সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ৪
চলচ্চিত্র শিল্পের ধ্রুপদী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে আমরা গত সংখ্যাগুলিতে আলোচনা করেছি। চলচ্চিত্রের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। সমসাময়িক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে অবিভক্ত বঙ্গ (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বোঝায়। পৃথিবীর অনেক দেশের মত ১৮৯০ এর দশকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। এই সুত্র ধরে ১৯০০ শতকে নির্বাক চলচ্চিত্র শুরু হয়। ১৯১০ সালে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর পরবর্তী সময়ে সবাক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র সৃষ্টি হতে প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় লেগেছিল এবং বাংলাদেশে একটি অর্থকরী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই চলচ্চিত্র শিল্প।
বাংলাদেশে প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদ্যোগে। ১৮৯৮ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার এস ডি ও-র বাংলোতে। পরবর্তী প্রদর্শনী হয় ঢাকার পাটুয়াটুলির ক্রাউন থিয়েটারে। এইগুলি বায়োস্কোপের বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল। গবেষক অনুপম হায়াতের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, এইসব চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল মহারানি ভিক্টোরিয়ার জুবিলী মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের তুষারপাতের ক্রীড়া, সিংহ ও মাহুতের খেলা ইত্যাদি। তখন বায়োস্কোপ দেখানোর জন্য সাধারণ দর্শকের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা ছিল।

কলকাতায় যে বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠিত হয় তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকার মানিকগঞ্জ মহকুমার বগজুরি গ্রামের হীরালাল সেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বায়োস্কোপ কোম্পানির নাম ‘দ্য রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’। এইসময় কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে যে সমস্ত নাটক প্রদর্শিত হয় সেইগুলির কিছু অংশ ক্যামেরায় ধারণ করে বায়োস্কোপ আকারে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এইসব জনপ্রিয় থিয়েটার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘আলীবাবা’, ‘দোল লীলা’, ‘সীতারাম’, ‘ভ্রমর’। বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে হীরালাল সেন এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিজ্ঞাপন চিত্র ও সংবাদ চিত্র নির্মাণের পথিকৃতও ছিলেন তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে নির্মিত ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ ছিল বাংলা ভাষার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র। ১৯১৬ সালে কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটারের পক্ষ থেকে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত বাংলা নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ মুক্তি পায়। ১৯২১ সালে কলকাতায় ‘বিলাত ফেরত’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার প্রযোজক ও অভিনেতা ছিলেন বড়িশালের ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯২৭-২৮ সালে নবাব পরিবারের কয়েকজন সংস্কৃতি মনস্ক তরুণ ‘সুকুমারী’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তখনো পর্যন্ত নাট্য মঞ্চেও নারী চরিত্রের অভিনয় পুরুষেরাই করতেন। চলচ্চিত্রও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই নবাব পরিবারের উদ্যোগেই ঢাকায় ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত এই কোম্পানির প্রযোজনায় নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বৈপ্লবিক বিষয়টি হল, নারী চরিত্রে নারীরাই অংশগ্রহণ করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন ললিটা বা বুড়ি নামে এক বাঈজী। চারুবালা ও দেবী নামে আরও দুই বাঈজী এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হরিমতী নামে এক অভিনেত্রীরও আবির্ভাব ঘটে এই চলচ্চিত্রে। ১৯৩১ সালে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে। ১৯৪৬ সালে ওবায়েদ উল হক হিমাদ্রি চৌধুরী ছদ্মনামে ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। কলকাতায় এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনো মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র।
উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মহম্মদ নির্মাণ করেন ‘মানুষের ভগবান’ নামে চলচ্চিত্রটি ১৯৪৭ সালে। দেশ ভাগের পরে এই চলচ্চিত্র পরিচালকেরা ঢাকায় ফিরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ প্রদান করেন। ১৯৪৮ সালে নাজির আহমেদ ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরের বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে নাজির আহমেদের পরিচালনায় নির্মাণ করা হয় প্রামাণ্য চিত্র ‘সালামত’। তিনি একাধারে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতার কর্মী ও লেখক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁরই উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি ও স্টুডিও চালু হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক। তাঁর কাহিনী থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আসিয়া’ এবং ‘নবারুণ’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। ‘নতুন দিগন্ত’ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন তিনি।
তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ২০০২ সালে কান ফেস্টিভ্যালে ডিরেক্টরস ফোর্ট নাইট ক্যাটাগরিতে মনোনীত ও প্রদর্শিত হয়। ২০০৩ সালে এই ছবিটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য পেশ করা হয়। এটি প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র, যা অস্কারে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য পেশ করা হয়। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনটি সিনেমা অস্কারের জন্য পেশ করা হয়। হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, আবু সাঈদের ‘নিরন্তর’ এবং গোলাম রাব্বানীর ‘বিপ্লবের স্বপ্ন ডানায়’। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত বাংলাদেশী ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’, অমিত আশরাফের ‘উধাও’ রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেহেরজান’।
বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রযুক্তিগতভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গন আরও কিছু সমৃদ্ধ ভাণ্ডার বাংলাদেশ থেকে পাবে বলে আশা করা যায়।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)