আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

আজিজুলের বাড়ি থেকে কুলি প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। কুলি মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার একটা জায়গার নাম। জায়গাটা বেশ নামকরা। ভারতবর্ষের যেকোনও জায়গায় এখান থেকে যাওয়া যায়। গাড়ি সবসময়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভালো! শুধু তাই নয়, জায়গাটা ব্যবসার জায়গা হিসেবেও সুপরিচিত। বিভিন্ন জায়গার মানুষ এখানে ঘরভাড়া করে থাকে। শুধু থাকে না; ব্যবসা করে। বাগড়ির কত হকার যে এখানে হকারি করে তার ইয়ত্তা নেই। আজিজুলও এখানে শপ, মশারি ও বিছানার চাদরের হকারি করে। সাইকেলে করে মাল বেচে। বাড়ি তার রানিনগর থানার ডিগ্রি নামের একটা ছোট গ্রামে। গ্রামটা বাংলাদেশ বর্ডারের ধারে; গ্রামটা থেকে তাকালে বাংলাদেশের উঁচু ঘরবাড়ি ও গাছপালা দেখতে পাওয়া যায়।
   আজিজুল কুলি থেকে মাসান্তে বাড়ি আসে। এসে পাঁচদিন-দশদিন থেকে আবার কুলি চলে আসে। কুলিতে তার কান্দি রোডের ধারে ঘর ভাড়া নেওয়া আছে। এখানে মোট চারটে রোড আছে। একটা কান্দি রোড, একটা সাঁইথিয়া রোড, একটা ডাকবাংলা রোড ও একটা নগর রোড। কুলির আশপাশের গ্রাম গুলোতে আজিজুল মাল বেচে। আশপাশে অনেক গ্রাম। সব গ্রামের নাম জানা নেই। তবে যে গ্রামটাতে আজ আজিজুল মাল বেচতে গিয়েছে সেই গ্রামটার নাম কুমরাই। গ্রামটা কান্দি রোডের ধারে। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আজিজুল গ্রামটাতে মাল বেচতে বেচতে একটা ফোন এলে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল— হ্যালো!
   — আজিজুল?
   — হ্যাঁ। মা?
   — হ্যাঁ।
   — ক্যার ফোন থেক্যা ফোন করছো?
   — রহেদুলের।
   — রহেদুল ওড়িশ্যা থেক্যা কবে বাড়ি আসলো?
   — কাল আস্যাচে।
   — কিন্তুক রহেদুলের নাম্বার যে আলাদা লাগছে। রহেদুলের নাম্বার আমার মুখুস্তু আছে। লাস্টে বত্রিশ আছে। কিন্তুক এই নাম্বারডার লাস্টে আছে ষাট।
   — লতুন নাম্বার কিন্যাছে হয়তো।
   — কী জানি? হতে পারে।
   রহেদুল আজিজুলের প্রতিবেশী এবং সমবয়সী। একসাথে তারা বড় হয়েছে এবং একসাথে তাদের মুসলমানি হয়েছে। মুসলমানি, শরিয়া অনুসারে মুসলমান ছেলেদের লিঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলে দেওয়া। মুসলমানির দিন রহেদুল খুব ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নদীর ধারে ঝুপড়ির ভেতর লুকিয়ে ছিল। তার বাপ বাকবুল সেখ সেখান থেকে তাকে ধরে এনে—আজিজুলের সাথে রহেদুল আগে কুলিতে থাকত। কিন্তু বছর খানেক থেকে আর থাকে না। ওড়িশায় থাকে। কুলির মতো ওখানে শপ, মশারি এবং বিছানার চাদর বেচে। ওড়িশা যাওয়ার আগের দিন রহেদুল আজিজুলকে বলেছিল— চল আজিজুল, ওড়িশ্যা যাই! ওড়িশ্যায় ভালো ব্যবসা হোচে।
   — তোখে কে বুলল? তুই কি গেলছিলি?
   — যাবো ক্যানে?
   — তাহালে তুই জানলি কী করে?
   — ওখ্যানে আমার মামা আছে। মামা রোজ ফোন করে আমাকে ডাকছে।
   — তাই?
   — হ্যাঁ।
   তারপরও আজিজুল বলেছিল— আমার যাওয়া হবে না রে! তুই যা।
   — ক্যানে তোর যাওয়া হবে না?
   — বাড়িতে আব্বা অসুখ না! অসুখ মানুষ বাড়িতে থুয়ে অত দূরে যাওয়া হয়? আবা হতোক, বাড়িতে দেখাশোনা করার যতি লোক থাকতোক। আমি ছাড়া কেহু নাই না! তাই আমার যাওয়া হবে না। কুলিতে আছি, কুলিতেই থাকি। কাছে। আপদে বিপদে যখুন তখুন বাড়ি চলে আসতে পারবো। 
   — তুই গ্যালে ভালো হতোক। দুজনা এ্যাকসাতে থাকতুক, এ্যাকসাতে খাতুক, এ্যাকসাতে ঘুমাতুক, এ্যাকসাতে গাঁ ঘুরতুক; খুব ভালো লাগতোক।
   — কিন্তুক বাড়িতে অসুখ মানুষ থুয়ে কী করে যাই, তুই বুল! তাত্থেক্যা তুই-ই যা; ঘুরে আয়!
   — ঠিকাছে; ভালো থাকিস।
   আজিজুল তার মাকে বলল— ফোনডা রহেদুলকে এ্যাকচিন দ্যাও, মা! তার সাতে দুট্যা কথা বুলে তুমার সাতে কথা বুলছি।
   আজিজুলের মা বলল— রহেদুল কাছে নাই। তুমার নাম্বারে ফোন লাগাতে বুললে ফোন লাগিয়্যা দিইয়্যা কুন্ঠে চলে গ্যালো! দেকতে পাছি ন্যা। আসুক তো ফোন লাগাতে বুলছি।
   — ঠিকাছে; কী হলো, বুলো!
   — তুমি কবে বাড়ি আসব্যা?
   আজিজুল বলল— এই তো বাড়ি থেক্যা আসা ক্যাবল পাঁচদিন হলো। আরও কিছুদিন থাকি! ক্যানে, বাড়িতে কুনু দরকার হলো?
   — হলোই তো।
   — কী দরকার হলো?
   আজিজুলের মা বলল— ওষুদ খাইয়্যা তুমার বাপ ভালো নাই। এ্যাকচিনও কমেনি। গ্যালো রাতে তো ঘুমাতেই পারেনি। সারারাত বসে কাটালছে।
   — এ্যাখুন ক্যামুন আছে?
   — কই ভালো আছে? যন্ত্রণায় সারাক্ষুণ আহাডাহা করছে। আর দোমে কুলাতে পারছে না। এ্যাতো যে গ্যাস টানছে তা-ও কীসে কী!
   — সে কী! রানিনগর হাসপাতালের সবচে বড়ো ডাক্তার দ্যাখানু; তা-ও!
   — বড়ো ডাক্তার হলেও উ ডাক্তার ভালো না। উ ডাক্তারের ওষুদে কুনু কাজই করে না। উ ডাক্তার পাল্টাতে হবে। পাল্টে অন্য ডাক্তার দ্যাখাতে হবে। তুমি বাড়ি আস্যা অন্য ডাক্তার দ্যাখাও! নাহালে তুমার বাপের যা শরীলের হাল; বাঁচবে না।
   বাপের সংবাদ শুনে আজিজুলের মনটা খুবই খারাপ হলো। কুলি আসার দিন সে ডাক্তার দেখিয়ে বারোশো টাকার ওষুধ কিনে দিয়ে এসেছে। আর এখন? আজিজুল বলল— অন্য ডাক্তার আর কাখে দ্যাখাবো? ডাক্তার দ্যাখান্যা কুনুদিন কামহাই নাই। এলাখার কুনু ডাক্তার দ্যাখাতে বাদ থুই নি। ডাক্তার দ্যাখাতে দ্যাখাতেই তো ফেঁস্যা হইয়্যা গেনু। যাহোক, তুমি এ্যাখুন ফোন রাখো; কী করা যায়, আমি ভেব্যা দেকছি!
   ফোনটা রেখে দিয়ে আজিজুলের মনটা আরও খারাপ হলো। গ্রাম ঘুরতে তার ভালো লাগল না। গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে রোডের ধারে একটা গাছতলায় দাঁড়াল। খানিকক্ষণ পর কুদ্দুস নামের একটা পরিচিত হকারের সঙ্গে তার দেখা হলো। আজিজুল তাকে ডাকল— এই কুদ্দুস, শুনে যাও!
   কুদ্দুসের বাড়িও আজিজুলদের ওই কড়ে। নটিয়ালে। কাছে এসে সে জিজ্ঞেস করল— কী, বুলো!
   — কুন কড়ে গেলছিল্যা?
   — মহিশারের কড়ে।
   — মাল ক্যামুন বিক্রি হলো?
   — হলো কিছু।
   — এ্যাখুন কুন কড়ে ঢুকব্যা ভাবচো?
   — দেখি, বদুয়ার কড়ে ঢুকতে পারি। তুমি এখ্যানে কী করছো?
   — দাঁড়িয়্যা আছি।
   — শুদু শুদু?
   — হ্যাঁ।
   — খ্যাতালে যাও নি!
   — গেলছিনু। কিন্তুক খ্যাতাল করতে ভালো লাগল না বুলে চলে আসনু। এ্যাখুন ঘরে যাবো।
   — ভালো লাগল না ক্যানে, শরীল খারাপ?
   — না; মুন খারাপ।
   — মুন খারাপ ক্যানে?
   — আর বুলো না। বাপকে লিইয়্যা পড়েছি ভীষণ বিপদে। কুনু ডাক্তারের কুনু ওষুদে কাজ করছে না। কুলি আসার দিনই ডাক্তার দেখিয়্যা বারোশো টাকার ওষুদ কিনে দিইয়্যা আসনু। তারপরও মা ফোন করে বুলল…তাই মুন খুব খারাপ! এ্যাতো পয়সা খরচ করেও ভালো থাকচে না। এব্যার কুন ডাক্তার দ্যাখাবো, কী করবো, গাছতলায় দাঁড়িয়্যা সেসবই ভাবচি।
   কুদ্দুস জিজ্ঞেস করল— তুমার বাপের কী অসুক?
   — বুকে ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট।
   — কতোদিন থেক্যা?
   — তা পরায় বছর খানেক হইয়্যা গ্যালো।
   — কুন ডাক্তার দ্যাখালচো?
   — কুন ডাক্তারের নাম করবো?
   — সারচে না?
   — কই সারচে?
   — তাহালে আমি যে ডাক্তারের কাছে বুলছি, সেই ডাক্তারের কাছে লিইয়্যা যাও! সের‍্যা যাবে। আমার বাপেরও অই অসুক হইয়্যাছিল। বুকের ব্যথায় কুনু রাতে ভালো ঘুমাতে পারতোক না। আর এ্যাকচিন জোরে কথা বুললেই ধুঁকাতোক। দোম পাতোক না। তুমার মুতন আমার বাপকে লিইয়্যা আমিও এ্যাক বছর খুব গল্ল্যি ঘাঁট্যাচি এবং ইদিক উদিক ম্যালা টাকা ভাঙ্যাচি। কুথুতে ভালো হয়নি। শ্যাষে অই ডাক্তার দেখিয়্যা এ্যাখুন ভালো আছে।
   — ক’ব্যার দ্যাখালচো?
   — বেশি ব্যার দ্যাখাইনি; মুটে তিন ব্যার।
   — ডাক্তারের নাম কী বুলো! বাপকে না হয় অই ডাক্তারের কাছে আমিও দ্যাখাবো।
   — ডাঃ দেবাঞ্জন সরকার। দ্যাখাও ভালো হইয়্যা যাবে।
   — পুরুষ? না মহিলা?
   — নাম শুনে বুসতে পারো না, পুরুষ!
   — ডাক্তার কুণ্ঠে বসে?
   — বহরমপুর রানিবাগানে আশালতা ফার্মেসিতে।
   — হাসপাতালের ডাক্তার?
   — হ্যাঁ।
   — কুন হাসপাতালের?
   — বহরমপুরে তো এ্যাখুন এ্যাকটাই হাসপাতাল। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ।
   — ফি কতো?
   — ছ’শো টাকা। তা-ও আবা নাম লিখিয়্যা দিনের দিন পাবা না। আগের দিন সকাল সাতটার মধ্যে নাম লিখাতে হবে। সাতটা পার হইয়্যা গ্যালে আর নাম লিখান্যা হবে না। আবা তার পরেরদিন। তিরিশট্যার বেশি রুগী দ্যাখে না। হাসপাতালে রুগী দেকতে যাওয়ার আগে পুনোরোডা, হাসপাতাল থেক্যা রুগী দেখ্যা আস্যা পুনোরোডা। মুট তিরিশট্যা রুগী দ্যাখে।
  — ঠিকাছে; নাম লিখান্যা ফোন নম্বরডা দ্যাও! কাল সকাল সাতটার মধ্যেই আমি ফোন করবো।
   — কিন্তুক ফোনে নাম লিখে না যে! তাহালে ফোন নম্বর লিইয়্যা তুমি কী করব্যা? ওখ্যানে যাইয়্যা নাম লিখাতে হবে। অগ্রিম টাকা জমা লিইয়্যা তারপর কাড দিবে। অই কাডেই নম্বর এবং কুন সুমায় যাত্যে হবে সব লিখা থাকবে। মুখেও বুলে দিবে।
   — তাহালেই তো হলো মুশকিল! এই জাড়ে অতো ভোরে উঠবো কী করে?
   — ক্যানে, বহরমপুরে তুমাহের কুনু আত্মীয় বা পরিচিত কেহু নাই? থাকলে না হয় তাখে বুলে—
   — কেহু নাই। আমাহের মুতন হকার মানুষের বহরমপুরের মুতন শহরে কেহু থাকে?
   — তাহালে এই জাড়েই তুমাকে— কিছু করার নাই। নবিপুর থেক্যা ভোর চাট্ট্যায় এ্যাকটা বাস ছাড়ে। অই বাসডা ধরতে পারলে তুমি সকাল ছ’টার মধ্যে বহরমপুর পোঁহুচ্যা যাব্যা। তারপর নাম লিখিয়্যা দিইয়্যা কাড লিইয়্যা— আমি তো তাই-ই করতুক।
   — পরপর দু-দিন কামহাই!
   — শহরের নাম করা ভালো ডাক্তার দ্যাখাতে গ্যালে কামহাই তো হতেই হবে। কিছু করার নাই।
   — তুমি ভোর কডায় উঠত্যাক?
   — আমি ভোর তিনড্যায় উঠতুক। উঠে হাগামুতা করে বাড়ি থেক্যা তিনড্যা কুড়িতে বার হতুক। চাড্ড্যা বাজতে পাঁচ-দশ মিনিট বাকি থাকতে নবিপুরে পোঁহুচ্যা যাতুক। তুমাকেও অই সুমায় উঠতে হবে। নাহালে বাসডা ধরতে পারব্যা না। বাসডা ধরতে না পারলে তুমি সঠিক সুমায়ে বহরমপুর পোঁহুচাতে পারব্যা না। কারণ, পরের বাস আবা দু-ঘণ্টা পর।
   — চেম্বার রোজ খুলা থাকে?
   — সপ্তাহে দু-দিন বন্ধ থাকে।
   — কী কী ব্যার?
   — শনিব্যার আর রবিব্যার। আজ রবিব্যার। আজ চেম্বার বন্ধ আছে। কাল থেক্যা আবা খুলা থাকবে।
   — আমি তাহালে আজই বাড়ি যাই নাকি বুলো! বাড়ি যাইয়্যা কাল নাম লিখাতে আসবো।
   — দ্যাখান্যার ইচ্ছ্যা থাকলে যাত্যে পারো। আমি কী বুলবো! বলে কুদ্দুস আর দাঁড়াল না। মাল বেচতে চলে গেল— ও বন্ধু, তুমি শুনতে কি পাও; গাইতে গাইতে। আজিজুল তখন ঘরে ফিরে গা, পা ধুয়ে বাড়ি বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ি পৌঁছে দেখল, তার বাপ সত্যি খুব কঠিন। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। তার মা বাপের বুকে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। লোকে তা দাঁড়িয়ে দেখছে। বাপের এহেন করুণ অবস্থা দেখে আজিজুল আর থামতে পারল না। বাপের পায়ের কাছে ধপ করে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল— আব্বা, ও আব্বা গো! এ্যা কী অসুক তুমার হলো গো! আল্লাহ এ্যা কী অসুক তুমার দিল গো! আব্বা, ও আব্বা গো!
   পরে ভিড় ভাঙলে পরে আজিজুল তার মাকে বলল— ভোর তিনড্যা সুমায় তুমি আমাকে ডাক্যা দিব্যা! বহরমপুরে আব্বার নাম লিখাতে যাবো। এ্যাকটা ভালো ডাক্তারের খোঁজ পাইয়্যাছি। ছ’ শো টাকা ফি। কুলিতে নটিয়ালের আমার এ্যাক বন্ধু থাকে। আমাহের মুতনই শপ, মশারির হকার। খোঁজডা তার কাছেই পাইয়্যাছি। আব্বার যে অসুক অর বাপেরও অই অসুক হইয়্যাছিল। কুনু ডাক্তার দেখিয়্যা সার‍্যাচিল না। শ্যাষে অই ডাক্তার দেখিয়্যা ভালো আছে। আব্বাকে তাই অই ডাক্তারের কাছেই এ্যাকব্যার লিইয়্যা যাবো; কাল নামডা লিখ্যে দিইয়্যা আসি।

                                 ।। দুই ।।

   শুলে যদি ঘুম চলে আসে আর ঘুম চলে এলে যদি ঠিক সময়ে উঠতে না পারে। আজিজুলের মা তাই শুলো না। আজিজুলকে ঘরের ভেতর বিছানা করে দিয়ে বাহির উসরায় বিছানা করে কাঁথার ভেতর সে পা ভরে বসে থাকল। সারা জনপদ যখন নিশুতি আর রাত গভীর হলো তখন সে খানিকক্ষণ পরপর আঙিনায় নেমে ওপরে তাকিয়ে আকাশের তারা দেখল। আকাশের তারা দেখে তার সময় নির্ণয় করা অভ্যাস আছে। তার স্বামী মানে আজিজুলের বাপ যখন জোয়ানকালে চালের ব্যবসা করত তখন আকাশের তারা দেখে রাতে ধান সেদ্ধ করতে উঠত। মাথার ওপর তিন তারা দেখে। মাথার ওপর তিন তারা দেখা মানে মাঝরাত। তারমানে মাঝরাতে উঠে ধান সেদ্ধ করত। আর সকাল হতে হতে এক নাদ ধান সেদ্ধ করে ফেলত। তারপর ওই ধান শুকিয়ে চাল করে বিক্রি করত। হাটের দিন হাটে। হাট যেদিন না থাকত খ্যাতালে বিক্রি করত। বিয়েতে শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া আজিজুলের বাপের একটা র‍্যালি সাইকেল ছিল। ওটাতে চেপে খ্যাতাল করত। তখন চালের ব্যবসা আজকের মতন প্যাকেটের ভেতর ছিল না। এভাবেই খুচরা চাল বিক্রি হতো। গাঁয়ের বেশিরভাগ মানুষই তখন গরিব আর অভাবগ্রস্ত ছিল। এক কেজি, দু-কেজি ও তিন কেজি করে চাল কিনে খেত। পরিবারে যার যেমন লোক। বেশি লোক থাকলে আরও বেশি লাগত। তাদেরও খুব কষ্টের সংসার ছিল। না খাটলে খেতে পেত না। যদিও এখনও সেই কষ্টই রয়েছে। দূর হয়নি। এখনও তারা না খাটলে খেতে পায় না। বাড়ির ভিটা টুকু আর শরীর টুকু ছাড়া যে তাদের আর কিছুই নেই।
   যাহোক, সময় নির্ণয় করার জন্য আজিজুলের মা খানিকক্ষণ পরপর আঙিনায় নেমে আকাশের যে তারা দেখল, সেই তারার নাম তিন তারা। তিন তারা দেখেই তার সময় নির্ণয় করা অভ্যাস আছে। তিন তারা ছাড়া অন্য তারা দেখল না। দেখতে দেখতে একসময় দেখল, তিন তারা মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে খানিক গড়ে গেছে। আর একটু গড়ে গেলেই প্রথম মোরগ বাগ দেওয়ার সময় হবে। প্রথম মোরগ বাগ দেওয়া মানে ফজরের আযানের সময় আসন্ন। রাত তখন আর বেশি বাকি থাকে না। একটু একটু করে ফর্সা হতে শুরু করে। সুতরাং, আজিজুলকে এখনই ডাকতে হবে; আজিজুলের মা তাই ডাকতে শুরু করল— আজিজুল, ও আজিজুল! কিন্তু আজিজুলের ঘুম কিছুতেই ভাঙলো না। সারারাতের ঘুম যেন এখনই তার চোখে নেমে এসেছে। বাধ্য হয়ে আজিজুলের মা ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাকল— আজিজুল, এই আজিজুল!
   আজিজুল নড়ে উঠল— উঁ!
   — বহরমপুরে তুমার বাপের নাম লিখাতে যাবা বুলে! তো উঠো!
   আজিজুল অমনি ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল। বালিশের তলা থেকে মোবাইলটা নিয়ে সুইচ টিপে সময় দেখল, তিনটে বেজে পাঁচ মিনিট। অমনি সে কাছের বাঁশড়া থেকে পায়খানা ফিরে এসে বেরিয়ে পড়ল।

                                ।। তিন।।

   চারটে বাজতে দশ মিনিট বাকি থাকতে আজিজুল নবিপুরে এসে পৌঁছে গেল। তাদের গ্রাম থেকে নবিপুর খুব বেশি দূরে নয়। কাছে। ছোট একটা মাঠ পার হয়ে নবিপুর। আজিজুল হেঁটেই চলে এল। কারণ, অত রাতে টুকটুকি পাওয়া যাবে না। সাইকেল নিয়ে এলেও অসুবিধা। অত রাতে সাইকেল রাখবে কোথায়? অত রাতে কোনও দোকান খোলা থাকে না। বর্ডার এলাকা হিসাবে সারারাত পুলিশি টহলদারি চলে। রাত ন’টার পরে আর সকাল পাঁচটার আগে কোনও দোকান খোলা থাকলে তাকে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হবে। তবে যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়ি নেই। যদি সেগুলোর বৈধ কাগজপত্র থাকে। এই ভয়ে রাতে কেউ দোকান খোলা রাখে না। সবাই বাড়িতে শুয়ে ঘুমায়। যেকারণে আজিজুল পায়ে হেঁটেই চলে এল। হকার মানুষ। হাঁটা প্রচুর অভ্যাস আছে না!
   এসে দেখল, খালাসি বাস ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছে। আর কন্ডাকটর টিকিট হাতে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভার ইঞ্জিন ঠিক আছে কিনা পরখ করে দেখছে। ভেতরে কোনো যাত্রী নেই। সব যাত্রী বাসের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তা প্রায় জনা তিরিশেক হবে। এসব দেখে আজিজুল কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করল— বাস কখুন ছাড়বেন গো! দেরি হবে নাকি?
   কন্ডাকটর বলল— না না, দেরি হবে না। এক্ষুনি ছাড়বো। গাড়িটা ধোওয়া মোছা হলেই ছেড়ে দিব।
   মিনিট সাতেক বাদে গাড়িটা ধোওয়া মোছা হলে কন্ডাকটর বলল— আপনারা সবাই উঠে পড়ুন! এক্ষুনি ছাড়বো।
   সবাই তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল এবং যার যেরকম সিট পছন্দ বসে পড়ল। কিন্তু আজিজুল তখনও নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে কন্ডাকটর তাকে জিজ্ঞেস করল— আপনি যাবেন না? একটু আগে তো—
   আজিজুল বলল— যাবো।
   — যাবেন তো উঠুন! এক্ষুনি বাস ছাড়বো।
   আজিজুল জিজ্ঞেস করল— টিকিট দিবেন না?
   — টিকিট বাসে দিব; এখন উঠুন!
   আজিজুল বাসে উঠে পড়ে কেবিনে বনাটের ওপর চেপে বসল। ভেতরে আরও সিট ফাঁকা থাকলেও সে ভেতরে গেল না। ওখানেই বসল। বসার পর বাসে উঠতে আর কেউ বাকি নেই দেখে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। দেওয়ার পর কুয়াশার চাদরে চারদিক ঢেকে গেল। তিনটে স্টপেজ কুয়াশা ভেঙে কোনও রকমে আসার পর একটা ফাঁকা মাঠ পড়ল। ড্রাইভার তখন কন্ডাকটরকে বলল— এ কী কুয়াশা রে বাব্বা! কিছুই দেখা যায় না।
   কন্ডাকটর বলল— সাবধানে চালাস!
   — সাবধানেই তো চালাচ্ছি। দেখতে পাস না?
   ব্যস, তারপরই একটা পাথর ভর্তি লরির সঙ্গে সামনাসামনি— যে তিনজন লোক মারা গেছে তাদের মধ্যে একজনকে আজিজুলের মতো দেখতে, ঠিক আজিজুলের মতো। ওই রকমই চোখ, ওই রকমই গোঁফ, ওই রকমই সবকিছু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *