সুতপন চট্টোপাধ্যায়
শিব
চৌরঙ্গি রোডের উপর এভারেস্ট হাউসে নোসিল কোম্পানির অফিসে ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক এসোসিয়েশানের উদ্যোগে শনিবার করে প্লাস্টিক টেকনোলজি ক্লাস হত। শনিবার ছুটির দিন। বিভিন্ন প্লাস্টিক কোম্পানি থেকে তাদের বড় সাহেবেরা এসে ক্লাস নিতেন। বিখ্যাত কোম্পানি যেমন আই সি আই, আংলিয়া প্লাস্টিক, এমন কোম্পানির কারখানার টেকনোক্রাটরাও ক্লাস নিতেন। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় প্লাস্টিক কারখানায় দক্ষ কর্মচারি যোগান দেওয়া। কোন টাকা লাগত না। বিনা মুল্যে ট্রেনিং পেয়ে গেলে কেই বা ছাড়ে। আমি ও যোগ দিলাম। চারিদিকে চাকরির হাহাকার তখন । এই সময় বিনা খরচায় শিক্ষানবিশী। তারপর দেশের বিখ্যাত কোম্পানির অফিসে। কে জানে কোথায় বিড়ালের শিকে ছিঁড়ে?
রাজস্থানের বিকানীর থেকে সদ্য কোলকাতায় এসেছে শিব। মাথায় এক মাথা ঝাকড়া চুল, নাক টা ছোট, সারে পাঁচ ফুট লম্বা, সপ্রতিভ শিবের সঙ্গে দেখা লিফটে। লিফটের বোতাম টিপতে দেখেই আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি নয় তলায়?
আমি ঘাড় নারলাম। শিব হাত বাড়িয়ে নিজের নাম বলল,। তার পর যেটা বলল, তাতে আমি চমকে উঠি। বলল, আমি বীটস পিলানী থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি কিচুক্ষণ। বিটস পিলানী? তা এখানে কী করতে?
–ট্রেইনিং নিতে?
–চাকরি পাওনি? তোমাদের তো বাজারে দারুণ ডিমান্ড। হাত বাড়ালেই চাকরি। কেউ বিটস এ জইন করলে মেয়ের বাবারা তাক করে থাকে। কবে পাশ করে বেরবে। তারপর ।
একগাল নির্মল হাসি হাসল শিব। বলল, না। চেষ্টাই করি নি। আমি ওই পথের লোক নয়।
সেই আলাপ। তার পর ক্লাসে সে আমার পাশেই বসত। দেখতাম ভীষন মন দিয়ে ক্লাস করে। ইঞ্জিনিয়ার তাই টেকনিকাল প্রশ্ন করলে শিক্ষকদের মাঝে মাঝে ভিরমি খেতে দেখি। ফলে অল্পদিনের মধ্যে শিব কে সবার চোখে পরে গেল। প্রোগ্রাম ম্যানেজার দেখা হলেই শিবকে কেমন খাতির করে বলত, শিব, তোমার কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন কর। আমাদের তিনি খুব একটা হিসেবের খাতায় ধরতেন না। আমার স্থির বিশ্বাস শিব একদিন যে কোন প্লাস্টিক কারখানার সর্বচ্চ পদে চাকরি করবে। তাকে আটকে রাখার কেউ নেই।
আর একটা গুণ ছিল শিবের। সে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারত অনায়াসে। সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক। ছয় মাসের হপ্তান্তের ক্লাস, তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম সারা সপ্তাহ। তখন প্লাস্টিক এক নতুন বস্তু। কি না হয় তাতে? বেলুন, নল, বালতি, মগ, ঢাকা, ত্রিপল, ফিল্ম, বাদ্য, যন্ত্রপাতি,। লোকের ধারণা হয়ে ছিল লোহা লক্কর, স্টিল, পাট এর সব ভাত মেরে দেবে দু এক বছরেই। এই বস্তুটির ভবিষ্যত পারদ উজ্জ্বল।
পড়তে পড়তে এটা বুঝতে পারছিলাম এই বস্তুটি কোন আম, জাম নারকেলের মত বস্তু নয়। এর নানা ধরন আছে। নানা ধরণ নানার কাজে ব্যবহার হয়। আবার তৈরি জিনিস পুরনো হলে গলিয়ে আবার কিছু নতুন জিনিস করা যায়। ফলে ব্যবহারও অনেক বিস্তৃত। ফলে লোকের প্রয়োজন হবে একথার অপেক্ষা থাকে না।
শিব মারোয়ারি হলেও অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে নয়। সে কথা সে অকপটে স্বীকার করেছে। পড়াশোনা করেছে স্কলারশিপের সাহায্যে। মেধাবী ছাত্র ছিল তাই তার পড়ার চাপ তার পরিবারকে বইতে হয় নি। এ জন্য সে ভগবানের নাম করে। সে বলত সে ভগবানের কৃপাধন্য। ফলে সে যে শিব ভক্ত হবে এতে আর অবাক হবার কী আছে?
বাঙালি হয়েও যে বাঙ্গালিদের চিনতে সারা জীবন লেগে যায় সে প্রায় সব বাঙালি মাত্রই জানে। আমি এই মারোয়ারি সম্প্রদায়ের কথা খুব বেশি জানি না। আমাদের যেমন কয়েকশো পদবি আছে তাদের তেমন নেই। এমনি একটা ধারনা ছিল। আগর্বাল তা তেমনি একটা। একদিন শিবকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এখানে কে থাকে?
শিব বলল, কেউ নেই। আমার কোন আত্মীয় স্বজন নেই কলকাতায়।
–কার ভরসায় এখানে চলে এলে সেই বিকানির থেকে?
শিব বলল, নেই ত কী হয়েছে। মারোয়ারি সমাজ তো আছে। তারাই সব। তারাই আমাদের আত্মীয়, বন্ধু, গাইড।
–মানে?
–মানে আমি মারোয়ারি জানাতেই তারাই সব থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
–তাই নাকি?
— হান, আমি তাদের হোস্টেলে থাকি, আমার কোন খরচা লাগে না। আমার মতন অনেকে আছে। নানান কাজে আছে। তারা পরে রোজগার করলে তারাই আবার খেপে খেপে টাকা শোধ দেয়, সাহায্য করে।
–বেশ ভাল সিস্টেম তো?
–আজকের নাকি। কতও দিন থেকে চলে আসছে। প্রথম যারা রাজস্থান থেকে কলকাতায় ব্যাবসা করতে এসেছিল তারা করেছে। দারুণ সিস্টেম। তাই আমার কোন টেনসান নেই।
আমি অবাক হয়ে ভাবতাম আমাদের রাজ্য, আমদের শহর কলকাতায় এমন কী বাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠান আছে? কোন ব্যবস্থা নেই কেন? কেউ কী ভাবেনি একদিন গ্রাম গঞ্জ থেকে গরীব মেধাবী ছাত্ররা কলকাতার বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে এলে তারা কোথায় থাকবে? বা তার মতন কেউ দুবেলা খাবার এর টেনসান না নিয়ে উজ্জ্বল জীবন বুন্তে পারে? তাঁর ব্যবস্থা!
না বোধ হয় ভাবেনি। তার হয়ত অন্যতম কারন এই সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে অন্য রাজ্যে বাস করতে এসেছিল। তাই স্বজাতি টান তাদের রক্তে মিশে ছিল।
একদিন শিব ক্লাসে এল না। এমন হয় নি আগে? সে কামাই করার ছেলে নয়। তবু সে না আসতে পরের শনিবার প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার? শরীর খারপ ছিল নাকী?
–না। ত? শরীর ঠিক আছে।
–তাহলে এব্যসেন্ট?
–ওহো! ওইদিন আমাদের সমিতিতে আমার ইনটারভিউ ছিল।
— কিসের? চাকরির?
একগাল হেসে শিব বলল, আরে না না। চাকরির হবে কেন? আমি একটা ব্যবসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে টা নিয়েই কথা হল, কিসের ব্যবসা, কি ভাবে করব, কি কি চাই, লাভ কত হতে পারে, কবে থেকে শুরু করব? এসব আর কী।
আমি অবাক হয়ে শিব কে প্রশ্ন করি, তুমি পিলানির ছাত্র, প্লাস্টিক টেকনোলজি ট্রেন্ড, তুমি এই বয়সে ব্যবসা করবে?
–এটাই তো ব্যবসার বয়স ব্রো। বলে প্রবল আস্থার ভঙ্গিমা করল শিব।
আমি বললাম, ব্যবসা করবে টাকা কোথায় ?
–দরকার নেই তো। সমিতি আমাকে সাপোর্ট করবে। পরে ফিরিয়ে দিতে হয় কিস্তিতে কিস্তিতে। কোন প্রব্লেমই নেই।
আমি আরও একবার অবাকের চেয়েও অবাক হলাম।
কোর্স শেষের পর আর শিবের সঙ্গে কোন দিন দেখাই হয় নি। আমি কলকাতার বাইরে চলে গেলাম চাকরির কারণে। দেখা হবার সম্ভবনা রইল না। আমি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি থেকেও অনেক দুরে চলে গেলাম। থাকলে হয়ত দেখা হত, কোথাও কোন সমাবেশে, সেমিনারে। আচমকা দেখা হতেও পারত। দেখা হলে আমিও শিব কে জড়িয়ে ধরে পুরাণ বন্ধুত্বের নিবু নিবু আগুন অনুভব করতুম। শিব হয় তো বলত, ব্রো কেমন আছো? আল ইস ওয়েল?
অনেক দিন পর কলকাতায় ফিরে কি কাজের জন্য একদিন আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে ঢুকেছি, একটা সাইন বোর্ড দেখে থমকে দাঁড়ালাম। “শিব প্লাস্টিক”। সম্পুর্ণ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির অতল থকে শিবের মুখটা ডলফিনের মত ভেসে উঠল। আমি অবাক হয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখলাম এক বয়স্ক মানুষ বসে আছেন ভিতরে । তাঁর চার পাশে অনেক বস্তা, এক এক বস্তায় এক এক রঙের প্লাস্টিক গুলি। ইংরাজী তে যাকে বলে গ্রানুয়েলস। যেন চারি দিকে নানান রঙের ফুল ফুটে আছে। আমি সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকি। ভদ্রলোক আমাকে দেখে সাদরে ভিতরে যাবার আমন্ত্রণ করলেন। আসুন আসুন , দেখুন হাই ডেন্সিটি , লো ডেন্সিটি সব রকমের গ্রানুয়েলস আছে। সব রঙের মাল পাবেন। আমি মুহূর্তে বুঝতে পারি ভদ্রলোক ভুল বুঝেছেন। আমি প্লাস্টিকের গুলি কিনতে আসিনি। তাঁর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার দোকান?
ভদ্রলোক হঠাৎ সতর্ক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন বলুন তো? আপনি কোথা থেকে আসছেন?
আমি চটপট তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, না না আমি কোন সরকারি অফিস থেকে আসছে না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
ভদ্রলোক একবার আমার আপাদ মস্তক দেখে ভিতরের ঘরের দিকে হাত দেখালেন। ঘরের ভিতর দেখি সাদা চুল, মোটা শরীর, , পুরু চশমা চোখে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। আমি তাকে দেখে বলে বসে, শিব না?
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে শিব। তার পর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, হোয়াট এ সারপ্রাইজ? ত্রিশ সাল বাদ!
আমার গলা বুজে আসে। কথা বের হয় না। শিব আমাকে ভুলে যায় নি। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি সেই অমলিন হাসি, সহৃদয় কন্ঠ, আর অমায়িক ব্যবহার। আমাকে বসতে বলে প্রশ্ন করল, কি খাবে?
–না না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমার খাবার অনেক বিধি নিষেধ আছে।
–তোমার মনে আছে আমি কিছু টাকা ধার করে ব্যবসা করব বলেছিলাম। এই সেই আমার বিজনেস।
— দেখলাম অনেক বস্তা রাখা বাইরে। প্লাস্টিক গুলির। নানান রঙের।
— হ্যাঁ। এটা খুচরো। লোকালে কেজি দরে বিক্রি হয়।
— কেজি দরে। মানে? কেজি দরে কিনে মানুষ কি করে?
— তোমার ধারনা আছে কত জন এই বড়বাজার অঞ্চলে প্লাস্টিকের ডট পেনের বড তৈরি করে?
— না ।
— প্রায় একশ জন। ছোট বড় মিলিয়ে । তারা পেন কোম্পানি কে দেয়। কোম্পানি রিফিল ভরে নাম দিয়ে প্যাক করে বাজারে ছাড়ে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। পিলানির ইঞ্জিনিয়ার বড় বাজারে খুচরো বিক্রেতা?
শিব বলল, খুব কম পুঁজি থেকে শুরু করেছিলাম। আস্তে আস্তে বড় হতে সময় লেগেছে। এ ছাড়া আমার সাপ্পাই আছে নর্থ ইস্ট, উড়িষ্যা, বিহার ,রাঁচী ও পোর্ট ব্লেয়ার। সব ডট পেন প্রস্তুতকারী। বলে সে এক অসীম পরিতৃপ্তির হাসি হাসল। এই হাসি শুধু সাফল্য থেকে আসে না, বিজয়ী হলেই তবে আসে। আমি তো এমন হাসি আমার চাকরি জীবনে কোন দিন হাসতে পারিনি । প্রতিভাস ম্যাগাজিন