সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ১০
বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায় একজন আইকন। তাঁর সৃষ্টি কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা। যার পুরো নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট। তিনি পেশায় একজন বেসরকারি তদন্তকারী। তাঁর বাড়ি ২১, রজনী সেন রোড, কলকাতা – ২৯। ভাইপো তপেশ রঞ্জন মিত্র বা তোপসেকে নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন তদন্ত মূলক অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। এইসব অভিজানে তাঁর সঙ্গী হন বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী। যিনি জটায়ু ছদ্মনামে বিভিন্ন রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লিখে থাকেন।
১৯৬৫ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই সিরিজের মোট পয়ত্রিশটি সম্পূর্ণ গল্প এবং চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস রচিত হয়েছিল।
সত্যজিৎ রায় ফেলুদা চরিত্র নিয়ে দুটি ছবির পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। ১৯৭৮ সালে সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় একটি নতুন ফেলুদা চলচ্চিত্র সিরিজ তৈরি করেছিলেন। সন্দীপ রায় নির্মিত স্বতন্ত্র ফেলুদা চলচ্চিত্র ‘বাদশাহী আংটি’ ও ‘বোম্বাইয়ের বম্বেটে’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেন সৌমিত্র চ্যাটার্জী, জটায়ুর চরিত্রে সন্তোষ দত্ত, তোপসের চরিত্রে সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জী এবং একটি বিশেষ ও মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কুশল চক্রবর্তী। এই ছবির বাজেট ছিল বারো লক্ষ টাকা এবং বক্স অফিস বাজার করেছিল পচাত্তর লক্ষ টাকা।

ছবিটি শুরু হয় এক স্কুল ছাত্র মুকুল ধর (কুশল চক্রবর্তী) সর্বদা বিষন্ন থাকে এবং মধ্য রাতে ময়ূর, দূর্গ, উট — এইসবের ছবি আঁকে। কখনো কখনো বলে সে সোনার দূর্গে বসবাস করত এবং তাদের বাড়িতে অনেক রত্ন ছিল। প্যারা সাইকোলজিস্ট ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা (শৈলেন মুখার্জী) মুকুলের বাবা-মাকে সাহায্যের প্রস্তাব দেন। মুকুলের এই আচরণ তাঁর গবেষণায় সাহায্য করতে পারে বলে বিশ্বাস করেন। ড. হাজরা মুকুলকে নিয়ে রাজস্থানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। মুকুলের মনস্তত্ত্ব ও তাকে সুস্থ করার ব্যাপারে সাহায্য হবে ভেবেই ড. হাজরা এই পরিকল্পনা করেন।
এদিকে মন্দার বোস (কামু মুখার্জী) ও অমিয় নাথ বর্মন (অজয় ব্যানার্জী) এই চলচ্চিত্রের দুই খল চরিত্র এই ঘটনার কথা জানতে পারে এবং তারা ধারণা করেছিল যে রত্নের কথা মুকুল বলত, তা ওই কেল্লার মধ্যে গুপ্তধন হিসেবে রয়েছে। এই উদ্দেশ্যে তারা মুকুলকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। আবার মুকুলের বাবা এই দুষ্ট চক্রের কথা জানতে পেরে মুকুলের রক্ষার জন্য ফেলুদাকে নিয়োগ করে। কুচক্রী বর্মন এবং বোস ড. হাজরার সাথে বন্ধুত্ব করে এবং তাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে মুকুলকে অপহরণ করে। ফেলুদার সাথে নকল হাজরার দেখা হয় এবং সে সহজেই ফেলুদার সন্দেহের তালিকায় চলে আসে।
মন্দার বোস মুকুলকে সম্মোহিত করে জেনে যায় যে কেল্লাটি জয়সলমিরে। পরেরদিন ফেলুদারাও জয়সলমিরে পৌঁছে যায়। কেল্লার কাছাকাছি ময়ূর দেখে মুকুল উৎসাহিত হয়। এদিকে বর্মন ময়ূরের প্রতি ভয়ের কারণে ময়ূরটিকে গুলি করতে যায়। এই ঘটনা মুকুলের শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। সে বর্মন এবং তার সঙ্গীকে ‘দুষ্টু লোক’ বলে সম্বোধন করে এবং বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে ছুটে পালায়। ফেলুদা সমস্ত ঘটনার জন্য তৈরি ছিল। সে মুকুলকে ধরে ফেলে এবং নকল হাজরা পালাতে গেলে ফেলুদার ড্রাইভার তাকে পাকড়াও করে।
ইতিমধ্যে মুকুলকে সোনার কেল্লার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে মুকুল জানায় যে সে বাড়ি যেতে চায়। এরপর ফেলুদা নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরে বুঝে যায় এবং জানিয়ে দেয় সোনার কেল্লা বলে কিছু নেই। সেখানে কোনো রত্নও নেই এবং কোনোদিন ছিলও না।
‘সোনার কেল্লা’ সিনেমাটি বেশ কয়েকটি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। সেরা পরিচালক হন সত্যজিৎ রায়। ভারত সরকারের তরফ থেকে ১৯৭৫ সালে ‘বেস্ট স্ক্রিন প্লে’ পুরস্কার অর্জন করে ‘সোনার কেল্লা’। রাষ্ট্রপতির রৌপ্য পদক লাভ করে এই চলচ্চিত্রটি। একই সালে বেস্ট স্ক্রিন প্লে ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের পুরস্কারও ভারত সরকার সত্যজিৎ রায়ের হাতে তুলে দেন। “বেস্ট লাইভ ফিচার ফিল্ম” হিসেবে গোল্ডেন স্ট্যাচু দেওয়া হয় দশম তেহরান ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অফ ফিল্মস ফর চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্টস-এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)