুমি খবর নিলে না? কেউ কী খবর জানে না? এ কেমন কথা। ওর সঙ্গে কেউ না কেউ এখনের বাজার আসে। তারা জানে না?

কী উত্তর দিই? কিছু তো খবর পাচ্ছি না। আবাসনে অন্য ফুল ওয়ালা ঢুকে গেছে। তাদের কাছেও কোন খবর নেই। আর থাকলেও তারা বলবে না। উলটে বলল, ও নেই তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি?

যে প্রান্তিক গ্রাম থেকে হিমেল আসত সে গ্রাম কেমন তার প্রকৃত ধারণা করা মুশকিল। রাস্তায় গাড়িতে বা বাসে যেতে যেতে দু পাশে যে গ্রাম পড়ে সেইসব গ্রামের ভিতরে  গ্রাম থাকে, যাদের দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে যেমন ঘর থাকে, গ্রামের মধ্যেও গ্রামের চেহারা যে সব সময় শান্ত, সরল , শান্তি ঘেরা  তা কিন্তু নয়। গ্রাম উত্তাল হলে তার চেহারা আলাদা, হিংসে, মারামারির গোপন চোরা স্রোত  চলতেই থাকে। পরবের সময় ফুরফুরে থাকে গ্রাম । এইটুকু জানা কিন্তু অনেক কিছু অজানা, গ্রামের মানুষই  জানে। সেখানে তার কিছু হল না তো?

সুমনা একদিন বলল, হিমেলটা কোথায় যে গেল? মেয়েটা খুব মায়া কাড়া। থাকলে আমাদের সঙ্গে দিল্লি নিয়ে যেতাম। আমাদের সঙ্গে থাকতো, টুকটাক বাড়ির কাজ করতো, ফুল নিয়ে আসতো। আমি বললাম, সে আমাদের সঙ্গে সব ছেড়ে ছুড়ে যাবে কেন? ওর বাবা আছে। আর তাছাড়া তার বাড়িতে কে আছে তাই তো জানি না। নাবালক মেয়ে নিয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার নয়। গ্রামের অনেক জটিলতা আছে। গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। কিছু হলে কে দিল্লি থেকে আসবে এই সব ঝামেলা সামলাতে? 

গোপন ইচ্ছে অনেক সময় ফুল ফোটার মত ফলে যায়। তাই হল। হিমেল একদিন এসে হাজির হল।মা নেই জানতাম। বাবাও যে নেই সেটা বলল। সুমনা জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় ছিলি? সে হাসতে হাসতে বলল, মাসির বাড়ি বসিরহাট। 

-তোর দোকান কী হবে?

-কাল থেকে আনব। তাই তো তোমাদের মন বুঝতে এসেছি। আমার কাছ থেকে নেবে তো?

সেই সুযোগে সুমনা কথাটা ঠিক বলে বসল। হিমেল বলল, একটু সময় দাও। কাকিকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। ওরাই আমাকে দেখে। 

হিমেল আর আসে নি। আমার ট্রান্সফারের অর্ডার বেড়িয়ে গেছে । যাবো যাবো করেও এক মাস ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর? আর তো রোখা গেল না। চলে গেলাম দিল্লি। দিল্লির জীবন কলকাতার থেকে অনেক আলাদা। প্রথম প্রথম খুব একা লাগত। মানুষ কেবল কাজের পিছনে দৌড়য়। সারা দিন নিস্তার নেই। একজনের একটি চাকরি করে জীবন চলে না। দুজনকেই কাজ করতে হয়। দিনের শেষে অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফেরা। প্রতিটি মানুষ  সবের মধ্যে ফায়দা খোঁজে। এই  ফায়দা খোঁজার অভ্যাসটা আমাদের ছিল না। সুমনা তো কোন দিন চাকরি করেনি। দিল্লিতে সেও কোন উপায় না  দেখে চাকরিতেই যোগ দিয়ে নিজেকে স্রোতের মধ্যে  ভাসিয়ে দিল। এতে সুমনার লাভ হল অনেক। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে কখন আমারা হিমেলের কথা ভুলেই গেলাম।  

অবসর নেবার পর দিল্লিতে কয়েক বছর কাটিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে আসার প্রবল আকুতিতে দিল্লিতে বাড়ি করি নি। আপামর বাঙ্গালীর মত অবসরে দেশের মাটিতে ফিরে আসার গোপন ইচ্ছা চিরকালই জাগ্রত ছিল প্রবাসে। ফিরে এসে আবার নতুন করে বসবাস আমাদের   আবাসনে। আমুল বদলে গেছে আবাসন। অনেকে চলে গেছে ওপারে। নতুন ভাড়াটে এসে ভর্তি করেছে শূন্যস্থান। প্রবীণ নাগরিকরা হয় ছেলে বা মেয়ের কাছে হাদ্রায়বাদ, পুনে গুরগাঁও বা বিদেশে গিয়ে স্থিতু হয়েছে। তারা আর আসবে বলে মনে হয় না। আমার ফ্ল্যাটের পাশেই তো তিন দিকে নতুন  পরিবার। তাদের কাউকে চিনি না। ফ্ল্যাট কিনে তারা আবসিক। আমি যে জগৎটা ছেড়ে গিয়েছিলাম সেই জগৎটার আর কোন অস্তিত্ব নেই। 

এক দিন সকালে বাজারের রাস্তায় অখিলের সঙ্গে দেখা। আমাদের আবাসনের পাশেই সাতগ্রামে সে  অনেক দিন আগে জমি কিনে নিজের বাড়ি করেছিল লোন নিয়ে। আমাকেও বলে ছিল। করি নি। অখিলের নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশে নেমতন্ন খেয়েছিলাম। মনে আছে। অখিল আমাকে দেখেই  বলল, 

-আরে তুই? কবে এলি?

-এই তো? মাস খানেক।

-পাকাপাকি?  

-অবসর, আর কি? পাকাপাকিই বলতে পারিস। কোথায় আর যাব?

– আরে দূর, এলি কেন দিল্লি ছেড়ে? কেউ গেলে তো আর ফিরতে চায় না। এখানে কেউ ফিরে আসে? 

-সবাই তা নয়। বলে হেসে উঠি। অখিল ও হেসে বলে, আবার  এতদিন পরে বৃত্তে ফিরে  আসা। 

এক বিকেলে অখিলের বাড়িতে গেছি। বাড়ির প্রবেশের দ্বারে একটি ছোট্টো মন্দির। ভিতরে বিগ্রহ। দেখে মনে হয় পুজো হয় নিয়ম করে। ভিতরে বসার ঘরে বসাল অখিলের স্ত্রী। বলল, আপনার সঙ্গে  দেখা  হয়ে আপনার বন্ধু খুব খুশি।  বসুন, আপনার জন্য গরম সিঁঙ্গাড়া আনতে গেছে।

বলতে বলতেই অখিল এসে হাজির। ঘরের ভতরে যেতে যেতে বলল, বস বস, আজ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে। 

আমরা দুজনে গল্প করছি। আমাদের অতীতের গল্প, কলেজের, ভারসিটির, চাকরির। মাঝে মধ্যে সহপাঠী, বান্ধবী সব’ই উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ পরদা সরিয়ে একজন এগিয়ে এসে চা আর সিঁঙ্গাড়া রাখল টেবিলে। অখিল বলল, আমার মেয়ে হিমেল। 

হিমেল শব্দটা কেমন আশ্চর্যের সপ্তম তারে বেজে উঠল। হিমেল? আমি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছি। অখিল বলল, এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  পি এইচ ডি  করছে। বটানি নিয়ে। 

বাহ বাহ দারুণ খবর। পুর্ণ যৌবনা টগবগে সুন্দরী একটি মেয়ে। বিজ্ঞানে বিদুষী । কি অদ্ভুত মিল? মনে হতেই দেখি সেই রোগা পাতলা মেয়েটির মুখের আদল।

ভিতরে চলে গেল হিমেল। 

অখিল বলল, আমাদের তো সন্তান হয় নি তাই ও আমাদের দত্তক মেয়ে। খুব মেধাবী। এতো ভালো হবে আমরা কল্পনাই করিনি। ভালই কেটে গেছে ওকে নিয়ে। কিন্তু এখন একটাই সমস্যা।

আমি জিজ্ঞাসা করি, কী সমস্যা তোর?

আরে, এবার ওকে বিয়ে করতে বলছি। কিছুতেই করবে না। বলে আমাদের কে দেখবে? আমি বলি আমাদের তো বয়স হচ্ছে। আমরা তো থাকব না।

আমি বললাম , দুজনেই তো দু দিক থেকে ঠিক।

-তুই একটু বুঝিয়ে বল না। তোর কথা শুনতেও পারে।

-আমার কথা? আমার কথা সে শুনবে কেন? ওতো আমাকে চেনে না। আজ ই আলাপ। 

পর্দা সরিয়ে হিমেল ঘরে ঢোকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি নির্মল  এপার্টমেন্টেরর এগারো তলায় থাকেন না? 

আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আমি দেখতে পাই হিমেল দাঁড়িয়ে আছে আমারই দরজার সামনে। হাতে ফুল আর বেলপাতা। ঠিকই তো ওর বটানির ছাত্রী হওয়ারই কথা!

সজল মামা

আমাদের বড়িতে মধ্য রাতে কেউ কোনদিন আসে নি। আমরা দেখিনি। তাই আমাদের বাড়ির দরজা ভিতর থেকে হুড়কো দিয়ে আটকান থাকে। বাবা রোজ সকালে খোলে এবং রাতে বন্ধ করে। সে দিন এমনি রাত। দরজা বন্ধ।  

মধ্য রাত। ধুপ করে শব্দ হল বাইরে। বাইরে না ভিতরে ঘরের ভিতর থেকে বোঝা দায়। মা’র ঘুম  পাতলা, রাতে শব্দ আরো জোরে বাজে। মা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাকে বলল, দেখ তো নারকোল গাছ থেকে কে যেন লাফিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। চোর হবে। বাবাকে ডাক। বাবা ততক্ষনে উঠে পড়েছে।  

কোনদিন চোর পড়েনি, ডাকাত তো কল্পনার অতীত। ভয়ে গা ছম ছম করছে। বাবা চৌকীর নিচ থেকে বাঁশের লাঠি নিয়ে বারান্দার দরজা খোলার তোরজোর করছে। বাইরে থেকে চাপা গলা, ভয় নেই আমি চোর নই। আমি সজল। বাড়ির দেওয়াল টোপকে বাড়িতে ঢুকেছিল সজল মামা। সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে এক চাপা উত্তেজনা। সজল মামা আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে? রহস্যের বেড়াজালে মোড়া হয়েছিল আমাদের বাড়ি। কে প্রথম জানবে সজল মামার আসার কারণ টা কী? 

সজল মামা বাড়ির ভিতরে একটা টুলের উপর বসল। মা, জল এনে মাথায় একটু ছিটিয়ে দিল। সজল মামা মায়ের ছোট ভাই। তিন বোনের পর দুই ভাই। কমলমামা থেকে বর্ধমানে। সজল মামা বাঁকুড়ায় ডাক্তারি পড়ে। ছোট ভাই সবার আদরের । তার একটা প্রধান কারণ সে মাধ্যমিকে জেলার প্রথম হয়েছিল বলে বোনেরা গর্বে বিভোর । মাকেও মাঝে মাঝে আমাকে বলতে শুনেছি, ছোট  মামার মত হতে হবে। এই আপ্ত বাক্যটা মনের মধ্যে ঘড়ির কাঁটার মত  টিক টিক করে নড়ত। সেদিন রাতে কেন যেন তার ছিঁড়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম সজল মামা এমন চোরের মত রাতে আমাদের বাড়িতে কেন? কিছু কী অন্যায় করেছে তাই পালিয়ে এসেছে? কী হতে পারে? মারামারি, চুরি, শুনেছিলাম সে হোস্টেলে থাকত। সে কী হোস্টেলে কিছু করেছে?

কে জিজ্ঞেস  করবে? দেখি বাবা মাকে বলছে। তুমি জিজ্ঞাসা কর। মা বলছে, আমায় বলবে না,তোমায়  শ্রদ্ধা করে, ভয় ও খায়, তোমাকেই বলবে। এর মাঝেই সজল মামা বাথরুম থেকে চোখে মুখে  জল দিয়ে মাকে বলল, কিছু খেতে দে দিদি, দুপুর থেকে খাই নি।

মা সব ছেড়ে রান্না ঘরে চলে গেলে বাবা সজল মামাকে বলল, কী ব্যাপার বলত সজল, এত রাতে তুমি কোথা থেকে? কী করেই বা এলে। বাস তো রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়? 

সজল মামা একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। আমি বাসে আসে নি। একজন আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে বাইকে। 

কেন এলে তা তো বললে না। সজল মামা বলল, সেটা পরে বলব। এখানে ক’ দিন থাকব জামাই বাবু।

বাবা বলল, সে তুমি যত দিন থাকতে চাও থাক। তোমারই তো দিদির বাড়ি। 

সজল মামা অনেক দিন ছিল আমাদের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে এতোদিন থাকাটা কেউ আপত্তি করে নি। কলেজে পড়তে পড়তে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলে ভিড়ে গিয়েছিল সজল মামা। তাদের  কলেজে একটা খুন হয়েছিল সে কারণে পুলিশ খুঁজছিল তাকে। সে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে আমাকে অঙ্ক ও ইংরাজী পড়াত । সজলমামা যে খুব মেধাবী ও তুখোড় তা তাঁর পড়ানো দেখলেই বোঝা যেত। অনেক অনেক দিন পর কলেজে ফিরে গিয়েছিল সজল মামা। আর আসে নি।

সেই সজল মামা ডাক্তার হয়ে অনেক কাল ইংল্যান্ডে। আমাদের দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেই দেশে । কয়েক বছর দেশে আসে নি। ছেলে মেয়ে বড় হতে তবেই আসা আরম্ভ করেছে। বিদেশী বউ, দুই ছেলে নিয়ে এবার কোলকাতায় আসছে সজল মামা। আমাদের বড়িতে থাকবে দু দিন তার পর একদিন হোটেলে থেকে রাজস্থান বেড়াতে যাবে। সেই মত আমি বিমান বন্দরে আনতে গেছি। বাবা নেই, মাও শয্যাশায়ী। তবু বিদেশ থেকে কৃতী ভাই আসছে শুনে বেশ চাঙ্গা। দু দিন থেকে ঘর বার করছে, কুঁজো হয়ে এক হাঁটুতে  হাত রেখে। চুল সব সাদা। মাঝে মাঝে বলছে, সজলটা  আমাকে  দেখে খুব দুঃখ পাবে, এত শরীর খারাপ, চুল সব সাদা। চিনতে পারলে হয়। খুব ইচ্ছে ছিল তালের ফুলুড়ি বানাবো। সজল খুব খেতে ভালোবাসে। কিন্তু তাল মারার লোকই নেই!

ঠিক সময় বি্মানবন্দরে আমি হাজির। সপরিবারে সজল মামা এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে এসেই চিৎকার করে উঠল, বিলটু? আমারা এখানে। বলে এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে  দিল আমার। আমি একটা বড় গাড়ি নিয়ে  গিয়েছিলাম। সবাই ফিরে এলাম  বাড়িতে।

মায়ের কোথায় যেন একা দ্বিধা ছিল। আমাদের মত ছোট্ট বাড়িতে সজল মামার পরিবার থাকতে পারবে তো? বাড়ি পৌছনোর পর অব্দি সেই ধন্দ কমে নি। তাই বাড়িটা  দেখিয়ে মা সজলমামাকে বলল, হাঁরে, আমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না তো তোদের?

বিদেশিনী মামিমা বলল, না না একবারিই নয়।

আমরা সবাই চমকে গেছি তার বাংলায় কথা বলা দেখে। ভেবেছিলাম মামিমার ও ছেলেদের সঙ্গে আমদের ইংরাজি তেই কথা বলতে হবে। মামিমার কথা শুনে মা অবাক হয়ে বলল, ওমা তুমি তো ভালো বাংলা বলতে পার?

মামিমা বলল, আপনার ভাই শিখিয়েছে। আমি পড়তেও পারি।

আমাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

মামিমা আবার বলল, বিয়ের পর হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে বাংলা শেখাত। 

শুনে আমাদের কি আনন্দ। মামিমা কে যেন তিন গুন ভালবেসে ফেললাম। মামিমা ও ডাক্তার তবে মামার মত সার্জেন নয়। ডারমাটোলজিস্ট । দুই ছেলে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের বাড়িতে সেদিন উৎসবের আবহাওয়া। মামা বাবার লুঙ্গি পড়ে সোফায় বসে টেলিভিসন দেখছে। মামিমা মায়ের সঙ্গে রান্না ঘরে খাবার তদারকি করার চেষ্ঠা করছে। মা কিছুতেই করতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই পছন্দের  খাবার করে নিয়ে আসছে। মা আর সজল মামার গল্পের শেষ নেই। তাদের ছোট বেলা, দেশের বাড়ি, দাদার কথা, অন্য বোনেদের কথা নিয়ে মশগুল । এর মধ্যে আমি বাজার করে ফিরেছি। নানা রকম বাজার করে এনেছি । মা লিস্ট করে দিয়েছে। সজলমামা  কী কী খেতে ভালো বাসত তার লিস্ট ধরে। চন্দনা সেগুল ধুয়ে, মুছে সব একে একে সাজিয়ে রাখছে ফ্রিজে। মায়ের আদেশ মত সে ব্যবহার করবে।  

এমন সময় দুই জমজ ভাই ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামিমার কোলে। কে বড় কে ছোট বোঝা মুশকিল। মামিমার কোলে মুখ ঘসে এবার আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, চল আমরা বাইরে ঘুড়ে আসি। 

দু জনেই এক কথায় রাজি। মা দুজনকে আদর করে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?

দু জনেই এক স্বরে বলল, ডাক্তার।   

মা অবাক হয়ে বলল, ওমা ওরাও বাংলা বলতে পারে! মামিমা বলল, ওই সব শিখিয়েছে।  

মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, সজল, এটা দেখে মা যে কী খুশি হত। খুব খুশি হত। তুই এতো বড় ডাক্তার হয়েছিস, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলিস নি।   

অতসী

সেদিন সকালে আকাশ কালো করে এসেছিল। ক’দিন গুমোট গেছে, বাইরে বেরলেই ঘামে পোষাক ভিজে সপসপে। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি যে কোন সময় আসতে পারে। তারই আয়োজন এই সাত সকালে। চারিদিক  অন্ধকার করে এসেছে। সুর্যের আলো তাকে ভেদ করে বাইরে আসতে পারছে না দেখে  মাথায়  টোকা নিয়ে মাঠের দিকে বেড়িয়ে গেল অতসী। তাল পাতার টোকা, বৃষ্টিতে মাথাটা না ভিজলেও, শরীর তো ঝাপটায়য় ভিজে যাবে। ছাতায় আটকায় না। টোকা ঝড়ে ওড়ে না, ছাতা উলটে যায়। এ সব অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। এখন মাঠে যাবার সময়। সময় নষ্ট করার সময় কোথায়? 

ইছামতী নদীর পাড় দিয়ে লম্বা রাস্তা চলে গেছে গোলপাতা ম্যানগ্রোভের দিকে।  ম্যানগ্রোভের মধ্যে  রাস্তা দু দিকে ভাগ হয়ে ইছামতী নদীতে পড়েছে। একটি রাস্তা গোলপাতা জঙ্গল পেরিয়ে, ইছামতী অনেক সরু হয়ে বইছে।  গোলপাতা নামটি এসেছে গোলপাতা ফলের আকার থেকে। গাছটা নারকোল গাছের পাতা  যেন মাটি থেকে লম্বা দাঁড়ানো। জঙ্গলে এই গাছ ছাড়া আরও অনেক গাছের আধিক্য। তারই এক দিকে চাষের খেত,। প্রধানত পাট ও ধান। মাঝে মাঝে অন্য সবজি এখানে সেখানে চোখে পড়ে। অতসী বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক এই গ্রামে অনেক বছর। আগে সে গুরুপদর সঙ্গে যেত। গুরুপদ কয়েক বছর হল ছেড়ে গেছে  তাকে। ঠিক ছেড়ে যায় নি। এমনি সাপের ছোবল যে তাকে দু মিনিট দেয় নি। টাকী হাস্পাতালে নিয়ে যেতে যেতেই সে ইছামতীর ওপারে চলে গেছে। সেই থেকে অতসী একা। একা ঠিক নয়।  শিখা, তাঁর এক মাত্র মেয়ে। পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে গাঁয়ের ইস্কুলে। শিখা কে নিয়ে অতসীর একটা গোপন ইচ্ছে আছে। তা সে মনের গোপনেই লুকিয়ে রাখে।

গুরুপদ খুব খরচে ছিল না। চাষের রোজগার থেকেই সে একটা কোটা ঘর করেছিল। বাড়ির পাঁচিলে পাট শুকোতে দিত। সব পাট চোখের সামনে থাকত। না হলে চুরি চামারি তো লেগেই থাকে । গুরুপদ মারা যাবার কিছুদিন আগে একটা স্কুটি কিনেছিল টাকী শহরে যাবার নামে। সব সময় শহরে যেত না।  গুরুপদর পিছনে বসে অতসী নদীর ধার দিয়ে চলে যেত সোনার বাংলা রিসর্টের  দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিন জনে আইস্ক্রিম খেত ইছামতীর দিকে তাকিয়ে। উল্টো পাড়েই বাংলা দেশ। দূরে তাদেরি মত বাংলা দেশের সাতক্ষীরা গ্রামের টিম টিমে আলো দেখা যেত । রাতের অন্ধকারে বর্ষায় নদীর জল চোখে পড়ে না। মনে হয় হেঁটেই চলে যাওয়া যায় বাংলা দেশ। সে সব কেমন সিনেমা সিনেমা মনে হয় অতসীর। 

গুরুপদর মৃত্যুর পর অতসী স্কুটি  চলান শিখেছিল । এখানের রাস্তা খুব চওড়া নয়। রাস্তার দু ধারে অনেক গেস্ট হাউসে ছেয়ে গেছে।  ভ্রমন পিপাসু মানুষের ভীড়। প্রচুর টোটো চলে । হোটেলের সামনে  অনেক টোটো। হাত খুলে চালানোর অনেক অসুবিধা। তাতেও অল্প সময় সে শিখে ছিল। 

বাড়ি থেকে বাইরে বেড়োতেই শিখার গলা। মা, আজ আমার ক্লাস আছে। মনে আছে তো?

অতসী বলল , মনে আছে। আমি মাঠ থেকে আগেই চলে আসব। 

যদিও বর্ষা কাল, কালো মেঘ অনেকটাই ইছামতী পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে গেছে। তবু আবার ভেসে আসতে পারে। এমনি তে দুই বাংলায় এই মেঘের আনাগনা লেগেই থাকে। ওখানে তো তারের বেড়া নেই! মাথা উঁচু করে একবার তাকাল আকাশের দিকে। না, তেমন জোরে আসবে না, ঝির ঝিরে তো চলবেই। জঙ্গল, নদী ও সবুজ শস্য  ক্ষেত্র, এখানে বর্ষার রূপ ক্ষনে ক্ষনে বদলে যায়। অতসী  দেখেছে। আর গুরুপদর সঙ্গে মাঠের আলে ঘুরতে  ঘুরতে  সে আকশটাও পড়তে শিখে গেছে।  ধানের শিষে এই ঝির ঝিরে বৃষ্টি খুব উপকারী। বীজতলা থেকে কালো পালের ছেলে বলল, কী গো দিদি আজ এতো সকাল সকাল? 

হাঁ, বিকেলে কাজ আছে। 

-শুনেছ, আমাদের গ্রামে পুজোয় এবার জমিদার বাড়িতে তিন দিন ধরে নানান খেলার ব্যবস্থা করছে। জমিদার বাবু সপরিবারে আসছে। এবার তাদের চারশ পাঁচ বছরের পুজো গো।

 অতসী বলল, তাই নাকি? তা কী কী খেলা হবে? 

আমাদের গ্রামে ঘরে যা হয় আর কী? চু কিত্ কিত্, হা ডু ডু, এমনি সব।

মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল অতসীর। মনে মনে ঠিক করল আজই টাকী তে গিয়ে প্রস্তাবটা  দিতে  হবে। একবার যদি শিখা জিততে পারে সে বিখ্যাত হয়ে যাবে এই অঞ্চলে। তার সপ্তাহে সপ্তাহে শহরে নিয়ে যাওয়া সফল হবে। বর্তমান জমিদারের  জমিদারি নেই। আছে আট মহলা একটা জমিদার বাড়ি। আর জমিদার সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত। পুজোর সময় প্রতি বছর আসেন। বাকি  সময় কোলকাতায়। তার হাত থেকে পুরস্কার তো স্বপ্নের মত। 

-কোন কোন দিন হবে জানো?

-সপ্তমী, অষ্ঠমী ও নবমী। 

দুপুর বারটায় বেশ জোরে নামল বৃষ্টি। টোকায় কী আর শরীর বাঁচে? সারা শরীর ভিজে গেলে মাঠ থেকে উঠে এল অতসী। টিপ কলে মাথায় জল ঢেলে হাল্কা করে ঝেরে নিল সে। তারপর, হাঁটতে হাঁটতে  বাড়ি ফিরে দেখল শিখা চৌকিতে বসে পড়ছে। মা না এলে সে ছুটির দিনে খেতে বসে না। অতসী কে দেখে সে রান্না ঘরে থালা ও রান্না নামাল মেঝেতে।

ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ মেয়েকে পিছনে বসিয়ে রওনা দিল টাকীর উদ্দেশ্যে। আজ রবিবার, রাস্তার গেস্ট হাউস গুলির মুখে মুখে টোটোর ভীড়। তার সঙ্গে গাড়ি, অটো আর সাইকেল। অতসী এসে পৌঁছল ক্যারাটে  ট্রেনিং সেন্টারে। স্কুটি থেকে নেমে শিখা চলে গেল নিজের ক্লাসে।

বেশ কিছু দিন হল গাঁয়ে বলেছে সে মেয়েকে টিউসান দিতে নিয়ে আসে শহরে। গ্রামে তেমন  শিক্ষক নেই। তাই লোকের বুঝতে অসুবিধা নেই। শুধু পাশের বাড়ির সর্বমঙ্গলা চিমটি কেটে বলেছিল, কী হবে গো তোমার মেয়ে? ডাক্তার  না উকিল।

উত্তর দেয় নি অতসী।

ক্লাসে ভর্তি করেছিল বছর খানেক আগে। গুরুপদর মৃতুর পরে পরেই। এটা তাঁর অনুভবের তারণায়। মনে হয়ে ছিল, নিজেকে বাঁচাতে হলে এমন একটা জিনিস শিখতে হবে যাতে কেউ আঘাত করতে এলে প্রথমেই রুখে দেওয়া যায়।ইস্কুলের ননী মাস্টার ্পরামর্শ দিয়ে ছিল। অতসী আর দেরি করে নি। গ্রামে ঘরে এক মেয়ে নিয়ে বিধবা, বিপদ যে কোন দিন যে কোন দিকে থাকে আসতে পারে। কী  দিয়ে ঠেকাবে তাকে? 

তাই শিখা কে সে ভর্তি করেছিল এখানে। সে মাকে না বাঁচাতে পারলেও নিজেকে তো বাঁচাতে পারবে? যে ভাবে মেয়েদের বিপদ বাড়ছে বাইরের জগতে? আর বেঁচে থাকলে তো বাইরে বেরোতে হবেই। সে অপেক্ষা করে রইল শিখার ক্যারাটে ক্লাস শেষের জন্য। ফিরতে ফিরতে ঠিক করল, জমিদার বাবু কে বলতে হবে পুজোয়  ক্যারাটের প্রতিযোগিতা যেন এক দিন করে। 

বোকেন

হাট বসন্তপুরে রাজরাজেশ্বরী পুজোর ধুমধামই আলাদা। গ্রামের  দুর্গা পুজোর  আকর্ষণের চেয়ে এই পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই সারা বছর । এটা তো পুজো নয়, মেলা, নানান খেলা আর জিলিপী ও জিভে গজার চার দিনের মহোৎসব। কে না আসে? দশ মাইল দূর থেকে গ্রামের মানুষজন কে দেখতে পাওয়া যায় এই মেলায়। এখানে হিন্দু মুসলমানের  কোন ভেদাভেদ নেই। এক কোনে খাসির মাংসের দোকান দেয় হোসেন। কী বিক্রি তার দোকানের। দিনে তিন চারটে  ছাগল সাবার করে দেয়। এক সময় সমরেশ মুখুজ্জের পুর্ব পুরুষ জমিদার, এখন সে কোলকাতায় থাকে। সপরিবারে এই পূজোর সময় তাদের আসা নিয়ম মাফিক। তাদেরি বাড়িতে এই সময় আসে তাঁর ছেলে, ছেলের বউরা ও চাকরবাকর। তারাই দিনের বেলায় বারবার মেলাতলায় গিয়ে খবর নিয়ে জানায় সমরেশ মুকুজ্জে কে। । পুজোর ফল নৈবেদ্য যায় সমরেশ মুকুজ্জের বাড়ি থেকে। তাই তাদের বাড়িতেও এক উৎসবের ঘনঘটা। জমিদারি নেই। কিন্তু তার ঠাট বাট  আছে। শীতের শেষে মাঘ মাসের প্রথমে রাজ  রাজেশ্বরীর  পুজো। লোকে বলে এটি মা দুর্গার ষোড়শী রূপ। এই পুজো জাতি, ধর্ম  নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিরক্ষা প্রার্থনার পুজো। 

এই মেলায় আমার সঙ্গে দেখা হয় সমরেশ মুকুজ্জের ছেলে বোকেনের। বোকেনের গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ের রঙ ফর্সা,সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে সে পুজো তলায় ঘুরে  বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখে কাছে এসে বলল, এবার তেলে ভাজার দোকান দেখছি না তো?

-আছে তো। বিকেলে বসবে। সকালে আর গরম গরম পাঁপড় কে খাবে? 

-আমি আজ জিবে গজা খাব, পাঁপড় খাব, ডালের ফুলুড়ি খাব। তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না। বাবা শুনলে রক্ষে রাখবে না।

-ঠিক আছে। বলে আমরা দু জনে মেলায় ঘুরে বেড়াছি। এমন সময় সনাতন বলল, দাদাবাবু তোমায় খুঁজছে। আর তুমি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছো। তাড়াতাড়ি যাও। না হলে বকুনি খাবে। অনেকক্ষণ ধরে তোমায় খুঁজছে। বলে সনাতন চলে গেলে বোকেন বলল, জানো তো আমার হার্টে একটা ফুটো আছে। আমি খুব বেশী দিন বাঁচবো  না। খুব জোর মেরে কেটে আর দশ বছর। তারপর পটল তুলব। 

কী করে জানলে?

-ডাক্তারকে বলতে শুনেছি। ওরা ভাবে আমি জানি না। জানি সব জানি। সব জানি তাই সব খাবার টেস্ট করে নিতে চাই। 

আমি অবাক হয়ে বোকেনকে দেখি। নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে এতটা  জেনেও সে নিজেকে নিয়ে রসিকতা করছে?

-কী অবাক হচ্ছো? বোকেন প্রশ্ন করল।

-আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না দেখে বোকেন বলল, ওই হার্টের ফুটোটা সেলাই করার অনেক চেষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু করা যায় নি। কবে হবে কেউ জানে না। হঠাৎই একদিন আমি আর নিশ্বাস নিতে পারব না।  

আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। বোকেন বাড়ি যেতে যেতে বলল, বিকেলে এসো কিন্তু। দুজনে পাঁপড় খাব।

সেদিন বোকেন আর আসে নি। হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। পরের দিন বিকেলে দেখি একটি মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর মেয়েটি আপন মনে বাঁশী বাজাচ্ছে। একটু পরে সে  কিছুটা দূরে বসে  চোখ বুঝে বাঁশী শুনছে। আমার ডাকে ধ্যান ভাঙল । তকিয়ে বলল, কী দারুন বাজায় মেয়েটি। শুনেছ কখনো?

-শুনেছি। ভগবানের দেওয়া গুন। খুব ছোটবেলা থেকে বাজায়। এবার মেলায় এসেছে।

কী নাম মেয়েটির?

নাহিদা।

নাহিদার সামনে একটা কাপড় পাতা, সেখানেই যে যার মত করে পয়সা ফেলছে। বোকেন পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, তুমি রোজ আসো?

নাহিদা মাথা নেড়ে বলল, আসি। বিকেলের দিকে। 

সকালে আসতে পারে না নাহিদা। বুড়ো বাবার খাবার করতে হয়, তাকে চান করিয়ে দিতে হয়, গোয়ালে জাবনা দিতে হয়, মুরগিগুলোকে খোল দিতে হয়। এমনি সব কাজ সারা সকাল । তারপর তার ভিতর ভর করে সুর। সে একমনে বাজাতে থাকে পুকুর পাড়ে বসে। কখন জমির আলে বসে। পেয়ারা গাছের ডালে বসে। আমি অনেক দিন দেখেছি।

কেউ তাকে বাঁশী শেখানোর নেই। হাটবসন্তপুরের প্রবেশের মুখে এক ছোট জনপদে নাহিদাদের ক’ ঘর বাস  । তাদের লোকের জমি ভাগে চাষ করে দিন যায়। দু’বেলা পেটের ভাত জোটে,। তাদের মধ্যে এই বাঁশী বাজানো কেউই ভালো চোখে দেখে না। পাড়ার মোড়লরা অনেক বার তার বাবা কে বলেছে, মেয়েকে এই সব না করে ঘর কন্নায় মন দিতে বল। বাবা শামসের ও অনেক বুঝিয়েছে নাহিদা কে। বোঝেনি সে। সে কেবল লোকের কথা শুনেছে। কোন কথার উত্তর দেয় নি। মা মারা গেছে সে অনেক  কাল। তাই তার পৃথিবীটা সে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে বলেই বাঁশী তার নিত্য সঙ্গি। সে যেখানেই যায়, বাঁশী তাঁর সঙ্গে  থাকে। কোনদিন সে পয়সার জন্য বাঁশী বাজায়নি। এবার করেছে, কারণ শামসেরের চিকিৎসার খরচ  বাড়ছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শামসের কে ডাক্তার দেখানোর সময় টের পেয়েছে নাহিদা। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।

দশ টাকা দেখে ডাগর চোখে তাকাল নাহিদা। দু হাত জুড়ে নমস্কার করল। তারপর বলল, আপনি জমিদারবাবুর ছেলে?

বোকেন বলল, হাঁ। কেন বলত?

-না। এত টাকা দিলেন। সহজে তো কেউ এত টাকা দেয় না। আপনার ভালো হবে। বলে আবার বাঁশী তে ফুঁ দিল নাহিদা। বোকেন আমার দিকে তাকাল একবার। কথা বলল না। আমি বুঝতে পারি বোকেনের এই কথাটা পরিহাসের মত ঠেকেছে। আমরা মেলায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তেলেভাজার দোকানে এসে দাঁড়ালাম। 

তেলেভাজার দোকানের বিশেষ আকর্ষণ আলুর চপ। চপের মধ্যে এক ফলা নারকোলের ছিলা চপ কে এত মুখোরোচক করে যে থালায় পড়তে পারে না। একটা উনুনে ভেজে শেষ করতে পারে না পবন। বোকেন কে দেখে পবন বলল, দাদাবাবু এবার তোমার জন্য ডবল ডিমের চপ করেছি। আগের বারে বলেছিলে না? ডিমের ডেভিল খাবে?

বোকেন বলল, বলেছিলাম নাকি? হবে বা। তা তাতে কি আছে? 

খেয়েই দেখ না দাদাবাবু। রোজ খেতে ইচ্ছে করবে।

আমি বললাম,তুমি চপ খেলে রাতে আর কিচ্ছু খেতে পারবে না। এক একটা চপ বোমার মত। তোমার আবার শরীর খারাপ না?

-তা ঠিক। তবে কত দিন আর বাঁচব? খেয়ে নিই। না খেয়ে মরার কোন মানেই হয় না। 

কথাটা ভালো লাগল না আমার। বললাম, আরে কী আজে বাজে বকছো? আচ্ছা খেতে চাইলে খাও।  আমি একটু ঘুরে আসি। 

ফিরে এসে দেখি বোকেন সেখানে নেই। পবন বলল, দুটো চপ নিয়ে নাহিদার কাছে গেছে।  

নাহিদার কাছে?

আমি দুর থেকে দেখলাম নাহিদার কাছে  বোকেন দাঁড়িয়ে । নাহিদা কে সাধাসাধি করছে চপ খেতে। নাহিদা খাচ্ছে না। আমি গিয়ে পৌঁছতেই নাহিদা বলল, দাদাবাবুকে বোঝাও তো। আমি চপ খেলে বাঁশী বাজাতে পারব না। আমার কাজ তো এখন বাঁশী বাজান। না বাজালে কে পয়সা দেবে? 

আমি একটু পাশে ডেকে বোকেন কে বোঝালাম। বললাম, এখন নাই বা খাওয়ালে? 

বিষন্ন হল বোকেন। তারপর বলল আমি বলেছি ওকে, ওর বাঁশী বাজানো এত সুন্দর, আমি  ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব। আমার গানের মাস্টার রেডিওতে গান করে। ওখানে অডিশন দেওয়াব। ও খুব বড় শিল্পী হবে।ওকে ভিক্ষে করতে হবে না। 

সব বুঝলাম। কিন্তু সে তো একদিনের কথা নয়। রাজ রাজেশ্বরী পুজোটা শেষ হোক। তারপর ওকে  ডেকে কথা বলা যাবে। বলে আমি কিছুটা সান্তনা দিলাম বোকেন কে। 

বোকেন মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। আমরা সে দিন মেলায় অনেক রাত অব্দি ঘুরেছি, নানান মুখোরোচক খাবার খেয়েছি। রাতে সিরাজদুৌল্লা যাত্রা দেখেছি। সিরাজের কিশোর বয়সের চরিত্রটা তেমন ফুটিয়ে তুলতে পারে নি পরেশ। তাই বোকেন বাড়ি যাবার সময় বলল, পরের বার এমন রোল থাকলে আমি করব। বলে রেখো গ্রামের যাত্রা পাটিকে।

রাজ রাজেশ্বরী পুজো শেষ । এবার যে যার গন্তবে ফেরার পালা। সমরেশ মুকুজ্জে সপরিবারে ফিরে যাবে কলকাতা। আমি যাবার আগের দিন বোকেনের বাড়িতে ঢোকার সময় কানে এল  ভিতরে তুমুল চ্যাঁচামেচি। সমরেশ মুকুজ্জে বলছে, না, তুমি যেটা চাইবে,  তা হবে না।

বোকেনের গলা। কেন হবে না? আমি তো কোন অন্যায় কথা বলছি না।

-তুমি যেটা বলছ সেটা সম্ভব নয়।

-কেন সম্ভব নয়? যার প্রতিভা আছে সে কেন পরে থাকবে এই গন্ডগ্রামে?

-এটা গন্ডগ্রাম নয়। এখানে মেয়েটার অনেক দায়িত্ব আছে। সে একা গিয়ে থাকতে পারবে না। ওর বাবা আছে। আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কে নেবে সেই সব ঝামেলা?

বোকেনের মায়ের গলা, ছেলে হলে কথা ছিল, মেয়ে । কোথায় কী হয়ে যায়।  ওর বাবাকে কে দেখবে? 

-সে ব্যবস্থা করে তবেই নিয়ে যাব। বোকেনের ঝাঁঝাল গলা।

বোকেনের মার এবার নীচু গলা, আমাদের বাড়িতে রাখা যাবে কী করে? ওর তো ধর্ম আলাদা। 

এবার বোকেন বলল, মা, ও যেটা বাজায় সেটা সুর। তার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই।

এবার আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, মেয়েটি নাহিদা। 

কিন্তু তাকে নিয়ে বোকেনের  ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানাতে নাহিদা এক কথায় নাকচ করে বলল, না। আব্বাকে ফেলে যেতে পারব না। দাদা।

জবা

কী নাম তোর?

জবা।

কে আছে বাড়িতে?

মা, বাবা আর ভাই।

এই দুপুরে তুই এখানে কী করিস?

শামুক কুড়ুই।

শামুক নিয়ে কী করিস?

দ্বারবাসিনির হাটে বিক্রি করি।  বলে জবা হরিণের মত ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, তা তোমার এত জানার কী আছে? তুমি কে?

আমি কে সেটা তোর না জানলেও চলবে। তুই একা একা দুপুর রোদে ক্যানেলের পাড়ে শামুক খুঁজে বেড়াস, বাড়িতে কিছু বলে না? 

সে জেনে তোমার কী?

এবার উঠে দাঁড়াল জবা। গাছ কোমর করে আঁচলটা বেঁধে এগিয়ে এল মনিকান্তর দিকে। হাতে হেঁসোর মত একটা  যন্ত্র। সেই দিয়ে সে ক্যানেলের গায়ে আঁচড় কেটে শামুক খোঁজে। 

শামুকের গায়ে লাগলে টক করে শব্দ হয়। তারপর শামুকের চারপাশের মাটি সরিয়ে আস্ত শামুককে বের করে  জবা। বড় শামুক তিন চারটে হলেই সপ্তাহের হাটের খরচাটা উঠে আসে। তাই এখানে সে কাউকে ঢুকতে দেয় না। গ্রামের উত্তর দিকের ক্যানেলের পাড় তার। এখানে কাউকে দেখলে রক্তে আগুন নেচে ওঠে। বর্ষার পর ক্যানেল শুকিয়ে গেলে শামুকরা পাড়ের মাটিতে লুকিয়ে পড়ে। জবা শীত কাল অব্দি শামুক খোঁড়ে। এবার জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?

-রাজীব।  

-কোন বাড়ি?

-মুকুজ্জে বাড়ি।

-বেড়াতে এয়েছো?

-না। আমি কলকাতায় থাকি। ছুটিতে এসেছি। আমাদের জমি দেখতে এসেছি।

-হুম। তুমাদের তো অনেক জমি? 

-ক্যানেলের যেখানে তুমি শামুক খুঁড়ছো তার পারেই তো আমাদের টানা পাঁচটা কলমা ধানের জমি। 

-জানি। এত জমি কি করবে? 

-মানে? মানে আর কী? বলছি  এত জমি নিয়ে কী করবে? চাষ তো ঠিক থাক করতি পার না।

প্রসঙ্গ বদলে  রাজীব জিজ্ঞেস করে, তুমি ইস্কুল যাও না কেন?

-যেতে তো চাই। কিন্তু সেটা অনেক দূরে। রাস্তার  দু’পাশে ঘন জঙ্গল, বাঁশ বন, বিলের ধারের খাড়ি। যাওয়া খুব সুবিধের নয়। ভয় হয়। 

  ধীরে ধীরে ক্যানালের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় রাজীব। এখানে কথা না বাড়ানো ভাল। কী কথা থেকে কী কথা বেড়িয়ে পড়বে। কে জানে? গ্রামের হাওয়াতেও প্রতি নিয়ত কথা চালচালি হয়।

পরের দু দিন রাজীব আর ওই মাঠের দিকে পা বাড়াল না। জবা লক্ষ রেখেছে। দেখা হলেই কথা সে বলবেই। ক্যানেলের জল কম। বর্ষায় জল থাকে কানায় কানায়।  বাঁধ থেকে জল ছেড়ে দু কুল ভাসিয়ে দেয়।  তখন এই উত্তরের মাঠ জলে তক তক করে। মাঠে মঠে চাষের  সময়। জলের ভিতর গাছের চারা বসিয়ে দিয়ে কোমড় ফেটে যায় দিনের শেষে। বুড়ো মা কে সে বলে কোমড়ে মালিশ করে দে মা। ব্যাথা টা চাগাড় দিছে ।

কদিন পর রাজীব কে দেখতে পেল জবা। মাঠের পারে এসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে । একবার জবার দিকে তাকাতেই জবা বলল, এত দিন কোথায় ছিলে?

রাজীবের মনে হল মেয়েটা কী বেহায়া, যেচে যেচে কথা বলছে। আবার বোধ হয় কিছু একটা বলে বসবে । ভালো লাগবে না তার। সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। জবা এবার বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। শুনবে?

রাজীব মুখ ঘুড়িয়ে বলল, কী?

তুমাদের জায়গাটায় আমাদের মেয়েদের একটা ইস্কুল করে দাও না। তুমাদের তো অনেক জমি। এ গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই। 

অবাক হয়ে তাকাল রাজীব। বলল, কী আবল তাবল বলছ? 

আবল তাবল বলব কেন গো? আমাদের গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই তুমি জান না? অনেকে ইস্কুলে যেতে চায় কিন্তু অনেক বিপদ। 

এখানে ইস্কুল করলে কী সুবিধা শুনি। 

জবা যেন আশ্বাসের সুর শুনতে পেল । উৎসাহিত হয়ে বলল, এই দেখ ক্যানেল চলে গেছে উত্তরে, দক্ষিনে, পুবে। প্রতিটি গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে এই ক্যানেল। ক্যানেলের পার দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা সারা বছর ঠিক থাকে। চারিদিকের গ্রামের মেয়েরা এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসবে। কিছু হলে কেউ না কেউ দেখতে পাবে। কোথাও কোন আড়াল নেই। কেউ আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। আমার খুব ইস্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। 

বলে ক্যানেলের পাড়ের মাটিতে সে কোপ বসায়। কোথায় যেন কট করে শব্দ হয়। মনে হয় আছে  শামুক আছে। তার চার পাশ থেকে চাগাড় দিলে ঠিক বেরিয়ে আসবে। আসলে খোঁজাটাই আসল। তার পর  খোলা থেকে শামুক এমনি বেড়িয়ে আসবে। পড়ে থাকবে খোলা।  

রাজীব তাকিয়ে থাকে জবার দিকে। মেয়েদের জন্য এমনি উন্মুক্ত ইস্কুলের রাস্তা যদি সারা পৃথিবী তে হতো তাহলে মেয়েরা কত নিরাপদ থাকত । প্রতিদিন মেয়েদের উপর নানা নির্যাতন হয়ত জবা জানে না, সে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, তাদের বাড়িতে টেলিভিসন নেই। রেডিও হয়ত গ্রামে কদাচিত বাজে।  লোক মুখের কথাতেই তাদের ভরসা। তার বাড়িতে কে আছে রাজীব জানে না তবে জবা যে  সাহসী, প্রান্তিক গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক কায়িক শ্রমিক, তাতে তার সন্ধেহ নেই । এমন  একজন শামুক কুড়ানীর মাথায়  একটি  উন্মুক্ত ইস্কুলের পরিকল্পনা কী ভাবে আসে তাই সে নির্ণয় করতে পারে না। জবাকে  দেবার মত কোন উত্তর মাথায় আসে না রাজীবের। 

1 thought on “পথে পথে মোহর ছড়ানো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *