হামিরউদ্দিন মিদ্যা

নদীর নামটি শামুকখোল। গঙ্গা-পদ্মা-যমুনার মতো গায়েগতরে বড় নদী নয়। শামুকখোল হল একটা ছোট্ট তিরতিরে নদী। তুমি যদি ভাবো শামুকখোল একটি নদী তাহলে নদী,আর যদি ভাবো নালা তো নালা। তুমি কী ভাবলে না ভাবলে তাতে শামুকখোলের কিচ্ছু যায় আসে না। শামুকখোলের আশেপাশের প্রবীণ বুড়োরা হুকোতে টান মেরে কাশতে কাশতে বলত,বিশাল বড় এক শামুকের পেট থেকে এই নদী বেরিয়ে এসেছিল।

বর্ষায় শামুকখোলে জল টলমল করে। ফাগুন চোত বৈশাখে শুকনা খটখটে। খটখটে মানে চালভাজার মতো খটখটে নয়। কোথাও কোথাও গোড়ালিডোবা জল থাকে। কোথাও বা আধহাঁটু। এপারের মানুষ চটি জোড়া হাতে নিয়ে ছপ্ ছপ্ করে পেরিয়ে যায়। ভুবন মাঝি তখন ছোট্ট ডিঙিটায় বসে বসে বিড়ি টানে। আর অপেক্ষা করে আবার কখন বর্ষা নামবে। খেয়া বাইবে।

নতুন বউ চম্পাকলি বাপের বাড়ি যাবে। সাইকেলের রড থেকে ছ’বছরের ছেলেটাকে কোলে তুলে নিল। খোকার নানির বাড়ি মধুচুষি গ্রামে। খোকার বাপ নামাজি। সে মেলা দেখতে যায় না। টিভি দেখে না। গান শোনে না। তবে খোকার মাকে কোনওদিন বারণ করেনি। পৌষসংক্রান্তি এলেই পাঠিয়ে দেয়। হাতে দেয় টাকাকড়ি। বলে, যাও খোকার মা, খোকাকে মেলা দেখিয়ে নিয়ে আসো। খেলনাপাতি কিনে দিও।

শামুকখোলের ধারে ধারে অনেক গাছপালা। পাকুড়,অশ্বত্থ,বট,পলাশ,শিমুল। ফাগুন মাসে পলাশ-শিমুলের ফুল ফুটে। নদীর দু’পারে তখন কী শোভা! দূর থেকে দেখলে মনে হবে আগুন লেগেছে গাছে গাছে। যত রাজ্যের পাখিরা এসে কিচিরমিচির করে। পাখিদের ডানার ঝাপটায় টুপটাপ করে ফুল ঝরে নদীর জলে ভেসে যায়। সেই ফুল দূরের কোনও ঘাটে স্নান করতে করতে হেসে তুলে নেয় কোনও কুমারী মেয়ে। যেন তার নাগর ফুল পাঠিয়েছে।

খোকার বাপ বলল,আমি চললম গো! পরব বাদ গিয়ে নিয়ে আসব তুমাদের। সাবধানে যাও,কেমন?

খোকার মা ঘাড় নাড়ে। খোকা পিট পিট করে চেয়ে দেখে বাপটাকে। এই লোক টিভি দেখে না,গান শোনে না,মেলা দেখে না,এ কেমন লোক! আবার মেলা দেখতে পয়সাও দেয়!

সাইকেলের রডে বসে অনেকদূর পথ পেরিয়ে এসেছে খোকা। রডের সঙ্গে একটা গামছা বেজিয়ে দিয়েছিল তার বাপ। কচি ছেলে,বসতে কষ্ট পাবে। খোকার পাগুলো যাতে না চাকায় লেগে কেটে যায়,তার জন্য পা-দানিও লাগিয়ে দিয়েছে। 

নৌকার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। এখন নদীতে জল অনেক কম। ভুবন মাঝি ঘাটে নৌকা ভেড়াল। কাঠের পাটাটা লাগিয়ে দিল। যাত্রীরা সব একে একে উঠে পড়ল নৌকায়। খোকার মা সরু পাটায় পা দিয়ে খোকাকে কোলে নিয়ে উঠতে ভয় পায়। ভুবন মাঝি বুঝতে পেরে খোকাকে কোলে নিয়ে আগে তুলে দিল। তারপর উঠল খোকার মা।

নাম কী তোমার খোকা?

খোকা বললে,আব্দুল।

আব্দুল! বাহ,বেশ বেশ।

কীসে পড়ো?

ক্লাস ওয়ানে।

ওয়ান ওয়ান ওয়ান,খায় শুধু জোয়ান।

খোকা হাসল। এই ছড়া সে জানে। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা তাকে রাগায়। মাকে সেকথা বলতে, ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়া ছেলেদের রাগানোর ছড়া শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। টু খায় কুকুর গু, ক্লাস থ্রি পানবিড়ি, ফোর ফোর ফোর, হেডমাস্টারের জুতো চোর…

নৌকা চলছে। খোকার মা খোকাকে কোলে নিয়ে বসল পাটাতনে। ভুবন মাঝি খোকার সঙ্গে গল্প করে সুখ পায়। বলল, আব্দুল মাঝির গল্পটা শুনেছ তো? রবি ঠাকুর লিখেছেন।

খোকা কৌতুহলী হল। রবি ঠাকুরের ছবি সে দেখেছে। স্কুলের দিদিমনি একদিন বলল, কাল পঁচিশে বৈশাখ। ক্লাস হবে না। প্রত্যেকে ফুলের মালা আনবে তোমরা।

খোকাদের ফুলবাগান নেই। ভোর ভোর উঠে পারুল দিদির সঙ্গে ফুল কুড়িয়ে এনেছিল জ্যোৎস্নাদের বাড়িতে। সেই ফুল পারুলদিদিই গেঁথে দিয়েছিল। মা গামছা ভিজিয়ে মুখ-হাত মুছে,মাথায় চবচবে করে তেল মাখিয়ে,চুল আচড়ে দিয়ে বলেছিল, রাস্তার মাঝ দিকে যাস না খোকা,এক ধারে ধারে সাবধানে যাবি,কেমন? কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করিস না।

খোকা স্কুলে গিয়ে সেই প্রথম রবি ঠাকুরের ছবি দেখেছিল। ছবিতে মালা দিয়েছিল সে। সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো লোকটা তার নামে গল্প লিখেছে!

খোকা কথা বলে না। ফ্যালফ্যাল করে চায়। নদীর জল দেখে। কচুরিপানার ভেসে যাওয়া দেখে। গায়েনতারা মাছের সাঁতার দেখে। পানকৌড়ির ডুব দেওয়া দেখে। আকাশে চিলের ওড়ান দেখে। তারপর বললে,আব্দুল মাঝি?

ভুবন মাঝির যেন ওপারে যাওয়ার তেমন গরজ নেই। নৌকা চলছে চলুক। ভাসছে ভাসুক। ছোট্ট তিরতিরে নদী,কতক্ষণ আর লাগবে! টপটপ চলে গেলেই তো আবার যাত্রীদের জন্যে হা-করে চেয়ে বসে থাকতে হবে। 

হ্যাঁ খোকা,আব্দুল মাঝি,ছুঁচলো তাঁর দাড়ি,গোঁফ তার কামানো,মাথা তার নেড়া। দাদাকে এনে দিত পদ্মার ইলিশ আর কচ্ছপের ডিম।

খোকা বললে,কাছিমের ডিম?

ভুবন মাঝি বললে,হ্যাঁ খোকা কচ্ছপই হল কাছিম। কাছিমই হল কচ্ছপ। ডিম পেড়ে বালি চাপা দিয়ে রাখে। আব্দুল মাঝি তো সব জানে। সব দেখে। সে জলের মানুষ। সে নদীর মানুষ। কচ্ছপের ডিম ঠিক খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসত। একদিন কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়ল আব্দুল। নৌকা ডোবে ডোবে। সাঁতরে নদীর চরে উঠল। উঠে দেখে বিশাল এক বাঘ…

ভুবন মাঝি নৌকা ভিড়াল। নদীর ঘাটে একটি নতুন বউ খোকার মতোই একটি ছেলেকে গা ধুইয়ে দিচ্ছে। যত গা রগড়ে দিচ্ছে তত কাঁদছে ছেলেটা। কিছুটা দূরে একটা লোক গাইগরুকে গা ধোয়াচ্ছে। বাছুরটা পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে। দূরের কোনও গাছ থেকে ঘুঘু পাখির ডাক ভেসে এল,ঘু-ঘুর-ঘু,ঘু-ঘুর-ঘু….

খোকার মা বলল,ওই বটগাছের ছায়ায় বসব চল খোকা। তোর মামা আমাদের নিতে আসবে।

নদীর পাড়েই প্রকান্ড এক বটগাছ। কী তার ছায়া! ক’জন যাত্রী বসেছিল নৌকার অপেক্ষায়। ওরা উঠে পড়ল। খোকা আর খোকার মা বটতলায় গিয়ে দাঁড়াল।

মামার কথা শুনে নানিবাড়ির কথা মনে পড়ল খোকার। কতদিন পর মধুচুষি গ্রামে যাচ্ছে সে। মধুচুষি গ্রামটা কত সুন্দর! গাছগাছালিতে ভরা। পাখপাখালিতে ভরা। মাঠে মাঠে ঝিঙাফুলি,রুপশালি,খেঁজুরছড়ি ধানের চাষ হয়। পেঁয়াজবাড়ির ধারে ধারে খোকার নানা কুসুমের বীজ ছড়ায়। কুসুমগাছে লাল-হলুদ ফুল ফোটে। কুসুমবীজ খেতে টিয়াপাখি নামে ঝাঁকে ঝাঁকে।

খোকার নানী খোকাকে খুব ভালোবাসে। খোকা গেলে তার জন্য প্রতিদিন কতরকম পদ রাঁধে। সজনেফুলের পোস্তবড়া,কচুর লতির ঘন্ট। আসকি পিঠে,ঝিঙ্কা পিঠে,কলেরযাতা,চটুই পিঠে। খোকা হলুদ মুড়ি খাবে। খোকা মেলা দেখতে যাবে। খোকা গাড়ি কিনবে।খোকা বাঁশি কিনবে। খোকা জিলিপি খাবে। কিন্তু খোকার মামা এখনও আসে না কেন গো! খোকার আর তর সয় না।

খোকা নদীর দিকে চাইল। কী লিকলিকে নদী! কুলকুল করে জল বইছে। রোদ পড়ে ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। বালিহাঁসের দল কিচ্ কিচ্ করে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। বাতাস বইছে শো শো…

ঘু-ঘুর-ঘু,ঘু-ঘুর-ঘু…. 

খোকার দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে না। মায়ের কাছ থেকে হেঁটে হেঁটে একটু দূরে চলে যায় সে। খোকার মা বলে,জলে নামিস না খোকা।

খোকা দেখে একটা জেলে ডিঙি বেয়ে আসছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে খোকা ডিঙিটাকে দেখে। কিছুক্ষণ পর লোকটা তীরে ডিঙি লাগিয়ে একটা খুটির সঙ্গে বেঁধে দিল। মাথায় বাঁধা গামছার পাগড়িটা খুলতেই খোকা দেখল,নেড়া মাথা। লোকটাকে ভুবন মাঝির মুখে শোনা গল্পের সেই আব্দুল মাঝির মতো দেখতে। মুখে তার ছুঁচলো দাড়ি,গোঁফ কামানো। নৌকা থেকে জাল,মাছের খালুই নিয়ে পাড়ে উঠে এল লোকটা।

তুমির কাদের বাড়ির ছেলে খোকা?

খোকা আঙুল বাড়িয়ে মাকে দেখাল। বটতলা থেকে মা ডাকল,চলে আয়।

খোকা ভয়ে ভয়ে বলল,হ্যাঁ গো,তুমি কি সেই আব্দুল মাঝি? পদ্মা থেকে ইলিশমাছ,আর কচ্ছপের ডিম আনো?

লোকটা হাসল। হাসলে বড় সুন্দর দেখাল তাকে। বলল,হ্যাঁ খোকা আমি আব্দুল মাঝি। জল শুকিয়ে শুকিয়ে নদী সরু হয়ে গেল। শরীরের হাড় হল নড়বড়ে। দৃষ্টি হল ঝাপসা। আর ভালো ডিঙি বাইতে পারি না। পদ্মায় মাছ ধরতে যেতে পারি না। পদ্মাতেও আর সেই আগের মতো ইলিশ নেই খোকা। একদল জেলে আছে,তারা ছানা মাছগুলোই ধরে ধরে খেয়ে নেয়। নদীর মাছ কমল। কচ্ছপ ধরে ধরে শেষ করল। কাঁচি বেদিনির ছাগলছানাটাও আর নেই । আরও একদিন জল থেকে কুমির উঠে ঠ্যাং ধরে টেনে নিয়ে গেল। বেদিনি সেদিন নদীর চরে ভাত খেতে বসেছিল। তখন সন্ধে হয় হয়।সূয্যি ডুবু ডুবু। সারাদিন বাখারি চেঁছে চেঁছে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল কাঁচি। সেই ফাঁকেই…

শুনে খোকার মনখারাপ হল। চোখ ছল ছল করে উঠল তার।

কতদিন পর খোকা ঘরের বাইরে এসেছে। এই নদী,নদীর চর,মাথার ওপর নীল আকাশ সবকিছু ভালো লাগে খোকার। খোকা ভাবে বড় হলে সে একটা নৌকা কিনবে। ভাসাবে এই শামুকখোলে। তারপর ভেসে ভেসে চলে যাবে পদ্মায়। যেখানে কুমিরে নাক বের করে জলে বসে থাকে,আর ডাঙায় রোদ পোহায়।

সাইকেলের টিংটিং  ঘন্টি শুনতে পেল খোকা। মামা চলে এসেছে। খোকার মা ডাকল,চলে আয়।

খোকা হাত নাড়ল। তারপর লোকটাকে বললে,আমি নানির বাড়ি যাচ্ছি। আসার দিনে আবার দেখা হবে,কেমন?

লোকটা খোকলা গালে হাসল। বলল,হ্যাঁ খোকা। আবার দেখা হবে। এই নদীই আমার ঘর,এই নদীই আমার বাড়ি। নদীর জলেই কাটল জীবন,এবার দেব পাড়ি।

খোকা দৌড় লাগাল। খোকা ছুটছে। খোকার মামা নিতে এসেছে। খোকা নানির বাড়ি যাবে। খোকা হলুদ মুড়ি খাবে। খোকা আসকি পিঠে খাবে। খোকা ঝিঙ্কা পিঠে খাবে। খোকা মেলা দেখতে যাবে। খোকা জিলিপি খাবে,খোকা বাঁশি কিনবে…

লোকটা মুগ্ধ হয়ে খোকার যাওয়ার পথের পানে চেয়ে রইলো। ওদিকে ঘুঘু পাখিটা তখনও  বিমর্ষ গলায় ডেকেই চলেছে,ঘু-ঘুর-ঘু…ঘু-ঘুর-ঘু…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *