তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

ইতিহাসাচার্য ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮ – ১৯৮০)

(বাঙালী জীবনের যে সারস্বত-স্পর্শী পর্ব অনুধ্যান; তাঁর সৌম্য-স্থিত সৃজনধারাবর্তী আলোকময় ব্যক্তি-পুরুষ ঐতিহাসিক আচার্য রমেশ চন্দ্র মজুমদার। ইতিহাস চর্চার মেধাবী এই জাতীয়তাবাদী তেজসম্পন্ন  দৃঢ়-চেতনাবাহী নিরাভরণ মানুষটি তাঁর আত্মজীবনের মনন-সুকৃতিবশে চির  প্রণম্য। প্রাচ্য ইতিহাসের গঠন মূলক ভাষ্য রচনায় আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ  এই ইতিহাসবেত্তার ভারতবিদ্যা সর্ম্পকে  কয়েক কিস্তিতে  আলোচনা করা হবে। এই আলোচনা সর্ম্পকে অনিবার্য  ভাবে এসে পড়বে পন্ডিত নেহেরুর সাথে তাঁর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখন নিয়ে বিরোধের প্রসঙ্গ)

চতুর্থ পর্ব

রমেশ চন্দ্রের আরো একটি মূল্যবান প্রচেষ্টা হলো An Advantage History of India, মূলত সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখিত হলেও গবেষকদের কাছেও এটি ‘ হ্যান্ডবুক ‘ এর মত কাজ করে। সংক্ষেপে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এরকম ইতিহাস ইতিপূর্বে রচিত হয়নি। এই বইয়ের অপর দুজন লেখক হলেন শ্রুতকীর্তি ঐতিহাসিকদ্বয় হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং কালিকিঙ্কর দত্ত। আধুনিক গবেষণাকেও এঁরা যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। সন তারিখের গোলক ধাঁধায় পাঠককে ফেলতে চাননি। ইতিহাসের শুষ্ক কঙ্কালকে এঁরা যেন রক্তমাংসে পরিণত করে পরিশ্রমবিমুখ পাঠকদের বোধগম্য করে তুলেছেন। আর সেই কারণেই গ্রন্থটির এতোটা জনপ্রিয় ও সীমাহীন চাহিদা। আর যেকারণে ইতিহাসের ছাত্র – ছাত্রীদের এ গ্রন্থটি অবশ্য পাঠ্য। রমেশ চন্দ্র ভারত ইতিহাসকে ইউরোপীয় দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি দেখেছেন ভারতীয় আঙ্গীকে, যেখানে তিনি সামগ্রিক ইতিহাস আলোচনার প্রয়াস করেছেন। কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাসকে মুখ্য আলোচনায় না রেখে, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের উপর যথাযথ গুরুত্ব সহকারে আলোকপাত করেছিলেন। ইতিহাস রচনার এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা যায় তাঁর রচনার অসামান্য ও শ্রেষ্ট্র কীর্তি ভারতীয় বিদ্যা ভবন সিরিজের History and Culture of the Indian People – এ।
   একাদশ খন্ডের এই মহাগ্রন্থ ছিল রমেশ চন্দ্রের ‘Magnum opus’. তিনি স্বয়ং বলেছিলেন, ” ইতিহাস চর্চার দিক থেকে এটিই আমার জীবনের সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করি।” এই সুবিশাল গ্রন্থ রচনার একটি ইতিহাস আছে। আচার্য মজুমদারের স্মৃতিকথায় তা লিপিবদ্ধ আছে। ইতিপূর্বে ঢাকা থেকে প্রকাশিত History of Bengal  মুগ্ধ করেছিল ইতিহাস অনুরাগী কে. এম. মুন্সীকে। তাঁর কাছে  উক্ত বইটির স্ট্রাকচার টা খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন এই আঙ্গিকেই ভারতের আনুপার্বিক ইতিহাস লেখা হোক। বোম্বাইতে নব প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বিদ্যা ভবন এর ডিরেক্টর জিন বিজয়ের  প্রস্তাব আচার্য মজুমদারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে যান। এই উপলক্ষ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়, ভারতীয় ইতিহাস সমিতি নামে। এর চেয়ারম্যান মুন্সীজী, ভাইস চেয়ারম্যান জি. ডি. বিড়লা, সদস্য সর্বপল্লি ড. রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ। মুন্সীজীর প্রস্তাবে রাজি হলেও রমেশ চন্দ্র এই মহাগ্রন্থ প্রণয়নে দুটি শর্ত আরোপ করেছিলেন: এক, কোন অধ্যায় কে লিখবেন তা তিনি নিজেই ঠিক করবেন, অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করবেন না। অন্যটি, তিনি সম্পাদনা করে যে বইটি প্রেসে পাঠাবেন, সেখানে তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনো অদল বদল করা যাবে না। যদি কোনো আপত্তিকর কিছু থাকে তা তিনি অবশ্যই বিবেচনা করবেন। তবে তাঁর সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত বজায় থাকবে।
মুন্সীজী দুটি প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যান। এই ইতিহাস রচনার কাজ শুরি হয় ১৯৪৫ সালে, প্রায় তিরিশ বছর লেগেছিল পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে। অনেক লেখক নিজেদের জীবদ্দশায় তাঁদের রচনা দেখে যেতে পারেননি। প্রায় নয় হাজার পৃষ্ঠাব্যপী এই সুবৃহৎ গ্রন্থ সম্পাদনা ও লিখনে যে অসামান্য নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ছিল কল্পনার অতীত। এই সিরিজের খন্ড গুলির শুধু নাম উল্লেখ করলেই পাঠকগণ এর ব্যাপ্তি উপলব্ধি করতে পারবেন:
Vol.I- The Vedic Age ( upto 600 B C.).
Vol.II- The Age of Imperial Unity (600 B.C.-320 A.D.)
Vol.III- The Clasical Age ( 320- 750 A.D.)
Vol.IV- The Age of Imperial Kanaujiya (750-1000 A. D.) Vol.V- The Struggle for Empire (1000- 1300 A.D.)
Vol.VI- The Delhi Sultanate (1300- 1526 A.D.)
Vol.VII- The Mughal Empire (1526- 1707)
Vol.VIII- The Maratha Supremacy (1707- 1818)
Vol.IX- British Paramountcy and Indian Renaissance (1818-1905) Part -1
Vol.X- British Paramountcy and Indian Renaissance (1818- 1905) Part-2
Vol.XI- Struggle for Freedom ( 1905-1947).
অর্থাৎ সভ্যতার আদি পর্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত সমগ্র ভারতের ইতিহাস ও সংষ্কৃতিকে রমেশ চন্দ্র মন্থন করেছিলেন। এই সিরিজের শেষ খন্ড প্রকাশের দিন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “Dr. Majumdar has the correct view about history and the duty of a historian.” আর বহু আগেই প্রথম খন্ড বেরোনোর পরেই The Times Literary Suppliment, London লিখেছিল, “The history unlike its predecessors is first and foremost a history of India and of her people rather a history of those who have from time to time invaded her… The standard, in a word, is very high…”   ( ক্রমশ…)  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *