সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ১
মঞ্চাভিনয় ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। সেলুলয়েড আসে পরবর্তী যুগে। আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশি আগে। সরাসরি মঞ্চাভিনয় না করে চলমান ছবিকে প্রোজেকশন বা অভিক্ষেপণের মাধ্যমে সফলভাবে প্রদর্শনই হল সেলুলয়েডের প্রাথমিক পর্যায়।
ঠিক কবে এই কাজ শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা না গেলেও ১৮৯৫ সালে প্যারিস শহরে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় নিজেদের তৈরি ছোট ছোট দশটি চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক ভাবে প্রদর্শন করেন। এই ঘটনার পরেই বিশ্বজুড়ে ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতে থাকে। এক দশকের মধ্যে চলচ্চিত্র সার্বজনীন বিনোদন শিল্পে পরিণত হয়।

সাদা কালো ক্যামেরায় তোলা নির্বাক এক মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রথমদিকে তৈরি হত। পরবর্তীকালে একাধিক শট সম্বলিত কয়েক মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি হতে থাকে। ১৮৯৮ সালে ঘূর্ণায়মান ক্যামেরা দিয়ে প্যানিং শট নেওয়া শুরু হয়। ছবির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার নানান কৌশল ব্যবহার হতে থাকে।
১৯০০ সালে ক্লোজ আপ শটের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯০৫ সালে জার্মানির পিটসবার্গে ‘দ্য নিকেলোডিয়ান’ প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ, যেখানে শুধুমাত্র চলচ্চিত্রই প্রদর্শন করা হত। চলচ্চিত্র শিল্প তার গ্ল্যামার নিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জনপ্রিয়তার রাস্তা খুলে দেয়। এই সময়ে তৈরি হওয়া মার্কিন চলচ্চিত্র গুলি অস্ট্রেলিয়া এবং ইওরোপের বিভিন্ন দেশে শেয়ার মার্কেটের বৃহত্তম ভাগীদার হয়ে দাঁড়ায়।
চলচ্চিত্রায়নে নতুন নতুন প্রয়োগ কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে আকর্ষণীয়তা বৃদ্ধির প্রয়াস চলতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চলচ্চিত্র শিল্পে এক রূপান্তর ঘটে যায়। ছোট ছবির জায়গায় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনী চিত্র শুরু হয়। প্রেক্ষাগৃহ বড় হতে থাকে এবং টিকিটের দামও বাড়তে থাকে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিনোদনের মাধ্যম দিয়ে মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়ে যান।
ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ সেই সময় মার্কিন চলচ্চিত্রে দর্শকদের মধ্যে নাটকীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের প্রান্তে হলিউড অঞ্চলে তিনিই প্রথম শুটিং করেন, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রে এই সময়ে বছরে গড়ে আটশোটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হত, যা সারা বিশ্বের প্রায় বিরাশি শতাংশ ছিল। ১৯২৭ সালে বিশ্বখ্যাত বিনোদন কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রাদার্স তৈরি করে ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’। এই ছবিতে সম লয়ে সংলাপ ও সম লয়ে সংগীত ব্যবহার করা হয়। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পরে নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অবসান ঘটে।
১৯২৯ সালের শেষের দিকে হলিউডের সমস্ত ছবিই ছিল সবাক। এই সময়ের চলচ্চিত্রে বাস্তব বিষয় এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে প্রচুর চলচ্চিত্র তৈরি হয়। এই সময়ে তৈরি চলচ্চিত্র গুলি বিভিন্ন মতামত প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
১৯৫০ সালের আশেপাশে হাউজ আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটস কমিটি হলিউডে তদন্ত চালিয়ে অনেক কলাকুশলীকে কালো তালিকাভুক্ত করে। এরমধ্যে প্রথিতযশা চলচ্চিত্র শিল্পী চার্লি চ্যাপলিনও এই তালিকাভুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্বে বিনোদন শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। উন্নত প্রয়োগ কৌশলের আবির্ভাব হয়।
পর্ব – ২
চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতা আলোচনা করতে গেলে যে জনপ্রিয়তম অভিনেতা আজও সমানভাবে দর্শকের মনে স্থান করে নিয়েছেন তিনি স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র, যিনি চার্লি চ্যাপলিন নামেই জগদ্বিখ্যাত। হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুর সময় থেকে চার্লি চ্যাপলিন অভিনয় ও পরিচালনা দুইই করেছিলেন এবং সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
ভিক্টরিয়ো যুগে এই ব্রিটিশ অভিনেতা প্রায় পচাত্তর বছরের কর্মজীবনে খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিলেন। তাঁর অভিনীত ছবিগুলো আজও এক আলাদা মাত্রা যোগ করে।
১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল ব্রিটেনের এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চার্লি চ্যাপলিন। বাবার অনুপস্থিতি এবং মায়ের অর্থকষ্টের কারণে শৈশবেই তাঁকে কর্মশালায় কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল। চোদ্দো বছর বয়সে তাঁর মাকে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হলে কৈশোরেই তাঁর একলা পথ চলা শুরু হয়। ওই সময় থেকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রঙ্গশালায় শিশুশিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন। মঞ্চাভিনেতা এবং কৌতুক অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
উনিশ বছর বয়সে “ফ্রেড কার্নো” কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯১৪ সালে কিস্টোন স্টুডিওজের সাথে যুক্ত হয়ে বড় পর্দায় অভিনয় শুরু করেন। তাঁর নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে চরিত্র “দ্য ট্রাম্প” চরিত্রের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন।

ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে ব্রিটিশ ভদ্রজনোচিত আদব কায়দায় কেতাদুরস্ত ‘ট্রাম্প’ চরিত্রটি দর্শকদের কাছে সমীহ আদায় করে নেয়। চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর টুথব্রাশ গোঁফ গেট আপটি শিক্ষিত জনমানসে প্রভাব বিস্তার করে।১৯১৮ সালের মধ্যে চার্লি চ্যাপলিন বিশ্বের বিশেষ ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।
১৯১৯ সালে সহ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান “ইউনাইটেড আর্টিস্টস” গঠন করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হল, ‘দ্য কিড’। এই চলচ্চিত্রটি ১৯২১ সালে নির্মিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে নির্মিত হয়েছিল ‘আ উওম্যান অব প্যারিস’। ‘দ্য গোল্ড রাশ’ নির্মিত হয় ১৯২৫ সালে। ১৯২৮ সালে নির্মিত হয় ‘দ্য সার্কাস’। সবকটি চলচ্চিত্রে তিনি তাঁর অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯৩০ সালে তিনি সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। নিজের দায়িত্বে ১৯৩১ সালে নির্বাক চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইটস’ ও ১৯৩৬ সালে ‘মডার্ন টাইমস’ নির্মাণ করেন, যা চলচ্চিত্র শিল্পের মাইল স্টোন স্বরূপ।
১৯৪০ সালে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে অ্যাডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করে তৈরি করেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’। ওই বছর এবং তার পরবর্তী সময়ে চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সমাজতান্ত্রিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁর বিরুদ্ধে পিতৃত্বের মামলা চলাকালীন অপর এক মহিলাকে বিয়ে করায় তাঁর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার শুরু হয়। এফ বি আই চার্লি চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যান।
১৯১৮ সালে মার্কিন অভিনেত্রী মিলড্রেড হ্যারিসের সাথে চার্লি চ্যাপলিনের বিয়ে হয় এবং এই সম্পর্ক ১৯২১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময় তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। অপর এক মার্কিন অভিনেত্রী লিটা গ্রে এর সাথে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত দাম্পত্যজীবন যাপন করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। এই সময়ে তাঁর দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। আরও এক অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত মার্কিন অভিনেত্রী পলেট গডার্ড ১৯৩৬ সালে চার্লি চ্যাপলিনের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি চ্যাপলিন অভিনীত ‘মডার্ন টাইমস’ এবং ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এও অভিনয় করেছিলেন। ১৯৪২ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে নোবেল ও পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ওনিলের কন্যা উনা ওনিল চ্যাপলিনের চতুর্থ এবং শেষ স্ত্রী। এই সময়ে তাঁদের তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যার জন্ম হয়।
পরবর্তীকালে তাঁর নির্মিত ও অভিনীত চলচ্চিত্রগুলিতে ‘ট্রাম্প’ সত্তাকে বিসর্জন দেন। এরপর একে একে ১৯৪৭ সালে ‘মঁসিয়ে ভের্দি’, ১৯৫২ সালে ‘লাইমলাইট’, ১৯৫৭ সালে ‘আ কিং ইন নিউ ইয়র্ক’ এবং ১৯৬৭ সালে ‘আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’ চলচ্চিত্রগুলি নির্মাণ করেন।
নির্বাক চলচ্চিত্র যুগে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন সবাক এবং নির্বাক, দুই ধরনের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে নিজের মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রথম দিকের চলচ্চিত্র গুলোতে বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে ‘দ্য ট্রাম্প’-এর সংগ্রামের করুণ রসের সাথে এক কৌতুকময় হাস্যরসের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন এবং কয়েকটিতে আত্মজীবনী মূলক বিষয়বস্তু পরিবেশন করেছেন।
নিজের কাজের প্রতি তাঁর উৎসর্গিত প্রাণ চলচ্চিত্র শিল্পে চিরকালীন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯৭১ সালে ফরাসি সরকার লেজিওঁ দনরের কমান্ডার সম্মান প্রদান করে চার্লি চ্যাপলিনকে। ১৯৭২ সালে তাঁকে অ্যাকাডেমি সম্মান সূচক পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ তাঁকে ‘নাইটহুড’ সম্মানে ভূষিত করেন।
দীর্ঘ কর্মজীবনে বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। চলচ্চিত্র শিল্পের পটভূমি নির্মাণ করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির প্রভুত উন্নয়ন হলেও তাঁর মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পরে তাঁর নির্মিত “দ্য গোল্ড রাশ”, “সিটি লাইটস”, ” মডার্ন টাইমস”, “দ্য গ্রেট ডিক্টেটর” চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি অমর হয়ে উঠেছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই চলচ্চিত্রগুলোকে মার্কিন চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরার তালিকায় প্রায়শই স্থান করে নিতে দেখা যায়।
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট চার্লি চ্যাপলিনকে “বিশ্ব সংস্কৃতির অতি উচ্চ ব্যক্তিত্ব” বলে বর্ণনা করে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে ইতালিও চলচ্চিত্রকার ‘ফেদেরিকো ফেল্লিনি’ মন্তব্য করেন, “চ্যাপলিন অনেকটা আদমের মত, আমরা সবাই যার উত্তরসূরি”। ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাক তাতি বলেন, “চ্যাপলিন না থাকলে হয়তো আমি কখনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতাম না”।
সুইজারল্যান্ডের কর্সিয়ের-সুর-ভেভিতে চ্যাপলিনের বাড়ি মনোইর দে বানকে “চ্যাপলিনস ওয়ার্ল্ড” নামে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে, যা ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে চালু করা হয়েছিল। লণ্ডনের লেস্টার স্কোয়ারে ১৯৮১ সালে উন্মোচিত চ্যাপলিনের “দ্য ট্রাম্প” চরিত্রের একটি ভাস্কর্য রয়েছে। ওই জায়গার একটি রাস্তার নাম “চার্লি চ্যাপলিন ওয়াক”।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চার্লি চ্যাপলিনকে নানানভাবে সম্মান প্রদর্শন করেছে। ১৯৮১ সালে সোভিয়েত জ্যোতির্বিদ লুদমিলা কারাচকিনা আবিষ্কৃত একটি ছোট গ্রহের নামকরণ করা হয় “৩৬২৩ চ্যাপলিন”। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের অনেক দেশ চ্যাপলিনের পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশের মাধ্যমে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেছে।
চ্যাপলিনের সন্তানেরা প্যারিসে অবস্থিত চ্যাপলিন কার্যালয় থেকে উত্তরাধিকারের দেখাশোনা করেন। চ্যাপলিনের কাজের নাম, ভাবমূর্তি ও অধিকার রক্ষা করার জন্য ‘অ্যাসোসিয়েশন চ্যাপলিন’ নামে একটি কার্যালয় স্থাপন করেন তাঁর কয়েকজন সন্তান। রয় এক্সপোর্ট এস এ এস ১৯১৮ সালের পর চ্যাপলিনের নির্মিত চলচ্চিত্রের স্বত্ব অর্জন করে। বাবলস ইনকর্পোরেটেড এস এ চ্যাপলিনের ছবি ও নামের স্বত্ব অর্জন করে।
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ‘চ্যাপলিন রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করে। সিনেতিকা দি বোলোগ্নাতে অবস্থিত ‘চ্যাপলিন রিসার্চ সেন্টার’-এ তাঁর ছবি, পাণ্ডুলিপি ও চিঠি গবেষণার জন্য পাওয়া যায়।
চ্যাপলিনের জীবনী অবলম্বনে রিচার্ড অ্যাটেনব্রো একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চ্যাপলিনের জীবনীর ওপরে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তাঁর নিজস্ব জীবন ও চলচ্চিত্র চরিত্র নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়ে চলেছে। চ্যাপলিন যেহেতু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান স্বরূপ, তাঁকে নিয়ে তাই তাঁর জন্মের ১৩৫ বছর পরেও সমানতালে গবেষণা চলছে।
পর্ব – ৩
চার্লি চ্যাপলিনের কর্মজীবনের স্থায়িত্ব পচাত্তর বছর। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বিশেষ রকমের পরিবর্তন ঘটেছিল। নির্বাক থেকে সবাক, সবধরনের চলচ্চিত্র এইসময়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিমাণ ছিল প্রায় বিরানব্বইটি। কৌতুকের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সময়কে তাঁর তৈরি চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেছেন।

চ্যাপলিন কি স্টোন স্টুডিওতে ছত্রিশটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রযোজনা করেন মার্ক সিনেট। ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাক চলচ্চিত্র ‘মেকিং আ লিভিং’-এ চ্যাপলিন ছাড়াও অভিনয় করেন হেনরি লেহম্যান, ভার্জিনিয়া কার্টলি, চেস্টার কঙ্কলিন এবং মিন্টা ডার্ফি। এই ছবির চিত্রগ্রাহক ছিলেন এনরিক হুয়ান ভাইজো এবং ফ্র্যাংক ডি উইলিয়াম। এই ছবিটির মূল বিষয়বস্তু মানুষের জীবনের ভালোভাবে বাঁচা এবং সেই বাঁচতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে নানান চারিত্রিক উত্থান পতনের কাহিনী।
ছবির শুরুতে দেখা যায় চ্যাপলিন এক যুবতীকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছেন। লেহম্যান চরিত্রটি ওই একই যুবতীকে ফুল ও আংটি দিতে চাইলে, সে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং জানায় তার অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ঘটনাচক্রে চ্যাপলিন সেইখানে উপস্থিত হলে তাদের মধ্যে স্ন্যাপস্টিক যুদ্ধ হয়। পরবর্তী সময়ে লেহম্যান চরিত্রটি একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ছবি তোলে এবং মোটর চালককে সাহায্য করার সময়ে চ্যাপলিন তার ক্যামেরা চুরি করে নেন এবং সংবাদপত্রের অফিসে গিয়ে তা নিজের বলে ছাপিয়ে দেন। পরে তাদের মধ্যে আবার মারপিট শুরু হয়ে যায়।
এইসময় তাঁর নির্বাক ছবিগুলি পরপর প্রকাশ হতে থাকে। ‘মেকিং আ লিভিং’ ছবিটি প্রকাশ হওয়ার দিন কয়েক পরেই প্রকাশিত হয় ‘কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস’। মুখ্য ভূমিকায় চার্লি চ্যাপলিন ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেন হেনরি লেহম্যান, ফ্র্যাংক ডি উইলিয়াম এবং গর্ডন গ্রীফিত। ছয় মিনিট দীর্ঘ এই ছবির চিত্রগ্রাহক ছিলেন এনরিক হুয়ান ভাইজো এবং ফ্র্যাংক ডি উইলিয়াম।
এই ছবির মূখ্য বিষয়বস্তু হল, কিশোরদের একটি গাড়ি প্রতিযোগিতা। দ্য ট্রাম্প এই প্রতিযোগিতার একজন দর্শক। কিন্তু তিনি প্রতিযোগিতার চিত্রগ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি করছেন, শুধুমাত্র ক্যামেরার সামনে চলে এসে। এতে দর্শক এবং প্রতিযোগীরা উভয়েই বিরক্ত হচ্ছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই চলচ্চিত্রে ট্রাম্প চরিত্রটিকে প্রথম দর্শকদের সামনে উপস্থিত করা হয়।
চার্লি চ্যাপলিনের অন্যান্য সিনেমা গুলির মধ্যে ‘দ্য গোল্ড রাশ’, ‘দ্য সার্কাস’, ‘সিটি লাইট’, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ইত্যাদি সিনেমা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সমসাময়িক সময়ে জীবনধারা এবং মানুষের মানষিক বোধকে চিত্রায়িত করেছে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমার মধ্যে দিয়ে বাস্তব জীবনকে অভিনয় দক্ষতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন এই শিল্পী।
পর্ব – ৪
চলচ্চিত্র শিল্পের ধ্রুপদী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে আমরা গত সংখ্যাগুলিতে আলোচনা করেছি। চলচ্চিত্রের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। সমসাময়িক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে অবিভক্ত বঙ্গ (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বোঝায়। পৃথিবীর অনেক দেশের মত ১৮৯০ এর দশকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। এই সুত্র ধরে ১৯০০ শতকে নির্বাক চলচ্চিত্র শুরু হয়। ১৯১০ সালে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর পরবর্তী সময়ে সবাক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র সৃষ্টি হতে প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় লেগেছিল এবং বাংলাদেশে একটি অর্থকরী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই চলচ্চিত্র শিল্প।
বাংলাদেশে প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদ্যোগে। ১৮৯৮ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার এস ডি ও-র বাংলোতে। পরবর্তী প্রদর্শনী হয় ঢাকার পাটুয়াটুলির ক্রাউন থিয়েটারে। এইগুলি বায়োস্কোপের বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল। গবেষক অনুপম হায়াতের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এইসব চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল মহারানি ভিক্টোরিয়ার জুবিলী মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের তুষারপাতের ক্রীড়া, সিংহ ও মাহুতের খেলা ইত্যাদি। তখন বায়োস্কোপ দেখানোর জন্য সাধারণ দর্শকের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা ছিল।

কলকাতায় যে বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠিত হয় তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকার মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুরি গ্রামের হীরালাল সেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বায়োস্কোপ কোম্পানির নাম ‘দ্য রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। এইসময় কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে যে সমস্ত নাটক প্রদর্শিত হয় সেইগুলির কিছু অংশ ক্যামেরায় ধারণ করে বায়োস্কোপ আকারে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এইসব জনপ্রিয় থিয়েটার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘আলীবাবা’, ‘দোল লীলা’, ‘সীতারাম’, ‘ভ্রমর’। বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে হীরালাল সেন এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিজ্ঞাপন চিত্র ও সংবাদ চিত্র নির্মাণের পথিকৃতও ছিলেন তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে নির্মিত ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ছিল বাংলা ভাষার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র। ১৯১৬ সালে কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটারের পক্ষ থেকে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ মুক্তি পায়। ১৯২১ সালে কলকাতায় ‘বিলাত ফেরত’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার প্রযোজক ও অভিনেতা ছিলেন বড়িশালের ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯২৭-২৮ সালে নবাব পরিবারের কয়েকজন সংস্কৃতি মনস্ক তরুণ ‘সুকুমারী’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তখনো পর্যন্ত নাট্য মঞ্চেও নারী চরিত্রের অভিনয় পুরুষেরাই করতেন। চলচ্চিত্রও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই নবাব পরিবারের উদ্যোগেই ঢাকায় ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত এই কোম্পানির প্রযোজনায় নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বৈপ্লবিক বিষয়টি হল, নারী চরিত্রে নারীরাই অংশগ্রহণ করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন ললিটা বা বুড়ি নামে এক বাঈজী। চারুবালা ও দেবী নামে আরও দুই বাঈজী এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হরিমতী নামে এক অভিনেত্রীরও আবির্ভাব ঘটে এই চলচ্চিত্রে। ১৯৩১ সালে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে। ১৯৪৬ সালে ওবায়েদ উল হক হিমাদ্রি চৌধুরী ছদ্মনামে ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। কলকাতায় এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনো মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র।
উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মহম্মদ নির্মাণ করেন ‘মানুষের ভগবান’ নামে চলচ্চিত্রটি ১৯৪৭ সালে। দেশ ভাগের পরে এই চলচ্চিত্র পরিচালকেরা ঢাকায় ফিরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ প্রদান করেন। ১৯৪৮ সালে নাজির আহমেদ ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরের বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে নাজির আহমেদের পরিচালনায় নির্মাণ করা হয় প্রামাণ্য চিত্র ‘সালামত’। তিনি একাধারে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতার কর্মী ও লেখক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁরই উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি ও স্টুডিও চালু হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক। তাঁর কাহিনী থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আসিয়া’ এবং ‘নবারুণ’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। ‘নতুন দিগন্ত’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন তিনি।
তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ২০০২ সালে কান ফেস্টিভ্যালে ডিরেক্টরস ফোর্ট নাইট ক্যাটাগরিতে মনোনীত ও প্রদর্শিত হয়। ২০০৩ সালে এই ছবিটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য পেশ করা হয়। এটি প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র, যা অস্কারে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য পেশ করা হয়। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনটি সিনেমা অস্কারের জন্য পেশ করা হয়। হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, আবু সাঈদের ‘নিরন্তর’ এবং গোলাম রাব্বানীর ‘বিপ্লবের স্বপ্ন ডানায়’। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত বাংলাদেশী ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’, অমিত আশরাফের ‘উধাও’ রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেহেরজান’।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রযুক্তিগতভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গন আরও কিছু সমৃদ্ধ ভাণ্ডার বাংলাদেশ থেকে পাবে বলে আশা করা যায়।
পর্ব – ৫
১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে নিবেদিত প্রথম নির্বাক ভারতীয় চলচ্চিত্র ছিল ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। অবিভক্ত ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্রের নাম ‘আলম আরা’। ১৯৩১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন ‘আরদেশির ইরানি’।

প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা শুরু হয় ১৯৩০ সালের প্রথম থেকে। বাজার ধরার আশায় উর্দু কিংবা ফরাসি ভাষায় চলচ্চিত্রগুলি প্রথমে নির্মাণ করা হত। ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি প্রথমে এইগুলি নির্মাণ করত। বাংলা ভাষায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় ১৯৩১ সালে। ছবিটির নাম ‘জামাই ষষ্ঠী’। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বোস এই চলচ্চিত্র গুলিতে অভিনয় ও পরিচালনা করতেন।
পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রথম বাংলা ছবি ‘দেনা পাওনা’ কলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে মুক্তি পায় ১৯৩১ সালে। ১৯৩২ সালে ‘চণ্ডীদাস’ একটি উল্লেখযোগ্য সবাক চলচ্চিত্র। এর পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র জগত কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দামামা এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিনোদন জগত কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয় নিয়ে কিছু সিনেমা জনমানসে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল।
প্রাচীন বাংলা সিনেমায় যে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবদান অসামান্য তাদের মধ্যে কানন দেবী অন্যতম। ১৯২৬ সালে জয়তিশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জয়দেব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর অভিনয় জীবন শুরু। তখন তিনি নিতান্তই কিশোরী। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে অভিনয় জগতে প্রবেশ। প্রথম জীবনে তাঁকে বহুবার প্রতারিতও হতে হয়েছে। এই সময় তিনি জোর বরাত এবং বাসবদত্তা নামে দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ছবি দু’টির কিছু বিষয়বস্তু তাঁর কাছে আপত্তিকর ছিল।
১৯৩৫ সালে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ চলচ্চিত্রে নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ ছবিটি তাঁর সফল জীবনের চাবিকাঠি। পরবর্তীকালে অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, যার বেশিরভাগই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে। তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে ‘ঋষির প্রেম’, ‘কংশ বধ’, ‘মা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘পরাজয়’, ‘যোগাযোগ’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘মেজদিদি’ উল্লেখযোগ্য।
কানন দেবী একজন সুগায়িকা ছিলেন। ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা নেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম এবং পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কাছেও তিনি গানের তালিম নেন। আধুনিক গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতও তিনি গেয়েছিলেন যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও খুশি করেছিল।
নিজের অভিনয় জীবনে কানন দেবী অনেকগুলি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ‘পরিচয়’ এবং ‘শেষ উত্তর’ দু’টি চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে বি এফ জে পুরস্কার পান। ১৯৬৮ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ কানন দেবীর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেন।
আসামের রাজপরিবারের সন্তান প্রমথেশ বড়ুয়া বাংলা চলচ্চিত্র জগতে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কলকাতার হেয়ার স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। ইওরোপ ভ্রমণ করে এসে শান্তিনিকেতনে থাকার সময় ১৯২৯ সালে দেবকী কুমার বোস পরিচালিত ‘পঞ্চাশর’ নামে একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় পা রাখেন। ১৯৩২ সালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তখন টকি যুগ। ‘বেঙ্গল — ১৯৮৩’ নামে একটি টকি নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রকাশিত এটি একটি সাহসী প্রচেষ্টা। এই টকিটি চার দিনে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই প্রচেষ্টা প্রমথেশ বড়ুয়ার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় ছিল।
১৯৩৩ সালে বি এন সরকার নিউ থিয়েটারে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। এই ঘটনা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁকে কেরিয়ারের শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া অভিনীত ‘দেবদাস’ মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি কৌশল প্রবর্তনের জন্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। কৌশলটি ছিল “ইন্টারকাট টেলিপ্যাথি শট”। ‘মুক্তি’ ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার আরেকটি সাহসী ছবি। অসমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটভূমিতে এই ছবির শুটিং হয়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত এই চলচ্চিত্রে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘দেবদাস’। যা বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষাতেই নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া ‘মায়া’, ‘মঞ্জিল’, ‘মুক্তি’, ‘রজত জয়ন্তী’, ‘অধিকার’, ‘সুবহ শাম’, ‘রানী’, ‘জবাব’ ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি কিছু ছবি তিনি পরিচালনা করেছিলেন এবং কিছু ছবির চিত্রনাট্য তিনি নিজে রচনা করেছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রথম পর্যায়ে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে কানন দেবী ও প্রমথেশ বড়ুয়ার অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তীকালে আরো অনেক শিল্পী বাংলা চলচ্চিত্রকে স্বর্ণযুগের শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় পথ প্রশস্ত করেছিলেন এই দুই শিল্পী ও তাদের সহযোদ্ধারা।
পর্ব – ৬
বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলস্টোন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। মুখ্য চরিত্র অপুর শৈশবকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ বাংলার নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনযাপনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। স্বল্প নির্মাণ ব্যয়ে সরকারি সহায়তায় অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন আজকের কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়।
সুব্রত মিত্র এই ছবির চিত্র গ্রহণ করেন। দুলাল দত্ত ছিলেন সম্পাদনার কাজে। এই চলচ্চিত্রে স্বনামধন্য সেতার বাদক রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ ব্যবহার করেছেন। ১৯৫৫ সালের ৩ মে নিউ ইয়র্ক শহরে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টের একটি প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। ওই বছরেই কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটি মুক্তি লাভ করলে গুণীজনদের প্রশংসা লাভ করে। এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত বাস্তববাদ, মানবতা এবং মানব জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের চিত্রায়ন চলচ্চিত্রটিকে অন্য মাত্রা দান করে।
নিশ্চিন্তপুর নামে বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে হরিহর (কানু বন্দোপাধ্যায়) এবং তার স্ত্রী সর্বজয়া (করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়), তাদের দুই সন্তান অপু (সুবীর বন্দোপাধ্যায়) এবং দুর্গা (উমা দাশগুপ্ত) কে নিয়ে দৃশ্যায়িত হয়েছে একটি ছোট পরিবার। সেই সংসারে হরিহরের দূরসম্পর্কের বিধবা পিসি ইন্দির ঠাকরুণ (চূনীবালা দেবী)-র বসবাস। পেশায় পুরোহিত হরিহর ছিলেন শিক্ষিত মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, যাত্রাপালা লিখে সচ্ছল সংসার নির্বাহ করবেন। অভাবের সংসারে ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে সর্বজয়ার মনোমালিন্যের জেরে ইন্দির ঠাকরুণ মাঝেমাঝেই অন্যত্র চলে যান। আবার এই ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে দুর্গার ভারি সখ্যতা। গ্রামের বিভিন্ন বাগান থেকে ফলমূল পেড়ে এনে দুর্গা, ইন্দির ঠাকরুণ ও অপু ভাগাভাগি করে খায়। নিখুঁত সেইসব দৃশ্যায়ণ ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে।
আবার ভাইবোন অপু-দুর্গার মধ্যেও ভীষণ ভাব। শোলার মুকুট পরে আঁখ চিবতে চিবতে কাশফুলের বনের মধ্যে দিয়ে অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্যটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন বলা চলে। পরবর্তী সময়ে ভাল উপার্জনের আশায় হরিহর শহরে চলে যান। ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে তাদের একমাত্র কন্যা দুর্গার মৃত্যু ঘটে। ইন্দির ঠাকরুণও মারা যান। হরিহর ফিরে এলে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে একমাত্র পুত্র অপুকে নিয়ে সর্বজয়া ও হরিহর শহরের পথে পা বাড়ান।

‘পথের পাঁচালী’ একটি জীবনীমূলক ধ্রুপদী উপন্যাস। সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ নামক অংশে শিশু থেকে কিশোর অপুর গ্রামীণ জীবন, শৈশবের সারল্য, শৈশবেই স্বজন হারানোর অব্যক্ত ব্যথা এবং শৈশবে গ্রাম ছেড়ে আসার কাহিনীকে দৃশ্যায়িত করেছেন। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর। কলকাতার নিকটবর্তী বড়াল গ্রামটিকে নির্বাচন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রাতের দৃশ্যগুলি স্টুডিওতে গ্রহণ করা হয়েছিল।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল আনুমানিক সত্তর হাজার টাকা। এই টাকা সংগ্রহের জন্য সত্যজিৎ রায় গ্রাফিক্স হিসেবে নিজের কাজ যেমন চালিয়ে যান, পাশাপাশি নিজের জীবন বিমা পলিসি বন্ধক রাখেন, নিজস্ব গ্রামাফোনের সংগ্রহ বিক্রি করে দেন এবং নিজের স্ত্রী বিজয়া রায়ের গয়নাগুলিও বন্ধক রাখেন। এতকিছুর পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের বিভাগীয় প্রধান মনরো হুইলার ১৯৫৪ সালে কলকাতায় ছিলেন। তিনি এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে যখন শোনেন এবং কিছু কিছু দৃশ্যায়ণ যখন দেখেন, তখন অতি উচ্চ মানের কাজ বলে পরের বছরের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের প্রদর্শনীতে প্রথম বারের জন্য প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করেন।
সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে অপুর শৈশব ও কৈশোরকে চিত্রায়িত করেছেন। ‘অপরাজিত’ শিরোনামের চলচ্চিত্রে অপুর ছাত্র জীবন ও যুবক অপুকে চিত্রায়িত করেছেন। ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অপুর প্রেম ও সাংসারিক জীবনকে চিত্রায়িত করেছেন। এই চলচ্চিত্র দুটিকে নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় আলোচনা করা হবে।
পর্ব – ৭
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অপরাজিত’। ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর কাহিনীর সম্প্রসারিত অংশই ‘অপরাজিত’। বাংলার ১৩৩৬ সালের পৌষ থেকে আশ্বিন মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘পথের পাঁচালী’ যেখানে শেষ ‘অপরাজিত’ সেখান থেকেই শুরু। ছোট্টো অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা অপুর যৌবনের আশা আকাঙ্খার গল্প ‘অপরাজিত’। বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতির বর্ণনা একটু বেশিই থাকে। গ্রাম থেকে শহরে আসা অপুর জীবনের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের যেমন বদল ঘটে তেমনই কলেজ জীবন, বন্ধুত্ব, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে নতুন নতুন চমক আসে অপুর জীবনে।
‘অপরাজিত’ উপন্যাসকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। যদিও ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করার সময় ‘অপরাজিত’ নির্মাণ করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’-র বাণিজ্যিক সাফল্য এবং কিশোর অপুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চলচ্চিত্র প্রেমীদের কৌতূহল তাঁকে ‘অপরাজিত’ চলচ্চিত্র নির্মাণে প্ররোচনা দিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে ‘অপরাজিত’ মুক্তি পায়। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী সেনগুপ্ত, রমণীরঞ্জন সেনগুপ্ত, চরপ্রকাশ ঘোষ, স্মরণ ঘোষাল এবং সুবোধ গাঙ্গুলী। চলচ্চিত্রটিতে সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন সুব্রত মিত্র। সম্পাদনা করেছিলেন দুলাল দত্ত। সংগীত পরিবেশনায় ছিলেন রবিশঙ্কর।
অপুর শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ, গ্রাম থেকে শহুরে কায়দায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, নতুন বন্ধু পাওয়া, বিভিন্ন বই পড়ার দিকে ঝোঁক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়গুলি এই চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে। ছবিটি এগারোটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে। যার মধ্যে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বর্ণ সিংহ’ পুরস্কার অন্যতম।

অপু ত্রয়ীর শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’। তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক অপুর আকস্মিকভাবে সংসার জীবনে প্রবেশ প্রেম এবং বিরহ নিয়ে ‘অপুর সংসার’ দর্শকাসনে এক আলাদা শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে। এই চলচ্চিত্রে অপুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপুর স্ত্রী অপর্নার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর প্রথমবার অভিনয় করেন। এছাড়াও অলক চক্রবর্তী ও স্বপন মুখার্জী অভিনয় করেন। একশো সাত মিনিটের এই চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন রবিশঙ্কর এবং চিত্রগ্রাহক ছিলেন সুব্রত মিত্র। ১৯৫৯ সালের ১ মে চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভ করে এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। লণ্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৬০ সালে ‘সাদারল্যান্ড’ ট্রফি, এডিনবরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিপ্লোমা অফ মেরিট’ পুরস্কার লাভ করে। ব্রিটিশ আকাদেমি চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার পায়।
অপু আই এ পাশ করে চাকরির সন্ধানে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে থেকে টিউশন করে নিজের খরচ চালাতে শুরু করে। বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়া চাইতে এলে পাকা শহুরে লোকের মত ঝগড়া করে অপু। বাড়িওয়ালা ভাড়া না পেয়ে অপুকে তুলে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলে অপু সেটা ও সঙ্গে বাইরের আলো সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দেয় এবং দাঁড়ি কামানোয় মন দেয়। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় নিশ্চিন্তপুরের সরল গ্রাম্য বালক এখন পুরোপুরি কলকাতার নাগরিক।
কয়েকবছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর। পুলু অপুকে ভাল রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় এবং একটি চাকরিতে যোগদানের কথা বলে। অপু জানায় সে চাকরি করবে না। আত্মজীবনীমূলক একটা উপন্যাস তখন লিখছে অপু। পুলু বলে, অপু কিছুতেই একটা সফল উপন্যাস লিখে উঠতে পারবে না। কারণ সেই উপন্যাসে যেহেতু প্রেমের বিষয়বস্তু রয়েছে তা কল্পনা করে অপুর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। যেহেতু অপুর প্রেমের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। যদিও একটি দৃশ্যে দেখা যায় এক প্রতিবেশিনী অপুর বাঁশি শোনার জন্য জানলার ধারে এসে দাঁড়ালে অপু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ে।
পুলু অপুকে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে। ঘটনাচক্রে পুলুর মাসতুতো বোন অপর্নাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু। বিয়ের আগে অপু পুলুকে যে চাকরিটা নেবে না বলেছিল, সেই চাকরিটা পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়েতে রাজি হয় অপু। অপর্না শহুরে দরিদ্র জীবনে স্বামীর সাথে ভাড়া বাড়িতে মানিয়ে নেয়। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে মশকরা করে কাগজের ঠোঙা ফাটায়। সিগারেটের প্যাকেটে একটি মাত্র সিগারেট খাওয়ার অনুরোধ লিখে রাখে। বাড়তি টিউশন ছেড়ে দিয়ে অফিসের পরে বাড়িতে ফিরে এসে তার সাথে সময় কাটানোর কথা বলে অপর্না। আবার অপর্না খেতে বসলে অপু পাশে বসে তাকে বাতাস করে। এইভাবে তাদের দাম্পত্য প্রেম মধুর হয়ে ওঠে।
পরবর্তী পর্যায়ে তাদের সন্তান কাজলের জন্ম দিতে গিয়ে অপর্নার মৃত্যু হয়। এই আঘাত অপুকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলেও অপু তা পারে না। কিন্তু সন্তান কাজলকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কারণ অপুর মনে হয়, কাজল রয়েছে বলেই অপর্না পৃথিবীতে নেই।
সত্যজিৎ রায় বেশ কয়েকটি কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যেগুলি তাঁকে চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘অস্কার’ এনে দিয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ ব্যক্তি মানুষের ধারাবাহিক জীবনের যে মূল্যমান চিত্রায়িত করেছে, তা দর্শকের মনে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পর্ব – ৮
বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বাস্তববাদী ত্রয়ী যদি ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ হয়, তবে বাংলা ভাষার প্রথম সুপার হিরো সৃষ্টির গৌরবও তাঁর। শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রূপকথার গল্প অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। সত্যজিৎ রায় নিজেই এই ছবির চিত্রনাট্য রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেছেন।
দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংগীতশিল্পী গুপী এবং বাঘার যাত্রা অনুসরণ করে এই চিত্রনাট্যের শুরু। যাদের ভূতের রাজা তিনটি যাদুকরী বর প্রদান করে। গুপী তার গানের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা অর্জন করে অন্যদিকে বাঘা তার বাজনার মাধ্যমে মানুষকে গতিহীন করে দিতে পারে।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমায় তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, জহর রায় ও শান্তি চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন। চিত্রগ্রাহক ছিলেন সৌমেন্দু রায়। সম্পাদক ছিলেন দুলাল দত্ত।

গল্পের দুই নায়ক গুপী এবং বাঘা সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হলেও সাঙ্গীতিক প্রতিভা তাদের মধ্যে ছিল না। এই কারণে গুপীর গ্রাম আমলকি ও বাঘার গ্রাম হরিতকী থেকে তারা বিতাড়িত হয়। পথে বনের মধ্যে দুই সরল একনিষ্ঠ মানুষের সাক্ষাত হয়। সেখানে ভূতের রাজার বরে তারা সুপার হিরো হয়ে ওঠে। প্রথম বরে তারা যখন ইচ্ছে তখনই মনের মত খাবার পেতে পারে এবং দ্বিতীয় বরে দু’জোড়া বিশেষ জুতো ও দু’জনের হাতে হাতে তালি দিয়ে দেশবিদেশ ঘোরার ক্ষমতা পায় এবং তৃতীয় বরে সংগীত এবং বাদনের মাধ্যমে মানুষকে গানবাজনা শুনিয়ে অবশ করে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে।
এরপর শুন্ডীর রাজাকে গান শুনিয়ে তাঁর সভা গায়ক হয়ে তারা সেখানে থেকে যায়। শুন্ডীর প্রতিবেশী রাজা হাল্লা শুন্ডীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে গুপী এবং বাঘা হাল্লায় গুপ্তচরের বেশে যায় এবং সেখানে ভূতের রাজার বরে পাওয়া সংগীত প্রতিভা দিয়ে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। এরপর শুন্ডীর রাজকন্যা মণিমালার সাথে গুপীর এবং হাল্লার রাজকন্যা মুক্তামালার সাথে বাঘার বিয়ে হয়ে যায়।
মূলত ছোটদের জন্য নির্মিত হলেও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সব বয়সের দর্শকদের কাছে সমান উপভোগ্য। ছবির মূল আকর্ষণ সত্যজিৎ রায় রচিত গানগুলি। সাড়ে ছ’মিনিটের ভূতের নৃত্যের একটি দৃশ্য ভারতীয় ঘরানায় নির্মিত একটি স্পেশাল এফেক্ট। ভূতের রাজার দেওয়া বর সত্যজিৎ রায় নিজের গলায় উপস্থাপন করেছেন। এই ছবির গানগুলি গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল, রবি ঘোষ এবং কানু মুখার্জী।
এই ছবিটি অনেকগুলি পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক ১৯৭০। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে ১৯৬৯ সালে অকল্যান্ড থেকে পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৭০ সালে টোকিও থেকে ‘মেধা’ পুরস্কার এবং মেলবোর্ন থেকে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করে। আকাদেমি ফিল্ম আর্কাইভ ২০০৩ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটি সংরক্ষণ করে।
পর্ব – ৯
ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর অপু ত্রয়ী এবং ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নিয়ে বিগত সংখ্যাগুলিতে আলোচনা হয়েছে। তাঁর আরো কয়েকটি কালজয়ী ছবির নাম ‘হীরক রাজার দেশে’, যা মূলত গুপী বাঘার ধারাবাহিক কার্যক্রম। এছাড়া ‘সদগতি’, ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘আগন্তুক’ ভিন্ন মাত্রার ছবি।
গুপী বাঘা জুটি রাজ জামাতা হওয়ার পরে হীরক রাজ্য থেকে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য রাজদরবারে আমন্ত্রিত হয়। এদিকে শুন্ডী ও হাল্লার দুই রাজ জামাতা গুপী এবং বাঘা মনে মনে হীরক রাজ্যের হীরার খনি দেখার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গানের সভায় আমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগ এসে যায়। হীরক রাজ্য হীরক রাজার মনের মত করে চালিত হয়। হীরা কোষাগারে জমা হয়। আর প্রজারা যথেষ্ট পরিমাণে পারিশ্রমিক পায় না। তারা ক্ষুধার্ত হয়ে কষ্ট পায়। প্রতিবাদী মানুষকে ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে পুরে রাজ বিজ্ঞানীকে দিয়ে মগজ ধোলাই করানো হয়। যার ফলে প্রতিবাদী প্রজারা রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। একজন মাত্র শিক্ষক উদয়ন পন্ডিতকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না হীরক রাজা। সে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাজাকে জব্দ করার ব্যবস্থা করতে থাকে।

এই সময়ে উদয়ন পন্ডিতের সঙ্গে দেখা হয় গুপী এবং বাঘার। উদয়ন পন্ডিত ও তার ছাত্ররা এবং গুপী বাঘা মিলে শোষক রাজার কবল থেকে দেশকে রক্ষা করার ব্রত নেয়। গুপী বাঘা তাদের জাদুকরী সংগীতের মাধ্যমে শুধু মানুষ নয়, এমনকি একটি বাঘকেও গানের ছন্দে জব্দ করে হীরক রাজার কোষাগার লুঠ করে। লুঠ করা হীরা হীরার খনির শ্রমিক ও রক্ষীদের মধ্যে বন্টন করে তাদের রাজার বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচিত করে। উদয়ন পন্ডিত এবং তার ছাত্রদের রাজা যখন যন্তরমন্তর ঘরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে তখন রাজ বিরোধী মন্ত্র যন্তরমন্তর মেশিনে দিয়ে হীরক রাজারই মগজ ধোলাই করা হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রাজার মূর্তি উদ্বোধনের দিনে অন্যান্য প্রজাদের সঙ্গে রাজাও স্লোগান দিতে থাকে, “দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোষাগার লুঠ করার সময় যে বাঘটি কোষাগার পাহারা দিচ্ছিল, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই বাঘটি আসল ছিল।
গুপী বাঘার চরিত্রে তপেন চ্যাটার্জী ও রবি ঘোষ, হীরক রাজার চরিত্রে উৎপল দত্ত, বিজ্ঞানীর চরিত্রে সন্তোষ দত্ত ও উদয়ন পন্ডিতের চরিত্রে সৌমিত্র চ্যাটার্জী অভিনয় করেন। সমগ্র সিনেমাটি পরিচালনা করেন সত্যজিৎ রায়। এই চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটি গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
১৯৮০ সালে এই চলচ্চিত্রে সেরা প্লেব্যাক গায়কের জন্য অনুপ ঘোষাল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সেরা সংগীত পরিচালনা এবং শ্রেষ্ঠ বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সত্যজিৎ রায়।
এই চলচ্চিত্রে মোট বারোটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। শিল্পী অমর পালের গাওয়া “কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” ছাড়া বাদবাকি সমস্ত গান অনুপ ঘোষালের গাওয়া। তাঁর গাওয়া গানগুলি হল, “মোরা দু’জনায় রাজার জামাই”, “আর বিলম্ব নয়”, “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”, “আহা সাগরে দেখো ছায়ে”, “এ যে দৃষ্টি দেখি অন্য”, “এবারে দেখো গর্বিত বীর”, “এসে হীরক দেশে”, “ধরো নাকো সান্ত্রী মশাই”, “পায়ে পড়ি বাঘ মামা”, “নহি যন্ত্র” এবং “মোরা গুপী বাঘা দু’জন ভায়েরা ভাই”। এই গানগুলি বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)