সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ১১
সত্যজিৎ রায় সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। তাঁর স্বরচিত ছোট গল্প ‘অতিথি’ অবলম্বনে ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি একটি বাংলা ভাষার নাট্য চলচ্চিত্র। ১৯৯১ সালে সত্যজিৎ রায়ের শেষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রটি একটি ইন্দো-ফরাসি প্রযোজনা। আন্তর্জাতিক নামী প্রোডাকশন কোম্পানিগুলি থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল এই চলচ্চিত্রটি।
মুখ্য অভিনেতা ছিলেন উৎপল দত্ত। এছাড়া মমতাশঙ্কর, দীপঙ্কর দে, ধৃতিমান চ্যাটার্জী, রবি ঘোষ, প্রমোদ গাঙ্গুলী বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন বরুণ রাহা।
অনিলা বোসের চরিত্রে মমতাশঙ্কর, সুধীন্দ্র বোসের চরিত্রে দীপঙ্কর দে এবং তাদের একমাত্র ছেলে সাত্যকিকে নিয়ে ছিমছাম সংস্কৃতি মনস্ক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই বাড়িতে একটি চিঠি আসে যে প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে বিদেশে ভ্রমণরত অনিলা দেবীর একমাত্র মামা দেশে ফিরে তার সঙ্গে দেখা করতে চান। অনিলা দেবীর এই মামা দেশের কোনো পরীক্ষাতেই কোনোদিন দ্বিতীয় হননি। খুব অল্প বয়সেই বিদেশ ভ্রমণের নেশায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। অনিলা দেবী এহেন ব্যক্তির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু তার স্বামী সুধীন্দ্র এই ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান থাকেন।

মামা মনমোহন মিত্রের পাসপোর্ট যাচাই করতে কৌশলে উদ্যোগী হন সুধীন্দ্র। ছোট্ট সাত্যকি কিন্তু তার নতুন দাদুর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ক্রমে অনিলা দেবীও তার দাদুর উইলের কথা মনে করে ভাবে যে লোকটি হয়তো তার উত্তরাধিকারের অংশ দাবি করতেই এসেছে। কিন্তু লোকটির প্রকৃত পরিচয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
সুধীন্দ্র কৌশলে তার এক আইনজীবী বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানায়। নানাভাবে সেই আইনজীবী বন্ধু মনমোহন বাবুকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করতে থাকেন। স্কলার মনমোহন মিত্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গভীর জ্ঞান ও অতি সক্রিয় অভিজ্ঞতা এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি নিবিড় দৃষ্টিভঙ্গি অনিলা দেবী এবং সুধীন্দ্রকে মুগ্ধ করে। আইনজীবী বন্ধু এত বড় ব্যক্তিত্বের সামনাসামনি হয়তো কখনো হননি। মনমোহন বাবুর জ্ঞানবোধ, বিচক্ষণতা, আবেগ শহুরে সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আইনজীবীর কাছে বাতুলতা বলে মনে হয় এবং তিনি অতিথিকে বলে দেন, “হয় পরিষ্কার হয়ে আসুন অথবা কেবল পরিষ্কার হয়ে যান” বলে নির্দেশ দেন।
পরেরদিন সকালবেলা মনমোহন বাবুকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না বাড়িতে। বোস পরিবার উতলা হয়ে ওঠে নিজেদের পর্যবেক্ষণে চিনতে না পারা মামাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। ব্যক্তিত্বের তল আবিষ্কার করে তারা অনুমান করে কাছের আদিবাসী গ্রামই মামার বর্তমান ঠিকানা। তারা পৌঁছে যায় সেই ঠিকানায়। আদিবাসী রমণীদের সঙ্গে অনিলা দেবী নৃত্যে মেতে উঠলে মামা বলেন, “বুঝলাম, তুমিই আমার আসল ভাগনি।” বোস দম্পতি তার কাছে ক্ষমা চান এবং কলকাতায় আসতে রাজি করান।
পরেরদিন মামা মনমোহন মিত্র আবার বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন বোস দম্পতির হাতে একটি মুখবন্ধ খাম দিয়ে। তিনি রওনা হওয়ার পরে বোস দম্পতি জানতে পারে মামা মনমোহন মিত্র তার সমস্ত উত্তরাধিকারের অংশ একমাত্র ভাগনিকেই দান করে গেছেন।
১৯৯২ সালে ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘আগন্তুক’ সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং সেরা পরিচালনার জন্য পুরস্কার জিতেছিল। অনিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মমতাশঙ্কর পেয়েছিলেন বিশেষ জুড়ি পুরস্কার। ঋত্বিক ঘটক পুরস্কারে এটি সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়কে সেরা দৃশ্যকল্প লেখক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)