তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

জাতীয় অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭ – ১৯৪৯)

ভারতবিদ্যাচর্চার এক অন্যতম জ্যোতিষ্ক অথচ বিস্মৃতপ্রায় অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার জন্মেছিলেন মালদহ শহরে ১৮৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর। অসম্ভব মেধাবী বিনয়কুমার ১৯০১ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯০৫ সালে প্রেসিডেন্সী থেকেই ইতিহাস ও ইংরেজীতে দুটি বিষয়েই অনার্স নিয়ে বি. এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এর থেকে বোঝা যায় যে তাঁর মেধার গভীরতা কতখানি!
   তবে এম. এ. পড়া তিনি সে ভাবে করতে পারেন নি কারণ তখন বঙ্গদেশ স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে প্লাবিত। বিনয়কুমার স্বদেশী ব্রতে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। নিম্নবিত্ত পরিবারের অত্যন্ত মেধাবী সন্তান বিনয়কুমার জীবনের সুখ – স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে দেশ সেবার অনিশ্চিত ব্রতে নিজেকে সঁপে দিয়ে ছিলেন। এই সময় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল। এদেরই ছত্রছায়ায় স্থাপিত ন্যাশনাল কলেজে ইংরেজি ও অর্থনীতির অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্বের ইতিহাস ও অর্থনীতিতে লব্ধ জ্ঞান ভান্ডারকে তরুণ প্রজন্মের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন
   সে সময় দেশে শিক্ষামূলক গ্রন্থের যথেষ্ট অভাব ছিল। এই অভাব দূর করতে তিনি গ্রন্থ প্রণয়নে উদ্যোগ নেন। এই সময় তিনি বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে তাঁর ভারতবোধ সংক্রান্ত ভাবনা জারিত হয়েছিল। এই বইগুলি শুধু যে ছাত্রদের উপযোগী ছিল তাই নয়, এই বইগুলিতে আমাদের দেশের প্রাচীন গরিমা, সংস্কৃতির ও সভ্যতার অন্তর্নিহিত মূলদিক গুলি উম্মোচিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একদিকে সমাজ বিজ্ঞানের এবং অন্যদিকে সাহিত্যের ছাত্র, ফলে তাঁর লেখনীর মধ্যে এই দুই ধারার সম্মিলন ঘটেছিল। এই যোগ্যতার প্রসাদ গুণে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে ভারত চর্চার যুক্তিসঙ্গত অথচ সুন্দর ও পরিশীলিত – পরিমার্জিত রূপ আমাদের চোখে ধরা পড়ে। ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, লোক সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি নিরলষ চর্চা করে গেছেন। তাঁর প্রকাশ ঘটেছে Lessons on Sanskrit, History of the English Literature , The Science of History and Hope of Mankind (London, 1912), Introduction to the Science of Education (London, 1913). লন্ডন থেকে প্রকাশিত বই গুলির খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।
   সংস্কৃতে পারদর্শী বিনয়কুমার কিছুদিন এলাহবাদের ‘ পাণিনি কার্যালয় এ ভারতবিদ্যা সংক্রান্ত কাজকর্মের শুক্রাচার্জের ‘ শুক্রনীতি ‘ গ্রন্থের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি আর একটি গ্রন্থ Positive Background of Hindu Sociology  প্রকাশ করে ছিলেন। এর পর তিনি বিশ্ব পরিক্রমায় বের হন। ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি পরিক্রমা করেছিলেন এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তিনি সেখানকার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা অর্জন করেন। সেই অধিত বিদ্যা তিনি ভারত অন্বেষণে ব্যাপৃত করেন। সমৃদ্ধ হয় ভারতবিদ্যাচর্চা। তিনি উদার এবং এক বিশ্বদৃষ্টি নিয়ে মানুষকে নিজের দেশ সর্ম্পকে ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। বিদেশে পর্যটনকালে তিনি রচনা করেন হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর কয়েকটি ভিন্ন ধরণের গ্রন্থ: Love in Hindu Literature, The Folk Elements of Hindu Culture, Hindu Achievements in Exact Science, Hindu Arts: Its Humanism. ভাবা যায় বিশ্ব পর্যটনের পথে বেরিয়ে তিনি এই অসাধারন বইগুলি রচনা করে ফেলেন। সব কটি বইই লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি যখন জার্মানীতে ছিলেন তখন তাঁর সামগ্রিক জ্ঞান এবং ভারতবিদ্যাচর্চায় অবদানের জন্য লাইজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সাম্মানিক Ph.D. ডিগ্রী লাভ করেন।
   তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। বাংলা, ইংরাজি, সংস্কৃত ছাড়া তিনি ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটিলিয়ান ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কেবল জার্মানিতেই জার্মান ভাষায় তিনি বিরাশি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে  আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে তিনি ১৫০ টির ও বেশি বক্তৃতা করেছিলেন সেখানকার বিভিন্ন সারস্বত প্রতিষ্ঠানে। ওই বছরই ২৭ অক্টোবর ওয়াশিংটন এ একটি সভায় ভাষণ প্রদানকালীন সময়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রায় একমাস ডাক্তারদের চেষ্টার পর সব আশা নিরাশ করে দিয়ে ২৪ নভেম্বর তারিখে ভারতবিদ্যাচর্চার এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব বিদেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
    ভাবতে অবাক লাগে কলকাতায় তাঁর নিজের কোনো বাড়ী ছিল না।সারা জীবন ভাড়া বাড়ীতেই কাটিয়ে গেছেন। ছিলনা কোনো জমানো টাকা পয়সা। এমনকি তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর বিদেশী স্ত্রীর এদেশে থাকা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এটা লজ্জার এই গুণী জনের স্ত্রীকে এখনকার সরকার একটু সম্মানজনক মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পারল না। বাধ্য হয়ে তাঁকে চলে যেতে হয় ইউরোপে তাঁর আত্মীয়দের কাছে। আর এখনকার প্রজন্ম বিনয়কুমার সরকারের কাজকর্মের  সঙ্গে পরিচিতি হওয়া তো দূরের কথা! তাঁর নাম টুকু শুনেছে কি ? সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *