সুতপন চট্টোপাধ্যায়

পলাশ

মাদ্রাজের কোডাম্বাক্কম এলাকায় ফতিমা কনভেন্টের উল্টোদিকের আকাশ এপার্ট্মেন্টে আমার বাড়ির একটু  দূরে সে একটি ঘর নিয়ে থাকে। আমার সঙ্গে একদিন হঠাৎই আলাপ।  ভিতরের রাস্তায় মুদির দোকানে সে চাল কিনছিল। তার ইংরাজী শুনে তার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, বাঙ্গালী নাকি? 

-হ্যাঁ, আমি পলাশ। 

-ওদিকে কোথায় বাড়ি? 

-দক্ষিনেশ্বরে। মাদ্রাজের এই পাড়ায় প্রায় চার বছর। আপনি?

-সবে এসেছি। বছর খানেক হল। 

-পড়তে এসেছো?

-না। আমি চেলো বাজাই। ইল্লাইয়া রাজার নাম শুনেছেন? 

– ওনার নাম কে না জানে? বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক। 

-আমি ওনার টিমে চেলো বাজাই। ওনার মিউজিসিয়ান। আর কিছু করি না। তাতেই দিন শেষ। 

-মানে? চাকরি কর না? 

-না। ওনার গান তো তিন শিফটে রেকর্ডিং হয়। আমি কোন দিন মর্নিং আর ইভনিং শিফট করি। আবার কখনো  দুপর ও রাতে কাজ করি। 

তুমি চেলো শিখলে কী করে? 

-কোলকাতায় শিখেছি। আপনার কলকাতায় কোথায় বাড়ি?

-গড়িয়ায়।

আলাাপ করে খুব ভালো লাগল। বলে পলাশ  চলে গেল। 

পলাশকে দেখে কে বলবে সে কোলকাতা থেকে ইল্লাইয়া রাজার সঙ্গে কাজ করে? সপ্রতিভ, গোল মুখ মন্ডল, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, গায়ের রঙ কালো। চিবুকে একটা হালকা কাটা দাগ আছে যেটা মুখের সৌন্দর্য্য অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ লাগল। তারপর থেকে আমার সংগে তার মাঝে মাঝে দেখা হয়। 

বছর পাঁচেক আগে সুদূর মাদ্রাজ থেকে এক দম্পতি এসেছিলেন দক্ষিনেশ্বরের কালী মন্দির দর্শনে। তারা যে বাড়িতে দিন পনেরো ছিলেন  তাদের পাশেই পলাশদের দু’কামড়ার বাড়ি। একদিন পলাশের  চেলো শুনে তিনি পলাশের বাবার সঙ্গে দেখা করেন। বলেন, আপনি ছেলেকে মাদ্রাজ পাঠান। আমার পরিচিত এক সঙ্গিত পরিচালক আছে। সেখানে বাজাবে। রোজগারও হবে আর থাকতেও পারবে। ভবিষ্যত তৈরী হয় যাবে। পলাশের বাবা ও মা রাজী হন নি। বলেছিলেন আমাদের দু সন্তান। মেয়ে বড়, বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর ছেলে । পলাশ শোনেনি। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে চলে এসেছিল । তিনি পলাশ কে নিয়ে গিয়েছিলেন ইল্লাইয়া রাজার কাছে। সারা দেশ তাকে এক নামে চেনে। দক্ষিনের চলচ্চিত্র জগতে তিনি এক ও একছত্র সঙ্গিত পরিচালক। প্রথম দিন তাঁর বাজনা শুনে ইল্লাইয়া রাজা তাকে নিজের দলে নিয়ে ছিলেন। সেই দিনটা পলাশের মনে আছে। সকালে স্নান সেরে, শুভ্র বসনে স্টুডিয়োতে প্রবেশ করেই ডেকে ছিলেন পলাশকে। তারপর বলেছিলেন, বাজাও। পলাশ সে দিন নিজেকে উজাড় করে বাজিয়ে ছিল রাগ ভৈরবী। দু চোখ বুজে শুনেছিলেন তিনি। তারপর বলেছিলেন কাল থেকে চলে আসবে। প্রতি শিফট এ দুশো টাকা পাবে। কাজের কোন শেষ নেই। তোমার ভালো লাগবে। সেই শুরু। 

অনেক দিন হল সে বাড়ি যায় নি। মাস তিনেক পরে এই কোডাম্বাক্কম কলোনিতে সে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। পলাশ খুবই দরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা একটি সোনার দোকানে কারিগর, মা সেলাই ইস্কুলে সেলাই শেখায় ও সেলাই করে । এহেন সংসারে চেলো বাজানোর জন্য পলাশের জন্ম এক অভাবনীয় ঘটনা। মনে নেই, এখন আর মনে নেই কে তাকে পাড়ার ফনী বাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই চেলো বাজানোর হাতে খড়ি পলাশের। খুব বেশী পড়াশোনা করতে পারে নি । বাবার দোকানের  মালিক কে বলে একটা চাকরির  ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। দু দিন পরে আর সে মুখো হয় নি। বাবা কে বলেছিল, আমি এই কাজ করতে পারব না। বলে সে আবার চেলো বাজানোর পথে ফিরে এসেছিল।

 আমার এক মাত্র পুত্রর বয়স তখন দু বছর। পলাশ মাঝে মাঝেই চলে আসত আমদের বাড়ি।

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কীরে বাড়ি যাবি না?

একগাল হেসে বলল, না, বাবা মা আসছে সামনের মাসে। খুব উত্তেজিত লাগছে। এলে তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। বলে সে আমার ছেলের সঙ্গে খেলতে লাগল।

আমি তার খেলার ব্যাপারটা লক্ষ করছিলাম। সে আমার ছেলেকে ডার্ট দিয়ে একটা বিন্দুর  উপর টিপ  করে মারতে শেখাচ্ছিল। ডার্ট টি বার বার সেই বিন্দুর আশে পাশে  লাগছিল, পলাশ তাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল কি করে ঠিক গোল লাল বিন্দুটিতে মারতে হয়। সে বার বার মুখে বলছিল, ঠিক ওই জায়গাটা ফোকাস কর বাবাই।

আমার ছেলে ফোকাস কাকে বলে জানে না। সে একটি ডার্ট ছুঁড়ে  তাকাল আমার দিকে। আমি ছেলে কে বললাম পলাশ কাকার  কাছে ভাল করে শেখো। আর সেই সময় আমার প্রিয় ফিজিক্সের  মাস্টার চন্দ্রবিন্দু স্যারের কথা মনে পড়ল। একদিন লেন্স পড়াতে পড়াতে একটা প্রিজম আর একটা হলুদ পোস্ট কার্ড নিয়ে ক্লাসের বাইরে এসে  ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন আমাদের। প্রিজম টি রোদের সামনে ধরে পোস্টকার্ড টি নীচ থেকে আস্তে আস্তে উপরে তুলে আনতে লাগলেন। আমাদের বলেছিলেন পোস্টকার্ডটিকে  লক্ষ রাখতে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি কার্ডটিতে আগুন । স্যার বলেছিলেন, যে জায়গায় এই আগুন জ্বলছে সেটাকে বলে ফোকাল পয়েন্ট আর প্রিজম থেকে এই ফোকাল পয়েন্টের  দুরত্ত্বকে বলে ফোকাল লেংন্থ। আমদের আর কোনদিন  ভূল হয় নি। কিন্তু তারপর চন্দ্রবিন্দু স্যার বলেছিলেন, জীবনে বড় হতে গেলে এই ফোকাসটা  ঠিক করতে হয়। করলে সেখানে সৃষ্টির আগুন জ্বালানো সম্ভব।

আমি পলাশের মধ্যে সেই ফোকাস প্রশিক্ষনের ঝলক দেখতে পেলাম। জিজ্ঞসা করলাম , কত দূর পড়াশোনা করেছিস।

পলাশ বলল, হায়ার সেকেন্ডারি। তারপর চলে এসেছি। আমি আর পড়ব না। আমি স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাস করি। এটা  খুব দরকার।

-কেন? 

– সে একদিন বলব, বলে সে চলে গেল। তার শিফটের সময় । 

আমাকে মঝে মাঝেই ট্যুরে যেতে হয় দক্ষিনের চারটি প্রদেশের বিভিন্ন শহরে । অলকা একাই থাকে  বাবাই কে নিয়ে। পাড়াটা পরিচ্ছন্ন, নতুন এপার্ট্মেন্ট  উঠেছে পাশপাশি অনেক। মাদ্রাজের বাইরের অনেক পরিবার এখানে ফ্ল্যাট কিনেছে। শহরের খুব কাছেকাছি অথচ শহরের  ভিড় নেই এমন  একটি নির্মল বসতি মাদ্রাজের মধ্যে সহজে চোখে পড়ে না। কাছেই টি-নগর, মেরিনা বিচ খুব দূরে নয়। ভাল্লুভর কোট্ট্যায়াম  দু হাত দূরে। প্রাচীন বেঙ্গলী  ক্লাব  মাত্র দশ মিনিটের পথ। এই অঞ্চলের মানুষরা  সরল, অনারাম্বড় ও শিক্ষিত। ইঞ্জিনীয়ার ও ডাক্তারের ছড়াছড়ি । আর  দেখার মত প্রায়  প্রতিপাড়ায় একাধিক মদের দোকান । দেশী মদ বা কান্ট্রি লিকার সদা পাউচে বিক্রি হয়। অলকা একদিন ট্যুর থেকে ফিরলে  বলল, কদিন আগে পলাশ এসেছিল। দেখলাম মন খুব খারাপ। ইল্লাই রাজার ওখানে কিছু গোলমাল হয়েছে। বলল, কাজ ছেড়ে দিয়েছি। 

আমি বললাম, কেন? সে কী? এত ভাল সুযোগ ছেড়ে দিল? এই ত শুনলাম ওর মা বাবা আসবে?

অলকা বলল, আমিও তো তাই জানতাম। এই খবরটা শুনে আমি আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি।

-আবার অবে আসবে কিছু বলেছে?

-না। কবে বলেনি। তবে আসবে বলেছে।

আমি অপেক্ষায় আছি। মাঝে মাঝে মনে পরে তার কথা। আমি তার বাড়ি চিনি না। চিনলে গিয়ে খবর নিতাম। বিদেশ বিভূয়ে নিজেদেরই তো নিজেদের খবর  রাখতে হয়।  

একদিন অফিস বেরোব। দেখি পলাশ একটা সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। আমাকে দেখেই বলল, দাদা, আজ সন্ধ্যে বেলা থাকবেন তো?

থাকব। বলে আমি অফিস চলে যাই। ফোনে অলকা কে বলি পলাশ আজ আসতে পারে, বসিয়ে রেখো। আমার একটু দেরী হতে পারে।

আমার আর মনে থাকে না যে পলাশ আসবে। যেমন হয়, দেরী হয়েছে ফিরতে। অলকা বাড়ি ঢুকতেই বলল, পলাশ কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছে। 

আমি বললাম, কই?

-ছেলের সঙ্গে খেলছে।

দেখি ভিতরের ঘরে বাবাই এর সঙ্গে খেলছে পলাশ। আমাকে  দেখেই উঠে বসল। বলল, দাদা, খবর আছে। আমি আমেরিকা ট্যুরে যাচ্ছি। বলে এক গাল হাসি।

-ট্যুরে যাচ্ছিস মানে? 

ইল্লাই রাজার  কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আমি এ আর রহমানের টিমে জয়েন করেছি। বলিনি বউদিকে। দুজন কে একসঙ্গে বলব বলে। এবার বললাম। টিকিট ও ভিসা সব হয়ে গেছে। চার মাসের ট্যুর । তার পর এসে রহমান সাহেবের  কাছেই থাকব। 

আমি অবাক হয়ে পলাশের দিকে তাকাই আর চন্দ্রবিন্দু স্যারের কথাটা মনে হয়। ফোকাস ঠিক করতে পারলে সেখানে আগুন ও জ্বালানো যায়। কোথাকার দক্ষিনেশ্বরের পলাশ এবার আর এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে কে জানে? আমি বুঝতে পারছিলাম স্পোকেন ইংলিশ কেন জরুরী ছিল তার কাছে। 

আমি  তাকে অভিনন্দন জানাতে দু চোখ তার চিকচিক করে উঠল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *